রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭

আচ্ছে দিন ~ সুশোভন পাত্র

চুনো-পুঁটি'দের দিন গুলো দুরকম। একদিন, যেদিন আপনি বাজারে গিয়ে দেখেন, পটল ৪০ টাকা/কেজি, শসা ৬০ টাকা, আর টোম্যাটো ৮০ টাকা, যেদিন আপনি পাঁচ-দশ টাকার জন্যও দর কষাকষি করেন; সেদিনটা, 'খারাপ দিন'। আরেক দিন, যেদিন আপনি দেখেন, পটল ৫০ টাকা/কেজি, শসা ৭০ টাকা, আর টোম্যাটো ১০০ টাকা, যেদিন আপনি দাম শুনেই আঁতকে ওঠেন; সেদিনটা 'আরও খারাপ দিন'। দাম বেড়ে যাবে আন্দাজ করে কেজি খানেক শসা যদি আপনি আগের দিনই বেশী কিনে রাখতেন, তাহলে সেটা হতে পারতো আপনার 'মাস্টার স্ট্রোক।' বিজনেসের ভাষায় 'রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্ট'। ঐ যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছিলেন, "এদেশের বিগ-বিজনেস হাউস গুলো বরাবর রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্টের সুবিধা উপভোগ করে" -সেই 'রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্ট' ¹ । 
রাঘব-বোয়াল'দের দিনগুলো তিনরকম। একদিন, যেদিন আম্বানি-আদানি'রা ব্যবসায় ইনভেস্ট করে, 'শ্রম ও উৎপাদনের' সম্পর্কের বঞ্চনায় সংশ্লেষিত মুনাফা অর্জন করে; সেদিনটা 'আচ্ছে দিন'। আরেক দিন, যেদিন মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হন এবং নির্বাচিত জনকল্যাণকামী সরকার, রিটায়ার্ড বাপের পি-এফে সুদের হার কমিয়ে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ-কোটি টাকার লোন 'রাইট অফ' করে; সেদিনটা আরও 'আচ্ছে দিন'। আর যেদিন, বিজয় মালিয়া ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ৯,০০০ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া রেখে, গোয়ার প্রাইভেট বিচে জন্মদিনে এনরিক ইগলেসিয়াসের 'ব্যালেন্ডা'র' সুরে কোমর দুলিয়ে, প্লেনে চেপে, হুশ করে লন্ডন উড়ে যেতে পারেন, সেদিনটা আরও আরও 'আচ্ছে দিন' ² । 
রাজন বলেছিলেন "সিস্টেমের কাছে যার এতো ধার বাকি, জন্মদিনের পার্টিতে তাঁর এতো অপব্যয়র বিলাসিতা মানায় না। ³" সমস্ত ব্যাঙ্ক কে নির্দেশ দিয়েছিলেন "অন্যায় সুবিধা না দিয়ে এই বিগ-বিজনেস হাউস গুলির অনাদায়ী ঋণ দ্রুত আদায় করতে হবে। ⁴" এরই মূল্য চোকাতেই সেদিন অর্থমন্ত্রীর সাথে 'লো ইন্টারেস্ট রেট' আর মুদ্রাস্ফীতির তু-তু-ম্যা-ম্যা'র অজুহাতে, রাজন কে তাড়িয়ে উৰ্জিত প্যাটেলের ক্ষমতায়নের ঘোলা জলে মাছ ধরে সম্পন্ন হয়েছিলো 'রিস্কলেস ক্রনি ক্যাপিটালিজম' কে বাঁচিয়ে রাখার আস্ত একটা 'মোডাস অপারেন্ডি'। 
আম্বানি'দের 'ব্যালেন্স শিটে' পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার নাম উঠেছে ২০১৪'তেই। যেদিন প্রকাশ পেয়েছিল পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার "গ্যাস ওয়ার্স" বইটি। নিখুঁত বর্ণনা, অলঙ্ঘনীয় নথি, আর রিলায়েন্সের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা'দের সাক্ষাৎকারে সেদিন দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়েছিল, কৃষ্ণ-গোদাবরী বেসিনের গ্যাস উত্তোলন, নগদীকরণ, বাজারিকরণ নিয়ে আম্বানি'দের বাণিজ্যিক সংঘাতের কালো অধ্যায়। বে-আব্রু হয়েছিল তৎকালীন ক্যাগ, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আম্বানি'দের ব্যাক-ডোর সখ্যতার 'নেক্সাস'। তিনদিনের মাথায় 'ইচ্ছাকৃত মানহানি'র অভিযোগে ১০০ কোটির ক্ষতিপূরণ চেয়ে পরঞ্জয় কে লিগাল নোটিশ পাঠিয়েছিল রিলায়েন্স ⁵। 
কলম থামেনি পরঞ্জয়ের। বরং অ্যাকাডেমিক জার্নাল ই.পি.ডাব্লিউ'র এডিটরের দায়িত্ব নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী আর্টিকেলে তিনি 'ক্রনি ক্যাপিটালিজম' মুখোশ খুলে দেন। জনসমক্ষে আসে 'আদানি পাওয়ার লিমিটেড' কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মালবাহী জাহাজের খরচ ও কাস্টম ডিউটি সহ ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩৩৫০ টাকা/মেট্রিক টন মূল্যে 'স্টিম কয়লা' আমদানি করে ৫৪৯৪ টাকা/মেট্রিক টন মূল্যে বিভিন্ন স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড গুলিকে বিক্রি করছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীর তথ্যানুসারে যে দুর্নীতির পুঞ্জীভূত অঙ্ক প্রায় ৫০,০০০ কোটি ⁶। শুধু তাই নয়, ২০১৬'র অগাস্টে অর্থমন্ত্রক সংযোজনী এনে এস.ই.জেড এলাকার কোন প্রজেক্টে প্রযোজ্য ট্যাক্সের নিয়ম শিথিল করে এবং রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্টে অতিরিক্ত ট্যাক্স রিফান্ডেবেল ঘোষণা করে। সংসদে সেই সংযোজনী পাশ হবার দু-দিনের মাথায় 'আদানি পাওয়ার লিমিটেড' গুজরাট হাইকোর্টে পি.আই.এল ফাইল করে ৫০০ কোটি টাকার প্রদত্ত ট্যাক্স রিফান্ডের আবেদন করে। এবং ক্রিম অফ দি টপ; উপযুক্ত নথি ছাড়াই হাইকোর্টে সেই আবেদন মঞ্জুরও করে। 'ক্রনি ক্যাপিটালিজমের' নিখুঁত চিত্রনাট্য এবং তার মসৃণ বাস্তবায়ন বোধহয় একেই বলে। শুধু মিসিং ছিল এক চিমটে ট্র্যাজেডি। শেষ পাতে জুটেছে সেটাও। পরঞ্জয় কে ঐ আর্টিকেল লেখার অপরাধে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে ই.পি.ডাব্লিউ'র মালিক পক্ষ। ওয়েবসাইট থেকে সরিয়েও নেওয়া হয় আর্টিকেল গুলি। রঘুরাম রাজনের পরে পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। কট অর্থমন্ত্রক বোল্ড বিগ-বিজনেস হাউস ⁷ ⁸ ⁹ ।  
এবং এর পরেও আপনার মনে হতেই পারে এসব নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু সমস্যা কি জানেন? সমস্যাটা কাকতালীয় ঘটনা গুলোর পৌনঃপুনিকতায়। যেমন ধরুন, ২০১৪'র অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী গৌতম আদানি স্বাক্ষর করলেন কুইন্সল্যান্ড অববাহিকায় কয়লা উত্তোলন প্রোজেক্টে ¹⁰।  কিম্বা ২০১৫'র প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া এবং ফ্রান্স সফরে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ম্যানুফ্যাকচারিং'র চুক্তি পেলো রিলায়েন্স ¹¹।  আবার ধরুন, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে 'আম্বানি পাওয়ার লিমিটেডের' সাথে মৌ সাক্ষরিত হল বাংলাদেশ পাওয়ার বোর্ডের ¹² । ২০১৭'র আমেরিকা সফরে রিলায়েন্স পেল যুদ্ধজাহাজ মেরামতের বরাত ¹³ । আর ইজরাইল সফরে আদানি'রা করল ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিলের বাজিমাত ¹⁴ ।  
আপনি যখন ব্যস্ত আছেন হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ক্রিশ্চানে বাছতে; আপনি যখন চায়ের আড্ডায় প্রতিদিন ঝড় তুলছেন গরু-শুকর-গোবর-ঘুঁটে নিয়ে; মেয়ের টিউশন ফিস, মায়ের বাত, বউ'র আবদার আর নিজের বিয়ার; একটু গুছিয়ে বসে যখন ভাবছেন 'এই বেশ ভালো আছি'; ঠিক তখনই এই সব কিছুর আড়ালেই বাড়ছে সরকার ও বিগ-বিজনেস হাউসের প্রতিদিনের সখ্যতা। বাড়ছে আম্বানি-আদানিরা। বাড়ছে তাঁদের মুনফা। বাড়ছে ৯৯%'র সঙ্গে ১%'র বৈষম্য।  
কাকতালীয় আজ আপনার মনে হতেই পারে কিন্তু, যে দেশে ঋণখেলাপি বিজয় মালিয়া পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে লন্ডনে বসে থাকেন, যে দেশে ওত্তাভিও কাত্রোচ্চিরা বোফোর্সের পরও কলার তুলে ঘুরে বেড়ান, যে দেশে ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেনরা ভোপালে নির্বিচারে মানুষ মেরে মন্ত্রীদের প্লেনে চেপে পালিয়ে গিয়ে আমেরিকায় নিশ্চিন্তে মরেন, সে দেশে সত্যেন্দ্র দুবেরা বাঁচতে পারে না, রঘুরাম রাজনরা থাকতে পারেন না, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতারা লিখতে পারেন না। 
এবার আপনি ঠিক করুন আপনি কোন পক্ষে। ওত্তাভিও কাত্রোচ্চি-ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেন'দের পক্ষে ? না সত্যেন্দ্র দুবে'দের? আম্বানি-আদানি'দের পক্ষে? না রঘুরাম রাজন-পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাদের?  ঠিক করুন আপনি থাকবেন কার সাথে? ঐ ১%'সাথে না  ৯৯%'দের সাথে? নিরামিষ নিরপেক্ষতা তো অনেকদিন হল। এবার না হয় পক্ষ নিন। এবার না হয় বদলে দিন।








-- 





মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০১৭

প্রার্থনা ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

নৃত্য যেথা সারমেয়, পুচ্ছ যেথা বাঁকা 
গরু যেথা বোড়ে, যেথা গেরুয়া পতাকা
কেবলই গায়ের জোরে দিবসশর্বরী
দখল মন্ত্র গায়, আহা মরি মরি
যেথা বাক্য তঞ্চকতা ভরা হতে হতে
বক্তৃতা সাজায়, যেথা মিথ্যাকথা স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কালোটাকা ধায়
বিজয় মাল্য সম চরিতার্থতায়
যেথা উচ্চ পতঞ্জলি প্রহেলিকারাশি
বিজ্ঞানের স্রোতঃপথ ফেলিয়াছে গ্রাসি
সংবিধান করেছে শতধা; নিত্য যেথা
আমোদিত মোদী ভুল বোঝানোর নেতা
নিজ হস্তে পাঠ্যবই ঠিক করে পিতঃ,
ভারতকে সে' নরকে করো হে স্থাপিত।

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

আর এস এস এর শত্রু ~ সুশোভন পাত্র

-কটা বাজে খেয়াল আছে? দুপুরের খাবারটা কি তোদের চায়ের দোকানের ঠেকেই দিয়ে আসবো? 

মহাসপ্তমী'র পুণ্য তিথিতে, খাবারের থালা সাজিয়ে মা তখন জাগ্রত এবং সংহারী। অগত্যা ঝাঁটাপেটা এড়াতে, প্রবল বাগবিতণ্ডার ষোলআনা রাজনৈতিক আড্ডার আপাতত ইতি টানলাম। নব্য আর.এস.এস এবং আমার বাল্য বন্ধু'র গায়ে তখনও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় দিল্লীর মসনদ দখলের ঔদ্ধত্যের গন্ধ টাটকা। একমুখ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আর এক আকাশ রয়াব নিয়ে বন্ধু সেদিন বলেছিল 
-ভাই, তোদের কে নিয়েই যা চিন্তা। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কে আমরা জাস্ট ফুঁকে উড়িয়ে দেব। সত্যি বলতে, উই ডোন্ট রিয়েলি কেয়ার অ্যাবাউট দেম।

আলতো হিমেল পরশে মোড়া নভেম্বরের দিল্লী। কেতাদুরস্ত অশোকা হোটেলে বসল 'ওয়ার্ল্ড হিন্দু কংগ্রেস।' তিনদিনের আলোচনার নির্যাস নিংড়ে, আগত প্রতিনিধি'দের হাতে 'থট পেপার' ধরিয়ে জানিয়ে দেওয়া হল, 'হিন্দু সমাজে সবচেয়ে বড় পাঁচ শত্রু'র নাম' –'এম ফাইভ'। না! 'মুসলিম' কিম্বা 'মিশনারি' না! 'এম ফাইভ'র তালিকাতে প্রথম 'এম'; 'মার্ক্সিসিম' ¹। বুঝলাম, বাল্য বন্ধু'র দুশ্চিন্তা নেহাতই বিক্ষিপ্ত নয়। বরং আর.এস.এস'র আদর্শের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত।

২০১৪'র ওড়িশার বিধানসভা নির্বাচনে এই 'মার্ক্সসিস্ট'রা ভোট পেয়েছিল মেরেকেটে ৮০,২৭৪। শতকরা ০.৪%। আর বিধায়ক কুড়িয়ে বাড়িয়ে ঐ একটা ² । অথচ গত ডিসেম্বরে, ভুবনেশ্বরে, এমনই একটা ক্ষয়িষ্ণু ডেভিড'দের রাজ্য পার্টি অফিস আক্রমণ করল 'পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দল', গোলিয়াথ বি.জে.পি ³ । বুঝলাম, বাল্য বন্ধু'র দুশ্চিন্তা নেহাতই কাকতালীয় নয়। বরং আর.এস.এস যাজকতন্ত্রের ধমনীতে অন্তর্নিহিত আশঙ্কা সূত্রে সংক্রামিত। 

২০১১'র আগে, এই নব্য আর.এস.এস বন্ধুই জোর গলায় বলত, "এই রাজ্যে গরু-ছাগল-ভেড়া-কুকুর যেই ক্ষমতায় আসুক আপত্তি নেই; কমিউনিস্ট'দের তাড়াতে হবে।" কমিউনিস্ট'দের তাড়ানোর সেই মনোবাঞ্ছনা নিছকই উদ্দেশ্যহীন ছিল না। ছিল না, কারণ, গরু-ছাগল-ভেড়া-কুকুরের'ও অধম এই 'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, আর.এস.এস-জামত'দের জন্য এ রাজ্যের দরজা নিয়ম করে বন্ধ থাকতো। রথে চেপে 'লৌহপুরুষ'দের 'মন্দির ওহি বানায়াঙ্গে'র চ্যাংড়ামি এ রাজ্যের দুয়ারে এসে থমকে যেতো। ৮৪ কিম্বা ৯২, গোধরা কিম্বা গুজরাট; এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তখন "দাঙ্গাবাজ'দের মাথা ভেঙ্গে" দেবার হিম্মত রাখতো। লড়াইটা এ রাজ্যের 'হ্যাভ নটস' গুলো জাত নিয়ে নয় পেটের খিদে আর হাতের কাজ নিয়েই করতে জানতো। 

'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, ধূলাগড়ে কোনদিন নবী'র জন্মদিনে মিছিল করতে হয়নি। তৃণমূলের গুলশান মল্লিকের মত, ধূলাগড়ে, 'কমিউনিস্ট'দের' কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কে ভোটের জন্য আইন-প্রশাসনের বিধি নিষেধের তোয়াক্কা না করে সেই মিছিল 'হিন্দু পাড়া'র মধ্যে নিয়ে যেতে উস্কানি দিতে হয়নি। আর.এস.এসের মদত এবং আদর্শপুষ্ট 'অন্নপূর্ণা ক্লাবের' ঢিল ছোড়া দূরত্বে ইসলামের পতাকা টাঙ্গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বারুদ সাজাতে হয়নি ⁴ । এতে ৩৪ বছরে ইসলাম পালনে কোন বাধা হয়নি। কোরানের সূরার পবিত্রতার দুধে একফোঁটা চোণা পড়েনি। বেহেশতের রাস্তা কণ্টকাকীর্ণও হয়নি। 

জীবদ্দশায় মৌলানা ইয়াসিন মণ্ডল, বারাসতে কোনদিন হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় উত্তেজনার লেশ অনুভব করেননি। ইয়াসিন মণ্ডল বাদুড়িয়ার মিলান মসজিদের ইমাম। সেই মিলান মসজিদ, যে মিলান মসজিদের উল্টো দিকের বাড়িটা ১৬ বছরের শৌভিকের। যে বয়সে শৌভিক'দের ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী পেরিয়ে, ক্যালকুলাসের অঙ্কে কিম্বা শেক্সপিয়ারের সনেটে বুঁদ হয়ে থাকার কথা, দু-একটা ইনফ্যাচুয়েশন কে প্রেমে বদলে দেবার কথা; আজকাল সেই বয়সে শৌভিক'রা মনে ঘৃণার বিষ পুষছে। নির্দ্বিধায় অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করে আনন্দ পাচ্ছে। বাড়ি বয়ে এক মৌলবাদের খাল কেটে অন্য মৌলবাদের কুমীর আনছে ⁵। 

নেহেরুর ভ্রান্ত মাশুল সমীকরণ নীতির ⁶ বদন্যতায় পূর্ব প্রান্তের রাজ্যগুলোর শিল্প সম্ভাবনার শশ্মানেই সেদিন সেজে উঠেছিল পশ্চিমের রাজ্যগুলো। ব্যবসায়ী'দের বোম্বে হবু 'বাণিজ্যনগরী'। মালিকের মুনফা আর কারখানার উৎপাদনের ত্রৈরাশিকে প্রতিদিন লেখা হচ্ছে শ্রমিক বঞ্চনার ইতিহাস। শোষিত সেই মুটে-মজুর'দের অধিকার আদায়ের ফিনিক্স স্বপ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলো লাল ঝাণ্ডা। ১৯৬৭'র নির্বাচনে বোম্বে জুড়ে ভোট বাড়াল কমিউনিস্ট পার্টি। দক্ষিণ বোম্বে থেকে সাংসদ হলেন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রীপাদ অমৃত দাঙ্গে ⁷। ট্রেড ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে সেদিন প্রমাদ গুনেছিল মালিক-ব্যবসায়ী মহল। শ্রমিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে কমিউনিস্ট'দের শায়েস্তা করতে, জরুরী অবস্থায় অন্ধকার দিনে আত্মপ্রকাশ করেছিল শিবসেনা। মালিক'দের টাকা আর কংগ্রেসের ইন্ধনে অল্প কিছুদিনেই নিছক একটা পত্রিকা সম্পাদক থেকে বাল ঠাকরের হয়ে উঠলেন বিষাক্ত রাজনীতির বেতাজ বাদশা ⁸। আর 'অজ্ঞাত পরিচয়' ব্যক্তির ১৬টা গুলি বুকে নিয়ে রক্তাক্ত হলেন শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃৎ 'কমিউনিস্ট' দত্ত সামন্ত ⁹ । 

আসলে 'কমিউনিস্ট'দের সাথে লড়াইয়ে মৌলবাদী'দের বরাবরই একটা মুখোশ লাগে। সেদিনে যে মুখোশের দায়িত্ব কৃতিত্বের সাথে পালন করেছিল শিবসেনা, আজকের বাংলায় সেই গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। তাই 'কমিউনিস্ট'দের' ৩৪ বছরে, যে রাজ্যে কোনদিন চার দেওয়ালের গণ্ডী পেরিয়ে ধর্ম রাস্তার রাজনীতিতে এভাবে বেআব্রু হয়নি, যে রবীন্দ্র-নজরুল-লালনের মাটিতে গুলশান মল্লিক কিম্বা শৌভিক'দের চাষ হয়নি, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আজকাল মৌলবাদ চাষের জমি উর্বর করতে যত্ন করে লাঙ্গল দিচ্ছেন। 

তবুও আমার গোলিয়াথ বন্ধু আজও 'কমিউনিস্ট' ডেভিড'দের নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। করে কারণ, আজও গোটা বিশ্বজুড়েই মৌলবাদী'দের মুখ আর মুখোশ, দুইয়ের বিরুদ্ধেই 'কমিউনিস্ট'রাই বুক চিতিয়েই লড়াই করে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু'দের উপর অত্যাচার কিম্বা পাকিস্তানে বঞ্চিত শ্রমিকের অধিকার, আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষের শিকার কিম্বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ব্যয়সংকোচ নীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের জোগাড় –আজও দেশে-বিদেশে লাল ঝাণ্ডাই প্রতিদিন পথে নামে। ইতিহাস সাক্ষী এই 'কমিউনিস্ট'দের' জন্যই দুনিয়া একদিন হিটলারের রক্ত চক্ষুর কাছে মাথা নোয়ায়নি, মুসোলিনির কাছে হারেনি। এই 'কমিউনিস্ট'দের জন্যই আজও জীবন বাজি রেখে আই.এস.আই.এস বিরুদ্ধে কুর্দ'দের লড়াই থামেনি। আর এই 'কমিউনিস্ট'দের' জন্যই বাংলার মাটি পাকিস্তান হয়নি, আর গুজরাটও হবেনা। 

আমার গোলিয়াথ বন্ধু দুশ্চিন্তার করে কারণ, ইতিহাস সাক্ষী, আর.এস.এস'র কিম্বা জামাত -দুনিয়ার তামাম ডেভিড-গোলিয়াথের লড়াইয়ে, গোলিয়াথরা কোনদিন জেতেনি। গোলিয়াথরা কোনদিন জিতবে না।









শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

হাসপাতালের জার্নাল ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

এই জার্নালে, কাব্য ভারাক্রান্ত কিছু দেব না এই রকমেরই ভাবনা ছিল। এমনিতেই মন খুব খারাপ। চাকরিতে ঢোকার সময় অবসরের জন্য আটান্ন বছর বয়স ধার্য ছিল। ভিআরএসএর অধিকারহীন এই চাকরির বাধ্যতামূলক বয়সসীমা বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় স্বপ্ন দেখলাম জীবনানন্দ দাশ সরকারি ডাক্তার, তাঁর বয়স তেষট্টি পেরিয়েছে। রিটায়ারমেন্টের বয়স হেঁটে যাচ্ছে অনন্তের দিকে।
ঘুম ভাঙতেই কবিকে প্ল্যাঞ্চেটে ডাকলাম। সমান্তর পৃথিবী থেকে নেমে এসে তিনি লিখে দিয়ে গেছেন যা, সে'টুকু নীচে রইল।
------------------------------------------------------------------------

তেত্রিশ বছর ধরে আমি খেলা দেখাচ্ছি সরকারি সার্কাসে
মেডিকেল কলেজ থেকে সত্তরের বিভীষিকা দশক পেরিয়ে
অনেক ঘুরেছি আমি। ইন্টার্নশিপের সেই ধূসর জগতে,
সেখানে একবছর, আশা প্রহেলিকামাখা হাউসস্টাফ শিপেও
সে'খানে ছিলাম আমি। আরও ঘোর অনিশ্চিত চিকিৎসার রিঙএ,
আমি ক্লান্ত বাঘ এক, রিঙমাস্টারেরা শুধু চাবুক মারেন।
আমাকে দু'দণ্ড শান্তি দিলই না আজব এক হিটলারি ব্রেন।

মাইনে তার কবেকার ডিএ-হীন অতিদীন স্কেলে
চাকরির ক্ষেত্রটুকু মাননীয়াটির দেওয়া উস্কানির পর
আজ নিরাপত্তাহীন। সেই বাঘ হারিয়েছে দিশা
তবু অবসর-লোভ যখন সে চোখে দেখে সার্ভিস বুকের ভিতর,
তখনই ভবিষ্য দোলে অন্ধকারে, বুঝে যাই জেগেছে ভিলেন
বক্তৃতায় অতিদড় গলা যার… মাননীয়া শয়তানি ব্রেন।

তেষট্টি বছর পুড়ে ছাইভরা চিতার মতন
সন্ধ্যা আসে, মাথার মেধা ও স্মৃতি ক্রমশ বাতিল
পৃথিবীর সব রঙ নিভে এলে সিপিএ-র হয় আয়োজন
তখন কেসের ভয়ে ছানি-চোখ করে ঝিলমিল
মৃত্যুপথযাত্রী বাঘ… পাবই না,  পেনশনে প্রাপ্য লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মেরে ফেলে গিলবার শয়তানি ব্রেন।

শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭

নয়ডা ~ আর্কাদি গাইদার

'কে কখন কোথায় কিভাবে বিষ্ফোরণ ঘটাবে তা জানতে রাষ্ট্রশক্তির এখনো বাকি আছে'
- হারবার্ট, নবারুন ভট্টাচার্য্য

নয়ডাতে মহাগুন মর্ডার্ন সোসাইটি নামক গেটেড কমপ্লেক্স। গেটেড কমপ্লেক্স মানে এই যেমন ধরুন কলকাতার সাউথ সিটি, বা বেংগল অম্বুজা। প্রাচীর ঘেরা জমি, সবুজ লন, তার মধ্যে ছবির মতন সুন্দর অট্টালিকার সমাবেশ। বাইরের নোংরা শহর আর তার ততধিক নোংরা ঘেমোগন্ধওয়ালা মানুষগুলোর থেকে পার্টিশন করা সম্পূর্ন আলাদা একটা জগত। তা এরকমই একটি গেটেড কমিউনিটি মহাগুন মর্ডার্নের কোন একটি ফ্ল্যাটে কাজ করতেন জোহরা বিবি। পরশু থেকে হঠাত নিখোজ হয়ে যান। তারপর কাল তার হদিশ পাওয়া যায়। তার মালিকের দাবি যে জোহরা বিবি নাকি ১০০০০ টাকা চুরি করে বাড়ির বেসমেন্টে লুকিয়ে ছিলেন। জোহরা বিবি জানিয়েছেন, তাকে মালিক গোটা দিন একটা ঘরে আটকে রেখেছিলো। এরপর জোহরা বিবির  বাড়ি যেযে বস্তি/কলোনীতে সেখানকার লোকজন খেপে গিয়ে কমপ্লেক্সে হামলা করেন, ভাংচুর করেন। সিকিওরিটি গার্ডরা হাওয়ায় গুলি চালায়। তারপর পুলিশ আসে। আপাতত ওই বস্তির ৫০ জন পুলিশ হাজতে।

এর পরেই বাজার গরম হয়ে ওঠে বিভিন্ন ভাবে। বেশ কিছু মিডিয়া রিপোর্ট করে যে 'আবাসনের শান্তিপ্রিয় বাসিন্দাদের ওপর 'মব' এর হামলা'। চুরি লুকোতে গা জোয়ারি। ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভদ্রলোকেরা আতংকিত হয়ে লিখতে শুরু করে - এদের কে কাজে রাখা যাবে না! কি অনাসৃষ্টি! কত সাহস! এমনকি চাড্ডিরাও পিছিয়ে থাকবে না বলে প্রচার শুরু করে দিয়েছে 'হিন্দু মালিকপক্ষের ওপর বেআইনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মোল্লাদের হামলা'। চাড্ডিদের নিয়ে আজকাল আর অবাক হইনা, হাসিও পায় না। যে কোন শ্রেনী সংঘাতকে সাম্প্রদায়িক রং দিতে ওরা বিশেষ ট্রেনিং পায় বোধহয়। ভাঙরের ক্ষেত্রেও করেছিলো। তা এই চরম ক্যাকোফোনির মধ্যেও কিছু কিছু মিডিয়া ঘটনার সব দিক তুলে ধরে রিপোর্টিং করবার চেষ্টা করেছে, তার লিংক কমেন্টে দিয়ে দেবো।

এই হলো তথ্য। এরপর আসবে সত্য। আমি দুটো বাক্য কে মূলমন্ত্র মেনে চলি - Seek truth from facts. আর There is no truth but class truth. তাই আপাতত তথ্য থেকে শ্রেনী সত্য উদঘাটনের সামান্য প্রয়াস করি।
প্রথমেই জানাই, জোহরা বিবি মিডিয়াকে জানিয়েছেন যে তিনি কুচবিহারের বাসিন্দা, এবং ভারতের নাগরিক হিসেবে তিনি নিজের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সবই পুলিশ এবং মিডিয়াকে দেখিয়েছেন। এবার চলুন তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম উনি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মোল্লা। তা ওনাকে কাজে রাখবার সময় তো এইটা নিয়ে কোন অসুবিধে হয়নি। তাহলে আজকে ওনার সাথে বৈরিতার সময় এই তথ্য দিয়ে কি হবে? 
ভারতবর্ষের উচ্চমধ্যবিত্ত কি পরিমানে সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা বহন করে, তার প্রমান আমরা রোজ হাতেনাতে পাই নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। এ ছাড়া এই বাংলাতেই খবরের কাগজে মাঝেমধ্যেই বাড়ির কাজের লোকের ওপর অত্যাচার নিয়ে কত খবরই বেরোয়। সেখানে নয়ডার মতন জায়গার বড়লোকরা, বিশেষ করে এই আবাসনে থাকা পয়সাওয়ালারা, যাদের অভিজ্ঞতা আছে, জানবেন যে বাকিদের থেকে অনেককাঠি ওপরে। তাই যখন দেখেছি যে গোটা কলোনীর লোক একসাথে আবাসনে হামলা চালিয়েছে, এটা বুঝতে খুব অসুবিধে হয়নি যে এটা দিনের পর দিন পুঞ্জিভূত হওয়া অন্যায়, অপমান ও শ্রেনীঘৃনার বহিঃপ্রকাশ। 'তোমার আছে, আমাদের নেই' স্রেফ এই কারনে তুমি আমাকে নিচু চোখে দেখলে, একদিন আমি ফেটে পড়বোই।
আমার নিরপেক্ষতার প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। বৈষম্যের পৃথিবীতে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা মানে ক্ষমতার পাশে দাঁড়ানো। 'নিরপেক্ষতা' দেখানোর জন্যে মিডিয়া আছে, ফেসবুকের বাবু বিবিরা আছে। আমার একমাত্র দায়বদ্ধতা শ্রেনীর প্রতি। তাই আমি ওই মহাগুন মর্ডার্নের তছনছ হয়ে যাওয়া সবুজ লন আর দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া স্থাপত্যগুলো দেখে খুব আনন্দ পেয়েছি। ওই চকচকে ঝকঝকে চামড়াওয়ালা ভীত মুখ গুলো দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েছি।
ঠিক যেমন পেয়েছিলাম কয়েকদিন আগে কলকাতার আবাসনে পাশের বস্তি থেকে হামলা করে সব দামী গাড়ি গুড়িয়ে দেওয়াতে। 
জোহরা বিবির বস্তির লোকজন বেশ করেছেন। লাল সেলাম।

There is a storm coming Mr Wayne. You and your friends better batten down the hatches, because when it hits, you are all gonna wonder how you could live so big, and leave so little for the rest of us.






বুধবার, ১২ জুলাই, ২০১৭

সময় ~ রেজাউল করীম

মেয়ে বলল: দেখেছ t উপরে মাত্রা দিয়ে সময়কে ভেক্টর বানিয়ে দিয়েছে। বললাম: ভুল করেছে। সময় ভেক্টর নয়, কিন্তু বলেই কেমন ধন্দ লাগল। সময় কি কেবলই একটা মান, যা দিকশূন্যপুরে সহজেই হারিয়ে যায়! সময়ের গতি শুধু সুমুখপানে কিন্তু সামনে এগোতে পারলে পেছনপানে কেন যেতে পারবে না? আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যানে সময়ের গতি ও দিক নিয়ে নিয়ে বিস্তৃত গবেষনা হয়েছে। তিনরকমের সময়ের তীর বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন- thermodynamic, Cosmological ও psychological। মনোবৈজ্ঞানিক সময়ের তীর যদি আমাদের বিক্ষত না করত তাহলে পৃথিবীটাই অন্যরকম হত। দুষ্মন্ত সেই সময়ের তীর চালান করতে পারলে শকুন্তলাকে এত কষ্ট পেতে হতে না, জার্মান-প্রুশিয়া রাশিয়া-ফ্রান্সের সঙ্গে লড়তো না আর তাহলে হয়ত নাজি দলের উত্থান হত না। এমনি এক জুলাই মাসে প্রুশিয়ান আর্চ-ডিউক খুন হলেন জুগোশ্লাভ জাতীয়তাবাদী নেতাদের হাতে। রাশিয়া প্রথম যুদ্ধ শুরু করলো। ফ্রান্স ১৮৭৮ র হারের বদলা নেবার সুযোগ খুঁজছিল, তারা সহজেই রাশিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে ফেলল। দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হল আর পৃথিবীর চেহারাটাই গেল চিরতরে বদলে। 

সময়ের মানসিক তীর পশ্চাদগামী না হলে কেমন হত তা রবীন্দ্রনাথ ঠাট্টার ছলে লিখেছিলেন- "পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেণ্টিমেণ্টাল আত্মীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে।" সময়ের সাথে এগিয়ে না চলতে পারার নাম কী মৃত্যু? তাহলে, আমরা কমবেশী সবাই অল্প স্বল্প মৃত। কেউ সমাজের পুরনো রীতি আঁকডে ধরে প্রানপনে মরতে চাইছি, কেউ আবার ধ্বজাধারী ধর্মের ফসিল আঁকডে নিজেকে ভোলাতে চাইছি। সময়ের গতিপথ নিয়ে হকিং সায়েব বই লিখে ফেলেছেন।  সময় নাকি কোন এক যুগে আবার পেছনপানে চলতে শুরু করবে। আজ যা ঘটছে অনাদিকাল ব্যাপি অনন্তবার সেই ঘটনা ঘটেছে, আবার ঘটতেই থাকবে, এর কোন শেষ নেই। ভেক্টর যাই হোক, ফিজিক্স বেশ রোমান্স ভরা। কল্পনার রঙিন ডানায় ভর করা স্বপ্নকেও সে সাকার করে তোলে- তাই হকিংয়ের মুগ্ধবোধ পড়ে অন্যতর অনুভূতি হয়। শুধু সময়ের তীর যখন সাঁ করে উল্টো দৌড লাগাবে তখন কী সব মনে পড়বে নাকি "যে পথ চলে গেলি সে পথ কেন ভুলে গেলি রে" বলে গান ধরতে হবে!! 
সময়ের মান অর্থাৎ পরিমান নিয়ে ও একই রকম ধন্দ। প্রেমিকের জন্য এক মূহর্ত অপেক্ষা যেন অন্তহীন কিন্তু দেখা হলে? "যুগ যুগ হাম হিয়ে হিয়ে রাখলু/ নয়ন না তিরপেত ভেল!" নয়নের কথা বলেছেন কিন্তু আসলে সময় এত দ্রুত নিজেকে শেষ করে ফেলে যে ঘন্টাগুলো সেকেন্ডের মত দৌডায়। অমিত বলেছিল-  সময় যাদের বিস্তর তাদেরই পাঙ্ক্‌চুয়াল হওয়া শোভা পায়। দেবতার হাতে সময় অসীম তাই ঠিক সময়টিতে সূর্য ওঠে, ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ অল্প, পাঙ্ক্‌চুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে অমিতব্যয়িতা। অমরাবতীর কেউ যদি প্রশ্ন করে 'ভবে এসে করলে কী' তখন কোন্‌ লজ্জায় বলব, 'ঘড়ির কাঁটার দিকে চোখ রেখে কাজ করতে করতে জীবনের যা-কিছু সকল সময়ের অতীত তার দিকে চোখ তোলবার সময় পাই নি"। 
এদেশের ঋষিরাও সময় নিয়ে বিস্তর চর্চা ও লেখালেখি করেছেন। কাল শাশ্বত এবং গতিশীল :হে চিন্ময় শক্তিসম্পন্ন ! আপনি পরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রনকারীরূপ শাশ্বত কালের গতিবিধি সম্বন্ধে অবগত । আপনি যেহেতু আত্ম-তত্ত্ববেত্তা, তাই আপনি আপনার দিব্য দৃষ্টির প্রভাবে সব কিছু দর্শন করিতে পারেন ।(ভাগবত ৩/১১/১৭)
এ শ্লোকে কালকে শাশ্বত বলে অভিহিত করা হয়েছে । কাল গতিশীল এ বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করা হয়েছে । এখানে দিব্য দৃষ্টির উল্লেখ করা হয়েছে যার দ্বারা একজন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দর্শন করতে পারেন । দিব্য দৃষ্টির দ্বারা মহাবিশ্বের সবকিছু দর্শন করা যায় এমনকি কালের গতিবিধি সন্মন্ধে ধারণা পাওয়া যায় । রবিঠাকুর কালের যাত্রার ধ্বনিও শুনতে পেয়েছেন। সময়ের সেই অন্তহীন রথে চেপে  একদিন উধাও হয়ে যাব। যেতে যেতে হয়ত আজকের খণ্ড মূহুর্তগুলির সাথে দেখা হয়ে যাবে- নববধুটির মত সাজগোজ করে সময়ের সে বিন্দু বসে থাকবে, অন্তহীন যাত্রার ক্লান্তি সরিয়ে সে বন্দুক সাথে সুখ-দুখের বিনিময় করতে করতে হারিয়ে যেতে বোধহয় ভালোই লাগবে।

বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭

স্মৃতিচারণ - ৪ ~ স্বাতী রায়

এরকম টুপটাপ, ঝিরিঝিরি বা ঝমঝম বৃষ্টির দিনে খুব মেসে কাটানো দিন গুলোর কথা মনে পড়ে। ২০০৪ সাল, রুমমেট আমি, রুমি, দীপমালা, অন্বেষা। আমি আর রুমি সমবয়সী বাকি দুজন বয়েসে বছর তিনেকের ছোটো। রুমি যাদবপুরের ফিলজফিতে মাস্টার্স করছে, বাকি দুটি ফার্স্ট ইয়ার। আমি তখন গ্র‍্যাজুয়েশন শেষে কাঠ বেকার, চাকরি খুঁজছি। বর্ষার দিনে আমাদের বিলাসিতা ছিলো ঘরের ভিতরেই স্টোভ জ্বেলে ঢ্যালঢ্যালে খিচুড়ি। বাকি তিনজন অভুক্ত বাচ্চার মত খাটের উপর পা গুটিয়ে বসে জুলজুলে লোলুপ দৃষ্টিতে বুগবুগ করে ফুটতে থাকা হলুদ অমৃতর দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি খিচুড়িতে হাতা নাড়তাম। কখনো সেই সুগন্ধি আতপ আর মুগডালের মিশ্র গন্ধে পাগল হয়ে বলতো অনেক হয়েছে, এবার নামিয়ে খেতে দে। আমি ধমক দিতাম, দাঁড়া এখনো চাল ডাল আলাদা আলাদা তাকিয়ে রয়েছে, না মিশলে খিচুড়ি হবে? সকালের চায়ের দায়িত্ব ছিলো দীপ আর অন্বেষার। আমি চিরকাল কুঁড়ে মানুষ,  তায় লেট রাইজার। দুই কন্যা স্টিলের গ্লাসে চা নিয়ে আমায় ঠেলে তুলে দিতো। আর কতো ঘুমুবে? ওঠো। এদিকে বাইরে বেরোবার উপায় নেই গলিতে এক হাঁটু জল। আমাদের দিন রাত ব্যাপি আড্ডা, গান।

 স্মৃতিমেদুর মনে সেসব গলিতে জলজমা বর্ষাদিনের কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়লো অন্বেষা আর দীপ সকাল সন্ধে ঘরে ধূপ দিতো। সেই ধূপের গন্ধে আমার বহুদূরে থাকা মায়ের কথা মনে পড়ত। শাঁখের আওয়াজ, চুড়ির রিনিঝিনি, তুলশী তলায় প্রদীপ। আমি মাথা নোয়াতাম না বলে আমার স্বল্প শিক্ষিত মায়ের বক্তব্য ছিল আমি নিশ্চই হাসপাতালে কোনো যবনীর বাচ্চার সাথে অদলবদল হয়ে গেছি। হিন্দুর বাচ্চা আমি হতেই পারিনা! পুরো স্কুল জীবন, আমি সামনা সামনি কোনো মুসলিমের সাথে মেশার সুযোগ পাইনি। শোনা কথার বিষ আমার ভিতরে কিছুটা হলেও ছিল। কলেজে পড়তে এসে প্রথম পেলাম কিছু অহিন্দু সহপাঠী, আর এই মেসে থাকতে এসে তো একই ঘরে বসত করা শুরু হল। এক সন্ধায় কামাখ্যার ভক্তিমতী দীপের সন্ধার ধূপ দেখানোর পর আমি রুমিকে জিজ্ঞাসা করলাম হ্যাঁ রে তোকে তো কোনো দিন নামাজ পড়তে দেখলাম না। "তোদের" নাকি পাঁচ বেলা নামাজ মাস্ট। রুমি বলল তোকেও তো কোন দিন ধূপ দিতে বা প্রণাম করতে দেখলাম না। আমার চোখের উপর থেকে একটা পর্দা সরে গেলো। মায়ের ভাষায় "যবনী " রুমি Rehana Haidar আমার জ্ঞান চক্ষু উন্মিলিত করে দিল, শিক্ষার বিকল্প নেই। দীপ আর অণ্বেষাকে কোনোদিন এক বিন্দুও অপ্রস্তুত হতে দেখিনি চারজনায় একে অপরের মুখের খাওয়ার কাড়াকাড়ি করে খেতে আপত্তি তো দূর। আদুরে দীপের ফেবারিট পাসটাইম ছিলো ঘুমন্ত আমার বা রুমির চাদরের মধ্যে টুক করে ঢুকে পড়ে জাপ্টে ধরে শুয়ে থাকা, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর না করা অবধি ছাড়তো না। অবিশ্বাসী আমায় বা অন্যধর্মের রুমি কে নিয়ে কই কোনোদিন একফোঁটাও অসহিষ্ণুতা দেখিনিতো। 

 আসলে ওই ফুটতে থাকা চাল ডাল গুলো আমরাই ছিলাম, আমাদের মিলে মিশে এক হয়ে থাকতে কোনো ধর্ম নামক জুজু চোখ রাঙায়নি। আমাদের এক থালায় ভাত খাওয়া, আমাদের একে অপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, এর ওর পিছনে লাগা কিছুই ব্যহত হয়নি। পরমা সুন্দরী রুমি কে আমি এখনো যখন-তখন বেগমসাহিবা বলে পিছনে লাগতেই পারি, বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। আমাদের একটাই পরিচয় ছিল, এখনো আছে- আমরা রুমমেট, আমরা বন্ধু এবং আমরা... আমরা মানুষ আর কি...

দাঙ্গা ~ আর্কাদি গাইদার

আপনাদের একটি গল্প শোনাই। গত তিন দিন ধরে বিভিন্ন লোকের সাথে কথা বলে, খবর নিয়ে, অনেকুগুলো বিন্দুর মধ্যে লাইন টেনে গল্পটা তৈরি করেছি। আসলে তৈরি করেছি বলা ভুল, আসলে এই গল্পটা খালি অপেক্ষা করছিলো কখন কেউ তাকে একজায়গায় একসাথে লিখে ফেলবে।

পুরো বসিরহাট মহকুমা অঞ্চলেই দীর্ঘদিন ধরে জামাতের চাষ হচ্ছে । বিশেষ করে শেষ দশ বছর।পরিকল্পিত ভাবে বাংলাদেশ থেকে জামাতিরা এসে গ্রামে গ্রামে মিটিং করে যায়। ওয়াজ করে যায়। সেই ওয়াজের কিছু কিছু ভিডিও আপনারা ইন্টারনেটেও দেখতে পান। গোটা বারাসাত বসিরহাট দেগঙা অঞ্চলে শেষ ৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভরে ভরে জামাতি পাব্লিক এসেছে হাসিনার সরকারের তাড়া খেয়ে, তার সাথে এসেছে জামাতি আইডিওলজি, সৌদি ফান্ডিং আর বেসরকারি মাদ্রাসা। তৃণমুলের আগের এমপি হাজি নুরুল আর এখনকার এমপি ঈদ্রীশ আলি সরাসরি ঘোষিতভাবে জামাতের সাহায্যে প্রচার করে, তার বদলে জামাতকে নিজেদের অঞ্চলে ফ্রী হ্যান্ড দেয় যা ইচ্ছে করবার জন্যে। সারদার টাকা ববির হাত দিয়ে জামাতের কাছে যায়, বিনিময় ওরা বাংলাদেশি জামাতিদের ভোট এবং তার ওপর প্রভাব এনশিওর করে। 
এবার আসরে নামলো বিজেপি / আর এস এস/ সংঘ পরিবার। বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদের মধ্যে তাদের সংগঠন অনেকদিন ধরেই ছিলো, তারা এবার অঞ্চলে প্রচার করতে শুরু করলো, যে হিন্দুরা আজ এই আগ্রাসনের সামনে বিপন্ন, যার ফলে উপনির্বাচনে জিতলো শমীক। 
আশার কথা, অঞ্চলের স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যেও ধীরে ধীরে এই জামাতি মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হলো। জামাতিদের প্রথম টার্গেট হলো স্থানীয় মাজহার এবং তাদের পীরেরা, কারন তাদের ধর্মীয় মতবাদে ইসলামে এগুলো শিরক। এই দ্বন্দ্ব গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলে আরও শক্তিশালী হয়েছে।

২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে এইখানকার তিনটে বিধানসভা কেন্দ্রের দুটো জিতলো জোটের প্রার্থীরা (একজন কংগ্রেস একজন সিপিএম) এবং একটি জিতলো তৃণমুল। তৃণমুল দেখলো যে ঈদ্রীশ আলির মতন 'ধর্মপ্রান' নেতা বা জামাতিদের দিয়েও এখানকার মুসলিম ভোট কনসোলিডেট করা যাচ্ছে না, তারা রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে ভোট দিচ্ছে, ধর্মীয় না। 

বাদুড়িয়ায় রবিবার থেকে ঝামেলার সূত্রপাত। একটি খবরের কাগজে স্থানীয় বিজেপি নেতার ইন্ধনে ভুয়ো খবর ছাপানো নিয়ে, যে ঈদের দিন নাকি পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হয়েছে। এবার আসরে নামলো হিন্দু সংহতি। হিন্দু সংহতির নাম শুনেছেন তো? এদের নেতা তপন ঘোষ। তিনি ভোটের আগে ঘোষনা করে মমতাকে ভোট দিতে আবেদন জানান, তিনি মমতার সরকারকে দশে সাত দেন, তিনি অঞ্চলে অঞ্চলে তৃণমুলের লোকেদেরকে বলেন হিন্দু সংহতিতে যোগ দিতে, কারন 'আমরা আপনাদের এবং দিদিরই পক্ষে'। তা শৌভিক সরকার নামক একটি ১৭ বছরের তরুন, যে আবার এই হিন্দু সংহতির সাথে যুক্ত, সে ফেসবুকে একটি নোংরা ছবি পোস্ট করলো। এ নিয়ে অঞ্চলের স্থানীয় কিছু মুসলিম বিক্ষোভ দেখানো শুরু করলো। শৌভিক গ্রেপ্তার হলো। 

এরপরেই গল্পের আসল মজা। স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, থানা ঘেরাও করেছিলেন, তাদেরকে পুলিশ ডিসপার্স করে দেয়। তারপরেই বাইরে থেকে কিছু অচেনা লোক আসে, যারা হিন্দিতে কথা বলছিলো, তারাই পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো এবং ভাংচুর শুরু করে। (নিচে নিউজ ১৮ এর ভিডিও রিপোর্ট দেখুন)

এর পরে হঠাত করে অঞ্চলে কে বা কারা গুজব ছড়াতে থাকে। শোনা যায় বসিরহাটে নাকি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। পবিত্র কোরানের ওপর নাকি প্রস্রাব করা হয়েছে। এবার ঝামেলা ছড়াতে থাকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দলবল নিয়ে কিছু মানুষ বেরিয়ে পড়ে ভাংচুর, অবরোধ শুরু করে, অনেক দোকান আর বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। শৌভিকের বাড়িও বাদ যায় না। স্থানীয় বহু হিন্দু-মুসলিম যুবক যুবতী এমনকি বেশ কিছু মসজিদের ইমাম শান্তিরক্ষার জন্যে রাস্তায় নামে, কিন্তু প্রথম কয়েক ঘন্টা তাদের চেষ্টায় কোন কাজ হয়না। খেয়াল রাখবেন, এর মধ্যে মাত্র ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। এই গোটা সময়টায় পুলিশ প্রশাসন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিলো। এর মধ্যে রাজ্যপাল আর মমতার ফোনে বচসা হয়। মমতা প্রেস কনফারেন্স করে ফেলেন, যেখানে তিনি বলেন - 'আপনাদের আমি অনেক প্রটেকশন দিয়েছি, আর দেবো না'। (নিচে নিউজ রিপোর্ট দেখুন) স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, এখানে মমতা 'আপনাদের' বলতে কাদের কথা বুঝিয়েছেন? দাঙ্গাবাজরা? জামাতি ধর্মগুরুরা? নাকি সাধারন মুসলমানরা? এবার আস্তে আস্তে পুলিশ সক্রিয় হয়।  স্থানীয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংগঠিত হয়। ফুরফুরা শরীফের ইব্রাহিম সিদ্দিকি, বসিরহাটের পীরজাদা, অল বেংগল ইমামস এসোশিয়েশনের চেয়ারম্যান, সবাই বিবৃতি দিয়ে দাঙ্গাবাজদের নিন্দা করেন আর শান্তির আবেদন জানান। তৃণমুলের এমপি ঈদ্রিশ আলি বোধহয় সারাদিন ঘুমোচ্ছিলেন। তৃণমুলের এম এল এ দীপেন্দু বিশ্বাস জার্মানিতে ফুটবল দেখতে গেছেন। তাই তার অঞ্চল বসিরহাট দক্ষিনে মাঠে নেমেছেন বসিরহাট উত্তরের সিপিএমের এমএলএ রফিকুল ইসলাম। ওদিকে ঝামেলার দিন সারাদিন বিজেপির দিলীপ ঘোষ আর বাবুল সুপ্রিয় ট্যুইটারে নিজেদের মধ্যে তরজা করে গেছেন কে রাজনীতিতে নতুন তাই নিয়ে। এখন ওনারা আর হিন্দু সংহতি মাঠে নেমেছেন, হিন্দুদের 'প্রতিশোধ' নিতে আহ্বান জানিয়ে।

তাহলে যা দাড়ালো, এই অঞ্চলে এতদিন জামাত আর হিন্দু সংহতি চাষ করিয়েও সাধারন হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট ভাগাভাগি করা যাচ্ছিলো না। তাই এই ৪৮ ঘন্টার স্ক্রীপ্টটার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ ঢুকিয়ে তাদের ভোট বিজেপির দিকে ঠেলবার চেষ্টা। বিজেপির বৃদ্ধির সম্ভাবনার জুজু দেখিয়ে মুসলমানদের ভোট তৃণমুলের দিকে টানবার চেষ্টা হলো। বিরোধী ভোট সুন্দর করে ভাগ করে দেওয়া গেলো। যেই ঝামেলা স্রেফ পুলিশ দিয়ে প্রথম এক ঘন্টায় থামিয়ে দেওয়া যেতো, রাজ্য প্রশাসনকে ছুটিতে পাঠিয়ে তাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে এই আকার দেওয়া হলো। সাথে যোগ করা হলো রাজ্যপালের সাথে তরজা, রাষ্ট্রপতি শাসন আর কেন্দ্রীয় বাহিনীর মশলা। নাগপুর আর কালিঘাটের যৌথ ফরমুলায় ল্যাবরেটরিতে তৈরি হলো এই বিষ। 

এই ঘটনা থেকে যাদের ক্ষীর খাওয়ার তারা খেয়ে নিয়েছে। পড়ে রইলাম আমি আর আপনি। আমাদের মধ্যে আরেকটু অবিশ্বাস বাড়লো। এবার আমরা একে অপরকে আরও বাঁকা চোখে দেখবো। ভয় পাবো। আরও অচেনা হবো। জিএসটি, নারদা, ভাঙরের লড়াই আপাতত সবাই ভুলে গেছে। 

মিশন সাকসেসফুল।

বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭

বাদুড়িয়া দাঙ্গা ~ শোভন চক্রবর্তী

চৌত্রিশ বছরে দশমী আর মহরম একবারও একই দিনে পরেনি? উত্তর হ্যাঁ! বহুবার পরেছে!ঠাকুর বিসর্জনও হয়েছে আবার তাজিয়াও বেড়িয়েছে! জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যকে কখনও বলতে শুনেছেন ঠাকুর বিসর্জন বন্ধ(?) নাহ! ধর্ম ধর্মের পথে চলেছে! অরিন্দম শীল নয় বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা বলছে ২০০২এ গুজরাট দাঙ্গার বছর যেদিন দশমী সেদিনই ইসলাম মতানুযায়ী মহরম ছিলো! কেশপুরে শেষপুর দেখার পরের বছরও CPI(M) এর নেতৃত্বে চলা বামফ্রন্ট সরকারকে খাবি খেতে হয়নি!আমাদের রাজ্যে কি এমন হলো যে বিসর্জন বন্ধ করে দিতে হবে! আসলে কিছুই হয়নি! বিসর্জনটা বন্ধ করে হিন্দু সাইকোলজিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো "শালা মুসলমানের মহরমের জন্য বিসর্জন বন্ধ করে দিলো মমতা!" রামকে জমি দিতে ইসলাম দরকার! ময়দানে এলেন অবতার দিলীপ এবং তপন ঘোষ! এই প্রথম কোন মুখ্যমন্ত্রী উৎসবে পাঁচিল তুললো! 
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের কোন মুখ্যমন্ত্রীকে মঞ্চে উঠে কোরানও কোট করতে হয়নি আবার ইয়া দেবী সর্ব্বভূতেশুও আওড়াতে হয়নি! তাতে শ্রীভূমি কিংবা সুরুচি সংঘে এসেছে শরৎ থিমের পরশ লাগেনি এমনটাও হয়নি আবার কাজী পাড়ায় চাঁদের নানী ঈদে বিরিয়ানিতে ক্যাওড়া জল বেশি ঢেলে ফেলেছে এমনটাও হয়নি!
রামনবমীর অস্ত্র আস্ফালন আপনার জন্য! ধূলাগড়ে অশান্তির মূলে আপনি! কারন বিভেদের তাস খেলেছেন আপনি! নোটের রাজনীতি,ভোটের রাজনীতি মিলিয়ে দিয়েছেন আপনি! ঢঙের সঙ্গে রং মিশিয়ে দিয়েছেন আর মিলে মিশে থাকা মানুষকে আলাদা করে দিয়েছেন! মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন আপনি! ইসকনের রথ টেনেছেন আর প্রশাসনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করেছেন!
তবু ......
যেহেতু রাজ্যটার নাম পশ্চিমবাংলা এখনও তাই অল্প হলেও ভরসা আছে! প্যারালাল ভাবে রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক কাজ শুরু করুন! আপনার জন্য নয়! মানুষের হাত থেকে মানুষের রক্ত মুছতে! পশ্চিমবাংলার গা থেকে দাঙ্গার গন্ধ মুছতে বামপন্থীরা রাস্তায় থাকবে! কারন এখনও বিশ্বাস করি-
আমার মাটি আমার মা 
পাকিস্তান হবে না!
গুজরাটও হবে না!

মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭

বসিরহাট দাঙ্গা ~ পুরন্দর ভাট

বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে, ২০১০-এ দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য হাজী নুরুল ইসলামকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৪-তে সরিয়ে দেন। সরিয়ে কাকে আনেন? তসলিমার বিরুদ্ধে দাঙ্গা খ্যাত ইদ্রিস আলীকে। এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায়। সেখানে যে এরকম পরিস্থিতি হবে সেটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল গত ৮-৯ বছর ধরে ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িকতার চাষ করেছে। ওই এলাকার কিছু কিছু ধর্মীয় সংগঠন বাংলাদেশ থেকে জামাৎপন্থী মৌলবিদের নিয়ে এসে ওয়াজের আয়োজন করেছে দিনের পর দিন, তৃণমূল চুপ করে থেকেছে কারণ এতে তাদের লাভ হয়েছে। আজকে পরিস্থিতি তাই হাতের বাইরে। উল্টোদিকে তৃণমূলের হিন্দু অংশ কাজে লাগাচ্ছে তপন ঘোষের হিন্দু সংহতিকে। উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সীমান্তবর্তী মহকুমাগুলো আখড়া হয়ে উঠেছে হিন্দু সংহতির। সেই লাভও তৃণমূল নিজের ঘরে তুলেছে গত নির্বাচনে, তপন ঘোষ সরাসরি তৃণমূলকে ভোট দিতে বলেছিল নির্বাচনে। রাজ্য জুড়ে ক্রমশ তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব চেহারা নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার। আমার চারপাশে দেখছি সরকারি জমি, ফুটপাথ, এমনকি রাস্তার ওপর গজিয়ে উঠছে নতুন মন্দির, ফলকে লেখা থাকছে "সৌজন্যে" এলাকার বিধায়ক। সেখানে প্রতি শনি মঙ্গল বিলানো হচ্ছে ভোগের প্রসাদ। নিশ্চই এরকম আগাছার মতো মসজিদও গজাচ্ছে, যেহেতু আমার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যাতায়াত কম তাই চোখে পড়ে না। তৃণমূল সরকার এখন আর চেষ্টা করলেও এই চাকা পেছন দিকে ঘোরাতে পারবে না। জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যাপক আন্দোলনই একমাত্র পথ। খাদ্য আন্দোলন পেরেছিলো দেশভাগের ক্ষত মুছে দিতে, সেরকম ব্যাপক আন্দোলনই পারবে পরিস্থিতি ফেরাতে। অনেক ইস্যু রয়েছে সামনে, গণ আন্দোলন তৈরি করবার।