রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পাকী তিন পোয়া হুইস্কি ~ সোমা ব্যানার্জী

কয়েকদিন জ্বরের ঘোরে পড়েছিলাম। আর আট ভাট কত কথাই ভাবছিলাম। কেন জানিনা কফি হাউজের ভেটকির কথা খুব মনে পড়ছিল। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কোন এক দাদা যেন ভেটকিকে দেখিয়ে আমাকে বলেছিলো, ওই দেখ ভেটকি, কফি হাউজের মহাপুরুষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মদ খায়। বাকি সবার সঙ্গেও মদ খায়। মাঝে লিভারটা একটু খারাপ হয়েছিল। তাই এখন লিভ ফিফটি টু  দিয়ে মদ খায়। ভেটকিকে দেখেও যেন মনে হল দ্রব্যগুণেই আছে। চোখ মুখে সামান্য একটু লালচে আভা, যেন ঝামরে জ্বর আসছে। আমি মানসচক্ষে দেখতে পেতাম যে ভেটকি এক মনে মদ খাচ্ছে আর তার পাশে রাখা আছে চাটের বদলে একটি লিভ ফিফটি টু এর কৌটো। বিগড়ে যাওয়া মেটে, রগড়ে ঠিক করে নেওয়ার জন্য গম্ভীর মুখে, কয়েক চুমুক মদের পরেই একটি করে ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করছে সে।

আমার তখন বাস্তবে মদ খাওয়া নিয়ে ধারণা খুব একটা স্পষ্ট ছিলো না। মদ খাওয়া যা দেখেছি সব সিনেমায়। বাবার কাছে বরাবর শুনেছি যারা মদ বা সিগারেট খায় তাদের চরিত্র খুবই খারাপ হয়। আর যে সব মহিলারা ওইসব খায় তাদের সম্পর্কে তো ইয়ে, যত কম বলা যায় ততই ভালো! হাউজে কিছুদিন আসার পর, টেবিলে এর ওর থেকে সিগারেট চেয়ে দু-এক টান দিয়ে দেখলাম। ভালোই লাগলো। আমার চরিত্র কেউ টান মেরে ধরে হিড় হিড়  করে অনেক নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল বলে তো মনে হলো না। বরং স্বামী বিবেকানন্দের মতো জিজ্ঞাসু মনে এর তার হুঁকোয় পরীক্ষামূলক টান মেরে দেখা হল জাত যায় কিনা। পরীক্ষার ফলাফল? দেখা গেল আমার মন পবিত্র হলে কি হবে আশেপাশের ছেলেরা খুবই হিংসুটে। দু'দিন যেতে না যেতেই তারা বললো তুই তোর সিগারেট কিনে খা! আমারটা দেব না, ইত্যাদি। 

তবে কফি হাউজের নিভে আসা মরা মরা আড্ডায় সবসময় দেখতাম মাতালদের নিয়ে চুটকি বলা হতো। ডজন খানেক এইধরণের চুটকি সব টেবিলেরই হট ফেভারিট ছিল। আড্ডার মরা আঁচে ফুঁ দিতে, বহু ব্যবহৃত ক্লিশে চুটকি গুলো কিন্তু বেশ কাজে দিত! মাঝে মাঝে ওই সবকটা জোকস পুনরায় বসে শোনবার ভয়েও লোকজন তাড়াতাড়ি উঠে বসে কথা শুরু করে দিত! ছেলেরা কোথাও তিনদিনের জন্য বেড়াতে গেলে ফিরে এসে সাতাশ দিন ধরে তার গল্প শোনাত। এক দিন বলতো বেড়াতে গিয়ে কি কি দেখেছে, আর ছাব্বিশ দিন ধরে বলতো কে কে মদ খেয়ে কি কি বিচিত্র আচরণ করেছে! এইসব খিল্লির ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মেয়েরা বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। কারণ বাড়ি থেকে কোনোভাবেই অনুমতি পাওয়া যেত না বেড়াতে যাওয়ার। একদল ছেলের সঙ্গে চার-পাঁচ দিন টানা বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলাই যেত না বাড়িতে। আমার বাড়িতে তো একটা একদিনের পিকনিক যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে যা পরিশ্রম করতে হতো, যে আসল পিকনিকের দিনটায় আমার খুব ক্লান্ত লাগতো। মনে হতো গাছতলায় শুয়ে একটু  বিশ্রাম নিই। বা এইসব তুশচু হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়ার প্রলোভন পরিত্যাগ করে বানপ্রস্থে চলে যাই। চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দুর্বাসা মুনির পেছনে লুকিয়ে থাকি। যে শালা আমাকে খুঁজতে আসবে সে ভস্ম হয়ে যাক বা হাফ ডজন অভিশাপের গুঁতোয় ধরাশায়ী হোক!

যাই হোক, বহু ক্লাস মিস করে, গভীর মনোযোগ সহ সব বেড়ানোর গল্প শুনে, ভালো রেজাল্টের আশা অলকানন্দার জলে ভাসিয়ে দিয়ে, আমি আমার চেনা বন্ধুদের মনে মনে কিছুটা ক্লাসিফাই করতে শুরু করি। প্রথম দল ছিলো চার আনার খেয়ে আট আনার নাটক করা টাইপ। এই দলে সবার আগে নাম ছিল বোধহয় বুম্বা আর কামুর। এরা শক্ত পানীয় দু তিন চুমুক খেয়েই, নিজ নিজ বন্ধুবৃত্তে নিজেদেরকে হলমার্ক যুক্ত 'আসল মাতাল' প্রমাণ করার জন্য মহা উৎসাহে ড্রামা আরম্ভ  করতো। টিভির সব ঝুল সিরিয়ালে এবং হলে সব হিট সিনেমায় মাতালদের যা যা করতে দেখেছে সবই এক এক করে করত এরা। কিছুই বাদ যেত না।

এদের ঠিক বিপরীত মেরুতে ছিল আরেকটি দল। এরা অনভ্যস্ত শরীরে কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল ঢোকায় মাথা ভোঁ ভোঁ করলেও কিছুতেই তা স্বীকার করত না।  কিচ্ছুটি হয়নি ভাব দেখিয়ে, নির্লিপ্ত মুখে ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতো। হঠাৎ করে 'একটু আসছি' বলে বাইরে গিয়ে বমি করে আবার এসে অম্লানবদনে বসে থাকতো। 'কিছুই হয়নি'র প্রমাণ স্বরপ মাঝে মাঝে স্মিত হেসে 'পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ' আবৃত্তি করে শোনাতো। তিন চার লাইন আবৃত্তির পর যেখানটাতে হোঁচট খেত, সেখানে থমকে গিয়ে আবার গোড়া থেকে শুরু করতো। তারপর কেমন একটা লুপে পড়ে যেত। এটা মোটামুটি চলতেই থাকতো।

আর একদল ছিল যারা নিজেদের মস্ত বড় কনোসার ভাবতো। কোনরকম লঘু ক্রিয়া-কলাপ বা বালখিল্যের মধ্যে এরা নিজেকে জড়াতে অপছন্দ করতো। এরা এসে থেকে আকাশে নাক তুলে বসে থাকতো আর বলতো, এই তোরা যে যা পারবি খেয়ে নে। দেখি কার কতটা দম আছে। একটু পরেই অ্যামেচারের দল কাত হয়ে গেলে এরা গম্ভীর মুখে নীলকন্ঠ অবতারের মতন এসে যেখানে যা মদ পড়ে আছে সব ঢক ঢক করে অনায়াসে খেয়ে শেষ করে ফেলত। তবে এরা নিজেদের যোগ্য সম্মান পেতো না দলের কাছে। এদেরকে সবাই ব্লটিং পেপার বলে ডাকতো। অথবা স্পঞ্জ।

এইসবের বহু বছর পরে আমি বাচ্চা নিয়ে সুকল্পদের সাথে বেড়াতে গিয়ে মোনালিসার অভিজ্ঞতা শুনি। সেটা এখানে না বললেই নয়। বিয়ের আগেই সুকল্প তার প্রেসিতে পড়া মিষ্টভাষী হবু স্ত্রীকে বলে নিয়েছিল, আমি কিন্তু বেড়াতে গেলে মদ খাই। মোনালিসা বেচারা এতে দোষের কিছুই দেখতে পায়নি । সে সোনামুখ করে আচ্ছা বলেছিল। বিয়ের দু এক মাস বাদেই সুকল্প বলে চলো, বেড়াতে চলো। তারপর সুকল্প তার তিরিশজন বন্ধুর বিশাল দলে বউ নিয়ে মহাসমারোহে দীঘা ঘুরতে গেল।
সকালবেলায়  বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রে চান করতে গেল। গেল তো গেল, আর ফেরার নাম নেই!  উদ্বিগ্ন মোনালিসা  তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে থাকলো, হ্যাঁ গো, আমার বর কোথায়? অধিকাংশই টইটুম্বুর মদ খেয়ে ওকে পাত্তাই দিলো না। পরে, কে একজন মায়া করে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল, ওই তো আসছে। সেদিকে তাকিয়ে মোনালিসা কিছুই দেখতে পেল না। তারপর সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখতে পেল সুকল্পকে চ্যাংদোলা করে আনা হচ্ছে। হুঁশ নেই। বিকেলবেলায় মোনালিসা সুকল্পকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সন্ধ্যেবেলায় নিরুপায় মোনালিসা দলের মধ্যে এক দাদার সঙ্গে কি সব মালা ফালা কিনতে দোকানে গেছে। সেখানে আবার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দু এক কথার পরেই সে জুলজুল করে চেয়ে মোনালিসাকে ফিসফিস করে বলে, তোর বরের ছবি তো আমরা দেখেছি আগে। তোর সাথে আজ যাকে দেখছি এ তো তোর বর নয়! থতমত খেয়ে মোনালিসা হ্যাঁ মানে, না মানে, বর নয় ঠিক, বরের বন্ধুর সাথে... এইসব আবলান জাবলান অসংলগ্ন উত্তর দিয়ে রাগ করে হোটেলে ফিরে আসে...

কাল বছরের শেষ দিন। তাই আজ সমস্ত মদের দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। বুড়ো বাচ্চা লেডিজ জেন্টস সবাই লাইন দিয়েছে। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। হয় দুঃখে নয় আনন্দে, কি জন্যে ঠিক বলতে পারবো না। হেমিংওয়ে বলতেন, "I drink to make other people more interesting." সেটাই হল কি? আমরা সকলে কি একে অপরের মুখ দেখে খুব বোর হচ্ছি? চারপাশে সবার সবাইকে খুব বিস্বাদ লাগছে?  নিজের মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই ভাবি, সত্যি মাইরি, কি আত্মমগ্ন, যান্ত্রিক লোকজন আমরা সবাই। এর চেয়ে ভেটকি অনেক ভালো ছিলো, ইন্টারেস্টিং ছিলো! কাব্যলোকে আসছে কাল মনে হয় মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারণ। মধ্যরাতে মুমূর্ষু তেইশ সালটিকে আলতো করে মদিরায় ভাসিয়ে দেবেন শক্তি আর ভেটকি। নতুন বছরের চিবুক ধরে আদর করে বলবেন, "থুৎনিপরে তিল তো তোমার আছে/ এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?"

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

জীবনের ধাঁধা ~ রজত শুভ্র ব্যানার্জী

মানুষের মেজো ছেলে লোম পরে হুপ হাপ করে,
নিজেকে দেখিয়ে বলে, দেখো, আমি কত বড় হনু,
ওই দূরে বড় মাঠে গোটাকত গরু মোষ চরে,
মেঘ কাটে অবশেষে, আকাশে গজায় রামধনু।

উঠনে তুলসী তলা, ছাগলেরা তায় মাথা ঠোকে,
দু'খানা নেংটি এসে এক কোণে দানা পানি গোঁজে,
পাখিরা বাসায় ফেরে, ইয়ে ক'রে সম্মুখে ঝোঁকে,
পাশে কটা বুড়ো ভাম বসে থাকে সুযোগের খোঁজে।

হঠাৎ পটকা ফাটে, সবাই শিউরে ওঠে ত্রাসে,
আগুন জ্বলতে থাকে সীমানার এধারে ওধারে,
পিপীলিকা ভ্যাবাচ্যাকা, সভয়ে লুকিয়ে পড়ে ঘাসে,
দু'একটা সারমেয় ইতি উতি চেয়ে ল্যাজ নাড়ে।

আর কেউ জানুক বা না জানুক, জন্তুরা জানে
অবশেষে ভগবান ভুলেছেন জীবনের মানে। 

RSB (2023-12-19)

শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

মৎসপুরাণ ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

পারশে নাহয় সর্ষে দিয়ে রেঁধে 
শীতের দুপুর ট্যাংরা পেঁয়াজকলি
বাজার গেলাম চিংড়ি দিল সেধে
ইলিশ কে কি মাছের সেরা বলি!!

গোল বাঁধাল মৌরলা আর পুঁটি
মাছ কাটবার বিভিন্ন পদ্ধতি 
আছেন মাসি, সামান্য ভুল ত্রুটি 
ভেটকি নিলেও এমন কি আর ক্ষতি।।

রুই কাতলা রাজার মত শুয়ে
কেউ খুঁজেছে চিতল মাছের পেটি
মাগুর সিঙ্গি পাবদা বরফ ছুঁয়ে 
কাজরি যেন বড়লোকের বিটি।।

বোয়াল যেন ধ্যানস্থ এক সাধু
উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে শোল
ওভাররেটেড তোপসে জানে জাদু
তেলাপিয়া বাঁধায় গন্ডগোল।। 

সাতসকালে মাছের বাজার টানে
মৎসপুরাণ স্বাদকাহনের মানে।।

শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

সুজানা ~ কৌশিক মজুমদার

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাত খুন মাফ সিনেমাটা আছে না? ওই যে যেখানে উষা "দিদি" উত্থুপ আর রেখা ভরদ্বাজ মিলে "ডা-র-র-র-লিং" বলে একটা গান গেয়েছিলেন (যেটা আবার রাশিয়ান গান কালিঙ্কা থেকে অনুপ্রাণিত)...মজার ব্যাপার এই সিনেমাটার আসল শিকড় লুকিয়ে আছে চুঁচুড়ার মাটিতে। 

খাদিনা মোড় থেকে প্রিয়নগরের দিকে যেতে বাঁ হাতে জি টি রোডের ধারে সাদা মন্দির টাইপ একটা স্থাপত্য চোখে পড়ে। অচেনা লোকেরা এঁকে মন্দির ভাবেনও..কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা জানেন এই মাটিতে শুয়ে রয়েছেন "সাত সাহেবের বিবি" সুজানা আনা মারিয়া ভারকার্ক। নামটা চেনা চেনা লাগছে? রাস্কিন বন্ড তাঁর বিখ্যাত চার পাতার গল্প Susanna's Seven Husbands এ নায়িকার ঠিক এই নামই দিয়েছিলেন। গল্পের প্লট এক কথায় বন্ড এই রকম বলেছেন "When a guy visits the ruins of an old haveli on G T Road, Old Delhi, he was told the story of the mysterious haveli owner, Susanna and killings of her husbands..."

দিল্লীকে আপাতত ভুলে জি টি রোড আর সুজানা নাম দুটো আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। এই গল্প থেকেই কিন্তু গোটা সাত খুন মাফ সিনেমার জন্ম।

কে ছিলেন আসল সুজানা? অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা দলে দলে চুঁচুড়ায় এসে ভিড় জমালেন। সাথে তাঁদের স্ত্রীরাও। এমনই একজন ছিলেন পিটার ব্রুয়িস। তিনি ১৭৫৪ নাগাদ চুঁচুড়ায় ঘাঁটি গাড়েন। সাথে স্ত্রী সুজানা।  তাঁদের একটি ছেলে , দুটি মেয়েও ছিল।  ১৭৮৩ তে পিটারের মৃত্যু হয়। সুজানা এক ইংরেজ টমাস ইয়েটস-এর প্রেমে পড়েন।  ১৭৯৫ সালের ৩০ মার্চ কলকাতার অ্যাংলিকান চার্চে তাঁদের বিবাহ হয়। সাথে সাথে পুত্র কন্যা সমেত সুজানা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ছিল সুজানার দুটি বৈধ বিবাহ। কিন্তু লোকে বলে মাত্র দুটি পুরুষে সন্তুষ্ট থাকার মহিলা ছিলেন না সুজানা। অসংখ্য প্রেমিক ছিল তাঁর। ওলন্দাজ, রাশিয়ান, ইংরেজ এমনকি কেউ কেউ বলেন দু -এক জন ভারতীয় থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পতঙ্গরা যেমন আগুনে পুড়ে মরে, সুজানার রূপের আগুনে এসে ঝাঁপ দিত পুরুষেরা, আর সবাই কোন না কোন অদ্ভুত ভাবে মারা যেত। কেউ আত্মহত্যা করত বিষ খেয়ে,কাউকে কে যেন বুকে ছুরি বসিয়ে যেত,  বাড়ি শুদ্ধু আগুনে পুড়ে মরত বা কেউ...

১৮০৯ সালের ১২ মে সুজানা মারা যান। তাঁকে কবর দেওয়া হয় আয়েস বাগে। কবরের উপর তৈরী করা হয়  ডাচ- ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রনে এক অপূর্ব সৌধ। সেখানে আজও শুয়ে আছেন সুজানা। তাঁর কবরে লেখা ""SUSANNA ANNA MARIA YEATS REBOORE VERKERK OBiIT 12 MAY ANNO 1809"। এই REBOORE VERKERK মানে তাঁর আসল পদবি হল ভারকার্ক। সাত স্বামীর সাথে সম্পর্কের পরেও সুজানা তাঁর পিতৃদত্ত পদবিকে ছাড়েন নি।

সুজানার প্রথম স্বামী পিটার ব্রুয়িসও শুয়ে আছেন চুঁচুড়ার মাটিতে। তবে সুজানার থেকে অনেক দূরে। ফুলপুকুর রোডের সেই ওলন্দাজদের কবরস্থানে। কবরখানার দক্ষিন-পশ্চিম কোণের বিশাল ওবেলিস্কটা আসলে পিটারেরই সমাধি। ভাঙাচোরা ইঁট এদিক ওদিক দাঁত বের করে আছে। তার মাঝে এখনও বিবর্ণ ফলকে দেখা যায়  ৫২ বছরে মারা যাওয়া মানুষটির নাম, যারও স্ত্রীর জীবন বাস্তবিক তাঁর থেকে অনেক রঙিন ছিল।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ~ অহনা বিশ্বাস

আজ মহামহিম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিনে তাঁকে অনন্ত শ্রদ্ধা জানাই। আজ এই উপমহাদেশের সকল মেয়েদের, বিশেষত নবপর্দায় শোভিত মেয়েদের তাঁকে বড় প্রয়োজন।

তাঁর 'অবরোধবাসিনী' (1931) বইটি থেকে খানিক উদ্ধৃত করলাম। যদি কারুর ইচ্ছা হয় তো পড়বেন। 

'প্রায় ৪০/৪৫ বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা-কয়েক ঘর বঙ্গীয় সম্ভ্রান্ত জমীদারের মাতা, মাসী, পিসী, কন্যা ইত্যাদি একত্রে হজ করিতে যাইতেছিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় ২০/২৫ জন ছিলেন। তাঁহারা কলিকাতায় রেলওয়ে ষ্টেশন পৌঁছিলে পর সঙ্গের পুরুষ প্রভুগণ কার্য্যোপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন। বেগম সাহেবাদিগকে একজন বিশ্বস্ত আত্মীয় পুরুষের হেফাজতে রাখা হয়। সে ভদ্রলোকটীকে লোকে হাজী সাহেব বলিত, আমরাও তাহাই বলিব। হাজী সাহেব বেগম সাহেবাদের ওয়েটিং রুমে বসাইতে সাহস পাইলেন না। তাঁহারা উপদেশ মতে বিবি সাহেবারা প্রত্যেক মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরিয়া ষ্টেশনের প্লাটফরমে উবু হইয়া (Squat) বসিলেন; হাজী সাহেব মস্ত একটা মোটা ভারী শতরঞ্জি তাঁহাদের উপর ঢাকিয়া দিলেন। তদবস্থায় বেচারীগণ এক একটা বোচকা বা বস্তার মত দেখাইতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ঐরূপে ঢাকিয়া রাখিয়া হাজী সাহেব এক কোণে দাঁড়াইয়া খাড়া পাহারা দিতেছিলেন। একমাত্র আল্লাহ জানেন, হজযাত্রী বিবিগণ ঐ অবস্থায় কয় ঘণ্টা অপেক্ষা করিতেছিলেন-আর ইহা কেবল আল্লাহতালারই মহিমা যে তাঁহারা দম আটকাইয়া মরেন নাই।

ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্ম্মচারীটী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, "মুন্সি! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আবেগা-প্লাটফরম পর খালি আদামি রহেগা-আসবাব নেহি রহেগা।" হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, "হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি-আওরত হায়।" কর্ম্মচারিটী পুনরায় একটা "বস্তায়" জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, "হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।" বিবিরা পর্দ্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।'
******

'আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, "পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?"-সে কি উত্তর দিবে?

এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে।

এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না।

বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ।

শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন।'
******

'কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ

"কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!"

প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···"না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা'ব না।" বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,—বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ "এয়ার টাইট" বলা যাইতে পারিত।

প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,—মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।

দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,—দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।

সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,—"আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, "ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।" তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?"

তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, "আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।" আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, "কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, "বেপর্দ্দা গাড়ী।" তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, 'তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।" সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।

সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া "খবিছ" "পলীদ" প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।

এ তো ভারী বিপদ,—
"না ধরিলে রাজা বধে,—ধরিলে ভুজঙ্গ!"

রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,—

"কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!"

শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু ~ সংকলন সরকার

সে অতি অদ্ভুত বিদঘুটে ভূতুড়ে জায়গা বাপরে বাপ! সাত সক্কাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলেই খিদে পেয়ে যায়। বরং বলা ভালো অত সকালে খিদের চোটেই ঘুম ভাঙ্গে! খিদে পেলে হাতের কাছে কিছু না থাকলে চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়ে নিয়ে হালকা কুয়াশা ঠেলে গুটি গুটি হেঁটে পৌঁছে যাও থানার পাশে পাঁড়েজীর চায়ের দোকানে। শীত এখানে ভালই পড়ে গেছে। এই সকাল সাড়ে ছটার সময় পাঁড়েজীর দোকানে গরমা গরম চা ছাড়া আর কিছুই গরম পাবে না। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে...! একটু মাথা ঘোরালে দেখবে দোকানে মোটে তিন রকমের বিস্কুট আছে, একটা কাচের ঘেরাটোপে গুটিকয় গতকাল সন্ধ্যেবেলার বানানো শিঙ্গাড়া আর গতকাল বিকেলের বানানো জিলিপি। সারারাতের ঠাণ্ডা খেয়ে সে সব খাদ্যবস্তুর গায়ে জমাট ডালডার সাদা পরতের কারুকার্য্য! প্রথম দর্শনে মনে মনে তলপেট থেকে একটা কাল্পনিক চোঁয়াঢেঁকুর খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আলজিভের তলায় ঘুরপাক খেতেই পারে। হাজার হোক বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল খাওয়া পেট তো! কিন্তু বাস্তব ঘটনা আরো খারাপ। সেটা হল পেটের বেসমেন্ট থেকে পেটের টপ ফ্লোর অবধি এখন কম করে খান কুড়ি ছুঁচো দৌড়চ্ছে! তাই আর ডালডার আর্টওয়ার্ক না দেখে ঐ বাসি শিঙ্গাড়া আর জিলিপিই সই। চোখ কান বুজে খেয়েই নেওয়া যাক আপাতত। পরের কেস নাহয় পরে সাল্টে নেওয়া যাবেখন! 

পাঁড়েজীর লোক এখন সবে খোসা সমেত আলুর তরকারীর মালমশলা কেটে বীর বিক্রমে আটা মাখতে লেগেছে। গরমাগরম পুরি তরকারী পেতে পেতে কমকরে আরো ঘন্টা দেড়েক দেরী। সকাল আটটা সোয়া আটটার আগে কোনো মতেই নয়! এখন দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলে ছুঁচোগুলো সংখ্যায় বেড়ে খান চল্লিশেক হয়ে গিয়ে ছুটোছুটি করে পেট ফুটো করে দিতে পারে। অতএব ছুঁচোগুলোকে ঐ আগের দিনের গোটাচারেক করে ডালডা জমা ঠাণ্ডা বাসি শিঙ্গাড়া জিলিপি খাইয়েই ঠাণ্ডা করে দাও আপাতত। তারপর ছোটো কাচের গেলাসে গরম চা দু' হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আয়েশ করে ছোটো ছোটো চুমুকে শেষ করে আবার গুটি গুটি হেঁটে ফিরে আসা যাক নির্ভেজাল ভূতেদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত লালকোঠিতে। এবার এটা ওটা খুটখাট করতে করতে সকালের কাজকম্মো গুলো সেরে নেওয়ার পালা, আমাদের কাজ বলতে সামান্যই। দাঁতমাজা, দাড়িছাঁটা বড়বাইরে ইত্যাদি বাথরুমের কাজ মূলত। এ ছাড়া বেড়াতে এসে তোমার আর কাজ কী! 

অদ্ভুত রকমের রুক্ষ অথচ সতেজ প্রকৃতি শিমুলতলায়। এখানকার লোকজনদের জীবনযাপন আরো অদ্ভুত... কিছুটা সপাট সতেজ কর্মঠ সময় দেখার পরেই দেখতে পাবে, এখানে আর কোনো কাজ নেই। সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে... অতএব আবার যেদিকে তাকাবে দেখবে আলস্য বাবাজী সবখানে চাদর বিছিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই... আয় আয়, আয় এবার একটু চুপটি করে আমার দালানে ঠেস দিয়ে বোস দিকিনি... হুশহুশিয়ে অনেক কাজ তো করলি রে বাপ, এখন আমায় একটু শান্ত হয়ে বল তো দেখি কী কী কাজ করলি এতক্ষণ ধরে অত হৈহল্লা করে?! তো, এই সব ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে আটটা বেজে যাবে, আর আমরা আবার প্রচণ্ড অবাক হয়ে খেয়াল করব যে জানলা দিয়ে একটা মন উদাস করা মৌরীফোড়োন দেওয়া খাবারের সুগন্ধ আসছে। সেটা সম্ভবত পাঁড়েজীর দোকানে আলুর তরকারী রেডি হয়ে যাওয়ার গন্ধ... এইবার এক কড়াই গরম তেলে আটার লাল লাল পুরি ভাজা হবে! এবং আরো ভয়ানক অবাক হয়ে আমরা খেয়াল করব, পেটে গোটাপাঁচেক ছুঁচো নড়াচড়া শুরু করেছে! কোলকাতা বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলে থাকলে কিন্তু ওই একগন্ডা বাসী শিঙ্গাড়া আমাদের বিকেল পাঁচটা অবধি খিদে পাওয়া থেকে বিরত করে রাখতে পারত। কিন্তু আমরা এখন বাড়িতে নেই... তাই এবার একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে গুটি গুটি আবার রওয়ানা দেব পাঁড়েজীর দোকানের উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য আর আমরা আর চাদর নেব না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে যে... রোদ মাখতে মাখতে হাঁটা যাক। 

তারপর সারাদিন অল্প ঘোরাঘুরি খানিক আড্ডা, ঘুরতে ঘুরতে চলে যাওয়া ধু ধু মাঠে পড়ে থাকা বিশাল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে... তারপর আবার গঞ্জের দিকে ফিরে এসে ফের আমরা ঘুরঘুর করব বিশাল বিশাল গেট ওয়ালা এক কালে জাঁকিয়ে বসা, অধুনা পলেস্তরাখসা ইটের মধ্যে থেকে গাছ গজানো পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর চারপাশে... কারো কোনো গেটের থামে মুখোমুখি বসে আছে এক জোড়া বিগতশ্রী সিমেন্টের সিংহ...  যাই হোক... দুপুরে আবার একচোট ভাত ডাল দেশীমুরগীর ঝোল দিয়ে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পরে নাহয় ভাবতে বসা হবে, আমাদের এত খিদে ছিলো কোথায়!? এবং, এই বিকট পরিমাণ খাদ্যাখাদ্য পেটের কোথায় কোথায় চালান হচ্ছে শেষ অবধি?!!!! 

শীতের বেলা ঝটপট শেষ হয়ে আসার তাড়ায় থাকবে। এখানে এখনো লো ভোল্টেজ থাকে। টিমটিমে বাল্বের আলোয় দিনের শেষে সন্ধ্যাকে বরণ করে নেওয়া হবে... এটাই এখানকার দস্তুর। ঝকঝকে তকতকে কোনো ব্যাপার কোত্থাও নেই, সবই ম্যাড়ম্যাড়ে আর ভয়ানক মায়াবী। মায়াবী সন্ধ্যে নেমে গেলেই দেখতে পাবে এই এলাকায় কী বেশী পরিমাণে থিকথিক করছে ভূত! 

এলাকার সমস্ত গহন অন্ধকার জুড়ে কনসেনট্রেটেড ঘন ভূতের দল মাইল কে মাইল ছড়িয়ে পড়ে থাকা অতীত ঘিরে গিজগিজ করছে। ভূতেদের মধ্যে সাহেব বাঙালি দেহাতি সবাই রয়েছে। দু' চারটে ঘোড়া আর অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতও রয়েছে। রাতের রাস্তা জুড়ে ঘোড়া ভূতে সওয়ার সাহেব ভূত তার সঙ্গে প্রিয় পোষ্য অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলের ভুতুড়েহাওয়া খেতে বের হয়। এখানকার ভূতের দল ভীষণ নির্লিপ্ত। এরা কাউকে একেবারেই ভয় টয় কিচ্ছু দেখায় না! শুধু লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কিন্তু বেড়াতে আসা কেউ কেউ হয়ত অত পরিমাণ ভূত একসঙ্গে দেখে ফেলে ভয় পেতেই পারে! তার জন্য অবশ্য এখানকার ভূতদের কোনোভাবেই দোষ দেওয়া উচিৎ নয়! 

রাতের টিমটিমে আলোমাখা জমাট অন্ধকারে ভূতেদের দু হাতে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে আমাদের এক পা দু' পা করে এগিয়ে যেতে হবে তাজা সবজীর দোকানে। সেই সবজীর দোকান থেকে আমরা ড্যামচিপ তাজা বেগুন কিনবো, পোকা এবং রাসায়নিক ছাড়া সস্তায় তাজা বড় বড় বেগুন কিনে আমরা আবার দু' হাতে ভূত সরাতে সরাতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাবো পাঁড়েজীর দোকানে। পাঁড়েজী ওই তাজা বেগুনগুলোর গায়ে মাপ মতন ছুরি চালিয়ে ছ্যাঁদা করে ঢুকিয়ে দেবে চার পাঁচ কোয়া রসুন আর কাঁচা লঙ্কা। তারপর কয়লার উনোনো বেগুনগুলোকে দেশী টমেটোর সঙ্গে খুব যত্ন করে নিজের হাতে পোড়াতে পোড়াতে পাঁড়েজী আমাদের বলবে, যে এখন তো এখানে আর কিছুই নেই... তবে একসময় এই যায়গাটার একটা 'সময়' ছিলো বটে! পাঁড়েজীর সহকারীরা মুখ বন্ধ করে একের পর এক রুটি বেলে তাওয়ায় সেঁকে উনোনে চিমটে দিয়ে ফুটবলের মতন ফুলিয়ে নরম কাপড়ের ওপর রেখে পাঁজা খানেক রেডি হয়ে গেলে চিল চিৎকার করে কর্কশ গলায় বলবে - ফুলকা তৈয়ার হো গ্যায়া হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে নিজনিজ পেটে সেই পাঁজা পাঁজা রুটি অবলীলায় পাকস্থলীর বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে ঠেসেঠুসে ভ্যানিশ করে দিয়ে, দু' হাত দিয়ে ঠেলেঠুলে ভূত সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ভূতের ডেরার লালকোঠিতে পৌঁছে যাবো। 

হ্যাঁ মশাই শিমূলতলার কথা বলছিলাম...  আগামী সপ্তাহের মাঝখানে দিন চারেকের জন্যে আবার একবার বিহারের শিমূলতলা ঢুঁ মারতে চলেছি একটা ছোটোখাটো ড্রাইভে। যাওয়ার আগে ব্যাগ পত্তর গোছাতে গোছাতে হালকা করে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম তাই ছোট্টো একটা স্মৃতিনির্ভর ভূমিকা ছেড়ে রাখলাম। এরপর ফাঁকে ফোঁকরে অথবা ফিরে এসে দু একটা ছবিছাবা আপলোডিয়ে দেবোখন! আসানসোলের পর থেকে চিত্তরঞ্জন পেরিয়ে 'জামতাড়া-গোড্ডা রোড ধরে' নিলেই রাস্তার দু'পাশ পৌঁছানোর আগেই পয়সা উশুল করে দেবে! আশা করছি প্রতিবারের মতন এবারেও শিমূলতলায় পৌঁছে নেট ফেট পাবো না! আর ইয়ে, একটা ভীষণ জরুরী ইনফো দিয়ে রাখি। যাঁরা শিমূলতলা গিয়ে ইঁদারার মিনারেল মেশানো জলের বদলে প্লাস্টিকের বোতলে কেনা মিনারেল ওয়াটার খেয়ে থাকেন তাঁরা অবশ্যই অ্যান্টাসিড ক্যারি করবেন। নইলে ঐ ডালডা মাখা ঠাণ্ডা শিঙ্গাড়া জিলিপি কিন্তু আপনাদের মাথায় চড়ে চেপে বসবে। ওসব হজম করানো বা পাকস্থলীতে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল বানানো কেনা প্লাস্টিকের জলের বোতলের কম্মো নয়... এইবেলা সবাইকে বলে কয়ে রাখলুম!

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু... 
শিমুলতলা, ডিসেম্বর ২০১৭

An idea, like a ghost, must be spoken to a little before it will explain itself... 
...Lord Sinha's place, Shimultala. 

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

বেলা আর বাতুল ~ অরিজিৎ গুহ

বেলা আর বাতুল এর গল্প শুনেছেন? অনেকেই শোনেন নি হয়ত। আসুন শুনে নি। গল্পটা আমরা শুনছি বোম্বের প্রসিদ্ধ ফরাস রোডের এক তওয়াইফের মুখ থেকে।
বেলা ছিল রাওয়ালপান্ডির কাছের একটা গ্রামের মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ত। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল। এগারো বছর বয়স। আর কয়েকবছর পরেই হয়ত গ্রামেরই কোনো গরীব ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, তারপর সুখে ঘরকন্না করতে পারত।
কিন্তু হঠাৎ করেই কী হল, একদিন আল্লাহ হো আকবর বলে একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলার বাড়ির ওপর। বেলার বাবাকে তরোয়ালের কোপে ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিল, মায়ের স্তন কেটে দিল, আর আরো যেসব হিন্দু বাড়ি ছিল সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। গ্রান্ট রোডের এপারে ফরাস রোডে জিন্নাহ্ সাহেব কোনোদিনও আসবেন না। শরিফ আদমিরা কখনো গ্রান্ট রোড ক্রস করেন না।কিন্তু জিন্নাহ্ সাহেব একবার যদি বেলার সাথে দেখা করতেন, তাহলে হয়ত বেলাকে বোঝাতে পারতেন বেলার সাথে যা হয়েছে তা করার অধিকার কোরাণে কোনো মুসলমানকে দেয় নি।
বেলা এরপর পালিয়ে চলে আসে রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে এক মুসলিম দালাল ওকে নিজের হেপাজতে করে নেয়। সেই দালালের থেকে আরেক দালাল ওকে কিনে নেয়। তারপর বেলার ঠাঁই হয় ফরাস রোডের তওয়াইফখানায়। বেলার মুখটা যদি জিন্নাহ্ সাহেব দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতেন 'মাসুমিয়াত কি কোই মজহব নেহি হোতি'। এক সরল নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মুখ। সেই মুখে ধর্ম লেখা নেই। সেই মুখে হিন্দুস্তান পাকিস্তান লেখা নেই। সেই মুখ হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই যে কারো মুখ হতে পারে। জিন্নাহ্ সাহেবের বাংলোতে যে বেলার চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় না!
বাতুল থাকত জলন্ধরের কাছের এক গ্রামে। বাবা খুবই গরীব। মুটে মজুরি করে চালায়। অনেকগুলো দিদি আর ভাইদের নিয়ে তার মধ্যেও শান্তিতে থাকত ওরা। বাতুলদের গ্রামে 'নমাজ আদা' করার কোনো হুকুম ছিল না। বাতুল কোনোসময়ে জিন্নাহ্ সাহেবের গল্প শুনেছিল। সেই থেকে জিন্নাহ্ সাহেবকে খুব পছন্দ করত। গলায় একটা লকেট ঝুলিয়েছিল জিন্নাহ্ সাহেবের ছবি দিয়ে।
হিন্দুস্থান পাকিস্থান ভাগ হওয়ার পর বাতুল স্লোগান দিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে। ঠিক যেরকমভাবে পাঁচ ছ'বছরের বাচ্চা কোনো কিছু না বুঝেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ফেলে, সেরকমই আরকি।
সেই স্লোগান শুনে গ্রামের জাঠরা এসে প্রথমে ওর বাবার জামা কাপড় খোলাল, তারপর মুখে পেচ্ছাপ করল, তারপর বাবার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। দিদিদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল আড়ালে।
এরপর বাতুলকে যখন এক হিন্দু দালালের থেকে ফরাস রোডের ওই তওয়াইফ কিনে নিল, তখন সে দেখেছিল বাতুলের সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তো অনেক পণ্ডিত মানুষ আর উনিও অনেক শরিফ আদমি। তাই উনিও কখনো ফরাস রোডের তওয়াইফখানায় ঢুকবেন না কোনোদিন। কাজেই বাতুলকেও দেখতে পাবেন না কোনোদিন। যদি দেখতে পেতেন, তাহলে হয়ত উনি বোঝাতে পারতেন যখন বাতুলের সাথে এরকম হচ্ছিল, তখন ঋকবেদ স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। গুরু গ্রন্থসাহিব বোবা হয়ে গেছিল। কারণ দুই কিতাবের কোথাও যে লেখা ছিল না বাতুলের সাথে এরকম ব্যবহার করার কথা।
নেহেরুজি'র বাংলোতে যে বাতুলের চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় নি। নেহেরু জি কী করবেন!
কৃষণ চন্দর যখন 'এক তওয়াইফ কি খৎ জিন্নাহ্ সাব অউর নেহেরু জি কো' লিখেছেন তার কিছু আগেই আজাদি এসেছে। কিন্তু তাও বারেবারে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে গেছেন কৃষণ চন্দর।
'মহালক্সমী কা পুল' গল্পে মহালক্সমী পুলের পাশে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত শ্রমিক বস্তির যে ছবি এঁকেছেন তার প্রতিটা ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে ভদ্র সভ্য উচ্চবিত্তদের প্রতি বিদ্রুপ।
পুলের পাশে মিল মজদুররা তাদের নিজেদের নিজেদের চওলে থাকে। পুলের ওপর ওদের স্ত্রীদের শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছটা শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। শান্তাবাঈ এর ফ্যাকাসে বাদামী রঙের শাড়ির পাশে যে শাড়িটা ঝুলছে শুকোতে দেওয়ার জন্য, সেই শাড়িটাও পাঠকদের চোখে ফ্যাকাসে বাদামী রঙই মনে হবে। কিন্তু কথক, যিনি একজন পয়ষট্টি টাকা মাইনের ক্লাস টেন পাস করা ক্লার্ক, যখন থেকে শাড়িটা দেখেছেন তখন সেটার রঙ ছিল গাঢ় বাদামী। পুরনো হয়ে রঙ হাল্কা হয়ে হয়ে সেটা ফ্যাকাসি বাদামী রঙে পর্যবসিত হয়েছে। তার পাশে রয়েছে মিল থেকে বহিষ্কৃত শ্রমিক ঝাব্বুর স্ত্রী লোড়ির শাড়ি। লোড়ির শাড়ির পাশে ঝুলছে মঞ্জুলার শাড়ি। সব থেকে ঝকমকে শাড়ি ওটা। কারণ মঞ্জুলার কয়েকমার আগে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের শাড়িটাই ঝুলছে। মঞ্জুলার স্বামী কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মঞ্জুলার পাশে শেষ যে শাড়িটা ঝুলছিল সেটা ছিল বুড়ি মা'র। যার ছেলে সিতু এখন জেলে। সরকার থেকে যখন হরতাল বে আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সিতুরা জুলুস বের করেছিল হরতালের সমর্থনে। পুলিশ থেকে মহালক্সমি পুলের পাশের চওলে গুলিবৃষ্টি চলে। সবাই ভয় পেয়ে নিজের নিজের চওলের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে যখন সব শান্ত হয়ে যায় তখন দেখা যায় সিতুর মা গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। বুড়ি মানুষ, হয়ত তাড়াহুড়ো করে নিজের খোপরে ঢুকতে পারে নি। সেই লাল শাড়িটা এখন পরে সিতুর বৌ। সিতু হরতাল করার জন্য জেলে রয়েছে।
একটু পরই মহালক্সমী পুলের ওপর দিয়ে 'ওয়াজির এ আজম' মানে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর চোখেও সেই ঝোলানো শাড়িগুলো চোখে পড়বে না। যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যায় ততক্ষণ ধরে সেই শান্তাবাঈদের কলোনির গল্প শুনিয়েছেন কৃষণ চন্দর।
যুবতী শান্তাবাঈ, বৃদ্ধা জীবনা বাঈ বা কথকের মধ্যবয়সী স্ত্রী সবার গল্প মোটামুটি একইরকমের। প্রতি পদে অর্থের হাহাকার, ছোট্ট ছোট্ট সাধ আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না হওয়ায় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর তারই সাথে কুসংস্কার, সব যেন একসাথে হাত ধরাধরি করে রয়েছে। সবার শাড়িগুলো একসাথে যখন পাশাপাশি উড়তে থাকে তখন প্রত্যেকের শাড়ির রঙগুলো আর আলাদা করে চেনা যায় না।
প্রত্যেকের গল্প বলতে বলতেই কখন যে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে যায় বোঝাও যায় না। আসলে কনভয় তো এই মহালক্সমী পুলের পাশে দাঁড়াবে না, প্রধানমন্ত্রীর অত ঠেকাও পড়ে নি। কিন্তু ওই ছ'টা শাড়ি যেন ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিদিনের গল্প বলে যায়।
১৯৩৬ সালে যখন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় প্রেমচন্দকে সভাপতি আর সাজ্জাদ জাহিরকে সম্পাদক করে, তখন সেই সংগঠন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইকবাল আর নজরুলের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে ওঠে। উর্দু সাহিত্য সেই সময়ে মোটামুটি আগের অবাস্তব আবেগের জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বাস্তবের মাটিতে।
প্রথম সম্মেলনে আহম্মদ আলি, আলি আব্বাস হুসায়নী, মুলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমেদ আব্বাস, শওকত সিদ্দিকে, গোলাম আব্বাস, আহমেদ নাদিম কাশমী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নাম হলেও চারজন যারা পরবর্তীকালে উর্দু সাহিত্যের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন তারা হলেন সাদাত হাসান মান্টো, রাজিন্দার সিং বেদি, ইসমাত চুঘতাই আর কৃষণ চন্দর। বলা যায় এই চারজন উর্দু সাহিত্যকে শাসন করেছেন। তবে বাকি তিনজন যেমন চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কৃষণ চন্দর আবার চিরকাল সাহিত্য রচনা করে গেছেন শোষিত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা সার্থক ভাবে বয়ে নিয়ে গেছেন। মান্টোর মতই দাঙ্গা আর দেশভাগকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
'গাদ্দার' গল্পে বৃদ্ধ বুলাকি শাহ চারিদিকের শয়ে শয়ে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। বৈজনাথের কন্ঠে চমকে উঠে বলে 'আমি মুসলমান। আমাকে মেরো না।' জবাবে বৈজনাথ যখন বলে মুসলমান হলে এখানেই তোর লাশ ফেলে দেব, তখন উত্তরে বুলাকি শাহ জানায় আমি বুলাকি শাহ। বৈজনাথ এবার আশ্চর্য হয়। গ্রামের সব থেকে বড় মহাজন বুলাকি শাহ! বৈজনাথ জিজ্ঞাসা করে এখানে কী করছ? ততক্ষণে বুলাকি শাহ ভয় কাটিয়ে উঠেছে। বলে সব তো মরে পড়ে রয়েছে এখানে। আমার পরিবারেও কেউ বেঁচে নেই, সম্পত্তিও সব লুঠপাট হয়ে গেছে। শুধু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে। তা মেয়েটাকে তো বিয়ে দিতে হবে। যা পাচ্চি এখান থেকে সোনাদানা তাই হাতিয়ে নিচ্ছি পকেট থেকে। তুমিও এসো না। যা পাব ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেব।
স্তম্ভিত হয়ে যায় বৈজনাথ। মানুষ কোথায় নামতে পারে ভেবে! বুলাকি শাহ বলে মেয়ের বিয়ের যৌতুক ছাড়া কেউ তো মেয়েকে বিয়ে করবে না।
দেশভাগ আর দাঙ্গার নানারূপ দেখেছেন কৃষণ চন্দর। বরাবর গল্প বলেছেন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া গরীব মানুষের। তাঁদের দুঃখ দুর্দশা, লড়াই করা হেরে যাওয়া এবং আবার জানকবুল লড়াই এর জন্য উঠে পড়া, এই গল্পই শুনিয়ে গেছেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'রোটি কাপড়া মকান' এক অদ্ভুত গল্প।
খাজা আহমেদ আব্বাস যখন সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন, তখন বাংলার বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' আর 'জবানবন্দি' এই দুটো নাটকের গল্প শোনা হয়ে গেছে। ৪৩ এর মন্বন্তরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আব্বাস। এরপর কৃষণ চন্দরের 'অন্নদাতা' গল্পে পড়ে ঠিক করলেন তিনটে গল্পকে একসাথে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন বাংলার ৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে।
যথা সময়ে 'ধরতি কে লাল' সিনেমা তৈরি হল আইপিটিএ র সব রথী মহারথীর সাহায্যে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেল সেই সিনেমা। এটাই একমাত্র সিনেমা যা আইপিটিএর নিজস্ব প্রযোজনায় তৈরি। সেখান থেকেই ফিল্ম জগতের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয় কৃষণ চন্দরের।
এক সময়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গল্প লেখার পেছনে এত সময় দিতে হয়েছিল যে তাঁর নিজের গল্পে সেই প্রভাব পড়েছিল। গল্পের ধার গেছিল কমে।
নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা 'উত্তর ফাল্গুনি' হিন্দি স্ক্রিপ্ট 'মমতা' কৃষণ চন্দরেরই লেখা। এছাড়াও অসিত সেনের আরেকটি সিনেমা 'সরাফত' যেখানে ধর্মেন্দ্র হিরো ছিল তার গল্পও কৃষণ চন্দরের। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে সিনেমার জগতে থাকলে তার গল্পের মান নেমে আসছে। অবশেষে ছেড়ে দিলেন সিনেমার জগত। ১৯৭৭ এ যখন মৃত্যু হয় তখন হাসপাতালে তার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা সিদ্দিকি। লিখতে শুরু করেছিলেন নতুন একটি গল্প। কয়েক লাইন লেখার পরই ঢলে পড়েন মৃত্যুর মুখে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে নিভে যায় উর্দু সাহিত্যের এক স্তম্ভ কৃষণ চন্দরের জীবন দীপ।
১৯৭৭ এ মৃত্যু হলেও একজন লেখক কতটা প্রভাবশালী হতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া গেছে এই ২০১৯ সালেও এসে। ২০১৯ সালের এক সার্কুলার জারি করে আইসিএসসি বোর্ডের দশম শ্রেনীর সিলেবাস থেকে 'জামুন কা পেড়' বলে একটি গল্প বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটিতে খুব তীক্ষ্ণভাবে মজার ছলে ভারতের ব্যুরোক্রেসির প্রতি, লাল ফিতের ফাঁসের প্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সরকারের সেসব পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই আজও কৃষণ চন্দর কতটা প্রাসঙ্গিক বোঝা যায়।
১৯১৪ সালের আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৩ শে নভেম্বর জন্ম হয়েছিল কৃষণ চন্দরের।

রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৩

শান্তিগোপাল, লেনিন ও আমরা ~ শুদ্ধ্বসত্ত্ব ঘোষ

কালীপূজো এসে গেল। এমন সময় রেল কলোনীর বিশাল মাঠ ঘিরে ফেলা হত। টিনের দেওয়াল। দেড় মানুষের বেশী উচ্চতা। সেই টিনের দেওয়াল যা ঘিরছে তা কিন্তু সার্কাস না। তা হল যাত্রা।

ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা মঞ্চ হচ্ছে। সেই মঞ্চের চারদিক খোলা। লম্বা দুটো স্লোপ চলে গ্যাছে সাজঘর থেকে সোজা সে মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসবে কনসার্ট পার্টি। তাদের জন্য একটু নীচু করে জায়গা রাখা। কখনো দু পাশেও বসতে দেখেছি তাঁদের। পিছনে সাজঘরের দিক থেকে টেপ বাজতো। সামনে, পিছনে আলোর স্ট্যান্ড বসে যাবে। আলোক নিয়ন্ত্রকের বসার ব্যবস্থা হবে ওই দুটো স্লোপের মাঝখানের অংশে। 
শুনেছি এ সব ব্যবস্থা হল যাত্রা সম্রাট স্বপনকুমারের করা। আধুনিক করেছেন তিনি। রবি ঠাকুরের বাড়ির মেয়ে তাঁর জ্যাঠাইমা। মেজদা, বিজন মুখোপাধ্যায়। শিশির ভাদুড়ির সাক্ষাৎ ছাত্র। তিনি, স্বপনকুমার ছিলেন সনৎ, হলেন স্বপন যাত্রায়। বাবা, দাদার মৃত্যুর পরে, দিদির একমাত্র ছেলে দাঙ্গায় মারা যাবার পরে, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এসেছিলেন যাত্রায়।   

সন্ধ্যা নামবে একদিন মফস্বলে, শীত আসার আগের সন্ধ্যা। দলে দলে লোক যাত্রার সিজন টিকিট কেটেছে। একেক কোম্পানি আসবে, একেক যাত্রা গাইবে। নট্ট থেকে শুরু করে রয়্যাল বীণাপাণি। সে আমলে শান্তিগোপাল অপেরাও। শান্তিগোপালে আসার আগে বলে নিই আমার ভয় পাওয়ার কথা। মঞ্চে দেখলাম তেমন এক সন্ধ্যায় এক খোঁড়া বাদশার জন্য থালায় সাজিয়ে কাটা মুন্ডু নিয়ে আসছে এক পার্ষদ। অবিকল যেমন দেখতে অভিনেতা একটু আগে খুব লড়ছিলেন বাদশার সঙ্গে তাঁর কাটা মুন্ডু। ভয় পাবো না? তখন কি ছাই জানি ও মুন্ডু মাটির? ও মুন্ডু কৃষ্ণনগরের ফুল-ফলের মতন? তবে বাদশাটি শান্তিগোপাল না, তিনি শিবদাস।

শান্তিগোপাল-ও ভয় দেখালেন। হিটলার-এ। আরেকটু বড় তখন। মেদিনীপুড়, জকপুর, খুড়দা কত কত জায়দায় যাত্রা হয়। বাবার সঙ্গে সঙ্গে, সোনা কাকু, দাদাভাই-এর সঙ্গে চলে যাই। রাত জেগে যাত্রা। দেখতে দেখতে ঘুমিয়েও পড়েছি। আবার আতঙ্কের মধ্যে জেগে থেকেছি সারারাত। স্পার্টাকাসে কালো লোকটা সেই! সেই যে যে স্পার্টাকাসের মতন দাস ছিল, গ্ল্যাডিয়েটর ছিল, যে এরিনায় স্পার্টাকাসকে খুন করতে চেয়েছিল, স্পার্টাকাসের বউ-কে কামনা করেছিল, সেই লোকটা কি কালো, কি ভয় ধরাণো ছিল। অজিতেশ-কে দেখছি আসলে। সেই হাসিটা? কি ক্রুর, কি ভয়ানক! মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই মনে হত এই শয়তানটা কেন মরে না? 

কিন্তু যখন স্পার্টাকাস ওকে মারলো না, যখন ও স্পার্টাকাসের বন্ধু হল, যখন ওরা একসঙ্গে বিদ্রোহের কথা বললো, করলো- তখন মন ভরে গেছিলো। মনে হয়েছিল এবারে কেউ স্পার্টাকাসকে হারাতেই পারবে না। ছাই তখন বুঝি শ্রেণী সংগ্রাম কি? সশস্ত্র বিপ্লবের কত কত পথ ও পন্থা? বামের কত মত? যত মত তত পথ না? খুনোখুনি হয়ে যায় বামের বামত্ব মাপতে? কিচ্ছু জানি না এসব। শুধু জানি মালিকেরা বড় ভয়ানক। নিগ্রো মানুষটার চেয়েও। তারা শয়তানের-ও শয়তান। তারা সব লুঠে নেয়। কেমন করে জানলাম? শান্তিগোপাল দেখে। সুকান্ত-র শোন রে মালিক, শোন রে মজুতদার পড়ে। 

সুকান্তর কবিতা, শান্তিগোপালের যাত্রা, সুরেশবাবুর পাপেট থিয়েটার-এর একটি মোরগের কাহিনী সব মিলে মিশে যেত সেই সব শীত সন্ধ্যার অন্তরে অন্তরে। মানুষ গর্জন করতো। মানুষের গর্জন যারা শোনেনি তারা জানে না কেমন ভীষণ সে গর্জন। সমুদ্র-ও শিশু তার কাছে। মহাসমুদ্রের নাদ সে। আমি আমার দুই থেকে বারো অব্দি মজে ছিলাম যাত্রায়। থিয়েটার অল্প স্বল্প এসেছে মফস্বলে। মাচা বেঁধে খুব বেশী দল করতো না ওখানে। ডিহি কলকেতার বাবু মহলের যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকের দলে পড়তাম আমরা। 

মফস্বলের-গ্রামের মানুষরা। আমরা সেই ফাত্রা লোক, যারা না খাটলে মাঠ থেকে ধান ওঠে না, যারা না খাটলে কল-কারখানা চলে না। বাবুদের ফুটুনি তিন মিনিটে উবে যায়। আমরা যারা অপমানিত হতাম বাবুদের হাতে, যারা বাবুদের ফাত্রা লোক তারা যাত্রাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম।

শান্তিগোপাল, পোষাকি নাম বীরেন্দ্রনারায়ণ পাল। বাবা প্রেসিডেন্সির ছাত্র, দাদা জজ। ও বাড়ির ছেলে যাত্রা করে না। তিনি করেছিলেন। প্রথমে পাড়ার নাটক, তারপরে গ্রুপ থিয়েটার উদয়াচল, তারপরে একদিন যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রা। বাগবাজারের মদনমোহনতলায় শুরু হত সিজন। সেখানে অমর ঘোষ পরিচালক হয়েছিলেন। 

শান্তিগোপাল, রস্ট্রাম ব্যবহার শুরু করলেন। মাইক্রোফোন এল। চিৎকার করেই যাতে শুধু শোনাতে না হয়। নেপথ্যে টেপরেকর্ডার থেকে শব্দ-প্রক্ষেপণ। এ সব এলো হিটলার-এ। শান্তিগোপাল বলতেন পার্টি ইত্যাদি নয় মানুষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বাকী সব নিয়ে সচেতন করছেন।

আসলে আমরা ভুলেই গিয়েছি নবান্ন, নবনাট্য বাংলার মাঠেঘাটে যত না ঘুরেছে তার চেয়ে বেশী ঘুরেছে যাত্রাপালা। ভক্তিরসের বন্যায় গিরিশেরা পেশাদারী রঙ্গমঞ্চ চুবোচ্ছেন, কারণ যাত্রাতেও ঐ চলছে। একা মুকুন্দদাস বাদ দিলে কেউ আর নীলদর্পণ-এর লড়াইতে ছিল না। যাত্রার দর্শক, গ্রাম-মফস্বলের মানুষই এসেছে সেকালের থিয়েটারে দর্শক হয়ে। একালের দর্শকভেদ আগেই বোধহয় হতে থেকেছে। শহুরে বাবুরা যাকে নাট্য বলবেন, বাকীদের তাকেই নাট্য বলতে হবে। তারপরেও জনগণের কাছাকাছি কিন্তু একমাত্র যাত্রা। জন-রাজনীতিরও কাছাকাছি।

শান্তিগোপাল বুঝেছিলেন। শুধু উৎপল দত্তের কথা আমরা বলি রাজনীতি প্রসঙ্গে। তাঁর কথা বলি না। শান্তিরাম, শান্তিরঞ্জন পেরিয়ে অবশেষে তিনি শান্তিগোপাল হয়েছেন। মম্মথ রায় গলার মালা খুলে দিয়েছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে রাতের পর রাত ইতিহাস পড়িয়েছেন শান্তিগোপাল। বাংলার এক অনন্য ইতিহাসের শিক্ষক। লোকে বলতো কমিউনিস্ট দালাল। গ্রামের কংগ্রেস গুন্ডা, জোতদার, দালালরা বলতো। লেনিন করে। রাশিয়া যায়। হিটলার করে। আবার আমি সুভাষ-ও করে। মাও সে তুং করে। ব্যাটা নকশাল। কত কি! 
শুনেছি মারার জন্য মুখিয়ে থাকতো তারা। শুনেছি কৃষকদের দল হাতে কাস্তে নিয়ে যাত্রা দেখতে আসতো। দেখেছি পাড়ার কংগ্রেসের ছোট নেতা তড়পে গেলে পালটা রুখে দাঁড়াতে রেলের কর্মী মজদুরদের। যারা ইউনিয়নের লোক। যারা লাল। বা অতিলাল। শান্তিগোপাল  আসবেন-ই। শান্তিগোপাল এসেছিলেন। আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। লোকশিক্ষা দিতেন। এবং একটা অনন্য শিক্ষা দিতেন। 
আজ ডিহি কলকেতার বাবুপাড়ার থেটারে এসে দেখি 'লোকে কি খাবে' তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলে। আমরা যারা গ্রামে-মফস্বলে শান্তিগোপালের একনিষ্ঠ দর্শক, বোকা এবং ফাত্রা লোক- তারা জানি কে কি খাবে ভেবে রান্না হবে না। এ থ্যাটার হোটেল না, কি স্বাস্থ্যকর, কি দরকারী, কি তারপরেও সুস্বাদু তাই রান্না করা দরকার। যদি রাঁধিয়ের দম থাকে তাহলে পাত পেড়ে খাবে পাড়া-বেপাড়ার লোক। না থাকলে উঠোন কেন ব্যাঁকা তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করতে হবে, নাচা হবে না। 
শান্তিগোপাল, আমাদের শিক্ষক হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন। চাষাভূষো, মজুর-টজুর বিধিবদ্ধ ফাত্রা লোককে শিক্ষণীয় যাত্রা দেখিয়েছেন হাজারে হাজারে বসিয়ে। হ্যাঁ, তারাও দেখে গিয়েছে। সেলাম করে গিয়েছে, আর গর্জনে উত্তাল হয়েছে। মহাসমুদ্রের মহানাদে। 

ঋত্বিক যখন 'আমার লেনিন' করছেন তখন 'লেনিন লেনিন লেনিন লেনিন/ নূতন আশা নূতন দিন' গানের যুদ্ধতৎপরতায় চরিত্র আর ক্যামেরা এগিয়ে যায় যাত্রার মঞ্চের দিকে। 'লেনিন, কথা বলছেন, বোঝাচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন এই গ্রাম্য রাজ্যের মাঝে'। নেপথ্যে ভয়েস ওভার বলছে। বলছে লেনিন বাংলার মঞ্চে গাইছেন ইন্টারন্যাশনাল। এই-ই সম্ভবত সেকালের রাজনৈতিক যাত্রার একমাত্র ফুটেজ। যিনি জানেন কোথায় তাকাতে হয় কোন রাজনীতি নিয়ে - তিনিই দেখেন, বাকীরা দেখি দেখি ভাণ করে মাত্র।

ঋত্বিক দেখেছেন। দেখিয়েছেন। আমরা ফাত্রা লোকেরা দেখেছি। রাজনীতি ঠান্ডা ঘরে বসে, গাড়ি চড়ে ঘুরে, ভোট মাপবার বস্তু নয় জেনেছি। বাবুরা পুলিশ-গুণ্ডা দিয়ে বুথস্তরের সংগঠন গড়ে ক্যাডার বেস্‌ড পার্টি হবার খোয়াব দেখেছে। দেখে এখনও। নির্বাচনে হারা জেতা নয়, আদপেই বাংলার মাঠে মাঠে পুলিশ-গুণ্ডা বাদ দিয়ে কত মানুষ হাতের লাঠি কিম্বা কাস্তে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, সেখানেই জোর, ভুলে গেছে তারা। 

এখনো, গ্রামে-মফস্বলে, শহরে বিদ্বেষের পারদ উর্ধগামী। ক'টা সিটে জেতার আনন্দে সেদিকে কারো নজর নেই। এখন নেই শান্তিগোপাল। রাতের পর রাত জেগে, নিঃস্ব হয়ে গিয়েও মাঠে মাঠে আদর্শের বীজ বোনার চেষ্টা নেই। খিল্লি আছে শহুরে আমোদগেঁড়ে মধ্যবিত্তের 'কে তুই শান্তিগোপাল' বলে। আর আছে রাজনৈতিক ভয়াবহ শূন্যতা যেখানে যা খুশীকেই রাজনীতি বলে চালিয়ে হাততালি নেবার পালা। ঘৃণ্যকে ঘৃণা না করতে পারার অক্ষমতাই চিনিয়ে দেয় কে কোন শ্রেণীর পক্ষে, কে কোন রাজনীতির পক্ষে। স্তাবকতা আর সাপলুডোর দিনকালে শান্তিগোপালকে তাই মনে পড়ে।

শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩

বিজয়া ~ ডাঃ বিষাণ বসু

শোনো, ছাতিমের ঘ্রাণ বিষাদ অতিক্রম করে মৃত্যু অবধি স্পর্শে সক্ষম, সে কথা তো তোমাকে আগেও বলেছি। নতুন বলতে, শিউলির বৃন্ত থেকে কমলা রঙ থেঁতলে - অশ্রু আর রক্তে ভিজিয়ে - গেরুয়া করে তোলা। যদিও সময় থাকতে তোমাদের আর বলে ওঠা হয়নি - এসবের পরেও - যে সাদা পাপড়িটুকু পড়ে আছে, মাঠে - বৃন্তচ্যুত যদিও - ওই দ্যাখো, ভেসে যাচ্ছে নদীর স্রোতে - সে তো মিছে কিছু নয়।

এই সবই ঠিক, শুধু এটুকু, আজও, রহস্য-ই রয়ে গেল, বিসর্জনের শেষে ফাঁকা মণ্ডপ, পরম অবিশ্বাসীর মনেও, কেন শূন্যতার আবাহন করে! মেঘলা আকাশ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। রহস্য ক্রমে আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। আকুল রহস্যের মধ্যে ঝরে পড়তে থাকে হিম। আর তো দুদিন মাত্র, তার পর চন্দননগরের আলো আস্তে আস্তে আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকবে। কার্তিক তো এসে পড়েছে হে।

তথাপি এ তো কিছু অজানা কথা নয়, যে, নতুন জামা, দুদিন পরেই পুরনো হয়ে যায়। এমনকি পুরনো হতে পারারও আগে, জামার তন্তুতে মিশে যেতে থাকে ঘামের গন্ধ। দর্পনে প্রতিফলিত প্রতিমা-মুখ, কেউ নাড়িয়ে দেওয়ার আগেই, ঝাপসা হয়ে যায়। বস্তুত, প্যান্ডেলের আয়োজন, সে যে নেহাতই চুক্তিভিত্তিক, একথা তো প্রথম খুঁটিটি পড়ার পূর্বেই জানা।

তবু পিছুটান এমনই, সবকিছু জানার পরেও, বিষণ্ণ চোখ শুধু দেখে, প্যান্ডেলের মেঝেতে পড়ে থাকা ইতস্তত সিঁদুর। বিষাদবিধুর।

দ্যাখো, ফুরিয়ে যায় না কিছুই। কেননা, ফুরোনোর পরেও কিছু গল্প শুরু হবে। শুরু হয়-ই। সমাপ্তি কীভাবে আসবে, সেটুকু জানা গেল না - কিন্ত ও নিয়ে আক্ষেপ অবান্তর। কিছু কিছু অজানা এমনই থাকুক না। কিছু অপ্রাপ্তি, কিছু ছাড়তে-না-পারা দীর্ঘশ্বাস। ঘন হয়ে থাকুকই না।

জানা বলতে, বিদায়ী ঢাকের শব্দের সঙ্গে মিলে যেতে থাকে 'চিরদিনই তুমি যে আমার'-এর প্রিল্যুড। গল্প না-ই বা জানলে, গানের কথা যদি জানতে চাও, আরেকটু সবুর করো। আলোগুলো ফুরিয়ে যাক, তারপর… শোনো…

এ জীবন ফুরিয়ে যেদিন
পাবো এক নতুন জীবন
সেদিনও হবে একাকার… 

না হে! ওসব নিতান্তই বাজে কথা। স্তোকবাক্য নিছক। তোমাকেই জানিয়ে রাখি, আসছে বছর আবার হবে, এই শব্দমালা, কোনও এক বছর থেকে, মিথ্যে হয়ে যায়। যাবেই। চিরতরে। 

আকাশে, বাতাসে, ধোঁয়ায়, মলিন হয়ে আসা আলোয় - কিংবা মাটির গভীরে - লীন হয়ে যাওয়ার আগে…

এই বেঁচে থাকাটা, উৎসবের মতোই, পরের বারের জন্য প্রতীক্ষা। একে কি মিথ্যে বলব, বলো? বলব, মায়া? একেই??

শুভ বিজয়া। ভালো থেকো।

পড়ে আসা বেলায় দাঁড়িয়েও বিশ্বাস করতে বড় লোভ হয় - আবার তাহলে…

© বিষাণ বসু

রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩

পুজোয় চাই নতুন শাড়ি ~ সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

কি কঠিন সব শাড়ির নাম হয়ে গ্যাছে আজকাল। বৌয়ের সাথে পুজোয় কেনাকাটা করতে গেছিলাম। একজন বলছে, আপনাকে একটা ফ্লোরাল জরি, জুট-কটন বালুচরি দেখাই! আর একজন বলছে, না, না!আপনি বরং প্রথমে একটা হাতে বোনা এথনিক-মোটিফ জুট সিল্ক দেখুন। শাড়ির নাম না ধামালের ভেনুগোপাল মুতথুস্বামী আইয়ারের পুরো নাম বলা শক্ত। শাড়ির দোকানে গেলে আমি কতগুলো বেসিক্স মাথায় রাখি। যদি দুটো শাড়ির রঙ একদম এক মনে হয়, তাহলে অবশ্যই তাদের রঙ পুরোপুরি আলাদা। প্রথম আধঘণ্টায় দেখানো কোন শাড়ি কখনো ভালো হয় না। এবং কোন শাড়ির কত দাম হতে পারে, পাড়ের নীচে স্টেপল করা কাগজে নিজে না দেখে বোঝা অসম্ভব। শাড়ি আর সৌরভ গাঙ্গুলী শেষ অবধি কত টাকায় বিক্রি হবে কেউ আগে থেকে জানতে পারে না।  

বউ, দুটো শাড়ি অনেকক্ষণ ধরে দেখছে, আমি জানি শেষ অবধি দুটোই নেওয়া হবে, কিন্তু সেটা এখন বললে মানবে না, আমি বলছিও না। দুটো একইরকম শাড়ি কেনার একটা প্রাথমিক শর্ত হল ডিসিশান-মেকিংটাকে প্রথম একঘণ্টা একটা ডিনায়ালের মধ্যে দিয়ে যেতে দিতে হবে। সে হোক, আমার তাড়া নেই, আমি ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখছি, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন জিরাফের গলা কি করে এতো লম্বা হলো দেখছি। হঠাত দেখি বৌ বলছে, এর মধ্যে কোনটা নেবো বলতো? এগুলো ট্রিক কোয়েশ্চেন, সত্যি করে উত্তর দিতে নেই। এরকম আমরা স্কুলে জিজ্ঞাসা করতাম, তুই কি এখনও আগের মত শেয়ালদা স্টেশানে পকেট মারিস? সে যাই হোক, এরকম প্রশ্নের উত্তর দেবার একটা টেম্পলেট আছে।দেখবেন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ডার্বির দিন হয়তো স্কুল গ্রুপে উদমা খিস্তিখাস্তা চলছে, হঠাত কোন এক শান্তিগোপাল লিখল, কিন্তু শেষ অবধি জিতে গেলো ফুটবল।

আমি বউকে বললাম, কোনটা নেবে সেটা বড়কথা না, দুটো শাড়িতেই কি সুন্দর হাতে বুনে কাজ করেছে। যেটাই নাও, শেষ অবধি জিতে যাবে শিল্পটা। বউ খুশি হয়েছে, বুটিকের মহিলা, যে কিনা রাত্তিরবেলাতেও অপর্ণা সেনের মত একটা বাদামী গগলস পরে বসে ছিলো, সে অবধি আমাকে গগলস খুলে মাপছে। সে মাপুক, আমি আবার মোবাইলে ফিরে গেছি। ফেসবুকে একজন ভদ্রমহিলা কবিতা লেখেন বলে ফলো করেছিলাম, দেখছি রিলসে কামার্ত দৃষ্টিতে ঠোঁট চিপে তাকিয়ে আছেন। নীচে বাপ্পা সমাদ্দার লিখেছে, দিদি খুব স্নিগ্ধ লাগছে। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথের সময় রিলস ছিলো না, নইলে আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি, রাশিয়ার চিঠিতে মস্কোর বারান্দা থেকে রবিবাবু নবাব গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া পরে পাউট করছেন আর রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, দাদা, খুব স্নিগ্ধ লাগছে।  

বুটিকের মহিলা বউকে বলছে, আপনাকে একটু সুদীপার কালেকশান দেখাই, আমি কলকাতা থেকে আনিয়েছি।এটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম, সাবধান হওয়ার দরকার আছে। কোন শাড়ি দেখানোর আগেই মনে হচ্ছে সুদীপার হাতে আমার একটা কাটা কিডনি দেখতে পাচ্ছি।  সুদীপা রান্নাঘরে বলছে, প্রথমেই আমরা সৌম্যর একটা কিডনি, ছাঁকা তেলে মুচমুচে করে ভেজে নেবো। অপর্ণা সেন বৌকে একটা সাদা ন্যাতার মত শাড়ি দেখাচ্ছে, এরকম শাড়ি পরে জেনেরালি জয়া এহসান বিধবা সেজে ঘোরে কৌশিক গাঙ্গুলীর সিনেমায়। বলছে, একদম সিম্পলের মধ্যে, নাম আঙুরলতা, দামও রিজনেবেল, সত্তর হাজারের রেঞ্জে এইগুলো। আমি মানসচক্ষে দেখতে পারছি, সুদীপা আমাকে বলছে, শুধু কিডনি না, পুরো শরীরটাই চাই সৌম্য, নইলে আঙুরলতা হবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি সুদীপার বাড়িতে একটা পুতুল সাজানো আছে, মুখটা একদম আমার মত দেখতে। বাড়িতে কেউ গেস্ট এলেই পুতুলটা ঠক করে নীচে পরে যায়। 

আমি উশখুশ করে বলছি, না না, এইগুলো থাক, অন্য কোন কালেকশান আছে নাকি! বুটিকের অপর্ণা সেন বলছেন, তাহলে একটু সব্যসাচী দেখাবো নাকি? আসলে সকলে দেখতে চায় না! সুদীপার মত সব্যসাচী চক্রবর্তী যে শাড়ির ব্যবসায় নেমেছেন এটা জানতাম না। চিরদিন বামপন্থী মানুষ, গণআন্দোলনে থেকেছেন। নিশ্চয়ই মাস-সেগমেন্ট টার্গেট করেছেন। আমাদের প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টে শেখানো হত, Sensodyne এর কাস্টমার আলাদা, আবার বাবুল টুথপেস্টের কাস্টমার আলাদা, একদম ডিফারেন্ট প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট, আলাদা ক্যাচমেন্ট এরিয়া। ভালোই করেছেন, ছেলে দুটো তেমন দাঁড়াতে পারে নি। মাস-সেগমেন্টের, মেহনতি মানুষের প্রোডাক্ট যে এই বুটিকে কেউ দেখতে চাইবে না, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে।

এতক্ষণে বেশ কনফিডেন্ট ফিল করছি, শাড়ীর রঙগুলো ও বেশ ফ্যানাভাত, দুধভাত টাইপের, খেটে খাওয়া মানুষের শাড়ির রঙ যাকে বলে আরকি। বৌকে বললাম, নাহ এবারে তাহলে একটা সব্যসাচী নাও বুঝলে। বউ খুব অবাক, বলছে, এই না না, এইসবের একদম দরকার নেই, এইগুলো কেউ কেনে নাকি, পাগল হয়েছো! শাড়ির দাম দেখার জন্য, পাড়ের নীচটা উল্টে স্টেপল করা কাগজটা দেখলাম। দেখলাম শুধু আমি না, আমার পুরো গুষ্টি, আমার পুরো পাড়া হাতে কিডনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
 
শাড়ি আর সৌরভ গাঙ্গুলী! শেষ অবধি কত টাকায় বিক্রি হবে কেউ আগে থেকে জানতে পারে না মাইরি।

মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৩

ইজরায়েল ~ অভিষেক রয়

একটা ছোট্ট ভূখণ্ড নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। সভ্যতার উষাকাল থেকে যে কাটাকাটি চলছে তার কোনো স্থায়ী সমাধান মনে হয়না সম্ভব। জায়গাটাকে রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি করে মানুষের বদলে জন্তুদের থাকতে দিলে হয়ত এর পরিত্রাণ হতে পারে।

তা মুল ঝামেলা কি নিয়ে? জেরুজালেম (হ্যাঁ শেষের তিনটি অক্ষরই তিনটি গোষ্ঠীর মৌলবাদের পরিচয়), যে ৫৩ বার আক্রান্ত হয়েছে, ৪৪ বার দখলকৃত হয়েছে ২ বার ধ্বংস হয়েছে! 

প্রায় এক হাজার খৃষ্টপূর্ব সময়ে রাজা ডেভিডের সময়ে এটা ইসরায়েল এর রাজধানী ছিল, পরে রাজা সুলেমন এর সময়ে প্রথম মন্দির (যেখানে মসজিদ আল আকসা) তৈরি হয়। এখনকার ইহুদীরা ৯২৫ খৃষ্টপূর্ব সনেই মিশরীয় ফারাও দের দ্বারা বিতাড়িত হয়। এরপর খৃষ্টপূর্ব ৫৮৭ তে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য  ও খৃষ্টপূর্ব ১৩৯ এ রোমান সাম্রাজ্যের সময় টেম্পল অফ সুলেমান ভেঙে ফেলা ও বিরাট সংখ্যক ইহুদী বিতাড়ন নথিবদ্ধ আছে।

গোটা ইউরোপ ও মধ্যএশিয়া জুড়ে যে ইহুদী বিদ্বেষ তারাও কিন্তু অন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাবই পোষণ করে এসেছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট জুড়ে ফিলিস্তিনি দের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও গণহত্যার কথা নথিবদ্ধ: প্রমিসড ল্যান্ডের বাইরের শহর গুলোর সাথে যুদ্ধে ও প্রমিসড ল্যান্ডের ভেতরে যুদ্ধ (Deut 20:10-15) এবং (Deut 20:16-18) জেসুয়া ও মুসা উভয়েই গণহত্যা চালিয়েছেন। যীশুর ক্রুসিফিকেশন এও ইহুদী চক্রান্তর গল্প আছে।

এরপরে এলো খ্রিস্টানরা। নিউ টেস্টামেন্ট জুড়ে অ্যান্টি সেমিটিজম "Cleansing of the Temple" (11:15-19) ও "Parable of the Vineyard" (12:1-12). আবার যীশুর মৃত্যুর পর আমরা পাই বাইবেলের ভার্স:
"তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও যে তোমরা তাদেরই বংশধর যারা নবীদের হত্যা করেছে... হে সাপ, সাপের বংশ! জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচবে কিভাবে ?"
- Matthew (23:31-33)
Gospel of John এও ইহুদীদের তুলনা করা হয়েছে অন্ধকার ও শয়তানের সাথে।
এছাড়াও Book of Revelation: (2:9)
"যারা বলে তারা ইহুদী, তারা শয়তানের উপাসনালয়"
লক্ষ্যনীয়, এই ঘৃণার সময়কালে ফিলিস্তিনিরা খ্রিস্টান ছিল, ও ইহুদীদের জেরুজালেমে কোনো প্রবেশাধিকার ছিলনা। লুকিয়ে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়লে মৃত্যু।

সপ্তম শতকে মুসলিম উত্থান হলে দেখা গেল কোরআন ইহুদীদের প্রতি তাৎপর্যপূর্ন বিদ্বেষ পোষণ করে। তারা ঈশ্বরের অবাধ্য (2:93), নিজস্ব চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে (2:100), তারা নিজস্ব তোরাহ অনুসরণ করতে ব্যার্থ (5:66) ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত (2:88, 4:51-52) থেকে সূরা আল বাকারা যেখানে সরাসরি খুন ও বিতাড়নের আয়াত।

মোহাম্মদ নিজে বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর উপর যে গণহত্যা ও অত্যাচার চালিয়েছেন তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। এমনকি মৃত্যু শয্যাতেও ওনার শেষ ইচ্ছে ছিল আরবভূমি হতে ইহুদী বিতাড়ন!
আজ যে হামাস এর অতর্কিত হামলা, যুদ্ধবন্দী নারী ও শিশুদের তুলে নিয়ে যাওয়া তাও কোরআন সমর্থিত বর্বরতা।

আব্রাহামিক ধর্মমানুষদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ততক্ষণ শেষ হবেনা যতক্ষন না তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থগুলি ত্যাগ না করে। ইসলামের নামে ভারত ভাগ করে পাকিস্থান তৈরি যতটা ভুল ততটাই ভুল জয়নিজম এর নামে ইসরায়েল তৈরি। ২০০০ বছর আগে পূর্বপুরুষ ছিল বলেই করো অধিকার জন্মায়না যে  নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে অন্যদেশে এসে সেখানকার মানুষকে উৎখাত করে বসা। কাল এন আর আই শ্যামলবাবু আপনার বাড়ি এসে যদি বলেন "৫০ প্রজন্ম আগে আমার পূর্বপুরুষ এই জমিতে থাকতেন, ওই তো পশ্চিমের ভাঙ্গা পাঁচিলটা এখনও আছে, ওখানেই ওরা ইয়ে করতেন, আপনি নিজের বাড়ি থেকে চলে যান" তাহলে আপনি ছেড়ে দিতেন ?
কিন্তু ৭৫ বছর ধরে এটাই চলে আসছে, এর মূল কারণ ইহুদী ধর্মগরন্থ: তোরাহ, যেখানে লেখা আছে হেকেল (বর্তমানে মসজিদ আল আকসা) এর কাছাকাছি থাকা ইহুদীদের জন্য সবচেয়ে পুণ্যের। তাই জেরুজালেম এর এই অংশের প্রপার্টির দাম সবথেকে বেশি। মৌলবাদী ইহুদীরা লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে   এখানে থাকে। Third Temple গড়ে তোলার জন্য, কল্পিত মাসিহার আগমনের জন্য ইহুদী জনবসতি ইলাস্টিকের মত বাড়ানো হচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাংক জুড়ে।

আবার ঠিক তেমনভাবেই দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে হবে, ভোররাতে ঘুমন্ত জনপদে ৭৫০০ রকেট হামলা করে, নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে নারী শিশুদের গনিমতের মাল বানিয়ে ধর্মীয় স্লোগান দেওয়া শুধুই সন্ত্রাসবাদ কোনো স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়। বরং ফিলিস্তিনদের স্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার মুল কালপ্রিট হল হামাস ও হিজবুল্লাহ।

এটাই সংগঠিত ধর্মের সমস্যা। শেষের সেদিন ত্বরান্বিত করার জন্য এরা নিজ নিজ গ্রন্থ অনুযায়ী বদমাইশি করতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ গুলোতে প্রতি গুড ফ্রাইডে নিয়মিত টাকা তোলা হয় ও স্টেট অফ ইসরায়েল এর জন্য প্রার্থনা হয় যাতে ইহুদীরা যীশুকে ঈশ্বরপূত্র বলে মেনে নেয় (John XXIII)
সেই যীশু, যিনি বলেছিলেন তিনি ফিরবেন পরেরবার যোদ্ধার মত, শাসকের মত শাস্তি দিতে (অবশ্য মানুষকে দেখলে সত্যি মাথা ঠিক রাখা কঠিন, ৫০০ টাকায় যারা ভোট বিক্রি করে তাদের দেখলে আমারই আগাপাশতলা চাবকাতে ইচ্ছে করে)।

যাইহোক যা বলছিলাম, ভবিষ্যত সম্পর্কে সব ধর্মীয় মৌলবাদের প্রায় একই রকম একটা ধারণা আছে। ঈশ্বরপ্রেরিত দূত আসবেন; ইহুদীদের মসিহা, খৃষ্টানদের খ্রিস্ট ও অ্যান্টি খ্রিস্ট, মুসলিমদের দজ্জাল ও তাকে দমন করতে ইমাম মেহেদী ও যীশু, হিন্দুদের কল্কি অবতার। এলেই একটা বিভৎস মারামারি শুরু হয়ে যাবে। লাশ জমবে পাহাড়ের মত, রক্ত বইবে নদীর মত। তারপর ঠিক আপনার বাপ পিতামোর ধম্মটাই নাকি জিতে যাবে! সেই জিত উপভোগ করার জন্য আপনার বংশের কেউ বেঁচে নাও থাকতে পারে হয়ত সেই জয় ভোগ করবে রাস্তায় আপনার মেয়েকে যে টিজ করেছিল সে বা আপনার জমির ভেতরে যে আল দিয়েছে সে! 

তাই এই ভয়ঙ্কর ফ্যান্টাসি থেকে বেরিয়ে আসুন, মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখুন, শিশুকে ভালোবাসুন শুধু শিশু বলে, পৃথিবীকে কেয়ামতের দিনের মাঠ না ভেবে আজকের পৃথিবীকে বাঁচতে দিন, গাছ লাগান। ধর্মনিরপেক্ষতা ও কল্যাণকামী বিজ্ঞাননস্কতাই একমাত্র শুভপথ।

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০২৩

রামগ্রামের আদি স্তূপ ~ স্বাতী ভট্টাচার্য্য

রামগ্রামের নাম কখনও শুনিনি, তাই সেখানে যে একটা বৌদ্ধ স্তূপ আছে, এবং বিশ্বের সব স্তূপের মধ্যে তা বিশিষ্ট, তা জানার কোনও স্কোপ ছিল না। বেড়াতে গিয়ে যা শুনলাম, তাতে রীতিমতো একটা ওটিটি সিরিয়াল হয়ে যায়। যাকে বলে, পিরিয়ড পিস। মহাপরিনির্বাণ সূত্রে গল্পের মূলটা রয়েছে।
ব্যাপার হল, গৌতম বুদ্ধ তো কুশীনগরে দেহ রাখলেন। বছরটা খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩,  সেখানে তখন মল্ল বংশের এক রাজার রাজত্ব। তিনি বুদ্ধের ভস্মাধার এবং অন্যান্য যা কিছু স্মরণিকা, সেই সব কিছু একটি বৃহৎ জন-প্রকোষ্ঠে ('কাউন্সিল হল') কঠোর পাহারার মধ্যে রাখলেন। সেখানে ফুল, ধূপ, গান ইত্যাদি সহকারে শ্রদ্ধা নিবেদন চলতে থাকল। কিন্তু আশেপাশের রাজারা এক যোগে বুদ্ধের সেই সব স্মারকের ভাগ দাবি করলেন। তাদের মধ্যে  কপিলাবস্তুর শাক্য রাজা, পভার মল্ল রাজা, বেথদীপের ব্রাহ্মণ রাজা, বৈশালীর লিচ্ছবি, মগধের মৌর্য, পিপলিবনের মৌর্য এবং রামগ্রামের কোলিয়া (বা কল্য) রাজারা।  গোড়ায় কুশীনগরের মল্ল রাজা বেঁকে বসেছিলেন, কিন্তু অন্য রাজারা বুঝিয়ে দিলেন, দরকার হলে তাঁরা যুদ্ধ করবেন। শেষে কুশীনগরের এক ব্রাহ্মণ, তার নাম দ্রোণ বা দোন রাজাকে বোঝালেন, যে বুদ্ধ সারা জীবন করুণা আর অহিংসার বাণী প্রচার করলেন, তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে রক্তারক্তি কি ভাল দেখায়? শেষমেষ সেই সব স্মারক আট ভাগ হল (অথবা দশ ভাগ, নানা মত পাচ্ছি)।

কোলিয়া রাজা বুদ্ধের স্মারক পেয়ে মহাসমারোহে শোভাযাত্রা করে তাঁর রাজধানী রামগ্রামে এনে রাখলেন, এবং তার উপর মহাস্তূপ রচনা করলেন। এই কোলিয়া রাজারা ছিলেন গৌতম বুদ্ধের মাতুলকুল — এঁদেরই কন্যা মায়াদেবী এবং প্রজাপতি গোতমী (দুই বোনকেই বিয়ে করেছিলেন শুদ্ধোধন, বুদ্ধের জন্মের পরে মায়াদেবী মারা যান, গোতমী তাঁকে মায়ের মতোই বড় করেন, তাঁর নিজের দুই ছেলেমেয়েও ছিল)। বুদ্ধের স্ত্রী যশোধরাও কোলিয়া বংশের মেয়ে।
সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর স্থির করলেন, তাঁর গোটা রাজ্যে চুরাশি হাজার স্তূপ তৈরি হবে। তাই তিনি আদি স্তূপগুলি খুলে, তার ভিতরে রক্ষিত স্মারকগুলির অধিকাংশই বার করে নেন। কেবল রামগ্রামের স্তূপটি তিনি খুলতে পারেননি। কেন, তা নিয়ে যথারীতি কাহিনি তৈরি হয়েছে। যেমন, অশোক সেখানে এসে দেখেন, এক মহানাগ সেই স্তূপ রক্ষা করছে। অথবা, হাতির দল সেখানে শুঁড়ে করে জল দিচ্ছে, ফুল দিচ্ছে। এমন কোনও অলৌকিক দৃশ্য দেখে অশোক নিরস্ত হয়েছিলেন। কিংবা হয়তো বুদ্ধের মামাবাড়ির লোকেরা অশোকের 'মামাবাড়ির আবদার' পাত্তা দিতে চাননি, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কী হয়েছিল, কে বলতে পারে। শরদিন্দু থাকলে এ নিয়ে একটা আস্ত উপন্যাস লিখতে পারতেন। সেখানে হয়তো রামগ্রামের কোনও দৃপ্ত ভিক্ষুণী দিগ্বিজয়ী সম্রাটকে নতমস্তকে প্রণিপাত করে বিদায় গ্রহণ করতে বাধ্য করতেন।
সে যা-ই হোক, হিস্টরিক্যাল ফ্যাক্ট (কিংবা কনসেনসাস অন ফ্যাক্ট) হল এই যে, রামগ্রামই বিশ্বের একমাত্র আদি স্তূপ, যা আড়াই হাজার বছর ধরে অক্ষত রয়েছে।
তা বলে কি কালের ছায়া পড়েনি তার উপরেও? কয়েকশো বছর লোকে ভুলে গিয়েছিল, কী এই জায়গা, কী এর মাহাত্ম্য। স্থানীয় চাষিরা এই ভূখণ্ডকে বলতেন দুর্ভাগা জমি, কারণ এখানে ফসল লাগালে তা বড় হয় না। হবে কী করে, স্তূপকে ঘিরে মাটির তলায় ঘন ইটের গাঁথনিতে তৈরি সঙ্ঘারাম রয়েছে, তা কি আর তখন জানা গিয়েছিল? ১৮৯৯ সালে এক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্তিক ডব্লিই হোয়ি (W Hoey) এটিকে আবিষ্কার করেন। 

লুম্বিনী থেকে চুয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে রামগ্রামের এই স্তূপ রয়েছে মাটির তলায়, সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে ঢাকা তার উপরিভাগ। তবে সত্যি বলতে কী, কারুকার্যময়, সোনালী চূড়ায় শোভিত , বিচিত্র স্থাপত্যে সাজানো স্তূপ তো নেপালে বা ভারতে কম নেই। তার চাইতে এই সবুজ ঘাসে ঢাকা, এক বৃহৎ অশ্বত্থের ছায়ায় শীতল, অতি শান্ত পরিবেশে শুয়ে থাকা স্তূপটি যেন অনেক বেশি স্পর্শ করে মনকে। এমন কোমল কিন্তু অবিচল স্থানে এসেই তো রাজশক্তি লজ্জা পায়, হেরে গিয়ে ফিরে যায়।

কপিলাবস্তু ~ স্বাতী ভট্টাচর্য্য

কপিলাবস্তু। ক'জনই বা গেছে, অথচ, কে না গেছে? প্রাচীন সে শহর মনের চোখে চিরজীবন্ত। এক প্রৌঢ় পিতার তৈরি এমন রমণীয় এক নগরী, যাতে তার তরুণ পুত্র সংসারের প্রতি বীতরাগ না হয়, পিতার সিংহাসনেকে উপেক্ষা করে চলে না যায়। তা-ও সেই পুত্র, মাত্র ২৯ বছর বয়সে, সুন্দরী স্ত্রী আর শিশুপুত্রকে ছেড়ে, স্নেহময়ী বিমাতা প্রজাপতি গোতমীকে ছেড়ে, কপিলাবস্তুর পূর্ব দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নির্বাণ লাভের পরে পিতার আহ্বানে ফিরেছিলেন বটে, তবে কপিলাবস্তু নগরীতে প্রবেশ করেননি। নগরী থেকে ছ'কিলোমিটার দূরে,  বটগাছের বনের ছায়ায় থাকতেন। সেই জায়গার নাম নিগ্রোধারাম। সেখানে সঙ্ঘও তৈরি হয়, সম্ভবত বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই। তার সাক্ষ্য মেলে ধ্বংসাবশেষে।  এখানেই নাকি গোতমী বুদ্ধের থেকে সন্ন্যাস প্রার্থনা করেছিলেন, বুদ্ধের ছেলে রাহুল এখানেই দীক্ষিত হয়েছিলেন সন্ন্যাসে।

যে কোনও তীর্থস্থান তার  মাহাত্ম্য খুঁজে পায় বহু প্রজন্ম-লালিত কাহিনিতে, সেগুলোকে 'আরও সত্য' বলা চলে। পাশাপাশি চলে আর এক বয়ান — ইতিহাসের, প্রত্নতত্ত্বের। ভারত আর নেপাল মিলিয়ে অন্তত তিনটি স্থান ছিল কপিলাবস্তু হওয়ার দাবিদার। শেষ অবধি লুম্বিনীর অনতিদূরে তিলৌরকোটে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন  নগরীর যে নিদর্শন মিলেছে, তাকেই ঐতিহাসিকরা কপিলাবস্তু বলে মোটামুটি স্বীকার করে নিয়েছেন। তা হয়তো আমাদের কল্পিত রাজধানী ছিল না, ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। শুদ্ধোধনও মস্ত রাজা ছিলেন না, ছিলেন রাজপুরুষদের প্রধান। কপিলাবস্তুর চাইতে অনেক বড়, অনেক বিলাসবহুল, সুরম্য নগর তখন ভারতে ছিল। হয়তো তরুণ সিদ্ধার্থ সে সব দেখেওছেন। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কপিলাবস্তুতেই যে তিনি কাটিয়েছেন, সে বিষয়ে সংশয় নেই।

১৮৯৯ সালে তিলৌরকোটের প্রত্নতাত্ত্বিক  আবিষ্কারকে প্রাচীন কপিলাবস্তু বলে চিহ্নিত করার কৃতিত্ব এক বাঙালির, তাঁর নাম পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সলজ্জে স্বীকার করি, কপিলাবস্তুতে দাঁড়িয়ে সে দেশের সরকারি দফতরের বোর্ডে তাঁর নাম ( পি সি মুখার্জি) দেখে তাঁর কথা প্রথম জানলাম। আমাদের ইতিহাসের সিলেবাস রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়েই ক্ষান্ত দিয়েছিল, আর নিজের পড়াশোনার দৌড় তথৈবচ। নেট সন্ধান করছে দেখছি, বহু সাহেব হর্তাকর্তার ঈর্ষা-বিষ সয়ে পূর্ণচন্দ্রকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হয়েছিল।

আমাদের সঙ্গের গাইডটি নিজেকে 'গভর্নমেন্ট রেজিস্টার্ড' বলে দাবি করলেন, এবং আগাগোড়া কল্পকাহিনী শুনিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আবছা হয়ে-আসা সরকারি বোর্ডগুলো ছিল। গাইড বললেন, এই পশ্চিমের দরজা দিয়ে শুদ্ধোধন ঢুকতেন কপিলাবস্তুতে, এটাই ছিল নগরের প্রধান রাজপথ। বোর্ড বলল, এই এলাকায় সম্ভবত সব চাইতে গরিবরা থাকত, কারণ এখানকার বাড়িগুলো সব ভাঙা ইটে তৈরি, বেঁটে বেঁটে দেওয়াল। অতঃপর 'এখানেই মায়া দেবী চান করতেন' 'এটাই রাজার শোয়ার ঘর ছিল' ইত্যাদি ব্যাখান চলল। বোর্ড বলল, এ সবই কুশান আর মৌর্য আমলের, বুদ্ধের সময়ের শহর সম্ভবত মাটির অনেক তলায়। তবে এলাকা যে প্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, খ্রিস্টের জন্মের আটশো বছর আগেকার সাক্ষ্যও মিলেছে। বুদ্ধের জন্যই এ নগরীকে সবাই চিনলেও, এর নাম তাঁর চাইতেও অন্তত একশো বছর আগেকার এক ঋষির নামে, তিনি কপিল, সাংখ্য দর্শন যাঁর দান। কপিলের বাস্তু, সেই থেকে কপিলাবস্তু। শাক্যদের মধ্যে সাংখ্যের গভীর প্রভাব ছিল, এবং অনেকে মনে করেন যে বুদ্ধের চিন্তাতেও নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের প্রভাব রয়েছে।

সর্বত্র যেমন হয়, এখানেও তাই — এক ধর্মস্থান কালক্রমে দখল করেছে অন্য ধর্ম, তৈরি করেছে নিজের বিকল্প কাহিনি। নিগ্রোধারামের নাম এখন কুদান — 'কুদা' অর্থাৎ লাফানো থেকে। শিব নাকি এখানে লাফ দিয়ে দিয়ে নৃত্য করেছিলেন। এই অঞ্চলে দেখা যায়, প্রায় সব বৌদ্ধস্তূপের কাছাকাছি একটা না একটা শিবলিঙ্গ মিলেছে। এই ইতিহাসের বয়সও ফেলনা নয়, ১৮৯৯ সালে পূর্ণচন্দ্র কপিলাবস্তুর প্রাচীর ঘেরা এলাকার মধ্যে এক দেবী মন্দির দেখেছিলেন, যেখানে মনস্কামনা পূর্ণ করতে হাতি গড়ে রেখে দিয়ে যায় লোকে। এখনও সেখানে নানা রঙের, নানা মাপের হাতি দেখে এলাম।  মন্দিরটি নিত্য ব্যবহৃত।  কপিলাবস্তুতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পরিব্রাজকরা বিশেষ তিথিতে পুজো করেন, তার ছবি দেখলাম। তবে লুম্বিনীতে মায়া দেবীর মন্দিরে যেমন নিত্য আরাধনা, কপিলাবস্তুতে তেমন ব্যবস্থা আছে বলে মনে হল না।

কপিলাবস্তু বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই তছনছ হয়ে যায় কোশল রাজাদের আক্রমণে। সম্ভবত রোহিনী নদীর জল নিয়ে বিবাদ বেধেছিল। অশোক লুম্বিনীতে এসে কপিলাবস্তুতেও এসেছিলেন। চিনা তীর্থযাত্রীরা এখানে ঘুরে গিয়েছেন এবং বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তাদের বিবরণের সূত্রেই ফের কপিলাবস্তুকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এক বাঙালি সন্তান।

দুপুরের ঠাঠা রোদে কপিলাবস্তুর সামনে দাঁড়িয়ে কী দেখা যায়? মস্ত এক জমি, সবুজ ঘাসে ঢাকা, নানা জায়গায় আয়তক্ষেত্রের মতো পুরনো ইঁটের গাঁথনি। বুদ্ধের বিচরণক্ষেত্র যদি বা এটাই হয়ে থাকে, তা রয়েছে মাটির নীচে। তাতে কী? ঠিক এখানেই যদি বা না হয়, যদি হয় একটু এ পাশ বা ও পাশে, যদি বা সম্পূর্ণ অন্য রকম হয় ভূগর্ভে প্রোথিত নগরীটির নকশা, তাতে কী আসে যায়? তরুণ সিদ্ধার্থ এই আকাশের নীচেই বিচরণ করেছেন, অকল্পনীয় কষ্টসাধ্য সাধনার পরে ফিরেছেন জ্ঞানপ্রাপ্ত মহামানব হয়ে, করুণাঘন রূপে, বানগঙ্গার তীরে এই জায়গাটি সেই অলৌকিক জীবনের একটি লৌকিক চিহ্ন তো বটে। সেই অচিন্তনীয়কে একটু আপন করে নেওয়ার উপায় — দুপুর রোদে চোখ-মুখ কুঁচকে, গাইডের বকর বকর অগ্রাহ্য করে, সবুজ ঘাস আর ছাতা-পড়া ইটের সারির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করা — এই কপিলাবস্তু। এই কপিলাবস্তু।

মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সেটিংয়ের 'পিপিপি' মডেল ~ সুদীপ্ত বসু

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রও নেটে সার্চ দিয়ে যে তথ্য খুঁজে পেতে পারে তাই এখন ইডির কাছে রকেট সায়েন্সের মত দুর্বোধ্য!!
চিত্রনাট্য এতটাই দূর্বল যে ইডি এক বিশেষ দুই ব্যক্তিকে তদন্তে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এটা না বুঝতে পারাটা ই এখন ' অপরাধ '!

' সেটিং ' এখন আর রাজনৈতিক দলের অভিযোগের পর্যায়ে নেই।
সেটিং ' চেহারা কেমন তা এখন আদালতের এজলাসে খোদ ইডি প্রমাণ করছে।

কেমন করে? আচ্ছা উদাহরণ দেওয়া যাক.

আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের নিউ আলিপুর শাখা, এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের হরিশ মুখার্জি রোডের শাখা, স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্কের চৌরঙ্গী শাখা, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পার্লামেন্ট শাখা এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের হরিশ মুখার্জি রোড শাখা।

এই পাঁচটি অ্যাকাউন্ট অভিষেক ব্যানার্জির। এর মধ্যে শেষ অ্যাকাউন্টটি অভিষেক ব্যানার্জি নির্বাচনী অ্যাকাউন্ট হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন ২০১৯ সালের ভোটে।

প্রকাশ্যেই সেই তালিকা রয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে অভিষেক ব্যানার্জি ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তাতেই রয়েছে সেই তথ্য। 
অথচ ইডি নাকি খুঁজে পায়নি!!!

শুধু তাই নয়, অভিষেক ব্যানার্জির সম্পত্তি বলতে ইডি'র জমা দেওয়া রিপোর্টে উল্লেখ আছে কেবল মাত্র তিনটে জীবন বিমার পলিসি! 
সেই তথ্যও অসম্পূর্ণ। অন্তত অভিষেক ব্যানার্জির নির্বাচনী হলফনামা জানাচ্ছে, তাঁর নামে রয়েছে লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির অব ইন্ডিয়ার চারটি পলিসি!

তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে 'সেটিংয়ের' যে অভিযোগ উঠছে রাজনৈতিক মহলে, তাকেই যেন বৈধতা দিচ্ছে ইডি'র এমন দায়সারা রিপোর্ট। 

১৮৮ এ, হরিশ মূখার্জি রোডের বিলাসবহুল 'শান্তিনিকেতন' ভবন। সারা বছর এখানে রাস্তার একাংশ বন্ধ থাকে, ফুটপাতেও চলাচল নিষিদ্ধ। স্থায়ীভাবে রয়েছে পুলিশের কিয়ক্সও। চব্বিশ ঘন্টা সেখানে প্রহরা। 
 লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসের দুই প্রাক্তন ডিরেক্টর ( অভিষেক ও রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি) ও বর্তমান সিইও অভিষেক ব্যানার্জি থাকেন এই বাড়িতে। অথচ ডিরেক্টরদের সম্পত্তির তালিকাতেই উল্লেখ নেই এই প্রাসাদোপম বাড়িটির!

আরো আছে, তালিকা লম্বা। লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস কিসের সংস্থা, ব্যবসা টা কিসের, আয় করে কিভাবে সেটুকুও নাকি তদন্ত করে জানতে পারেনি ইডি!!

কিন্তু ইডি নিজেদের অপদার্থতা এভাবে নিজেই আদালতে প্রকাশ করছে কেন?? 
হিস মাস্টারস ভয়েস! তদন্ত রিপোর্টে তারই প্রতিফলন!

সারদা কাণ্ডের তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০১৪ সালে শুরু হয়। সাড়ে নয় বছর পেরিয়ে গেছে।
তদন্তের এই  দীর্ঘসূত্রিতায় লাভ কার?? চোরদের ই লাভ। তদন্তকারী সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকলে তখন অভিযুক্তদের অভিযোগই বৈধতা পায়!!!!
চুরি, দুর্নীতি ছাপিয়ে তখন স্বাভাবিকভাবে তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকাই মানুষের চোখের সামনে ধরা দেয়!!

ইডি সিবিআই এবং বিজেপি আসলে এরাজ্যে শাসক তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাদের প্রতিহিংসার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে, অভিযুক্তের ইমেজকেই রিবিল্ডিং করতে সাহায্য করছে!!!!

পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে এমনভাবে বৈধতা আর কেউ দিতে পারেনি!!!

শুধু এটুকুর জন্যই ২০-২২ টা আসন অনায়াসে উপহার দেওয়া যায়!!

৫ অক্টোবর সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান নিছক তাই একটা কর্মসূচি নয়, দুই শাসকের সেটিংয়ের পিপিপি মডেলের বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট কনফ্রন্টেশন!!

ইডি সিবিআইয়ের অফিস ঘেরাও করে সারদা থেকে নারদা, কয়লা গোরু থেকে নিয়োগ দুর্নীতির কিংপিনদের গ্রেপ্তারির দাবি তোলা আসলে এরাজ্যের বুকে তৃণমূল বিজেপির বাইনারি ভাঙারই স্লোগান।

সিবিআই - ইডি ' এখন সিআইডি' র 
থেকেও বেশি স্বস্তি দিচ্ছে শাসক দলকে!

তাই আপনি সিজিও কমপ্লেক্স অবরুদ্ধ করুন, অটোমেটিক ঘাম ঝরবে নবান্নের! 

রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

Syzygy (ফেলুদা ফ্যান ফিকশন) ~ মালবিকা রায়

Syzygy ফেলুদা ফ্যান ফিকশন
পর্ব ১ঃ প্রথম দেখা
—————————————————
কেদারে সিংঘনিয়ার সঙ্গে দেখা করে ধর্মশালায় ফেরার পথে ফেলুদাকে কোন অজ্ঞাত আততায়ী কাঁধে বাড়ি মেরে পালাল।ওকে আমি আর লালমেহনবাবু মিলে ধরে তুলতেই দেখলাম কাঁধে বেশ জখম। একজন ডাক্তার লাগবে শীগ্গীর। ধর্মশালায় ফিরতে মাখনবাবু বললেন পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে ডঃ ব্যানার্জির বাড়ি। শুনেই আমরা ফেলুদাকে নিয়ে রওনা দিলাম। ও অবশ্য গাঁইগুঁই করছিল কিন্তু জটায়ু যখন বললেন "যাবেন, নাকি কাঁধের ব্যথায় ভুগে কালকের ক্লাইম্যাক্সটা মিস করবেন ফেলুবাবু?" তখন রাজী হল।
ছোট্ট পাহাড়ী জায়গায় রাত নটা মানে অনেক। দুটো গলি পেরিয়ে নির্দেশমত একটা দোতলা বাড়ির একতলার দরজায় নক করতেই কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন বছর ছাব্বিশের এক ভদ্রমহিলা, মনে হল ঘুমোতে যাচ্ছিলেন, পাজামার ওপর চাদর জড়ানো।
"কিছু মনে করবেন না, বাধ্য হয়ে এত রাতে বিরক্ত করতে এলাম। আপনার বাবাকে একটু ডেকে দেবেন?"
"আমার বাবা! তিনি তো কলকাতায়!"
ভদ্রমহিলা অবাক।
"তবে কি আপনার স্বামী? মানে ডাঃ ব্যানার্জিকে খুঁজছি…আসলে এই ভদ্রলোকের একটু চোট লেগেছে… দেখাতে হবে।" লালমোহনবাবু বলেন।
" আসুন ভেতরে।" ভদ্রমহিলা দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।
ভেতরে গিয়ে দেখি বেশ বড় একটা ঘর। বেশ গোছানো। জানলার পাশে একটা ডেস্ক আর চেয়ার। তারপাশে একটা বড় বুকশেল্ফ। দূরের দেওয়ালে একটা খাট।আর কোন লোক দেখা গেল না। ভেতরের দিকের একটা দরজা দিয়ে ডাইনিং টেবলের অংশ বিশেষ আর চেয়ার দেখা যাচ্ছে।
"বসুন আপনি এই চেয়ারে..কোটটা খুলে রাখুন ঐ হ্যাঙ্গারে।"ফেলুদাকে বলেন উনি।
"আর আপনারা ঐ মোড়াদুটো টেনে নিন" আমি আসছি। বলে ভেতরের দরজা দিয়ে চলে গেলেন। বোধহয় ওঁর স্বামী ডাঃ ব্যানার্জিকে ডাকতে।
মিনিট খানেক পরে ফিরে এলেন একাই।চাদরটা খুলে এসেছেন। হাতদুটো সদ্য ধোওয়া।জামার হাতাদুটো কনুই অব্দি গোটানো।
"আপনি শার্টটা খুলুন। ইনজুরিটা দেখতে হবে.." ভদ্রমহিলা গম্ভীরভাবে নির্দেশ দেন ফেলুদাকে।
আমি ততক্ষণে আন্দাজ করেছি ব্যাপারটা..
"কিন্তু আপনার স্বামী মানে ডাঃ ব্যানার্জি…" জটায়ু এখনো বোঝেননি মনে হচ্ছে।
"স্বামী টামী নেই। আমিই ডাঃ মণিকঙ্কণা ব্যানার্জি। চলবে তো তাতে?"
জটায়ু বেকুবের মত ঘাড় নাড়েন।
ভদ্রমহিলা এত গম্ভীর কেন!
আমি ফেলুদাকে সাহায্য করতে গেলাম…ও ডান হাত প্রায় ব্যবহার করতে পারছে না। মুখের চেহারাও দেখার মত। উঠে আসতেও পারছে না কিন্তু থাকার যে বিশেষ ইচ্ছে আছে তাও মনে হচ্ছে না।
শার্ট খোলা হয়ে গেছে। ডাঃ ব্যানার্জি দেখে নিলেন একবার আঘাতটা। মুখটা আর গম্ভীর করা সম্ভব নয় ওঁর। তাও একটা চেষ্টা হল মনে হল। কানে স্টেথোটা গুঁজে বললেন
"গেঞ্জিটা খুলুন এবার।"
কাঁধের যে জায়গায় চোট তার মধ্যিখান দিয়ে স্যান্ডো গেঞ্জির হাতাটা গেছে। না খুললে যে চিকিৎসা সম্ভব নয় সেটা বুঝতে ডাক্তার হতে হয় না।
ফেলুদার ভ্রূকুটিও ম্যাক্সিমাম হয়ে গেছে। কিন্তু ওর ক্ষুরধার বুদ্ধিতে ওখান থেকে উঠে আসার কোন উপায় বের করার আগেই আমি আর লালমোহনবাবু মিলে ওর গেঞ্জিটা মাথার ওপর দিয়ে সাবধানে তুলে নিলাম।
ভদ্রমহিলা মনে হল ডাক্তার হিসেবে ভালই। চোটের জায়গাটা আর পিঠে, কাঁধে তার আশপাশটা ভাল করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। ফেলুদা পুরো সময়টা দেওয়ালে একটা গ্ল্যাক্সোর ক্যালেন্ডার আর তার ওপর বসা টিকটিকির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
"দেখুন, ফ্র্যাকচার কিনা বুঝতে তো এক্স রে করতে হবে। সে তো এখন হবে না। ইন দ্যাট কেস, দ্য বেস্ট আই ক্যান ডু ইজ…আপনি আসুন মিঃ..
"মিত্র। প্রদোষ মিত্র। কোথায় যাব"?
"ঐ খাটে গিয়ে শুয়ে পডুন। অন ইওর টামি। আমি দেখব শোল্ডার ব্লেডে কোনো অবভিয়াস ফ্র্যাকচার আছে কিনা…"
"কিন্তু ওটা তো পেশেন্ট বেড নয়…" ফেলুদার গলায় ভীষণ অনিচ্ছা।
"না নয়। দ্যাটস মাই ওন বেড। আ্যন্ড এই যে চেয়ারটায় আপনি বসে আছেন সেটাও পেশেন্টদের নয়। আমার পড়ার চেয়ার। এই ঘরটাও ডিসপেন্সারী নয়, আমি এখানে থাকি। এমার্জেন্সী সিচুয়েশনে বোধহয় আগে কখনো পড়েননি না? খুব সিকিওরড, প্ল্যানড জীবনে অভ্যস্ত নাকি? কি করেন আপনি, সরকারী চাকরী?"
বাপরে। ডাঃ ব্যানার্জি তো ভালই বকুনি দিতে পারেন!
ফেলুদা আর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। জিনসের ওপর ব্যায়ামপুষ্ট খোলা গা আর উস্কোখুস্কো চুলে বেশ একটা র্যাম্বো সুলভ ভাব এসেছে। কাঁধের কাটাটা একটা এক্সট্রা রাফনেস যোগ করেছে।
গটগট করে গিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ল খাটটায়। ডাঃ ব্যানার্জি কাঁধ, পিঠ টিপেটুপে, স্টেথো লাগিয়ে, হাত কতটা উঠছে এসব দেখে মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছেন।
"আমি শিওর ভাঙেনি। তবে চাইলে পরে এক্স রে করে নিতে পারেন। আমি প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি আ্যন্টি ইনফ্লামেশন আর পেইনকিলারের । আজকের রাতের মত আমার থেকে নিয়ে নিন। কাল কিনে নেবেন।"
চেয়ারে বসে লিখতে লিখতে বলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
ফেলুদা খাটেই বসে। কারণ ঘরে আর কোনো বসার জায়গা নেই।
"আপনি এখানে এসে বসুন মিঃ মিত্র। উঠে দাঁড়িয়ে বলেন উনি। একটা ব্যান্ডেজ করে দিই আর একটা মেকশিফট স্লিং.."
"না, ব্যান্ডেজ করুন। তবে নো স্লিং"।
"কেন বলুন তো?"
"কারণ স্লিং সমেত রিভলভার চালানো সম্ভব নয়, যেটা আমার কয়েকঘন্টা পরেই হয়তো লাগবে।"
এবার ডাঃ ব্যানার্জি সত্যি গম্ভীর।
"বিকজ অফ দ্যাট হিপোক্র্যাটিক ওথ আমি সব ধরণের লোকের চিকিৎসা করতে বাধ্য। কিন্তু ইউ আর পুশিং ইট ট্যু ফার। স্মাগলিং বা গ্যাং ওয়ার যাই আপনার প্রফেশন হোক না কেন, আ্যজ এ ডক্টর আই উড রেকমেন্ড…"
"এই যে বললেন আমি সিকিওর সরকারী চাকরী করি.." র্যাম্বো এবার চান্স পেয়েছে।
"আমি কি করে জানব বলুন! রিভলবার টিভলবার.."
"আপনার শেলফে তো ভর্তি ক্রাইম থ্রিলার। গুন্ডা বদমাইশ ছাড়া সেগুলোতে কারো রিভলভার থাকে না?"
"পুলিশ নাকি আপনি? তাহলে কিন্তু রিভলভার আর সরকারী চাকরী দুটোই হল",
ব্যান্ডেজের জোগাড় করতে করতে এতক্ষণে ফিক করে হাসলেন উনি। বেশ দেখায় কিন্তু হাসলে। কেন যে গম্ভীর থাকেন এত জানিনা।
"আপনি কেমন পুলিশ? লেস্ট্রেডের মত না বচ্চনের ইনস্পেক্টর বিজয়ের মত?" ব্যান্ডেজটা বাঁধতে বাঁধতে বলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
"আরে ম্যাডাম, লেস্ট্রেড অব্দি গেলেন আর আসল লোককে ভুলে গেলেন?" জটায়ু এখন কথা খুঁজে পেয়েছেন।

"দোহাই আপনার, ম্যাডাম বলবেন না। নাম ধরে ডাকুন, ডাক্তারবাবু বলুন, বহেনজী বলুন…যা খুশী। কেবল ঐ ট্যাঁশ ফিরিঙ্গি সম্বোধনটা করবেন না।"
ফেলুদার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।ও ও পারতপক্ষে স্যর শুনতে চায় না।
"তা আসল লোক মানে…শার্লক হোমস? ডিটেক্টিভ?" ব্যান্ডেজ শেষ করতে করতে বলেন ডঃ ব্যানার্জি।
"আমার ধারণা ছিল ওটা শুধু গল্পে হয়…আপনি শার্টটা পরে ফেলতে পারেন মিঃ মিত্র।"
"গল্পেই বেশী হয়। যেমন এঁর গল্প। তবে আমি বাস্তবের.." চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে ফেলুদা।
"উনি কি গোয়েন্দা গল্প লেখেন?"
"হ্যাঁ। ওঁর বই দেখলাম তো আপনার শেলফে। সাহারায় শিহরণ!" শার্টটা পরতে পরতে বলে ফেলুদা।
"মাই গড! আপনি লালমোহন গাঙ্গুলী? দারুণ টানটান লেখেন আপনি, ধরলে ছাড়া যায় না…"
লালমোহনবাবুর মুখে একগাল হাসি।
"তবে…কয়েকটা ফ্যাকচুয়াল এরর আছে। যেমন ধরুন উটের পাকস্থলীতে জল জমিয়ে রাখার ব্যাপারটা। ওটা ঠিক নয়। হয় কি জানেন, ওদের ঐ কুঁজের ফ্যাটটা অক্সিডাইজ হয়ে.."
লালমোহনবাবু চুপসে গেছেন, কিন্তু ওঁর হাসি ফেলুদার ঠোঁটের একপাশে সংক্রামিত হয়েছে।
—————————————————-
পর্ব ২ঃ শব্দ-জব্দ
—————————————————
পরদিন ভোরের মধ্যেই কেদারের ক্লাইম্যাক্স ভালয় ভালয় মিটে গেছে। দেবীশংকর পুরী ওরফে মিঃ ভার্গব ধরা পড়েছেন। লালমোহনবাবু ছোটকাকাকে খুঁজে পেয়েছেন। সেই সঙ্গে বহুমূল্য বালগোপাল লাভ হয়েছে। কিন্তু এত ভাল ভাল ঘটনার মধ্যে একটা বাজে ব্যাপার হল যে ফেলুদার কাঁধের চোট থেকে আবার রক্ত পড়ছে। ওরই দোষ। কয়েকঘন্টার মধ্যে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে এইরকম ছোটাছুটি করলে আর কি হবে!
"তাহলে চল আবার ডাঃ ব্যানার্জির ওখানে, এটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো।" আমি বললাম।
"আর কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না?"
ফেলুদা বলে ওঠে।
"এই ছোট পাহাড়ী জায়গায় আবার কটা ডাক্তার পাব ফেলুবাবু? উনি দেখছিলেন এটা। ডাক্তার তো উনি খারাপ বলে মনে হল না…"
"খারাপ ডাক্তার তা আমি বলি নি। তবে…"
ও কি নিজেও জানে প্রবলেমটা কি!
"তবে ওটা ওঁর থাকার বাড়ি, ডাক্তারখানা নয়। সেখানে এরকম বারবার গিয়ে হানা দিলে…"
এতক্ষণে একটা অজুহাত পেয়েছে।
"আরে কতক্ষণ আর লাগবে, সেরকম হলে আমরা বাইরে দাঁড়াই, আপনি দেখিয়ে আসুন.."জটায়ু বলেন।
"না না, তার দরকার নেই। আপনারা আসুন সঙ্গে".. চটপট বলে দেয় ফেলুদা।
"কি হল, কিছু প্রবলেম?" আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন ডাঃ ব্যানার্জি।
"হ্যাঁ, মানে ব্যান্ডেজটা থেকে ব্লীডিং হচ্ছে.."
"সেকি? কথা নয় তো। আসুন ভেতরে।"
আজ এই সকালবেলা বিছানা টিছানা সব পরিপাটি করে তোলা। টেবলে একটা স্ক্র্যাবলের বোর্ড পাতা…অর্ধেক খেলা হয়েছে।
ফেলুদা বসল চেয়ারে।
"আসলে আপনার দোষ না, আমিই একটু বেশী স্ট্রেন করে ফেলেছি" শার্ট খুলতে খুলতে বলে ও।
"সে তো দেখতেই পাচ্ছি…সাতসকালে মারামারি করতে গেছিলেন? ডাক্তারের কথা টথা শোনার দরকার নেই…ওঃ স্যরি, মাই হ্যান্ডস আর কোল্ড।"
শেষ কথাটার কারণ হল ওঁর হাত ফেলুদার গায়ে পড়তেই ও শিউড়ে উঠেছে।
"আসলে এইমাত্র চান করে এলাম তো!"
"দ্যাটস ওকে!" গম্ভীর গলায় বলল ফেলুদা।
আবার সেই ক্ষতস্থান পরীক্ষা, ড্রেসিং, ব্যান্ডেজ..! তবে আজ আর টিকটিকি না দেখে ফেলুদা স্ক্র্যাবলের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল।
একবার নিজের মুখটা যখন ফেলুদার প্রায় কানের কাছে এনে উনি ক্ষতটা পরীক্ষা করছিলেন, মনে হল ওর মুখের রংটা একটু বদলে গেল…তবে সেটা আমার চোখের ভুলও হতে পারে।
"ওকে। ইটস ডান নাও। জল না লাগানোর চেষ্টা করবেন দুদিন।আপনার স্ত্রীকে বলবেন যেন স্পঞ্জ বাথ দিয়ে দেন"।
"স্ত্রী-টী নেই ।তবে আমি জল লাগাব না। থ্যাঙ্ক ইউ।" শার্ট পরতে পরতে বলে ফেলুদা।
"বেশ পোক্ত করেই ড্রেসিং করে দিয়েছি। তবে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ ধরতে যাবেন না ক'দিন, তাহলেই হল।" বলে দেন ডাঃ ব্যানার্জি ।
"আর সিলি মিড অফে?" ফেলুদার ঠোঁটে মৃদু হাসি। ও কলেজে ক্রিকেট খেলত, তাই মেটাফোরগুলো বেশ উপভোগ করছে বুঝতে পারলাম।
"ডোন্ট বী সিলি! আই ক্যান ওনলি আ্যলাউ ফিল্ডিং আ্যট দ্য মিড উইকেট!"
ভদ্রমহিলা বেশ উইটি।
"কিছু যদি মনে না করেন , আপনি কি একা একা স্ক্র্যাবল খেলছিলেন?" ফেলুদার গলাটা এখন রিল্যাক্সড।
"হ্যাঁ । এখানে আর দোকা কোথায় পাব বলুন! তাই একাই খেলি।"
"আরে আমাদের ফেলুবাবুও তো তাই, কেউ না থাকলে একা একা স্ক্র্যাবল বা দাবা…" লালমোহনবাবু বলে ওঠেন।
"ফেলুবাবু!"
"আরে ওঁর ডাক নাম তো ঐ। ভাল নাম.."
"মিত্র! ফেলু মিত্তির! ইয়েস আই হ্যাভ হার্ড আ্যবাউট ইউ। সেই বোম্বাই এর ঘটনাটা কাগজে বেরিয়েছিল তো!
গুড ওয়ার্ক। তারপর আপনার গার্লফ্রেন্ড ফিল্ম আ্যকট্রেস রূপার ইন্টারভিউ।"
"আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। ওটা নেহাতই ফিল্মি গসিপ। দুদিন বেরিয়েছিল এখন খবরের অভাবে চাপা পড়েছে বহুদিন। আপনি এই পান্ডববর্জিত জায়গায় না থাকলে জানতে পারতেন। আমাদের জীবন ভীষণরকম নারীবিবর্জিত।"
"ইউ সীম ট্যু বী প্রাউড অফ দ্যাট! হোয়াটস রং উইথ আস?"
"আমি বলিনি আমি প্রাউড। আই মেয়ারলি স্টেটেড দ্য ফ্যাক্ট।দেয়ার ইজ নাথিং রং উইথ এনি জেন্ডার। আপনি যেভাবে আমাকে চিকিৎসা করেছেন তারপরে তো ওকথা মুখে আনাও পাপ।"
"খালি একটা প্রশ্ন, এই যে এই ওয়ার্ডটা…syzyg-ওটা কি…?" ফেলুদা স্ক্র্যাবল বোর্ড দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।
"ঐ ব্ল্যাঙ্কটা y. শব্দটা Syzygy"
"আ্যকচুয়েল ডিকশনারীতে আছে নাকি..?"
"তার মানে? নিজেই নিজেকে চীট করে খেলছি নাকি? সর্বভূতে ক্রিমিনাল দেখেন কি আপনি?"
"আহা, ভুল হতে পারে তো!"
"স্ক্র্যাবলে ভুল হয় না আমার মিঃ মিত্তির। মেডিক্যালে আমি অবিসংবাদী চ্যাম্পিয়ান ছিলাম।"
"ডাক্তারদের কলেজ তো! তারা আর শব্দের মাস্টার কবে থেকে? ওষুধের নাম হলে নয় হত…"
"আর আপনার আ্যলমা ম্যাটারটা.."?
"ঐ আপনার পাশেই!"
"ঠিক জানি! প্রেসি ছাড়া এরকম বিশ্ব স্নব আর কে হবে! এক হাত খেলে দেখুন না ডাক্তাররা ওয়ার্ড গেম পারে কিনা।"
"আমার ক্রিমিনাল ধরা পড়ে গেছে। এখানে ছুটি কাটাতেই এসেছিলাম। এক হাত খেলতেই পারি। কিন্তু আপনার কি কাজ নেই? আজ তো সোমবার।"
"আমি শনি রবি কাজ করি কেদারে।এনজিওর হয়ে।সোম মঙ্গল আমার ছুটি। আজ বিকেলে চলে যাব রুদ্রপ্রয়াগ। সপ্তাহের বাকী ক'দিন ওখানে থেকে কাজ করি।
"ঠিক আছে। আমরাও বিকেলে নেমে যাব রুদ্রপ্রয়াগে।ওখানে আর দুটো দিন কাটিয়ে কলকাতায়। সুতরাং আমরা একসঙ্গেও যেতে পারি।তবে আপনাকে বলা আমার কর্তব্য যে আমি কিন্তু কখনো স্ক্র্যাবলে হারিনি। কলেজে না, বাড়িতে না, বন্ধুদের সঙ্গে না। কাজেই.. "
"চ্যালেঞ্জ আ্যকসেপ্টেড মিঃ মিত্র। ওদিকে চলুন, এখানে তো জায়গা নেই। ডাইনিং টেবলে বসতে হবে।
কিন্তু লালমোহনবাবু আর…তোমার নাম কি ভাই?"
"তপেশ। তপেশ রঞ্জন মিত্র।"
"তা ওরা কি করবেন?"
"যদি কিছু মনে না করেন তো আমি একটু ঐ চৌমাথার দিকে যাব। দারুণ আলুর পরটা করছিল কাল দেখেছি।" জটায়ু বললেন।
"আর আমি আশপাশটা ঘুরে দেখে ছবি তুলব আমার নতুন ক্যামেরায়। চলুন লালমোহনবাবু।"
আলু পরটা খেয়ে, ছবি তুলে, বাজারে ঘুরে, আমি একটা হিমাচলী টুপি কিনলাম আর লালমোহনবাবু একটা পাথরের শিব কিনলেন।
"এটাও তো আপনার আর একটা ব্লান্ট ইনস্ট্রুমেন্ট হয়ে গেল লালমোহনবাবু।" পাথরের তৈরী ওজনদার জিনিসটা দেখে আমি না বলে পারলাম না।
"এটা একটা ওয়ার্ক অফ আর্ট তপেশ, আর রিলিজিয়াস ইমপর্টেন্সটাতো জানই।"
আমার অবিশ্যি ওটা দারুণ কিছু ওয়ার্ক অফ আর্ট মনে হচ্ছিল না, তবে আর ঘাঁটালাম না। বললাম,
"এগারটা বেজে গেছে , চলুন লালমোহনবাবু, ফেলুদাকে নিয়ে আসি।"
"চল। কে জিতবে বলে মনে হয় তোমার তপেশ ভাই?"
"কি করে জানব বলুন। ফেলুদা ভাল, তবে…"
"তবে টবে কিছু নেই। ভারী জাঁহাবাজ মেয়ে ঐ ডাঃ ব্যানার্জি। না জিতলেই ভাল।"
"তা বলছেন কেন? চিকিৎসা করলেন ফেলুদার। আপনার বই পড়েন.."
"হ্যাঁ আর রাজ্যের ভুল ধরেন! ফেলুবাবুকে শুদ্ধ বকুনি! জিতবে না, দেখ তুমি!"
গিয়ে দেখলাম ফেলুদার সামনে একটা শেষ হওয়া প্লেট।
"ক্যারামেল পুডিং খাওয়ালেন ডাঃ ব্যানার্জি।" ফেলুদা সাফাই দেয়।
"তা কে জিতল?" জটায়ুর প্রশ্ন।
"আমি। একবার না দু দুবার।" ডাঃ ব্যানার্জির মুখে এখন ঝকঝকে হাসি। বলেছিলাম তো পাঙ্গা না নিতে।"
"কি না নিতে?"জটায়ুর জিজ্ঞাসা।
"পাঙ্গা, পাঙ্গা! হিন্দি কি কিছুই বোঝেন না নাকি আপনি?"
"এই নিন। ক্যারামেল পুডিং। আপনাদের জন্য।আপনারা তো হেরোর দলে। তাই অন্ততঃ এটুকু করা আমার কর্তব্য।"
জটায়ু গম্ভীর মুখে প্লেটটা টেনে নিলেন।কিন্তু মুখে প্রথম চামচটা দিয়েই ওঁর মুখের চেহারা বদলে গেল। অসম্ভব ভাল খেতে।
"বাই দ্য ওয়ে, এটাতে কিন্তু আপনার সই চাই।"সাহারায় শিহরণ বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।জটায়ুর মুখে এবার অনাবিল হাসি।


———-—————————————-
পর্ব ৩ঃ ভানু গোয়েন্দা জহর আ্যসিসট্যান্ট
—————————————————

রুদ্রপ্রয়াগে আমরা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বাদামভাজা খাচ্ছিলাম। ডাঃ ব্যানার্জিও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমার সঙ্গে এখন দারুণ ভাব হয়ে গেছে…মণিদি আর তুমিতে নেমে এসেছি। কারণ ওঁর কাছে ‘ডার্কসাইড অফ দ্য মুন’ ক্যাসেটটা দেখেই আমি ধার চাইলাম আমার ওয়াকম্যানের জন্য। দেখা গেল উনিও পিঙ্ক ফ্লয়েডের ভক্ত। লেখাপড়া নিয়েও অনেক কথা হল।

“কোন সাব্জেক্ট ফেভারিট তোমার, তপেশ?”
“ফিজিক্স। ম্যাথও ভাল”।
“তাহলে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজি খারাপ লাগে, তাই  তো?” হেসে জিজ্ঞেস করে মণিদি।
“হ্যাঁ। ঐ মানে…তুমি জানলে কি করে ?”
“এরকমই হয়।ইলেভেনে পড়ে আমার মামাতো বোন পুকাই, তারও তাই… হাসলে যে?”
“না, আসলে ঐ…পুকাই নামটা…”
“আর তোমার দাদা যে তোমাকে তোপসে বলেন সে বেলা? পুকাই-এরও ভাল নাম আছে, রূপমঞ্জরী ।”

“বাবা! আপনাদের বাড়ির মেয়েদের নামের তো খুব ঘটা! আপনারা কি জুতোর নাম দেন অবিমৃষ্যকারিতা, ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব আর বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ”? জটায়ু বলে উঠলেন।
“আর আপনার কি মেসোর নাম তকাই, শ্বশুরের নাম বিস্কুট”? মণিদিরও সুকুমার রায় ঠোঁটস্থ।
“শ্বশুর তো নেই, ডাঃ ব্যানার্জি। আমি, ফেলুবাবু সবাই ব্যাচেলর। তপেশের বয়স কম, এখনো সময় আছে তাই ওকে ওদলে ফেললুম না।”
“তা আপনাদের দুজনের কি সময় গেছে নাকি?”
“আমার সময় কোনদিনই ছিল না। ফেলুবাবুর কথা উনিই জানেন। কি মশাই?”

ফেলুদা অবশ্য জটায়ুর প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। তার বদলে একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল,

“আমার শরীরটা ঠিক জ্যুৎ নেই বলে হারলাম।” 
বেচারা! উপুর্যপরি দুবার স্ক্র্যাবলে হারের কথাটা ভুলতে পারছে না।

“জীবনে শুনিনি লোকে কাঁধে ব্যথা বলে স্ক্র্যাবলে হারে। তাও দু বার।” মণিদি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল।
“ওষুধগুলোর এফেক্ট আছে তো!”
“কি নেপ্রক্সেন আর প্যারাসিটামল? এতে আপনার ব্রেন ফাংশন গুলিয়ে গেল! মেডিসিনে নবদিগন্ত খুলে যাবে এই আবিষ্কারে।”
“ভোরে উঠে ছুটতেও হয়েছিল ক্রিমিনালের পেছনে। যদি কাল একবার চান্স পেতাম তো…”

ঠিক শুনছি কি! ফেলুদা আবার একবার ওঁর ওখানে যেতে চায়। তাও কোনো ডাক্তারী কারণে না, স্ক্র্যাবল খেলতে! আঁতে লেগেছে মনে হয়।

“বেশ বারবার তিনবার হয়ে যাক। আপনার বুদ্ধির তো খুব প্রশংসা চারিদিকে। তৃতীয়বার হারলে মুচলেকা লিখে দেবেন। আমি বাঁধিয়ে রাখব।”
“আগে তো হারি!”
“ওহো! কিন্তু কাল যে…মণিদির কিছু মনে পড়েছে।
“কি ভয় পেয়ে গেলেন? পরাজয় স্বীকার করে নিতে
পারেন। ওয়াক ওভার দিয়ে ।”
“হ্যাঁঃ। মণিকঙ্কণা ব্যানার্জি ভয় পায় এমন শর্মা এখনো জম্মায়নি, বুঝলেন মিত্তির মশাই! কাল দুপুরে আমি একবার পাহাড়ে চড়তে যাব ভাবছিলাম তাই…”
“ও, তাই ঘরের কোনে ঐ মাউন্টেনিয়ারিং বুটগুলো দেখছিলাম। আমারি তো লোভ হচ্ছে মশাই আপনার সঙ্গে ঝুলে পড়ার।”
“একেবারেই না। কাঁধের এই অবস্থায় পাহাড়ে চড়তে আমি আপনাকে আ্যলাউ করতে পারি না ডাক্তার হিসেবে। শেষে যদি আমার ওপর পড়েন তো আমিই ছবি হয়ে যাব।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ একদম ঠিক। পাহাড়ে আর চড়তে হবে না। যথেষ্ট চড়েছি গত ক’দিনে।” জটায়ু বলে দেন।
“ক’টায় বেরোবেন কাল?” ফেলুদার প্রশ্ন
“এই দশটা নাগাদ। “
“যদি আমি আটটায় যাই তাহলে একদান খেলা যাবে তো?”
 
ওরে বাবা। এতো উৎসাহ! হেরে গিয়ে খুব মানে লেগেছে বোধহয়।

পরদিন দশটা নাগাদ ডাঃ ব্যানার্জির বাড়ি গিয়ে দেখলাম উনি হাসিমুখে বেরোচ্ছেন পাহাড়ে চড়ার জন্য রেডি হয়ে। মুখ দেখলেই বোঝা যায় উনি জিতেছেন।
যেটুকু সন্দেহ ছিল সেটুকুও উনি মাথার ওপর দুহাত তুলে নাচের ভঙ্গিমা করায় ঘুচে গেল।

“সে কি আবার হেরে গেলেন ফেলুবাবু?” 
জটায়ুও বুঝেছেন।
“হি হি! আমি তো আগেই বলেছিলাম! আজ তো আর ক্যারামেল পুডিং নেই, তবে দুঃখ করবেন না, এই নিন ম্যাঙ্গো ড্রপস লজেন্স।”
একগাল হেসে লজেন্স সমেত হাতটা বাড়িয়ে দেন ডাঃ ব্যানার্জি।

যাকে দেওয়া হল সে যে হেরে বিশেষ দুঃখিত তা মনে হল না অবিশ্যি। কিন্তু একটা লজেন্স মুখে দিয়েই ফেলুদার মুখটা অদ্ভুত হয়ে গেল।

“কি, পছন্দ নয় ফ্লেভারটা?” মণিদি জিজ্ঞেস করল।
“কি রকম একটা…ঠিক আপনার শ্যাম্পুর মত গন্ধ।”

ডাঃ ব্যানার্জি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। 
আমি আর লালমোহনবাবু চুপ।

“না মানে আপনার বিছা-আ-নায়…আই মীন বা-বালিশে ..মা-মানে সেদিন কেদারে চেকআপের সময়…আমার ঘ্রাণশক্তি আসলে বেশ …”
কোনোদিন ফেলুদাকে এত তোতলাতে দেখিনি তো!
“হ্যাঁ, আমি ক্লোরানে ম্যাঙ্গো শ্যাম্পু ব্যবহার করি। আপনার নাক তো দারুণ…আমার বাচ্চাটার মত প্রায়।” মণিদি আবার সহজ।

“আপনি যে বললেন আপনি ব্যাচেলর। তাহলে বাচ্চা?” লালমোহনবাবু বলে উঠলেন।

“কে বলেছে মশাই বিয়ে করতেই হবে বাচ্চা পেতে গেলে? একটা মেয়ে যদি চায় তাহলে সে মা হতেই পারে। দ্যাটস হার প্রেরোগেটিভ। থিংকিং আদারওয়াইজ ইজ রিগ্রেসিভ। আপনি নীনা গুপ্তা আর ভিভ রিচার্ডসের কথা শোনেননি?” এক নিঃশ্বাসে বলে যান উনি।

“আপনার তো মশাই ভিভ রিচার্ডসও নেই, বাচ্চাও নেই…শুধু শুধু কেন তর্কগুলো করছেন”?
ফেলুদা বলে উঠল।
“কি করে জানলেন নেই”?
“দেখলেই বোঝা যায় কার কতদূর দৌড়। ভিভ রিচার্ডস! বাচ্চা বলতে কি পালিত কুকুর নাকি বেড়াল? কুকুরই হবে। নাক ভাল যখন।”
“হ্যাঁ কুকুর। হল তো! কি মহান ডিটেক্টিভ! সরুন এখন আমার ট্রেকিং এর দেরী হয়ে যাবে।”
“ফিরছেন কখন?”
“এই চারটে নাগাদ..”
“তো আজ রাতে ডিনারটা আমাদের সাথে করলে অসুবিধে আছে?”
“না, অসুবিধা আবার কিসের! সন্ধেবেলা এসে হোটেল থেকে ডেকে নেব আপনাদের।” বলে রওনা দিল মণিদি।

ফেলুদা তো দেখছি ওঁর সঙ্গে সময় কাটানোর কোন সুযোগই ছাড়তে রাজী নয়!
               
“তা ফেলুবাবু, ডাঃ ব্যানার্জির সঙ্গে আপনার বেশ ভাব হয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি।”
 জটায়ু বলে উঠলেন মণিদি বিদায় নেবার পর। ওঁরও নিশ্চয় একই কথা মনে হয়েছে।
“ভাব বলতে যদি মীন করেন বন্ধুত্ব তবে নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু যদি অন্যকিছু দ্ব্যর্থবোধক ইঙ্গিত করেন তো ডেফিনিটলি না। শী ইজ গুড কম্পানি, দ্যাটস অল।”
                   ——————
সারাদিন আশপাশের জায়গাগুলো বেড়িয়ে এসে বিকেলে আমরা হোটেলের লবিতে বসে গল্প করছিলাম। মণিদির একক্ষণ এসে পড়ার কথা। 
“ভুলে যাননি তো আবার উনি”, সবে বলেছেন জটায়ু এমন সময় ঝড়ের মত এসে হাজির হল মণিদি…

“মিঃ মিত্র আমার বাচ্চাটাকে না কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!”
“তা ওরা স্বাধীন জীব তো, গেছে কোথাও…”
“কি করে যাবে বেশীদূর? ওর একটা ঠ্যাং ভাঙা তো! কাছাকাছিই থাকে। আমি খেতে না দিলে মরেই যেত ! রোজ বিকেলে ব্রীজের কাছেই বসে থাকে, আমি পাঁউরুটি দিই তো! যখন কেদারে থাকি পাশের চায়ের দোকানদার ওকে খেতে দেয়। পয়সা দিয়ে বলা আছে ওকে।কাল রাত অব্দি ছিল। এখন গায়েব।”

“তা আপনি কি আমাকে আ্যপয়েন্ট করতে চাইছেন? কুকুর খুঁজতে?” 
ফেলুদার মুখ গম্ভীর কিন্তু চোখ হাসছে!
“না না সে কি! আপনি এত বিখ্যাত গোয়েন্দা…আপনি কেন করবেন এসব…কিন্তু কি যে করি …খুঁজলাম চতুর্দিক!” ডাঃ ব্যানার্জির মুখটা করুণ।
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আপনি চান যে আমি তদন্তটা করি কিন্তু সোজাসুজি বলতে লজ্জা পাচ্ছেন!”
“ওসব লজ্জা টজ্জা আমার আসে না মিঃ মিত্তির। কিন্তু ভয় হয় আপনার ভক্তবৃন্দ তেড়ে আসবেন ফেলু মিত্তিরকে দিয়ে কুকুর খোঁজালে।”
“হুম! তবে লজ্জা নয়, ভয়! কিন্তু শোনেননি, ঘৃণা, লজ্জা, ভয়…তিন থাকতে নয়?”
“হ্যাঁ কিন্তু আপনার ভক্তরা…”
“তা ভক্তরা আমায় ভালবাসে কিনা, ওরা তো ওরকম ভাবতেই পারে। না বললেই তো হল ওদের। হোয়াট হ্যাপেনস ইন রুদ্রপ্রয়াগ, স্টেস ইন রুদ্রপ্রয়াগ!
চলুন তবে, একটু তদন্ত করে আসি।”

“না না, সত্যি, আপনি কেন এ রকম তুচ্ছ ব্যাপারে…”
“আপনার কাছে তুচ্ছ কি ব্যাপারটা?”
“তা নয় তবে..”
“তবে টবে আর কিছু নেই। তাছাড়া সেদিন চিকিৎসার পরে ফিজটাও নেননি। তারওপর ক্যারামেল পুডিং। ফলে কৃতজ্ঞতার ভারটাও একটু নামানো দরকার। আপনি একটু বসুন এখানে,আমরা ঘরে গিয়ে গরম জামা পরে আসি তারপর চলুন দেখাবেন কোথায় বাসস্থান ছিল আপনার সারমেয়টির।”
—————————————————
পর্ব ৪ঃ হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়
—————————————————

“কি মশাই? শেষে কুকুর হারানোর কেস? তা আবার তিন ঠেঙে রাস্তার কুকুর! আপনার একটা ইজ্জৎ নেই? ভানু গোয়েন্দা জহর আ্যসিসট্যান্টেও তো ওরা গরু চুরির কেস নিল না। আর আপনি এই দুদিন আগে এখানেই এতবড় একটা কেস সমাধা করে কিনা…”

ঘরে যেতেই বললেন জটায়ু। ভীষণ অফেন্ডেড হয়েছেন।
আমারও মনে হচ্ছিল একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কি যে হয়েছে ফেলুদার কে জানে!

“কেন লালমোহনবাবু? পাখি চুরির কেস নিই নি আমি? সাধু সাবধান!” ফেলুদার যুক্তি অকাট্য।
“আহা সে তো পরে অন্য রকম দাঁড়াল…”
“এখানে তেমন হবে না আপনি জানেন?”
“না তা নয়, তবে ভাবলুম…মানে আপনি ঐ ডাঃ ব্যানার্জির জন্য একেবারে…মানে স্ক্র্যাবলে হারলেন ইচ্ছে করে, তারপর এই কুকুরের কেস…”
“কে বলল আমি ইচ্ছে করে হেরেছি? খেলেছেন কখনো স্ক্র্যাবল বা দাবার মত মাইন্ড গেম? খেললে বুঝতেন ওতে হারার চেয়ে হাজারগুণ বেশী খারাপ হল অযোগ্য প্রতিদ্বন্দীর সঙ্গে খেলা! শিশু তো নন উনি যে জিতিয়ে দিতে হবে! 
        তাছাড়া এটা কি লুডো যে দুটো খাবার ঘুঁটি না খেলেই জিতে যাবেন উনি! ক্যাট ম্যাট ধরণের বালখিল্য শব্দ গড়লে বুঝবেন না উনি? ওঁর মাথায় যে নেহাৎ গোবর পোরা তেমন ভাবার কোন কারণ আছে কি? আ্যদ্দিনে আপনার সঙ্গে খেলেছি কি একবারও? উপযুক্ত প্রতিপক্ষ ছাড়া ফেলু মিত্তিরের মস্তিষ্ক পুষ্টি হয় না, বুঝলেন?”
“বুঝলুম ফেলুবাবু। এখন চলুন দেখি এই তিন ঠেঙে কুকুরের কেস কোন রোমহর্ষক দিকে মোড় নেয়!”

“কি ব্রীড ছিল আপনার কুকুরের?” 
মেইন রোডের দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
“কুকুর কুকুর করবেন না মিঃ মিত্র। ও আমার…”
“তা নাম দিয়েছিলেন কিছু ওর?”
“হ্যাঁ । ভাল নাম হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়—ওকি, আপনি হাসলেন নাকি মিঃ গাংগুলী?”? 
পেছনে “খিঁক” শুনে বললেন ডাঃ ব্যানার্জি ।
“না না। হাসব কেন? হাসার কথা  নাকি! আমার হেঁচকি উঠল বলেই তো..”
“আর ডাকনাম!”? 
ফেলুদা যে কি করে না হেসে আছে কে জানে। আমার তো পেট ফেটে যাচ্ছে।
“ডাকনাম হালুম।”
“তা এই হালুমের বংশ পরিচয় কিছু জানেন? না মানে এখন উনি ব্যানার্জি পরিবারভুক্ত ঠিকই, তবে জন্মসূত্রে ঠিক কি?”
“জার্মান শেপার্ড। ইফ দ্যাটস হোয়াট ইউ আর আস্কিং!”

বলতে বলতে আমরা ব্রীজের পাশে এসে গেছি। ব্রীজের নীচের একটা খোঁদল মত দেখিয়ে মণিকঙ্কণা বললেন “ওখানেই থাকত হালুম! আমি ভেবেছিলাম বাড়িতে নিয়ে আসব। কিন্তু বাড়িওয়ালা রাজী না। তার ওপর আমি সারাদিন থাকি না, কে দেখবে ওকে। তারপর আবার দুদিন পরে দার্জিলিং চলে যাব..”
“আপনি দার্জিলিং চলে যাবেন? চাকরী নিয়ে?” জটায়ু শুধোন।
“হ্যাঁ । ওখানে আ্যপ্লাই করেছিলাম,হয়ে যাবে মনে হয়। আসলে আমার পাহাড় ভাল লাগে বলে খালি এসব জায়গাতেই খুঁজি।”

ব্রীজের পাশে একটা ছোট্ট গুমটি চায়ের দোকান। সেটার দোকানদার দেখলাম মণিদিকে চেনে। 
“আরে বহেনজী, ও কুত্তা আভি মিলা নেহি ক্যায়া আপকো?”
“নেহি ভাইসাব। আজ শুভেসে উসকো নেহি দেখা আপনে, হ্যায় না?”
“নেহি বহেনজী। পাতা নেহি কাঁহা গয়া, আ্যয়সে তো রোজ আ যাতা হ্যায় খানে কে লিয়ে। শান্তি সে বৈঠা রহতা হ্যায়। মগর কাল রাতকো, জব ম্যয় দুকানকে অন্দর শো রাহা থা তো বহৎ ভোঁক রাহা থা। ম্যয় শোচ ভি রাহা থা কি যাকে দেখুঁ ক্যায়া হ্যায়…লেকিন সর্দি ইতনি থী…অউর থোড়ি দের বাদ তো চুপ ভি হো গয়া।”

ফেলুদা ইতিমধ্যে ঢালু দিয়ে নেমে ঐ খোঁদলের পাশে চলে গেছে। আমরাও ওর কাছে গেলাম।
“ম্যাগনিফায়িং গ্লাস নেই আপনার?” মণিদির প্রশ্ন।
“ কেন তাছাড়া ঠিক গোয়েন্দা গোয়েন্দা লাগছে না?” ফেলুদা চারপাশটা দেখতে দেখতে বলে।
“ভাববেন না, দরকার লাগলে সব পাওয়া যাবে, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, রিভলভার…তবে আপাততঃ…”বলে আশপাশের মাটিতে মন দিয়ে কি যেন দেখতে দেখতে হঠাৎ উবু হয়ে বসে একটা মাঝারি গোছের পাথরের ওপর তর্জনী বুলিয়ে কি যেন তুলে আনল।

মণিদি এতক্ষণ চোখ গোল গোল করে সব কিছু দেখছিল। ওর দিকে আঙুলটা বাড়িয়ে দিয়ে ফেলুদা বলে
 “কি, কিছু বুঝতে পারছেন?”
খপাৎ করে ওর আঙুলটা ধরে মণিদি নিজের চোখের কাছে এনে ভুরু টুরু কুঁচকে দেখল খানিক্ষণ।

“টেস্ট না করলে তো বুঝতে পারব না, তবে টেক্সচার আর কালার যা দেখছি তাতে মনে হয়…”
“হুম। যা ভাবছেন তাই।টেস্ট না করলেও বুঝতে পারছি আমি”। 
আঙুলটা মণিদির কবল থেকে ছাড়িয়ে নিজের নাকের কাছে নিয়ে বলল ফেলুদা।
“খুব হাল্কা কোকোর গন্ধ।ভেরী ফেইন্ট।বললাম না, আমার ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর!”
“ওহ্, তার মানে কি…”
“ইয়েস ডাঃ ব্যানার্জি। আপনার হালুম মনে হচ্ছে স্নিফার ডগ ছিল। জার্মান শেপার্ড বললেন তো, তাই না! এল কি করে এখানে! কতদিন ধরে এখানে ছিল জানেন?”
“মাস তিনেক হবে। একটা পা খুব ইনজিওরড ছিল। এখানে তো সেরকম ভেট টেট নেই। আমিই একটু দেখাশোনা করে অনেকটা সারিয়েছিলাম।”
“ইন্টারেস্টিং! স্নিফার ডগ, জার্মান শেপার্ড এভাবে রাস্তার ধারে…”

“ঐ সাদা গুঁড়োটা কি ফেলুবাবু?” জটায়ু বলে ওঠেন।
“কোকেন। মনে হয় কাল রাতে এখানে কিছু ডেলিভারি হচ্ছিল যেটি হালুমবাবু টের পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে ধরতে যায়।”
“ধরতে যায় বুঝলেন কি করে?”
“কারণ এই পড়ে থাকা গুঁড়ো। আরো কয়েক জায়গায় আছে আশপাশে।হয়ত প্যাকেট কামড়েছিল হালুম। আর ঐ দেখুন ঐ ঘাসে…দু ড্রপ রক্ত.”
“সেকি? হালুমের রক্ত নাকি!”
“ঐ রক্তের ফোঁটা সম্ভবতঃ ড্রাগ পেডলারদের। হালুমচন্দ্র বিনা যুদ্ধে জমি ছাড়েননি। হাজার হোক সম্রাট হর্ষবর্ধনের নামে নাম তো!”

“কিন্তু ও গেল কোথায় বলতে পারেন?”
“সে তো বলা মুশকিল ডাঃ ব্যানার্জি । হয়তো ওকে কাবু করে ধরে নিয়ে গেছে। শুনলেন না, চায়ের দোকানী বলল চিৎকারটা হঠাৎ থেমে গেল!”
“ঈশ! মেরেই ফেলেছে বোধহয় হালুমটাকে”।
কেঁদে ফেলবেন নাকি ভদ্রমহিলা ! 

“আমি বাড়ি যাই মিঃ মিত্তির। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।” হঠাৎ উল্টো দিকে হাঁটা লাগালেন উনি।
“আরে, আরে! দাঁড়ান, দাঁড়ান! কোথায় চললেন? ডিনার খাবেন না?”
“আপনারা যান। আমার খিদে নেই।”
“এভাবে আহার নিদ্রা ত্যাগ করলে তো কোনো লাভ হবে না। তারচেয়ে চলুন কিছু খেয়ে নিই সবাই মিলে। পেটটা ভরা থাকলে দেখবেন আইডিয়া আসবে মাথায়।”
“হ্যাঁ মণিদি চল। তোমার থেকে আমার বেঞ্জিন রিং এর স্ট্রাকচারটা বোঝার আছে।”
“চলুন ডাঃ ব্যানার্জি, আমার পরের গল্পের প্লটটা একটু বলি আপনাকে। এটা ভাবছি একদম মাসাইমারায় ফেলব…সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক, ভিক্টোরিয়া ফলস…”জটায়ু উৎসাহ দেন।
“ওটা মাটেরুনি ফলস হবে লালমোহন বাবু “, মণিদি ফোঁৎ করে নাকটা টেনে ধরা গলায় শুধরে দেয়। 
ফেলুদার মুখটা দেখতে পেলাম না, কারণ তক্ষুণি ও হাত মুঠো করে একটা ছোট্ট কাশি আড়াল করল।

রেসট্যুরেন্টে গিয়ে মণিদি শুধু একটু স্যুপ খেল। কথাবার্তাও হুঁ হাঁ দিয়ে চালিয়ে দিল।
“আপনি তো এনজিওর হয়ে ডাক্তারী করেন। পেশেন্টদের মধ্যে ড্রাগ প্রবলেম দেখেন?” ফেলুদা অবশেষে একটা চারমিনার ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“বিনি পয়সায় চিকিৎসা করাতে আসে যারা তারা সব গরীব লোক। কোকেনের পয়সা কোথায় পাবে? নেশার সমস্যা আছে, কিন্তু সেগুলো ঐ বাংলা চোলাই জাতীয়। 
তবে একবার আমার ডাক পড়েছিল সরকারী হাসপাতালে, একটা সার্জারীর জন্য…এখানে তো সার্জন অত আ্যভেলেবল নয়, তাই ওরা অনেক সময় আমাদের হেল্প নেয়। তো সেটা ছিল একটা ড্রাগ মিউলের কেস।”

“ড্রাগ মিউল আবার কি ফেলুবাবু? খচ্চড় ড্রাগ বয়ে আনে নাকি?”
“না লালমোহনবাবু, পশুতে নয়। মানুষে বয়। গরীব মানুষকে সামান্য পয়সার লোভ বা ভয় দেখিয়ে এই কাজ করানো হয়। তাদের ছোট ছোট ড্রাগ ভর্তি প্লাস্টিকের পোঁটলা গিলিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়া যায়। ঐ লোকগুলোই তখন চলমান ড্রাগবাহক বা মিউল। এভাবে এক এক জন মিউল কোটি টাকার কোকেন ক্যারি করতে পারে।”

“কি সাংঘাতিক! কিন্তু পেটে তো আ্যসিড থাকে মশাই।ঐ প্লাস্টিকের পোঁটলাগুলো ফেটে টেটে যায় না?”
“এমন জিনিস ব্যবহার হয় যাতে তা না হয়। কারণ ফেটে গেলে মিউল মরবে তো বটেই, কিন্তু কোটি টাকার কোকেনও বরবাদ হবে। তাই ঠিকঠাক মেটিরিয়ালের পাউচ বানানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুড কোয়ালিটি ল্যাটেক্স, প্রেফারেবলি মাল্টি লেয়ার্ড, লো পারমিয়াবিলিটি…” 

“এত স্বত্ত্বেও সে রকম দুর্ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে বই কি! ঐ মিউলের তখন প্রাণ সংশয়…হেভি ড্রাগ ওভারডোজে। সেকরমই হয়েছিল এখানে ক’দিন আগে। সরকারী হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল একজনকে। তারই এমার্জেন্সী গ্যাস্ট্রিক সার্জারীতে সাহায্য করতে আমার ডাক পরে।” মণিদি বুঝিয়ে বলে।
“যে লোকটির অপারেশন হয়েছিল তার নামধাম পাওয়া যাবে?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
“তা আমি গিয়ে হাসপাতালে চাইলে ওরা দেবে মনে হয় আমাকে।”
“তাহলে চলুন হাসপাতাল” ফেলুদা উঠে বলল।
“কিন্তু এত রাতে?”
“তাতে কি? হাসপাতাল তো! ২৪ ঘন্টা খোলা।”

হাসপাতালে গিয়ে কিন্তু কোন লাভ হল না। লোকটিকে কেউ হাসপাতালের সামনে ফেলে গেছিল। সেরে যাবার পর পুলিশ এসেছিল। কথা ছিল পরদিন এসে জেরা করবে। কিন্তু তার আগেই লোকটি পালায়। এই সরকারী হাসপাতালে সিকিউরিটি এমন কিছু কড়া না, কোন ওয়ার্ডবয়কে কিছু টাকা দিয়ে পালানো কিছুই নয়। লোকটি নিজের নাম বলেছিল মোহন, এর চেয়ে বেশি কিছু জানা গেল না।

“আপনি বাড়ি যান ডাঃ ব্যানার্জি। আমি ভেবে দেখছি কি করা যায়।” ফেলুদা অবশেষে বলল।
“হ্যাঁ সে তো যেতেই হবে। আপনিও হোটেলে ফিরে যান। অনেক করেছেন আপনি, আর ঝামেলায় জড়াবেন না। আপনার সোল্ডার ইনজুরি এখনো পুরো সারে নি।”
বলে মণিদি বিদায় নিল।

—————————————————
পর্ব ৫ঃ শিবতীর্থ
—————————————————

ফেলুদা কিন্তু হোটেলে না ফিরে ঘুরল বাজারের দিকে।
“আপনি কি মশাই আবার তদন্ত করার তালে আছেন? এবার ক্ষ্যামা দিন তো। এখনো পুরো সারেননি আগের জখম থেকে, একটা কুকুরের জন্য…ডাঃ ব্যানার্জিও তো বললেন ছেড়ে দিতে।”
“এটা কিন্তু আর কুকুরের নেই লালমোহনবাবু, কোকেনের মামলা হয়ে গেছে। যাকগে, আপনারা হোটেলে যান, আমি ঐ ওষুধের দোকান থেকে  আরো ক’টা পেইনকিলার কিনে নিয়ে আসছি। মিনিট পনেরর বেশী লাগবে না।”

হোটেলে ফিরে আমাদের ঘরে বসে গপ্প করতে করতে আমি আর জটায়ু যখন এক ঘন্টা কাটিয়ে ফেলার পরেও ফেলুদা ফিরল না, তখন চিন্তা হতে লাগল।
“তোমার দাদার এই ব্যাপারটা না ফ্র্যাঙ্কলি ভেরি ইরিটেটিং তপেশ।” জটায়ু ভুরু টুরু কুঁচকে বললেন।
“দেখি আর আধঘন্টা মত, নাহলে…”
“না হলে কি করবে বলতো তপেশভাই?”
“জানিনা। মাথায় আসছে না কিছু। একবার মণিদিকে..”
“না না, এই রাত বিরেতে, এটা তো কোন ডাক্তারী কেসও নয়। তারচেয়ে বরং পুলিশের কাছে..”

“পুলিশের কাছে কি হবে লালমোহনবাবু?”
 ফেলুদা ফিরেছে।
“এই তোমার পনের মিনিট? ওষুধ কিনতে ক ঘন্টা লাগে ফেলুদা?”
“আরে ওষুধ কিনতে গিয়েই তো অযাচিত ভাবে একটা ক্ল্যু পেয়ে গেলাম। ফলে সেটার একটু তদন্ত না করে তো আর আসা যাচ্ছিল না।”
“কিসের ক্ল্যু মশাই”?
“দেখলাম আমার আগের লোকটা ষোল বাক্স কন্ডোম কিনল।”
“ক্কি, কি বলছেন মশাই…তপেশের সামনে…ছি ছি ছি…”
“আপনি ধিক্কারটা থামান মশাই। এগুলো ইউরোপে ১০/১২ বছরের বাচ্চাদের স্কুলে শেখায়।তোপসে আর তিন মাস পরে আ্যডাল্ট হবে। ওর বায়োলজি টেক্সট বইতে আছে, ও যদি কিছু না জানে তো আমি ওর আসন্ন হায়ার সেকেন্ডারী নিয়ে সবিশেষ চিন্তায় পড়ব।”

“কিন্তু ফেলুদা তার থেকে তুমি ক্ল্যুটা কি পেলে? একটা লোক ফার্মেসীতে কিনতে এসেছে তো এর মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যাপারটা কোথায়?”
“অস্বাভাবিকত্বটা পরিমাণে। ঐ পরিমাণ একসঙ্গে কেনা…হাউ শ্যুড আই সে ইট…মোস্ট লাইকলি ইজ নট ফর দ্য ইনটেন্ডেড পারপাস!”
“তার মানে?” লালমোহনবাবুর প্রশ্ন।
“জানেন আর কিসে কিসে এর ব্যবহার হতে পারে?”
“হ্যাঁ …মা-মানে, সে তো আর না জানার কি আছে…” লালমোহনবাবু বেগুনী হয়ে গিয়ে তোতলাচ্ছেন।
“না, আমি এর প্রাইমারী ফাংশন আ্যজ এ বার্থ কন্ট্রোল টুলের কথা বলছি না…” ফেলুদাকে অসহিষ্ণু শোনায়।
“দেয়ার আর মেনি আদার লেসার নোন ইউজেজ, যেমন আন্ডার ওয়াটার সাউন্ড রেকর্ডিঙে লাগে আ্যজ এ ওয়াটার টাইট স্যাক ট্যু পুট দ্য মাইক্রোরেকর্ডার ইন। তেমনি…”

“আ্যজ ড্রাগ পাউচ…ফর দ্য মিউলস!” আমি বলে উঠি কারণ আমার মাথায় চট করে খেলে গেছে টাইমস ম্যাগাজিনের একটা আর্টিকেল।

“সাবাশ তোপসে। হ্যাঁ , আমি শিওর এগুলো কেনা হচ্ছে ওগুলোকে ড্রাগ পাউচ হিসেবে ব্যবহার করতে। আর তারপর সেগুলো মিউলের মাধ্যমে পাচার করতে।এটা অত্যন্ত ওয়েল নোন টেকনিক।পৃথিবীর সর্বত্র…মেক্সিকো, কলম্বিয়া থেকে ফার ইস্টের বিভিন্ন দেশেই বহুল প্রচলিত।”
“বলেন কি মশাই? ঐ জিনিস ড্রাগ পাচারের কাজে লাগে? জানতুম না তো!” বলে ওঠেন জটায়ু।
“ গুড কোয়ালিটি ল্যাটেক্স, ভেরি লো পারমিয়াবিলিটি, —মিউলদের পেটে ইনট্যাক্ট অবস্থায় থাকার সব গুণ আছে।তা ছাড়াও সস্তা, সহজলভ্য এবং সন্দেহউদ্রেককরী নয়। সুতরাং ড্রাগের কারবারীদের কাছে বেশ পছন্দের অপশন।”

“আমি একবার টাইমসে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম।দু তিন পিস একসঙ্গে ইউজ করে মাল্টিলেয়ার্ড পাউচ বানায়, মিউলদের পেটের আ্যসিডে অক্ষত রাখার জন্য। তাই বোধহয় এই বাল্ক পারচেস, না ফেলুদা?”
“এক্সাক্টলি! তাই আমি দোকানদারের সঙ্গে ভাব জমিয়ে জানার চেষ্টা করলাম ক্রেতাটি কে! “
“জানতে পারলেন কে?”
“হ্যাঁ । সাম তিওয়ারী। মাঝে মাঝেই এভাবে এসে লার্জ কোয়ান্টিটিতে কিনে নিয়ে যায়। অদ্ভুতভাবে কেউ সন্দেহও করে না…দে ওয়্যার জাস্ট মেকিং সাম টেস্টলেস পুয়োর জোকস আ্যবাউট হিজ প্রাওয়েস। এনিওয়ে ওরা বলতে পারল না তিওয়ারী কোথায় থাকে, তবে বলল যে ও একটা বাইকে চেপে আসে যেটা সারাই করায় মাঝে মাঝে বাজারের নাথ্থু গ্যারেজে।”

“তা তখন আপনি নাথ্থু গ্যারেজ গেলেন নাকি?”
“ন্যাচেরালি!  ওখানে ওদের মেকানিক ইসমাইলের থেকে পাওয়া গেল আসল খবর। ওদের ওখানে কাজ করত মোহন নামে এক হেল্পার যে গত একমাস ধরে আসছে না পেটে আ্যপেন্ডিক্স অপারেশন হয়েছে বলে। তিওয়ারীর কাজ মূলতঃ মোহনই দেখত। ওদের কাজের চাপ খুব বেড়ে গেছে মোহন না থাকায়। আর শেষ খবরটা হল…তিওয়ারী ওয়ার্কস আ্যট দ্য মেঘরাজ হাউস!”

এরপর খট করে যে আওয়াজটা হল সেটা জটায়ুর দাঁতে দাঁতে লাগার।
              ———-
“আমাদের আগেই বোঝা উচিৎ ছিল মশাই। পাহাড়ী জায়গা, ড্রাগ…এ আমাদের মগনলাল ছাড়া কেউ না।”
পরদিন সকালে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলেন জটায়ু।
“শুধু তাই না। সবই শিবের তীর্থ। কাশী, পশুপতিনাথ কিম্বা এই কেদার-বদ্রী।” ফেলুদা মনে করিয়ে দেয়।
“হ্যাঁ মশাই, সেই জন্য তো কেদারে কেনা ঐ পাথরের শিবও কাছেই রেখেছি।”
কাঁধের ঝোলা থাবড়ে বুঝিয়ে দেন জটায়ু।
“বেশ একটা কনফিডেন্স পাওয়া যায়, বুঝলেন তো!”

“ভেবে দেখুন আপনি যাবেন কিনা। আপনাকে যেতেই হবে এমন কিন্তু কোন মানে নেই। মগনলাল পার্টিকুলারলি আপনাকে যেমন নাজেহাল করে তাতে করে আপনি না গেলে আমি কিচ্ছু মনে করব না…”
“ফেলুবাবু, আপনি কিন্তু আমায় দারুণ আন্ডার এস্টিমেট করছেন। আমরা যে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স তাও কি ভুলে গেলেন?” জটায়ু গম্ভীর হয়ে বললেন।
“এবারে তাহলে থ্রি নয়, ফোর মাস্কেটিয়ার্স।” দূরে মণিদিকে দেখিয়ে বলল ফেলুদা।
“কি মশাই! ওঁর মত একজন মহিলাকে নিয়ে মগনলালের বাড়িতে… না না। মানা করুন ওঁকে।”
“পারলে করুন আপনি। সকালে উনি ফোন করেছিলেন। বললাম এই ব্যাপার তো উনি জেদ ধরলেন যাবেনই। বারণ করতে গেলাম তো দুকথা শুনিয়ে দিলেন কিসব নারীবিদ্বেষী টেসী বলে। আপনার সাহসে কুলোয় তো মানা করুনগে যান।”

মেঘরাজ হাউস শহর থেকে একটু দূরে একটা সুন্দর ছবির মত সাদা বাড়ি, বিরাট কম্পাউন্ডের মাঝখানে। চারপাশে পাইন ফারের জঙ্গল। গেট থেকে নুড়ি বিছানো পথ তার মধ্যে দিয়ে অনেকটা গিয়ে শেষ হয়েছে গাড়িবারান্দার নীচে। গোল গাড়িবারন্দার নীচে বড় ফোয়ারা, চারপাশে ফুলের কেয়ারি।আমরা গেটের সামনে গিয়ে আমাদের ভাড়ার গাড়ি ছেড়ে দিয়ে দারোয়ানকে বললাম মেঘরাজ মশাইকে জানাতে যে কলকাতা থেকে তাঁর চেনা মিঃ মিত্র এসেছেন দেখা করতে। সে ইন্টারকমে কথা বলে নিয়ে আমাদের প্রবেশের অনুমতি দিল।

ভেতরের সুসজ্জিত বসার ঘরে কিছুক্ষণ বসার পরেই শুনলাম পরিচিত কণ্ঠস্বরঃ
“আরে মিঃ মিত্তর নাকি! কি সৌভাগ্য হামার…সাথমে কাজিন ঔর আঙ্কল কো তো ম্যয় পহচানতা হুঁ, লেকিন ইয়ে মোহতরমা কৌন হ্যায়? ভাবীজী?”
“ না মিঃ মেঘরাজ। ওঁর একটা জিনিস হয়তো আপনার কাছে আছে। সেই জন্যেই আসা আর কি!”
“আচ্ছা। উনকি কোঈ চীজকে লিয়ে আপ সিধা মেরে ঘর আ পঁহচে। বিনা কোঈ ডর! তব তো ইয়ে সায়দ হোনেবালি ভাবীজী হ্যায়। শরমাইয়ে মত। বোল দিজিয়ে, হাম তো ঠেহরে পুরানে জান পহচান বালে..”

ফেলুদা মগনলালের খোঁচা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,
“মগনলালজি, পরশু রাতে আপনার লোকেরা যখন কোকেন ডেলিভারী নিচ্ছিল ব্রীজের পাশে, তখন কোনো কুকুর আপনাদের বড্ড বিরক্ত করে। যার ফলে আপনারা তাকে চুপ করান জোরপূর্বক।সেই কুকুরটি কোথায় এখন বলতে পারেন?”
“কুকুর ? আরে উয়ো স্নিফার ডগ! ক্যায়া ভাবীজী, উয়ো স্নিফার ডগ লেকে আপ ক্যায়া করেঙ্গে? মিঃ মিত্রা সে কহিয়ে উয়ো আপকো এক ছোটাসা, প্যারা সা পুডল দিলা দেঙ্গে। খুব যাচেগা আপকো!”
মণিদিও দেখলাম বেশ বুদ্ধিমতী। কোনো রিআ্যক্ট করল না।

“তাহলে আপনার ড্রাগ মিউলের কারবারটা…মানে পাউচ বানানো , মিউলদের দিয়ে সেটা ক্যারি করানো সব কি আপনার এই বাড়ি থেকেই হয় নাকি?” 
ফেলুদা নিজের লাইন অফ কোয়েশ্চনসে অটল।
“আপ ইয়ে ক্যায়া অনাব শনাব বকে যা রহে হ্যায় মিঃ মিত্তর? হাঁ কোকেন কা কাম হাম থোড়া বহুৎ করতে হ্যায়  আ্যজ এ রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ। লেকিন ইয়ে ড্রাগ মিউল ব্যাগেড়া…”
“তাহলে আপনার কর্মচারী তিওয়ারী কাল ওরকম বাল্ক পারচেজ অব কন্ডোমস করল কেন? দোকানে যা ছিল সব?”

“ আররে মিঃ মিত্র … আব সমঝা!” হেসে উঠল মগনলাল ।
“আপকো জরুরত থী  উয়ো চীজ, পর মিলি নেহি…ইসি লিয়ে ইতনা নারাজ হ্যায়….মুঝ পর, তিওয়ারী পর, সারি দুনিয়া পর! বহুৎ গলত কিয়া উস তিওয়ারী নে…”
মগনলালের উস্কানি অব্যাহত।

“ঔর আঙ্কলজি, আপ ক্যায়সে হ্যায়? ঠিক ঠাক”?
“আ্যঁ হ্যাঁ …সব ঠিক ঠাক, ঠিক ঠাক”। জটায়ু চমকে উঠে বলেন।
“মিঃ মিত্তর নে তো ঢুঁঢ লিয়া আপনি মাশুকা, ঔর আপকো কোঈ মিলি নেহি ক্যায়া আভি, আঙ্কলজি?”
“না না…মেরা তো মানে কুছ নেহি…মানে ম্যায় করতা নেহি এই সমস্ত।”
“কিঁউ? নামর্দ হ্যায় আপ…?”
মগনলালের সাহস বেড়ে চলেছে। ফেলুদা কি ভাবছে জানিনা। এই বাক্যবাণ আর কতক্ষণ সহ্য করবে ও…!

“ইউ কান্ট টক ট্যু হিম লাইক দ্যাট”, ফেলুদা কিছু বলার আগেই মণিদি বলে উঠেছে।
“ক্যায়া”? মগনলাল হকচকিয়ে গেছে।
“উনি একজন নামকরা সাহিত্যিক এবং ভদ্রলোক । এভাবে আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন না”। মণিদি গনগনে গলায় বলে ওঠে।

“আরে মিঃ মিত্তর, আপকো তো শেরনি মিলি হ্যায়। বাধাই হো। ঔর মেরে নসিব দেখিয়ে… কালি ভৈঁস!
খ্যার ছোড়িয়ে, আপ আয়ে হ্যায় ইধার শিউজিকা দর্শন কিজিয়ে আঙ্কলকে সাথ, কাজিন কে সাথ পাহাড় মে চঢিয়ে, ভাবীজীকে সাথ রোমান্স কিজিয়ে…কেঁও ঝুটমুট আপনা অউর মেরা টাইম এক কুত্তে কে পিছে বরবাদ কর রহে হ্যায়? 
তিওয়ারীকে বারেঁ মে পুছ রহে থে না? বুলাতা হুঁ ম্যয় …তিওয়ারী,আরে ও তিওয়ারী ইধার আ জারা…” 

ভেতর থেকে বেরিয়ে এল খোলা পিস্তল হাতে ন্যাড়া মাথা তিওয়ারী। হাতের কব্জির কাছে একটা ব্যান্ডেজ। বোধহয় হালুম বাবুর দাঁতের কাজ।

“যা তিওয়ারী ইন লোগোকো বাহার ছোড় আ। অউর গনেশ , তু ভী ইধার আ…”

আর একজন দশাসই লোক এসে হাজির হল। এর হাতে পিস্তল নেই বটে তবে রীতিমত পালোয়ান।
“গনেশ, তু মিঃ মিত্তরকে বিলকুল বগল মে রহনা, কোঈ উল্টি সিধি হরকত করনে না পায়ে ইয়ে।”

আমরা পর পর লাইন করে বেরিয়ে এলাম। আগে আমি, তারপর জটায়ু , তারপর ফেলুদা সবার শেষে মণিদি। নুড়িবিছানো পথ দিয়ে একটু এগোতেই শুনলাম “আঃ”, মণিদি বেচারা হোঁচট খেয়ে পড়ছে। তুলবার জন্য এগোনো যাবে কিনা ভাবার আগেই দেখলাম তিওয়ারী একটু নীচু হয়ে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মণিদির দিকে । ডান হাতে রিভলভার ধরা।
বেচারী ভূপতিত মহিলার প্রতি গুন্ডাদেরও দয়া হয়!

কিন্তু মণিদি বাড়ানো হাত ধরে ওঠার বদলে এক হ্যাঁচকা টান এমন ভাবে দিল যে তিওয়ারী কুমড়ো গড়াগড়ি আর একই সঙ্গে ও নিজে উঠে দাঁড়াল। তিওয়ারীর হাতের রিভলভার ছিটকে গেল যেটা সঙ্গে সঙ্গে আমি তুলে নিয়ে তাক করলাম।ফেলুদা ওর পাশের গনেশ লোকটাকে ততক্ষণে কাবু করে মাটিতে ফেলেছে, ধ্বস্তাধস্তি চলছে…এমন সময় ঠকাং। গনেশের মাথায় জটায়ুর ঝোলায় থাকা পাথরের শিবের বাড়ি। এবার লোকটা চোখ এলিয়ে চিৎপাত।

ফেলুদা রিভলভারটা আমার থেকে নিয়ে তিওয়ারীর দিকে চোখ রেখেই মণিদিকে জিজ্ঞেস করল “জুজুৎসু শিখতেন বুঝি?’ উচি মাতা ‘প্যাঁচে কাত করলেন না তিওয়ারীকে?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ । ব্লু বেল্টের বেশী এগোইনি, তবে কাজে লেগে গেল আজ! তা এবার কি? কতক্ষণ এভাবে পিস্তল তাক করে থাকবেন।”? মণিদির প্রশ্ন।
“আমার হিসেব মত বেশীক্ষণ না। ইনপেক্টর সিং এলেন বলে। সব সিনেমার মত শেষ দৃশ্যে।”
“বাতাইয়ে তিওয়ারী জী সারা সামান অউর উয়ো কুত্তা কিধার হ্যায়।”?

ফেলুদা পরে বলেছিল যে এটা নাকি সাইকোলজ্যিকাল। মানুষের পিউপিল মুভমেন্ট থেকে খুব সহজেই তার আসল মনের ভাব বোঝা যায়।
                তিওয়ারীও মুখে কিছু না বললেও একবার নিজের কব্জির আঘাতের দিকে আর পরক্ষণেই গাড়িবারান্দার নীচে ফোয়ারাটার দিকে তাকাল। আমরা সবাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি ফোয়ারার সামনে বাঁধানো জায়াগাটায় একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মত। ওপরে আংটা লাগানো। 

“ছুটবেন না ডাঃ ব্যানার্জি “,
বলাটা দরকার ছিল কারণ মণিদি ছুটতে যাচ্ছিল।
“আমি বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ পেলাম। পুলিশ ঢুকছে মনে হয়। এদুটোকে তাদের হাতে দিয়ে তারপর আপনার হালুম উদ্ধার।”

পাঁচমিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে তিওয়ারী আর গনেশকে হাতকড়া পড়িয়ে জীপে তুলল। দুজন বাড়ির ভেতরে গেল বোধহয় মগনলালের সঙ্গে কথা বলতে।তারপর ম্যানহোলের ঢাকনা তুলতেই দেখা গেল ভেতর দিয়ে লোহার সিঁড়ি নেমে গেছে। পুলিশের পেছন পেছন আমরা চারজনও নেমে এলাম সেটা দিয়ে। নীচে একটা হলের মত। সামনের দরজাটার তালা খুলতেই দেখা গেল ভেতরে বিশাল কারখানার মত ঘর। সেখানে কোকেনের প্যাকেট, পাউচ সবই পাওয়া গেল। আসলে পুরো মেঘরাজ হাউসের বেসমেন্ট জুড়েই এই কারবার। আমরা যেখান দিয়ে এলাম সেটা ছাড়াও বাড়ির মধ্যে থেকে এখানে আসারও নিশ্চয় রাস্তা আছে। তবে সেসব এখন পুলিশ দেখবে। আমরা উঠে এলাম ওপরে।

“ও মিঃ মিত্তির, সবই তো হল, কিন্তু আমার বাচ্চাটা…” মণিদি এখনো দুঃখী।
“চলুন ঐ আউট হাউসে দেখি, নয়তো মগনলালকে আবার দাবড়ানি দিয়ে খোঁজ বের করতে হবে।”
“ওকে দাবড়ানি এমনিই দিতে হবে! ভাবীজি বলা আমি বের করছি ওর”।
“দেখুন মগনলালের হাজার দোষ, কিন্তু ভাবীজি বলা ইজ হার্ডলি এ ক্রাইম। বহেনজীতে তো চটেন না। ভাবীজি বললে চটেন কেন?”
“ইজি ফর ইউ ট্যু সে! আপনাকে তো আর বলেনি!”
“বলতে তো কিছু বাকীও রাখেনি। ছিলেন তো ওখানেই বসে, শোনেননি?”

এর মধ্যে এসে গেছি আউটহাউসের সামনে।
ভেতরের ঘর থেকে চাপা ভৌ ভৌ আওয়াজ আসছিল। একজন কনস্টেবল দরজা টা খুলতেই তীরের মত ছিটকে বেরিয়ে এলেন হর্ষবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়।

তারপর কুড়ি সেকেন্ডে যে ঠিক কি কি জিনিস কি অর্ডারে ঘটল তা বোঝানোই শক্ত, তবু চেষ্টা করছি।
বাইরে দাঁড়িয়েছিল ফেলুদা। তার একটু পেছনে মণিদি। হালুম মারল ঝাঁপ মণিদির দিকে। ফেলুদা গেল লাফিয়ে পিছনে সরতে, মণিদি গেল এগিয়ে হালুমকে ধরতে…এই ত্রিবিধ ঝটাপটিতে দেখলাম ফেলুদা, মণিদি আর হালুম তিনজনেই ঢালু মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

-————————————————
পর্ব ৬ঃ Syzygy 
—————————————————

“সেই পড়লেন আমার ঘাড়ে?” উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মণিদি!
“আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন কেন? “ ফেলুদাও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“আমি মোটেই আপনার পেছনে দাঁড়াইনি। হালুমটা ছুটে আসছিল আমার দিকে, আপনি কোথায় সরে যাবেন, তা না…”
“সরতে গিয়েই তো এই কান্ড। যাকগে, লেগেছে নাকি আপনার?”
“তা আর না লাগে! ওজন আছে বাপু আপনার! দেখে তো মোটা লাগে না, তবু…”
“ওজন ফ্যাটের হয় না। হয় মাসল আর হাড়ের । ডাক্তার হয়ে জানেন না সেকথা?”
“জানি কিন্তু…ও কি? আবার আপনার কাঁধে চোট পেলেন নাকি?”
“না না ঠিক আছে বোধহয়”। কাঁধে হাত বুলিয়ে বিকৃত মুখে বলে ফেলুদা।
“ঠিক আছে কিনা সে তো আমি বুঝব। প্রেসির লোকেরা ভাবে বটে তারা সর্বজ্ঞ, তবে সেটা তো ঠিক নয়! দেখি কি অবস্থা। বসুন একটু, নয়তো আমি নাগাল পাব কি করে? যা ঢ্যাঙা আপনি!”

আমি যতক্ষণ হালুমের সঙ্গে খেলছিলাম তারমধ্যে আবার চোট পরীক্ষা হল। এবার যে ফেলুদার মুখের রং বদলে গেল সেটা আমি আড়চোখে হলেও পষ্ট দেখেছি…চোখের ভুল টুল নয় মোটেই। আবার ফেলুদার চোখে চোখ পড়তেই মণিদিও কেমন জানি দুম করে ডাক্তারীটা শেষ করে হুটপাট সরে দাঁড়াল।
“ঠি-ঠিক আছে। সে-এ-রে এসেছে মনে হয়”। এবার দেখছি মণিদির তোতলানোর পালা।

তা, সব  যখন ঠিকঠাক আছে, তখন ফেরা যেতে পারে।

                   ——————
বিকেলে একটা ক্যাফেতে বসেছিলাম চার জনে। আমি জ্যুস নিয়েছি। ফেলুদা আর মণিদি কফি আর লালমোহনবাবু চা।

“মগনলালের কি হবে ফেলুবাবু”? জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন।
“এখনকার মত তো বামাল সমেত গ্রেপ্তার । কিন্তু এই নিয়ে তো তিনবার হল। লোকটার পয়সাও আছে, কানেকশনও।দুবছর পর আবার কোন তীর্থে দেখা হয়ে গেলে আশ্চর্য হব না।সেই জন্যই আরো কাল গেলাম ওর বাড়ি। শুধু পুলিশকে খবর দিলে ওরা একটা রুটিন এনকোয়ারি করে কোন লীড না পেয়ে ফিরে আসত। মেঘরাজ হাউসের বেসমেন্টে ড্রাগের ব্যবসা চলতেই থাকত ।”
“ও কি আপনার পুরোনো শত্রু নাকি মিঃ মিত্র”? মণিদির প্রশ্ন।
“তা একরকম বলতে পারেন। শার্লক হোমসের যেমন প্রফেসর মরিয়ার্টি…ইনিও তেমন ঘুরে ফিরে এসে পড়েন আমার জীবনে। তবে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি সেদিন অতগুলো ভুলভাল কথা আপনাকে শুনতে হল…”
“তাতে আপনার ক্ষমা চাওয়ার কি হল? আপনাকেও তো বহুকিছু বলল। বললেই কি হয়ে গেল নাকি? যত্তসব। আপনি ছিলেন বলে হালুমটা ফেরত এল…”
“হ্যাঁ , হালুম তো বেশ অভিজ্ঞ স্নিফার ডগ, পুলিশের কুকুরই ছিল তো। ইনস্পেক্টর সিং বললেন যে মাস তিনেক আগে একটা অপারেশনের সময় ও ইনজিওরড হয়ে নদীতে পড়ে যায়। সবাই ভেবেছিল মরেই গেছে, কিন্তু দেখাই যাচ্ছে ও কোনরকমে তীরে উঠে ঐ ব্রীজের তলায় আশ্রয় নেয়।। নামটা অবশ্য হর্ষবর্ধন নয়, জ্যাক! তো সে যাই হোক, নামে কি যায় আসে, এখন আবার ও সঠিক জায়গায় ফিরবে, চিকিৎসাও পাবে।”

“হালুমটার জন্য মন খারাপ লাগছে জানেন। জানি ও ভাল থাকবে, তাও”।
“অত ভাববেন না। বরং আপনি এবার একটা বিয়ে থা করে নিন, নিজের ছেলেপুলে হোক তাহলে দেখবেন আর…” লালমোহন বাবু বলে ওঠেন।
“আপনি কি আমায় প্রস্তাব দিচ্ছেন নাকি?” 
চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল মণিদি। 
আমি জ্যুসের গ্লাসে বিষম খেলাম।
ফেলুদা অব্দি একটা খোলা হাসি হেসে উঠল।

“এই দ্যাখ! কি কথার কি মানে করে বসল, আপনি কিন্তু খুব গোলমেলে লোক মশাই ।”
“ ভাববেন না, আমি আপনার লেগ পুলিং করছিলাম। আমি জানি আপনি ভাল লোক।”
ফিক করে হেসে বলে মণিদি।
“তাহলে আপনাকে কেউ প্রস্তাব দিলে সে খারাপ লোক হবে বলছেন?” ফেলুদা হাসি থামিয়ে বলল।
“ধুর ধুর, আমাদের দেশে আবার কেউ দিতে পারে নাকি প্রস্তাব… যত সব মায়ের আঁচল ধরা বুড়ো খোকার দল,
মায়ের জন্য দাসী আনতেই শিখেছে কেবল।
                   এক হাঁটু গেড়ে বসে, আংটি দিয়ে বলবে…’উইল ইউ ম্যারি মী’…ব্যাকগ্রাউন্ডে মুন রিভার বাজবে, তবে না…”!
“হুম একদম বিলিতি মতে। তাহলে অবিশ্যি একটু শক্ত ! কখনো যদি পান কাউকে তো জানাবেন, শুভদিনে হাজির থাকব কথা দিলাম।”
           ————————
পরদিন সকালে গাড়িতে মালপত্র তুলছি হোটেলের বাইরে। 
“কই ফেলুবাবু, উঠে আসুন।” হাঁক দেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদার চোখ চারিদিকে কি যেন খুঁজছে।
“চলুন”, বলে সবে উঠতে যাবে ড্রাইভারের পাশে এমন সময় দেখা গেল প্রায় দৌড়তে দৌড়তে আসছে মণিদি।

“স্যরি, ভীষণ দেরী হয়ে গেল। আর একটু হলেই মিস করে যেতাম আপনাদের।”
“খুব ভাল হল দেখা হয়ে মণিদি।”
“হ্যাঁ ভাই। বেস্ট উইশেস ফর ইওর হায়ার সেকেন্ডারী। ভালোই হবে তোমার পরীক্ষা। লালমোহনবাবু, আপনার প্লট শুনেও কিন্তু মনে হচ্ছে পরের বইও সুপার হিট। আপনাদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না, তবে…”

“এ আবার কি কথা ডাঃ ব্যানার্জি , দেখা হবে না কেন? ফোন নাম্বার দিলুম যে! ফোন করবেন। কলকাতা গেলে অবশ্যই দেখা করবেন গড়পারে। ক্যারামেল পুডিং খাওয়াতে পারব না, তবে আমার রান্নার ঠাকুর রাঁধে কিন্তু খাসা।” জটায়ু বলে ওঠেন।
“তা না হলে আর আপনার বাড়িতে ওর চাকরী থাকত নাকি!” ফেলুদা বলে।
“আর ডাঃ ব্যানার্জি, আর একদান খেলা বাকী রইল কিন্তু! সে কলকাতায় হোক দার্জিলিঙে।”
“হারবেন তো সেই আবার! যেখানেই হোক।”
“দেখবেন দার্জিলিং গিয়ে আপনাকে এবার ঠিক হারিয়ে আসব”।
                   ———————
“ কখন যে মানুষের অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায় কিছুই বলা যায় না, বুঝলে তপেশ ভাই”। গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরে বললেন জটায়ু।
“সে তো বটেই।আপনার সঙ্গেও তো আমাদের আলাপ এরকম পথেই।” আমি মনে করিয়ে দিলাম।
“যা বলেছ ভাই, ভবিতব্য ! আ্যলাইনমেন্ট অফ স্টারস। তাকেই তো বলে ঐ যে ঐ খটমটে শব্দটা…syzygy…তাই না ফেলুবাবু?”

ফেলুদা কিছু না বলে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে লাগল।