শুক্রবার, ২৬ মে, ২০২৩

পুনরুত্থান ~ বিপুল দাস

এক
অনেকগুলো রাশিয়ান শব্দ শিখেছিলাম। দু'চারটে ছোট ছোট বাক্যও বলতে শুরু করেছিলাম। মুখের ভেতরে জিভের ডগায় শব্দগুলো বসিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় আমার শরীরে এক রকম পুলক তৈরি হত। টের পেতাম অজানা একটা সুখ আমার শরীরকে দৃঢ় করে তুলছে। আমাদের বাক্যবিন্যাসে অনভ্যস্ত ওই শব্দগুলো বারে বারে উচ্চারণ করতে আমার ভালো লাগত। স্বীকার করতে লজ্জা নেই – একটু যেন যৌন উত্তেজনাও হত।
রাশিয়ান এক্সপার্টদের হস্টেলের জন্য কারখানার হিসেবনিকেশের দপ্তর ছেড়ে কেয়ার-টেকারের কাজটা আমি করব কিনা জানতে চাইলে উত্তেজনায় প্রথমে আমি কিছুই বলতে পারিনি। আহা, আমার সেই স্বপ্নের দেশের মানুষগুলোকে আমি কত কাছাকাছি পাব। ওদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাব। মাইনিং অ্যান্ড অ্যালায়েড মেশিনারির দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ওরা এই শিল্পনগরীতে এসেছে। এতদিন কারখানায় আসাযাওয়ার পথে ওদের হস্টেলটা দেখতাম। একজন দুজন রাশিয়ানকে দেখতাম। আমার বুকের ভেতরে শিরশির করত। এরা সেই মহান দেশের নাগরিক। আমার স্বপ্নের দেশ। ইউনিয়ান অফ সোভিয়ত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক।
আমাদের পাড়ার শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে সোভিয়েত দেশ পত্রিকা রাখা হত। সোভিয়েত নারীও। আমি লাইব্রেরিয়ান শিশিরকাকুকে বলে আমার মায়ের জন্য পুরনো সোভিয়েত নারী বাড়িতে নিয়ে আসতাম। সেখানে সোয়েটারের ডিজাইন, মহান অক্টোবর বিপ্লবে বীরগতিপ্রাপ্ত শহীদদের মায়ের অবদান, লেবু জারানো, গোলরুটির গল্প থাকত। আস্ত্রাখান টুপি, গালোশ, সামোভার – এসব শব্দ শিখছিলাম। ইভান, পাভেল, ভানিয়া, কাতিয়া – এসব ছিল চরিত্রদের নাম। গোগ্রাসে গিলতাম।
লাইব্রেরিতে সোভিয়েত দেশ খুব একটা কেউ পড়ত না। বরং 'কালনাগিনীর প্রতিহিংসা' কিংবা 'মরণগুহার ভয়ংকর' খোঁজ করেও পাওয়া যেত না। আমার কিন্তু সোভিয়েত দেশ ভালো লাগত। কী মসৃণ ঝকঝকে কাগজ, কী সুন্দর রঙিন ছবি। তখন অন্য কোনও পত্রিকায় রঙিন ছবি প্রায় দেখাই যেত না। নতুন পত্রিকা এলেই আমি প্রথমে পৃষ্ঠা খুলে গন্ধ শুঁকতাম। কাগজ থেকে, অক্ষর থেকে রাশিয়ার বাতাস ফুসফুস ভরে টেনে নিতাম। বুকের ভেতরটা বিশ্বাসে ভরে উঠত। মনে হত আমার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে লেনিনগ্রাদ, মস্কো, বাকু, আজারবাইজান, তাসখন্দের বাতাস। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর ভেতরে শ্রেষ্ঠ দেশ হচ্ছে ইউ এস এস আর। পত্রিকায় এক একজন লেখকের নাম খুঁজে পাই, লাইব্রেরি থেকে তাদের বই খুঁজে নিয়ে পড়ি। বাংলায় অনুবাদ। তুর্গেনিভ, গোগোল, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি। নিকোলাই অস্ত্রয়েভস্কির 'ইস্পাত' পড়ে তো দু'রাত ঘুমই হল না। আমারও ইচ্ছে করত মাতৃভূমি না বলে আমাদের দেশকে পিতৃভূমি বলে ডাকতে। সেই লেনিনগ্রাদ থেকে ভারখায়ানস্ক – পৃথিবীর আদ্ধেকটা জুড়ে তো ওরাই রয়েছে। যুদ্ধ হলে শুধু একটা বোতাম টিপবে, আমেরিকা ফিনিশ।
এম এ এম সিতে আমি পাঁচ বছর চাকরি করেছিলাম। তখন সেই শিল্পনগরীতে যারা এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত, তাদের এক ধরণের কুলীনকুলসর্বস্বতা ছিল। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারণ করার সময় কন্ঠ থেকে ঝরে পড়ত নিয়ন্ত্রিত আভিজাত্য। অন্যান্য সেক্টরের মানুষদের চোখে স্পষ্টই টের পেতাম সম্ভ্রম, ঈর্ষা, হয়তো বেদনাও। ঘাড়ের রোঁয়া ফুলে উঠত আমার। ভাগ্যিস চাকরিটা এখানেই পেয়েছিলাম। রিজিওন্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তখনও এন আই টি হয়নি। এত প্রাইভেট কলেজ ছিল না। কোপার্নিকাস মার্গের কোয়ার্টারে মাকে নিয়ে থাকি। মামড়া মোড়ের ও দিকটায় শালের জঙ্গল। কম্যুনিটি হলে পথের পাঁচালি, পঁচিশে বৈশাখে ডাকঘর। জি টি রোডে ডিভিসি মোড়ের কাছে ঘন অরণ্য। পুরনো কোনও মন্দিরের গল্প একদিন কলিগের মুখে শুনলাম। বললাম – চল নিয়োগী, একদিন দেখে আসি। চারু নিয়োগী আমাকে ডাকাতের ভয় দেখাল।
লোহা এবং ইস্পাত শিল্পের জন্য দুর্গাপুর ছিল আদর্শ জায়গা। শ্রমিক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আকরিক, জ্বালানি – এ সবই ছিল সমাধানযোগ্য। এই বিশাল কর্মকান্ড অনবরত সচল রাখার জন্য চাই নিরবচ্ছিন্ন কাঁচামাল আর জ্বলানির সরবরাহ। আকরিক সংগ্রহের জন্য চাই আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। মাইনিং-এর স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকাঠামো ছিল আমাদের। যন্ত্রপাতি বানানো, সারানো এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে রাশিয়ান ইঞ্জিনিয়াররা আমাদের কারখানায় এসেছিল। তখন নতুন ভারত গড়ার লক্ষ্যে বন্ধুত্বের হাত সবার আগে বাড়িয়ে দিয়েছিল যে দেশ, তার নাম সোভিয়েত রাশিয়া। ওদের দেখলেই আমার শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের কথা মনে পড়ত। সোভিয়েত দেশ পত্রিকা, পুশকিনের কবিতা, গোগোলের 'ওভারকোট' গল্পের কথা। রাতের আকাশে তাকালে চাঁদ কিংবা তারা নয়, আমার মনে পড়ত গাগারিনের নাম। যেদিন এক্সপার্ট হস্টেলে ওদের দেখাশোনার দায়িত্ব পেলাম, মনে হল আমিও বোধহয় পৃথিবীর টান অগ্রাহ্য করে মুক্তিবেগ অর্জন করেছি।
মাত্র দু'বছর ছিলাম হস্টেল তদারকিতে। অনেকগুলো রাশিয়ান শব্দ শিখেছিলাম। বচন এবং কালভেদে ক্রিয়াপদের তারতম্য বুঝতে শুরু করেছিলাম। ছোট ছোট বাক্য বলতে পারি। হসন্ত এবং ৎ-প্রধান ওদের শব্দগুলো নিয়ে মুখের ভেতরে নাড়াচাড়া করার সময় এক রকম বিশ্বাস ও সুখমেশানো লালায় শব্দগুলো পিচ্ছিল হতে থাকে। শব্দগুলো গিলে ফেলি। শব্দগুলো আমি হজম করতে চাই। শরীরে রক্তের সঙ্গে মিশে যাক আ বে ভে গে দে। বর্ণমালার অক্ষরসমূহ। বিশ্বকর্মানগরে কী দুরন্ত কর্মকান্ড চলে দিনরাত। ওদিকে স্টিল প্ল্যান্টের কাজ, এদিকে মাইনিং-এর উপযোগী, সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি। আরও উন্নত যন্ত্র তৈরির নকশা, তৈরি যন্ত্রের পরীক্ষা, রক্ষণাবেক্ষণ, সেগুলো চালানোর ট্রেনিং। সে এক দুরন্ত সময়। সমস্ত ভারতবর্ষের নজর আমাদের এই শিল্পনগরীর দিকে। আশপাশের কোলিয়ারি থেকে রোজ টন টন কয়লা ঢুকছে। রাতে ফার্নেসের আলো দেখা যায় কতদূর থেকে। আকাশ আগুনের আভায় হলদে হয়ে থাকে। লোহা গলে তরল আগুন হয়ে গড়িয়ে যায় লাভাস্রোতের মত।
আমাদের ব্যাপার আলাদা। কী সুন্দর আমাদের কারখানা, অফিস-বিল্ডিং। অফিসের চারপাশে কী চমৎকার ফুলের বেড। দেখাশনা করার জন্য মালী রয়েছে। সারা বছর ওরা ফুল ফোটায়। অফিসের বাইরে কী অসাধারণ নক্‌শা করা আমাদের কর্পোরেশনের মনোগ্রাম। কী দারুণ ক্যালেন্ডার হয় আমাদের। এম এ এম সি'র ক্যালেন্ডারের জন্য সবাই হামলে পড়ে। কারও ঘরের দেয়ালে আমাদের ক্যালেন্ডারের শোভা যেন তার টুপিতে আরও একটা পালক গুঁজে দেয়। আমি বাঁকুড়ার সোনামুখীর ছেলে, এখানকার গরম গায়েই লাগত না। কোপার্নিকাস মার্গ থেকে এসে অফিসে ঢোকার সময় ওই প্রতীক চিহ্নের দিকে তাকালে বুকের ভেতরেও যেন ওই রকম একটা খাঁজকাটা চাকা ঘুরত। চাকা বয়ে আনত সুসময়ের বাতাস, চারদিকে সুলক্ষণ দেখতে পেতাম। সন্ধেবেলা ফার্নেসের-আভায়-উজ্জ্বল আকাশের দিকে তাকালে মনে হত স্বয়ং বিশ্বকর্মার মুকুট থেকে দিব্যজ্যোতির প্রকাশ যেন ওই আলোকবিভা। হঠাৎ মনে পড়ত দারোফা মানে পথ, কাক ভাস্‌ জাবুৎ মানে তোমার নাম কী।
আমার পলিটেকনিক ডিগ্রির সুবাদে একটা সরকারি চাকরির ইন্টারভিউ-এ ডাক পেয়েছিলাম। বেশ উঁচু পদ ছিল সেটা। সেখানেও, হয়তো এই এম এ এম সি'র অভিজ্ঞতাবাবদ ভালো নম্বর যোগ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইন্টারভিউ বোর্ডের তিনজনই বোধহয় অবাক হয়েছিল আমাকে এখানে দেখে। চাকরিটা পেলে আমি করব কি না – ওরা জানতে চেয়েছিল। আমার কোনও উপায় ছিল না। আমার বিধবা মায়ের চোখের জল, দধিমুখ্যা গ্রাম থেকে আমার গার্জিয়ান মেজোকাকার সংশয় ও সতর্কবার্তা এবং সরকারি চাকরির দিকে মধ্যবিত্ত মানসিকতাজাত বিশ্বাস – দারোফা, পুশকিন, গাগারিন, আমাদের কর্পোরেশনের সেই বিখ্যাত প্রতীকচিহ্ন থেকে আমাকে উপড়ে নিল। আমি রাতে লুকিয়ে কাঁদলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে হাসি হাসি মুখে বলেছিলাম – উইথ প্লেজার, স্যার। তখনই মনে পড়েছিল ডিজাইনের দিমিত্রিভ বলেছিল আমাকে একটা ইংলিশ টু রাশিয়ান ডিকশনারি উপহার দেবে। ইন্টারপ্রেটর শেভচেঙ্কোর বউ একদিন প্রচুর মদ খেয়ে আমার গলা জড়িয়ে বলেছিল – মিশ্‌রা, ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু। আমি বোকা বোকা মুখে শেভচেঙ্কোর দিকে তাকালে সে আমাকে চোখ টিপে বলেছিল এই বাক্যের অর্থ আমাকেই বুঝে নিতে হবে।
দুই
আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি পেটমোটা ব্রাউন পেপারের বড় এনভেলাপের ভেতরে অত টাকা রয়েছে। আমি তখন শিলিগুড়ির ডিভিশনাল অফিসে। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রশাসক হিসেবে ডিভিশনে তো বটেই, মহাকরণে আমার দপ্তরের মন্ত্রীর সুনজরে আছি – এ রকম খবর আমার কাছে ছিল। মন্ত্রীর খাস লোক – এই প্রচারে আমার লাজুক হাসির একটা সস্নেহ প্রশ্রয় ও সম্মতি ছিল। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন নিয়ে আমি অফিসে ওয়ার্ক-অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, ওদিকে চুনোপুটি থেকে রাঘববোয়াল ঠিকাদারদের কন্ট্রোলে রাখছিলাম।
ফাইল সই করতে করতে হঠাৎ কোনও দিন জানালা দিয়ে বাইরের লাল কৃষ্ণচূড়ায় ভরে থাকা গাছের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে শিশিরকাকুর কথা। ইস্পাত, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্রাদার্স কারামাজভ, ওভারকোট, অক্টোবর বিপ্লব, সোভিয়েত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে মনে হয় তা হলে আমেরিকাই জিতল। ভেঙে গেল শক্তির সমূহ ঐক্য। পেরেস্ত্রৈকা ... গর্বাচেভের সময় থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। মুক্ত বাতাস ছুটে এল। আগল খুলে দিতেই ভেঙে পড়ল সোভিয়েত।
বাড়িতে আমার টেবিলের ওপর থেকে ব্রাউন খাম নিয়ে সেটার মোটা পেটের ওপর অনীতা তীক্ষ্ণ নখ বসিয়ে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল। নোটের বান্ডিল নিয়ে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠল আমার বউ। অনীতার তীক্ষ্ণ নখ বসে যাচ্ছিল আমার মুখোশের ওপর। কতদূর বুঝতে পারে মূর্খ মেয়েছেলে। অনীতা কি জানে সোভিয়েত দেশের সেই পৃষ্ঠাগুলোর গন্ধ এখনও আমার নাকে আসে। অনীতা কি জানে সোভিয়েত ভেঙে গেলে আমি ভিখারি হয়ে গেছি। মুক্ত হাওয়ায় রতনবাহাদুর মোক্তান, লাল্টু প্রামানিক আমাকে ব্রাউন খাম দিয়ে বলে – স্যার, এটা ব্যাগে রেখে দিন। বাড়িতে গিয়ে খুলবেন। রতনবাহাদুর কার্শিয়াং-এ ডাওহিলে আমার মেয়ের ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লাল্টু প্রামানিকের ইন্ডিকায় হলং ঘুরে এলাম। হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল-সাফারি। লাল্টু পিঠটাকে কেন্নোর মত গোল করে বলে আমার মত অফিসার বাপের জন্মে দ্যাখেনি। হাঃ, মুক্ত হাওয়া।
দুর্গাপুরে অফিস ট্যুরে গিয়ে দেখলাম শহরটা কত পালটে গেছে। ডিভিসি মোড়ের সেই শালের জঙ্গল উধাও। সিটি সেন্টার ঝলমল করছে। একটু এগোলেই কোনও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এটা এখন শিল্পনগরী, না কি কোনও শিক্ষাচর্চার পীঠস্থান – গোলমাল হয়ে যায়। ড্রাইভারকে এম এ এম সি'র কথা বললে মনে হল যেন বিভ্রান্ত। কোনও এক ট্যুরিস্ট যেন নেই-এক-দুর্গের কথা জানতে চেয়েছে ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে। খবরের কাগজে মাঝে মাঝে দেখতাম এম এ এম সি'র অবস্থা খুব খারাপ। দুর্গাপুরে পৌঁছে প্রথমেই মনে পড়েছিল আমার পুরনো কোম্পানির সেই প্রতীক চিহ্নের কথা। একটা দাঁতওয়ালা চাকা, যেটা ঘুরলেই ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে ম্যাগনেটাইট, হেমাটাইট। যৌগ ভেঙে যেতে থাকে। পুড়তে পুড়তে তার আসল রসটুকু শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে স্রোতের মত বইতে থাকে। ইস্পাতনগরীর আকাশ স্বর্ণাভ হয়ে ওঠে। মাটির সাত পরত নীচে লুকিয়ে থাকা সেই ঐশ্বর্যের সম্ভার তো আমরাই স্রোতধারায় বইয়ে এনেছি মাটির পৃথিবীতে। আমাদের কোম্পানি ছিল যজ্ঞের পুরোহিত। লৌহ-সভ্যতার ভগীরথ। ড্রাইভারকে হেসে পথ বলে দিতেই সে ম্লান হাসল।
গোটা কতক ফুলগাছ এখনও কোনও মতে বেঁচে আছে। মরতে মরতে এখনও ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে চলেছে। আমার মনে হল দুটো শ্মশানচাঁপা ফুটে আছে। যা ছিল অমরাবতী, এখন যেন প্রেতলোক। জীবনের সাড়া নেই কোথাও। কোথায় গেল প্রাণস্পন্দনে মুখর আমাদের সেই ক্যান্টিনের কোলাহল। কোথায় গেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, এস্টাব্‌লিশ্‌মেন্টের লোকজন, প্ল্যান্টের লোকজন। মৃতদের শহরে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
অফিসে ঢোকার মুখে ডানদিকের দেয়ালে সেই বিখ্যাত প্রতীক চিহ্ন কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। কেমন করে মাটির নীচ থেকে উঠে আসবে গাঢ় ধূসর ম্যাগনেটাইট, উজ্জ্বল হলুদ হেমাটাইট, কোন যন্ত্রে আরও নিখুঁত, আরও বেশি করে, আরও কম পরিশ্রমে, কম খরচে মাইনিং-এর কাজ হবে – সেই সব যন্ত্রশিল্পীরা আজ কোথায় হারিয়ে গেল।
খাঁজকাটা চাকাটার দিকে তাকিয়ে আমার হঠাৎ নিজেকে মনে হল চেকভের সেই 'একজন কেরানির মৃত্যু' গল্পের কেরানি। মনে হল কমিউন মিথ্যে, পিতৃভূমির লড়াই-এ লালফৌজের বীরত্বের গল্প মিথ্যে। আমার ছেলেবেলায় সোভিয়েত দেশ নামে কোনও পত্রিকা ছিল না। কোনও দিন কোনও এক্সপার্ট এসে আমাদের শেখায়নি কোন অস্ত্র দিয়ে, কেমন করে খুঁড়ে আনতে হয় আকরিক লোহা। থেমে গেছে খাঁজকাটা দাঁতওয়ালা চাকা। পেটমোটা বাদামি খাম উড়ছে পৃথিবীজুড়ে। ভেঙে পড়ছে শক্তির সমূহ ঐক্য।
দুজন সিকিওরিটির লোক গেটের সামনে পাহারা দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। বুঝতে পারলাম, এখনও যে সব সামান্য কল-কব্জা অবশিষ্ট আছে, ওরা সেগুলো পাহারা দিচ্ছে।
খুব সামান্য সময়ের জন্য এই ঘোরের ভেতরে আমি ছিলাম। তার পরই আবার আমার গদিওয়ালা নরম চেয়ারে ফিরে এলাম। দক্ষ প্রশাসক, একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার প্রভাত মিশ্র। সেবার ভূমিকম্পের পর মহাকরণে আমাদের মন্ত্রী জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। মিটিং-এর শেষে মন্ত্রী একবার আমার কাঁধে স্নেহের হাত রেখে কথা বলেছিলেন। পটাপট ছবি উঠেছিল। সেই ছবির দৌলতে আমার বাড়বাড়ন্ত। এসব গল্প খুব দ্রুত ডালপালা ছড়ায়। আমাদের দপ্তরের সচিব পর্যন্ত ফোন করে আমার সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর নিত। মন্ত্রীমশাই আদতে বাঁকুড়ার লোক হওয়ায় এমন জনশ্রুতিও প্রচার পায় যে, তিনি আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি স্মিতমুখে তার দিকে তাকাই।
তিন
রিটায়ারমেন্টের পর আমার শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। কেমন যেন জবুথবু টাইপের হয়ে পড়ছিলাম। আগের সেই কাজকর্মের ব্যস্ততা নেই, তবু অসম্ভব ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে। আমার বউ অনীতা খুব স্বাস্থ্য সচেতন। দিব্যি টাইট রেখেছে তার ফিগার। পুরুষ মানুষের শরীর, অন্তর্জলীতে না যাওয়া পর্যন্ত কামনাবাসনার শেষ হতে চায় না। অথচ আমার শরীর যেন শীতঘুমে যাওয়া এক কুন্ডলীপাকানো সাপ। অনীতা অবশ্য আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট। তা হলেও তো পঞ্চাশ হল প্রায়। কিন্তু অনীতা সাজতে জানে। নিয়মিত জিমে যাওয়ার ফলে তার শরীরের গ্রন্থি ও পেশির ঔদ্ধত্য অমলিন। শরীরের খিদে ভালো। কিন্তু আমার আজকাল শুধু ঘুম পায়। শরীরজুড়ে অবসাদ। অনীতা দারুণ সেজে শপিং-এ যায়। আমি ওর সামনে পেছনে ক্লিভেজ দেখি, তবু ঘুম পায়। রাত একটু ঘন হয়ে এলে ব্যালকনির বেতের চেয়ারে বসে সোডা মিশিয়ে হুইস্কির গ্লাসে আস্তে আস্তে চুমুক দিই। এ অভ্যাস আমাকে ধরিয়েছিল কালিম্পং-এর ঠিকাদার যোশেফ মোক্তান। তার সুবাদেই স্কচের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে সাঁতার কেটেছি। এখন আর অতটা পারি না। দেশি মতেই আচমন সারি। কলকাতায় হাইল্যান্ড পার্কে একটা, শিলিগুড়ির উত্তরায়ণে একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখেছি। আরও পারতাম, ভিজিলেন্সের ভয়ে পারিনি। মন্ত্রীমশাইয়ের কি আর আমার কাঁধে হাত রাখার কথা মনে আছে।
দেখেছ, সাপটা কেমন ফোঁস করে উঠল।
বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিলাম, বিজ্ঞাপনটা দেখাতেই আমার দিকে তাকিয়ে অনীতা হেসে বলল। অপমানের এক রকম ঘন ছায়া বিছানায় ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ শীত করে উঠল আমার।
কী ভাবে যে এসব বিজ্ঞাপন দেখায়। বাড়িতে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে থাকলে বাবামায়ের সামনে ... কী রকম অস্বস্তিকর বলো।
আজকালকার জেনারেশন অনেক অ্যাডভানসড্‌। এসব ওদের কাছে জলভাত। স্কুলের সিলেবাসে পর্যন্ত সেক্স এডুকেশন এসে গেছে।
ঠিকই বলেছ। আমাদের তিতলি, তোমার হয়তো মনে নেই, টিভিতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপন দেখালে চট করে চ্যানেল পালটে দিত। আমরাই কিছু বুঝতাম না। সে রকম বাজে ছেলের পাল্লায় পড়লে সর্বনাশ হয়ে যেত।
একটু বাদেই বিজ্ঞাপনটা আবার ফিরে এল। এটা আজকাল খুব দেখাচ্ছে। এক ফোঁটা তেলের স্পর্শে কুঁকড়েমুকড়ে থাকা সাপ কেমন ভয়ংকরভাবে ফোঁস করে উঠছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনীতা মুখে ক্রিম ঘষছে। স্বচ্ছ নাইটির ভেতর দিয়ে অনীতার বাট-ক্লিভেজ স্পষ্ট বোঝা যায়। আয়নার ভেতরে ফ্রন্ট-ক্লিভেজ। পাশ ফিরে শুয়ে এক মিনিটের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমনোর আগে শুধু মনে করার চেষ্টা করেছিলাম আয়নায় অনীতার ঠোঁটের পাশে কি মৃদু ভেঙে যাওয়া রেখা ছিল। থাক, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
রিটায়ার্ড ফৌজি অফিসার রামজি বসাকের সঙ্গে আমার আলাপ ভোরবেলা মাঠে দৌড়তে গিয়ে। নীল ট্র্যাকস্যুট, নাইকের সাদা স্পোর্টস শু, পেল্লায় মোচ – ভদ্রলোক মাঠের পাশে বকুলতলায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসেছিলেন। আমি একপাক হালকা পায়ে দৌড়ে এসে গরমকালের কুকুরের মত জিভ বার করে হাঁপাচ্ছিলাম। ব্রিদিং একটু নর্মাল হলে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন।
কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা বলব ?
বলুন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখলাম। এই কমপ্লেক্সে বোধহয় নতুন এসেছে। এর আগে দেখিনি।
আপনি জগিং করবেন না। যাতে ঘাম ঝরে, এভাবে একটু জোর কদমে হাঁটুন। আমাদের মত উমরের লোকদের জগিং করা ঠিক হবে না।
আপনি ...
আমি রামজি বসাক। এ সিক্স। ছেলের কাছে এসেছি। ফৌজিতে ছিলাম। কার্গিল অপারেশনে ছিলাম। অ্যাকচুয়ালি রামগোপাল বসাক, ব্যারাকে সবাই রামজি বলে ডাকত। একটু পুণ্য করে নিত।
আমি প্রথমে নমস্কার করতে গিয়েছিলাম। লোকটা তার হাত বাড়ালে আমি আধা নমস্কার আধা হ্যান্ডশেক করলাম। তারপর থেকে রামজির সঙ্গে আমার খুব জমে গেল। যুদ্ধের গল্প, ডিফেন্স-এ পুকুরচুরির গল্প, সিনিয়ার জুনিয়ারদের ভেতরে প্রায় ব্রাহ্মণ শূদ্রের মত আচারব্যবহার, সিনিয়ার অফিসারদের বউ-এর সঙ্গে জুনিয়ার অফিসারদের ফষ্টিনষ্টি। ফৌজিদের লাইফ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। লোকটা জমিয়ে গল্প বলতে পারত। আর, আদিরসঘেঁষা রসিকতাগুলো বলার সময় তার আহ্লাদ যেন উপচে পড়ত। দেশের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল বাহিনিতেও এ রকম দুর্নীতি হয় জেনে আমার ভেতরটা বেশ স্নিগ্ধ হয়ে উঠত।
এ ভাবেই একদিন এসে পড়েছিল কামশীতল নারী ও অক্ষম পুরুষদের গল্প। এসেছিল চিনদেশের মানুষদের বিশ্বাস, ভায়াগ্রা, বাঘের চর্বি-গলানো তেল, পরিপূর্ণ সুখলাভের তরিকা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। রামজি তখন আমাকে মিশিরজি বলে ডাকত – বলেছিল নিয়মিত যৌনতা ও পরিমিত মদ্যপানই দীর্ঘজীবন সুস্থ থাকার রহস্য। শরীর ও মন ফিট রাখার গুপ্তকথা। কিন্তু সে আমাকে দু'হাতের আঙুল দিয়ে মৈথুন-মুদ্রা দেখিয়ে বলেছিল নিয়মিত যৌনতা বলতে শুধু সেটা নয়, সব মিলিয়ে বেঁচে থাকার ভেতরে যেন সেটা থাকে। ওটাই আসল ভাইটাল ফোর্স।
রামজি বোধহয় আমার দৈন্যদশা টের পেয়েছিল। শীতঘুমে চলে যাওয়া আমার এই শরীর, আমার আড়ষ্টতা নিশ্চয় সে বুঝতে পেরেছিল। ক্যান্টনমেন্টে কর্নেল চৌধুরির বউ-এর সঙ্গে জুনিয়ার অফিসার রাঠোরের এক বিছানায় রাত্রিযাপন, রাজাবাদশাদের অনন্ত ভোগবাসনা, সুবেদার মেজর দীপক কাপুরের সমকামিতা – এসব গল্প বলে সে নিশ্চয় আমাকে জাগাতে চাইত।
তারপর রামজি একদিন আমাকে এক ফোঁটা ম্যাজিক তেলের কথা বলল। ঘুমিয়ে থাকা সাপ কেমন ফোঁস করে ওঠে। পরিপূর্ণ বিষের থলি নিয়ে ছোবল মারবে বলে কেমন তার চমৎকার উত্থান হয়। আমি তো জানি, টিভিতে রোজ যখন বিজ্ঞাপন দেখায়, অনীতা না থাকলে আমি সাপটাকে ভালো করে দেখি। ওর চলন, ওর গ্রেস, ওর ফণা তোলার ভঙ্গি – সব লক্ষ করি। চুপ করে রইলাম। রামজি বোধহয় সেটাই সম্মতির লক্ষণ ভেবেছিল। পরদিন সন্ধেবেলা পার্কের বেঞ্চে বসে রামজি আমার হাতে প্যাকেটসহ একটা শিশি দিল।
ভিতরে লিট্রেচার আছে। ভাল করে পড়ে ইউজ করবেন। কাল আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এসে আপনার স্টোরি শুনব।
কোথায় যাচ্ছেন ?
আমার ছেলে তো শিল্পনিগমের বড়া অফসার। দুর্গাপুরে ওদের একটা মিটিং আছে। আমিও যাব। আমার ছোটভাই থাকে। সি এম ই আর আই-এর ইঞ্জিনিয়ার। দেখা করে আসব।
কীসের মিটিং ?
দুর্গাপুর শুনেই আমার বুকের ভেতরে কেমন খলবল করে উঠল। যেন পচা ডোবায় বর্ষার নতুন জল পড়েছে। কইমাছগুলো লাফাচ্ছে।
পুরানা একটা বন্ধ কারখানা, এম এ এম সি -- আবার খুলবে। কথাবার্তা চলছিল। ফাইন্যাল পলিসি, কুছ কন্ডিশন – এসব নিয়েই মিটিং। ছেলে বলছিল।
রামজির হাত থেকে তেলের শিশিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম। অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে ম্যাজিক তেলের শিশি। আমার শরীরের সমস্ত পেশিজুড়ে মোচড় দিচ্ছে খরিস, চিতি, ময়াল। আমি এঁকেবেঁকে ছুটছি বাড়ির দিকে। রামগোপাল বসাক নিশ্চয় অবাক হয়ে পেছন থেকে আমাকে দেখছে। ও কি করে জানবে আমার গুপ্তকথা, পুনরুত্থানের রহস্য। ও তো সোভিয়েত দেশ পড়েনি, ননী ভৌমিকের নামও শোনেনি। আমার বুকের ভেতরে একটা খাঁজকাটা দাঁতওয়ালা চাকা ঘুরতে শুরু করেছে।
অনীতা রান্নাঘরে ছিল। আমি ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রান্নাঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিলাম। চাকাটা ঘুরছে। এখন মাইনিং শুরু হবে। অনীতার শরীরের সাত পরত নীচে যাব বলে আমি ওকে দুরন্ত বিদ্ধ করেছি। এখন গভীর থেকে উঠে আসবে ম্যাগনেটাইট, হেমাটাইট। এখন লাভাস্রোত বইবে। অসম্ভব সুখে শীৎকার করে উঠছে মাটি। ফণা দুলিয়ে বিষ ঢালতে ঢালতে আমি হয়তো বলতে চেয়েছিলাম – আই লাভ ইউ অনীতা, কিন্তু হিসহিস করে আমি বলতে থাকি – ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু, ইয়া তেব্যা ল্যুভল্যু ...
এ সবই হল রাশিয়ান কলকব্‌জার কেরামতি। এর কাছে কোথায় লাগে জাপানী তেল।

মায়ের কিঙ্করদা ~ উর্বী মুখোপাধ্যায়

মায়ের সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে চাপতে বড় ভালো লাগত। চালকের আসনে বসা মাকে ঘিরে এক প্রবল বিস্ময়বোধ তৈরি হত। মায়ের অনায়াস ভঙ্গিতে যৌথ পরিবারের বিরাট হেসেলে রান্না করা, রান্না করতে করতে নির্ভুল সুরে গান করা, সারা দিনের শেষে রাতের বেলা পিঠে অসংখ্য মশার কামড় সহ্য করেও হঠাত হঠাত ছবি আঁকার ধুম, অথবা দম বন্ধ করা গরমে হঠাতই ফ্যান নিভিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় বাটিক করা সবই মুগ্ধ করত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ করত ছুটিতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে খোয়াই এর উঁচু নিচু অগ্রাহ্য করে সাইকেলের পিছনে আমাকে নিয়ে ঘোরা। মাকে মনে হত শিশু পুত্র পিঠে নিয়ে রনাঙ্গণে সাক্ষাত লক্ষ্মীবাঈ। আর যেতামও তো নানান অভিযানে। মা সাইকেল চালাতে চালাতে তার পুরো দস্তুর শহুরে মেয়েটাকে চেনাতো মুচকুন্দ ফুলের গন্ধ, বনপুলকের ঝোপ, চেনাত তক্ষকের ডাক, লালমাটির প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা তাল গাছের সারি আর নিয়ে যেত সব আজব লোকের বাড়িতে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মায়ের মাস্টারমশাই। মনে আছে একবার গৌরীদি (গৌরী ভঞ্জ, নন্দলাল বসুর মেয়ে)র বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি ব্যস্ত হয়ে হরতকি ফুটিয়ে রং বের করছেন, যেতাম সোমনাথ হোরের বাড়ি বা স্টুডিওতেও। সেখানে ছড়ানো কাগজে কত ছাগলের স্কেচ। এভাবেই যেতাম দিনকর কৌশিকের বাড়ি, অনেক কাল বাদে জেনেছিলাম তিনি বাঙালি নন। তবে মায়ের আরেক মাস্টারের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে অনেকেই আপত্তি করতেন, বলতেন, বাচ্চাটাকে নিয়ে যাস না। কিন্তু আমি বুঝতাম না কেন এত আপত্তি। তাঁকে দেখতে ছিল ঘুব সাদামাটা, গালে না-কাটা দাড়ি, খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকতেন। তিনি রামকিঙ্কর। মায়েরা ডাকতেন কিঙ্কর দা। তাঁর করা মুর্তি দেখতাম শান্তিনিকেতন জুড়ে, কলের ডাক, হাটুরে। আমার সব থেকে ভালো লাগত ইউক্যালিপ্টাসের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ দেহী সুজাতাকে।
তাঁর বাড়ি যখন যেতাম, তখন সন্দেহ হত, ইনিই কি সেই শিল্পী? ঘরটা মায়ের অন্যান্য মাস্টারমশাইদের বাড়ি থেকে যেন কিছুটা বেশি নোংরা থাকত। তার মাঝেই বসে থাকতেন বৃদ্ধ কিঙ্করদা। বাড়িতে অনেক বেড়াল ছিল। বেড়ালের গন্ধ উঠত আরো অনেক অপরিচিত গন্ধের সঙ্গে। মা এলেই খুব জোরে 'আয় আয়' বলে হাঁক ছাড়তেন। প্রণাম নিতেন না, জড়িয়ে ধরে বলতেন, 'বাইরে চল, গান গাইবি।' এদিক ওদিক ছড়ানো মাটি পাথরের দাওয়ায় মোড়া পেতে বসতাম আমরা। মা গাইত। যে গানই গাক না কেন মুগ্ধ হয়ে শুনতেন, শেষে বলতেন, 'আর সেইটা? সেইটা গাইবি না?' মা যেন জানত। হেসে গান ধরত, 'বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো'। ঘোর শীত বা গরমেও এই গানটাই শুনতে চাইতেন বারবার। আর গান শেষ হলে আমার দিকে তাকিয়ে প্রতিবারই একটাই গল্প বলতেন- 'তোমার মা জানো, একবার একটা ছবি একেছিল, অগ্নিশিখা ফুলের। তুমি দেখেছ অগ্নিশিখা?' আমি মাথা নাড়তাম। শান্তিনিকেতনে মা এই ফুলটা আর খুঁজে পায়না, তাই আর দেখায়ও নি। কিন্তু যে গল্পটা বলতেন, সে গল্পটা আমার জানা। মা তখন কলাভবনে সবে মাত্র ঢুকেছে। নেচার স্টাডির ক্লাসে দেওয়া হয়েছে ফ্লাওয়ার স্টাডি। মার ফ্লাওয়ার স্টাডির জন্য কোনো ফুলই পছন্দ হয়না। হঠাত একদিন ঝোপঝাড়ের মাঝে আবিষ্কার করে এক অদ্ভূত দর্শন ফুল- অগ্নিশিখা। এঁকে ফেলে সেই অগ্নিশিখাকেই। অদ্ভুত তার আকার আর অপূর্ব তার রঙ। এর কদিন বাদেই বাড়িতে হঠাত সশরীরে উপস্থিত কিঙ্করদা, রাম কিঙ্কর বেইজ। মাকে বললেন, 'দেখা দেখি কী এঁকেছিস? সবাই এত বলছে কেন?' মা ভয়ে ভয়ে দেখিয়েছিলেন ছবিটা। সস্নেহে বলেছিলেন, 'এত ফুল থাকতে তোর এই ফুলটাই কেন ভাল লাগল রে বেটি?' মায়ের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত। মা কেন এঁকেছিল সেই অগ্নিশিখা তা যেন কোন দিন ভাল করে বোঝাতে পারেনি কিঙ্করদাকে। তাই সেই গল্পের শেষেও কিঙ্করদা একই প্রশ্ন করতেন, কেন এঁকেছিলি রে অগ্নিশিখা?
মা যখন আমাকে এই গল্পটা বলত, আমি জিজ্ঞেস করতাম,' কিঙ্করদা তোমাদের কী শেখাতেন মা?' মা হেসে বলত 'স্কাল্পচার, ভাস্কর্য। কিন্তু ক্লাসে আমাদের কিছু শেখাতেন না, আমরা স্টুডিওতে কাজ করলেও বাইরে ডেকে আনতেন, বলতেন দেখ, দেখ বাইরেটা দেখ… কী হবে মুর্তি গড়ে… ওই মুর্তিকারের কাছে আমরা সবাই …। বলে বুড়ো আঙ্গুল তুলে কলা দেখাতেন।' আকাশে মেঘ জমলেই ডাক পড়ত মায়ের। হেকে বলতেন,' আয়… গান ধর … বহু যুগের ওপার হতে…।' মালবিকা অনিমিখে এলেই উনিও গলা মেলাতেন। মা বলত, খুব আনন্দ করে গাইতাম ঠিকই কিন্তু কিঙ্করদার ক্লাসের শেষে সাবমিশনের সময়ে বুক ঢিপঢিপ করত। কাজ তো হয়নি কিছুই। ধরে বেধে নিয়ে আসতাম কিঙ্করদাকে। স্টুডিওতে । আমাদের কাজ দেখে হাহা করে হাসতেন, মাঝে মাঝে হাতের চাপড়ে ভেঙ্গে দিতেন আমাদের বহুদিন ধরে যত্নে গড়া মুর্তিগুলো। মায়ের একবার প্রায় শেষ একটা মুর্তি এভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। মায়ের খুব রাগ হয়েছিল। মা বলে সেদিন সন্ধেবেলায় সেই বনপুলকের মাঝে কিঙ্করদার আড্ডায় সেদিন যখন সবাই গান ধরেছে, মা নাকি চুপ করেই বসেছিল ভারাক্রান্ত মনে। হঠাত কিঙ্করদার নজরে পড়ে মাকে। বলেন, কি রে, চুপ কেন? তোর মুর্তি ভেঙে দিলাম বলে? আমরা কি আর নিটোল মানুষ রে …। আমরা হলাম কাঁকরের দেশের মানুষ, তাদের কি ভেঙ্গে পড়লে চলে? মা বলেছিল, ঠিক সেই সময়েই আমার চোখ গেল চাঁদের আলোয় ভাসা প্রাঙ্গণে আমাদের কাঁকুড়ে মাটিতে পড়া এবড়ো খেবড়ো ছায়ার দিকে। মনে হল, সত্যি আমার মুর্তি ছিল অনেক নিটোল, এমন এবড়ো খেবড়ো মাটিতে বেমানান। পরদিন ফের শুরু করলাম কাজ। এবার যে মুর্তি হল, কিঙ্কর দা ভাংলেন না, সোমনাথদা কে ডেকে বললেন, দেখো, কেমন কাজ করে এই মেয়েটা।
কিঙ্করদার নানা গল্প শুনতাম শান্তিনিকেতনে মাদের বন্ধুদের কাছে। রিক্সোতে উঠেই নাকি রিক্সোওয়ালাকে দশ টাকা দিয়ে দিতেন। তারপর ছেলেমানুষের মত তাঁর বায়না শুরু হত, আমায় তেলেভাজা খাওয়া, আমায় ফুল কিনে দে, আমার ঐ টুপিটা চাই। এই ভাবেই যেতেন। যদি সে সওদার শেষে রিক্সোওয়ালার কিছু বাঁচত, তাহলে সে যাই বাঁচুক তার, আর লোকসান হলেও তার।
শুনেছিলাম, বাইরের রাজনীতির খবর কিঙ্করদা বড় একটা রাখতেন না। কংগ্রেসের ভোটের প্রতীক জোড়া বলদ থেকে যখন গাই-বাছুর হল, তখন নাকি তিনি বুথ থেকে ব্যালট হাতে বেরিয়ে এসে চেঁচামিচি জোড়েন, আমার জোড়া বলদ কোথায় গেল? আমি ভোট দেব না। অনেক বামপন্থীর মতে অবশ্য সেটা তিনি সজ্ঞানেই করেছিলেন, কারণ তিনি সেবার কংগ্রেসকে ভোট দিতে চাননি।
শুনতাম তা সত্তেও ইন্দিরা গান্ধী নাকি কিঙ্করদাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের বন্ধু মইনূল মামার কাছে অবশ্য শুনেছিলাম এমারজেন্সির সময়ে বা একটু পরে কোনও একটা প্রদর্শনী উদ্ভোধনের সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দাঁড়ানো কিঙ্করদা হঠাতই প্রধানমন্ত্রীর নাক টিপে ধরেন। দেহরক্ষীরা ছুটে এলে কিঙ্করদা নির্বিকার চিত্তে বলেন, ভয় লাগছিল, ওর নাকে আগুন লেগে যেতে পারে। এ রকম সব ঘটনা কিঙ্করদাই পারতেন, তা তালে না বেতালে কেউ জানত না।
শেষ বার মা যখন পি জি হাসপাতালে দেখা করতে গেছে, আমি সঙ্গে ছিলাম। মা মাথায় হাত রাখাতে চোখ মেললেন। বোধহয় চেষ্টা করলেন নামটা মনে করতে। তারপর, এক অপার্থিব গলায় বললেন, গা … মালবিকা অনিমিখে / চেয়েছিল পথের দিকে…।

শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

পার্টি ও ধর্ম ~ শুভম ব্যানার্জী

গল্প টা তিরুপতি পার্টি অফিসে বসে শুনছিলাম যখন, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো, হয়তো অনেকেই ভীষণ অবাক হবেন, তাই গল্প টা শেয়ার করছি। ঠিক দুই দশক আগের ঘটনা...

নিচের ছবি টা অবশ্য ২ দিন আগেই ভেঙ্কটেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তোলা। পেছনেই দেখা যাচ্ছে থিরুমালা পর্বত, যার ওপরে দেশের অন্যতম ধর্মস্থান ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির বা তিরুপতি বালাজি মন্দির অবস্থিত। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) এখানে মাথার চুল দান করেন নিজের মনোকামনা পূরণ হওয়ার আশায়, পুজো দেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। 

কিন্তু ভক্তের সাথে ভগবান কে ডাইরেক্ট কানেক্ট করাচ্ছেন যারা, সেই তিরুপতি মন্দিরের পূজারীরা দিন কাটাচ্ছিলেন অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে। কারণ বহু বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন, অথচ এতো বছরেও কারও বেতন বাড়ে নি এক পয়সা। কোনও একজন পূজারী জানতে পারেন AITUC নামে যে সংগঠন আছে, তারা নাকি বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি ঘটাতে খুব পটু। ব্যাস আর কি, তারা কয়েক জন সটান হাজির CPI এর তিরুপতি জেলা অফিসে AITUC নেতা শ্রীনিবাস এর সাথে দেখা করতে।

কমরেড শ্রীনিবাস সব শুনে বললেন বেতন বাড়বে, কিন্তু তোমাদের আমাদের সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে হবে, ৫০ টা সদস্য পদের একটা ফোলিও নিয়ে যাও, যত জন কে পারো যুক্ত করো। পূজারী রা বললেন একটা ফোলিও তে কি হবে, অন্তত ৬ টা কি ৮ টা দিন...আমরা মোট ৪০০ জন আছি। আর সত্যি সত্যিই ৪০০ পূজারীর সদস্য পদ পূরণ করে এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দিয়ে গেলো।

সেদিন ই শ্রীনিবাস চিঠি লিখলেন তৎকালীন মন্দির ট্রাস্টির চেয়ারম্যান টিডিপি সাংসদ অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা সুব্বি রামি কে। তিনি চিঠিতে উল্লেখ করলেন যে আমাদের সংগঠনের সাথে যুক্ত পূজারী দের অবিলম্বে বেতন বৃদ্ধি করতে হবে, নয়তো তাদের নিয়ে আমরা ধর্মঘটের পথে যেতে বাধ্য হবো। সুব্বি রামি ভীষণ হাসলেন, তারপর চিঠি টা ফেলে দিলেন। হাসার মতোই তো কথা, লাল ঝান্ডার বস্তুবাদী নেতারা বলে কিনা গেরুয়াধারী পূজারী দের নিয়ে আন্দোলন করবে!

যাই হোক চিঠির উত্তর না পেয়ে, শ্রীনিবাস আবার চিঠি লিখলেন, সময়সীমা বেঁধে দিলেন। সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হলে মিছিল করে সুব্বি রামির ট্রাস্টি অফিস অভিযান করা হবে এবং ধর্মঘট শুরু হবে। চিঠির কপি ফরওয়ার্ড করলেন তিরুপতি পুলিশ কমিশনার কে। এবারেও সুব্বি রামি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না, কিন্তু পুলিশ কমিশনারের ফোন পেয়ে তার ভুল ভাঙলো। কমিশনার বললেন যে তাদের কাছে রিপোর্ট আছে, বড় মিছিল হবে এবং প্রায় সমস্ত পূজারীই সেই মিছিলে হাঁটবে।

সুব্বি রামি এবার ঘামতে শুরু করেছেন, মন্দির প্রাঙ্গণে লাল ঝান্ডার মিছিল হবে!! পার্টি তে তিনি মুখ দেখাবেন কি করে!!
তিনি কমিশনার কে অনুরোধ করলেন যেকোনও ভাবে মিছিল, ধর্মঘট আটকাতে হবে। কমিশনার বললেন একটাই উপায় - AITUC নেতা দের সাথে মিটিং এ বসুন।  

সুব্বি রামি মিটিং এ বসলেন, কমিশনার অফিসেই বসা হলো। AITUC র পক্ষ থেকে উপস্থিত জেলা সম্পাদক কমরেড শ্রীনিবাস ও ৪ জন মন্দিরের পূজারী। শ্রীনিবাস বললেন - তিনটি দাবি - প্রথমত, পূজারীদের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব মন্দিরের ট্রাস্ট কে নিতে হবে, দ্বিতীয়ত তাদের পরিবারের সকলের চিকিৎসার খরচ বহন করতে হবে, এবং অবশ্যই বেতন দ্বিগুণ করতে হবে।

সুব্বি রামি প্রথম দুটো দাবি সম্পূর্ণ ভাবে মেনে নিলেন এবং তৃতীয় দাবি নিয়ে ট্রাস্টি মিটিং এ আলোচনা করে যত টা সম্ভব বেতন বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিলেন। মিটিং থেকে বেরিয়েই ৪০০ পূজারীর বিজয় মিছিল হলো CPI দপ্তর পর্যন্ত। গায়ে পীত অথবা শ্বেত বস্ত্র, কপালে তিলক আর হাতে লাল ঝান্ডা। হ্যাঁ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ এর স্লোগান ও নাকি উঠেছিল।

যাই হোক এখনও পর্যন্ত মন্দিরের ভেতরে পূজারী দের মধ্যে AITUC ই বড় সংগঠন, তবে TDP র শ্রমিক সংগঠন ও আছে এখন, যা চাপে পড়ে TDP নেতা রা গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আমাদের কমিউনিস্ট নেতা রা তো আনন্দেই আছেন - মন্দিরে না ঢুকে, পুজো না দিয়ে পার্টি অফিসে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন GI (Geographical Indication) ট্যাগ সম্পন্ন, অত্যন্ত সুস্বাদু তিরুপতি লাড্ডু...

- শুভম

#AITUC
#Tirupati

সিভিক ডাক্তার ~ ডাঃ বিষাণ বসু

তিন-বছরে-ডাক্তার প্রকল্প নিয়ে বলার কিছু নেই। বড়রা ভেবেচিন্তে যখন করছেন, নিশ্চয়ই ভালো ভেবেই করছেন। তবু মনের মধ্যে একটা খটকা বড্ড জ্বালাচ্ছে। 

সেটা হল, কেন এই উদ্যোগ?

শুনছি, দেশে ডাক্তারের বড় অভাব। সিকি শতক আগে আমরা যখন পাস করেছিলাম, তখন রাজ্যে এমবিবিএস-এর আসন মেরেকেটে সাড়ে সাতশ। এখন সংখ্যাটা ঠিক বলতে পারব না, কেননা রোজই তো এদিক-ওদিক মেডিকেল কলেজ খুলে যাচ্ছে, সিট-ও বাড়ছে, মাঝেমধ্যে দিল্লির হর্তাকর্তারা এসে কমিয়েও দিচ্ছেন। তবু, এই মুহূর্তে আসনসংখ্যা তিন হাজারের বেশিই সম্ভবত। তারপরও নাকি ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না।

তাহলে সংখ্যায় ঠিক কতজন ডাক্তার বছরে তৈরি হলে ঘাটতি পূরণ হবে? সেরকম কোনও হিসেব আছে কি? যদি না থাকে, তাহলে তো এমনও হতে পারে, যে, তিন-বছরে-ডাক্তার তৈরি করেও ঘাটতি রয়েই গেল! বড় বড় লোকেদের বড় বড় মাথা থেকে আসা পরিকল্পনা জলে যাক, এমন তো চাইতে পারি না, তাই না?

আবার দেখুন, সংখ্যায় ঠিক কত ডাক্তার তৈরি হলে আর ঘাটতি থাকবে না, এমন হিসেব যদি সরকারের কাছে থাকে, তাহলে এমবিবিএস-এর আসন সেই অনুযায়ী বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন? পূর্বতন বাম সরকারের কল্পনাশক্তির ঘাটতির কারণে তাঁরা ভেবে উঠতে পারেননি যে যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে মেডিকেল কলেজ খুলে এমবিবিএস-এর আসন মুড়িমুড়কির মতো বাড়িয়ে ফেলা যায়, তাই তাঁরা এসব শর্টকাটের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন তো সেই দিন আর নেই। উদ্যোগই বলুন বা উদ্ভাবনী শক্তি অথবা কল্পনাশক্তি, এসব দিকে বর্তমান সরকার যাকে বলে সেকেন্ড টু নন। যা যা পরিকাঠামোয় এঁরা নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ খুলে এমবিবিএস-এর আসন বাড়িয়ে ফেলেছেন, তাকে চমকপ্রদ বললেও কিছুই বলা হয় না। তাহলে এমবিবিএস আসন আরও হাজার কয়েক না বাড়িয়ে এই তিন-বছরে-ডাক্তার প্রকল্প কেন? কেন এই সঙ্কোচের বিহ্বলতা??

নাকি, শীর্ষে থাকা সদিচ্ছাপ্রবণ মানুষগুলো এতই উতলা হয়ে পড়েছেন, যে - প্রাক-নির্বাচনী স্লোগানের মতোই, 'অনেক হয়েছে, আর না' আউড়ে - স্থির করে ফেলেছেন, নাহ্, গাঁয়ের লোকের স্বাস্থ্যসমস্যার সুরাহা এখুনি করে ফেলতে হবে? আপাতত তিন বছর - অত সবুর না সইলে, পরে হয়ত বছরখানেক!!

তবে হ্যাঁ, সরকারের পক্ষেও যুক্তি কিছু কম নেই। আজকের খবরের কাগজে প্রকাশ, রাজ্যের সবচাইতে মান্যগণ্য মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে একেবারে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলেন। কেননা, যেখানে তাঁদের সহপাঠীদের অধিকাংশই নাকি পঁচাত্তর শতাংশ না পেয়ে থামেননি, সেক্ষেত্রে সত্তর শতাংশ তো অত্যন্ত ডিজ্যাপয়েন্টিং! তো তাঁরা খাতা রিভিউ করতে দিয়েছিলেন। রিভিউ-এর পরে দেখা গেছে, তাঁদের প্রাপ্ত নম্বর তিরিশ শতাংশ বা তারও কম!! মেডিকেল পরীক্ষায় যেহেতু পাসমার্ক পঞ্চাশ শতাংশ, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা একটু সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন - কেননা, পাস করা ছাত্র খাতা রিভিউ করে ফেল করে গিয়েছেন, এমন নজির স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্রস্ব ইতিহাসে তো নেইই, সুপ্রাচীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসেও রয়েছে কিনা বলা মুশকিল।

তো পরীক্ষার এমম্বিধ ফলই প্রমাণ - বড়কর্তারা বলতেই পারেন - রাজ্যে এডুকেশন ব্যাপারটা (মেডিকেলই হোক বা অন্য স্ট্রিম) এমন উচ্চস্তরে পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে কত বছর কোথায় পড়ানো হচ্ছে, তা পুরোপুরি অবান্তর। সাড়ে চার বছর পড়ানোর কারিকুলামে যখন এমন অবস্থা, তখন তিন বছরে আলাদা কী হবে!!

সেক্ষেত্রে অবশ্য বাড়তি আশঙ্কার কিছু নেই।

© বিষাণ বসু

সোমবার, ৮ মে, ২০২৩

রবীন্দ্রনাথ , বুর্জোয়া কবি ; এবং... ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

ফি বছর ২৫ শে বৈশাখ এলেই একটি অভিযোগ খুব উঠতে দেখি ইদানীং ― " কমিউনিস্টরা তো রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলেছিলো "! অভিযোগটি মূলত আসে তাদের দিক থেকে যারা স্কুল সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং ডারউইনকে ছেঁটে ফেলেছে। অভিযোগের উত্তরে বামপন্থীরা যুক্তি দেন - ওই মূল্যায়ন সিপিআই নেতা, প্রাবন্ধিক ভবানী সেনের ব্যক্তি মূল্যায়ন। ভবানী সেনের ব্যক্তি মূল্যায়ন কমিউনিস্ট পার্টির দলগত মূল্যায়ন ছিল না। মজা হলো, পক্ষ এবং বিপক্ষের লোকজন যদি একটু তথ্যনিষ্ঠ হতেন, যদি তারা জানতে চেষ্টা করতেন নিজের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্ম মতামতটি ঠিক কি ছিল, তাহলে তারা একটি আশ্চর্য তথ্যের খোঁজ পেতে পারতেন। তারা দেখতে পেতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজেকে বলতেন - " জাত - বুর্জোয়া "!  

সাহিত্যকে শ্রেণী দৃষ্টিতে বিচার করার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। সাহিত্য বিচারে ভাব এবং অন্তরের সম্পদকেই রবীন্দ্রনাথ বিবেচ্য মনে করতেন। সেই প্রসঙ্গেই ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন - ময়মনসিংহগীতিকা পড়ে তিনি খুবই আনন্দ পেয়েছেন। শ্রেণী বিচারে ময়মনসিংহগীতিকা হয়ত প্রলেতারিয়েত। আর তিনি নিজে জাত - বুর্জোয়া। তাতে গ্রন্থটির রসাস্বাদনে তার কোন অসুবিধা হয়নি। স্পষ্টতই বোঝা যায়, নিজের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে কতটা অকপট ছিলেন, কতটা স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। 

বুর্জোয়া শব্দটি যে গালাগালি নয়, ওইটি যে একটি শ্রেণীগত অবস্থানবাচক শব্দ, তা তথাকথিত রবীন্দ্র অনুরাগী দক্ষিনপন্থীরা না বুঝলেও, রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। নিজের সম্পর্কে " জাত বুর্জোয়া " বিশেষণ ব্যবহারে তাই কোনও কুন্ঠা ছিল না তার। নিজের শ্রেণীগত অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই হয়ত তার পক্ষে শ্রেণীগত অবস্থানের উর্ধ্বে ওঠার প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছিল। তার কৃষি সমবায় গঠনের প্রচেষ্টা, সোভিয়েত প্রীতি, সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি তার অকুন্ঠ সমর্থন মোটেই কাকতালীয় নয়।

রবীন্দ্রনাথকে " বুর্জোয়া কবি " বললে কি তার সৃষ্টিকে অপমান করা হয়? মোটেই না। বরং উল্টো। লেনিন প্রলেতারিয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে লিখেছেন - প্রলেতারিয় সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়বে না, বাতাস থেকেও তৈরী হবে না। বুর্জোয়া সংস্কৃতির যা কিছু বৈপ্লবিক,যা কিছু মহান, তার প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে উঠতে হবে প্রলেতারিয়েতকে। একমাত্র এভাবেই প্রলেতারিয়েতের পক্ষে নিজস্ব সংস্কৃতির নির্মান সম্ভব। 

সোভিয়েতে  পুশকিন, গোগোল, টলস্টয়, চেকভ বর্জিত হননি। তারাও সামন্ত অথবা বুর্জোয়াই ছিলেন। কেউই প্রলেতারিয়েত বা কমিউনিস্ট ছিলেন না। তাদের শ্রেণীগত অবস্থান গোপন না করেই সোভিয়েত কমিউনিস্টরা তাদের সৃষ্টিকে ধারণ করেছেন। তাদের সাহিত্যগত ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হয়েই তারপর নির্মিত হয়েছে - সোভিয়েত সাহিত্য।

ছবি : অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি।

শনিবার, ৬ মে, ২০২৩

নিসর্গনীতি ও মার্ক্স ~ অরূপরতন হালদার

আশির দশকের তখন শেষ পর্ব। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক জন বেলামি ফস্টার একটা সন্দর্ভ লিখে ফেললেন "A Vulnerable Planet : A Short Economic History of the Environment". বিশ্ব পরিবেশের সংকট ও তার সঙ্গে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট কিভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে, এবং কেন বিশ্বের পরিবেশের সামগ্রিক সংকট থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকটকে আলাদা করা যাবেনা সেই বিষয় নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছিলেন ফস্টার। প্রায় একই সময়ে American Journal of Sociology তে তিনি কার্ল মার্ক্সের "Metabolic Rift" বা "বিপাকীয় বিভাজন" তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন যা পরিবেশের সংকট ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কের মাঝখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলতে সক্ষম হয়। 

এখন Metabolic Rift বা বিপাকীয় বিভাজন বলতে মার্ক্স ঠিক কি বুঝিয়েছিলেন সেটা দেখা নেওয়া যেতে পারে। মার্ক্স পরিবেশগত সংকট নিয়ে যখন চিন্তা শুরু করেন তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে এই সংকটের মূল কারণ হল সামাজিক বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে এক বিভাজন যা নিরাময়েযোগ্য অবস্থায় নেই। মানবসম্পদ ও প্রকৃতির বাকি জৈব ও অজৈব উপাদানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কীয় একটা
ফাটল যা প্রধানত পুঁজিবাদী কৃষি অর্থনীতি যেখানে কৃষিকে মুনাফাভিত্তিক একটা ব্যবস্থায় পরিণত করার জন্য পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া মূলত দায়ী হয়ে ওঠে আর সেইসঙ্গে শহর ও গ্রামের ক্রমবর্ধমান বিভাজন একে সঙ্গত করে। Economic and Philosophical Manuscripts এ মার্ক্স তাঁর এই যুগান্তকারী চিন্তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এখানে মার্ক্স খুব স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন তাঁর সমকালীন যুগ থেকে বহু অগ্রবর্তী সেই ধারণা যেখানে তিনি উল্লেখ করছেন Metabolism বা বিপাক অর্থাৎ যেখানে মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে নিজের পুষ্টিসাধন করছে তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে প্রকৃতি থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মার্ক্সকে যাঁরা মূলত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বিপ্লবী মতবাদের প্রবক্তা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি তাঁদের ভুল প্রমাণিত করে মার্ক্স তাঁর অন্তর্দৃষ্টির এক বিস্ময়কর বিস্তারে ধরে ফেলেছিলেন সেই সংকট যা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সংকট হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে ফেলে দিয়েছে। 

১৮১৫ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ইংল্যান্ডের কৃষি বিপ্লবকে মার্ক্স গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। সেইসময় এই কৃষি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই মাটির রসায়নতত্ত্বের বিস্তার হয় ও রাসায়নিক সার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চিন্তা শুরু হয়। ফসলের উৎপাদন বাড়াবার জন্য রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কিভাবে মাটির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে সেই বিষয়ে মার্ক্স সবিশেষ অধ্যয়ন করেন ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন। 
পরে জার্মান কৃষিবিজ্ঞানি ভন লিবিগের গবেষণা মার্ক্সকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে যেখানে লিবিগ পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করে দেখিয়েছিলেন কিভাবে নগরায়ন এবং তার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রকৃতিতে আপন ধারণক্ষমতা বজায় রাখা কৃষির ব্যবস্থাকে ক্রমশ ধ্বংস করে ফেলে এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে মূলত কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে একটা পারস্পরিক বিভাজনরেখা ক্রমশ রূপ নিতে থাকে। ভন লিবিগ গবেষণা করে তথ্য দিয়ে দেখিছিলেন যে যদি কোনো একটা জনসংখ্যার সমগ্র জনসমুদয়ের জৈব বর্জ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে কৃষি জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই জমি থেকে বর্ধিত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব একটুও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে। এই তথ্যে মার্ক্স চমৎকৃত হন। 
এই সঙ্গে মার্ক্স তাঁর শ্রম সম্পর্কিত তত্ত্ব ব্যবহার করে বুঝতে পারলেন যে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে মানুষ প্রকৃতিকে তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে মূলত তার শ্রমের ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার প্রয়োগ ঘটিয়ে মার্ক্স এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে মাটির উৎপাদনক্ষমতা কোনো প্রাকৃতিক বিষয় নয়। বরং সময়ের সঙ্গে সমাজের যে লম্বা জটিল সম্পর্ক তার দ্বারা এই বিষয় নির্ধারিত হয়। 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্রমোত্থানের ও নগরায়নের অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়ালো গ্রাম থেকে শিল্পোৎপাদনের অঞ্চলগুলোতে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল ও খাদ্যের সরবরাহ। এর ফলে মার্ক্সের ভাষায় গ্রামসম্পদ শহরের দিকে প্রবাহিত হল, এবং সেইসঙ্গে গ্রামের জমির উৎপাদনশীলতাকে  ধারণক্ষমতার প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ব্যাহত করে ক্রমাগত ধ্বংস করা হল। সেইসঙ্গে শিল্পের বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে তা মাটিতে ফেলে সেখান দিয়েও মাটির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে ফেলা হল। মার্ক্স তাঁর "পুঁজি" গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে "বৃহৎ আকারের শিল্প ও কৃষি" অধ্যায়ে লিখছেন ঃ " পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া বিরাট এক জনসমুদয়কে আরও বৃহত্তর উৎপাদন কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত করে নিয়ে যায়, যার ফলে শহরের অধিবাসীদের হাতেই পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কেন্দ্রীভূত হয়। এর দুটি ফলাফল। প্রথমত এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে সমাজের সঞ্চালক শক্তির এক ধরণের কেন্দ্রীভবন ঘটে, অন্যদিকে মনুষ্যপ্রজাতি ও পৃথিবীর মধ্যে পারস্পরিক যে বিপাকীয় (পৃথিবীর সম্পদ আপন প্রয়োজনে ব্যবহার) সম্পর্ক রয়েছে তাকে গভীরভাবে ব্যাহত করে। অর্থাৎ এই ঘটনা মাটিতে সেই মৌলিক উপাদানগুলো ফিরে আসতে বাধা দেয় যা মানুষ খাদ্য এবং বস্ত্র হিসাবে মাটি থেকে বিভিন্ন উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে এই ঘটনা মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা বজায় রাখার একটা অনন্ত প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়... আর এটা ঘটে এই বিপাকীয় সম্পর্কগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে।...পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থার যাবতীয় প্রগতি সবই হয়েছে কেবল কৃৎকৌশলগত প্রগতি যা শুধু কৃষি-শ্রমিককেই লুঠ করেনা, লুঠ করে জমির উর্বরতাকেও। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির যাবতীয় পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত  সামগ্রিকভাবে জমির উর্বরতার সমস্ত উৎসকে নষ্ট করে ফেলে...পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং উৎপাদনের সামাজিক পদ্ধতির উন্নতিসাধন করে, কিন্তু একই সঙ্গে মাটি এবং কৃষি-শ্রমিকের যা প্রধান সম্পদ অর্থাৎ উৎপাদনশীলতাকে ধ্বংস করে।"

কবে ভাবছেন মার্ক্স এইসব কথা? ১৮৬৭ সাল। তার "পুঁজি" গ্রন্থের প্রথম খণ্ড লেখার সময়। তারপর দেড় শতকেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এই সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হয়েছে। সে আজ আরও জটিলতার আবর্তে। জটিলতর হয়েছে পুঁজির বহুমাত্রিক কেন্দ্রীভবন। আরও বেশি মুনাফার আশায় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে "কৃষি বিপ্লব" করতে গিয়ে আরও গভীর সংকটের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। সেইসঙ্গে বিশ্ব-উষ্ণায়ন এক সার্বিক ভয়াবহতার সামনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের।

২০০০ সালে বেলামি ফস্টার মার্ক্সের নিসর্গনীতি নিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিখ্যাত বই "Marx's Ecology".  এই বইতে তিনি সাম্প্রতিক পরিবেশগত সংকট নিয়ে আরও গভীরে গেছেন, এবং এপিকিউরাস, ডারউইন, ফয়েরবাখ ও আরও অন্যান্য দার্শনিকদের মতবাদের সঙ্গে মার্ক্সের নিসর্গতত্ত্ব আলোচনা করে সাম্প্রতিক পুঁজির বহুমাত্রিকতা ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটা তত্ত্বে পৌঁছাতে চেয়েছেন।  

মার্ক্স তাঁর "বিপাকীয় বিভাজন" তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় সবশেষে যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সমাজব্যবস্থা ছাড়া যে এই শিকড়ব্যাপী সংকটের মূল ধরে নাড়া দেওয়া যাবেনা সেই বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। তিনি সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন যেখানে তিনি মনে করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানবজাতির বিপাকীয় সম্পর্কটিকে পুনরুদ্ধার করতে গেলে সেই সম্পর্কটিকে প্রকৃতির শক্তি ও স্বাভাবিকতা  দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ মার্ক্স ফিরতে চাইছেন একেবারে গোড়ায়। সেটা মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সব সম্পর্কের মৌলিক উদ্ধার। তিনি পরিষ্কার বলছেন এই কাজ বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। তার জন্য চাই মুক্ত উৎপাদকদের এক সমাজ যেখানে সবাই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে প্রাকৃতিক সম্পর্কের স্বাভাবিক নিরিখে। এই সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে একমাত্র সমষ্টিগত স্বার্থে, কোনো বাজারী সম্পর্কের অন্ধ ক্ষমতার স্বার্থে নয়। 
কিন্তু মার্ক্স কখনো মনে করেননি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই এই সমস্যার স্বাভাবিক সমাধান ঘটবে। তিনি স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিভাজন কমিয়ে এনে ও শ্রমের যে বিভাজন চালু আছে তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ও মানবিকভাবে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুস্থ পরিকাঠামোয় রূপান্তরিত করে শেষ পর্যন্ত মাটির উর্বরতাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 

তাঁর এই চিন্তার বিস্তার ঘটেছে পরবর্তীকালে নিসর্গনীতির আর এক শাখায় যেখানে সমাজতান্ত্রিক নিসর্গনীতি নামে জ্ঞানচর্চার নতুন শাখা নিয়ে কাজ করেছেন বহু নিসর্গবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক। এঁদের মধ্যে জাপানি দার্শনিক ও নিসর্গবিদ কোহেই সাইতো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, এবং এখনো করে চলেছেন। 

০৫/০৫/২০২৩

কার্ল মার্ক্সের ২০৬ তম জন্মদিন আজ।

বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০২৩

ম্যাজিক মাশরুম, গাঁজা, ধর্ম আফিম নেশা ও চিত্রশিল্পের জন্ম ~ তথাগত দাসমজুমদার

-পানু, তুই আবার গাঁজা খাচ্ছিস? শালা হল্যান্ডে অনসাইট এসে থেকে আজ গাঁজা, কাল মাশরুম চালিয়েই যাচ্ছিস
- তোর কি রে বাঁড়া, নিজের পয়সায় খাচ্ছি
- - তুই শালা গাঁজা খেতে খেতে মরে যাবি একদিন
- - তোর মত রোজ মদ তো গিলিনারে বালটা, লিভার পচে, হেগেমুতে মরবিরে শালা।
- - তুই ক্যান্সার হয়ে মরবিরে শালা, রোজরোজ এত টার ঢুকছেরে লাঙসে, তুই ফুসফুসে ঘা হয়ে রক্তবমি করে মরবিরে শালা।
- - রাখ তোর ক্যান্সার, আমরা গাঁজাখোররা না থাকলে সভ্য হতে পারতিসনারে বাল
- - গাঁজাখোররা না থাকলে সভ্য হতে পারতামনা? কি বলছিসরে? এসব খেয়ে মাথাটা একেবারেই গেছে দেখছি
- - যায়নি রে যায়নি, নেক্সট উইকে লাসকু কেভস দেখতে যাবি তো? তো যাবার আগে একটু পড়াশোনা করে নিলেও তো পারিস রে বালটা, তাহলে দেখতে আরও মজা পেতিস।
- - যা বাঁড়া, এর সাথে গাঁজা খাওয়ার কি সম্পর্ক?
- - আছে রে আছে, গাঁজার সাথেও আছে, মাশরুমের সাথেও আছে।
- - কিন্তু তার সাথে লাসকু কেভসের কি সম্পর্ক?
- - আছে, আগে বল যে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র সম্পর্কে কি জানিস?
- - বেশি কিছুনা, জানি যে প্রাগৈতিহাসিক যুগে চল্লিশ থেকে ছহাজার বছর আগে পর্যন্ত আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া সব যায়গাতেই মানুষ গুহার ভেতরে ছবি এঁকেছে। স্পেনের আলতামিরা, ফ্রান্সের লাসকু এসব জায়গাগুলোতে প্রতিবছর অসংখ্য টুরিস্ট আসে গুহামানবদের আঁকা ছবিগুলো দেখতে।
- - কখনও মনে হয়নি কেন এঁকেছিল?
- - পড়েছি যে শিকারে যাওয়ার আগে শিকারের সফলতা কামনা করে নিজেদের বাসস্থানে কিছু রিচ্যুয়াল বা প্রথা অনুসরণ করত গুহামানবেরা, সেসব রিচ্যুয়ালেরই অংশ হল এই গুহাচিত্রগুলো।
- - বাল জানিস বাঁড়া
- - ওই দেখ, খিস্তি দিতে শুরু করলি, ভুলটা কোথায় শালা? প্রচুর তীর বা বর্শাবিদ্ধ বাইসন, ঘোড়া ইত্যাদির ছবি আছে তো
- - শোন বাল, যে গুহায় এসব গুহাচিত্র পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই মাটির অনেকটা নীচে। যে লাসকু কেভ দেখতে যাচ্ছিস, সেটা তো প্রায় ভার্টিকাল ড্রপ, নামতে গেলে দড়ি বেঁধে ঝুলে ঝুলে নামতে হবে, তুই যে বাড়িতে থাকিস, সেখানে ঢোকা বেরোনোর জন্য এত ঝামেলা করবি কেন?
- - এটা তো ভেবে দেখিনি
- - ভাব ভাব, আরেকটা কথা বলি শোন। আর্কিওলজিকাল এভিডেন্স বলছে যে এইসব চিত্রকরদের প্রধান খাদ্য ছিল বল্গা হরিণ, কিন্তু গুহাচিত্রে বল্গা হরিণ অনুপস্থিত। শিকারের আগের রিচ্যুয়ালই যদি হবে তাহলে বল্গা হরিণের ছবি না এঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ বাইসন, অরকস, হায়না, সিংহ এসবের ছবি আঁকবে কেন রে বাঁড়া?
- - আরিশ্লা, এটা তো ভাবে দেখিনি, কিন্তু বাল এখনো বুঝলামনা যে এর সাথে গাঁজা বা মাশরুমের কি সম্পর্ক।
- - বলছি, দাঁড়া, জয়েন্টটা ধরিয়েনি আগে
- - উফ, তুই আর তোর জয়েন্ট
- - গুণিনদের ভর হওয়া দেখেছিস কখনো?
- - হ্যাঁ, অনেকবার দেখেছি, আমাদের বাড়ির কাছেই একটা সাঁওতালদের গ্রাম ছিল, সেখানে ছোটবেলায় দেখেছি গুণিনদের ভর হতে। ভর হবার পর তারা বোঙ্গাদের সাথে কথা বলত, বোঙ্গারা যা নির্দেশ দিত সেটা গ্রামের সকলকে জানাত। যত্ত কুসংস্কার, সরল আদিবাসীদের বোকা বানিয়ে পয়সা রোজগারের ধান্ধা।
- - অত সরল নয়, কিছু ঠগবাজ থাকলেও অনেক গুণিনরা সত্যিই বিশ্বাস করে যে ভর হবার পরে তারা বোঙ্গাদের সাথে কথা বলতে পারে। আমাদের বামকৃষ্ণদেবের সাথে মাকালীর কথাবার্তা বা হজরত মোহম্মদকে জিব্রাইল ফেরেস্তার ওহী দান করা ব্যাপারটাও অনেকটা এইরকম। এই ওহী পাওয়া থেকে ভর হওয়া সবই আসলে অলটারড স্টেট অফ কনসাসনেসের বহিঃপ্রকাশ
- - অলটারড স্টেট অফ কনসাসনেস? সেটা কি?
- -মানবমনে আসলে দুরকম কনসাসনেস আছে, একটা হল কগনিটিভ কনসাসনেস যা বিয়েল লাইফের চিত্র তৈরি করে আর আরেকটা হল অলটারড স্টেট অফ কনসাসনেস, যেখানে রিয়েলিটি হয়ে যায় ডিসটর্টেড, মানবমস্তিষ্ক এমন সব ছবি তৈরি করে যার সাথে বাস্তবের সম্পর্ক থাকলেও তা ঠিক বাস্তব নয় বরং বলা যেতে পারে পরাবাস্তব। এই অলটারড স্টেট অফ কনসাসনেসের সাথে মানুষের সৃজনশীলতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে।
- - যাশ্লা, তাই নাকি?
- - হ্যাঁরে, হিপনোগগিয়া বলে একটা জিনিস আছে, বাংলায় আমরা যেটাকে তন্দ্রা বলি। ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যবর্তী একটা অবস্থা যেখানে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতনতা বজায় থকার পাশাপাশি চলে স্বপ্নের ইমেজারিগুলো যেগুলোকে এসময়ে কনসাসলি মোডিফাইও করা যায়। অনেকে মনে করেন যে সৃজনশীলতার উৎসও এখানেই।
- - সেসব তো বুঝলাম, কিন্তু এগুলোর সাথে গাঁজা, মাশরুম , গুহাচিত্র আর সভ্য হওয়ার সম্পর্ক কি? তখন থেকে ভ্যানতাড়া মারছিল শালা।
- পানু জয়েন্টে একটা লম্বা টান মেরে বলল
- - শোন ধ্রুব, ভ্যানতাড়া মারছিনা রে বাল। এগুলোকে বলে গ্রাউন্ড প্রিপারেশন
- - গ্রাউন্ড প্রিপারেশন তো হল, এবারে একদম ব্যাটিং পিচ, শেহবাগের মত চালা।
- - একটু আগে তোকে বললাম যে গুহাচিত্রগুলো কেন শিকারের আগের রিচ্যুয়াল নয়। তাহলে সেগুলো কি? বর্তমানে আর্কিওলজিতে গুহাচিত্রের এক্সপ্ল্যানেশনের কারণের নানান হাইপোথেসিসগুলোর মধ্যে হটলি ডিবেটেড মতটা হল শ্যামানিস্টিক অরিজিনের কথা। শ্যামান মানে গুণিন বা ওঝা ধরে নিতে পারিস। গুণিনরা স্পিরিট ওয়ার্ল্ডের সাথে যখন কম্যুনিকেট করে বা করার চেষ্টা করে তখন তাদের অলটারড কনসাশনেসে পৌঁছতে হয়, আসলে আর কিছুনা, অলটারড স্টেট অফ কনসাশনেসে যে ইমেজারি দেখা যায় সেটাকেই স্পিরিট ওয়ার্ল্ড ভাবে গুণিনরা।
- সেই কনসাসনেসে পৌঁছতে গেলে সবার আগে দরকার হয় একটা ট্রান্স বা ভর হওয়ার মত পরিস্থিতির। সেই ভর হওয়াটা হবে কিকরে? বেশ কয়েকটা উপায় আছে। জলদগম্ভীর শব্দ, অক্সিজেনের অভাব, উপবাস ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে সহজে এটা করা যায় যেটার মাধ্যমে, সেটা হল সাইকোট্রপিক ড্রাগের ব্যবহার।
- - সাইকোট্রপিক ড্রাগ আবার কি?
- - কেন? ম্যাজিক মাশরুম , গাঁজা এসবই সাইকোট্রপিক ড্রাগ। এগুলো সেবনের ফলে মানুষ সহজেই অলটারড স্টেট অফ কনসাশনেসে পৌঁছতে পারে।
- - আরিশ্লা, তুই বাঁড়া এজন্যই গাঁজা খাস
- - হ্যাঁ তো, যাইহোক টপিকে ফিরি। কগনিটিভ স্টেট অফ মাইন্ড থেকে অলটারড স্টেট অফ মাইন্ডের পথ যাত্রার অভিজ্ঞতাটা কেমন জানিস? অনেকটা টানেল বা গুহার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মত। এই টানেলের দেওয়ালগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে আর সেখানে প্রস্ফূটিত হতে থাকে ছায়াছবি। কখনো নানান পশুপাখী, কখনো মনুষ্যমূর্তি, কখনো বা জ্যামিতিক রেখা ও আকৃতি ছায়ামূর্তির মত ভেসে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়। ম্যাজিক মাশরুম, ভাঙের শরবত, গাঁজা ঠিক এই অনুভূতিগুলোকেই জাগিয়ে তোলে, আর এটাকে আরো ত্বরাণ্বিত হয় যদি সেইসাথে অক্সিজেনের অভাব ঘটে।
- লাসকু, কাস্তিল ইত্যাদি জায়গার গুহাগুলো মাটির অনেকটা নীচে ছিল, লাসকুতে তো গুহার তলায় লতা পেঁচিয়ে বানানো দড়ি পর্যন্ত পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে সেখানে ওঠানামা করা হত। এবারে মাটির নীচের এরকম গুহায় আলোবাতাস প্রায় পৌঁছয়ই না, সেক্ষেত্রে ছবি আঁকতে গেলে মশাল ব্যবহার করতেই হবে। আর যেখানে বাতাস পৌঁছয়না, সেখানে মশাল ব্যবহার করা মানে কি?
- - কি?
- - অক্সিজেনের অভাব সৃষ্টি হওয়া, মাশরুমের এফেক্ট আর অক্সিজেনের অভাব যে কি ইমেজারি তৈরি করতে পারে গুহাচিত্রগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
- - মানে বলছিস যে গুণিনরা গাঁজা, মাশরুম খেয়ে অক্সিজেনের অভাবে যে অলটারড স্টেট অফ মাইন্ডে পৌঁছে যে ইমেজারি দেখতো, সেটাই গুহাচিত্রে তুলে ধরত?
- - তুলে ধরতনা, পাতি যেটা দেখত সেটার মেন্টাল প্রোজেকশন করত গুহার দেওয়ালে, সেই প্রোজেক্টেড ইমেজের ওপর ট্রেস করে আঁকা হত এসব ছবি, লাইভ। জীবজন্তু, পশু আর মানুষের হাইব্রিডের সাথে সাথে নানান জ্যামিতিক আকার সেদিকেই নির্দেশ করে। গোয়ের্নিকা থেকে সিস্টিন চ্যাপেল সবকিছুরই উৎস এখানেই।
- - গাঁআআআড় মেরেছে
- - শুধু তাই নয়, গুহার দেওয়ালগুলোকে তারা সম্ভবত রিয়েল ওয়র্ল্ড আর স্পিরিট ওয়র্ল্ডের মধ্যেকার ফিজিকাল বাউন্ডারি ভাবত।
- - ইন্টারেস্টিং
- - ম্যাজিক মাশরুম যদি কখনো খাস, তার একটা এফেক্ট যেটা দেখতে পাবি, সেটা হল দেওয়ালের জীবন্ত হয়ে ওঠা, দেওয়ালগুলোতে ঢেউ খেলতে থাকে, নানান জ্যামিতিক আকার জেগে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়, কখনো বা অবাস্তব জীবেরা দৃষ্টিপথে উঁকি মারে। গুহাচিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর কিরকম সাথে একরকম মনে হচ্ছেনা?
- - আরেকটু এক্সপ্লেন কর, গুহাচিত্রের বৈশিষ্ট্যের সাথে কিভাবে মেলে?
- - গুহাচিত্রগুলো কিভাবে আঁকা হয়েছিল জানিস?
- - এটা জানি, লাল আর হলুদ ওকর, হেমাটাইট, ম্যাঙ্গানিজ মিশ্রিত খনিজ, কখনো কখনো কাঠকয়লার গুঁড়ো জল বা কাদার সাথে মিশিয়ে ছবিগুলো আঁকা হত। হাতের ছাপও ব্যবহার করা হত, সেক্ষেত্রে দেওয়ালের গায়ে হাত রেখে ফাঁপা হাড় বা শরের মধ্যে দিয়ে ফুঁ দিয়ে রং স্প্রে করা হত। স্প্রে পেন্টিংএর আদিরূপ বলতে পারিস আরকি।
- - আরিব্বাস, একদম ঠিক।
- - তাহলে? বেফালতু আমি পড়িনা বলে খিস্তি মারলি। তোর মত এত না হলেও, একটুআধটু আমিও পড়ি।
- - একটু এক্সপ্লেন করে বলি, গুহাচিত্রগুলোকে ভালভাবে দেখলে দেখা যায় যে সব ছবিগুলো শুধুমাত্র ড্রয়িং নয়। কিছু ছবি রীতিমত এনগ্রেভ করা হয়েছে দেওয়ালের গায়ে। তারপরে সেটার ওপর রঙ চড়ানো হয়েছে। গুহার দেওয়ালটাকে যদি ম্যাজিক মাশরুম বা গাঁজার এফেক্টে অলটারনেট স্টেট অফ মাইন্ডে স্পিরিট ওয়ার্ল্ডের সাথে বাউন্ডারি হিসেবে মনে হয়, তাহলে সেই অবস্থায় দেখা বাইসন, স্পিরিটের মেন্টাল ইমেজ যেটা গুহার দেওয়ালে প্রোজেক্টেড সেটার সাথে ইন্টার্যাক্ট করতেও ইচ্ছা হবে? তাই না?
- - সে তো হবেই, তুইই শালা মাশরুম খেয়ে খালি দেওয়ালের রামধনু ধরতে যাচ্ছিলি, যারা আত্মার অস্তিত্ত্বে বিশ্বাসী তাদের তো বেশি করেহবে।
- - এব্বাবা। ওসব কথা পরে হবে। যেটা বলছিলাম, এই ইন্টার্যাক্ট করার ইচ্ছাটাই হয়ত জন্ম দেয় এনগ্রেভিং টেকনিকের। শুধু তাই নয়, অলটারনেট স্টেট অফ মাইন্ডে ছবিগুলো বারবার ভেসে ওঠে, আবার মিলিয়ে যায়, প্রাগৈতিহাসিক গুণিনরা নিজেদের ভিশনকে ট্রেস করে আঁকার সময় সেদিকেও খেয়াল রাখত। বেশ কয়েকটা ক্ষেত্রে ছবিগুলো একটা বিশেষ অ্যাঙ্গেল থেকেই দেখা যায়, কেউ একজন যদি হাতে একটা মশাল নিয়ে গুহায় ঢোকে তাহলে দেখবে একটা বাইসনের ছবি ফুটে উঠল, একটু এগোতেই মিলিয়ে গেল, অথচ অন্য ছবিগুলো যেকোন কোণ থেকে আলো পড়লেই দেখা যাচ্ছে। ম্যাজিক, আদিম ম্যাজিক। সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্স যে ঘরের দেওয়ালকে জীবন্ত বস্তু ভাবাতে পারে, সেটা তো তোকে আগেই বললাম। এই প্রাগৈতিহাসির গুণিনরাও সাবস্ট্যান্স ইনিশিয়েটেড অলটারড স্টেট অফ মাইন্ডে গুহার দেওয়ালকে সেটাই ভাবত, বেশ কিছু ছবিতে গুহার গায়ের প্রাকৃতিক খাঁজ ও ভাঁজকে ছবির অংশ হিসেবে ব্যহার করা হয়েছে। গুহার দেওয়ালের ফাটল যেন সিংহের মুখ, যে সিংহ স্পিরিট ওয়র্ল্ড থেকে বেরিয়ে আসছে গুণিনের দিকে। যেন থ্রি ডাইমেনশনাল ইল্যুশন। ঠিক যেমন হয় ম্যাজিক মাশরুম খেলে। শুধু তাই নয়, মাশরুম ইন্ডিউসড অলটারড স্টেট অফ মাইন্ডে স্পিরিট ওয়ার্ল্ডের দেওয়াল ভাঙার জন্য পাথরের খাঁজে চাড় দেওয়ার প্রচেষ্টারও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
- - বুঝলাম এই মতে তার মানে শিল্প থেকে ধর্ম, সবকিছুরই উৎস আসলে নেশা, কিন্তু এটা। স্পেকুলেশন, কোন প্রমাণ টমান?
- - এইতো যুক্তিবাদী বেরিয়ে এসেছে। সাহারা মরুভূমির তাসিলিতে যে গুহাচিত্রগুলো আছে তাতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়। গুণিনের সারা শরীরজুড়ে মাশরুম। স্পেনের কয়েভা পাসকুয়েলার গুহাচিত্রে অরকসের সামনে আছে অনেক অনেক মাশরুম। এছাড়াও অনেক জায়গাতেই বেশ কিছু মনুষ্যচিত্র দেখা যায়, তাদের মাথাটাই মাশরুমের মত।
- - উরিশ্লা
- - শুধু তাই কেন, সাইবেরিয়ার গুণিন বা শ্যামানদের মধ্যে মাশরুমের ব্যবহার প্রবলভাবেই আছে, ইনফ্যাক্ট শ্যামান শব্দটাই এসেছে সেখান থেকে। আমাদের শিবের সাথে গাঁজা ও ভাঙের কানেকশনটাও ভেবে দেখ। ১৯৬০এর দশক থেকে হিপি মুভমেন্ট , রক মিউজিকের মধ্যে দিয়ে যখন নতুন সংস্কৃতি ও শিল্পের জন্ম হচ্ছে, তার অনেকটা অংশ জুড়ে আছে এলএসডির মত ড্রাগের ব্যবহার।
- - দে তো, আজ একটু জয়েন্ট খেয়ে দেখি
- - পথে এসো