আসুন, আজ আপনাদের এক মন-ভালো-করা গল্প শোনাই।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ রূপায়িত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। বিভক্ত দুই বাংলা ফের জুড়ে গেল ১৯১১ সালে, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে উঠে চলে গেল দিল্লিতে। এডউইন ল্যুটিয়েন্স নামে এক সাহেব আর্কিটেক্ট এলেন নতুন দিল্লির খোলনলচে বদলে সাহেবসুবোদের উপযুক্ত অফিস ও ভবন ডিজাইন করতে। লাট-বেলাটদের জন্যে পত্তন হল ল্যুটিয়েন্স' ডেলহির।
তবে সাহেবরা তো কলকাতার পচা ঘেমো গরমে হাঁসফাঁস করে এমনিতেই কাহিল হয়ে যেত। গরম পড়লে তারা কলকাতার বাস সাময়িকভাবে উঠিয়ে চলে যেত সিমলায়। সেখানেই পাহাড়ের কোলে ছিল তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।
দিল্লিতে রাজধানী উঠে যাওয়ার আগে কলকাতার কার্জনসাহেব এক গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে তাঁর সিমলার রাজভবনে নেমন্তন্ন করলেন তৎকালীন ভারতভ্রমণরত আর্চবিশপ অভ ক্যান্টারবেরি, র্যান্ডাল ডেভিডসনকে। দ্বিপ্রাহরিক খানাপিনার সময় গল্প করলেন, সিমলার কাছেই একটা কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম আছে, সেখানে এক ডাক্তার দম্পতি – মিসেস অ্যান্ড মিস্টার কার্লটন – ভারতীয় কুষ্ঠরোগীদের সেবাশুশ্রূষা করেন। আর্চবিশপ যদি সেটা দেখতে চান, তবে তিনি তার ব্যবস্থা করবেন।
বিশপ সেখানে গেলেন, কাজকর্ম দেখে খুব সন্তুষ্ট হলেন। জানলেন, এখানে এই আশ্রমটা বেশ কিছুদিন আছে বটে, তবে সম্প্রতি আমেরিকা থেকে এক যুবক সেখানে হাজির হওয়ার পর এর কাজকর্মে অনেক গতি এসেছে। যুবকটির নাম স্যামুয়েল ইভান্স স্টোকস। একুশ-বাইশ বছর বয়স তার।
স্যামুয়েলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা গেল, সে ফিলাডেলফিয়ার এক ধনী পরিবারের ছেলে। তার বাবা 'স্টোকস অ্যান্ড প্যারিশ মেশিন কোম্পানি' নামে এক বড়সড় যন্ত্রপাতি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। তাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে এলিভেটর অর্থাৎ লিফট তৈরির। বাবার ইচ্ছে স্যামুয়েল লেখাপড়া শিখে এই ব্যবসার দায়িত্ব নিক। কিন্তু স্যামুয়েলের ব্যবসাপাতিতে একেবারে মন নেই। সে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। মা-বাবা অখুশি হলেও ছেলের সব আবদার মেনে নেন। এইভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে ফিলাডেলফিয়ার এক চার্চে কার্লটন দম্পতির সঙ্গে তার আলাপ, তাঁরা সেখানে গেছিলেন ভারতীয় কুষ্ঠ মিশনের জন্যে চাঁদা চাইতে। স্যামুয়েল তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, সে তাঁদের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে কিনা। তাঁরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।
১৯০৪ সালের ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি জাহাজে কার্লটনদের সঙ্গে স্যামুয়েল এসে হাজির হলেন বোম্বেতে। সেখান থেকে তাঁরা গেলেন পাঞ্জাবের সাবাটু-তে, সেখানেই লেপ্রসি মিশনের বড়সড় কাজকারবার।
পাঞ্জাবের গরম আর ধুলো সহ্য হল না স্যামুয়েলের, কিছুদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলেন। তার এক অবস্থা দেখে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল উত্তরে পাহাড়ের কোলে, সিমলার কাছে কোটগড়ে। সেখানে এক চার্চের অধীনে তাদের এক ছোটোখাটো মিশন চলছে, স্যামুয়েল সেখানেই কাজ করতে পারে। ১৯০৪ সালের মে মাসে স্যামুয়েল চলে গেল সেখানে। এখানেই আর্চবিশপের সঙ্গে দেখা হল তার।
মিশনারিরা কাজের লোক, তাঁরা নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করে নিতে জানেন। স্যামুয়েলের প্রভূত প্রশংসা করে আর্চবিশপ র্যান্ডাল জানালেন, তাঁর ইচ্ছা, স্যামুয়েল ওখানে ফ্র্যান্সিস্কান অর্ডার প্রতিষ্ঠা করে, যাদের বক্তব্য হচ্ছে গরিবদের সেবা করতে গেলে তাদের মধ্যে গরিব হয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বাস করো। স্যামুয়েল সন্ন্যাসী হয়ে বাস করতে লাগল কোটগড়ের কাছে থানেদার নামে এক সুন্দর গ্রামে।
ওদিকে ফিলাডেলফিয়ায় এই খবর পৌঁছে গেল স্টোকস পরিবারে। এতদিন মা-বাবা স্যামুয়েলকে নিয়মিত ভালো টাকাপয়সা পাঠাচ্ছিলেন আর সে তা কাজে লাগাচ্ছিল জনগণের সেবায়। যখনই খবর গেল স্যামুয়েল মঙ্ক হতে চলেছে, মায়ের মন কেঁদে পড়ল। ১৯১১ সালে মিসেস ফ্লোরেন্স স্টোকস এসে হাজির হলেন ছেলে স্যামুয়েলের কাছে থানেদারে। অনেক বোঝালেন, এই জীবন তাঁদের জন্যে নয়। বাবার ব্যবসা সে যদি দেখাশুনা করতে নাও চায়, ঠিক আছে, কিন্তু তাকে এইভাবে হতদরিদ্র হয়ে থাকতে হবে কেন? এভাবে সে কীই বা সেবা করতে পারবে?
ছেলে দেশে ফিরতে রাজি হল না। থানেদারে ২০০ একর জমিতে চা-গাছ লাগিয়েছিলেন মিসেস বেটস নামে এক বিধবা ইংরেজ মহিলা। ১৯১২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি সেই জমি তিরিশ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে ফ্লোরেন্স ছেলেকে বললেন, তাহলে এখানে কিছু কর। টাকা-পয়সা যা দরকার, আমাকে বলবি, আমি দেব। নেংটি পরে তুই এদের সেবা কী করে করবি?
স্যামুয়েল ভেবেচিন্তে দেখল, মায়ের কথা ঠিক। আট বছর হয়ে গেছে তার ভারতে আসার পর। এতদিন সে যা করেছে, যাতে স্থানীয় লোকের কাছে তার ভাবমূর্তি অতি উজ্জ্বল, তার পেছনে মা-বাবার অনুদানের বিরাট ভূমিকা আছে। সন্ন্যাসী হয়ে চললে এ সব কিছুই সম্ভব হবে না।
ফ্র্যান্সিস্কান রোব ছুঁড়ে ফেলে দিল স্যামুয়েল। সে বছরেই সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখে সে বিয়ে করল স্থানীয় এক ভারতীয় রাজপুত মেয়েকে, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত যার নাম অ্যাগনেস।
অ্যাগনেস-স্যামুয়েল জুড়ি নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল স্থানীয় লোকজনের সেবায়।
মোগল-সম্রাট বাবর দিল্লির গদিতে কিছুদিন শাসন করে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন – এ কেমন দেশ, যেখানে না আছে বসরাই গোলাপ, না আছে ফরগানার উৎকৃষ্ট ফল। মোগল উদ্যান স্থাপন করে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় ফল-ফুলাদির চাষের চেষ্টা করেছিলেন। কিছু সাফল্য ছিল, কিছু ব্যর্থতাও। আপেল অবশ্য ফলেনি। ইংরেজরা আপেল খেতে ভালোবাসে, ভারতের ব্রিটিশ সাহেবরা আপেল আমদানি করে জাপান থেকে। ১৮৭০ সালে ক্যাপ্টেন আর সি স্কট নামে ব্রিটিশ আর্মির এক সাহেব নিউটন পিপ্পিন, কিং অভ পিপ্পিন আর কক্সেজ অরেঞ্জ পিপ্পিন নামে তিন প্রজাতির আপেল চাষের চেষ্টা করেছিলেন হিমাচলের কুলু উপত্যকায়। আপেল ফলেছিল যদিও, সে অতি টক আপেল। টক জিনিস আদৌ সহ্য হয় না সাহেবদের জিভে।
১৯১৫ সালে স্যামুয়েল স্টোক্স মা-বাবাকে ভারতীয় বৌ দেখাতে নিয়ে গেল আমেরিকায়। গিয়ে শুনল, সেখানে লুজিয়ানায় স্টার্ক ব্রাদার্স নার্সারি নামে এক কোম্পানি রেড ডেলিশাস নামে এক জাতের আপেল ফলিয়ে তার পেটেন্ট নিয়েছে। এই রেড ডেলিশাস অতি উৎকৃষ্ট আপেল, যেমন কচকচে আর রসালো, তেমনি মিষ্টি। সেই নার্সারি থেকে কয়েকটা চারা কিনে এনে থানেদারে পোঁতা হল পরের বছর শীতে। গাছগুলো ভালোই বেড়ে উঠছে জানতে পেরে বছর পাঁচেক পরে ১৯২১ সালে মা ফ্লোরেন্স বড়দিনের উপহার হিসাবে ওয়াশিংটন থেকে পাঠালেন স্টার্ক ব্রাদার্সেরই পরের দিকে পেটেন্ট-করা গোল্ডেন ডেলিশাস প্রজাতির আপেলের একগুচ্ছ চারা। সেগুলোও পোঁতা হল থানেদারের বাগানে।
থানেদারের বাগান কয়েক বছর পরেই সুস্বাদু আপেল গাছে ভরে গেল। যেমন এর রং, তেমন এর স্বাদ। সিমলার সাহেবরা গপগপিয়ে খেতে লাগল দিশি আপেল। জাহাজ ভর্তি হয়ে রপ্তানি হতে লাগল অন্য দেশে। স্যামুয়েল আরও জমি কিনলেন। স্থানীয় লোকেরা আলু আর প্লামের চাষ ছেড়ে বাগান ভর্তি করে এই আপেলের চাষ করতে লাগল। হিমাচলী আপেল খেয়ে ধন্য ধন্য করতে লাগল সারা দেশের মানুষ। জাপান থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেল অনতিবিলম্বে।
গল্পটা এইটুকুই। ফিলাডেলফিয়ার 'স্টোকস অ্যান্ড প্যারিশ মেশিন কোম্পানি' পরে কিনে নেয় ওটিস এলিভেটর্স। স্যামুয়েল স্টোক্স হিন্দুধর্মে দীক্ষা নিয়ে সত্যানন্দ নাম নিয়ে আর্য সমাজে যোগ দেন ও থানেদারে পরমজ্যোতি মন্দির নামে এক মন্দির স্থাপন করেন। তাঁর স্ত্রী অ্যাগনেস স্টোক্স স্বামীকে অনুসরণ করে নাম নেন প্রিয়াদেবী। সত্যানন্দ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে এবং একমাত্র আমেরিকান হিসাবে ব্রিটিশ জেলে বন্দি হন, তাঁর জেলসঙ্গী ছিলেন লালা লাজপত রাই। মায়ের পাঠানো ১৯২১ সালের আপেলের চারাগুলো যখন থানেদারে পৌঁছায়, তখন সত্যানন্দ জেলে, সেই আপেলের চারা পুঁতেছিলেন প্রিয়াদেবী নিজের হাতে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই আমেরিকান প্রবাসীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৯২১ সালের কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টোতে একমাত্র অ-ভারতীয় হিসাবে তাঁর সই ছিল। তিনি অবশ্য স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে রেখে চৌষট্টিতম জন্মদিনের আগেই ১৯৪৬ সালের ১৪ই মে তাঁর মৃত্যু হয়।
সঙ্গের ছবিটি সত্যানন্দ ও প্রিয়াদেবীর, নেট থেকে সংগৃহীত।
৭ ডিসেম্বর ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন