বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলায় বর্গী হানা ও গণহত্যা ~ শুভ্র সুন্দর

বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে হিংস্র গনহত্যা ঘটে নাগপুরের হিন্দু রাজার নেতৃত্বে

            হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন, বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য, ভয়ংকর গণহত্যা ঘটে হিন্দু রাজাদের নেতৃত্বে। মূলত নাগপুরের রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নেতৃত্বে। রাঘোজি ভোঁসলে ছিলেন নাগপুরের মহারাজা আর তিনি কাজ করতেন মহারাষ্ট্রের পুনের পেশোয়া বাজিরাও এর অধীনে। পেশোয়া বাজিরাও ও ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। সেই পেশোয়া অর্থাৎ প্রধাণ মন্ত্রী আবার কাজ করতেন সাতারা র ছত্রপতি দের অধীনে। সেইসময় ছত্রপতি ছিলেন সাহুজি রাও ভোঁসলে ১। 

            যাইহোক, মারাঠা ছত্রপতি সে শিবাজী হোক বা তার উত্তরসূরী, ইনকামের দিক থেকে এনারা ছিলেন তোলাবাজ, লুঠেরা। বিভিন্ন রাজ্য কে আক্রমণ করতেন, তারপর তাদের পরাজিত করতে পারলে, তাদের উপর বিশাল পরিমান বার্ষিক খাজনা বা তোলা বসাতেন না দিলে আবার আক্রমন করবেন এই ভয় দেখিয়ে। আর এই আক্রমণের সময় যা কিছু দুইচোখে দেখতেন তা লুঠ করে আনতেন ও নির্দ্বিধায় গণহত্যা করতেন। শিবাজীর নাতি সাহু প্রথম এই পেশোয়া বাজীরাও কে নিযুক্ত করেন। আর বাজীরাও এর অধীনে থাকা সামরিক বাহিনীর প্রধাণ দের বাজীরাও এক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ক্ষমতা দেন কিছু শর্তের ভিত্তিতে। কিন্তু, পরবর্তী কালে সামরিক বাহিনীর প্রধাণরা, সেই অঞ্চলগুলির সর্বেসর্বা বা মহারাজা হয়ে ওঠেন। যেমন মালোয়ার সিন্ধিয়া বংশ, গোয়ালিওর এর সিন্ধিয়া বংশ, ইন্দোরের হোলকার বংশ, বরোদার গায়কোয়ার বংশ এবং নাগপুরের ভোঁসলে বংশ।

           এই নাগপুরের ভোঁসলে বংশের প্রথম রাজা রাঘোজি ভোঁসলে ১৭৪১ সালে প্রথম বাংলা আক্রমণ করেন। বাংলা তখন অধুনা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল। তখন বাংলার মোঘল নবাব আলীবর্দী খাঁ। রাজা রাঘোজি ভোঁসলে তার মারাঠা সৈন্য বাহিনী নিয়ে আক্রমন করেন বাংলা। মারাঠা সৈন্যবাহিনীর নাম ছিল মারাঠী ভাষায় "বর্গীর"। এই "বর্গীর" একটি পার্সিয়ান শব্দ যার মানে "ঘোরসওয়ার"। এই বর্গীর বাহিনী দের মূল উদ্দেশ্য ছিল লুঠ ধর্ষন করা। আর তার জন্য তারা গণহত্যায় পিছ পা হতো না। ডাচ ইতিহাসবিদ লিখেছেন, প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালী কে হত্যা করেছিল এই বর্গীর বাহিনী, ১৭৪১ সাল থেকে ১৭৫১ সালের মধ্যে মোট ৬ বার আক্রমণ করে। বর্গীর বাহিনী বিহার ও উড়িষ্যার অনেকটা অঞ্চল দখল করে ফেলে যখন হূগলী নদীর কাছাকাছি চলে আসে তখন আলিবর্দী খাঁ বাংলা র মানুষ কে এই অত্যাচার থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের সঙ্গে "চৌথ" চুক্তি তে রাজি হয়।"চৌথ" অর্থাৎ, উৎপাদনের ২৫% খাজনা সব মানুষের উপর চাপিয়ে, তা বর্গীদের হাতে তুলে দিতে হবে। 

            তখনকার দিনে তার মূল্য নির্ধারণ হযেছিল বছরে ১২ লক্ষ টাকা। মানে বুঝতেই পারছেন এখন তার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান। এছাড়া প্রথম দুই তিন বছর পুরো খাজনা না দিতে পাড়ায় ১৭৪৩ সালে একসাথে ৩২ লক্ষ টাকা দিতে বাধ্য করা হয় নবাব আলীবর্দী খাঁ কে। তার পর থেকে প্রতিবছর ওই ১২ লক্ষ টাকা তোলা আদায়। সঠিক সময়ে সেই টাকা না পেলেই তারা বাংলার গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের থেকে টাকা আদায় করতো। না দিতে পারলে, নৃশংস অত্যাচার করা হতো, যেমন নাক, কান ও স্তন কেটে নেওয়া, জলের ট্যান্কে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দমবন্ধ করে মারা হতো, মহিলাদের ধর্ষন করা হতো,গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে দেওয়া হতো ইত্যাদি।হলওয়েল, সলিমুল্লাহ, গঙ্গারাম শাস্ত্রী প্রমুখের রচনায় মরাঠাদের বীভৎসতার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় "মহারাষ্ট্র পুরান" এ গঙ্গারাম লেখেন, " এবছর তারা কাওকেই ছারে নি। ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, সাধারণ মানুষ কাওকেই না। এমনকি হাজারে হাজারে গরু র গলা কেটে দিয়ে গেছে, গ্রামবাসী দের অর্থনৈতিক ভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।" মহারাষ্ট্র পুরানে উল্লেখিত "মাঠে ঘেরিয়া বরগী দেয় তবে সাড়া।/সোনা রুপা লুঠে নেয়, আর সব ছাড়া।।/কারু হাত কাটে, কারু নাক কান।/একি চোটে কারু বধয়ে পরাণ।/ভাল ভাল স্ত্রীলোক যত ধরিয়া লইয়া যায়।/অঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলায়।।/এক জনে ছাড়ে তবে আর জনা ধরে।/তারা ত্রাহি শব্দ করে।।''

            বর্গীর বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ছিলেন,  মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিত। তারা পাঞ্চেত হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে থাকেন! পরে ১৭৪৪ সালে আলীবর্দী খাঁ ভাস্কর পণ্ডিত কে ডেকে পাঠান শান্তি চুক্তির নামে। সেই মিটিং এর তাঁবু তেই ইয়ং সিরাজউদোল্লার সাহায্যে, গুপ্তসেনারা ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সহযোগী ২১ জন সেনাপতি কে খুন করে । এর পর ১৭৪৬ সালে বর্গীর বাহিনীর দায়িত্ব নেন জানজি রাঘোজি ভোঁসলে এর পুত্র জানজি ভোঁসলে।জানজি ভোঁসলের নেতৃত্বে বর্গীরা আবার বাংলা আক্রমণ করে, যদিও ১৭৪৭ সালে, তিনি আলীবর্দী খাঁ এর সঙ্গে বর্ধমানের যুদ্ধে হেরে গিয়ে মেদিনীপুরের দিকে চলে যান।এরপর বর্ধমান ও মূর্শিদাবাদ বর্গীদের হাত থেকে উদ্ধার হলেও, বাংলার মেদিনীপুর ও উড়িষ্যায় বর্গীদের প্রভাব থেকেই যায়। 

             ঝাড়গ্রামের কুলটিকরি। আর পশ্চিম মেদিনীপুরে কেশিয়াড়ি। কুলটিকরি থেকে কেশিয়াড়ি যাওয়ার পথে পড়ে কিয়ারচাঁদ। এই কিয়ারচাঁদের বিরাট এলাকায় শয়ে শয়ে লম্বা, চৌকা নানা রকম পাথর পোঁতা আছে। সাধারণ ভাবে বোঝা যায় না কী এগুলো। কিন্তু জনশ্রুতি বলছে, এই পাথরগুলোর সঙ্গে বর্গিদের যোগ রয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, তাঁরা বংশানুক্রমে শুনেছেন, বর্গিদের অত্যাচারে ভয় পেয়ে স্থানীয় জমিদার সারি সারি পাথর পুঁতেছিলেন। সন্ধ্যার সময় ওই সব পাথরের গায়ে মশাল জ্বেলে বেঁধে দেওয়া হত। দূর থেকে মনে হত, মশালধারী সৈন্য গড় পাহারা দিচ্ছে।

           ১৭৫১ সালে আলিবর্দী খাঁ উড়িষ্যা কে রাজা রাঘোজি ভোঁসলের নামে লিখে দিলে, বর্গী আক্রমণ থামে। তবে বর্গী রা কোনোদিন ই কোলকাতা কে আক্রমণ করে নি। মূলত গ্রামেই তারা আক্রমণ করতো। হয়তো ব্রিটিশ দের ভয় করতো। যদিও কোলকাতা কে রক্ষা করার জন্য ৫ কিমি লম্বা একটা খাল কাটা হয়েছিল যার এই পারে বর্গীরা কোনোদিন ঢোকে নাই। সেই খালটি আমরা এখন আপার সার্কুলার রোড নামে চিনি। ওহ, কোলকাতায় তারা শুধু জগৎ সেঠ এর বাড়ি লুঠ করেছিল।

            মারাঠি হিন্দু সম্রাট রা, যে শুধুই বাংলা আক্রমন করে বাঙালী হিন্দু দের হত্যা করেছিল তা না। তারা বিভিন্ন রাজ্য কেই আক্রমণ করতো। ১৭৫৯ সালে তারা তিরুপতি মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে। ১৭৯১ সালে রঘুনাথ রাও পটবর্ধনের নেতৃত্বে, মাইসোর রাজ্য আক্রমণ করে ফেরার পথে "সৃঙেরি" মন্দির লুঠ ও ধ্বংস করে মারাঠি সেনা। যদিও, সেই সময়ের মাইসোরের নবাব টিপু সুলতান মুসলিম রাজা হয়েও এই মন্দির আবার সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেন। নিজে মন্দিরের মূর্তির জন্য অলংকার কিনে দেন।

            এই বর্গী রাজা রা এতোটাই অত্যাচারী ছিল, যে, সেই শোলে সিনেমার "শো যা, নেহিতো গব্বর আ যায়েগা" র মতো করে বাংলার গ্রামে গ্রামে মায়েরা বাচ্ছা দের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতো এই বলে যে, 

                        "খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।
                          বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে? 
                          ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কী? 
                          আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি।"

            ইতিহাসের থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হয়। এই বর্গী রা হিন্দু হলেও তারা হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতে এতোটুকু ভাবে নি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, এই অত্যাচার বাঙালীরা হিন্দু বলেই হয়েছে, তা নয়। বর্গিরা আচমকা ঘোড়ায় চড়ে 'হর হর মহাদেব' বলে গ্রামে ঢুকে পড়ত। লুঠ টাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই নাগপুরের রাজা যতোই হিন্দু হোক, "হর হর মহাদেব" বা "জয় শ্রীরাম" যাই বলুন  তারা যে, হিন্দু বলে ছার দেবেন এটা ভাবা খুব ই ভুল, লুঠ টাই তাদের উদ্দেশ্য, ইতিহাস সাক্ষী।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন