ক্রিকেটে ছিল আমার জন্মগত দূর্বলতা। ছোট্ট মারফি রেডিওটা কানে চেপে ধরে মাঝরাতে শুনতাম – না না দেখতাম – সবুজ মখমলি সাবাইনা পার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্নের নায়ক সুনীল, ক্লাইভ লয়েড তাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে চারটে স্লিপ আর দুটো গালি দিয়ে। ছোট্ট চেহারার সুনীলের দিকে ধেয়ে আসছে দৈত্যাকৃতি জোয়েল গার্নার। রেডিওতে শোঁ শোঁ আওয়াজের মধ্যে শোনা যাচ্ছে নরোত্তম পুরীর গলায়, ইন কাম্স্ গার্না, রাইট আর্ম ফ্রম ওভা দা উইকেট। গার্না বোল্স্, স্লাইটলি ওভা-পিচ অন দ্য অফ্যান মিড্ল্। গাভাস্কা ড্রাইভ্স্ অ্যান্ড ড্রাইভ্স্ স্ট্রেট অ্যাজ দ্য বল গোজ স্ট্রেট পাস্ট দ্য বোলার অল অ্যালং দ্য কার্পেট ফর ইয়েট অ্যানাদা ফোর। আমি শিহরিত হতাম। মনে হত ইস্, যদি লর্ড ক্লাইভের বিরুদ্ধেও এমন রুখে দাঁড়াতো নবাবের টীমের কেউ।
তারপর টিভি এল। দূরদর্শন। মাঠ থেকে সরাসরি সম্প্রচার। স্কুল-কলেজে যেতে না হলে খেলা থাকলে টিভি আমার দখলে, যদিও মনে হত মাঠে সবসময়ই বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরঝিরি সাদা-কালো স্ক্রীনে কে ব্যাট করছে, কে বল, সব বুঝে নিতে হত। অদম্য উৎসাহে আমি অ্যান্টেনা ঘোরাতাম ছাদে, যদি আর একটু পরিস্কার আসে ছবি, আর নীচ থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলত, উল্টোদিকে ঘোরা, আর একটু, আর একটু, না না উল্টো, হ্যাঁ, আর না, যাহ –
টিভিতে খেলা ঠিকমত দেখা যাক না যাক, আস্তে আস্তে রেডিওতে খেলা শোনা বন্ধ হয়ে গেল।
রবিবারে খেলা থাকলে তো আমায় আর পায় কে! নড়লেই পাছে আউট হয়ে যায় কপিলদেব, সেই ভয়ে স্থির হয়ে থাকতাম। চান করতে যাওয়ার তাড়া দিত মা। খাওয়া শেষ করতাম গোগ্রাসে।
দুটো বাজলেই হঠাৎ লিখে দিত, এবার খেলা দেখাবে দু-নম্বর চ্যানেলে, কেননা এখানে এখন হবে খবর। মূক ও বধিরদের জন্যে। একজন গোঁফওয়ালা ষন্ডামার্কা লোক হেঁড়ে গলায় আস্তে আস্তে পড়ত সেই খবর, আর এক সুদর্শনা যুবতী হাতের বিভিন্ন মুদ্রায় তা প্রকাশ করত। যত ইচ্ছেই থাক আর রাগ হোক, আমার তক্ষুণি দু-নম্বরে যাওয়া হত না। ততক্ষণে আমাদের দুটো বাড়ির পরে থাকতো যে চক্রবর্তী কাকু, তার মেয়ে ঝিমলি এসে বসে যেত মেঝেয়। খবর 'শুনতে'।
ঝিমলিদের বাড়িতে টিভি ছিল না। ওকে পেছন থেকে খুব জোরে ডাকলেও কিচ্ছু শুনতে পেত না। ঝিমলি সব কথা বলত ওর মায়াময় চোখ দুটো দিয়ে। হাতের মুদ্রা দিয়ে অক্ষর শেখার ব্যাপারটা ওকে কেউ শেখায়নি। হিন্দী বা ইংরাজী ও কিছুই জানত না। আমাদের বাড়িতে রবিবারে দুপুর দুটোয় যে খবর, সেটাই সম্ভবত ওর একমাত্র শিক্ষা। কী বুঝত কে জানে। একঘন্টা হাঁ করে তাকিয়ে থাকত টিভির দিকে, আমার খেলা-দেখার চেয়েও অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে। খবর শেষ হলেই চুপচাপ উঠে চলে যেত।
আমার মা ঝিমলিকে খুব ভালবাসত। পাড়ার অন্যান্য কাকিমা-পিসিমারাও। পাড়াগাঁয় নর্মাল ইস্কুলই সে রকম নেই, তায় আবার বোবা-কালাদের! ঝিমলির লেখাপড়া শেখা হল না তাই।
অথচ প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত এসে গেল তার শরীরেও। ফ্রক থেকে শাড়ি হল একদিন। পাড়ার ছেলেরা দোলের দিন ওর সাথে যা করত, তাকে সভ্যতা বলে না। ঝিমলি বুঝত না ওর কী করা উচিত, বা হয়ত বুঝত কিন্তু ওর প্রতিবাদও তো মূক। শান্ত, সমাহিত প্রকৃতির ঝিমলিকে আমার মাঝে মাঝে দেবী মনে হত। মনে হত, ঈশ্বর অত্যন্ত রূঢ় এই যুবতীটির প্রতি। সমবয়েসী আর পাঁচজনের মত ওরও কেন একজন প্রেমিক থাকবে না?
চক্রবর্তী কাকু স্ট্রোক হয়ে মারা যান একদিন মাঝরাতে। আমার শোবার ঘরের দরজায় দুমদুম শব্দ করে জাগিয়ে দিয়েছিল ঝিমলি। অন্ধকার রাত, দরজা খুলে ঝিমলিকে দেখে কিচ্ছু বুঝতে পারি নি। ও মুখ দিয়ে শব্দ বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। তারপর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি।
সেই প্রথম হাত ধরা। আর সেই শেষ।
পাড়ার কয় ঘর যজমান, এই ছিল ওদের পরিবারের আয়ের উৎস। পুজোপার্বণ তো মেয়েদের দিয়ে হয় না। হলেও মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয় জোরে জোরে, সংস্কৃতে। একজন বোবা-কালা অশিক্ষিতা যুবতীর কাজ নয় এটা।
মাসখানেক পরে তাই শহরে ওর মামার বাড়ি চলে গেল ওরা। কাকিমা সেলাই টেলাই করতেন, বড়ি-আচার-পাঁপড় এই সব টুকটাক বানাতেন শুনেছি। ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দিতে আরো কয়েকবার এসেছিলেন, ঝিমলি আর আসে নি।
দেশে রঙিন টিভি এল। হাজারটা চ্যানেল এল। এখন আর খেলার মাঝে ফট করে মূক-বধিরের খবর শুরু হয়ে যায় না। আর দেখি না রুকাবট কে লিয়ে খেদ হ্যায়।
শুধু কোন এক প্রত্যন্ত বসন্তের রবিবারে জমিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে হাতঘড়িটার দিকে তাকাতে দেখি বেলা দুটো বাজে। সময় থমকে যায়। গলার কাছে কী একটা আটকে যায় যেন।
জীবন গড়িয়ে গেছে। পাঁচিলে শুকিয়ে গেছে রোদে দেওয়া ফ্রক-স্কার্ট-শাড়ি। কোথায় হারিয়ে গেছে রেডিও, ক্রিকেট।
আর কিছু স্বপ্নময়ী নারী।
২৮শে মার্চ ২০১৪