বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১

মীনাক্ষী ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

বয়সটা কম। প্রাজ্ঞতা নেই। ছত্তিরিশ বা সাঁইতিরিশ।
মনের ভেতর জ্বলছে আগুন, রাস্তাতে তুই তাই ফিরিস।

তুই কি পাগল? অ্যাম্বিশনের... আদৌ কি নেই ইচ্ছে তা?
সময় এখন গুছিয়ে নেবার, সবাই দিব্যি নিচ্ছে তা।

টেম্পারেচার চল্লিশ। তার গাল কপালে বইছে ঘাম।
তার মধ্যেই ঘুরছে মেয়ে। কখন নেবে সে বিশ্রাম?

ওদের তৈরি সিণ্ডিকেট আর ওদের আছে দাঙ্গা বিষ!
ভয় করে না? ওই যে ওরা... কীসের জোরে পাঙ্গা নিস?

মুখের ওপর তর্ক করিস, বড়ই দেখছি সাহস তোর।
খেলার ছলেই মুছতে পারে। সেই খেলা স্রেফ বাঁ হস্তর।

প্রশ্ন করলে অভয় শোনাস। কোথায় কারা শুধছে ঋণ!
তোর পাহারায় শুনছি হাজার চোখ জেগে রয় রাত্রিদিন। 

সবার চোখের মণির মতন। সবার আশার ফুল কি তুই?
হয় তো ঠিকই। এই রাত্রির তিমির বিনাশ ফুলকি তুই।

আমার কন্যা পিনাকপাণি। ওই জনতাই পিনাক কি?
বাবার চিন্তা মানতে চায় না! সাবধানে থাক্ মীনাক্ষী!



সোমবার, ২৯ মার্চ, ২০২১

নন্দীগ্রামের চক্রান্ত ~ সৌনক দত্ত

কাল থেকে মমতার হয়ে এপোলোজিয়া নামানো স্বাধীন বাম , লিবু, ম্যাও সবারই অনেক ন্যারেটিভই চোখে পরছে। সব কটার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি না, কিন্ত নির্দিষ্ট একটা ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়াটা খুবই জরুরি, সেটা হলো গুলি চালানো প্রসঙ্গে ১৪ই মার্চের পর  নাকি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের করা একটি মন্তব্য 𝗧𝗵𝗲𝘆 𝗵𝗮𝘃𝗲 𝗯𝗲𝗲𝗻 𝗽𝗮𝗶𝗱 𝗯𝘆 𝘁𝗵𝗲𝗶𝗿 𝗼𝘄𝗻 𝗰𝗼𝗶𝗻 "

টিপিকাল দক্ষিণপন্থী প্রোপাগান্ডা মেশিনারির কায়দা গুলো কি নিখুঁত ভাবে রপ্ত করে ফেলেছে এই রাজ্যের সিপিআইএম বিরোধী লিবারেল, স্বাধীন সহি বাম, অতিবাম সহ কিছু বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিবিশেষ। তা হলো আউট অফ কনটেক্স একটা স্টেটমেন্টকে পুরো পুরি বিকৃত করে একটি চূড়ান্ত মিথ্যা  ন্যারেটিভ কনস্ট্রাক্ট করে হোয়াটাবাউট্রি করে যাওয়া, অবাক লাগে এখনো  এরা এতটাই নির্লজ্জ, এতটাই সংকীর্ণ যে এই পর্যায়ের সিপিআইএম বিরোধী প্রোপাগান্ডা চালাতে এতটুকু ক্লান্তি নেই এদের।


অবশ্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য এই মন্তব্যটি করেছিলেন, কিন্তু মন্তব্যটি ছিল সম্পূর্ণ অন্য কনটেক্সে, অন্য প্রসঙ্গে। দেখা যাক সেই কনটেক্স।

নন্দীগ্রামে কোনো শিল্প অভিযান প্রক্রিয়া শুরুর আগেই, শুধুমাত্র কেমিকাল হাব নির্মাণের পূর্ব পরিকল্পনার আঁচ পেয়েই ২০০৬ এর ডিসেম্বর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে 'ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি ', যার অংশ ছিল তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি-নকশালপন্থী গোষ্ঠী-এসইউসিআই-জামাতে উলেমা হিন্দ -সবাই।  সাথে ঘাঁটি বেঁধেছিলো মাওবাদীরাও। এই ঘটনায় অগ্নিসংযোগ করে শুধুমাত্র দুটো ঘটনা--একটি  ২৩শে ডিসেম্বর সিপিআইএম এর শিল্পায়নের দাবিতে রাজারামচক থেকে সোনাচূড়া পর্যন্ত মিছিল আর দ্বিতীয়টি তার কদিন পরেই সংবাদমাধ্যমে বেরোনো একটি খবর, সালিম গোষ্ঠীর সাথে রাজ্য সরকারের একটি মৌ স্বাক্ষর।

২০০৭ এর  ২রা জানুয়ারি গঠিত  হয়ে যায় 'ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি' যথেষ্ট সময় এবং  চিন্তা করে ব্যাপক একটি পরিকল্পনার ওপরে ভিত্তি করে আগ্নেয়গিরির প্রথম বিস্ফোরণটা ঘটলো তার পরেরদিন অর্থাৎ ৩রা জানুয়ারি। শুরু হলো গোটা নন্দীগ্রাম জুড়ে অশান্তি। মাত্র দুই তিনদিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো গোটা নন্দীগ্রামকে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা অবশ্যই অনস্বীকার্য্য, সাথে ছিল অবশ্যই গ্রাস রুটে পার্টির প্রতিরোধের ব্যর্থতা।

এই সব ঘটনা চলছে যখন তখন মহাকরণে বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য জানান, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের কোনো সরকারি বিজ্ঞপ্তিই জারি হয়নি। নন্দীগ্রামের মানুষ না চাইলে সেখানে কোনো কোনো শিল্প হবে না, জমি অধিগ্রহণের তো প্রশ্নই নেই।

নন্দীগ্রামের সিপিআইএম বিরোধী রংধেনু জোট এতে কিন্তু কর্ণপাত করা দূরের ব্যাপারে, তারা ধরে নেয় সরকার পিছু হাটছে তাদের ভয়ে, এইখান থেকে শুরু হয় নন্দীগ্রামে সিপিআইএম কর্মীদের ওপর নৃশংস অত্যাচার, খুন হতে থাকে একের পর এক কর্মী, কেবল দুদিনে  জ্বালিয়ে দেওয়া, ভেঙে দেওয়া হয় ১০০র ওপর বাড়ি, হামলা চলতে থাকে সিপিআইএম এর পার্টি অফিস এবং দপ্তর গুলোতে। ৭ই জানুয়ারি পাঁচজন সিপিআইএম কর্মীকে ইট পাথর দিয়ে থেঁতলে কুপিয়ে পিটিয়ে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে ফেলে খুন করা হয়, এই পাঁচজন -বিশ্বজিৎ মাইতি (সাউডখালী), ভুদেব মন্ডল(সোনাচূড়া), রবীন ভূঁইয়া, সুদেব মন্ডল (সোনাচূড়া), শঙ্কর সামন্ত( তাল ডাংরা)। এদের মধ্যে শঙ্কর সামন্ত ছিলেন পঞ্চায়েত সদস্য। তাকে ছুড়ি দিয়ে চিরে জ্বলন্ত খড়ের গাদায় ছুড়ে ফেলা হয়। ভুদেব মন্ডলকে তাঁর পরিবারের লোকজনের সমানেই ইট দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয়। শিল্প হওয়া দূরের ব্যাপার, শিল্প হচ্ছে না ঘোষণার পর ও আরো বেশি করে চলেছে এই হত্যালীলা। মাত্র দিন চারেকের মধ্যে সহাস্রাধিক সিপিআইএম কর্মী নিরাশ্রয় হয়ে নন্দীগ্রাম ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে পাশের খেজুরী, কনতাই, পটাশপুরের মতো সংলগ্ন অঞ্চলে। এর পরেই ঘটে যায় সেই ১৪ই মার্চের তোলপাড় করা ঘটনা, মুহূর্তের মধ্যে সংবাদমাধ্যম সহ সুশীল বুদ্ধিজীবী মহলের  তরফ থেকে শুরু হয়ে যায় মুখ্যমন্ত্রী সহ সিপিআইএম এর মুন্ডুপাত, একদিকে চলছে যেখানে মুন্ডুপাত, আরেকদিকে ঠিক এই ঘটনার পরেরদিন থেকে নন্দীগ্রাম হয়ে ওঠে সিপিআইএম কর্মীদের সমাধি ক্ষেত্র, নিত্যদিন ৩-৪ টে সিপিআইএম কর্মীদের মৃতদেহ ছিল নন্দীগ্রামের নিউ নরমাল। অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যায় কল্পনাতীত সীমা , নিত্য নতুন উপায়ে চলতে থাকে হত্যা প্রক্রিয়া, এর মধ্যেই নির্মম ভাবে গণধর্ষণের পর খুন হন সিপিআইএম এর আরেক পঞ্চায়েত সদস্য সুনিতা জানা, তালিকা এর পর শুধু দীর্ঘ হতে থেকেছে। নৈরাজ্য এবং 'গণতন্ত্রের হত্যাকারী' সিপিআইএম এর বিরুদ্ধে সেই সময় 'সদা সক্রিয়', 'সদা জাগ্রত' একটাও ব্যক্তি বাম অথবা বুদ্ধিজীবি মহল থেকে ওঠেনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। রংধেনু জোটের 'মুক্তাঞ্চলে হয়তো এই হত্যালীলাই ছিল তাদের কাছে নব্য যুগের প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিপ্লব।

এর পর সাত আট মাস যাবৎ গৃহ হীন সেই সহস্র সিপিআইএম কর্মীদের পরিস্থিতির এতটুকু বদল হয়নি  , ঈদ দুর্গাপুজো তাদের কাটাতে হয়েছে পাশের এলাকায় নয়তো ত্রাণ শিবিরে আর এর পাশাপাশি নন্দীগ্রাম তো তখন শ্মশান। রোজ ৩-৪টে লাশ পরছে সিপিআইএম কর্মী, সমর্থকদের, বাদ যায়নি সাধারণ মানুষও। যারা পালিয়ে আসতে সফল হননি অথবা মোহন মন্ডল, মীর খুরশেদ, চঞ্চল মিদ্যার মতো যারা  শেষ মুহূর্ত অব্দি থেকে যেতে চেয়েছেন অকুতোভয় হয়ে গর্বের সাথে লাল পতাকাকে আঁকড়ে, মূল্য চোকাতে হয়েছে প্রাণের বিনিময়ে।

অনেক আগেই পার্টি মেশিনরীকে ব্যবহার করে কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, যা নিতে ব্যর্থ হলেও এবার সহ্যর সব বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর ২০০৭ এর নভেম্বর মাসে সিপিআইএম  তাদের কর্মীদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা করতেই জ্বলে ওঠে অশান্তির আগুন। ঘরের ফেরার এই লড়াই ও কম ভয়ঙ্কর ছিল না। হাজার অনুরোধ, প্রশাসনিক দিক দিয়ে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার প্রচেষ্টা, হাজার আকুতি মিনতি সত্ত্বেও বিরোধী  রঙধেনু জোট কর্ণপাত না করে উল্টে তাকে সরকারের দুর্বলতা ভেবে সিপিআইএম কর্মীদের খতম অভিযান জারি রাখার  ফলস্বরূপ  নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখ ওই ঘরে ফেরার পর্বে সিপিআইএম কর্মীদের সশস্ত্র অভিযান ছিল পাল্টা প্রতিরোধ মাত্র (যে প্রতিরোধ. দরকার ছিল আরো আগে থেকেই), এই অভিযান প্রসঙ্গেই বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য বলেছিলেন 𝗧𝗵𝗲𝘆 𝗵𝗮𝘃𝗲 𝗯𝗲𝗲𝗻 𝗽𝗮𝗶𝗱 𝗯𝘆 𝘁𝗵𝗲𝗶𝗿 𝗼𝘄𝗻 𝗰𝗼𝗶𝗻 " 

কোনোভাবেই এই কথা ১৪ই মার্চের দিন বলেননি উনি, বলেছিলেন ৮ মাস পর নিজের কর্মীদের আত্মরক্ষা প্রসঙ্গে।এবার প্রশ্ন উঠতে পারে উনি কী তাহলে এটা বলে ভুল করেননি, আমার মতো অনেকের মতেই হ্যা উনি ভুল করেছিলেন, বিশাল বড়ো ভুল করেছিলেন, এই মানসিকতা উনার শুধু ওই একদিনের জন্য নয়, গোটা ১০টা বছরই দেখানো প্রয়োজন ছিল,  সিপিআইএম এর একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসাবে উনার এই সফ্ট স্টান্স এর প্রবল সমালোচক আমি। 

যাই হোক শুধু একবার দেখা যাক ১৪ই মার্চ ঘটনা ঘটার পর বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্যর কি প্রতিক্রিয়া ছিল। অন্তত সিবিআই এর অফিসিয়াল রেকর্ড মতে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে। সেইদিন বিধানসভাতে অধিবেশন চলছিল, গুলি চালানোর ঘটনা শুনেই  হতবাক হয়ে যান বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য। বেশ কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থাকেন, চোখে মুখে চূড়ান্ত হতাশার ছাপ স্পষ্ট, তারপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় একটাই কথা বলেন "গুলি চললো কেনো? গুলি চালানোর তো কথা ছিল না। কি এমন পরিস্থিতি হলো যে গুলি চালাতে হলো!" সেদিন বিধানসভায় কোনো সরকারি বিবৃতি দেননি তিনি, চূড়ান্ত হতাশা থেকে বাকি সময় নিজের ঘরেই কাটিয়ে দেন তিনি। "

 কৃষি নির্ভর এই রাজ্যকে একটি উন্নত শিল্প ভিত্তিক রাজ্যে পরিণত করতে চাওয়ার ব্যাপারে তার পার্টির  সিদ্ধান্ত এবং তার নিজের বাসনার  এরকম  পরিণতি হতে দেখে আত্মগ্লানি এবং অভিমানের মধ্যেই ডুবে গেছিলেন খানিক। ভাবতেও পারেননি সেই সময় থেকেই যে বৃহৎ ষড়যন্ত্রর উল্লেখ করতে গিয়ে বারবার অতি বোদ্ধা, ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কাছে  হাস্যস্পদে পরিণত হয়েছিলেন তিনি এবং তার পার্টি, আজ ১৪ বছর পর সেই সময়ের এই ষড়যন্ত্রের মূল ঘুঁটি নিজের বিনাশকালে, একটি মরিয়া প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে এই ষড়যন্ত্রের মিসিং লিংক গুলো জুড়ে দেবেন।  যাই হোক সব চেয়ে বড়ো মিসিং লিংক এখনো বাকি। সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা দিলে মানুষের জেনারেল কনসেনসাসে গ্রহণযোগ্য হয় না, সময় মতো তাই অন্তিম মিসিং লিংক হিসাবে সিআইএ যোগসূত্র টাও প্রমান হবে। সবে তো শুরু।

P. S-  ওপরের লেখার প্রমান হিসাবে নিচে বিখ্যাত সাংবাদিক অঞ্জন বসুর বই "বাংলায় বামেরা : রাজ পথে ও রাজ্যপাটে"  বই এর দুটো পাতার ছবি কমেন্ট সেকশনে দিয়ে রাখলাম।

.

নন্দীগ্রাম ~ সুশোভন পাত্র

পাঁচ বছর আগে এক সন্ধ্যায় প্রথমবার আলিমুদ্দিন গিয়ে ঘড়ি ধরে ৩০ সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। মাথা ভর্তি সাদা চুল,  গাল ভর্তি দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে বুদ্ধবাবু, 'ফিরে দেখা'র ডিকটেশন দিচ্ছেন। আমি লেখালিখি করার চেষ্টা করি শুনে বললেন, 'লেখ। আমাদের যে ভুলের কথা গুলো কেউ লিখছে না, সেগুলোই সাহস করে লেখ।' 
কাল যখন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রামের স্বীকারোক্তি শুনেছি, পাঁচ বছর আগের সন্ধের ৩০ সেকেন্ডের ঐ অমলিন মুহূর্তটা চোখে ভাসছে বারবার। বুদ্ধবাবু মাফ করবেন। আমি আজ 'আমাদের ভুলের' কথা লিখতে বসিনি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নন্দীগ্রাম এবং পরে সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যে, দেশে, বিদেশে আপনার বিরুদ্ধে, বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে, 'আমাদের' বিরুদ্ধে; প্রতিদিন, 'ভুলের' নামে ষড়যন্ত্রের গালগল্প লেখার, কাব্য করার ছ্যাবলামি অনেক হয়েছে। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!  
তৃণমূল তো ছিলই। গৃহপালিত মিডিয়া তো আছেই। বিসেলেরির ঠাণ্ডা বোতলে চুমুক দিয়ে, কালো সানগ্লাস চোখে চাপিয়ে শহীদ বেদী তে লাথি মারা বুদ্ধিজীবী, কফি হাউসের সিগারেটখোর আঁতেলবাজ, সিপিএম'র থেকে আর একটু বেশি লেনিন জানা স্বাধীন-লিবারেল অণু কিম্বা আর একটু বেশি মার্ক্স বোঝা সংশোধনবাদী সিপিএম কে 'প্রকৃত বিপ্লবের' শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া অতি বাম পরমাণু –নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের আদ্যোপান্ত ষড়যন্ত্র কে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস'-র স্ট্যাম্প মেরে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে অবিরাম। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!
মর্ফড ছবিতে আপনার মুখে ক্যানাইন দাঁত বসিয়ে, আপনার পাঞ্জাবি তে রক্তের দাগ লাগিয়ে, আপনাকে 'খুনি বুদ্ধ' হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে, পুঁজিবাদের দালাল সাজিয়ে দিয়ে, 'পরিবর্তন চাই' ফেস্টুনে দাঁত কেলিয়ে, নেতা-মন্ত্রীর টিকিট বাগিয়ে, রেল কমিটির ল্যাজ ধরে পয়সা কামিয়ে, ক্যাডবেরি খাওয়া 'অনশন'-'আন্দোলনের' দোহাই দিয়ে রাজ্যটাকে ১০ বছর পিছিয়ে দেওয়া অনুঘটকদের মাতব্বরি অনেক হয়েছে। আর না, বুদ্ধবাবু মাফ করবেন!  
দৃপ্ত কণ্ঠে, কলার তুলে, বুক বাজিয়ে আবারও বলতে চাই; আগেও বলছি, পরেও বলব –কোন ভুল সেদিন বুদ্ধবাবু করেননি। কোন ভুল সিদ্ধান্ত সেদিন বামফ্রন্ট সরকার নেয়নি। কোন বিচ্যুতি সিপিএম-র হয়নি। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে একইঞ্চি 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' হয়নি। যা হয়েছিল সেটা আগাপাশতলা  নোংরা রাজনৈতিক চক্রান্ত। আদ্যোপান্ত একটা ষড়যন্ত্র।   
টানা বাহাত্তর দিন পুলিশ-প্রশাসনের প্রবেশ নিষিদ্ধ তখন নন্দীগ্রামে। বিস্তীর্ণ এলাকা তখন অবরুদ্ধ নন্দীগ্রামে। ভাঙা রাস্তা, ভাঙা সেতুর দৌলতে বিপন্ন, বিচ্ছিন্ন জনজীবন নন্দীগ্রামে। 'জমি আন্দোলনে'র সলতেতে সাম্প্রদায়িকতার বারুদ তখন নন্দীগ্রামে। বিরোধী নেতা-সাংসদ'দের মদতে বেআইনি অস্ত্রের পাহাড় জমছে তখন নন্দীগ্রামে। একদিনে সিপিএম'র ২৫টা পার্টি অফিসে আগুন জ্বলছে তখন নন্দীগ্রামে। নিয়ম করে শঙ্কর সামন্ত, সুনীতা মণ্ডলদের লাশ পড়ছে তখন নন্দীগ্রামে। 
লাগাতার হামলা শুরু হয় শিল্পের পক্ষে থাকা গ্রামবাসীদের উপর। কেউ ঘরছাড়া, কেউ খুন, কেউ ধর্ষিতা। প্রশাসনের ডাকা সাত-সাতটা শান্তি বৈঠকে যোগ দিলো না তৃণমূল। ৯'ই ফেব্রুয়ারি যেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু হেড়িয়ার জনসভায় বলেছিলেন "মানুষ না চাইলে কেমিকাল হাব হবে না নন্দীগ্রামে। অধিগ্রহণ হবে না এক ইঞ্চি জমিও"; ঠিক সেদিনেই পেট চিরে পুলিশ কর্মী সাধুচরণ চ্যাটার্জি'র লাশটা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল হলদি নদীর জলে।
কি করত সরকার? বুড়ো আঙুল চুষত? ললিপপ খেতো? ১৪ই মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশকে গোপনে পাঠায়নি বামফ্রন্ট সরকার। ১২ই মার্চ সাংবাদিক সম্মেলন করে পুলিশ যাওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে তবেই নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢুকেছিল। শখে গুলিও চালায়নি পুলিশ। মাইকে ঘোষণা, কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট, শূন্যে গুলি -আইনি কপিবুকের ক্রনোলজিতে ভুল করেনি সেদিন পুলিশ।
২০১৪'তে নন্দীগ্রামের ঘটনার চার্জশিট জমা দিয়েছিল সিবিআই। সিপিএম'র 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' কোন নিদর্শনই খুঁজে পায়নি সিবিআই। তালপাটি খালে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে 'সিপিএম'র হার্মাদ বাহিনীর হাতে পা চিরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটাও শিশুর লাশ খুঁজে পায়নি সিবিআই। গোটা নন্দীগ্রাম ঘুরে একটাও 'স্তন কাটা মহিলা' খুঁজে পায়নি সিবিআই। 
বরং চার্জশিটে বলা হয়েছিল, সেদিন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়া হচ্ছিল। বলা হয়েছিল, হামলাকারীদের হাতে তীক্ষ্ণ অস্ত্র ছিল। বলা হয়েছিল, "নন্দীগ্রামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসন এবং পুলিশ অফিসাররা চেষ্টা করেছিলেন। বৈঠকে বিরোধী দলগুলির নেতা এবং ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অনুপস্থিতির জন্য তা সম্ভব হয়নি।" 
যারা এরপরেও ২০১১-র বামফ্রন্টের নির্বাচনী পরাজয় কে স্বাভাবিক গণতন্ত্রীয় লিনিয়ার ইকুয়েশন মনে করেন, নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর কে সিপিএম'র 'ক্লাস ক্যারেক্টার'-র স্খলন বলে মনে করেন, কিম্বা নেত্রী মমতার একক রাজনৈতিক ক্যারিশ্মার জাবর কাটেন, তারা কি বলতে পারেন ক্ষমতায় এসে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের পদন্নোতির ব্যবস্থা কেন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? বলতে পারেন, কেন তৃণমূল-মাওবাদী-জামাতের নেক্সাস কে প্রচুর অস্ত্র মজুতে মদত দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? 
আর যারা বিজেপির বাইনারি তে দোল খাচ্ছেন তারা কি বলতে পারেন, কেন্দ্রীয় সরকারের একই সময় অনুমোদিত নন্দীগ্রামের মতই একটি পেট্রো রসায়ন শিল্প তালুক গুজরাটের দাভোসে হল কি করে? আর হলে, এখানে বিজেপি, সেদিন তৃণমূলের শিল্প বিরোধী ষড়যন্ত্রের পার্টনার ছিল কি করে? না, গুজরাটের মত আম্বানিদের বরাত না দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে শিল্প করতে চেয়েছিল বলে বিজেপির গোঁসা হয়েছিল? কিম্বা আরএসএস-র দুর্গা কে পলিটিক্যাল মাইলেজ দিতে হবে বলে কি বিজেপি কসম খেয়েছিল? 
চার আনার পলিটিক্যাল পণ্ডিতরা সেদিন বলেছিলেন বুদ্ধবাবুর 'নৈতিক পরাজয়'। মাননীয়া বলেছিলেন বামফ্রন্টের কৃতকর্মের 'পাপস্খলন' । জানতে চাই কোন পাপস্খলন? কিসের নৈতিকতা? আজ যে, নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাওয়া বাংলার যুব সমাজের হিমোগ্লোবিনে প্রতিদিন মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মের আফিম; ভেঙে ফেলা হচ্ছে হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-অবাঙালি, রাজবংশী-মতুয়ার আইডেন্টিটির টুকরোতে -সেই পাপস্খলনের দায়িত্ব নেবার যোগ্যতা, তার দায় বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা অবশ্য সেদিনও মাননীয়ার ছিল না, আর আজও নেই। রাজ্যের যুব সমাজের এই সামাজিক ও নৈতিক স্খলন চাক্ষুষ করার মত দূরবীন সেদিনও জাতীয় সড়ক অবরোধকারী অনশন মঞ্চে ছিল না, আজও নবান্নের চোদ্দ তলায় নেই। 
না! আজকে নন্দীগ্রামের চক্রান্তের পর্দা ফাঁস হয়ে গেছে বলে প্রায় শয্যাশায়ী, রোগাক্রান্ত বুদ্ধবাবুর নামে সিম্প্যাথি কুড়িয়ে ভোটের বৈতরণী পেরোনোর চেষ্টা করছে না সিপিএম। হুইলে চেয়ারের মেলড্রামা কিম্বা দাড়ি বাড়িয়ে জোকার সেজে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার বদভ্যাস বামপন্থীদের কোনদিন ছিল না। আজও নেই।   
বরং আপামর দুনিয়ার বহমান কমিউনিস্ট আন্দোলনের ও পুঁজিবাদের দ্বান্দ্বিকতার যে  প্রেক্ষিতে বুদ্ধবাবু বাংলা কে গড়ার চেষ্টা করেছিলেন সেই সময়ে, রাজ্য তো বটেই, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও তার গুরুত্ব বোঝে সিপিএম। ৬২ সাংসদ নিয়ে অপ্রতিরোধ্য বামেদের সেই সময় বোতলবন্দী না করতে পারলে কোন শ্রেণীর মানুষের ক্ষতি হতে পারতো সেই শ্রেণীশত্রুদের চেনে সিপিএম। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর জঙ্গলমহল, কিম্বা গোর্খাল্যান্ড -সেই সময়ের বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে রামধনু জোটের বে-নি-আ-স-হ-ক-লা, প্রতিটা রঙ কে আলাদা করে বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে সিপিএম-র। রাজনীতির রিলে রেসে বুদ্ধবাবুর তুলে দেওয়া ব্যাটন নিয়ে লড়াই করার বারুদ বুকে আছে আমাদের। আর তাই সিম্প্যাথি কুড়োতে নয় লড়তে শিখতে হয় আমাদের।   
ফিদেল বলেছিলেন History will absolve me। বুদ্ধবাবু বলেছিলেন "একটা বড় চক্রান্তের শিকার রাজ্য। ১০ বছর মানুষ ঠিক বুঝতে পারবেন।" পারছেনও। পারবেনও। History কি Absolve করবে কি করবেনা সেটা সময় বলবে। কিন্তু ইতিহাস পড়ার জন্য নয়, ইতিহাসে গড়ার জন্যই লড়ছি আমরা। লড়ছে মীনাক্ষী, লড়ছে সায়নদীপরা। লড়ছে আকিক ,সাদ্দাম, প্রতিকুর, সৃজনরা। লড়ছে দিপ্সিতা-ঐশী-পৃথা-সেলিম-সুজন-পলাশরা। লড়ছি আমরা, বামপন্থীরা। লড়ছি রাজপথে। লড়ছি আলপথে। হেঁটে এবং নেটে। লড়ছি নির্বাচনেও। লড়ব নির্বাচনের পরেও। লড়ব শেষতক। জিতব শেষতক।

বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১

সংযুক্ত মোর্চা বনাম বিজেমূল ~ সুশোভন পাত্র

শাট আপ! ধর্ম নিরপেক্ষতার জ্ঞান কে দিচ্ছে? তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা? কিষানজীর কোয়ার্টার-হাফ-ফুল চামচারা? মার্কামারা বিজেপি? তাদের আদর্শগত বাপ সঙ্ঘ পরিবার? না চার আনার আইটি সেলের ভক্তরা? মুখে ঝামা ঘষে বলে দিন ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে বামপন্থীদের জ্ঞান দেওয়ার যোগ্যতা এদের কোনদিন ছিলনা। আজও নেই। পরেও থাকবে না। 
ধর্ম নিরপেক্ষতার জ্ঞান কে দিচ্ছে? সিমির দালাল আহমেদ হাসান ইমরানকে যারা রাজ্যসভার টিকিট দিয়েছিল? সিদ্দিকুল্লাকে মন্ত্রী বানিয়ে যারা ঠুমকা নেচেছিল? বরকতিকে যারা ব্রিগেডের মঞ্চে তুলে ভাঁজ দেওয়া সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল? না যারা, সরকারি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামনে 'জয় শ্রী রাম' শ্লোগান শুনে মুচকি হেসে রোয়াব নিয়েছিল? গেরুয়া পোশাকের ক্লাউন আদিত্যনাথ কে গতকাল মালদাতে দাঙ্গা লাগাতে চরতে ছেড়েছিল? প্রজ্ঞা ঠাকুরদের পুষে লোকসভা তে পা রাখতে শিখিয়েছিল? বামপন্থীদের ধর্ম নিরপেক্ষতা শেখাবে এরা? জাস্ট শাট আপ!     
ফেজ টুপির সিদ্দিকি বামপন্থীদের হাত ধরলে গায়ে ছ্যাঁকা লেগেছে? ISF-র সভাপতি শিমুল সোরেন। মুসলিম নন, আদিবাসী। ISF-র সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকেই তফসিলি জাতি ও অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষ। তথাকথিত 'হিন্দু'। তবুও ফেজ টুপি দিয়েই দল চিনবেন, তাই তো? বেশ, চিনুন। রাজনাথ সিং মাথায় ফেজ টুপি পরলেও চিনুন, মোদী ভোটের আগের সলমান খানের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ালেও চিনুন, লকেট হাঁটু মুড়ে দোয়া চাইলেও চিনুন, আর মমতা হিজাব দিয়ে ইফতার পার্টি তে গেলেও চিনুন। আছে হিম্মত?   
আসলে বিজেমূলের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে ব্রিগেড। একদিকে 'যে গরু দুধ দেয় তার লাথ তো খেতেই হবে' বলে দিদি মুসলিম ভোট কুড়বেন, আর অন্য দিকে 'হিন্দু খতরে ম্যা' বলে বিজেপি হিন্দু ভোট কনসলিডেট করবে, রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে দাদা-দিদি মুজরা দেখবেন আর মিডিয়া আম্বানিদের পা-চাটার ব্লু প্রিন্ট রেডি করবে –প্ল্যান গুলো ভেস্তে যাচ্ছে? কি তাই তো?    
ভেবেছিলেন, ফেজ টুপি পরে আব্বাস সিদ্দিকি বক্তৃতা করলেই 'মোল্লাদের ব্রিগেড' বলে দাগিয়ে দেবেন! ভেবেছিলেন, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে দুধের দাঁত না ভাঙা সিদ্দিকি বক্তৃতার সময় একটা ফাউল করলেই লাল কার্ড দেখিয়ে দেবেন, ভেবেছিলেন আস্সালাম ওয়ালেকুম, ইনশাল্লাহ বা খোদা হাফেজ দিয়ে বক্তৃতা করবেন, ভেবেছিলেন মঞ্চের উপর থেকে না হোক নীচ থেকে কমপক্ষে আল্লা-হু-আকবর, নারায়ে তকবীর শুনবেন –প্ল্যান গুলো ভেস্তে গেছে? কি তাই তো? 
সিদ্দিকি থেকে দেবলীনা, সূর্য মিশ্র থেকে সেলিম হয়ে সীতারাম, ২৮শে-র ব্রিগেড জুড়ে রুজিরুটির কথা, চাকরির কথা, ধর্ম-জাত-বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িত শ্রেণীর কথা, বিকল্পের কথা –ঘাবড়ে গেছেন তো? বিজেমূল বিরোধী সমস্ত দলকে এক জায়গায় এনে সংযুক্ত মোর্চা গ্লুয়িং ফ্যাক্টর হিসেবে রকস্টার সিপিএম-র ভূমিকাকে দেখে চমকে চ হয়ে গেছেন তো? এতদিন তিল তিল করে গড়ে তোলা বাইনারি ন্যারেটিভটা ভেঙে যাচ্ছে দেখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তো? 
এসব একটু হবে! আগামী দু-মাস এরকম অনেক বাইনারি-টাইনারি, লেসার ইভিল-ফিভিলের ফান্ডা হুব্বা হয়ে যাবে। মানিয়ে নিতে অভ্যাস করুন। আব্বাস সিদ্দিকির পুরনো ভিডিও খুঁজে ক্যালোরি খরচা না করে, ২৪ বছরের তৃণমূলের ও তার সুপ্রিমোর ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে ছ্যাবলামির ইতিহাসটা দূরবীন দিয়ে দেখা অভ্যাস করুন। কামাল হাসানের ভূমিকায় সদমা সিনেমার শ্রীদেবীর মত 'লিবারেলদের' স্মৃতিশক্তির যত্ন নেওয়া অভ্যাস করুন।  
দেখবেন, দূরবীনে অতীতের প্রিজমে ধরা পড়বে, ৯২-র ৪ঠা ডিসেম্বর, অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা; সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে জনসভা ডাকল বামফ্রন্ট। আর সেদিনই সিধো-কানহু ডহরের সভায় মমতা বললেন, "সব সিপিএম'র ষড়যন্ত্র। বিজেপি অযোধ্যায় কিছুই করবে না।" মনে পড়বে, ৯৮-র লোকসভা ভোটে তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বিজেপি, আর ৯৯-এ এনডিএ-র শরিক মমতা হলেন রেলমন্ত্রী। ভেসে উঠবে, বিবিসি'র সাক্ষাৎকারে এক ভদ্রমহিলা নিঃসংকোচে বলছেন "বিজেপি তৃণমূলের ন্যাচারাল অ্যালি"। দাঙ্গা পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর মোদী কে অভিবাদন জানিয়ে পুষ্পস্তবক পাঠাচ্ছেন মমতা ব্যানার্জি। কিম্বা দিল্লিতে 'পাঞ্চজন্য'র অনুষ্ঠানে সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে যিনি বলেছিলেন, ''আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনারা দেশকে ভালোবাসেন' -তার নামও মমতা ব্যানার্জি। গদগদ আরএসএস নেতারা যাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ''হামারি পেয়ারি দুর্গা" -তার নামও মমতা ব্যানার্জি।  
বামপন্থীরা সময়ের দায়িত্ব জানে। 'One Step Forward, Two Steps Back'-র গুরুত্ব বোঝে। সিপিএম'র হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে "কী করিতে হইবে" সে বিষয়ে প্রতিদিন হোয়াটস-অ্যাপে দু-মুঠো উপদেশ দেওয়া টেক্সাসের টেকনোক্র্যাট, ফেসবুকে পার্টি-লাইনের অন্তঃসার শূন্যতার গবেষক লন্ডনের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, পার্টির অভূতপূর্ব দিশাহীনতায় মাথায় হাত রাখা সাংবাদিক, 'সাম্প্রদায়িকতার ব্যাধি' নিরাময়ের ১০৮ প্রকার ওষুধ নিয়ে হাজির সবার থেকে একটু বেশি লেনিন জানা, একটু বেশি মার্ক্স বোঝা তাত্ত্বিক, সংশোধনবাদ কে 'প্রকৃত বিপ্লবের' শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া কফি হাউসের সিগারেটখোর বিপ্লবী  -এদের সামনে দাঁড়িয়েই ১০০ বছরের বেশি পথ চলছে সিপিএম। এবারও চলবে। 
অভাব-অভিযোগ-কুৎসা-অপপ্রচার-আলোচনা-সমালোচনার বিষমসত্ততা নিয়েই সিপিএম। সাংগঠনিক সাফল্য কিম্বা ব্যর্থতা, নির্বাচনী জয় কিম্বা পরাজয়, আদর্শ বোধের বিচ্ছুরণ কিম্বা বিচ্যুতি এই সব কিছুর বৈপরীত্য নিয়েই সিপিএম। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ চলায় রাজনৈতিক ও মতাদর্শ গত এই আক্রমণের আগুনে জ্বলে পুড়েই ইস্পাত কাঠিন্যে বলিয়ান আজ সিপিএম। রাশিয়ান দার্শনিক নিকোলাই চেরনিশেভেস্কি কে উদ্ধৃত করে লেনিন বলতেন "কমিউনিজমের পথটা সেন্ট পিটার্সবার্গের সবচেয়ে লম্বা এবং সুসজ্জিত নেভস্কি প্রস্পেক্টর রাস্তার মত সহজ সরল আর প্রশস্ত নয়। বরং কণ্টকাকীর্ণ"। ঐ কণ্টকাকীর্ণ পথেরই পথিক সিপিএম।
দীর্ঘ পথ চলতে গিয়ে সিপিএম মৌলানা হসরৎ মোহানী এবং অপরজন স্বামী কুমারানন্দ মিলিয়ে দিতে শিখেছে। "Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people"- বুঝতে শিখেছে। সিপিএম চিনছে, মৌলবাদীদের। চিনেছে সাম্প্রদায়িকদের। চিনেছে ধর্মপ্রাণ কিম্বা ধর্মভীরু সাধারণ মানুষদের। 
সিপিএম স্বপ্ন দেখে এমন একটা সমাজের যে সমাজে, টিকি কিম্বা দাড়ি, সবাই থাকবে মিলে মিশে, সবাই থাকবে নিজের মত।  নাস্তিক কিম্বা আস্তিক সবাই বাঁচবে রাজার মত। যে সমাজে ধর্ম পালনের অধিকার থাকবে। ধর্ম কে নিয়ে হাসাহাসি করার অধিকারও থাকবে। শিল্পী ঈশ্বর কে নিয়ে ব্যাঙ্গ চিত্র আঁকবে। ভগবানের শুঁড় কেন, চারটে হাত কেন, তিনটে মাথা কেন –যুক্তিবাদীরা প্রশ্নও করবে। দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙে দেওয়ার লোক প্রশাসন চালাবে। যে সমাজে ধর্মচারণ হবে ব্যক্তিগত। যে রাষ্ট্রের কাজ, সরকার পরিচালনা হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। 
৭৭-র বামফ্রন্ট সরকার হয়েছিল ৫ মিনিটের সিদ্ধান্তে। ৫২% আসন জনতা দল কে ছেড়ে দিয়ে সেবারও প্রকৃত জোট ধর্মই পালন করেছিল বামফ্রন্ট। রাজি হননি জয়প্রকাশ। পড়ন্ত বিকেলে ৫ মিনিটের সিদ্ধান্তে প্রমোদ দাশগুপ্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন ৫২% বেশি এক ইঞ্চি জমি ছাড়বেনা বামফ্রন্ট। ভেস্তে যায় জোট, ৭৭-র নির্বাচনে ১০০% আসনেই প্রার্থী দেয় বামফ্রন্ট। বাকি লড়াইটা হয়েছিল বুথে। বাকিটা লেখা আছে ইতিহাসে। 
রাজ্য রাজনীতি আরও একটা ঐতিহাসিক কঞ্জাংচারে দাঁড়িয়ে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। 'Concrete analysis of the concrete situation'- আরও একবার প্রকৃত জোট ধর্মই পালন করছে বামফ্রন্ট। সিদ্ধান্ত ভুল বা ঠিক হয় না। সিদ্ধান্তকে ভুল বা ঠিক প্রমাণ করতে হয়। তাই এবার ব্রিগেড যাবে বুথে। আগামী দু-মাস সংগ্রামের। আগামী দু মাস লড়াইয়ের। আগামী দু-মাস লেখা থাকবে ইতিহাসে।  
পাড়ার কুকুরটা খেপেছে। যাকে তাকে কামড়ে বেড়াচ্ছে। কুকুরের নাম বিজেমূল । মুগুরের নাম সংযুক্ত মোর্চা। পাগলা কুকুর কে মারবে যারা সব্বাই তারা এক দলে। এবার আপনি ঠিক করুন। কুকুরের সাথে থাকবেন, না মুগুরের। আমরা দাঁড়িয়ে আছি আপনার পাড়ার মোড়ে। পাগল কুকুর কে ঠাণ্ডা করার ডাণ্ডা নিয়ে। উন্নত বিকল্পের সরকার গড়ার ঝাণ্ডা নিয়ে।

মঙ্গলবার, ২ মার্চ, ২০২১

কেন সংযুক্ত মোর্চা ~ শমীক লাহিড়ী

এতো মহা মুস্কিলে পড়া গেল। লোক জুটে গেল , মাঠ ভরে গেল।বিরিয়ানি, মায় ডিম-ভাত খাওয়ানোর গল্প বের করা গেলনা। চিড়িয়াখানা-ভিক্টোরিয়া দেখতে ক'লকাতা আসার গল্পও নেই। পাকাচুলে ভর্তি ব্রিগেডের সবুজ ঘাসকে সাদা দেখানো – সেটাও খাওয়ানো যাচ্ছে না। ছবি অন্য কথা বলে দিচ্ছে। 

তাহলে? দুপুরে ব্রিগেড সভা চলার সময়েই মাথা চুলকে, ঘাড়ের ঘাম মুছে তৃণমূল-বিজেপি-র ভোট ম্যানেজাররা ভেবে কুল পাচ্ছিল না – এবারের ব্রিগেড নিয়ে কি বলা হবে!

কংগ্রেসের সবাই আসেনি, বলাও মুস্কিল। বিশাল সমাবেশে এসে অধীর চৌধুরী আপ্লুত, মান্নান সাহেবও সকাল থেকেই হাজির। দীপা দাশমুন্সীও বেসুরে গাইলেন না। যাকে দিয়ে অনেক কিছু বলিয়ে নেওয়া যায়, সেই মনোজ চক্রবর্তী ব্যস্ত সভা সুষ্ঠুভাবে চলার আয়োজনে। মহা মুস্কিল! 

বামফ্রন্টের শরিকদলের নেতাদের খুঁচিয়ে কিছু পাওয়া যাচ্ছেনা? ঠান্ডা ঘরের নির্দেশ পেয়ে বেচারা সাংবাদিকদের ২/১ জন নেতাকে খোঁচাতে গিয়ে উলটে বিদ্রুপ শুনতে হ'লো।

তাহলে! একজন লাইন দিল - '২০১৯ সালেও ব্রিগেড ভরেছিল - কিন্তু ভোট পেয়েছিল ৭%। তাই এবারের ব্রিগেড ভরলেও ভোট সেই ৭%। এটাই চালানো হোক।'

পালে পালে লোক হাজার হুমকি, বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, গাঁটের পয়সা খরচ করে শত-শত মাইল পথ পেরিয়ে ব্রিগেড এসেছে। এই ব্রিগেড ফিরে গিয়ে বুথেও মরণপণ লড়াই চালাবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? ৭%+৫%= ১৩% ভোট ছিল মরা ভোট বাজারেও, ২০১৯ এ ভাঁটার টানেও।

তাই এত লঘু বস্তাপচা কথায় ভোট ম্যানেজার কোম্পানির  বাবুদের মন ভরলোনা। ভাবো ভাবো। সময় নেই। এক্ষুনি টিভি তে নেমে পড়তে হবে। কাগজে লাইন নামাবার জন্য কয়েক ঘন্টা সময় পাবে, কিন্তু টিভি তে এক্ষুনি লাইন চালু করতে হবে। একবার যদি মানুষের মাথায় ঢুকে যায় বিজেপি-তৃণমূল এই দুইয়ের বিকল্প আছে, তাহলেই ঘোর বিপদ। 

অবশেষে কয়েকটা লাইন পাওয়া গেল - 
লাইন ১ - আব্বাস সিদ্দিকী মাঠে ঢোকার সময়ে, জনতার উচ্ছাসে থামতে হ'লো অধীর চৌধুরীকে। 
না!  শুধু এতে কি হবে? বলো - 'ক্ষুব্ধ  অধীর চৌধুরীকে ভাষণ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করতে হ'লো আব্বাস সিদ্দিকীর জন্য।'

কিন্তু এটাতে ঠিক সিপিআই(এম) কে জড়ানো গেলনা। আরও কিছু চাই। ৩০ মিনিট বাদে ভাষ্য পাল্টে হ'লো - 'সিপিআই(এম) নেতা মহঃ সেলিম, লোকসভার বিরোধী দলনেতা অধীর চৌধুরীকে ভাষণ শেষ করতে বললেন, আব্বাস সিদ্দিকী মঞ্চে প্রবেশ করার সময়ে। অপমানিত অধীর চৌধুরীকে কোনোক্রমে বিমান বসু সামাল দিলেন, তাঁকে আবার বলতে দিয়ে।' 

ঠিক আছে - চলবে। তবে এই মান-অপমানের ব্যাপারটা খুব খেলো করে দিয়েছেন ধনকর সাহেব। এত ঘন ঘন নানা ব্যাপারে অপমানিত বোধ করে 'অপমান' শব্দটার মান-সম্মান কিছু রাখেননি।

তাই আরও কিছু চাই। এভাবে ব্রিগেড জমায়েতের প্রভাব কিছুতেই মানুষের ওপর পড়তে দেওয়া যাবেনা। 

মাথা ঘামালেই উপায় বেরোয়। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বুদ্ধিমান জীব পুষেছে বিজেমূল , আর উপায় বেরোবে না, তা হয় নাকি!

এবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। নতুন লাইন নেমে পড়লো সূর্যাস্তের আগেই।

লাইন ২ -  ছিঃ ছিঃ!! একটা কমিউনিস্ট পার্টি শেষে কি না ধর্মীয় নেতার হাত ধরে  ব্রিগেডের স্টেজে তুলে এই আদিক্ষেতা করলো! ভাবা যায়! এখানে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-রা বক্তৃতা করতেন। সেখানে শেষে কি না...!! ছিঃ ছিঃ!

এই লাইনটা বেশ ভালো। ২০১৯ সালে যেসব বাম সমর্থক তৃণমূলকে হারাবার প্রবল স্পৃহায় বামদের জয়ের প্রতি সন্দিহান হয়ে বিজেপির ওপর আস্থা রেখেছিল, তাদের বাম ঘরে ফিরে যাওয়াও  রোখা যাবে। 

এই অংশের বাম সমর্থকেরা আবার ভাবতে শুরু করেছে - বামরা রাস্তায় লড়ছে। হাজার হাজার বাম ছাত্র-যুব কর্মী বেকারত্বের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়ছে। সহযোদ্ধার মৃত্যু বা পুলিশের ভয়াবহ অত্যাচারও এদের দমাতে পারেনি। বাম মহিলা কর্মীরা আত্মমর্যাদার দাবীতে সমবেত হ'য়ে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়েও পালায় নি। এ-সব মানুষ দেখছে। মিডিয়া না দেখালেও বিকল্প সামাজিক মাধ্যমে দেখছে। 

তাই বামের ছেড়ে যাওয়া সমুর্থকদের ফেরার পালা শুরুর আগেই এই ফিরে যাওয়া আটকাতেই হবে। তাই নেমে পড়ো সংবাদমাধ্যম। বসে পড়লো আলোচনা। যাদের ধরে আনা হ'লো, তারা যেখানে জমাতে পারলেন না ভালো, সেখানে সঞ্চালক/সঞ্চালিকারাই লজ্জার মাথা খেয়ে নেমে পড়লেন, চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে। পরের দিন সকালের কাগজে গুছিয়ে গল্প লেখা হ'লো। কোথাও আলিমুদ্দিনের অন্দরমহলের কল্পিত খবর,  কোথাও মাঠে আসা কল্পিত প্রবীণ বা নবীনের মুখে বলে নিজেদের ভাষ্য প্রচার - সবই চলছে বাজারী কাগজে। 

লাইন ৩ - কিন্তু শুধু এতেও হবে না। সংযুক্ত মোর্চাকে ভাঙতেই হবে। কিছুতেই একসাথে এত শক্তিকে রাখা যায় না। বিজেপি-তৃণমূল এই দুয়েরই ভোট কেটে নেবে এরা, আর এটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে এই দুই দলের স্পনসর কর্পোরেট আর তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া?  এ হতেই পারে না। 

খোঁচাও কংগ্রেসের নেতাকে, খোঁচাও IFS নেতাদের। দেখো খুঁচিয়ে কিছু বলানো যায় কি না! সংযুক্ত মোর্চা ভাঙার এই খেলায় টাকার বন্যা বইবে। মিথ্যে প্রচারের বন্যা বইবে। বাজারে অনেক এজেন্ট/এজেন্সি ঘুরবে। কারণ সংযুক্ত মোর্চার ঐক্য দুই শাসক দলের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

রাজ্যের হালহকিকত কি - সবারই জানা। রাজ্যে ১০বছরে কোনও নতুন কলকারখানা হয়নি। আগেরগুলোর বেশীরভাগই তোলাবাজির ঠেলায় পালিয়েছে রাজ্য ছেড়ে। লক্ষ লক্ষ সরকারি পদ খালি - কোনো নিয়োগ নেই। নিয়োগ মানেই ঘুষ দাও তৃণমূলের নেতাদের। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী রাজ্য ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে। 

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে টাকা দাও। নম্বর যতই থাকুক টাকা না দিলে প্রবেশ নিষেধ। মাস্টার মশাই/দিদিমণি  এই তোলাবাজির বিরুদ্ধে বললে, ধরে পেটাও। 

চাষীর ফসল সরকার আইন করে কার্যত ফড়ে দালালদের হাতে তুলে দিয়েছে। ফল? চাষি আলুর দাম পায় ৫/৬টাকা, আর সেই আলু ক্রেতাকে কিনতে হয়েছে এমনকি ৪৫ টাকাতেও। অবাধ পয়সা লুঠছে ফড়ে-দালালরা।

গ্যাসের দাম-তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। দেশে ৭০ বছরে যেটুকু সরকারি  সম্পদ তৈরি হয়েছে, সব তুলে দাও আদানি-আম্বানী বা অন্য কোনো বেসরকারি কোম্পানিকে। মানুষের জমানো ব্যাঙ্ক-বীমার টাকা লুঠের সুযোগও উন্মুক্ত হোক বেসরকারিকরনে - এটাই বিজেপির লক্ষ্য।

রাজ্যের-কেন্দ্রের সরকারের এইসব কাজের সমালোচনা বা  প্রতিবাদ করলেই হামলা নয়তো মিথ্যা মামলা। এই রাজ্যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার  নেই। এমনকি ভোটও দিতে পারেনা বহু মানুষ। পঞ্চায়েত পৌরসভার ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারটুকুও নেই। ওদিকে পার্লামেন্টে সাংসদদেরও ভোট দিতে দেয়না বিজেপি সরকার। 

রাজ্যের ক্ষমতায় স্বৈরাচারী শক্তি। কেন্দ্রে ফ্যাসিস্ট শক্তি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ কি করবে? জ্বলন্ত উনুন আর ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যেই তাদের জীবন আটকে থাকবে? 

এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি বা বাম আন্দোলন কি ভূমিকা গ্রহণ করবে? এটাই যদি প্রশ্ন হয় তাহলে উত্তর - দুই শক্তিকেই পরাস্ত করতে হবে। লেসার এভিল বা কম ক্ষতিকর গল্প চলেনা জীবন মরনের মুখে দাঁড়িয়ে। গোখরো না কেউটে - কোনটা বেছে নেবেন, এই আলোচনা পাগলেও করেনা।

কিন্তু কি ভাবে এই দুই শক্তিকেই হারানো আর ঠেকানো সম্ভব? এটা সম্ভব হবে তখনই, যখন সব স্বৈরাচার ও ফ্যাসীবাদ বিরোধী মানুষকে একসাথে এক মঞ্চে এনে লড়াই করা সম্ভব হবে। এই সব মানুষ বা রাজনৈতিক দলগুলো বা সামাজিক শক্তিগুলো অনেক প্রশ্নেই ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে, কিন্তু এই দুই মারণ-শক্তিকে পরাস্ত করার বিষয়ে সহমত থাকলেই, এদের ঐক্যবদ্ধ করার সর্বোচ্চ প্র‍য়াস চালাতে হবে।

সেই লক্ষ্যেই তৈরি হয়েছে *সংযুক্ত মোর্চা*। এই মোর্চার লক্ষ্য ব্রিগেড সভা থেকেই ঘোষিত হয়েছে। 

বাজারি সংবাদমাধ্যম ও বিজেপি-তৃণমূল যৌথভাবে এইজন্যই রে রে করে উঠেছে। নানা ভেক ধরে নানা প্রশ্ন তুলছে।

৭% ছিলে তাই থাকো। ৫% কংগ্রেসকে সাথে নেওয়ার সাথে সাথে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে কি সাংঘাতিক মাথা ব্যথা এক অংশের সংবাদমাধ্যমের। ৭ আর ৫ যোগ করলে তো মাত্র ১৩। তাতে এত  সমস্যা হচ্ছে কেন? কারণ এরা ভালোই জানে ভোটের অঙ্কে ৭+৫ সব সময় ১৩ হয়না। এই যোগফলটাই গত বিধানসভা নির্বাচনে ছিল ৩৬%। কারণ বিকল্প শক্তি জিততে পারে, এই বার্তাটাই বহু অতিরিক্ত ভোট টেনে আনে। আর বিচ্ছিন্ন হয়ে লড়লে কি হয় এই ৩৬% ভোটের, সেটা গত লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে।

তাই এই যোগ যাতে না হয়, সেইজন্যই বিজেপি-তৃণমূলের  ভোট ম্যানেজাররা অনেক এজেন্ট /এজেন্সিকে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। এদের সাদা চোখে দেখা যায় না। এরা কেউ ৭২-৭৭ সালে অত্যাচারিতের ভেক ধরে লিখছে। কেউ এই জন্যই সিপি আই(এম) ছাড়লাম, বলে ঘোষণা করছে।  নবগঠিত সংযুক্ত মোর্চার ভেতরে পঞ্চম বাহিনীর কেউ আছে কিনা খুঁজতে বেরিয়েছে টাকার থলে নিয়ে এরা। 

এবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া। তপশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু  মানুষরা গত ২/৩ বছর ধরেই ফুঁসছিল, তৃণমূল সরকারের বিশ্বাসঘাতকতায়, আর বিজেপির দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে। নানা সংগঠনের ছাতার তলায় এরা সংগঠিত হচ্ছিল।

এবার এরা সবাই মিলে একটা বড় মঞ্চ তৈরি করেছেন - ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। সভাপতি হয়েছেন শিমূল সোরেন আর সম্পাদক আব্বাস সিদ্দিকী। এদের লক্ষ্যও বিজেপি ঠেকাও, তৃণমূল হঠাও।

বাজারে বিজেপি-তৃণমূল এজেন্টরা এদের কাছে টানার জন্য কি না করেছে গত কয়েক মাস ধরে। সাফল্য না পেয়ে এখন মায়াকান্না জুড়েছে। এরা কত সাম্প্রদায়িক, জাতপাতের রাজনীতি করছে, সেই প্রচারে মত্ত হাতির মতো আচরণ করছে সংবাদমাধ্যম।

সোরেন-সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই নতুন দল ব্রিগেড মঞ্চে কি বলেছে? 

না মুখ্যমন্ত্রীর মতো আব্বাস সিদ্দিকী কথায় কথায় ইনশাল্লাহ বলেন নি। ইমাম ভাতা বা হজ যাত্রায় ভাতার দাবী তোলান নি। বলেছেন কর্মসংস্থানের কথা। প্রশ্ন করেছেন কেন চাকরি চাইতে আসা ছাত্র-যুবদের লাঠি মারলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পুলিশ। কেন পঞ্চায়েত-পৌরসভা- সরকারের টাকা লুঠ হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো সাম্প্রদায়িক? 

কোন কথাটা সাম্প্রদায়িক? কেউ তা বলতে পারছে না। বলছে কেন ফেজটুপী? মুখ্যমন্ত্রী হিজাবী টেনে ভাষণ দিতে পারেন অসুবিধা নেই, কিন্তু একজন মুসলমান কেন ধর্মীয় প্রথা মেনে ফেজ টুপি পড়েছেন সেই প্রশ্ন তুলছেন এরা কি উদ্দেশ্যে, সেটা স্পষ্ট। 

তৃণমূলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করলে অসুবিধা নেই, যোগী আদিত্যনাথ ঘৃণা ও খুনের রাজনীতির কথা প্রকাশ্যে বলেও বিজেপির নেতা হ'লেও অসুবিধা নেই, গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দেওয়া যায়, কিন্তু সব বেকারের চাকরির দাবি জানানো আব্বাস সিদ্দিকী সাম্প্রদায়িক? 
বাহঃ। চমৎকার যুক্তি!!

মুসলমান, তপশিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসী মানুষ  কোনো ভিক্ষা চায়না, চায় সংবিধান স্বীকৃত অধিকারের বাস্তবায়ন। ব্রিগেডের মঞ্চে এই কথা বলে কি সাংঘাতিক অপরাধই না করেছে সোরেন-সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ISF !!

অনেক বাম সমর্থক ভাবছেন, কাজটা কি ঠিক হ'লো! একজন ধর্মীয় নেতার দলের সাথে বাম দল কেন মোর্চা করবে? 

প্রথমত ধর্ম বিশ্বাস আর সাম্প্রদায়িকতা কি এক? কেবল নাস্তিকরাই কি বামপন্থী হবে? ধর্মাচরণে ব্রতী কি তবে ব্রাত্য বামদের কাছে? 

ধর্ম নিয়ে কার্ল মার্কসের বিখ্যাত উক্তির পুরোটা অনেকেই বলেন না, বলেন একটা অংশ - ধর্ম হ'লো আফিম। কার্ল মার্কস 'A Contribution to the Critique of Hegel's Philosophy of Rights'  লেখায় উল্লেখ করেছিলেন - "ধর্ম হলো শোষিতদের মর্মযাতনা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম হ'লো  আফিম।"

কার্ল মার্কস এই উক্তিটির মাধ্যমে ধর্ম‌কে আফিমের সা‌থে তুলনা ক‌রে‌ছি‌লেন। কিন্তু কেন ?

এই বিষয়‌টির গভী‌রে না গি‌য়ে মোল্লা, পু‌রো‌হিত, ধর্ম ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ না বু‌ঝে কিংবা না জেনে এক‌রৈ‌খিকভা‌বে সরল মানুষগু‌লোর কা‌ছে উপস্থাপন ক‌রে সাধারণ মানুষ‌কে ক‌মিউনিস্ট  বি‌দ্বেষী গড়ে তুলতে এর প্রকৃত ব্যাখ্যা উপস্থিত করে না কমিউনিস্ট বিরোধীরা। এমন‌কি অনেক ক‌মিউনিস্ট কর্মীও এই বিষয়‌টির স‌ঠিক মর্মার্থ উদ্ধার কর‌তে ব্যর্থ হয়ে পু‌রো বিষয়টি‌কেই গুলিয়ে ফে‌লেন।

আস‌লে মূল বিষয়‌টি হ‌চ্ছে, আজ‌কালকার ম‌তো তখনকার সম‌য়ে আফিম কোন নেশাদ্রব্য ছিল না। তখনকার চি‌কিৎসকরা ব্যাথা বা চেতনা নাশক হিসা‌বে আফিমকে ব্যবহার করতেন। আর মার্কস নি‌পীড়িত, শো‌ষিত মানু‌ষের কা‌ছে ধর্ম আফিম স্বরূপ বল‌তে এটাই বোঝা‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন যে - সমাজ থে‌কে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ, যন্ত্রনা, কষ্ট, অন্যায়, নির্যাতন লাঘবের চেষ্টায় যখন ‌কোনও ব্যা‌ক্তি ব্যর্থ হয়, তখন সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে সমস্ত অন্যা‌য়ের বিচা‌রের ভার সে অর্পন ক‌রে।

ধর্ম‌কে আশ্রয় ক‌রেই তার সকল যন্ত্রনা লাঘ‌বের চেষ্টা ক‌রে ‌কিংবা ভুলে থা‌কতে চায়। নি‌জে যখন বদলা নি‌তে ব্যর্থ হয়, তখন সে ম‌নে ক‌রে, এক দিন না এক‌দিন তার প্রতি এ অন্যা‌য়ের বিচার সৃ‌ষ্টিকর্তাই কর‌বেন। এ প্রেক্ষাপ‌টেই মার্কস এ উক্তিটি ক‌রে‌ছি‌লেন।

লেনিনের লেখা ধর্ম প্রসঙ্গে প্রবন্ধাবলীর মধ্যে 'সমাজতন্ত্র ও ধর্ম' প্রবন্ধটি এই প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য।  এখানে তিনি বলছেন - "ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে ঘোষণা করা উচিত। এই উক্তিতেই সাধারণত ধর্ম সম্পর্কে সমাজতন্ত্রীদের মনোভাব স্পষ্ট হয়।..... রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে বিবেচনার দাবী করছি। ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো গরজ থাকা চলবে না এবং ধর্মীয় সংস্থাসমুহের রাষ্ট্রের ক্ষমতার সাথে জড়িত থাকা চলবে না। যে কোনও ধর্মে বিশ্বাস  অথবা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না রাখার অধিকারে সবাই থাকবে স্বাধীন।''

এই প্রবন্ধেই তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন - কেন কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের পার্টি কর্মসূচীতে নাস্তিকতাবাদ ঘোষণা করেনি এবং কেন তা উচিত নয়। স্থানাভাবে সমগ্র উদ্ধৃতি উল্লেখ করলাম না, আগ্রহী পাঠকরা সমগ্র প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।

এই প্রসঙ্গে ফিডেল কাস্ত্রোর সাথে ব্রাজিলিয় ধর্মতাত্ত্বিক ফ্রেই ব্রিট্টোর একাধিক সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত একটি বইয়ের উল্লেখ হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবেনা। ১৯৮৫ সালে 'ফিডেল এন্ড রিলিজিয়ন' নামে এই বইটি প্রকাশিত হয়। 

কিউবার বিপ্লবের পর স্পেনের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সাহায্য করার জন্য সেই দেশের চার্চের প্রধানদের বিতাড়িত করেছিল নতুন বিপ্লবী সরকার। কিন্তু ধীরে ধীরে চার্চের ভূমিকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই দেশের সমাজতান্ত্রিক সরকারও তাদের পরিবর্তিত অবস্থান ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে স্বঘোষিত নাস্তিকদের দেশ কিউবা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে ঘোষণা করে। 

'আজকের যুগে যীশু জন্ম নিলে তিনি অবশ্যই আমাদের বিপ্লবীদের মতই প্রচার করতেন' - একথা ফিডেল ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন। 

কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্র ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানের পৃথক অস্তিত্বের কথাই বলে। কেউ কারোর কাজে নাক গলাবে না, এটাই আধুনিক রাষ্ট্রের মূল কথা - এটাই মনে করে কমিউনিস্টরা।

যারা এতদিন কমিউনিস্টদের নাস্তিক, ধর্ম বিরোধী বলে প্রচার করতো, তারাই এখন ধর্মীয় মানুষের সাথে কেন কমিউনিস্টরা হাত মেলাচ্ছে বলে গলা ফাটাচ্ছে। সত্যি কি বিচিত্র এদের প্রচার!!!

আমার মা ধার্মিক ছিলেন। নিয়মিত পূজা আর্চা ধর্ম পালন করতেন। কিন্তু তাতে আমাদের বাড়িতে আসমাদি'র কাজ করতে কোনো সমস্যা হয়নি। ওর রাঁধা ভাত আমরা দিব্যি পেটপুরে খেয়েছি। আসমাদি আমাদের বাড়ির ঠাকুর ঘরের সামনেই নমাজ পড়তেন, মা'কে কোনোদিন আপত্তি করতে শুনিনি। আমার মা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, ছিলেন ধার্মিক।

তাই ধর্মাচরণে অভ্যস্ত বা ধর্মীয়যাজকদের সাথে পথ চলতে অসুবিধা কিসের, যদি তিনি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরোধী হন?

যোগী আদিত্যনাথেরা ধর্ম পালন করেনা, ঘৃণার আগুন ছড়ায়। বিজেপি স্পনসর্ড ভোগ বিলাসে মত্ত 'বাবা রামরহিম বা আশারাম বাপু'-রা ধর্মের নামে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামায়। নরেন্দ্র মোদি ধর্মকে ব্যবহার করেন ক্ষমতা দখলের জন্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নন।

আর এদের সমর্থক বাহিনী প্রশ্ন তুলছে - কেন পীরযাদা ব্রিগেডে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই ত্রিশক্তির মিলনে বিজেপি-তৃণমূল আর এদের ক্ষমতায় রাখতে মরীয়া কর্পোরেটরা কেন থরহরিকম্প। এতদিন প্রচার চালাচ্ছিল - বিজেপি তৃণমূলের বিকল্প কেউ নেই, তাই অপছন্দ হলেও বাঁ হাতে মনসা পূজার মতো এই দুজনের কাউকে একটা ভোটটা দিয়ে দিন।

এখন প্রকৃত বিকল্প সামনে উঠে আসছে। যারা ধর্ম জাতপাতের বদলে কাজ, শিক্ষা, গণতন্ত্র,  সংবিধান স্বীকৃত অধিকারগুলোর বাস্তবায়নের দাবী করছে। 

এতদিন মুসলমানদের সামান্য কিছু ইমাম-মোয়াজ্জেম ভাতা ধরিয়েই ঠান্ডা রেখে দিব্যি এদের ভোট পকেটস্থ করতে পারছিল তৃণমূল। মুসলমানদের জুজু দেখিয়ে হিন্দুদের ভোটটাও পাচ্ছিল বিজেপি। কিন্তু ভাত-রুটি-কাজ- অধিকারের দাবী তুলে সব ঘেঁটে দিয়েছে *সংযুক্ত মোর্চা*। তাই  দেশের লগ্নি পুঁজির ধারক বাহকেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে, শিশু অবস্থাতেই একে হত্যা করতে।

এতদিন জাতপাত ধর্ম দিয়ে বেশ ভুলিয়ে রাখা গেছিল সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এই অংশকে। কিন্তু বামপন্থীরা এদের ভাত-কাপড়-কাজ-অধিকারের লড়াইতে এনেছে। দেশের মূল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টায় নেমেছে সিপি আই(এম)। হ্যাঁ, এটাই মূল কাজ এখন বামপন্থীদের। জড়ো করো বঞ্চিত, অত্যাচারিত, লাঞ্চিত সব মানুষকে, নিজের হক বুঝে পাওয়ার লড়াইতে।

ওরা চেয়েছিল - বামপন্থীরা ছুৎমার্গ দেখিয়ে এদের দূরে সরিয়ে রাখুক। ছূঁয়ো না ছুঁয়োনা ছিঃ, ও যে চন্ডালিকার ঝি - এই মন্ত্র বামপন্থীরা গেলেনি কোনোদিনই। কিন্তু  বামপন্থীদের থেকে সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল এই নিপিড়ীত মানুষদের। যেই ওদের ছলা-কলা- কৌশল বুঝে আদিবাসী, তপশিলি জাতি-উপজাতি, সংখ্যালঘুরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের সাথী হিসেবে বামপন্থীদের বেছে নিয়েছে - তখনই শুরু হয়েছে মিথ্যার নির্মান। 

যে সমস্ত স্বঘোষিত বামপন্থীরা প্রশ্ন তুলছেন কেন ধর্মীয় নেতার সাথে হাত মেলাচ্ছে সিপি আই(এম), তাঁরা কি ইতিহাস ভুলে গেছেন, না কি ইচ্ছে করে বলছেন না সেই অধ্যায়গুলো। সারা ভারত কৃষক সভার প্রথম সভাপতির নাম ছিল -   স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী। ১৯২১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনে প্রথম পূর্ণ স্বরাজের দাবী তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে উত্থাপন করেছিলেন কারা? একজন মৌলানা হসরৎ মোহানী এবং অপরজন স্বামী কুমারানন্দ। এইসব ইতিহাস ওরা আলোচনা করবে না, কারণ বকলমে তৃণমূলের হয়ে ঠিকেদারির অগ্রীম গ্রহণ  করে ফেলেছে এইসব স্বঘোষিত বামপন্থীদের অনেকেই।

তবে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের সাথে লড়াইটা হবে দীর্ঘ। লম্বা পথ। এই পথে চলতে গিয়ে অনেকেই আসবে। সবাই যে শেষ পর্যন্ত থাকে বা থাকতে পারবে, তার কোনও মানে নেই। এ অনেকটা দিল্লি গামী ট্রেনের মতো। হাওড়া থেকে ওঠা সব যাত্রী দিল্লি যায়না। অনেকে মাঝপথে নানা স্টেশনে নেমে যায়, আবার মাঝপথেই অন্য যাত্রী ওঠে। এই ওঠানামা চলতেই থাকে। সবাই দিল্লি পর্যন্ত যায়না। এই লড়াইয়ের দীর্ঘ পথেও তাই হয়।

সাবধান! অনেক ঝানু লোক মিত্র সেজে ঘুরছে সদ্যগঠিত *সংযুক্ত মোর্চা* ভেঙে দেওয়ার জন্যই। কেউ টাকার থলে নিয়ে, কেউ পরামর্শ দেওয়ার ছলে, কেউ বা নারদের ভূমিকায়। 

পোড় খাওয়া রাজনৈতিক নেতার মতো পাশ কাটিয়ে, কথা খেলিয়ে, কিছু কথা পেটে কিছু কথা ঠোঁটে,  আর অন্য কিছু মাথায় রেখে কথা বলা এখনো আয়ত্ব করে উঠতে পারেন নি, রাজনীতিতে নবাগত আব্বাস সিদ্দিকী। তাই একে দিয়ে ঐক্য বিরোধী কথা বলিয়ে নেওয়ার জন্য ঝানু সাংবাদিকদের লাগিয়ে রেখেছে কর্পোরেট মিডিয়া। সতর্ক অবশ্যই থাকতে হবে সংযুক্ত মোর্চার অন্তর্ভুক্ত সব কটি দলের নেতাদেরই। 

তবে হ্যাঁ মনে রাখতে হবে সংযুক্ত মোর্চায় অনেক দল আছে। তাই সব প্রশ্নে সবাই একমত হবে কেন? তাহলে তো একটা দলেই সবাই মিশে যেত। সবাই একমত হয়েছে - তৃণমূলকে হটিয়ে,  বিজেপিকে ঠেকিয়ে নতুন বাংলা গড়তে হবে, আগামীর জন্য।

তৃণমূল বা বিজেপি তো নিজেদের মধ্যেই মারামারি খুনোখুনি করে। ওদের সভা মানেই চেয়ার টেবিল ভাঙার প্রতিযোগিতা। আর এতগুলো দল নিয়ে সংযুক্ত মোর্চার প্রথম কর্মসূচী ছিল ব্রিগেড সভা। ১০লাখ লোক নিয়ে এমন সুশৃঙ্খল সভা করার হিম্মত আছে নাকি বিজেপি বা তৃণমূলের!!

এখন সুবর্ণ এক সুযোগ ও অধ্যায় সৃষ্টির মুখে বাংলা। জাতপাত ধর্মের বেড়াজাল ভেঙে ভাত-রুটি-কাজ- অধিকারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সংযুক্ত মোর্চা। এই ঐক্য অটুট রাখার দায় যেমন নেতাদের, তেমনি কর্মী-সমর্থকদেরও। মানুষের জন্যই এই ঐক্য অটুট রাখতেই হবে। ব্রিগেডের লড়াই নিয়ে পৌঁছে দিতেই হবে বাংলার পাহাড় থেকে সুন্দরবনের প্রতিটি বুথে। আগামী ২টো মাস ঐক্য আর সংগ্রামের মাস।

শমীক লাহিড়ী 
২রা মার্চ, ২০২১