বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

শ্রেণী ~ আর্কাদি গাইদার

সে এক সময় ছিলো বটে। তখন ফেসবুক, টিভি, কিছুই ছিলো না। রেডিও ব্যাপারটা অর্ধেক লোক চেনে না। সংবাদপত্র পড়বার মতন শিক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠের নেই। তখন যদিও নারী ছিলো। নারীদের লড়াই ছিলো। সম কাজে সম বেতনের দাবিতে লড়াই। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের দ্বারা হেনস্থাকে প্রতিহত করবার লড়াই। নারীদের ভোটাধিকারের লড়াই। নারীদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই। শিক্ষার অধিকারের লড়াই। অনেকেই জানেন না, বা ভুলে গেছেন হয়তো, রুশ বিপ্লবটা শুরুই হয়েছিলো ৮ই মার্চ, ১৯১৭ এর পেত্রোগ্রাদে মহিলা শ্রমিকদের মিছিল দিয়ে। International Working Women's Day র মিছিল। 

তারপর ভলগা থেকে গঙ্গা হয়ে বহু জল গড়িয়েছে। এর মধ্যে Working টা বাদ পড়ে গিয়ে International Women's Day হয়ে গেছে। আমরা পুরনো প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণা ত্যাজ্য করে নতুন করে ভাবতে শিখেছি। আমাদের শেখানো হয়েছে যে নারীর ক্ষমতায়নের মাপকাঠি হলো সে কতটা দক্ষতার সাথে অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভেঙে ক্ষমতার কাঠামো বেয়ে উঠছে, এবং স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে সাহায্য করছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন 'দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী'দের লিস্ট ছাপিয়েছে বছরের পর বছর। সেখানে স্থান পেয়েছেন পেপসিকোর সিইও ইন্দ্রা নুয়ী। কারন তিনি নারী হয়ে সেই কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরে পৌছাতে পেরেছেন, যারা এই দেশের মাটিতে পানীয় জলস্তরকে নিঃশেষ করেছে, হাজার হাজার একর জমিকে বিষিয়ে দিয়ে নষ্ট করেছ। স্থান পেয়েছেন হিলারি ক্লিন্টন। কারন তিনি আরেকটু হলেই হাতে পেতেন দুনিয়ার সবচেয়ে ভীতিপ্রদর্শক সামরিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, তার হাতে থাকতো মার্কিন পারমাণবিক শক্তি সমাহারের বোতাম, যা এতদিন ছিলো শুধু পুরুষদের কুক্ষিগত। স্থান পেয়েছেন বায়োকনের কিরণ মজুমদার শ, এবং তার পরেই তার খ্যাতির জৌলুষ নিয়ে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাড়িয়েছেন। স্থান পেয়েছেন অরুন্ধুতী ভট্টাচার্য্য, যিনি স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান থাকাকালীন রিলায়েন্সকে বানিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের প্রমোটার, আর রিটায়ারমেন্টের পরেই রিলায়েন্সের ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা হাততালি দিচ্ছি, কারন স্বাধীন ভারতের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ভরা বাজার, যা এতদিন ছিলো শুধু অবাঙালি পুরুষদের কুক্ষিগত, সেখানে মাথা উচু করে প্রবেশ করেছেন একজন বাঙালি নারী।

না, ফোর্বসের এই লিস্টে স্থান পাননি জগমতি সাংগোয়ান, যিনি বছরের পর বছর গোবলয়ের খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। স্থান পাননি সোনি সোরি, যার সারা শরীরে পুলিশ লিখেছে সন্ত্রাসের উপকথা, আর যার মুখে এসিড ছুড়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে দেশভক্ত নাগরিক। স্থান পাননি দীপিকা সিং রাওয়াত, যিনি নিজের পেশায়, নিজের পরিসরে, নিজের সমাজে সম্পূর্ন একা হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একটি আট বছরের শিশুকন্যার বিধ্বস্ত লাশের হয়ে। স্থান পাননি অংগনওয়াড়ি কর্মীদের বহু বছরের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া ডাক্তার হেমলতা। কারন এনারা কেউই সেই অমোঘ কাঠামোর অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভাঙতে পারেননি হয়তো। আমরা তো তাই শিখেছি, আসল ক্ষমতায়ন তো সেইখানেই - যখন কাঠামো আপন করে নেয় প্রান্তিক পরিচিতিকে, যখন 'মুসলমান' কালাম রাষ্ট্রপতি হন, যখন 'নারী' অরুন্ধুতী ডিরেক্টর হন, যখন 'কালো' ওবামা প্রেসিডেন্ট হন, যখন আমাদের শেখানো হয় 'বাঙালি' প্রধানমন্ত্রী তোমার চাহিদা, কারন তুমি বাঙালি - আর কাঠামো বলে - দেখো, ক্ষমতায়ন একেই বলে, পরিচিতির স্বীকৃতি আমার থেকে ভালো আর কে দিতে পারবে?

আর চারিদিকে এই হিন্দু, মুসলমান, বং, গুজ্জু, খোট্টা ইত্যাদি আইডেন্টিটির ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যেতে থাকেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মানেক হোমি আর জামশেদজি টাটার ভাইপো, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং এমপি সাপুরজি সাক্লাতওয়ালা, দুই পারসি কমিউনিষ্ট, যারা একইসাথে ডান্ডিতে আর জামশেদপুরে লেবার ইউনিয়নের স্ট্রাইক শুরু করেছিলেন, পারসি মালিকানার টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে। হারিয়ে যায় তাদের পারসি পরিচিতি, যেমন হারিয়ে যায় সেই লোকটির পরিচিতি যাকে টাটারা জামশেদপুরে নিয়ে এসেছিলো 'প্র‍্যাগম্যাটিক' ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসেবে এবং যিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটিয়ে স্ট্রাইক ভেস্তে দেন। হারিয়ে যায় টাটাদের ভরসার সেই দুর্দান্ত তরুন নেতা সুভাষ চন্দ্র বোসের 'বাঙালি' পরিচিতি। পারসি, বাঙালি, ভারতীয়, ব্রিটিশ সব ছাপিয়ে একটাই পরিচিতি মূখ্য হয়ে ওঠে - শ্রেণী।

রাজনৈতিক দলের পুজোর বুকস্টলে ঘুরতে ঘুরতে দেখি স্টল সাজানো হয়েছে পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দিয়ে। রাজস্থানে শম্ভুলাল রেগারের হাতে আফরাজুলের খুনের খবর। সেইসময়কার শিরোনামের সাথে মেলাতে চেষ্টা করি - 'রাজস্থানে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হলো বাঙালিকে', 'রাজস্থানে খুন মুসলিম'। মেলাতে পারি না। খবরের কাগজের শিরোনাম গালে সপাটে থাপ্পড় মারে - 'রাজস্থানে আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হলো শ্রমিককে'। কেউ যেন মুখের সামনে চিৎকার করে - শ্রেণী, শ্রেণী, শ্রেণী। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর পাশ থেকে একজন প্রৌঢ়া বই ওলটাতে ওলটাতে মন্তব্য করে - রাজস্থানে দারুন ব্যাপার ঘটছে, বলো? ওরকম একটা গোবলয়ের অঞ্চলে কৃষকদের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের রাজ্যের লোক। উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘুরে দাড়াই, ভাবি বলবো - হ্যা, ভেবে দেখেছেন, একজন বাঙালি মুসলমান, হান্নান মোল্লা, তার নেতৃত্বে রাজস্থানের এতগুলো চাষী এরকম মারমুখী হয়ে নেমেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। যেন ম্যাজিক। 

কিন্তু বলবার আগেই থেমে যাই, নিজেকে শুধরে নিই। ম্যাজিকের কি আছে এতে? পরিচিতির ভরাবাজারে যাকে যাদুমন্ত্র মনে করছি - শ্রেনী, শ্রেনী, শ্রেনী! - আসলে একমাত্র সেই পুরনো সাবেকি unfashionable ব্যাপারটাই তো বাস্তব। বাকিটাই আমাদের বোকা বানানোর ম্যাজিক।

সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

নেতাজী, বাড়ি আছো? ~ রজত শুভ্র বন্দোপাধ্যায়

নেতাজী, বাড়ি আছো?
"জয় হনুমান" ফেলছে না আর সাড়া,
হঠাৎ দ্বারে তেনার কড়া নাড়া – 
নেতাজী, বাড়ি আছো?

হুশপুশিয়ে বাড়ছে তেলের দাম,
গৌসেনাদের চিৎকারে হাড় হিম,
শুকিয়ে যাচ্ছে শ্রমিক, চাষীর ঘাম,
মাথায় ধরে ঝিম –
নেতাজী, বাড়ি আছো?

দিন চলে যায়, বেড়েই চলে ক্লেশ,
লোন বাগিয়ে সবাই যে দেশ ছাড়া,
জমাট দেহে আবছা ঘুমের রেশ,
সহসা কড়ানাড়া - 
নেতাজী, বাড়ি আছো?

( ২২-১০-২০১৮)

.

[With due apologies to Shakti Babu]

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮

ফুটবল মাঠ ~ অর্ক ভাদুড়ী


একটা ফাঁকা ফুটবল স্টেডিয়ামে বসে থাকার কথা কথা বলেছিলেন এডুয়ার্দো গালিয়েনো। খেলা শুরুর সময় সেন্টার লাইনের মাঝখানে ঠিক যেখানটায় বল রাখেন রেফারি, সেখানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে বলেছিলেন। মনখারাপের দিনে আমি এমন বসে থেকেছি, বহুবার। বাবা মারা যাওয়ার দিন বসেছি, প্রেমিকা চলে যাওয়ার দিন বসেছি। প্রিয়তম মানুষকে ছেড়ে আসার পর, বড্ড বেশি ঠকে যাওয়ার পর, বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার পর— বসেছি। যেদিন শেষবারের মতো বেরিয়ে এলাম পার্টি অফিস থেকে, গলি পেরনোর পর শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম রংচটা প্রাণের নিশান, সেদিনও বসেছি। ফাঁকা স্টেডিয়ামের মাঝমাঠে বসলে মনে হয়, মাটি থেকে উঠে আসছে মায়ের আঁচলের মতো গন্ধ। মাটি মাটি, বিকেল বিকেল। সেই গন্ধ আমায় ছেড়ে যাবে না কখনও। আমিও যাব না তাকে ছেড়ে।
দু'পাশে দু'টো গোলপোস্ট, জাল নেই। হাজার হাজার চেয়ার, শব্দহীন। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। উল্লাস-কান্না-গালাগালি কিচ্ছুটি নেই। একটা আস্ত ফাঁকা স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে আমি বসে থেকেছি, একা।
ফুটবল ঠিক যেন মরে যাওয়া বাপমায়ের মুখ, যে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। আমি ধর্ম বদলে ফেলতে পারি, মতাদর্শ বদলে ফেলতে পারি, নাম বদলে ফেলতে পারি, দেশ-বাড়িঘর-প্রেম-সম্পর্ক সবকিছু বদলে ফেলতে পারি, শুধু প্রিয় ফুটবল দলের নাম বদলায় না কখনও। বদলানো যায় না। ফুটবল রক্ত-ঘাম-হাড়েমাংসে মিশে যায়।


আমার দাদু আর দিদা একে অন্যকে প্রথম দেখেছিল মনুমেন্টের নীচে। চল্লিশের দশক। রশিদ আলি দিবসের মিছিল ফেরত দিদাকে উয়াড়ি ক্লাবের প্র্যাকটিশ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দাদু যখন প্রথম দেখে, তখন ময়দান জুড়ে নেমে এসেছে কনেদেখা বিকেল। তারপর মেঘে মেঘে বেলা বেড়েছে। মোহনবাগানের খেলা থাকলে কমিউনিস্ট পার্টির কার্ড হোল্ডার আমার দাদু মাঠে যাওয়ার আগে ঠাকুরঘরে ঢুকত একবার। সেদিন সকাল থেকে উচাটন। উল্টো করে বিড়ি ধরত, তাতে মোহনবাগানের শনি কেটে যায়। শুনেছি, ফুটবলের মাঠ থেকে ছেলেরা ঢুকে পড়ত ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে। পুলিশ তাড়া করত, ঘোড়সওয়ার পুলিশ।

শুনেছি, দেশভাগ। শুনেছি, দাঙ্গা। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের বাড়ির আশেপাশে তখন গোপাল মুখার্জির রাজত্ব। ইতিহাস যাঁকে মনে রেখেছে গোপাল পাঁঠা নামে। অনেক পরে গোপালবাবু সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, ওঁর ঈশ্বর ছিলেন সুভাষচন্দ্র আর মন্দির মোহনবাগান। তখন অবশ্য সকলেই প্রায় মোহনবাগান। এগারোর স্মৃতিতে ভর করে ওড়ে স্বাধীনতার বিজয়কেতন। দাদুর বন্ধু নাসিমসাহেব মহামেডান ক্লাবের কর্তা ছিলেন। ইস্টবেঙ্গল তখনও সে অর্থে বড় দল নয়। দেশভাগের পর আচমকা বদলে গেল শহরটা। অদ্ভূত ধরণের বাংলা বলা হাজার হাজার লোক ভিড় করল শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশনে। আগে শহরে বাড়িওয়ালারাই তোয়াজ করতেন ভাড়াটিয়াদের। এবার ভাড়া পাওয়ার মতো বাড়ি মেলাই হয়ে উঠল দুষ্কর! কোথায় যাবেন এত মানুষ! কোথায় মাথা গুঁজবেন! শহরের আদি বাসিন্দাদের একাংশের অনুযোগ, লাখ লাখ উদ্বাস্তুর ভিড় শহরটাকে নোংরা করে তুলছে। কথাটা মিথ্যেও তো নয়। যে মানুষের থাকার জায়গা নেই, যাকে সাত পুরুষের ভিটে থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, সে শুরু করল জবরদখল। বাগানবাড়ি, ফাঁকা জমি, খালপাড়— সব। হাতে হাতে বসতি গড়ে উঠল। জঙ্গল সাফ হল। তৈরি হল দরমার বেড়া দেওয়া স্কুলঘর। সন্ধ্যা গড়ালে সেই দাওয়ায় আড্ডা বসল— 'আমাদের পুকুর আছিল, পুকুরে মাছ আছিল, বাগান আছিল! কত গাছ, কত গরু, কত দুধ! আর এখন……।' কেউ বিশ্বাস করে না সে সব কথা। হাভাতের প্রলাপ। অফিসকাছারিতে খিল্লি হয়। কয়েকজন বুদ্ধিমান আগে থেকেই আঁচ বুঝে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে ঠাঁই পেয়েছে ভদ্রপাড়ায়। তাদের মুখেও মাঝেমধ্যে ফেলে আসা ঐশ্বর্যের গল্প। সে নিয়ে হাসাহাসি। ভাষাটাও যেন কেমন! খিল্লি। এই সব শুনে গজরাতে থাকা বরিশালের মানুষ, ঢাকা, বিক্রমপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফেনি, রংপুরের মানুষ ফুটবল ময়দানে ঢুকে পড়ল। সুরেশ চৌধুরির ক্লাবের হয়ে গলা ফাটাল। গালাগালি দিল। রোজকার জীবনের হাজার না-পাওয়া মুছিয়ে দিল লাল-হলুদ জার্সির নায়করা। জন্মের কয়েক দশক পর নতুন করে জন্মাল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।


ফুটবলের ঠিক কত শতাংশ ওই চৌকো মাঠটায় খেলা হয়? জানি না। সেন্টার লাইন পেরিয়ে, কর্ণারের দাগ পেরিয়ে ফুটবল ঢুকে পড়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। ফুটবল এই দুনিয়ার সব হেরে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার অভিজ্ঞান। কখনও কখনও মৃত্যুরও বটে। সাদা চামড়ার তাড়া খেয়ে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে পালাতে পালাতে রঙিন মানুষেরা একটা আস্ত ফুটবল দর্শনের জন্ম দিতে পারে। দুনিয়া কাঁপানো বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যের সঙ্গে ফুটবল খেলা যায়। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের ছেলে ঘাস উঠে যাওয়া এক টুকরো জমিতে ড্রিবল করতে করতে টপকে যায় তার স্কুলে না যাওয়া শৈশব, প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার ক্ষত। যে ছেলেটির চাকরি চলে গিয়েছে, যে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায় প্রিয় দলের গোলে। মানুষকে মেরেও ফেলে ফুটবল। পুড়িয়ে পুড়িয়ে আংরা করে দেয় তাকে।
মনে করুন উরুগুয়ের কিংবদন্তী আবদিয়ন পোর্তেকে। আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগের কথা। ১৯১০ সাল। পোর্তে খেলতেন মাঝমাঠে। প্রথম বছর কোলন ক্লাব। সেখানে এক বছর কাটিয়ে লিবের্তাদ ক্লাবে। তারপর ১৯১১ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত একটানা নাসিওনাল ক্লাবে। ১৯১৭ সালে সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা উরুগুয়ের অন্যতম নায়ক পোর্তেকে আদর করে সমর্থকেরা ডাকতেন 'এল ইন্দিও' বলে। ক্লাবের হয়ে ২০৭টি ম্যাচ খেলা, ১৯টি ট্রফি দেওয়া পোর্তের জীবনটা বদলাতে শুরু করল আঠেরো সালেই। সে বছর বুড়ো কিংবদন্তীর বদলি খুঁজে নিলেন কর্তারা। তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে পাঠিয়ে প্রথম দলে চলে এলেন আলফ্রেদো সিবেচি। বসে থাকতে থাকতে ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষক হয়ে গেলেন পোর্তে। ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীল করলেন, নিংড়ে দিলেন নিজেকে। লাভ হল না। ৪ মার্চ, ১৯১৮। শেষ ম্যাচ খেললেন নাসিওনালের হয়ে। দল জিতল ৩-১ গোলে। কিন্তু পোর্তে গোল পেলেন না। বুড়ো, বাতিল হয়ে যাওয়া ঈশ্বরের দিকে সমর্থকেরা টিটকিরি ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, 'ও এখন একটা কচ্ছপকেও কাটাতে পারে না।' মাথা নীচু করে সবকিছু মেনে নিলেন হেরে যাওয়া, শেষ হয়ে যাওয়া কিংবদন্তী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।


ম্যাচের পর অনেকগুলো ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। অবসন্ন, একা পোর্তে একটা ট্রামে উঠলেন। তখন মাঝরাত। গন্তব্য, এস্তাদিও গ্রাণ পার্কে সেন্ট্রালে— নাসিওনাল ক্লাবের তাঁবু। ক্লাব শুনশান, একটা আলোও জ্বলছে না। বাইরে বসে ঢুলছেন একজন সিকিউরিটি গার্ড। পোর্তে ধীর পায়ে মাঠের ঠিক মাঝখানে পৌঁছলেন। গালিয়েনো যেমন বলেছিলেন, তেমনই। বসে পড়লেন সেন্টার লাইনের মাঝখানে। মাথা নীচু। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলেন চুপ করে। তারপর পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন। মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপলেন।
গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। পরদিন সকালে স্টেডিয়ামে হাঁটতে এসেছিলেন সেভরিনো কাস্তিত নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁর কুকুরই প্রথম দেখতে পায় এল ইন্দিও'কে।


অনেক পরে গালিয়েনো লিখেছিলেন, 'ফুটবল মাঠই হল সেই জায়গা, যেখানে অতীত এবং বর্তমানের দেখা হয়ে যায়। তারা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরস্পরকে বুকে টেনে নেয়।'

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮

আড্ডা ও বাঙ্গালী ~ সমরেন্দ্র দাস


বহু চেষ্টা করেও ইংরেজিতে 'আড্ডা'র একটা জুতসই প্রতিশব্দ জোগাড় করা গেল না। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য আরও কয়েকধাপ এগিয়ে গোটা পৃথিবীর কোনও ভাষাতেই 'আড্ডা'র আদৌ কোনও প্রতিশব্দ আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে, পৃথিবীর অন্য দেশে আড্ডার মেজাজ নেই, বা থাকলেও তার জন্য যথোচিত পরিবেশ নেই। উন্নাসিক কেজো লোকেরা মনে করেন, যাঁরা কাজের মানুষ তাঁরা আড্ডা মারেন না, কিন্তু আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই যদি শুধু কাজের হয়ে উঠত তা হলে কী নিছক যান্ত্রিকতাতেই ভরে যেত না জীবন?

স্বয়ং রাজশেখর বসু আড্ডার অর্থ লিখেছেন 'কু-লোকের মিলনস্থান'। অথচ কে না আড্ডা মেরেছেন বলুন তো! আর যাঁদের কথা বলতে যাচ্ছি তাঁদের অকর্মণ্য কিংবা কু-লোক বলি এমন সাধ্য আছে কার?

বুদ্ধদেব বসু কি লিখছেন পড়ুন, "ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে আমি আত্মহারা। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পার্টির নামে দৌঁড়ে পালাই, কিন্তু আড্ডা!! ও-না হলে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে আড্ডার হাতেই আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে।"

আড্ডার ফসল মহাভারত!

মহাভারতের কথা ধরা যাক, একেবারে গোড়াতেই ব্যাসদেব জানাচ্ছেন– একদিন নৈমিষারণ্যে সারা দিনের কাজ শেষে মহর্ষিরা সবাই সমবেত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একটু আড্ডা মারছিলেন। হঠাৎ ঋষি লোমহর্ষণের ছেলে সৌতি এদিক সেদিক ঘুরে সেখানে এসে হাজির হলেন। তাঁর আবার বৈঠকি ঢঙে গল্প করার অভ্যেস। সুযোগ পেয়ে তিনিও বলে গেলেন তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা, আর মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে গেলেন বাকি সবাই। আড্ডা যখন ভাঙল দেখা গেল মহাভারতের আঠারোটা পর্বই নাকি বলা হয়ে গিয়েছে। ম্যারাথন আড্ডার ইতিহাসে এটাই সম্ভবত দীর্ঘতম।

এই ঘটনা থেকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তিনটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, এক, আড্ডার একটা ইতিহাস আছে এবং তা সুপ্রাচীন। দুই, শুধু বখাটে ছোকরা নয়, মুনি-ঋষিরাও আড্ডা দিতেন। তিন, আড্ডা থেকে মহাভারতের মতো মহাকাব্যও সৃষ্টি হতে পারে।

গ্রিসেও আড্ডা!

সত্যজিৎ রায় তাঁর 'আগন্তুক' ছবিতে কিন্তু আড্ডার উদ্ভাবনকে বাংলা বা ভারত ছেড়ে গ্রিসে নিয়ে গেছেন। তিনি মনে করেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিস দেশের অ্যাথেন্সের জিমনেসিয়ামে অনেক উন্নত মানের আড্ডা হত। সে যুগে অ্যাথেন্সবাসী একই জায়গায় শরীর ও মনের এক্সাসাইজ করতেন। ওই সব আড্ডায় আসর জমাতেন সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আর সেই আড্ডা থেকে সৃষ্টি হত উন্নত মানের শিল্পসাহিত্য ও  জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারনা।

রসদ-জোগানদার

প্রত্যেক আড্ডাতেই দু-একজন এমন থাকেন যাঁদের রসদ-জোগানদার বলা যেতে পারে। এঁরা হলেন আড্ডার প্রাণপুরুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং আড্ডার বিচারে নানা রসদ-জোগানদার পাওয়া যাবে। এঁদের কেন্দ্র করেই আড্ডা আবর্তিত হতে থাকে। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সময়ের ভিত্তিতে তাঁর দেখা সেরা পাঁচ রসদ-জোগানদারের নাম বলেছেন এই রকম – দাদাঠাকুর, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (বুড়োদা), নলিনীকান্ত সরকার, কাজী নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক বিশ্বপতি চৌধুরি। আড্ডার আসরে দাদাঠাকুরকে যিনি প্রত্যক্ষভাবে না দেখেছেন তিনি নাকি জীবনের একটা মধুরতম স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বুদ্ধিদীপ্ত সরস আলাপে অগ্রগণ্য প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন আলাপচারী শিল্পীদের রাজা। একই ভাবে বিদ্রোহী নজরুল আড্ডার আসরে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, তিনি নাকি তখন কড়িকাঠ ফাটানো হাসি হাসতেন।

আড্ডার স্থান-কাল-পাত্র, সঙ্গে আড্ডাবাজেরা

আড্ডার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কালের দরকার হয় না। যখন তখন যেখানে সেখানে আড্ডা শুরু হতে পারে। খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠে, পুকুর ঘাটে, নদীর ধারে, লেকের পাড়ে, চায়ের দোকানে, পার্কে গাছের ছায়ায়, বসার বেঞ্চে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, আড্ডা বসতে পারে। আবার আড্ডা হতে পারে বারান্দায়, ঘরের ভেতরে, ছাদের ওপরে, অফিসের কমন রুমে, কলেজের ক্যান্টিনে, খাওয়ার টেবিলে, হোটেলের লবিতে, রেস্টুরেন্টে, কফি শপে, বইয়ের দোকানে, পত্রিকা দপ্তরে, রঙ্গমঞ্চের পিছনে– কোথায় নয় বলুন তো?

বিশ্ব তো কোন ছাড়, গোটা ভারতে বাংলার মতো এমন আড্ডাস্থল ও আড্ডাবাজ কোথায়! এবারে কিছু সেরা আড্ডাস্থল ও আড্ডাবাজের হালহদিশ নিয়ে খোঁজখবর করা হল। এর পরেও বাকি থেকে গেল অসংখ্য আড্ডাস্থল, বাদ পড়ে গেলেন টেনিদা, ঘনাদা বা ব্রজদার মতো রসদ-জোগানদার এবং হাবুল, ক্যাবলা ও প্যালার মতো অগন্য চরিত্র। তাঁদের সবার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

বাড়ির আড্ডা

কলকাতার নানা বাড়ি আড্ডার সুবাদে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির 'দক্ষিণের বারান্দা'র কথা বলা যায়। সেখানে নানা ধরনের আড্ডা হত। রোটেনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ এই বারান্দাতেই।

বঙ্গীয় কলা সংসদের আড্ডা বসত অবনীন্দ্রনাথের বৈঠকখানায়। কখনও চৈতন্য লাইব্রেরিতে।  সেখানে আসতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাপ্রসাদ-সহ সমসাময়িক প্রায় সকল শিল্পী। এই বৈঠকি আড্ডার কোনও সময় ছিল না। নন্দলাল বসুর হাতিবাগানের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসতেন তত্কালীন নামী–দামি প্রচুর শিল্পী। ১৯১৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত হেমেন্দ্রকুমার মজুমদারের উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতেও চিত্রশিল্পীদের একটি আড্ডা গড়ে উঠেছিল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের বাড়ির প্রতি রবিবারের আড্ডায় হাজির হতেন কলকাতার বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, প্রবীন ও নবীন সাহিত্যিক দল। বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটা থেকে শুরু হয়ে তিনটে-সাড়ে তিনটে অবধি গড়াত সেই আড্ডা।

কালীঘাটে সদানন্দ রোডে থাকতেন কবি অরুণ মিত্র। তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আড্ডার আসর বসত। নিয়মিত আসতেন বিজন (গোষ্ঠ) ভট্টাচার্য। গৃহকর্তা সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন তাঁর বড় মামা। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এই আসরে এসেছেন অনেকেই। যেমন, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, গোপাল ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। ততদিনে 'অরণি' পত্রিকার প্রকাশ ঘটে গেছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, রাম বসু, সিদ্ধেশর সেন-এর মত কবিরা। পরবর্তীকালে এই আড্ডা ৪৬, ধর্মতলা স্ট্রিটে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের দপ্তরে সরে যায়। এখানে মাঝে মধ্যে আসতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় সেহানবিশ, সুধী প্রধান প্রমুখ। ধর্মতলার অফিস থেকে বেরিয়ে অরুণ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিজন ভট্টাচার্য, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা বাড়ি ফেরার পথে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে বসেও আড্ডা দিতেন। চলত যৌথ গান। পরবর্তীকালে অরুণ মিত্রদের সদানন্দ রোডের এই বাড়ি গণনাট্য সংঘের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।        

রবি ঘোষের বাড়ি ছিল একটা ছোটখাটো আড্ডার বাজার। সেখানে নিয়মিত আসতেন শর্মিলা ঠাকুর-সহ নানা রসিকজন। আড্ডা দেওয়ার ব্যাপারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মন। একসময় প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই নাকি তাঁর বাড়িতে ম্যারাথন আড্ডার আসরে বসতেন 'এক্ষণ' পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, আই পি টি-র নির্মল ঘোষ, অভিনেতা রবি ঘোষ প্রমুখ।

প্রথমে লেক অ্যাভিনিউ, পরে ৩ লেক টেম্পল রোড এবং একেবারে শেষে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। বাড়ি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়ির আড্ডারও স্থানবদল হয়েছে। রবিবার সকালের রায়বাড়ির আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। আসতেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, ডি জি কিমারের বেশ কিছু সহকর্মী, অমল সোম, কালীকিঙ্কর রাহা, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, অশোক বসু, সৌমেন্দু রায়, পূর্ণেন্দু বসু, নিমাই ঘোষ, দুলাল দত্ত, টিনু আনন্দ, রবি ঘোষ, তপেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। প্রতি রবিবারে না হলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাসে অন্তত দুটি রবিবারে আসতেন। এই আড্ডার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়। সস্ত্রীক আসতেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। কিছুদিন এসেছেন ও সি গাঙ্গুলি কিংবা হরিসাধন দাশগুপ্তও। সকাল নটা-সাড়ে নটা থেকে শুরু হওয়া আড্ডা গড়াত বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত। সেখানে শুধু যে গুরুগম্ভীর আলোচনা হত তা কিন্তু নয়, কামু মুখোপাধ্যায় বা রবি ঘোষের হালকা রসিকতা উপভোগ করতেন স্বয়ং সত্যজিৎ থেকে শুরু করে বাকি সবাই। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আসত সুরভিত দার্জিলিং চা, ডালমুট ও বিস্কুট। কখনও শিঙারা বা চপ। অন্দর সামলাতেন বিজয়া রায় স্বয়ং।


মেসবাড়ি

কলকাতার আড্ডার ইতিহাস নানা মেসবাড়ির ভূমিকাও আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পশ্চিম কোণে 'সাকি' মেস। সেখানে থাকতেন মুকুল গুহ। তাঁর লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানে নাকি আড্ডার তাণ্ডবনৃত্য চলত। মেসে থাকতেন শিল্পী প্রতাপচন্দ্র চন্দ, খেলোয়ার অজয় দাশগুপ্ত, ভাষ্যকার শরদিন্দু দত্ত-সহ অনেকেই। ছন্নছাড়া অথচ আন্তরিক এই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন প্রসূন মিত্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর ঘোষ। আসতেন দেবব্রত বিশ্বাস (জর্জদা)ও।

মির্জাপুরে ত্রিপুরা হিতসাধিনী হলের পাশে একটি মেসবাড়িতে তেলেভাজা আর মুড়ি সহযোগে আড্ডায় হাজির থাকতেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোকুল নাগ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে। এই আড্ডাকে অনেকে বলতেন কল্লোলীয় আড্ডা।

পত্রিকা দপ্তর

ভাবা যায়, মানসী পত্রিকার অফিসে আড্ডা মারতেন নাটোরের মহারাজ জগদানন্দ রায়! আর আড্ডার মৌতাত জোগান দিতেন বিখ্যাত দুই রাশভারি ব্যক্তিত্ব – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আড্ডার দ্বিতীয় অধিবেশন নাকি হত নাটোরের রাজবাড়িতে। আর তা শেষ হতে হতে রাতের তৃতীয় প্রহর হয়ে যেত, যখন শহর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

পটুয়াটোলার লেনের একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ির একটি ছোট্ট ঘরে 'কল্লোল'-এর জন্ম এবং সেটাই ছিল আড্ডাঘর। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পবিত্র গাঙ্গুলি থেকে শুরু করে অনেকেই আসতেন সে আড্ডায়। তাছাড়া সমসাময়িক 'শনিবারের চিঠি'-র আড্ডার কথাও সর্বজনবিদিত। 'কল্লোল' ও 'শনিবারের চিঠি'- এই দুই আড্ডার রেষারেষি এক সময় নাকি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় তাঁর বাড়িতে দুই দলকে ডেকে সাহিত্যের প্রথম 'সামিট মিটিং'-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় 'কল্লোল'-এর আড্ডার কিছু কিছু হদিশ পাওয়া যায়।

'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে  সন্ধের দিকে আড্ডার আসর জমে উঠত। আসতেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কবিশেখর কালিদাস রায়, জগদীশ গুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, বন্দে আলি মিঞা, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, রাসবিহারী মণ্ডল, শক্তিপদ রাজগুরু, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস সরকার প্রমুখ। 'অর্থনীতি, সমাজনীতি, বেকারত্ব, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, গ্রহ-নক্ষত্র, স্বপ্নতত্ত্ব, ধর্ম ও দর্শন, চিত্রকলা, যাদুবিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান, ভূ-তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, মঞ্চ ও চিত্রাভিনয়, নারীপ্রগতি, বিবাহ ও লোকচরিত্র প্রভৃতি সবই ছিল আড্ডার আলোচ্য বিষয়; সঙ্গে কিছু টীকা-টীপ্পনি হাস্যরস।'

'যুগান্তর' পত্রিকা দপ্তরের কেন্দ্রমণি ছিলেন পরিমল গোস্বামী। আসতেন দাদাঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব) ইত্যাদি ব্যক্তিত্ত্ব। এইরকম পত্রিকা দপ্তরের আড্ডা হত আরও অনেক জায়গায়। যেমন, 'দৈনিক নবযুগ' পত্রিকায় কাজি নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত আড্ডার আসর।

কলেজ স্ট্রিটের একটা এঁদো বিশাল বাড়ির এক কোণের এক চিলতে ঘরে ছিল 'চতুষ্কোণ'-এর অফিস। দেয়ালের দিকে দুটি ছোট ছোট টেবিল, দুটো চেয়ার আর সামনে গোটা আটেক চেয়ার। এখানেও দারুণ আড্ডা জমত। আসতেন তত্কালীন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিকূল।

আড্ডা হত 'পরিচয়' পত্রিকা দপ্তরেও। থাকতেন বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, গোপাল হালদার, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখার্জি এবং পরবর্তীকাল দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ।

'কৃত্তিবাস'-কে ঘিরে একসময় উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। শক্তি-সুনীল-সন্দীপন-শ্যামল-দীপক-সমরেন্দ্র-শরৎ-ভাস্কর-বেলাল এবং আরও অনেক তত্কালীন তরুণ তুর্কীর সেই জমাটি আড্ডা তো ইতিহাস হয়ে থাকবে।

প্রকাশনা দপ্তর  

বিংশ শতকের প্রথমদিকে কলেজ স্কোয়ারের পিছন দিকে ছিল 'বুক-কোম্পানি' নামে এক বইয়ের দোকান। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে বই আসত এখানে। পেছন দিকে গুদামঘরে নতুন বইয়ের বিচিত্র গন্ধের মাঝে জাহাজ থেকে আসা বাক্স ভর্তি বই আর মেঝেতে ছড়ানো মোটা মোটা কাগজকে আসন বানিয়ে আড্ডা দিতেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কিংবা প্রমথ চৌধুরির মতো ব্যক্তিত্ব। বুক-কোম্পানির ভেতরের ছোট্ট একটা ঘরে আড্ডা দিতেন মালিক গিরিনবাবু, আনন্দবাজারের সুরেশচন্দ্র মজুমদার এবং আরও অনেকে।

মিত্র ও ঘোষের দোকানে আড্ডা দিতে আসতেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহারঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ। স্বয়ং গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয় তো থাকতেনই।

এম সি সরকারের দোকানের আড্ডার কথা অনেকেই জানেন। মধ্যমণি ছিলেন মালিক সুধীরচন্দ্র সরকার, বাইরে গম্ভীর প্রকৃতির হলেও অন্তরে তিনি ছিলেন শিশুর মতো। বহু শিল্পী ও সাহিত্যিককে সেখানে দেখা যেত। আসতেন প্রবাসী সম্পাদক কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, তুষারকান্তি ঘোষ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ কুমার সান্যাল, শিবরাম চক্রবর্তী, মনোজ বসু, ভবানী মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, সুশীল রায় এবং আরও অনেকে।

থিয়েটার

থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চের আড়ালে আড্ডা দিতেন অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়ি। সমাজের তাবড় হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গে সেই আড্ডার দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে আসতেন স্বয়ং শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। আড্ডাধারীদের কাছে শিশিরকুমারের পরিচয় ছিল সুধাদা নামে। শোনা যায়, শরত্চন্দ্রের ইচ্ছে ছিল বিস্ময়কর ও বিচিত্র ব্যক্তিত্বের সুধাদার চরিত্র অনুসরণে কোনও সাহিত্য সৃষ্টির।   

পরবর্তীকালে নাট্যকার ও পরিচালকদের আড্ডা বসত শ্যামবাজারের মোড়ে পবিত্র পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে। আশেপাশের রিহার্সাল রুম থেকে রিহার্সাল সেরে বিভাস চক্রবর্তী কিংবা অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতো গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালকরা আড্ডায় আসতেন। নাটক নিয়ে আড্ডা হত।

রেষ্টুরেন্ট ও কফি হাউস

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস যেন আড্ডার মক্কা। কোন আড্ডাবাজ এখানে আড্ডা দিতে আসেননি সেটাই বিস্ময়ের। বছরের পর বছর ধরে বাঙালির আড্ডা-মানচিত্রে কফি হাউস এক ও অদ্বিতীয় হয়ে রয়েছে। এই আড্ডার একটা চিত্র দিই।

পঞ্চাশের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে জাঁকিয়ে বসে থাকতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, হিরণ সান্যাল, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। আরও কিছু পরে যুক্ত হলেন শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শঙ্কর দে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, উত্পলকুমার বসু, দীপক মজুমদার, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বেলাল চৌধুরি, অরবিন্দ গুহ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শেখর বসু, রমানাথ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নিখিল সরকার, সুব্রত চক্রবর্তী, ভাস্কর চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-সহ আরও অনেকে। এই সময়কার মহিলা আড্ডাবাজদের মধ্যে কৃষ্ণা মিত্র, মীনাক্ষী সরকার, সন্ধ্যা বসু, প্রণতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করা যেতে পারে। টেবিল ভাগাভাগি করে আড্ডা হত তখন। রবিবার বেলা ১০-১১টা নাগাদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আড্ডা দিতেন নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে। তাঁদের ওখানেই আসতেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তী কিংবা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

যাঁদের কথা লিখলাম এঁরা যে সবাই প্রতিদিন আড্ডায় আসতেন এমন নয়, তা ছাড়া কেউ কেউ হয়ত কলকাতার বাইরেও থাকতেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ মিললে তাঁদের এই তীর্থস্থান একবার ঘুরে দেখা চাই-ই চাই। এই ছিল আড্ডাবাজদের মনের অন্দরের কথা। আর সেই আড্ডার ধারা আজও অব্যাহত আছে।

রাধাপ্রসাদ গুপ্তের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৪৫-৪৬ সালে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে জমাটি আড্ডা বসত। এখানে লাঞ্চের সময় নিয়মিত ভাবে যাঁরা আড্ডা দিতে আসতেন তাঁরা হলেন – সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ নিয়োগি, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, কালিসাধন দাশগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যেন মৈত্র, সুভাষ ঘোষাল, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রনেন রায়, প্রতাপ রায়, জেড এইচ (বান্টি) খান প্রমুখ। মাঝে মধ্যে দেখা যেত পরিতোষ সেন, শুভো ঠাকুর, প্রদোষ দাশগুপ্ত, গোপাল ঘোষকেও। একটা টেবিলে নাকি নিয়মিত এসে আড্ডায় মাততেন তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারি-সহ সব বড় বড় আমলারা।

এই আড্ডা নিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লিখছেন, '.. সেই টেবিলে যে দুনিয়ার কত জিনিস নিয়ে কতরকমের আলোচনা হত তার কোনও ইয়ত্তা ছিল না। .. হলিউড আর বিলিতি ফিল্ম ছাড়া ইউরোপীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের আড্ডায় যে সব সে সময় কথাবার্তা হত তখন ভারতের অন্য জায়গায় বিদগ্ধ বাবুরা তা নিয়ে ভাবতেই শুরু করেন নি। .. ' ফিল্ম সোসাইটি তৈরির ভাবনা প্রথম সেখানেই শুরু হয়েছিল। 'দি রিভার' ছবির স্যুটিং চলাকালীন স্বয়ং জা রেনোয়া ওই আড্ডাস্থলে বারকয়েক আসেন। আসতেন মৃনাল সেন, অম্লান দত্ত, হামদি বে, গৌরকিশোর ঘোষ ছাড়াও রবি সেন, সমর সেন, অশোক মিত্র, শেখর চট্টোপাধ্যায়, উত্পল দত্ত প্রমুখ।

দেশপ্রিয় পার্কের 'সুতৃপ্তি', কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের 'বসন্ত কেবিন' কিংবা উত্তরের 'ফেভারিট কেবিন'-এ চায়ের কাপে তুফান তোলা আড্ডা জমত। আড্ডা হত দক্ষিণের 'স্যাঙ্গুভ্যালি'-তেও। সুতৃপ্তি-র রবিবারের সকালের চমৎকার আড্ডায় জমায়েত হতেন মূলত দক্ষিণ কলকাতায় থাকা লেখকরা। শংকর চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন প্রমুখ।

শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কাছে এসব ছিল নিজস্ব ভুবন। গড়িয়াহাটার মোড়ে 'পানিয়ন' বলে একটি রেস্টুরেন্টে জমাটি আড্ডার আসরে মধ্যমণি ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। আসতেন উত্পল দত্ত, রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, এন বিশ্বনাথন, শেখর চ্যাটার্জি। কমলকুমারের আকর্ষণীয় কথায় উঠে আসত শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস-ভূগোল ও আরও নানা বিষয়।

চা দোকান

কত অসংখ্য অকিঞ্চিত্কর চা-এর দোকানে যে কত মহান আড্ডা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একটা উদাহরণ।

কালিঘাট ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে এক চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন সাগরময় ঘোষ। দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন এমন অনেক সাহিত্যিক সেখানে জমায়েত হতেন নির্ভেজাল আড্ডার লোভে। যেমন, চেতলা থেকে বিমল মিত্র, ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকের অমৃত ব্যানার্জি রোড থেকে রমাপদ চৌধুরি, চারু অ্যাভিনিউ থেকে হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় আর ব্যতিক্রমী ব্যাঙ্কের কেরানি কিন্তু সাহিত্যানুরাগী বিশুদা ওরফে বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। আশ্চর্য হলেও যেটা সত্যি তা হল এই বিশুদাই ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। সন্ধে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে সবাই এসে হাজির হতেন সেখানে। আর রবিবারে নিয়মিত ভাবে আড্ডা বসত সকালবেলায়। সকালের আড্ডায় আসতেন শচীন বন্দ্যোপাধ্যায় বা স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

পার্ক

কলকাতার নানা পার্কে আড্ডা হত। এখনও হয়। একটা উদাহরণ দিই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমল কর আনন্দবাজার দপ্তর থেকে বেরিয়ে আগের মতো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে না গিয়ে তরুণ ও মধ্যবয়সি লেখকদের সঙ্গে কার্জন পার্কের সবুজ ঘাসের ওপরে বসে আড্ডা দিতেন। তার আগে কে সি দাশের চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া হত। বেশির ভাগ দিন বিমল কর নিজেই চায়ের দাম মেটাতেন। সেই আড্ডায় থাকতেন সমরেশ মজুমদার, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশু ঘোষ, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন, অভ্র রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, শেখর বসু, কণা বসু মিশ্ররা।

চিত্রশিল্পীদের আড্ডা  

পার্ক স্ট্রিটে বেঙ্গল ল্যান্ড হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন বা জমিদার সভার ঘরে ছবির প্রদর্শনীর পাশাপাশি নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত সুভো ঠাকুরের উদ্যেগে গঠিত 'ক্যালকাটা গ্রুপ'-এর ৫, এস আর দাস রোডের ঠিকানায় রথীন মৈত্র, প্রাণকৃষ্ণ পাল, নীরদ মজুমদার, প্রদোষকুসুম দাশগুপ্ত প্রমুখ শিল্পীদের আড্ডায় ভিড় করতেন শাহেদ সুহরাবর্দী, জন আকুয়িন, বিষ্ণু দে, বিনয় সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, স্নেহাংশুকান্ত আচার্য।

ধর্মতলার মোড়ে জি সি লাহার দোকানের উল্টোদিকে অধুনালুপ্ত 'নিউইয়র্ক সোডা ফাউন্টেন'-এ ছিল চিত্রী আর ভাস্করদের প্রাধান্য। শুভাপ্রসন্নের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে যে সেখানে নিয়ম করে আসতেন গনেশ পাইন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে এসেছেন মুস্তাফা মানোয়ার, সাহাবুদ্দিন, কামরুল হাসান। তাছাডা় তখনকার তরুন চিত্রীদের মধ্যে সেখানে নিয়মিত দেখা যেত রবিন মণ্ডল, সুহাস রায়, সুনীল দাসদেরকে। 'সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি'র সদস্যরা, ক্যালকাটা পেন্টার্সদের প্রায় সব সদস্যদেরই আনাগোনা ছিল এই ঠেকে।' অনিয়মিত ভাবে আসতেন অহিভূষণ মালিক, শ্যামল দত্তরায় কিংবা গৌরকিশোর ঘোষ।

আকাশবাণী

একসময় 'আকাশবানী'কে ঘিরে বিস্তর আড্ডা হয়েছে। তখন বাঙালির সাংস্কৃতিক  কর্মকাণ্ডের অন্যতম শরিক ছিল 'আকাশবানী' দপ্তর। কবিতা সিংহ জানাচ্ছেন, 'দাদাঠাকুর ছিলেন এই আড্ডার ধূমকেতু জ্যোতিষ্ক। এলেই মাত।'  সেখানে যাঁরা আসতেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন অন্তরাল এবং মঞ্চের সেলিব্রিটি। যেমন ধরুন, হীরেন্দ্রনাথ বসু, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বাণীকুমার, মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, সুরেশ চক্রবর্তী, কাজি নজরুল ইসলাম প্রভৃতি। আর এঁদের ডাকে মধ্যে মধ্যে আড্ডায় এসে হাজির হতেন পরিমল গোস্বামী, সজনীকান্ত দাস, নিরোদ সি চৌধুরি, এন কে জি, নলিনীকান্ত সরকারের মতো ব্যক্তিত্ব। এই আড্ডায় বসে গান বাঁধতেন নজরুল। নতুন নাটকের মহড়া দিতেন বাণীকুমার-বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। 'আর চলত পান আর চা। চা আর পান। চাপান-উতোর। উতোর-চাপান।'

আড্ডা দিতে দিতেই একদিন কেয়া চক্রবর্তীকে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়া হয় চার চরিত্রের একটি কাব্য নাটক। বিমল মিত্রকে দিয়ে গাওয়ানো হয় গান।

প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ হিসেবে চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখার্জি, অভিনেতা বিকাশ রায়, অতুল মুখোপাধ্যায়, সবিতাকুমার মিত্র মুস্তাফি প্রভৃতি এবং প্রোডিউসার হিসেবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভি জি যোগ, দীপালি নাগ চৌধুরি, লীলা মজুমদার প্রমুখ আসতেন। এঁরা এলে কাজের পাশাপাশি আড্ডাও হত। 'যুববাণী' দপ্তরে আড্ডা মারতে আসতেন তখনকার নতুন প্রজন্ম।

দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল চমত্কার 'পান' করতে পারতেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একদিন খুব বাজে (অকথ্য তেতো) চা এল। দীপ্তেন্দ্রবাবুর মন্তব্য ছিল এইরকম –

"যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই

যাহা পাই তাহা 'চা'ই-ই না।"

কৃতজ্ঞতাঃ কলকাতার আড্ডা (সমরেন্দ্র দাস সম্পাদিত)

(লেখাটি 'আজকাল সুস্থ' পত্রিকার অক্টোবর ২০১৫ সংখ্যায় কভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত হয়। কভার স্টোরির বিষয় ছিল 'আড্ডা'।)

মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১৮

পানি ~ ডা: রেজাউল করীম

সম্প্রতি একজন লিখেছেন যে "বাংলা ভাষায় জল কি করে যেন পানি হয়ে গেল"। আসলে পানি শব্দটি খাঁটি তৎসম শব্দ পানীয় থেকে এসেছে বলে শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন মহাশয় লিখেছেন। বাংলা ভাষা নিয়ে ছুৎমার্গ না করলেও বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে বিদেশী ভাষার পরিমান মাত্র ৭শতাংশ বলে ভাষাচার্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। ৩৩০০০ হাজার শব্দে তিনি মাত্র ২৫০০ বিদেশী শব্দ পেয়েছিলেন। 
অধুনা সমাজে প্রাত্যহিক সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার হয়েছে। তারা কেউ ধর্ম সাম্প্রদায়িক নন, ভাষা সাম্প্রদায়িক। আত্ম সচেতন বাঙালী তাই ভাষা নিয়ে সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে তথাকথিত মুসলমানী শব্দ যথাসম্ভব পরিহার করার চেষ্টা করছেন। এর ভালমন্দ বিচার করার ক্ষমতা ও রুচি কোনটাই আমার নেই। কিন্তু, তবু বলবো ভাষার ভেতর হিন্দু-মুসলিম খোঁজা একরকম পশ্চাদ-যাত্রা। মিশ্র শব্দের ঐতিহাসিক যুক্তি আছে, তা অস্বীকার করা পুরোপুরি বোকামি।
একটা কাল্পনিক কথোপকথন উল্লেখ করে মিশ্র ভাষা নিয়ে আলোচনা করা যায়। 
-আনাজের দাম খুব বেড়েছে। বাজারে যেতে ভয় করে । কারখানায় লকআউট। বঙ্কিমবাবু টেবিল থেকে খবরের কাগজ খানা খুলে খুব মন দিয়ে শেয়ার বাজারের উঠানামা দেখতে থাকলেন।মাগ্গি-গণ্ডার বাজারে আখরোট কাঠের টেবিলটাও এবার বেচে দিতে হবে।  নাকের উপর চশমাখানা সেঁটে বেশ তরিবত করে খবরের আগাপাস্তালা খুঁজলেন। না: যতরাজ্যের বাজে ছাইপাঁশ কেচ্ছা, আসল খবরের নাম ও নিশান নেই। আরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেটা নিয়ে লেখ! তবে বুঝবো এলেম আছে! তা নয়, যতসব বেআক্কেলে বদমাশ!রান্নাঘর থেকে থলেটা নিয়ে সাইকেলে করে বাজারের দিকে চললেন। ফতেমা বিবির কাছে শাকটা কেনেন। আজ আর ইচ্ছা করলো না। পাউরুটির দোকানে গেলেন। সেখান থেকে গেলেন আনারস কিনতে। বালতিটা কদিন ধরে ফুটো হয়ে গেছে। মেথরটা নতুন বালতির কি ছিরি করেছে। বাজার হল। এবার আদালতে যেতে হবে। আইন কানুন জানে এমন একটা উকিল জোগাড় হয়েছে। মুসাবিদা তৈরী, শুধু দস্তখত বাকি। দেওয়ানী মামলা, দারোগা-পুলিশের ব্যাপার নেই, কিন্তু মহকুমা আদালতের মুন্সেফকে কব্জা করা যায় না। বঙ্কিমবাবু আলমারী খুলে তুরুপের তাসটি বার করতে গিয়ে আলপিনের খোঁচা খেয়ে খেই হারিয়ে তোশকের উপর বসে পড়লেন। 
এই কাল্পনিক কথোপকথনে কমপক্ষে পন্চাশটি বিদেশি ও মিশ্র শব্দ আছে। আর হ্যাঁ, কাকা, বাবা ও বিবি শব্দগুলি তুর্কি শব্দ। বাবু ফার্সি। বিদায় শব্দটি আরবী। বাবা শব্দটি আরবী থেকে তুর্কিতে প্রবেশ করেছে। বই শব্দটিও যতদূর জানি আরবী। সুনীতিবাবু বলেছেন বাংলা ভাষায় মাত্র ৪০টি তুর্কি শব্দ আছে, কিন্তু প্রতিটিই মোক্ষম।