মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫

বিধান রায় ও পথের পাঁচালী ~ কৌশিক মজুমদার

পয়লা জুলাই এলেই বিধান রায়ের জন্মদিনের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় ফিরে আসেন সত্যজিৎ রায়-ও। আর আসবেন না-ই বা কেন? এখন তো প্রায় সবাই জেনে গেছি সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পিছনে ভূমিকা ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়েরও। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বারবার উঠে এসেছে সেই আলোচনা। পত্র পত্রিকায়, প্রবন্ধে এমনকি বিখ্যাত কিছু মানুষের লেখাতেও যে সব তথ্য এই বিষয়ে উঠে আসে, তাদের সারসংক্ষেপ এই রকম -



১। বিধান রায় সংস্কৃতির ধার ধারতেন না। তাঁর কোন আইডিয়াই ছিল না সত্যজিৎ কী বানাতে যাচ্ছেন, বা বানিয়েছেন। এই ধারণার পিছনে আছেন দুইজন নামকরা সত্যজিৎ জীবনীকার। মারি সেটন লিখছেন, বিধান রায় নাকি ছিলেন "a man with no pronounced love of art and no knowledge of film as an expressive medium." অ্যান্ড্রু রবিনসন এককাঠি এগিয়ে বিধান রায় সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বই 'ইনার আই'তে লিখেছেন "from the beginning, misunderstood the film's nature, seeing it as a documentary."

২। সিনেমার টাকা দেওয়া হয়েছিল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের টাকা থেকে, কারণ সরকার নাকি সিনেমার নাম দেখে ভেবেছিলেন এটা রাস্তা বানানোর ডকুমেন্টরি ধরনের কিছু হবে।

৩। বিধান রায়ের ছবির শেষের করুণ পরিণতি অপছন্দ হওয়াতে তিনি সেটা বদলে দিতে বলেন। শুধু তাই না, দুর্গাকে নাকি বাঁচিয়েও দিতে বলেছিলেন। সত্যজিৎ নিজের গোঁ ধরে রাখেন। বাকিটা ইতিহাস।

৪। সরকার সত্যজিতকে পরিচালনা বাবদ কোনো টাকা দেয়নি। শুধু বানানোর অন্য খরচা দিয়েছিল।

৫। সরকারি আধিকারিকরা নাকি বারবার বলেছিলেন এ-ছবির প্রযোজনা না করতে। কিন্তু সত্যজিতের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ডাক্তার রায় তাঁদের কথা নস্যাৎ করে দেন।

সব কটা ভুল কথা।

নানা তথ্য এবং সত্যজিতের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ইত্যাদি খুঁটিয়ে পড়লেই আসল সত্য উঠে আসে। সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ ছন্দক সেনগুপ্ত মহাশয়ও একবার এই নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু এই মিথ এত জবরদস্ত, যে সেই জগদ্দলকে ঠেলে ফেলা মুশকিল।

একে একে আসি।

১। সত্যজিৎ রায়ের ছবি করা উচিৎ কি উচিৎ না এই নিয়ে বিধান রায়-কে যারা উপদেশ দেন, তাঁদের মধ্যে যে পি এস মাথুর ছিলেন (যিনি বারবার বলেছিলেন এই ছবি না করতে) তেমন ছিলেন মন্মথ রায়। এই মন্মথ রায় কালের কালবৈশাখীতে চাপা পড়ে গেছেন, কিন্তু তিনি না থাকলে পথের পাঁচালী আদৌ আলোর মুখ দেখত কিনা সন্দেহ। এই ভদ্রলোক ছিলেন বিখ্যাত নাট্যকার, সিগনেটের সত্যজিতের প্রচ্ছদের ভক্ত, আর বিভূতিভূষণের একনিষ্ঠ পাঠক। সিনেমার রাফ কাট দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। সিনেমা বা চিত্রনাট্য তিনি খুব একটা বুঝতেন না, তবুও তাঁর রিপোর্টে তিনি পরিষ্কার লেখেন "বিভূতিভূষণের উপন্যাসের প্রকৃতি যেন ছবিতে অবিকল রূপ পেয়েছে। আমি অভিভূত। আমার দেখে মনে হল এক মহান পরিচালক যেন তাঁর জীবনের সেরা মাস্টারপিসটি বানাতে চলেছেন।" মনে রাখতে হবে, এটা তিনি যখন লিখছেন তখন ছবির গোটাটা বানানোই হয়নি। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তো দূরের কথা। কিন্তু মাথুরের রিপোর্ট ছিল এর ঠিক বিপরীতে। ফলে বল চলে আসে সরাসরি বিধান রায়ের কোর্টে যার কিনা "সিনেমা নিয়ে কোনো ধারণাই ছিল না!"

বিধান রায় আর পঙ্কজ মল্লিক মিলে ছবির রাফ কাট দেখলেন। হ্যাঁ, বিধান রায় নিজে রাফ কাট দেখেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিক পরে স্বীকার করেন তিনি নিজেও ছবি নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না। কিন্তু এই রাফকাট দেখেই বিধানবাবু উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বোঝেন এই ছবির মেরিট আছে আর সরসরি মন্মথবাবুর উপদেশটাই মেনে নেন। রবিনসনের কথা তাই কতটা ভুল ভেবে দেখুন।

২। এবার ছবির টাকার কথা। ছবির টাকা আদৌ পি ডব্লু ডি থেকে আসেনি। এসেছিল লোকরঞ্জন শাখা থেকে। সত্যজিৎ নিজে ফোক ইসাকসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এ-কথা। 'মাই ইয়ারস উইথ অপু'-তে সত্যজিৎ জানাচ্ছেন তাঁর মায়ের বন্ধু বেলা সেন আর তাঁর মেয়ে অর্চনার সঙ্গে তিনি যখন বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান, বিধান রায় বলেন শেষটা একটু করুণ হয়ে যাচ্ছে না? তখন সত্যজিতের আগেই অর্চনা প্রতিবাদ জানিয়ে বলে "The ending is too well-known and very moving. There would be objections from the readers of the novel as well as from [the author's] family if the ending was changed in any way." ফলে আলোচনা সেখানেই শেষ। সত্যজিতের গোঁ ধরার প্রয়োজনই হয়নি।

৩। সিনেমার বাজেট ছিল ৭০০০০ টাকা, আর যে-কোনো সরকারি প্রজেক্টের মতো এটাতেও পরিচালকের টাকা ধরা ছিল, যেটা সেদিনের হিসেবে নেহাত কম না। ৩০০০ টাকা। ইসাকসনকেও সত্যজিৎ বলেছেন "since I was taking a very small salary", ফলে এই সিনেমায় সত্যজিতকে বিধান রায় এবং তাঁর সরকার একেবারে কিচ্ছু দেননি, এটাও ভুল কথা। যেটা সত্যজিৎ চেয়েও পাননি, সেটা হল ফরেন রাইট। আর সেখানে তাঁকে কিছুটা অন্ধকারে রেখেই সই সাবুদ করানো হয়। বিস্তারিত জানার জন্য ইসাকসনের সাক্ষাৎকারটি পড়ে দেখার অনুরোধ করছি, কিন্তু তাতে ডাক্তার রায়ের কোনো হাত ছিল না। আর, কান উৎসবে ছবিটা দেখানো হলেও সরকার সেখানে সত্যজিৎ-কে পাঠায়নি।

তাহলে এই ডকুমেন্টারির কথা কার মাথায় এল? বিধান রায় তো ভাবেননি। ভাবলেও অর্চনা দেবীর সঙ্গে আলোচনায় তাঁর সন্দেহ দূর হবার কথা। আসলে এই ধারণা হয়েছিল পশ্চিমা কিছু চিত্র সমালোচকের। তাঁর মধ্যে বসলে ক্রোথার-ও ছিলেন। তাঁরা শুরুতে ছবিটা ধরতেই পারেননি। নিজের সমালোচনায় এত বার বাংলার গ্রাম নিয়ে তথ্যচিত্র শব্দবন্ধ লিখে গেছেন যে তাঁদের পরে পশ্চিমা যাঁরাই লিখেছেন এই ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁদের মনে হয়েছে পশ্চিমের মতো এদেশেও বুঝি এই সিনেমাকে সবাই ডিকুমেন্টারিই ভেবেছিল। আদৌ তা না।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসের বাঁক বদলে দিয়েছিল যে সিনেমা, তার সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করা আজ খুবই জরুরি। আমি নিশ্চিত এই বিকৃত আলোচনায় দুই কিংবদন্তির কেউই খুশি হতেন না

বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

জরুরি অবস্থায় আরএসএস-এর আত্মসমর্পণ ~ দেবেশ দাস

বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৫শে জুন সংবিধান হত্যা দিবস হিসাবে পালন করা হবে, কারন ১৯৭৫ সালে ওইদিন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। জরুরি অবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আজকের বিজেপির উত্তরসুরী জনসঙ্ঘ নেতারা ছিলেন ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তথা আরএসএস-এর লোকও ছিলেন। কিন্তু, তার সাথে এটাও সত্যি কথা যে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র আরএসএস ও জনসঙ্ঘ নেতারাই সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেই ইতিহাসটা একটু জেনে রাখা দরকার।

জেলে ঢুকেই আরএসএস নেতারা মুক্তির খোঁজে

আরএসএস-এর প্রধান মধুকর দত্তারেয় দেওরস ওরফে বালাসাহেব দেওরস আটক হন ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন। তার সাথে গ্রেফতার হওয়া মহারাষ্ট্রের আরএসএস সংগঠক ভি এন ভিদে, গ্রেফতার হওয়ার মাত্র ১৫ দিন বাদে লিখলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবনকে - "সঙ্ঘ এমনকি দূর থেকেও সরকার বা সমাজের বিরুদ্ধে কিছু করেনি। সঙ্ঘের কর্মসূচীতে এ জাতীয় জিনিসের কোনও স্থান নেই। সঙ্ঘ কেবল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কিন্তু এসব ভিত্তিহীন হিসাবে প্রমাণিত। ...... আমি আপনাকে আটক সঙ্ঘ কর্মীদের মুক্তি দিতে অনুরোধ করছি।" দেওরসের পরামর্শ নিয়েই ভিদে নিশ্চয়ই এই চিঠি লিখেছেন।

আরএসএস প্রধানের ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি

ইন্দিরা গান্ধীকে মোট তিনটি চিঠি লিখেছিলেন দেওরস, হিন্দিতে। তিনটি চিঠি নয়দার এক প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতি প্রকাশন ছাপিয়েছে ১৯৯৭ সালে। প্রথম চিঠি ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে দিল্লীর লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার পর। দেওরস লিখলেন - "সপ্রেম নমস্কার, ১৫ই আগস্ট তারিখে দিল্লীর লালকেল্লায় রাষ্ট্রকে সম্বোধন করে আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তা আমি আকাশবাণীতে এই কারগার থেকে মন দিয়ে শুনেছি। আপনার ভাষণ সময়োচিত এবং উপযুক্ত আর এর জন্য এই চিঠি লিখতে আমি প্রবৃত্ত হয়েছি"। লালকেল্লার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী দেশকে গঠন করার নানা কর্মসূচীতে সাহায্য করার জন্য সমাজের সাচ্চা শক্তিগুলিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। দেওরস চিঠিতে লিখলেন - "১৫ই আগস্টে আপনার ভাষণে এই কাজে সমাজের সাচ্চা শক্তিগুলিকে নিজের নিজের ক্ষেত্র নিয়ে লেগে পড়া চাই বলে আপনি সমস্ত সমাজকে যে ডাক দিয়েছেন তা সময়োচিতই ছিল" । দেশের উত্থানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর এই দেশ গড়ার আহ্বানে সঙ্ঘ যুক্ত হতে চায় সে কথাই লিখলেন দেওরস - "দেশের উত্থানের জন্য সঙ্ঘের এই শক্তিকে যুক্ত করার আয়োজন হওয়া জরুরি"। চিঠি শেষ করেছেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করতে চেয়ে - "আপনি চাইলে, আপনার সাথে দেখা করতে আমার আনন্দই হবে"। ভাবুন, যার বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে দুই মাস আগেই আন্দোলন, তার সাথেই দেখা করার জন্য আরএসএস প্রধান ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন।

না, ইন্দিরা গান্ধী দেখা করতে চাননি, উত্তরও দেননি। অধৈর্য হয়ে উঠলেন দেওরস। কিন্তু কী উপলক্ষ্য করেই বা আবার চিঠি লিখবেন? আবার সুযোগ এসে গেল। একটি সুখবর এলো ইন্দিরা গান্ধীর জন্য। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর জেতা অবৈধ। ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্টে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে জেতাকে বৈধ ঘোষণা করে। এই রায় বেরোনোর মাত্র ৩ দিন পরে ইন্দিরা গান্ধীকে অভিনন্দন জানিয়ে দেওরস চিঠি পাঠালেন ১০ ই নভেম্বর, ১৯৭৫ - "সাদর নমস্কার, উচ্চতম আদালতের পাঁচ বিচারপতি আপনার নির্বাচনকে বৈধ ঘোষণা করেছেন বলে আপনাকে হার্দিক অভিনন্দন"। তিনি লিখলেন - "শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের ---------- আন্দোলনের সাথে সঙ্ঘের কোনও সম্পর্ক নেই"। জয়প্রকাশ নারায়ণ ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জরুরি অবস্থার আগে থেকেই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, যেদিন জরুরি অবস্থা জারি হয় সেদিনও জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দিল্লীতে বিশাল জমায়েত হয়েছিল। তিনি আরও লিখলেন -"আমার আপনার কাছে প্রার্থনা যে আপনি প্রকৃত পরিস্থিতি জানুন...... সঙ্ঘের সম্বন্ধে সঠিক ধারণা বানান ...... সঙ্ঘের কয়েক হাজার লোককে মুক্তি দিন।
 .........এটা করলে সঙ্ঘের লাখ লাখ স্বয়ংসেবকদের নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার শক্তি সরকারী এবং বেসরকারী পথে রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য কাজে লাগবে ও আমাদের সকলের ইচ্ছা অনুসারে আপনার দেশ সমৃদ্ধ হবে। পত্রের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম"।

১৬ই জুলাই, ১৯৭৬ ইন্দিরা গান্ধীকে দেওরসের তৃতীয় চিঠি- "সাদর নমস্কার, আমি আপনাকে আগেই দুটি চিঠি লিখেছি, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কোনও প্রাপ্তিস্বীকার বা উত্তর পাইনি। ওই চিঠিগুলিতে আমি আপনি ও অন্যান্য শীর্ষ নেতারা আরএসএস সম্বন্ধে যে অভিযোগগুলি করেছেন তার কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছি। অভিযোগগুলির ধরন একই এবং কোনদিন তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দেওয়া হয়নি। ...... আমি আপনাকে অনুরোধ করছি যে দয়া করে সঙ্ঘ সম্বন্ধে যে ভুল বোঝাবুঝি বিরাজ করছে তার ঊর্ধ্বে উঠুন, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করুন ও সঙ্ঘের উপর যে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছে তাকে তুলুন"।


জরুরি অবস্থায় আরএসএস সম্বন্ধে আইবি রিপোর্ট

জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) হেড অফিসে ভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে উচ্চপদে কাজ করতেন বিখ্যাত আইপিএস অফিসার টি ভি রাজেশ্বর, পরে তিনি আইবি-র ডিরেক্টর হয়েছিলেন। শেষ বয়সে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে 'ইন্ডিয়া, দি ক্রুসিয়াল ইয়ারস' নামে একটা বই লিখেছেন, তাতে বিভিন্ন সময়ে আইবি দপ্তরের কিছু গোপন তথ্য আছে। তাতে লিখেছেন- "জরুরি অবস্থার প্রবর্তনে দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এর প্রধান বাবাসাহেব দেওরস, নীরবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সাথে একটি সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং দেশে নিয়ম ও শৃঙ্খলা প্রয়োগের জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। ...... আইবি-র একজন সিনিয়র অফিসার আরএসএসের উচ্চস্তরের কিছু লোককে জানতেন এবং দেওরস সহ তাঁদের সাথে কয়েকটি বৈঠক করেছিলেন। দেওরস মিসেস গান্ধী ও সঞ্জয়ের সাথে দেখা করতে আগ্রহী ছিলেন, তবে এটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি"।

জরুরি অবস্থাকে কার্যত সমর্থন

ডি আর গোয়াল রচিত 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ' বইতে আছে যে বাবাসাহেব দেওরস-এর বক্তব্য ছিল যে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলে, ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করার প্রশ্নই উঠতো না।

আরএসএস-এর শাখাগুলিতে প্রতি সপ্তাহে একটা বক্তৃতা হয়, যাকে বলে 'বৌদ্ধিক'। আরএসএস-এর এক শীর্ষ নেতা বাবা ভিদে, এই সমস্ত বৌদ্ধিকগুলিতে তিনি জরুরি অবস্থার সমর্থনে বক্তৃতা করতেন। এবিভিপির প্রভু চাওলা, বলবীর পুঞ্জ ও শ্রেরাম খান্না হই হই করে ইন্দিরা গান্ধীর ২০ দফা কর্মসূচীতে নেমে পড়েন, ফলে তাদের আর জেলে ঢুকতে হয় না। আরএসএস-এর একনাথ রামকৃষ্ণ রানাডে একটা সংযোগ গড়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে, তাকে বলা হয় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথাবার্তা চালাতে।

উত্তরপ্রদেশে জনসঙ্ঘ ১৯৭৬ সালের ২৫শে জুন, জরুরি অবস্থার এক বছর পূর্ত্তিতে  ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করার কথা ঘোষণা করে এবং সরকার বিরোধী কোনও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য আবেদন করে। সেখানেই শেষ নয়, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে ৩৪ জন  জনসঙ্ঘের নেতা কংগ্রেসে যোগ দেন।     

আরএসএস-এ সাথে যুক্ত পুনের একটি মারাঠী দৈনিক 'তরুণ ভারত' সঞ্জয় গান্ধীর নামে একটি বিশেষ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশ করে। আরএসএস-এর হিন্দি মুখপাত্র 'পাঞ্চজন্য' ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে যুব নেতা হিসাবে সঞ্জয়ের উত্থানকে অভিনন্দন জানায়।

আরএসএস-এর মুচলেকা

১৯৭৬ সালের ৩০শে নভেম্বর, আরএসএস-এর মাধবরাও মুলে, দত্তোপন্ত থেনগাডি, মরোপন্ত পিংলে সহ ৩০ জনের উপর নেতা ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লেখেন যে আরএসএস-এর নেতা-কর্মীরা মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরোতে চান ও যদি তারা সকলে মুক্তি পান, তবে তারা জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করবেন। মাধবরাও মুলে ছিলেন আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক। তিনি, তখন আত্মগোপনে আছেন। ইন্দিরা গান্ধীর মিডিয়া উপদেষ্টা তখন ছিলেন এইচ ওয়াই সারদা প্রসাদ, তার পুত্র রবি বিশ্বেস্বরায় সারদা প্রসাদ পরে লিখেছেন যে তার পিতাই আরএসএস নেতাদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি কার্যকর করার দায়িত্বে ছিলেন।

মহারাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বাবা আদভ দেওরসের সাথে একই জেলে ছিলেন, তিনি নিজের চোখে যা দেখেছেন তা লিখেছিলেন- "বন্দীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা কোনও অঙ্গীকার বা স্মারকলিপি সই করতে প্রস্তুত কিনা। আমি নিজের চোখে দেখেছি যে বেশিরভাগ আরএসএস বন্দীরা তাদের সম্মতি স্বাক্ষর করছে"।


সুব্রম্মনীয়মের বক্তব্য
সেদিনের জনসঙ্ঘের এক সাংসদ ছিলেন সুব্রম্মনীয়ম স্বামী, ২০১৩ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তিনি 'দি হিন্দু' পত্রিকায় ১৩ জুন, ২০০০ জরুরি অবস্থা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন যাতে বলেন যে সেদিনের আরএসএস নেতাদের বেশিরভাগ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।  তিনি লিখেছেন -"অটল বিহারি বাজপেয়ী মহাশয় ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে পত্র লিখেছিলেন এবং তিনি তাঁকে দয়া করেছিলেন। সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না বলে লিখিত আশ্বাস দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ২০ মাসের জরুরি অবস্থার বেশীর ভাগ সময়ে বাজপেয়ী মহাশয় প্যারোলে মুক্ত ছিলেন"। 

মাধবরাও মুলের কাছে থেকে সুব্রম্মনীয়ম  জানেন যে আরএসএস-এর নেতা-কর্মীরা  মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেও,  সুব্রম্মনীয়মকে ছাড়া হবে না, কারণ তিনি বিদেশে ইন্দিরা ও সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, ইন্দিরার চোখে ভালো হওয়ার জন্য বাজপেয়ীই বিশ্বাসঘাতকতা করে সুব্রম্মনীয়মকে ধরিয়ে দিতে পারেন।  বাজপেয়ী সুব্রম্মনিয়মকে ধরিয়ে দিতে শাসক দলকে খবর দিয়েছিলেন কিনা, সেটা জানা নেই, কিন্তু এটা সত্যি যে সেই সময়ে বাজপেয়ী নিজে নিজেই একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র দফতের প্রতিমন্ত্রী  ওম মেহতার সাথে। সুব্রম্মনিয়মের ধারণা যে সেদিন বাজপেয়ী বলে এসেছিলেন যে তিনি আর আরএসএস-এর সাথে আর সম্পর্ক রাখবেন না, এবং তিনি সুব্রম্মনীয়ম স্বামী, মাধবরাও মুলে ও অন্যান্য আরএসএস কর্মীরা যারা তখনো আত্মগোপনে আছে, তাদের সমস্ত হদিস দিয়ে আসেন।  স্বাধীনতার আগে থেকেই বিশ্বাসঘাতকতা আরএসএস-এর রক্তে আছে।

পুরো রেফারেন্স 

১) Shah Commission of Inquiry – 1st Interim Report, page 25

(২) Shah Commission of Inquiry - 3rd Final Report, page 134

(৩) The Print, 25th June, 2020


(৫) Amit Shah, 'Dictorial Mindset Led To Emergency' , টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬ সে জুন, ২০২১;

(৬) Sushil Kumar Modi. 'A story that needs to be retold', ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৬শে জুন, ২০২১;

(৭) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 124-129

(৮) D R Goyal, 'Rashtriya Swayamsevak Sangh', Radhakrishna Prakashan, 1979, page 116

(৯) M. S. Golwalkar, 'We Or Our Nationhood Defined', Bharat Publications, Nagpur1939, page 32

(১০) M. S. Golwalkar, Bunch of Thoughts, Sahitys Sindhu Prakashana, 1966, page 59

(১১) M. S. Golwalkar, Bunch of Thoughts, Sahitys Sindhu Prakashana, 1966, pages 177-201

(১২) Partha Banerjee, 'In the belly of the beast', Ajanta Books International, 1998, page 155

(১৩) The Hindu, 6 March, 2018

(১৪) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 486-487

(১৫) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, page 66

(১৬) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; pages 227-228

(১৭) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; pages 225

(১৮) Bipan Chandra, 'In the name of democracy: JP movement and the emergency' Penguin, 2003, page 172

(১৯) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 488

(২০) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 117
(২১) मधुकर दत्ताराय देवरस (बालासाहेब देवरस), 'हिंदू संगठन और सत्तावादी राजनीति', जागृति प्रकाशन, नोएडा, 1997
(২২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019; page 493-494

(২৩) T V Rajeswar, 'India, The crucial years', Harper Collins, 2015, page 79

(২৪) D R Goyal, 'Rashtriya Swayamsevak Sangh', Radhakrishna Prakashan, 1979, page 124-125;

(২৫) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 47
(২৬) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023 page 67
(২৭) The wire, 29 June 2024
(২৮) PRAJAKTA R. GUPTE, "India:"The Emergency"and the Politics of Mass Sterilization", Education About ASIA, Volume 22, Number 3, Winter 2017, pp. 40-44

(২৯) T V Rajeswar, 'India: The crucial years', Harper Collins Publisher, India, 2015, page 79

(৩০) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023 page 79

(৩১) Bipan Chandra, 'In the name of democracy: JP movement and the emergency' Penguin, 2003, page 217-218

(৩২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 494-495;

(৩৩) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 181;

(৩৪) Subramanian Swamy, 'Unlearnt lessons of the Emergency', The Hindu, 13 June, 2000;

(৩৫) Ajaz Ashraf, 'Vajpayee, RSS cowered before Indira Gandhi: BJP can't ignore Swamy's account of the Emergency', Firstpost, June 25, 2015.
(৩৬) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 122
(৩৭) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 133
(৩৮) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 36-37
(৩৯) N P Ulekh, 'The untold Vajpayee: politician and paradox', Penguin 2017, page 83-84
(৪০) Coomi Kapoor, 'The Emergency: A personal story', Penguin, page 19
(৪১) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 183
(৪২) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 185
(৪৩) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 66
(৪৪) The Indian Express, 26 February 1977
(৪৫) A G Noorani, 'The RSS A Menac to India', Left Word, 2019, page 197;
(৪৬) The Times of India, 11 April 1977
(৪৭) The Indian express, 8 May 1977
(৪৮) The Times of India 13 February 1980

(৪৯) Neerja Chowdhury, 'How Prime ministers decide', Aleph Book Company, 2023, page 67

শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫

বিশ্ব রিফিউজি দিবস ও ফিলিস্তিন ~ অরিজিৎ মুখার্জী

"...𝘛𝘩𝘦𝘴𝘦 𝘰𝘱𝘦𝘳𝘢𝘵𝘪𝘰𝘯𝘴 𝘤𝘢𝘯 𝘣𝘦 𝘤𝘢𝘳𝘳𝘪𝘦𝘥 𝘰𝘶𝘵 𝘪𝘯 𝘵𝘩𝘦 𝘧𝘰𝘭𝘭𝘰𝘸𝘪𝘯𝘨 𝘮𝘢𝘯𝘯𝘦𝘳: 𝘦𝘪𝘵𝘩𝘦𝘳 𝘣𝘺 𝘥𝘦𝘴𝘵𝘳𝘰𝘺𝘪𝘯𝘨 𝘷𝘪𝘭𝘭𝘢𝘨𝘦𝘴 (𝘣𝘺 𝘴𝘦𝘵𝘵𝘪𝘯𝘨 𝘧𝘪𝘳𝘦 𝘵𝘰 𝘵𝘩𝘦𝘮, 𝘣𝘺 𝘣𝘭𝘰𝘸𝘪𝘯𝘨 𝘵𝘩𝘦𝘮 𝘶𝘱, 𝘢𝘯𝘥 𝘣𝘺 𝘱𝘭𝘢𝘯𝘵𝘪𝘯𝘨 𝘮𝘪𝘯𝘦𝘴 𝘪𝘯 𝘵𝘩𝘦𝘪𝘳 𝘥𝘦𝘣𝘳𝘪𝘴) 𝘢𝘯𝘥 𝘦𝘴𝘱𝘦𝘤𝘪𝘢𝘭𝘭𝘺 𝘰𝘧 𝘵𝘩𝘰𝘴𝘦 𝘱𝘰𝘱𝘶𝘭𝘢𝘵𝘪𝘰𝘯


𝘤𝘦𝘯𝘵𝘦𝘳𝘴 𝘸𝘩𝘪𝘤𝘩 𝘢𝘳𝘦 𝘥𝘪𝘧𝘧𝘪𝘤𝘶𝘭𝘵 𝘵𝘰 𝘤𝘰𝘯𝘵𝘳𝘰𝘭 𝘤𝘰𝘯𝘵𝘪𝘯𝘶𝘰𝘶𝘴𝘭𝘺; 𝘰𝘳 𝘣𝘺 𝘮𝘰𝘶𝘯𝘵𝘪𝘯𝘨 𝘤𝘰𝘮𝘣𝘪𝘯𝘨 𝘢𝘯𝘥 𝘤𝘰𝘯𝘵𝘳𝘰𝘭 𝘰𝘱𝘦𝘳𝘢𝘵𝘪𝘰𝘯𝘴 𝘢𝘤𝘤𝘰𝘳𝘥𝘪𝘯𝘨 𝘵𝘰 𝘵𝘩𝘦 𝘧𝘰𝘭𝘭𝘰𝘸𝘪𝘯𝘨 𝘨𝘶𝘪𝘥𝘦𝘭𝘪𝘯𝘦𝘴: 𝘦𝘯𝘤𝘪𝘳𝘤𝘭𝘦𝘮𝘦𝘯𝘵 𝘰𝘧 𝘵𝘩𝘦 𝘷𝘪𝘭𝘭𝘢𝘨𝘦 𝘢𝘯𝘥 𝘤𝘰𝘯𝘥𝘶𝘤𝘵𝘪𝘯𝘨 𝘢 𝘴𝘦𝘢𝘳𝘤𝘩 𝘪𝘯𝘴𝘪𝘥𝘦 𝘪𝘵. 𝘐𝘯 𝘵𝘩𝘦 𝘦𝘷𝘦𝘯𝘵 𝘰𝘧 𝘳𝘦𝘴𝘪𝘴𝘵𝘢𝘯𝘤𝘦, 𝘵𝘩𝘦 𝘢𝘳𝘮𝘦𝘥 𝘧𝘰𝘳𝘤𝘦 𝘮𝘶𝘴𝘵 𝘣𝘦 𝘥𝘦𝘴𝘵𝘳𝘰𝘺𝘦𝘥 𝘢𝘯𝘥 𝘵𝘩𝘦 𝘱𝘰𝘱𝘶𝘭𝘢𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘮𝘶𝘴𝘵 𝘣𝘦 𝘦𝘹𝘱𝘦𝘭𝘭𝘦𝘥 𝘰𝘶𝘵𝘴𝘪𝘥𝘦 𝘵𝘩𝘦 𝘣𝘰𝘳𝘥𝘦𝘳𝘴 𝘰𝘧 𝘵𝘩𝘦 𝘴𝘵𝘢𝘵𝘦..." – 𝑃𝑙𝑎𝑛 𝐷𝑎𝑙𝑒𝑡, 10𝑡ℎ 𝑀𝑎𝑟𝑐ℎ, 1948

আজ বিশ্ব রিফিউজি দিবস। পিঠে কাঁটাতারের দাগ লেগে থাকা মানুষগুলোকে মনে রেখে। যাতে আর কারো পিঠে কাঁটাতারের দাগ না লাগে কোনওদিন। ১৯৪৭-৪৮ সালে দেশভাগের দুটো ঘটনার একটায় আমরা ভুক্তভোগী। আর অন্যটা—ফিলিস্তিনের নকবা—সেইভাবে আমরা মনে রাখিনি কোনোদিনও, যদিও ফিলিস্তিনের মানুষ আমাদেরই মত ভুক্তভোগী। মনে রাখিনি তার একটা বড় কারণ সম্ভবতঃ প্রোপাগান্ডা—"আগ্রাসী আরব দেশগুলো আক্রমণ করেছিল সদ্যজাত ইজরায়েলকে, ইজরায়েল প্রতিরোধ করে, এবং ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রসংঘের ১৮১ নম্বর নির্দেশিকা অনুযায়ী তৈরী নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়..."

ছোট করে রাষ্ট্রসংঘের এই পার্টিশনের ফরমুলাটা লিখে দিই—ব্রিটেনের অধীনে থাকা প্যালেস্টাইন তিন ভাগে বিভক্ত হবে—৪২% অংশ নির্দিষ্ট হবে ৮,১৮,০০০ ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের নিজস্ব রাষ্ট্র হিসেবে, সেখানে থাকবে ১০,০০০ ইহুদী ইমিগ্র্যান্টও। ইহুদীদের নিজস্ব রাষ্ট্র তৈরী হবে ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনের ৫৬% এলাকা নিয়ে, সেখানে থাকবে ৪,৯৯,০০০ ইহুদী, যার বেশিটাই ইউরোপীয় ইমিগ্র্যান্ট এবং ৪,৩৮,০০০ ফিলিস্তিনি অধিবাসী। জেরুজালেম এবং সংলগ্ন এলাকা আন্তর্জাতিক সংস্থার হাতে থাকবে, মোটামুটি দুই লক্ষ অধিবাসীসহ (যাদের মধ্যে ইহুদী এবং ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা প্রায় সমান সমান)। বেন গুরিয়নের নেতৃত্বে জায়নিস্টরা চেয়েছিল ব্রিটিশ প্যালেস্টাইনের ৮০ শতাংশ এলাকা শুধুমাত্র ইহুদী বসবাসের জন্যে। রাষ্ট্রসংঘ তার চেয়ে কিছু কম দেয়। এই ফরমুলা মেনে নিয়েও বেন গুরিয়ন বলেছিলেন—

"𝘛𝘩𝘦 𝘢𝘤𝘤𝘦𝘱𝘵𝘢𝘯𝘤𝘦 𝘰𝘧 𝘱𝘢𝘳𝘵𝘪𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘥𝘰𝘦𝘴 𝘯𝘰𝘵 𝘤𝘰𝘮𝘮𝘪𝘵 𝘶𝘴 𝘵𝘰 𝘳𝘦𝘯𝘰𝘶𝘯𝘤𝘦 𝘢𝘯𝘺 𝘱𝘢𝘳𝘵 𝘰𝘧 𝘵𝘩𝘦 𝘓𝘢𝘯𝘥 𝘰𝘧 𝘐𝘴𝘳𝘢𝘦𝘭. 𝘡𝘪𝘰𝘯𝘪𝘴𝘮 𝘳𝘦𝘲𝘶𝘪𝘳𝘦𝘴 𝘵𝘩𝘦 𝘑𝘦𝘸𝘪𝘴𝘩 𝘱𝘦𝘰𝘱𝘭𝘦 𝘵𝘰 𝘣𝘦 𝘢𝘳𝘮𝘦𝘥 𝘢𝘯𝘥 𝘳𝘦𝘢𝘥𝘺, 𝘯𝘰𝘵 𝘰𝘯𝘭𝘺 𝘵𝘰 𝘥𝘦𝘧𝘦𝘯𝘥 𝘪𝘵𝘴𝘦𝘭𝘧 𝘣𝘶𝘵 𝘢𝘭𝘴𝘰 𝘵𝘰 𝘦𝘹𝘱𝘢𝘯𝘥. 𝘛𝘩𝘦 𝘣𝘰𝘶𝘯𝘥𝘢𝘳𝘪𝘦𝘴 𝘰𝘧 𝘡𝘪𝘰𝘯𝘪𝘴𝘵 𝘢𝘴𝘱𝘪𝘳𝘢𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘪𝘯𝘤𝘭𝘶𝘥𝘦 𝘴𝘰𝘶𝘵𝘩𝘦𝘳𝘯 𝘓𝘦𝘣𝘢𝘯𝘰𝘯, 𝘴𝘰𝘶𝘵𝘩𝘦𝘳𝘯 𝘚𝘺𝘳𝘪𝘢, 𝘵𝘰𝘥𝘢𝘺'𝘴 𝘑𝘰𝘳𝘥𝘢𝘯, 𝘢𝘭𝘭 𝘰𝘧 𝘊𝘪𝘴-𝘑𝘰𝘳𝘥𝘢𝘯 𝘢𝘯𝘥 𝘵𝘩𝘦 𝘚𝘪𝘯𝘢𝘪. 𝘞𝘦 𝘮𝘶𝘴𝘵 𝘦𝘹𝘱𝘦𝘭 𝘈𝘳𝘢𝘣𝘴 𝘢𝘯𝘥 𝘵𝘢𝘬𝘦 𝘵𝘩𝘦𝘪𝘳 𝘱𝘭𝘢𝘤𝘦𝘴. 𝘈𝘯𝘥 𝘪𝘧 𝘸𝘦 𝘢𝘳𝘦 𝘧𝘰𝘳𝘤𝘦𝘥 𝘵𝘰 𝘢𝘤𝘤𝘦𝘱𝘵 𝘱𝘢𝘳𝘵𝘪𝘵𝘪𝘰𝘯, 𝘸𝘦 𝘮𝘶𝘴𝘵 𝘢𝘤𝘤𝘦𝘱𝘵 𝘪𝘵 𝘰𝘯𝘭𝘺 𝘵𝘦𝘮𝘱𝘰𝘳𝘢𝘳𝘪𝘭𝘺. 𝘛𝘩𝘦 𝘱𝘢𝘳𝘵𝘪𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘳𝘦𝘴𝘰𝘭𝘶𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘸𝘪𝘭𝘭 𝘣𝘦 𝘥𝘦𝘵𝘦𝘳𝘮𝘪𝘯𝘦𝘥 𝘣𝘺 𝘧𝘰𝘳𝘤𝘦 𝘢𝘯𝘥 𝘯𝘰𝘵 𝘣𝘺 𝘵𝘩𝘦 𝘱𝘢𝘳𝘵𝘪𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘳𝘦𝘴𝘰𝘭𝘶𝘵𝘪𝘰𝘯 𝘪𝘵𝘴𝘦𝘭𝘧"

আর, ঠিক তাইই হয়েছিল ১৯৪৭-৪৮ সালে। রাষ্ট্রসংঘ ঠুঁটো জগন্নাথের মত তাকিয়ে থেকেছিল।

পরবর্তীকালে এই সময়ের সমস্ত ন্যারেটিভ রেকর্ড হয়েছে। ফিলিস্তিনি গ্রাম দের ইয়াসিনের মত একাধিক নাম পাওয়া যায় ইতিহাসে—আরব অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রচেষ্টার স্পষ্ট ডকুমেন্টেশন। তবুও আরব-ইজরায়েল কনফ্লিক্টের ইতিহাস বেশিরভাগ মানুষের মাথায় ১৯৬৭ সালে দাঁড়িয়ে, বড়জোর ১৯৪৮ সালের মে মাসে, যখন আরব আর্মি প্যালেস্টাইনে ঢোকে, আর তারপর সদ্যজাত ইজরায়েল নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে ইত্যাদি...এই প্রোপাগান্ডার তলায় চাপা পড়ে যায় নকবার ইতিহাস, প্ল্যান দালে, আর এই সবকিছুর পথপ্রদর্শক ফিলিস্তিনী "ভিলেজ ফাইলস"...

বিশ্ব রিফিউজি দিবসে তাই এই ভিলেজ ফাইলসের কথা লিখি—ফিলিস্তিনি উচ্ছেদের নীল নকশা।

এই নীল নকশার শুরু তিরিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে—ততদিনে হাগানাহ তৈরী হয়ে গেছে, ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেয়নেট চালিয়ে বিদ্রোহীদমনের (মানে গ্রামের সাধারণ মানুষ) ট্রেনিংও সারা। ১৯৩৭-৩৮ সাল নাগাদ হিব্রু ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর বেন-জায়ন লুরিয়া এক পরিকল্পনা তৈরী করেছিলেন—ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত সমস্ত গ্রামের খুঁটিনাটি বর্ণনা ধরে রাখার—যা পরে জায়নিস্টদের জমি দখলের কাজে সাহায্য করবে। ইহুদি জাতীয় তহবিল (জেএনএফ)—ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি স্থাপনের মূল হাতিয়ার—এই প্রকল্পকে সাদরে গ্রহণ করে। সেই সময়ে জেএনএফ-এর প্রধান ইয়োসেফ ওয়াইৎজের নেতৃত্বে স্বয়ং ফিলিস্তিনি চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে।

কী কী তথ্য ধরে রাখা হত এই ভিলেজ ফাইলসে? সমস্ত ভৌগোলিক তথ্য, যেমন গ্রামের অবস্থান, যোগাযোগের রাস্তা, জলের উৎস, জমির মান; সামাজিক-রাজনৈতিক তথ্য, যেমন জনগোষ্ঠীর গঠন, গ্রামপ্রধান (মুখতার), ধর্মীয় পরিচয়, গোত্র কাঠামো, প্রতিবেশী গ্রামের সাথে সম্পর্ক; অর্থনৈতিক তথ্য, যেমন আয়ের উৎস, চাষাবাদের জমি, ফলের বাগিচা, পশুসম্পদ, কারিগর, যানবাহন; জায়নিস্ট কলোনিয়ালিজমের প্রতি ভাবনা, যেমন ১৯৩৬ সালের ব্রিটিশ ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বিদ্রোহে সেই গ্রাম অংশ নিয়েছিল কিনা, কারা ছিল তার মধ্যে ইত্যাদি। এর মধ্যে, সেই বিদ্রোহে নিহতদের পরিবারের নাম বিশেষভাবে নথিভুক্ত করা হত। ইহুদি হত্যার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের তথ্যও আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হত। এছাড়া যোগাড় করা হত সামরিক তথ্যও, যেমন গ্রামে পাহারাদারের সংখ্যা, গ্রামবাসীদের কাছে থাকা অস্ত্রের ধরন ও গুণমান—যদিও সেই অস্ত্রের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য, আর যা ছিল তাও মান্ধাতার আমলের।

শেফেয়া নামের এক ইয়ুথ ভিলেজ—যুবকদের বোর্ডিং স্কুল—ছিল এই তথ্য সংগ্রহের ঘাঁটি। খানিকটা কোল্ড ওয়ারের সময়কার "স্পাই ভিলেজ"-এর মত—যেখানে ফিলিস্তিনি গ্রাম্য জীবনযাপনের ট্রেনিং নিত আরবী বলিয়েকইয়ে ইহুদী যুবকরা। এই শেফেয়া থেকেই তারা বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গ্রামে যেত, আরব অধিবাসীদের আতিথেয়তার ফায়দা নিয়ে এই সমস্ত তথ্য যোগাড় করত। এজরা ড্যানিনের হাতে এই প্রোজেক্টের দায়িত্ব আসার পর ক্রমশ: আরো ব্যাপক চেহারা নেয় ভিলেজ ফাইলস।

১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় (আচমকাই, অনেকটা ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্তের মতই), তখন এই ভিলেজ ফাইলস সরাসরি যুদ্ধপ্রস্তুতির কাজে লাগায় জায়নিস্টরা। প্রত্যেক গ্রামের জন্যে "ওয়ান্টেড" লিস্ট তৈরী হয়—১৯৩৬ সালের ফিলিস্তিনি বিদ্রোহে যুক্ত থাকা লোকজন, মুফতি হজ আমিন আল-হুসেইনির সমর্থক লোকজন, প্রকাশ্যে ব্রিটিশ এবং জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে কথা বলা লোকজনের নাম তো লিস্টে উঠতোই, এমনকি লেবাননে বেড়াতে গিয়ে থাকলে বা গ্রামের পঞ্চায়েত ধাঁচের কমিটির সদস্য হলেও এই তালিকায় নাম উঠে যেত…
১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর রাষ্ট্রসংঘের পার্টিশন প্ল্যান পাশ হয় জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে। আর এর পরেই অ্যাক্টিভেট হয় প্ল্যান সি, হিব্রু ভাষায় গিমেল—বাস্তবে যেটা প্যালেস্টাইনের এলাকা দখলের জন্যে তৈরী এর আগের দুটো প্ল্যানের মিশেল—স্পষ্টপভাষায় যেখানে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশিষ্ট লোকজন, ফিলিস্তিনি অফিসার এবং কর্মীদের "খতম" করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল ফিলিস্তিনি যানবাহন ব্যবস্থা, অন্যান্য পরিকাঠামো আর জীবনধারণের ব্যবস্থা ধ্বংস করার কথাও। আর বলা হয়েছিল গ্রাম দখলের কথা—যে কাজে এসেছিল ওই ভিলেজ ফাইলস।
আর, তারপর, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে আসে প্ল্যান দালে, যে প্ল্যানের একাংশ উদ্ধৃত করে এই লেখার শুরু। শ'য়ে শ'য়ে ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস করা হয়েছিল পরের কয়েক মাসে। দের ইয়াসিনের মত হত্যাকান্ড ঘটেছিল একাধিক। ভিলেজ ফাইলসের তালিকা ধরে গ্রামের পুরুষদের সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো হত—লোকাল ইনফর্মারদের মাথায় কাপড়ের থলি পরিয়ে আনা হত আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে। চিহ্নিত লোকগুলোকে ওই লাইনের গুলি করে মেরে দিত ইরগুন, হাগানাহ আর স্টার্ন গ্যাঙের খুনেরা। তারপর আগুনে পুড়তো গোটা গ্রাম। এই জ্বলতে থাকা ফিলিস্তিন থেকে উদ্বাস্তু হয়েছিল কয়েক লক্ষ মানুষ। নকবা। 

যার অন্যতম হাতিয়ার ভিলেজ ফাইলস।

আচ্ছা, গেস্টাপো আর এসএস-এর চেয়ে কোন দিক দিয়ে আলাদা এই ইরগুন, হাগানাহ বা স্টার্ন গ্যাং?

বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

ফিলিস্তিন ~ স্বাতী মৈত্র

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভাগের প্রস্তাব পাশ করে। ক্রমবর্ধমান ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ ও জায়নবাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবার এটাই ছিল তাঁদের সমাধান, যদিও ডেভিড বেন গুরিয়নের মতন জায়নবাদী নেতৃত্ব সেই সময় থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে এটা প্রথম ধাপ মাত্র। ততদিনে আমাদের পরিবারগুলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে, বহু মানুষ তখন উদ্বাস্তু। 

সে সময় পোস্ট-ওয়ার অর্ডারের সময়। জাতিসংঘ সব সামলে দেবে, এই প্রত্যয়ের সময়। 

নতুন দেশ ভারত ও পাকিস্তান যখন ১৯৪৮ সালে রিফিউজি ও সাম্প্রদায়িক হিংসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, কাশ্মীরে ১৯৪৭-৪৮ সালের প্রথম যুদ্ধ লাগিয়ে ফেলেছে, তখনই ফিলিস্তিনে জায়নবাদী শক্তিগুলো শুরু করে ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিন যুদ্ধ। আমাদের পরিবারগুলো তখন ক্যাম্পে, জবরদখল কলোনিতে। হয়তো খবর এসেছিল, হয়তো আসেনি, কিন্তু সেই সময়েই ফিলিস্তিনে উদ্বাস্তু হলেন অন্তত ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনবাসী, এক বিধ্বংসী হিংস্র শক্তির হাতে। এই ঘটনাকে বলা হয় নকবা, অথবা মহাবিপর্যয়। 

দেশভাগ শেষ হয়নি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ এটা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। মানচিত্রের ভাগ আমরাই চেয়েছিলাম, কিন্তু হাঁড়ি ভাগ হলেই যে নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়না, তা আমরা একবিংশ শতকে বসে ভালোই বুঝতে পারি। 

শেষ হয়নি নকবাও। তার ফল আরো অনেক বিধ্বংসী, ভয়ঙ্কর। সেখানে এক পক্ষের হাতে পরমাণু বোমা আর আরেক পক্ষের হাতে ক্রুড রকেট ও কয়েকটা কালাশনিকভ। আমরা অন্তত স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীন হয়নি ফিলিস্তিন। 

গাজার সাম্প্রতিক গণহত্যা পৃথিবীর প্রথম গণহত্যা নয়, কিন্তু এই গণহত্যা যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। হাসপাতালে বোমা, স্কুলে বোমা, রিফিউজি শেল্টারে বোমা, তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বোমা, আটা নিতে গিয়ে হত্যা, কোয়াড কপ্টার-স্নাইপার দিয়ে হত্যা, শিশুহত্যা, স্নাইপার দিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে শিশুহত্যা, ধ্বংসস্তূপে হত্যা, খাবার নিতে গিয়ে হত্যা, ওয়াইট ফসফরাস (টুইটারে ফিলিস্তিনিদের বক্তব্য অনুযায়ী) দিয়ে হত্যা, তাঁবুতে আইভি ড্রিপ-সহ কিশোরকে পুড়িয়ে হত্যা, খেতে না দিয়ে হত্যা, জ্বালানি না দিয়ে হত্যা, মাছ ধরতে না দিয়ে হত্যা, আরও কত কত রকমের হত্যা - এবং সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া - এটাই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। জাতিসংঘ একটা ইয়ার্কির নাম। 

ভারতবর্ষের মানুষ মানতে চান, না চান, ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতনে মিডনাইটস চিলড্রেনের মতন এক সূত্রে আমরা গাঁথা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা শুধু ফিলিস্তিনের নয়, আমাদের স্বাধীনতা। ফিলিস্তিন হারলে, নিঃশেষ হয়ে গেলে, ম্যাপ থেকে মুছে গেলে আমাদের হার, কারণ তা আন্তর্জাতিক আইনের হার, তৃতীয় বিশ্বের সুরক্ষা কবচের অন্তিম অন্তর্ধান, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ জয়। 

একদিকে স্বাধীনতা, অন্য দিকে মহাবিপর্যয়।

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

দেশদ্রোহী কারা? ~ অরিজিত গুহ



    ১৯২৮ সালের কংগ্রেসের কলকাতার অধিবেশন বসে পার্ক সার্কাস ময়দানে। বর্তমানে পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর সামনের যে রাস্তাটা সেই রাস্তা দিয়ে কংগ্রেসের অধিবেশনের মিছিল চলেছিল। রাস্তাটার নাম কংগ্রেস এগজিবিশন রোড আজও সেই কংগ্রেসের অধিবেশনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। 

     এই রাস্তা দিয়েই এক শীর্ণকায় ব্যক্তির নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল যোগ দিয়েছিল কংগ্রেসের সেই মূল মিছিলে। মিছিলটি বিশেষ একটি কারণে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কারন এর আগে কংগ্রেসের কোনো মিছিলে কলকারখানার শ্রমিক মুটে মজুরদের সেভাবে প্রতিনিধিত্ব ছিল না যা এই মিছিলের বিশেষত্ব ছিল। 

   এই অধিবেশনে মতিলাল নেহেরুর দ্বারা একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবটি ছিল ভারতের ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের। গান্ধীজি সেই প্রস্তাব সমর্থন করলেও জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বোস প্রভৃতি অল্প বয়সী নেতৃত্ব এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা বিকল্প একটি প্রস্তাব পেশ করেন যা ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী। শীর্ণকায় ব্যক্তিটির নেতৃত্বে যে মিছিলটি এসেছিল, সেই মিছিলের প্রতিনিধিরা এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীর প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ায়। শীর্ণকায় ব্যক্তিটির নাম মুজফফর আহমেদ। যিনি কাকাবাবু নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। 

    মূল প্রস্তাবটি সংখ্যাধিক্যের জোরে একটি সংশোধনী সহ পাস হয়ে গেল। সংশোধনীটি ছিল যদি এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ রাজ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস মেনে না নেয় তাহলে পরের লাহোর অধিবেশন থেকে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করবে। যথারীতি ব্রিটিশ রাজ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস মেনে নেয় নি এবং লাহোর অধিবেশন থেকে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলে আর ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে নিজেদের স্বাধীন ভারতের নাগরিক বলে ঘোষণা করে। 

   কংগ্রেসের প্রবীন নেতৃত্ব এবং তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে কলকাতার এই অধিবেশন থেকেই একটা মতানৈক্য দেখা দিল। এই মতানৈক্যের প্রভাব পড়ল ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় কাজ করা তরুণ বিপ্লবী দলের মধ্যে। তাঁরা আর এই আবেদন নিবেদনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী থাকতে পারছিলেন না। বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজনে গড়ে উঠল রিভোল্ট গ্রুপ। অনুশীলন সমিতির সতীশ পাকড়াশি, নিরঞ্জন সেন এবং যতীন দাসের উদ্যোগে যুগান্তর গোষ্ঠির বরিশাল শাখা, চট্টগ্রামের সূর্য সেন, মাদারিপুরের পঞ্চানন চক্রবর্তী (কাজী নজরুলের অভিন্নহৃদয় বন্ধু), এবং আরো ছোট ছোট গ্রুপ মিলে এই রিভোল্ট গ্রুপে সামিল হল। কর্মসূচি নেওয়া হল বিভিন্ন জেলায় ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হবে। এই কর্মসূচি যদি বাস্তবে রূপায়িত করা যায় তাহলে প্রবীন নেতৃত্বও ও আরো অন্যান্য বিপ্লবী গোষ্ঠি এই কর্মোদ্যোগে সাড়া না দিয়ে পারবে না।
 
    অ্যাকশন প্ল্যান একজিকিউট করার হেডকোয়ার্টার স্থির হল কলকাতার মেছুয়াবাজার। সেখানকার গোপন ডেরায় দিনের পর দিন বিপ্লবীরা মিলিত হতে থাকল। আগামী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা, বোমা তৈরির ফর্মুলা, ইস্তাহার বিলির কর্মসূচি এইসবে সরগরম করে উঠল সেই বিপ্লবী ঘাঁটি।
     খবর ফাঁস হয়ে গেল গোয়েন্দাদের কাছে। ১৯২৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বরের কুয়াশাঘন গভীর রাতে সেই ডেরা ঘিরে ফেলল পুলিশ। গভীর রাতেই গ্রেপ্তার হল সতীশ পাকড়াশি ও নিরঞ্জন সেন। খবর না থাকায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু বোমার সেল আর পিস্তল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভোরবেলায় চট্টগ্রাম থেকে শিয়ালদা এসে সেই ঘাঁটিতে উপস্থিত হন সুধাংশু দাসগুপ্ত। সাথে সাথেই তিনিও গ্রেপ্তার হন। ঘাঁটি থেকে পাওয়া বিপ্লবীদের নাম ঠিকানা থেকে একে গ্রেপ্তার করা হল প্রমোদ দাসগুপ্ত, শচীন করগুপ্ত, মুকুল সেন, রমেন বিশ্বাস, নিশাকান্ত রায়চৌধুরী প্রভৃতি বিপ্লবীকে। শুরু হল মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলা।
    মামলায় দোষী হিসেবে সতীশ পাকড়াশি আর নিরঞ্জন সেনের হল সাত বছর দ্বীপান্তর, মুকুল সেন শচীন করগুপ্তের হল ছ বছর দ্বীপান্তর, সুধাংশু দাসগুপ্তের পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। প্রমোদ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কোনো সূত্র না পেলেও ব্রিটিশরা বুঝেছিল একে ছেড়ে রাখা ঠিক হবে না। কাজেই তাঁকে মেছুয়াবাজার ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াতে না পারলেও বেঙ্গল ক্রিমিনাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে আটক করে রাখা হয় এবং বিভিন্ন জেল ঘুরে পরে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। 

   মেছুয়াবাজার থেকেই প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরিকল্পনা হয়েছিল। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে গণেশ ঘোষ অম্বিকা চক্রবর্তীরা সেই পরিকল্পনার সফল রূপায়ন ঘটালেন। যদিও ধরাও পড়লেন সকলে এবং গণেশ ঘোষ আর অম্বিকা চক্রবর্তীও এসে পড়লেন দ্বীপান্তরের সেলুলার জেলে। এর কিছুকাল পরেই মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী হয়ে সেলুলার জেলে এলেন মুজফফর আহমেদ।
 
   মেছুয়াবাজারের গোপন ঘাঁটি থেকে যে স্ফুলিঙ্গের উৎপত্তি হয়েছিল তা দেশব্যাপি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে নবজোয়ার আনে। বিপ্লবী জগদীশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় 'মেছুয়াবাজারে অবস্থিত গোপন বৈপ্লবিক ঘাঁটি থেকে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের যে বহ্নিশিখা একদা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, সেই বহ্নিশিখাই পরবর্তীকালে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লেলিহান শিখার মত ছড়িয়ে পড়ল। কত ত্যাগ কত আত্মবলিদান স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদীতলে সমর্পিত হল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। শত শত শহিদের রক্তরাঙা ইতিহাসে রচিত হল নব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর গাঁথা'। (শৈলেশ দে সম্পাদিত অগ্নিযুগ)

   কাকাবাবুকে সবাই চেনেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে সিপিআই(এম) দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
   প্রমোদ দাসগুপ্ত সিপিআই(এম) দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিট ব্যুরো সদস্য এবং আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের দলের রাজ্য সম্পাদক। 
   সতীশ পাকড়াশি সিপিআই(এম) দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন।
   নিরঞ্জন সেন সিপিআই(এম) দলের পক্ষ থেকে ১৯৬৭-৬৮ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন।
   সুধাংশু দাসগুপ্ত সিপিআই(এম) দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং দলের মুখপত্র দেশহিতৈষী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। 
   শচীন করগুপ্ত ১৯৩৮ সালে আন্দামান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হন এবং সারা জীবন শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন।
   গণেশ ঘোষ সিপিআই(এম) দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গের বেলগাছিয়া বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন।

   কাজেই দেশদ্রোহী দাগিয়ে দেওয়ার আগে একটু ইতিহাসটা জেনে নেবেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার এই অগ্নিযুগ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছে। পুরো ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে দেখলে আরো অনেক নাম ও ঘটনা বলা যায়। তাতে লেখার পরিসরই বাড়বে শুধু। দেশ স্বাধীন করার জন্য বামপন্থীদের অবদান ইতিহাস এর পাতায় ছত্রে ছত্রে লেখা রয়েছে।

সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

কবিতা থেকে মিছিলে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর জন্মদিন যে লেখাটা লিখেছিলাম তাতে এক বন্ধু মন্তব্য করেছেন, "রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাৎসী বাহিনীর বাঁদরামো থামাতে পারে নি। পেরেছিলো স্তালিনের লালফৌজ৷ ফ্যাসিবাদ আটকানোর একমাত্র রাস্তা পালটা বলপ্রয়োগ। এছাড়া কোনো বিকল্প রাস্তা নেই।" এই প্রসঙ্গে আমার সামান্য কিছু বলার আছে। কমেন্ট হিসেবে লম্বা বলে আলাদা লিখলাম। 

ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকা কবিতাটি লেখেন ও নিজেই সেটির ইংরেজি অনুবাদ করে পাঠান অমিয় চক্রবর্তীর কাছে যিনি সে সময়ে ইংল্যান্ডে ছিলেন।জেনারেল ফ্ল্যাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে শুরু হয় ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন। এর বিরুদ্ধে তৈরি হয় পপুলার ফ্রন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড। নৈতিক ও দৈহিক সমর্থন দেন বহু বুদ্ধিজীবী যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ।

মার্চ, ১৯৩৭, স্পেন এর গৃহযুদ্ধের সময় পিপলস ফ্রন্ট এর সাহায্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "স্পেনের জনগণের এই চরম দুঃখ ও অবিচারের দিনে আমি মানবতার বিবেকের কাছে আবেদন রাখছি: স্পেনের পিপলস ফ্রন্ট কে সাহায্য করুন
জনগণের সরকার কে সাহায্য করুন, সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন, প্রতিক্রিয়াকে রুখে দিন"। স্পেনের ঘটনার পরপরই '‌লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার'–এর ভারতীয় শাখা তৈরি ও সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন

ফ্যাসিস্ট জাপানি সৈন্যবাহিনীর হাতে নানকিং শহরের পতনের পরে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে নিহত হন। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে লেখেন চিরস্মরণীয় কবিতা: "নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,"

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইতস্ততঃ করছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবেন কি দেবেন না বলে। হিটলার বাহিনীর কাছে ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করার পরে রবীন্দ্রনাথ এক তারবার্তায় তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে মিত্রপক্ষে যোগদান অনুরোধ জানান দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে। টেলিগ্রামে লিখলেন - "Today, we stand in awe before the fearfully destructive force that has so suddenly swept the world. Every moment I deplore the smallness of our means and the feebleness of our voice in India so utterly inadequate to stem in the least, the tide of evil that has menaced the permanence of civilization.

All our individual problems of politics to-day have merged into one supreme world politics which, I believe, is seeking the help of the United States of America as the last refuge of the spiritual man, and these few lines of mine merely convey my hope, even if unnecessary, that she will not fail in her mission to stand against this universal disaster that appears so imminent."

শুধু বিদেশের রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও কবি প্রতিবাদ করেছিলেন ফ্যাসিজমের। ১৯৩৯ সালের ১৭ মার্চ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে কবি বলেন— '‌অবশেষে আজ কংগ্রেস মঞ্চ থেকে হিটলার নীতির নিঃসঙ্কোচ জয় ঘোষণা শোনা গেল। ছোঁয়াচ লেগেছে। আমাদের এই গুরুভজা দেশে লাগবার কথা। স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করবার জন্য যে বেদী উৎকৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিস্ট সাপ ফোঁস করে উঠেছে।'‌ কিছুদিন পরে লেখা সেই অমিয় চক্রবর্তীকেই এক পত্রপ্রবন্ধে (‌২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯)‌ রবীন্দ্রনাথ সরাসরি ফ্যাসিজমের পরাজয় কামনা করলেন। সেই লেখার মধ্যে তিনি বললেন—"এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব–ইতিহাস ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।'‌

কেউ বলতেই পারেন যে এসবে প্রমাণিত হয় যে কবি সমাজ সচেতন ছিলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবর রাখতেন ও সাধ্যমত তার কবিতা ও লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতেন কিন্তু তার অভিঘাত কতটুকু। এর উত্তরে স্রেফ দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। জার্মান নাৎসি, কুখ্যাত প্রচারমন্ত্রী জসেফ গোয়েবলস একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এর ভক্ত হয়ে ছিলেন। স্পেনে পপুলার ফ্রন্ট কে কবি খোলাখুলি সমর্থন করার পরে গোয়েবলস সেই রবীন্দ্রনাথকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করে আক্রমণ করেন ও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেন। জাপান ডায়েট সিদ্ধান্ত নিয়ে কবির বক্তৃতা সেন্সার করা শুরু করে।

এবার আসা যাক লালফৌজের হাতে ফ্যাসিস্টদের পরাজয় প্রসঙ্গে। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই দুটি কথা মানেন। এক. স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধটাই ছিল ডিসাইসিভ, ফলাফল নির্ধারক। দুই. সমরবিজ্ঞানের সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেবার লালফৌজ জয়লাভ করেছিল। কেন করেছিল তার বহু কারণ ও ব্যাখ্যা আছে। একটি কারণ উল্লেখের জন্য জার্মান ইতিহাসবিদ Jochen Hellbeck এর সাহায্য নেওয়া যাক।

তার সুবিশাল "স্ট্যালিনগ্রাদ প্রটোকল" এ উল্লেখ করেছেন যে ১৯৪২ এর আগস্ট আর অক্টোবর মাসের মধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ড ঝোলানো সদস্য সংখ্যা ২৮,৫০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩,৫০০ এবং লালফৌজ ভাবতে শুরু করে যে তারা তাদের নাৎসি প্রতিপক্ষ বাহিনীর চেয়ে রাজনৈতিক ও নৈতিক ভাবে শ্রেষ্ঠ। [Der Spiegel magazine]। ব্রিগেডিয়ার কমিসার ভাসিলিয়েভ এর ভাষায় "It was viewed as a disgrace if a Communist was not the first to lead the soldiers into battle."

এই যে নৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে একটা ফৌজ তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী বিরোধীকে রুখেদিল, বেসামরিক জনগণ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে প্রতিরোধ করলো এ জিনিষ মানব সভ্যতার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তার প্রেরণার উৎসমূলে আমাদের ফিরে যেতেই হবে।

এখানেই প্রশ্ন আসে নীতি, নৈতিকতা, মতাদর্শ এসব এবস্ট্রাক্ট জিনিসের ব্যবহারিক মূল্য। এগুলোর যোগান দেন চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী আদর্শবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধে তাই কবিকে প্রয়োজন। বন্দুক দু পক্ষের হাতেই আছে বা থাকবে। কোন পক্ষ চূড়ান্ত জয়লাভ করবে সেটা বলে দেবে কবি কোন পক্ষে আছেন। স্রেফ বন্দুক দিয়েই লড়াই জেতা যাবে না।

"মহাকালসিংহাসনে
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী,
কুৎসিত বীভৎসা‌ পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন.‌.‌.‌'‌

তাই বন্ধু কিছু মনে করবেন না, বোধহয় শুধু ফৌজ বা শুধু কবিতায় হবে না। ফৌজের সাথে কবি ও কবিতাকেও চাই। আজ কবি জয়দেব বসুর জন্মদিন। এই লেখাটা তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেবন করলাম।

কবিতা থেকে মিছিলে .......

বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

বোকা বিকাশ, চতুর সুব্রত আর শ্রী জগন্নাথ ধাম ~ ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক


দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং দ্বার উন্মোচন হল। আমার মাথায় কয়েকটা প্রশ্নও এল। প্রথম প্রশ্ন হল, সব ধর্মের মানুষের ভোটে জিতে আসা একটি সরকার কি জনতার করের পয়সায় মন্দির তৈরি করতে পারে ? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দ্বিতীয় প্রশ্ন, এটি কি আদৌ মন্দির নাকি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ? কারণ সরকারিভাবে এটিকে শ্রী জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা হচ্ছে। তৃতীয় প্রশ্ন, এই যে বলা হচ্ছে দিঘা জগন্নাথ ধামকে কেন্দ্র করে পর্যটনের ঢল নামবে এবং এলাকার অর্থনীতিতে আমূল বদল আসবে, এই দাবি কতটা মজবুত ? এবারে এক এক করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। 

প্রশ্ন ১ : সরকার কি জনতার করের টাকায় মন্দির বানাতে পারে ? সংবিধান বলছে, না, পারে না। ভারতীয় সংবিধানে, ধর্মাচরণের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু তা নাগরিকের জন্য। সরকারের জন্য নয়। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভারতে, যে কোনও নাগরিকের, বিনা বাধায় ধর্মাচরণ এবং ধর্ম প্রচারের অধিকার আছে। ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যে কেউ বা বিধিবদ্ধ ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনও সংস্থা, ধর্মাচরণ, ধর্ম প্রচারের উদ্যেশ্যে ধর্মস্থান নির্মাণ, বিস্তার এবং পরিচালনা করতে পারে। এখানেও সরকারের কোনও স্থান নেই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, ২৭ নাম্বার ধারা। আপনাদের সুবিধের জন্য, আমি ধারাটি এখানে তুলে দিচ্ছি। 
27. Freedom as to payment of taxes for promotion of any particular religion.

No person shall be compelled to pay any taxes, the proceeds of which are specifically appropriated in payment of expenses for the promotion or maintenance of any particular religion or religious denomination.

~ "Article 027 (Freedom as to payment of taxes for promotion of any particular religion)" -Part III - Fundamental Rights (12–35)
মানে দাঁড়াল এই যে, নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হবে, এমন কোনও খরচের জন্য জনতাকে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না। দিঘা জগন্নাথ ধাম নির্মাণে ২০ একর জমি দিয়েছে সরকারি সংস্থা দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ। এরপর, হিডকো, মানে আরেক সরকারি সংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ আবাস পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ ধাম তৈরি করেছে। সংবিধান অনুযায়ী জনতার করের টাকা সরকার বাহাদুরের কাছেই গচ্ছিত থাকে। অতএব এই ২৫০ কোটি টাকা আমার আপনার করের টাকা। তাই দিঘা জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ আদৌ সাংবিধানিক কাজ কিনা, সেই প্রশ্ন থেকে গেল। 

প্রশ্ন ২ : দিঘা জগন্নাথ ধাম কি আদৌ মন্দির ? অনেকেই বলছেন, এ তো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা তো হতেই পারে। হক কথা। কিন্তু এখানে কোন সংস্কৃতি চর্চা হবে ? এমন কোনও তথ্য কোথাও পেলাম না। বৈষ্ণব মতাবলম্বীরা বলেন, প্রভু জগন্নাথ, কৃষ্ণেরই রূপ, সেই অর্থে বিষ্ণুবতার। যদিও শৈব এবং শাক্ত মতাবলম্বীদের একটা অংশ মনে করেন, প্রভু জগন্নাথ, ভৈরবের একটি রূপ বা ভগবান শিবের অবতার। স্কন্দ এবং ব্রহ্ম পুরাণে প্রভু জগন্নাথের উল্লেখ রয়েছে। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর কথা যদি হয়, তাহলে ভারতে মূলত তিন স্থাপত্য শৈলীর মন্দির দেখা যায়। উত্তরের নাগারা শৈলী, দক্ষিণের দ্রাবিড় শৈলী এবং বাকি মোটামুটি, ভেসারা বা মিশ্র শৈলী। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কলিঙ্গ শৈলী আসলে মিশ্র শৈলী। আমার প্রশ্ন, দিঘা জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কি পুরাণ, মন্দির স্থাপত্যশৈলী ইত্যাদি নিয়ে চর্চা বা গবেষণা হবে ? এমন তথ্য কোথাও পেলাম না। বরং দেখলাম, বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। হিন্দু ধর্ম সাকার সাধনায় বিশ্বাসী। তাহলে সংস্কৃতি কেন্দ্র নাম দিয়ে যাই বলার চেষ্টা হোক না কেন, বিষয়টা কি সংবিধানসিদ্ধ কাজ হল ? প্রশ্ন রয়েই গেল। এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের দেশে, মূলত দক্ষিণ ভারতে, তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্নাটকে মন্দির পরিচালন এবং পরিচালন ব্যবস্থায় দখলদারির বহু মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট, সব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করেছে। 

প্রশ্ন ৩ : দিঘা জগন্নাথ ধামের হাত ধরে, এলাকায় পর্যটনের জোয়ার আসবে কিনা বা পর্যটন অর্থনীতিতে গতি আসবে কিনা। এককথায় উত্তর হল হ্যাঁ। বহু মানুষ এখন মন্দির দেখতে যাবেন। কিন্তু তার মধ্যেও খানিক স্তরবিভাজন আছে। সে প্রসঙ্গে আসছি। তার আগে একটু পরিসংখ্যান দিই। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তথ্য বলছে, কোভিডের পর, পশ্চিমবঙ্গে দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে চোদ্দ কোটি পর্যটক (রাজ্যের পর্যটক ধরে) নানা জায়গা ঘুরেছেন। জাতীয় নিরিখে অষ্টম স্থান। তৃণমূল আমলে, রাজ্যের ভূবৈচিত্র, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরতে নানা কাজ হয়েছে। সরকার এক্ষেত্রে একাধিক পেশাদার এবং বেশ কয়েকটি পেশাদারি সংস্থার পরামর্শ শুনে কাজ করেছে। পর্যটন শিল্পে বৃদ্ধি তারই প্রতিফলন। এরই সুফল হিসেবে একটু একটু করে বেড়েছে বিদেশি পর্যটকও। ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, বিদেশি পর্যটক আসেন প্রায় ২৭ লক্ষ। তবে এই হিসেবে জল হয়ে ঢুকে আছেন বাংলাদেশিরা। জল কেন বলছি ? আসলে ওই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ১২০০/১৫০০ টাকা হোটেলের বাংলাদেশি পর্যটকরা, বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়াতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভরতে তাঁদের বিরাট অবদান আছে, তা মানছেন না রাজ্যে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত পেশাদাররা। বরং তাঁদের ভয়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, ভিসা নিয়ে কড়াকড়ির জেরে, ২০২৪ এ পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটা কমে যেতে পারে। আচ্ছা, পর্যটন ব্যবসায় বিদেশি পর্যটক এত গুরুত্বপূর্ণ কেন ? কারণ, ডলার। যত ডলার আমদানি, পর্যটন অর্থনীতিতে তত জোশ। কারণ কী জানেন, ন্যাপা, শ্যামা, পল্টু, মানে আপনার আমার মতো মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা স্বল্পবিত্তদের কৃপায়, দিঘাতে ডিম-পাওরুটি বা কাঁকড়া ভাজার ষ্টল আরও কিছু বাড়তে পারে, বিয়ার পাব, ভাল হোটেল আরও কয়েকটা বাড়তেই পারে। কিন্তু পর্যটন শিল্পে গতি এনে পর্যটন অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তার জন্য দরকার পয়সাওয়ালা দেশি খদ্দের বা বিদেশি পর্যটক। 
দিঘা এখনও পয়সাওয়ালা দেশি পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় নেই। কারণ বিচ ট্যুরিজম বলতে যা বোঝায়, দিঘাতে সেই পরিকাঠামো নেই। আজকের বাজারে পর্যটন পণ্য বিপণনের দুই মন্ত্র। ন্যাচারাল বা ইনহেরিটেড কোনও পণ্য আপনার দখলে থাকলেই হল না, তাকে কেন্দ্র করে ম্যানমেড পণ্য তৈরি করে একটা সুসংহত পণ্য তৈরি করতে হয়। দিঘাতে যতদিন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বা ওয়াটার স্পোর্টসের পেশাদার পরিকাঠামো না হচ্ছে, ততদিন দিঘা 'দীপুদা'র দিঘা হয়েই থেকে যাবে। 
রাজ্যের পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত পেশাদাররা বলছেন, সুন্দরবনকে কীভাবে আরও বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরা যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। উত্তরবঙ্গের পাহাড় জঙ্গলে, কী করে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। কলকাতায় হেরিটেজ ওয়াক কী করে বিদেশিদের কাছে, ভিন রাজ্যের পয়সাওয়ালা পর্যটকদের কাছে বেচা যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। রাজ্যে ১৩ টি শক্তি পীঠ রয়েছে। সুসংহত পরিকল্পনা করে, শক্তিপীঠ সার্কিট করা যেত। তাতে ডলার আমদানি হত। অথচ রাজ্যের অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। এটাই আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু দিঘার জগন্নাথ ধাম সামনে রেখে সেই বৃদ্ধি অসম্ভব। 

বোকা বিকাশ আর চতুর সুব্রতর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আপনাদের তো বলিইনি যে এই দুই চরিত্র কারা। দুজনেই কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। একজন বিকাশ ভট্টাচার্য। অন্যজন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুব্রতদা গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর একটি কথা আজ খুব মনে পড়ছে। সুব্রতদা তখন প্রথম তৃণমূল সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। একদিন আড্ডা হচ্ছে। কথায় কথায় কলকাতায় জল জমার প্রসঙ্গ উঠল। সুব্রতদা বললেন, বিকাশবাবু কিন্তু খুব ভাল কাজ করেছেন। যাঁরা জানেন না, তাঁদের বলি, কলকাতায় জল জমার সমস্যা সমাধানে, প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে, জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে বিকাশ ভট্টাচার্য মেয়র থাকাকালীন একটা বিরাট কাজ হয়। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্প। সেই টাকায় কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি ভূগর্ভস্থ ইটের নিকাশি নালা সংস্কার করে, বিশেষ প্লাস্টিকে তৈরি আস্তরণ দিয়ে মজবুত করা হয়। আজ যে কলকাতায় জল জমার সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে, তার কারণ, ওই কাজ। সুব্রতদা তার কথাই বলছিলেন। প্রশ্ন করেছিলাম, দাদা, এই কাজের প্রস্তাব তো আপনি মেয়র থাকার সময়ের। আপনি করেননি কেন ? সুব্রতদা সেই ট্রেডমার্ক হাসি হেসে, অননুকরণীয় ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেছিলেন, ধুর, ভোটে জিততে গেলে, এমন কিছু করতে হয়, যা পাবলিক চোখে দেখতে পায়। আমাদের দেশের পাবলিক ওতেই খুশি। মাটির তলায় ৩৫০ কোটি টাকা ঢেলে কী হত ? পাবলিক দেখতে পেত ? বিকাশবাবু ভোটে জিততে পেরেছেন ? 

দিঘার জগন্নাথ ধামের উচ্চতা দেখলাম, ২১৩ ফুট। বহুদূর থেকে দেখা যাবে।

জয় জগন্নাথ। ভুল ত্রুটি মার্জনা কোরো প্রভু….

শনিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীদের রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের ঘৃণ্য চেষ্টা ~ ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী



কী আস্পর্ধা! ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা উঠেপড়ে প্রমাণ করতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথও নাকি তাঁদেরই মত সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন! সমাজ মাধ্যমে ছড়ানো তাঁদের পোস্টটি দেখলে আপাতভাবে মনে হতে পারে সেটি বহু গবেষণা করে সূত্র উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, সুতরাং প্রামাণ্য। আদপে কোথাও কবিগুরুকে ভুল উদ্ধৃত করা হয়েছে, কোথাও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোন বড় একটা নিবন্ধের কোন এক অধ্যায়ের একটি বাক্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে আনা হয়েছে। কোনটির আবার রেফারেন্সের অস্তিত্বই নেই, স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো, হিন্দুত্ববাদীদের দপ্তরে বসে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে রচনা করা হয়েছে। আসলে কবিগুরুর আটটি উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদের ধর্মান্ধতাজনিত মুসলমান-বিদ্বেষকে জায়েজ প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাঁরা।

যাঁরা ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করার উদ্দেশ্যে সমাজ মাধ্যমে এই পোস্ট ক্রমাগত শেয়ার, ফরোয়ার্ড করছেন, তাঁরাও কেউ রবীন্দ্ররচনাবলী পড়ে দেখা দূর-অস্ত্, পাতা উল্টেও দেখেন নি কোনদিন। এরাজ্যের তস্করদের পোষা চেয়ার-মোছা বুদ্ধিজীবীদেরও এই ভাইরাল পোস্ট নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া পেলাম না! অবশ্য প্রত্যাশিতও ছিল না। একটু বড় লেখা, তবু ধৈর্য্য ধরে পড়লে বোঝা যাবে বিশ্বের দরবারে বাঙালীর গর্বের পরিচয় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁর লেখা গান দুটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত, তাঁর বক্তব্য কীভাবে বিকৃত করছে হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধরা।

*উদ্ধৃতি ১* - 'যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে।' (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র' একাদশ খণ্ডের ১১৮-১২২ পৃষ্ঠায়)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্রনাথ ঐ চিঠিতে লিখেছেন, 'বিদেশী সাম্রাজ্যের এতটা দাক্ষিণ্য ইংরেজজাতের ছাড়া আর কোনো জাতের হাত দিয়ে হতে পারত না। হয়তো এই দানের সঙ্গে সঙ্গে সুবুদ্ধিও আছে। জগৎ জুড়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিবাতাস জেগে উঠছে তাতে ভারতবর্ষের মন না পেলে ভারতবর্ষকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করা সম্ভব হতে পারে না। যে মুসলমানকে আজ ওরা সকলরকমে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানই একদিন মুষল ধরবে। যাই হোক, লুব্ধতা স্বভাবে প্রবল থাকলে স্ববুদ্ধির দূরদর্শিত কাজ করতে পারে না। ... আমাদের তরফে একটা কথা বলবার আছে, ইংরেজের শাসনে যতই দাক্ষিণ্য থাক আজ পর্য্যস্ত না মিলল আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, না জুটল যথেষ্ট পরিমাণে পেটের ভাত, না ঘটল স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা।'

স্পষ্টতই 'ওরা' বলতে ব্রিটিশ শাসকদের বোঝানো হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসকদের স্বভাবে প্রবল লুব্ধতার কথা বলা হচ্ছে এবং 'মুষল ধরবে' বলতে মুসলমানেরা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে সেকথাই বলছেন রবীন্দ্রনাথ। বাস্তবেও তা ঘটেছে। ১৯৩৪ সালে 'কমিউনাল এওয়ার্ড' এবং ভারতবাসীকে স্বায়ত্ত্ব শাসন দেওয়ার যে 'দাক্ষিণ্য' দেখাচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ আশঙ্কিত ছিলেন ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিতে। লিঙ্ক - 

*উদ্ধৃতি ২* - 'চল্লিশ লাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত।' ( আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্র রচনাবলীর কোথাও এইরকম কোনও লেখা পাওয়া যায় না। ১০২ বছর আগের ঐদিনের পত্রিকা অনলাইন আর্কাইভে পেলাম না, পেলে বোঝা যেত আদৌ রবীন্দ্রনাথ একথা বলেছিলেন কিনা, আর বললেও কোন প্রসঙ্গে, কী প্রেক্ষিতে বলেছেন। তবে 'ধর্মমোহ' কবিতায় তিনি লিখেছেন- 

"যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে/ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে -/ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,/এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।"

রবীন্দ্র রচনাবলীর আরেক জায়গায় পাওয়া যায়, "হিন্দুজাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রাকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়– অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের non-violent non-co-operation।"
লিঙ্ক -

*উদ্ধৃতি ৩* - 'যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স,১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)

*প্রকৃত তথ্য* - 'যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।', এই লাইনটি 'কালান্তর'-এর 'স্বামী শ্রদ্ধানন্দ' প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। সুচতুরভাবে শুধুমাত্র এই একটি লাইনকে তুলে এনে, অগ্রপশ্চাৎ কিছু না দেখিয়ে ভিন্ন বার্তা প্রেরণ করা হচ্ছে। এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার বলছেন—

'ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো অমঙ্গল বড়ো দুর্গতি ঘটে যখন মানুষ মানুষের পাশে রয়েছে অথচ পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ নেই, অথবা সে সম্বন্ধ বিকৃত। বিদেশীর রাজ্যে রাজপুরুষদের সঙ্গে আমাদের একটা বাহ্য যোগ থাকে, অথচ আন্তরিক সম্বন্ধ থাকে না। বিদেশীয় রাজত্বে এইটেই আমাদের সবচেয়ে পীড়া দেয়। গায়ে-পড়া যোগটা দুর্বলতা ও অপমান আনে। বিদেশী শাসন সম্পর্কে যদি এ কথা খাটে তবে স্বদেশীয়দের সম্বন্ধে সে আরও কত সত্য। এক দেশে পাশাপাশি থাকতে হবে, অথচ পরস্পরের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্বন্ধ থাকবে না, হয়তো বা প্রয়োজনের থাকতে পারে— সেইখানেই যে ছিদ্র— ছিদ্র নয়, কলির সিংহদ্বার। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেখানে এতখানি ব্যবধান সেখানেই আকাশ ভেদ করে ওঠে অমঙ্গলের জয়তোরণ। আমাদের দেশে কল্যাণের রথযাত্রায় যখনই সকলে মিলে টানতে চেষ্টা করা হয়েছে— কংগ্রেস প্রভৃতি নানা প্রচেষ্টা দ্বারা, সে-রথ কোথায় এসে থেমে যায়, ভেঙে পড়ে? যেখানে গর্তগুলো হাঁ ক'রে আছে হাজার বছর ধরে।

আমাদের দেশে যখন স্বদেশী-আন্দোলন উপস্থিত হয়েছিল তখন আমি তার মধ্যে ছিলেম। মুসলমানরা তখন তাতে যোগ দেয় নি, বিরুদ্ধ ছিল। জননায়কেরা কেউ কেউ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ওদের একেবারে অস্বীকার করা যাক। জানি, ওরা যোগ দেয় নি। কিন্তু, কেন দেয় নি। তখন বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এত প্রবল যোগ হয়েছিল যে সে আশ্চর্য! কিন্তু, এতবড়ো আবেগ শুধু হিন্দুসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ রইল, মুসলমানসমাজকে স্পর্শ করল না! সেদিনও আমাদের শিক্ষা হয় নি। পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি।

....জাজিম-তোলা আসনে মুসলমান বসেছে, জাজিম-পাতা আসনে অন্যে বসেছে। তার পর ওদের ডেকে একদিন বলেছি, 'আমরা ভাই, তোমাকেও আমার সঙ্গে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কারাবাস ও মৃত্যুর পথে চলতে হবে।' তখন হঠাৎ দেখি অপর পক্ষ লাল টক্‌টকে নতুন ফেজ মাথায় দিয়ে বলে, আমরা পৃথক। আমরা বিস্মিত হয়ে বলি, রাষ্ট্র ব্যাপারে পরস্পর পাশে এসে দাঁড়াবার বাধাটা কোথায়। বাধা ঐ জাজিম-তোলা আসনে বহুদিনের মস্ত ফাঁকটার মধ্যে। ওটা ছোটো নয়। ওখানে অকূল অতল কালাপানি। বক্তৃতামঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিলেই পার হওয়া যায় না।
আপনার লোককেও যে পর করেছে, পরের সঙ্গেও যার আত্মীয়তা নেই, সে তো ঘাটে এসেছে, তার ঘর কোথায়। আর তার শ্বাসই বা কতক্ষণ। আজ আমাদের অনুতাপের দিন, আজ অপরাধের ক্ষালন করতে হবে। সত্যিকার প্রায়শ্চিত্ত যদি করি তবেই শত্রু আমাদের মিত্র হবে.... '

*উদ্ধৃতি ৪* - 'কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে।' (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭,কালান্তর)

*প্রকৃত তথ্য* - আবার প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে একটা বাক্য তুলে আনা হয়েছে। কবি অন্যত্র লিখেছেন, 'একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।" 

রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি ও জানি একজন সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাসী দার্শনিক হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, দেশ বা সমাজের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁকে সমন্বয়বাদী রূপে দেখা গেছে। এখানেও বোধহয় ছিল সমন্বয়ের চেষ্টা। উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষ নির্মাণে ইংরেজ ভূমিকা নেবে – দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাস তিনি লালন করেছেন। একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে ইংরেজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস। ভাবেননি যে, উপনিবেশবাদী শোষক কখনো উপনিবেশকে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না। রবীন্দ্রনাথের-স্বদেশভাবনা - লিঙ্ক - https://www.kaliokalam.com/?s=%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%BE

*উদ্ধৃতি ৫* - এই ধর্ম যেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮,শান্তিনিকেতন)

*প্রকৃত তথ্য* - এখানে কবি মুসলমান সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি তাঁর ঘৃণাকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সুলতানি ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে, ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দুমন্দির, জৈনমন্দির ধ্বংস করে তার উপরে উঠেছে মসজিদ। অতএব, বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাতের কথা একবর্ণও কি মিথ্যে? বরং এখানে তিনি বলেছেন যে ওই সুলতানি আমলেও কবির, নানক, রবিদাস, দাদুদয়ালের মতো সাধকগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁরা মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ এখানে বলছেন-

সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি, হয়, আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে নয়, আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন। সেই যুগের নানক, রবিদাস, কবীর, দাদু প্রভৃতি সাধুদের জীবন ও রচনা যাঁরা আলোচনা করছেন তাঁরা সেই সময়কার ধর্ম-ইতিহাসের যবনিকা অপসারিত করে যখন দেখাবেন তখন দেখতে পাব ভারতবর্ষ তখন আত্মসম্পদ সম্বন্ধে কী রকম সবলে সচেতন হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষ তখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের এমন একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে। এইজন্যেই সত্যের আঘাত তার বাইরে এসে যতই ঠেকুক তার মর্মে গিয়ে কখনো বাজে না, তাকে বিনাশ করে না।' লিঙ্ক -

 
*উদ্ধৃতি ৬* - হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই।(রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)

*প্রকৃত তথ্য* - রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'আমাদের দেশে ভারতবর্ষীয়দের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্যলাভের চেষ্টা যখনই প্রবল হইল, অর্থাৎ যখনই নিজের সত্তা সম্বন্ধে আমাদের বিশেষভাবে চেতনার উদ্রেক হইল তখনই আমরা ইচ্ছা করিলাম বটে মুসলমানদিগকেও আমাদের সঙ্গে এক করিয়া লই, কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। এক করিয়া লইতে পারিলে আমাদের সুবিধা হইতে পারিত বটে, কিন্তু সুবিধা হইলেই যে এক করা যায় তাহা নহে। হিন্দু - মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না।
হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায় বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া অনুভব করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুইপক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরের কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,— সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাঁটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কি না, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসংগত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।' লিঙ্ক -


*উদ্ধৃতি ৭* - 'ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে।' (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫,ইতিহাস)

*প্রকৃত তথ্য* - তিনি লিখছেন, 'এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। তাহারা যেন ভিন্ন ভিন্ন দুর্গম মরুময় গিরিশিখরের উপরে খণ্ড তুষারের ন্যায় নিজের নিকটে অপ্রবুদ্ধ এবং বাহিরের নিকটে অজ্ঞাত হইয়া বিরাজ করিতেছিল। কখন প্রচণ্ড সূর্যের উদয় হইল এবং দেখিতে দেখিতে নানা শিখর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তুষারস্রুত বন্যা একবার একত্র স্ফীত হইয়া তাহার পরে উন্মত্ত সহস্র ধারায় জগৎকে চতুর্দিকে আক্রমণ করিতে বাহির হইল।
তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম বৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্ম বিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। তখন ধর্মে সমাজে শাস্ত্রে কোনো বিষয়ে নবীনতা ছিল না, গতি ছিল না, বৃদ্ধি ছিল না, সকল বিষয়েই যেন পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, নূতন আশা করিবার বিষয় নাই। সে সময়ে নূতনসৃষ্ট মুসলমানজাতির বিশ্ববিজয়োদীপ্ত নবীন বল সম্বরণ করিবার উপযোগী কোনো একটা উদ্দীপনা ভারতবর্ষের মধ্যে ছিল না।
নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রীকন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে– মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।'
'মুসলমান রাজত্বের ইতিহাস'
লিঙ্ক - 

*উদ্ধৃতি ৮* - 'প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।' (হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)

*প্রকৃত তথ্য* - হেমন্তীবালা বলে কেউ ছিল না, যিনি ছিলেন তাঁর নাম হেমন্তবালাদেবী। তাঁকে কবি ২৬৪-টি চিঠি লিখেছেন, তার মধ্যে একটি চিঠি থেকে প্রসঙ্গবিহীন ভাবে এই অংশটি নেওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে ঐ হেমন্তবালাদেবীকে অন্য একটি চিঠিতে কবি লিখছেন, 'সমস্ত মুসলমান জাতের উপর হিন্দুর বণ জন্মে যাচ্চে। অথচ এ কথা নিশ্চিত সত্য তাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা ভালো লোক, ঠিকমত পরিচয় পেলে যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে কোথাও বাঁধত না। .... মুসলমানেরা যদি সম্পূর্ণভাবে পর হোতো তাহলে এ ক্ষতি আমাদের পক্ষে তেমন সর্বনেশে হোতো না - কিন্ত দেশের দিক দিয়ে তারা আমাদের আপন এ কথাটা কোনো উৎপাতেই অস্বীকৃত হতে পারে না।' ধর্মান্ধদের দাবী নস্যাৎ করে কবির সম্প্রীতির বার্তা এখানেই স্পষ্ট প্রতিভাত।
লিঙ্ক - 

শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

কাঠি ও বারুদ ~ সন্দীপন চক্রবর্তী

জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!

ইদের প্রস্তুতির রং তখন লেগে আছে জেলাটা জুড়ে। নানা বিপণিতে বিভিন্ন ছাড়ের ব্যবস্থা, কেনাকাটার ভিড়ে শামিল সব সম্প্রদায়ের, সব ধরনের মানুষ। সেই সময়েই দেখা সানোয়ার ইসলামের সঙ্গে। 

পদ্মা দেখার জন্য রঘুনাথগঞ্জের প্রান্তিক গ্রামে ঢুকে সানোয়ারের সঙ্গে মোলাকাত। সেকলিপুরে সরু রাস্তা বেয়ে এগিয়ে বিএসএফ ছাউনিতে কাগজ-পত্র এবং সঙ্গের ব্যাগ বা থলে দেখিয়ে নৌকোর সওয়ারি নিচ্ছেন কত লোক। নদী পার হলে আরও কয়েক কিলোমিটার পেরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত। চড়া পড়ে পদ্মা সেখানে শীর্ণকায়। তবে পরিষ্কার, টলটলে জল! চোখের অদ্ভুত আরাম, পারে গিয়ে দাঁড়ালেও মন শান্ত হয়। সেই তল্লাটেই মনিহারি দোকান চালানো সা‌নোয়ার বলেছিলেন শান্ত জলে ঢিল মেরে কল্লোল তুলতে চাওয়ার কথা। 

এই আলাপচারিতার পরে মেরেকেটে দিন পনেরো পেরোতে না পেরোতেই হিংসার আগুনে পুড়েছে মুর্শিদাবাদে ওই জঙ্গিপুরের বেশ কিছু এলাকা। ধুলিয়ান, সুতি, শমসেরগঞ্জ। দেদার লুঠপাট হয়েছে, পুলিশের গাড়িতে হামলা হয়েছে, আগুন জ্বলেছে। চলে গিয়েছে তিনটি প্রাণ। আহতের সংখ্যা বেশ কিছু। উপলক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকারের আনা ওয়াকফ সংশোধনী আইনের প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদের চেহারা কয়েক বছর আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরোধিতায় বিক্ষোভকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেকটাই। ঘটনার পরে অবধারিত ভাবে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধী বিজেপির উচ্চ গ্রামের তরজা শুরু হয়ে গিয়েছে।

মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। মুর্শিদাবাদের ঘটনার জন্য তিনি বিজেপি তো বটেই, শান্তি রক্ষায় উদ্যোগী না-হওয়ার জন্য আঙুল তুলেছেন কংগ্রেসের দিকেও। বিএসএফ-কে দোষী করেছেন। আর সার্বিক পরিকল্পনার নেপথ্যের কারিগর চিহ্নিত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে আবেদন করেছেন শাহকে সামলে (কন্ট্রোল) রাখার! 

বসিরহাট, সন্দেশখালি বা শমসেরগঞ্জ হোক, রাজ্যের কোনও জায়গায় অশান্তির কিছু ঘটলেই চক্রান্তের অভিযোগ রাজ্যের শাসক পক্ষের গলায় অহরহ শোনা যায়। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক ঘটনায় 'চক্রান্তে'র কথা মাথায় রেখেও কেউ যদি প্রশ্ন তোলে— বিরোধী দল বিজেপি বাইরে থেকে গুন্ডা বা দুষ্কৃতী আনল, বিএসএফ কিছু টাকা দিয়ে বাচ্চা ছেলেদের দিয়ে পাথর ছোঁড়াল, কেউ এসে গুলি চালিয়ে দিল, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের অভিযোগ মতো এই সবক'টা ঘটনাই এ ভাবে বিনা বাধায় ঘটে গেলে প্রশাসন করছিল কী? পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ কোথায় ছিল? অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দেখেও পুলিশ প্রথম দিকে কেন তৎপর হল না? মুখ্যমন্ত্রী এই পর্বে একাধিক বার শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন ঠিকই। কিন্তু আবেদনই কি একমাত্র এবং শেষ কথা? দুষ্কৃতী-রাজ যদি জাঁকিয়ে বসতে চায়, আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনও অপশক্তি যদি জীবন, জীবিকা, সম্পত্তি ধ্বংসের খেলায় নামে, প্রশাসনের তখন দায়িত্ব কী?

ধুলিয়ানের জাফরাবাদে উন্মত্ত তাণ্ডবকারীদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছেন বাবা ও ছেলে। পারিবারিক ব্যবসা আছে তাঁদের। বাবা ছিলেন সিপিএমের সক্রিয় কর্মী, বয়সের কারণে পরে আর সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। ওই রানিপাড়ায় হামলাকারীদের লুটপাট ঠ‌েকানোর চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা আরও উন্মত্ত হয়ে, দল ভারী করে পাড়ায় ঢুকে আসে। ধারালো, ভোঁতা নানা সরঞ্জাম নিয়ে হামলা চালায়, যার পরিণতি, বাড়ির সামনেই বাবা-ছেলের মৃত্যু। একের পর এক বাড়িতে হামলার দাগ বাসিন্দারাই দেখিয়েছেন। পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী যখন এলাকায় গিয়েছেন, বাসিন্দারা সমস্বরে অভিযোগ করেছেন, তাণ্ডব চলাকালীন খবর দেওয়া হলেও পুলিশ সেখানে আসতে চায়নি। গাড়িতে থানা মিনিটদশেকের দূরত্বে হলেও সে দিন হিংস্র বাহিনীর মুখে অসহায় হয়ে লড়ে যেতে হয়েছে বাসিন্দাদের। রাজনৈতিক দলের সফরের সময়ে ওঠা ভিডিয়োয় ধরা পড়ছে বাসিন্দাদের ক্ষোভ। কেন সে দিন পুলিশ ও'ভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকল, তার উত্তর কি বিরোধী দল বা বিএসএফ দেবে!

সুতির কাসেমনগরে মারা গিয়েছেন ২১ বছরের আর এক যুবক। তাঁর শরীরে গুলির ক্ষত ছিল। পরিবারের বক্তব্য, পুলিশই তাঁকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গিপুরের হাসপাতালে ভর্তি করায়। বুলেট বার করে নেওয়া হয়। তার পরে বলা হয় বহরমপুরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে। জঙ্গিপুর থেকে হাসপাতালের কোনও অ্যাম্বুল্যান্স ওই পরিবার পায়নি। ওই গোলমালের মধ্যে টাকা দিয়ে গাড়ি জোগাড় করে বহরমপুরে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলেও রক্তক্ষরণ চলতে থাকা যুবককে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে ভর্তি আরও কয়েকজনের গুলির আঘাত আছে, স্থানীয় মানুষ এবং পরিবারের লোকেরাই বলছেন। পুলিশি তৎপরতায় তাঁদেরও বুলেট বার করে নেওয়া হয়েছে।

শাসক শিবিরের অন্দরেও আলোচনা আছে শমসেরগঞ্জ এবং সুতি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের নিয়ে। গোলমাল সেখানে পরতে পরতে বেড়েছে, ওই এলাকার পুলিশই আর্ত বাসিন্দাদের ডাক পেয়েও যায়নি বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের অভ্যন্তরেও চর্চা আছে। এবং ঘটনার কয়েক দিন পরে সরকারি আদেশ জারি করে দুই থানায় নতুন আইসি (আগে ইনস্পেক্টর স্তরের কেউ দায়িত্বে ছিলেন না ওখানে) নিয়োগ করা হয়েছে, পুরনো আধিকারিকদের আপাতত পাঠানো হয়েছে পুলিশ লাইনে। পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করে তদন্ত চলাকালীন এই বদলির পদক্ষেপে কিছু ইঙ্গিত মিলছে কি?

গোটা ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, নিয়োগ-দুর্নীতি এবং ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি হারানোর সঙ্কট ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এমন এক হিংসালীলা চলতে দেওয়া হল কি না, খুব অসঙ্গত প্রশ্ন হবে কি? বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলা জুড়ে হিন্দুত্ববাদী জিগির তোলার চেষ্টা চলছে চড়া সুরে। রামনবমী পালনকে ঘিরে হুঙ্কারের বহর কারওরই নজর এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু হাতে জ্বলন্ত কাঠি নিয়ে যারা ঘুরছে, তাদের জন্য বারুদের স্তূপ মজুত রাখা কি একই কৌশলের অঙ্গ নয়? নাকি সেটা কিছু কম অপরাধ?

এই আঁধারে ওই সানোয়ারের কথাটাই ফিরে ফিরে ভাবায়। ''জল তো দাদা এমনিতে শান্তই। ঢিল মেরে কেউ ঢেউ তুলে দিলে কী হয়, বলা যায় না!''

শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

বিবিসি ও মাষ্টারদা ~ কনাদ মুখোপাধ্যায়

১৯৩০ সালে ১৮ই এপ্রিল রাত সাড়ে আটটায় বিবিসি তার নির্ধারিত ইংরিজি খবরের বদলে আধ ঘণ্টা বেটোভেনের সিম্ফনি শুনিয়েছিল। ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ এই অদ্ভুৎ পরিবর্তনে যার পর নাই অবাক হয়। পরের দিন জানা যায় ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেছে সশস্ত্র বিপ্লবীরা।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অবিস্মরণীয় ঘটনা খবর সম্প্রচার করতে হলে স্বীকার করতেই হতো বিবিসির মতো কুলীন সংবাদ সংস্থাকে তাই তারা বেটোভেনের স্বরণাপন্ন হয়েছিলো। আজকের মিডিয়া যখন এক বিষয় থেকে লম্ফ দিয়ে আরেক বিষয়ে লাফ দেয় তাতে নতুনত্ব কিছু নেই, আছে পূর্বজের আনুগত্যের উত্তরাধিকার।

বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলায় বর্গী হানা ও গণহত্যা ~ শুভ্র সুন্দর

বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র গনহত্যা ঘটে নাগপুরের হিন্দু রাজার নেতৃত্বে

            হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন, বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, ভয়ংকর গণহত্যা ঘটে হিন্দু রাজাদের নেতৃত্বে। মূলত নাগপুরের রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নেতৃত্বে। রাঘোজি ভোঁসলে ছিলেন নাগপুরের মহারাজা আর তিনি কাজ করতেন মহারাষ্ট্রের পুনের পেশোয়া বাজিরাও এর অধীনে। পেশোয়া বাজিরাও ও ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। সেই পেশোয়া অর্থাৎ প্রধাণ মন্ত্রী আবার কাজ করতেন সাতারা র ছত্রপতি দের অধীনে। সেইসময় ছত্রপতি ছিলেন সাহুজি রাও ভোঁসলে ১। 

            যাইহোক, মারাঠা ছত্রপতি সে শিবাজী হোক বা তার উত্তরসূরী, ইনকামের দিক থেকে এনারা ছিলেন তোলাবাজ, লুঠেরা। বিভিন্ন রাজ্য কে আক্রমণ করতেন, তারপর তাদের পরাজিত করতে পারলে, তাদের উপর বিশাল পরিমান বার্ষিক খাজনা বা তোলা বসাতেন না দিলে আবার আক্রমন করবেন এই ভয় দেখিয়ে। আর এই আক্রমণের সময় যা কিছু দুইচোখে দেখতেন তা লুঠ করে আনতেন ও নির্দ্বিধায় গণহত্যা করতেন। শিবাজীর নাতি সাহু প্রথম এই পেশোয়া বাজীরাও কে নিযুক্ত করেন। আর বাজীরাও এর অধীনে থাকা সামরিক বাহিনীর প্রধাণ দের বাজীরাও এক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ক্ষমতা দেন কিছু শর্তের ভিত্তিতে। কিন্তু, পরবর্তী কালে সামরিক বাহিনীর প্রধাণরা, সেই অঞ্চলগুলির সর্বেসর্বা বা মহারাজা হয়ে ওঠেন। যেমন মালোয়ার সিন্ধিয়া বংশ, গোয়ালিওর এর সিন্ধিয়া বংশ, ইন্দোরের হোলকার বংশ, বরোদার গায়কোয়ার বংশ এবং নাগপুরের ভোঁসলে বংশ।

           এই নাগপুরের ভোঁসলে বংশের প্রথম রাজা রাঘোজি ভোঁসলে ১৭৪১ সালে প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন। বাংলা তখন অধুনা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল। তখন বাংলার মোঘল নবাব আলীবর্দী খাঁ। রাজা রাঘোজি ভোঁসলে তার মারাঠা সৈন্য বাহিনী নিয়ে আক্রমন করেন বাংলা। মারাঠা সৈন্যবাহিনীর নাম ছিল মারাঠী ভাষায় "বর্গীর"। এই "বর্গীর" একটি পার্সিয়ান শব্দ যার মানে "ঘোরসওয়ার"। এই বর্গীর বাহিনী দের মূল উদ্দেশ্য ছিল লুঠ ধর্ষন করা। আর তার জন্য তারা গণহত্যায় পিছ পা হতো না। ডাচ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালী কে হত্যা করেছিল এই বর্গীর বাহিনী, ১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে মোট ৬ বার আক্রমণ করে। বর্গীর বাহিনী বিহার ও উড়িষ্যার অনেকটা অঞ্চল দখল করে ফেলে যখন হূগলী নদীর কাছাকাছি চলে আসে তখন আলিবর্দী খাঁ বাংলা র মানুষ কে এই অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের সঙ্গে "চৌথ" চুক্তি তে রাজি হয়।"চৌথ" অর্থাৎ, উৎপাদনের ২৫% খাজনা সব মানুষের উপর চাপিয়ে, তা বর্গীদের হাতে তুলে দিতে হবে। 

            তখনকার দিনে তার মূল্য নির্ধারণ হযেছিল বছরে ১২ লক্ষ টাকা। মানে বুঝতেই পারছেন এখন তার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান। এছাড়া প্রথম দুই তিন বছর পুরো খাজনা না দিতে পাড়ায় ১৭৪৩ সালে একসাথে ৩২ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য করা হয় নবাব আলীবর্দী খাঁ কে। তার পর থেকে প্রতিবছর ওই ১২ লক্ষ টাকা তোলা আদায়। সঠিক সময়ে সেই টাকা না পেলেই তারা বাংলার গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের থেকে টাকা আদায় করতো। না দিতে পারলে, নৃশংস অত্যাচার করা হতো, যেমন নাক, কান ও স্তন কেটে নেওয়া, জলের ট্যান্কে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দমবন্ধ করে মারা হতো, মহিলাদের ধর্ষন করা হতো,গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো ইত্যাদি।হলওয়েল, সলিমুল্লাহ, গঙ্গারাম শাস্ত্রী প্রমুখের রচনায় মরাঠাদের বীভৎসতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় "মহারাষ্ট্র পুরান" এ গঙ্গারাম লেখেন, " এবছর তারা কাওকেই ছারে নি। ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, সাধারণ মানুষ কাওকেই না। এমনকি হাজারে হাজারে গরু র গলা কেটে দিয়ে গেছে, গ্রামবাসী দের অর্থনৈতিক ভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।" মহারাষ্ট্র পুরানে উল্লেখিত "মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।/সোনা রুপা লুঠে নেয়, আর সব ছাড়া।।/কারু হাত কাটে, কারু নাক কান।/একি চোটে কারু বধয়ে পরাণ।/ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধরিয়া লইয়া যায়।/অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলায়।।/এক জনে ছাড়ে তবে আর জনা ধরে।/তারা ত্রাহি শব্দ করে।।''

            বর্গীর বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন,  মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিত। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে থাকেন! পরে ১৭৪৪ সালে আলীবর্দী খাঁ ভাস্কর পণ্ডিত কে ডেকে পাঠান শান্তি চুক্তির নামে। সেই মিটিং এর তাঁবু তেই ইয়ং সিরাজউদোল্লার সাহায্যে, গুপ্তসেনারা ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সহযোগী ২১ জন সেনাপতি কে খুন করে । এর পর ১৭৪৬ সালে বর্গীর বাহিনীর দায়িত্ব নেন জানজি রাঘোজি ভোঁসলে এর পুত্র জানজি ভোঁসলে।জানজি ভোঁসলের নেতৃত্বে বর্গীরা আবার বাংলা আক্রমণ করে, যদিও ১৭৪৭ সালে, তিনি আলীবর্দী খাঁ এর সঙ্গে বর্ধমানের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মেদিনীপুরের দিকে চলে যান।এরপর বর্ধমান ও মূর্শিদাবাদ বর্গীদের হাত থেকে উদ্ধার হলেও, বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যায় বর্গীদের প্রভাব থেকেই যায়। 

             ঝাড়গ্রামের কুলটিকরি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়াড়ি। কুলটিকরি থেকে কেশিয়াড়ি যাওয়ার পথে পড়ে কিয়ারচাঁদ। এই কিয়ারচাঁদের বিরাট এলাকায় শয়ে শয়ে লম্বা, চৌকা নানা রকম পাথর পোঁতা আছে। সাধারণ ভাবে বোঝা যায় না কী এগুলো। কিন্তু জনশ্রুতি বলছে, এই পাথরগুলোর সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা বংশানুক্রমে শুনেছেন, বর্গিদের অত্যাচারে ভয় পেয়ে স্থানীয় জমিদার সারি সারি পাথর পুঁতেছিলেন। সন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।

           ১৭৫১ সালে আলিবর্দী খাঁ উড়িষ্যা কে রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নামে লিখে দিলে, বর্গী আক্রমণ থামে। তবে বর্গী রা কোনোদিন ই কোলকাতা কে আক্রমণ করে নি। মূলত গ্রামেই তারা আক্রমণ করতো। হয়তো ব্রিটিশ দের ভয় করতো। যদিও কোলকাতা কে রক্ষা করার জন্য ৫ কিমি লম্বা একটা খাল কাটা হয়েছিল যার এই পারে বর্গীরা কোনোদিন ঢোকে নাই। সেই খালটি আমরা এখন আপার সার্কুলার রোড নামে চিনি। ওহ, কোলকাতায় তারা শুধু জগৎ সেঠ এর বাড়ি লুঠ করেছিল।

            মারাঠি হিন্দু সম্রাট রা, যে শুধুই বাংলা আক্রমন করে বাঙালী হিন্দু দের হত্যা করেছিল তা না। তারা বিভিন্ন রাজ্য কেই আক্রমণ করতো। ১৭৫৯ সালে তারা তিরুপতি মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে। ১৭৯১ সালে রঘুনাথ রাও পটবর্ধনের নেতৃত্বে, মাইসোর রাজ্য আক্রমণ করে ফেরার পথে "সৃঙেরি" মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে মারাঠি সেনা। যদিও, সেই সময়ের মাইসোরের নবাব টিপু সুলতান মুসলিম রাজা হয়েও এই মন্দির আবার সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেন। নিজে মন্দিরের মূর্তির জন্য অলংকার কিনে দেন।

            এই বর্গী রাজা রা এতোটাই অত্যাচারী ছিল, যে, সেই শোলে সিনেমার "শো যা, নেহিতো গব্বর আ যায়েগা" র মতো করে বাংলার গ্রামে গ্রামে মায়েরা বাচ্ছা দের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো এই বলে যে, 

                        "খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।
                          বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে? 
                          ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কী? 
                          আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।"

            ইতিহাসের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়। এই বর্গী রা হিন্দু হলেও তারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতে এতোটুকু ভাবে নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, এই অত্যাচার বাঙালীরা হিন্দু বলেই হয়েছে, তা নয়। বর্গিরা আচমকা ঘোড়ায় চড়ে 'হর হর মহাদেব' বলে গ্রামে ঢুকে পড়ত। লুঠ টাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই নাগপুরের রাজা যতোই হিন্দু হোক, "হর হর মহাদেব" বা "জয় শ্রীরাম" যাই বলুন  তারা যে, হিন্দু বলে ছার দেবেন এটা ভাবা খুব ই ভুল, লুঠ টাই তাদের উদ্দেশ্য, ইতিহাস সাক্ষী।।

সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫

ওয়াকফ আইন নিয়ে আপত্তির জায়গাগুলো ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ ওয়াকফ বিল (যদিও এই লেখার সময় সেটি আইনে পরিণত) এর আপত্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করার আগে বিল তথা বর্তমান চালু আইনের কিঞ্চিৎ পটভূমিকা প্রয়োজন যেটা আপত্তির জায়গাগুলো অনুধাবন করতে আমাদের সাহায্য করবে। 

১.১. ওয়াকফ- বিষয়টি কী: ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন অনুসারে, ওয়াকফ বলতে মুসলিম আইনে স্বীকৃত ধার্মিক, ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে যেকোনো ব্যক্তির স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির স্থায়ী উৎসর্গকে বোঝায়। এইভাবে উৎসর্গ করা সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলা হয়। যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি এভাবে উৎসর্গ করেন তাকে ওয়াকফি বলা হয় এবং যে ব্যক্তি এই সম্পত্তি পরিচালনা করেন তাকে মুতাওয়াল্লি (পরিচালক এবং প্রশাসক) বলা হয়। ওয়াকফ তিন ধরণের। (১) ওয়াকফউলিল্লাহ অর্থাৎ পাবলিক ওয়াকফ), (২) ওয়াকফ-আল-আওলাদ (শিশুদের জন্য ওয়াকফ) এবং (৩) মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগাহ, কবরস্থান, পিরোস্তান, ঈদগাহ ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের দ্বারা ওয়াকফ। পাবলিক ওয়াকফ ধর্মীয় এবং দাতব্য উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় যা জনসাধারণের জন্য এবং ওয়াকফ-আল-আওলাদ হল একজনের সন্তান/আত্মীয়দের কল্যাণের জন্য তৈরি একটি ওয়াকফ।  ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ বলতে বোঝায় যেখানে কোনও জমি বা ভবনের অংশ স্থায়ীভাবে কোনও ধর্মীয় বা ধার্মিক উদ্দেশ্যে যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়।

১.২. মুতাওয়াল্লি কে: ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনাকারী ব্যক্তিকে "মুতাওয়াল্লি" বলা হয়। মুতাওয়াল্লির আইনি অবস্থান হল ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপক বা সুপারিনটেনডেন্টের। মুতাওয়াল্লিরা আবার দুটি শ্রেণীর; নিযুক্ত এবং রেকর্ডকৃত। ওয়াকফ কর্তৃক সম্পাদিত, উত্তরাধিকারের নির্দিষ্ট নিয়মের সাথে, হস্তান্তর দলিলের সংস্করণ অনুসারে রেকর্ডকৃত মুতাওয়াল্লিদের বলা হয় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যেখানে উত্তরাধিকারের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই বা ওয়াকফ দলিল নেই, বোর্ড কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুতাওয়াল্লি নিযুক্ত হন।

১.৩. ওয়াকিফ বা দাতা কে: ওয়াকফ বা দাতা বলতে বোঝায় যে কোনও ব্যক্তি সর্বশক্তিমানের নামে কোনও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি উৎসর্গ করে যা মুসলিম আইন দ্বারা ধার্মিক, ধর্মীয় বা দাতব্য হিসাবে স্বীকৃত। দুইটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক) যিনি দান করবেন তাকে ঐ সম্পত্তির আইনত মালিক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। দুই) একবার কোনও সম্পত্তি উৎসর্গ করা হলে দাতা  সেই সম্পত্তির ওপর তার সম্পূর্ণ অধিকার হারাবেন এবং এই ধরনের সম্পত্তি কখনই বিচ্ছিন্ন, বন্ধক বা হস্তান্তর করা যাবে না, ফেরত নেওয়া যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, উপহার দেওয়া যাবে না বা অন্য নামে দানপত্র করা যাবে না, কিংবা উত্তরাধিকার হিসাবে সন্তান-সন্ততিরা পাবে না। 

১ ৪. ওয়াকফ এর ধর্মীয় পটভূমি: "ওয়াকফ" (আরবি: وقف‎) শব্দটি হাবুস নামেও পরিচিত, আরবি শব্দ "ওয়াকফা" থেকে উৎপত্তি, যার অর্থ আটকে রাখা, আটকে রাখা বা বেঁধে রাখা। বলা হয় যে, একবার দ্বিতীয় খলিফা আব্দুল্লাহ বিন ওমর খাইবার এলাকায় এক টুকরো জমি অধিগ্রহণ করেন এবং নবী মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করেন যে কীভাবে এর সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়। নবী বলেন, "সম্পত্তি বেঁধে দাও এবং মানুষের কল্যাণে উপার্জিত অর্থ উৎসর্গ করো, এবং এটি বিক্রি করা বা উপহার বা উত্তরাধিকারের বিষয়বস্তু করা যাবে না, এর উৎপাদিত ফসল তোমাদের সন্তানদের, তোমাদের আত্মীয়স্বজন এবং দরিদ্রদের এবং আল্লাহর পথে উৎসর্গ করো"। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রথম ওয়াকফ গঠন হয় হজরত মহম্মদের জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরামর্শে। মুখাই-রিক নামে একজন ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হজরত মহম্মদকে ৭ টি ফলের বাগান দান করতে চাইলে হজরত মহম্মদ তাঁকে পরামর্শ দেন ওয়াকফ তৈরি করে ঐ সম্পত্তি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করতে। 

১.৫. ওয়াকফ এর আইনি পটভূমি: ভারতে ওয়াকফ গঠিত হয় মধ্যযুগে ইসলামের আগমনের পরে। সুলতানি আমলে, মুঘল আমলে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাবে, মুলতানে, নিজামশাহের আমলে অবিভক্ত অন্ধ্রে, নবাব শাহী আমলে বাংলায় এবং অন্যান্য রাজ্যে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি গঠিত হয়। এইসব ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহৃত হতো দাতব্যমূলক কাজে এবং মুসলমান জনগণের সেবায়। ঐ অর্থে তৈরি করা হতো মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরখানা এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। পরবর্তী পর্যায়ে মুঘল শাসনামলে, আওরঙ্গজেব "ফতোয়াই-ই-আলমগীরি" এর মাধ্যমে ওয়াকফ সংক্রান্ত আইন সহ মুসলিম আইনগুলিকে সংহিতাবদ্ধ করেছিলেন যা ব্রিটিশ যুগে প্রিভি কাউন্সিলের সময়কাল পর্যন্ত বৈধ ছিল। ভারতে, মুসলিম ওয়াকফ বৈধকরণ আইন, ১৯১৩, মুসলিম ওয়াকফ আইন ১৯২৩ ব্রিটিশ আমলে প্রিভি কাউন্সিলের সময় প্রচলিত ছিল। এর পরে বেঙ্গল ওয়াকফ আইন, ১৯৩৪, অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপরে, ওয়াকফ আইন, ১৯৫৪ (কেন্দ্রীয় আইন) যা বলবৎ ছিল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া (যেখানে বেঙ্গল ওয়াকফ আইন, ১৯৩৪ বলবৎ ছিল কেন্দ্রীয় আইন জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত।

১.৬। দেশ স্বাধীন হলে ভারত সরকার ঐ আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। পরে ১৯৫৯, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৮৪ সালে কিছু কিছু সংশোধন করা হয়। পরে যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালে নতুন ভাবে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। বর্তমানে এই আইনকেই প্রিন্সিপাল আইন বলা হয়। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদীয় সিলেক্ট কমিটির সুপারিশের উপর ভিত্তি করে ওই আইনের বেশ কিছু সংশোধনী যুক্ত করে। ১৯৫৪ এবং ১৯৯৫ সালের আইনের ভিত্তিতেই রাজ্যে রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৫ সালের আইনের উপর ৪০টির বেশি সংশোধনী এনেছে।

এইবার বর্তমান সংশোধনী বিল এর বিভিন্ন আপত্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা যাক  

২ ১. সংশোধনীতে বলা হয়েছে ওয়াকফ আইন WAQF Act কথাটির পরিবর্তে এই আইনটির নাম হবে ''Unified Wakf Management, Empowerment, Efficiency and Development Act''। বিলের ১৩(২এ) অংশে বলা হয়েছে বোহরা সম্প্রদায় এবং আফগানি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রাখতে পৃথক পৃথক বোর্ড করা হবে। অর্থাৎ  বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি হতে মুসিলম জনসাধারণকে ভাগ করতে চাওয়া হয়েছে। বর্তমান বোর্ডগুলি সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করে। 

২.২. বিল অনুযায়ী কেবলমাত্র একজন মুসলিম যিনি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ধর্ম পালন করছেন এমন ব্যক্তিই ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারেন। ১৯৯৫ সালের আইনে বলা ছিল যে কোনও ব্যক্তি তা করতে পারেন। এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ হতে সেই অধিকারকে খর্ব করতে চাওয়া হয়েছে যাতে অমুসলিমরা কেউ ওয়াকফে সম্পত্তি দান না করেন। সংশোধিত আইনের ফলে মুসলিম অমুসলিম ভ্রাতৃত্বের এই প্রকাশ আর সম্ভব হবে না।

২.৩. ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্যরা মুসলিম সম্প্রদায়ের হবেন। অথচ বিলে বলা হয়েছে ঐ কাউন্সিলে অন্তন্ত দু'জন অমুসলিম থাকবেন। অমুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনা থেকে নিষিদ্ধ করার ইসলামিক আদেশ সত্ত্বেও, সংশোধিত আইনে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি মুসলমানদের তাদের ধর্ম পালনের সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ।

২.৪. ১৯৯৫ আইনে বলা ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি বিষয়ে যে সব ট্রাইবুনাল গঠিত হবে সেখানে মুসলিম আইন সম্পর্কে দক্ষতা আছে এমন ব্যক্তিকে রাখতেই হবে। বিলে এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যটা কি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

২.৪. বিলে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দু'জন মহিলা সদস্য থাকবেন। অথচ ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ''at least two women members''  অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের আইনে দুইয়ের বেশি থাকারও সুযোগ রাখা ছিল। এখন বলা হচ্ছে দু'জন থাকবেন। এটা কেন?

২.৫. পূর্বের আইন মোতাবেক রাজ্য সরকার ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসাবে সাংসদ ও বিধায়ক ক্ষেত্র হতে মুসলিম সাংসদ ও বিধায়কদের মধ্য হতে মনোনীত করতো। বর্তমানে বিলে বলা হয়েছে মুসলিম হতে হবে এমন নয়, যে কোন সাংসদ, বিধায়ক থাকতে পারবেন। মন্দির ট্রাস্ট বডিতে এই ফর্মুলা মানা হবে তো?

২.৪. এই বিল অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি নির্ধারণের ক্ষমতা সার্ভে কমিশনারের কাছ থেকে সরকার নিযুক্ত রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করে, সরকার উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এবং বৃত্তিমূলক কেন্দ্রগুলিকে জব্দ করার লক্ষ্য নিয়েছে, যার ফলে ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করা হবে। বিলে আরও বলা হয়েছে যে কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির নথি সহ রেজিষ্ট্রকরণ বাধ্যতামূলক এবং তা করতে হবে জেলাশাসকের কাছে। কেন এটা হবে? মৌখিক অনুমতির ভিত্তিতে বহু ওয়াকফ তৈরি (Wakf by use) হয়েছে এবং তা লাগু আছে। সেগুলির তাহলে কি হবে? দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার ওয়াকফ সম্পত্তির নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতামূলক নতুন আদেশটি সরকারের গোপন কর্মসূচিকেই উন্মোচিত করে, সেগুলি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে।

২.৫. ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে রাজ্য সরকারগুলি ওয়াকফ ট্রাইবুনাল তৈরি করবে এবং ৭(১) ধারায় বলা আছে সেই ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত। বর্তমান বিলে ৭(১) ধারাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলাশাসকদের। এক্সিকিউটিভদের এই জুডিশিয়ারি ক্ষমতাদান এর মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হচ্ছে।

২.৫. এই বিল অনুযায়ী কোনও ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের অধীনে থাকলে তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। তা কেন হবে? মালিকানা কেন ওয়াকফ হারাবে? বরং সরকারের দেখা উচিত যেসব সরকারি সম্পত্তির মালিকানা ওয়াকফের নামে আছে অথচ সরকার ভোগ করছে তার মধ্যে যেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব তা দিতে হবে।

২.৬. এই বিল অনুযায়ী0l কেন্দ্রীয় সরকার রেজিস্ট্রিকৃত ওয়াকফ সম্পত্তির হিসাব পরীক্ষা করার বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ১৯৯৫ সালের আইনে ওয়াকফ বোর্ড এবং রাজ্য সরকার এই কাজ করতো। এটা রাজ্য সরকারের কাজের উপর এবং ওয়াকফ বোর্ডগুলির ক্ষমতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে 
ওয়াকফ বোর্ডগুলি তদারকি করে রাজ্য সরকার। এই বিল প্রণয়নের সময়ে কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা করেনি। কৃষিনীতি (বর্তমানে বাতিল), শ্রমনীতি, এমন কি শিক্ষা নীতি রচনায় কেন্দ্র একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। এই পদক্ষেপে আসলে ভারতের সংবিধান স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্রীয়  কাঠামোর ওপরেই আঘাত।

২.৭. সর্বশেষে ওয়াকফ আইনের ৪০ ধারা বাতিল করার মাধ্যমে, ওয়াকফ বোর্ড ওয়াকফ সম্পত্তির প্রকৃতি নির্ধারণের কর্তৃত্ব হারাবে। ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি মূলত চারটি বিভাগে পড়ে: দলিল অনুসারে ওয়াকফ (নথিভুক্ত), মৌখিক ঘোষণা অনুসারে ওয়াকফ (মৌখিকভাবে ঘোষিত), ব্যবহারের মাধ্যমে ওয়াকফ (দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত), এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমি। নতুন সংশোধনীর অধীনে, দেশের বেশিরভাগ ওয়াকফ সম্পত্তি - যা মৌখিকভাবে বা ব্যবহারের মাধ্যমে ঘোষিত - সরকারী দখলের ঝুঁকিতে পড়বে।উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং কেরালার মতো বৃহত্তম ওয়াকফ হোল্ডিং সহ রাজ্যগুলি এই ঝুঁকির সামনে

সবশেষে যেটা বলার তা হল এই যে বিষয়টা মোটেই এমন নয় যে এই বিল আসার আগে ওয়াকফ নিয়ে যা চলছে সেটা খুব গ্রহণযোগ্য। ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা এবং পরিমাণ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। কেননা দেশে সে ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কোনও সমীক্ষা হয়নি। নিবন্ধিত হয় নি এমন বহু ওয়াকফ আছে। তবে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল সূত্রে জানা যায় সারা দেশে কমবেশি ৮ লক্ষ ৭০ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি আছে এবং সেগুলিতে মোট জমির পরিমাণ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার একরের মতো। এর বাজার মূল্য ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দেশের স্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফের সংখ্যা ৮ লক্ষ ৭২ হাজার ৩২৮ টি এবং অস্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফ সংখ্যা হলো ১৬,৭১৩ টি। এর মধ্যে ডিজিটাল রেকর্ডভুক্ত করা সম্ভব সম্ভব হয়েছে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৯৯৫ টি ওয়াকফের। পশ্চিমবাংলায় ১ লক্ষের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। যার মধ্যে রেকর্ড ভুক্ত ৮০ হাজারেরও বেশি। যেটা বাম আমলে হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে দেশে প্রতিরক্ষা ও রেল দপ্তরের পরে সবচেয়ে বড় জমির মালিকানা হলো ওয়াকফ সম্পত্তি। 

এই বিপুল সম্পত্তির অনেকটাই বেআইনি ভাবে ব্যক্তিস্বার্থে ভোগ দখল করছেন এমন কিছু মানুষ যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, আদপে ওই সম্পত্তি সাধারণ গরীব মানুষের কাজে লাগছে না। তাই আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করবেন না। কিন্তু আইন সংশোধন সংস্কারের নামে সংবিধান প্রদত্ত ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করার চেষ্টা হলে সমস্ত শুভুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিভাজনকারী ওয়াকফ সংশোধনী আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাতে হবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে। এটাই আবেদন।