অনিমেষকে…
অনিমেষ, তুমি কমন আছো আজ?...গিটারে কি বাজে "পরশপাথর" সুর ??
সেই ক্লাস এইট ; প্রথম কবিতাগুলো… জং ধরে গিয়ে আজ তারা ভঙ্গুর ।
স্কুলজীবনের একলা বেঞ্চি-কোণ, কতবার তুমি দেখা করেছিলে diary-র page-এ এসে;
ধোঁয়ার টানে ঘুলিয়ে ওঠে মন, জলে যেভাবে একফোঁটা কালি নরম হয়ে মেশে…
অনিমেষ, তোমায় প্রথম দেখি মানিকতলার বাসে, তুমিও হয়ত কোচিং-এই যাচ্ছিলে।
আমিও তখন সদ্য এগারো ক্লাসে, চোরাদৃষ্টিতে ঊষ্ণতা রেখেছিলে…
অনিমেষ, আজ বছর আটেক হলো, যাওয়া হয়না বহুদিন ওইদিকে,
স্কুল-কলেজেতে রঙীন গণ্ডী ছিলো, স্যুটেড ব্যুটেড মোড়কে তা আজ ফিকে।
অনিমেষ, হয়ত এখন অফিস ফাঁকা… অবসরে তুমি জানলার এক কোণে;
আমি তো রোজ-ই রাস্তা পেরোই একা, diary-তে নিয়ে তোমায় সঙ্গোপনে…
অনিমেষ, রোজ ঘুম ভেঙে উঠে দেখি, bank statement দিনে-দিনে হয় ম্লান;
কান্নারা আজ দলা পাকায় না ঠিকই, জীবন-পাশায় কৈশর খানখান।
অনিমেষ, খুব মনে পড়ে সেই দিন… ব্ল্যাকবোর্ড-এ ছিলো উপপাদ্যের নকশা,
উঠে দাঁড়িয়ে পড়া না পারার scene, শাস্তি পেলেই চোখের জলে ঝাপসা…
অনিমেষ, বড়ো একলা হয়েছি আমি ; হারিয়ে ফেলে ছোট্ট টিফিন-বাক্স,
কাড়াকাড়ি হত, ছিলো এমনই দামি, সেই বন্ধুরা রোজ এসে পাশে বসত ।
অনিমেষ, এই চিঠিখানা রইলো, মায়া লাগছিলো হঠকারিতাটি করতে…
শেষ করলাম মাঝপথে এই প্রাণ, শূন্য থেকেই আবার শুরু করতে।।
মাধবীকে ...
মাধবী, তুই কি হারিয়ে গেছিলি,
আমার ভেতর-বাইরে মনের উল্টোদিকে?
মাধবী, তুই তো বলেছিলি কবে,
কাগজ নৌকো ভাসিয়ে দিবি
সদ্য বিকেল সাক্ষী রেখে!
মাধবী, তুই কি এখনো তেমনই,
কাটা কাটা কথা, আবেগে তেমনই
আগের মতই পাগলামি তোর?
মাধবী, তোর কি মনে আছে সেই -
পায়ে পা মিলিয়ে মিছিলে স্লোগান
মন জুড়ে থাকা "ইনকিলাব"কে?
মাধবী, তোকে যে খুব খুঁজে পাই,
এই শহরের রাজপথ থেকে,
পার্ক স্ট্রীট হয়ে আউট্রামেও।
মাধবী, আমারও বয়স বেড়েছে -
গোঁফে রুপোলি ঝিলিক-
আফটার শেভ মাখলে এখন ঘুম আসে!
মাধবী, জানিস, মাঝে মাঝে যেন
শুনে ফেলি তোর হঠাৎ করেই নিঃস্তব্ধতা
ভেঙ্গে পাগল করা 'রবীন্দ্রনাথ' - তুই ই পারতিস!
মাধবী, তুই কি সত্যিই ছিলি?
নাকি পুরোটাই কৈশোরে লেখা
metamorphic চিত্রনাট্য?
অনিমেষকে... কিছু প্রশ্ন...
অনিমেষ, কিছু প্রশ্ন ছিলো তোমায়, বহুদিনের অপেক্ষা আজ ক্লান্ত,
থিতিয়ে গিয়েছে ঘলা জলের মাটি, উপেক্ষিত হয়ে সে আজ শান্ত।
অনিমেষ, সেই সোনালী দিনের স্কেচ, কোনো এক ট্রামে পাশেই দাঁড়িয়ে দুজন ;
বৃষ্টিরা সব অকারণ ছিলো বেশ…. বড় নিশ্চুপে ভিজে গেলো দুটি মন ।
অনিমেষ, রোজ কলেজ শেষের পর; বন্ধুরা মিলে তোমাদের গোলটেবিল,
হঠাৎ ছোঁয়ায় শিহরণ তারপর, বাস্তব থেকে বহু দূরে তার মিল…
কলেজে তখন ছাত্রনেতা তুমি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, ছেঁড়া জিনস্… পাঞ্জাবি,
একগাল দাড়ি, হাসিমুখ হলো বিষ… পান করে আরো নিলচে হলাম আমি।
একদিন ছিলো মনখারাপের দুপুর, ক্যান্টিনেতে এক কাপ চা, আমি একা…
ঝড়ের বেগে দিয়েই চলে গেলে, সেই চিঠিখানা আজও ডাইরিতে রাখা ।
অনিমেষ, সত্যি কিছুই জানিনা আমি, দিশেহারা আমি বুঝতে চাইনা কিছু ;
বেঁচেই যেতাম হলে অন্তর্যামী, মায়াবী শহরে আমি যে এখনও শিশু…
পেশা জানা নেই, নেশায় বাউল জানি… বুঝিনি ঝড়ে একলা পড়ে তুমি,
একা দাঁড়িয়ে আউট্রামের পাড়ে, ক্লান্ত….. তবুও তোমারই দিন গুনি ।
ভাঙা দেওয়ালেতে তোমার স্লোগান আজও, ঢেকে যায়নি বিজ্ঞাপনের পাশে,
প্রশ্নগুলো আজকে বরং থাক ; বোবা দৃষ্টিতে এখনও স্বপ্ন আসে…
মাধবী কে - যে জবাব চায়নি কোনদিন
একেকটা দিন কলেজে যখন স্কোয়াড করেছি,
মনে আছে তোর? বুকে রাগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
সেই দিন গুলো, যখনই চেয়েছি পাশে পেয়ে গেছি তোকে,
সঙ্গিনী ছিলি, বিপ্লব আনতে, সর্বনাশের ঝোঁকে।
সেই মাধবীটা খুব চেনা ছিলো খুব খুব চেনা,
বদলেছে দিন, এই বদলটা ভাল লাগছেনা।
বুঝতে পেরেছি সেদিন আবেগে ঠোঁট কেঁপেছিল,
উত্তেজনায় ছল ছল চোখে, পরিণত মেয়ে হাত ধরেছিল।
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে নিজেই নিজের মুখোমুখি,
চারমিনারের ধোঁয়া - বয়সের নিয়মেই সুখী!
পালিয়েছিলাম তোর কাছ থেকে, তোর চোখে দেখা স্বপ্নের থেকে,
নীরব চাহনি অনেক কথাই বলতে চাইত ক্যানভাসে এঁকে।
পরিচিত কিছু অভিব্যক্তি কখনো কখনো ভাষায় প্রকাশ,
কখনো দেখেছি তোর চোখ দিয়ে, খুঁজতে চেয়েছি ইচ্ছে-আকাশ।
এখন রাত্রি, আরেকটা ভোর দেখবো আবার একটু পরে,
তোকেই যে কেন দিইনি আমার সবটুকু 'আমি' উজার করে!
আরেকবার অনিমেষকে…
অনিমেষ,আজ নিজেকেই ছোট মনে হয়,দূরদৃষ্টিতে হেরেছি তোমার কাছে,
দেখব আবার মিছিলে স্লোগানে তোমায়, অবুঝ প্রেম এই আশা করে আজো বাঁচে..
অনিমেষ, সেই কবেকার ফোন-নম্বর,রিসিভার ধরে মেঘলা দু'চোখে জল,
ছেড়ে গেছ বুঝি একতলা ভাড়াবাড়ি, একা দাঁড়িয়ে ঠায় সে টিউব-কল।
কড়া বাস্তব সহজপাচ্য নয়, অ্যান্টাসিড-এ তিক্ততা বাড়ে শুধু…
অফিস-ফেরত রোজ স্যারিডন নেশা, ভাবের জগতে ওষুধেরা ঢালে মধু।
রাতের বালিশে মাথা রাখলেই দেখতাম… রঙীন স্বপ্ন; গেলাস ভর্তি শরাব;
গভীর ঘুম আর আসেনা কেন যে আজ, ফাঁকা ঘরে তাই স্বেচ্ছাবন্দী খোয়াব।
অনিমেষ,কত দ্রুত পাল্টালো সব; নয় নয় করে বছর দশেক হবে,
ছেড়ে এসে সেই গলির মুখের বাঁক… কেন বারেবারে ফিরে চাই যে নিরবে…
ভিড়ে,বাজারে আমি তোমায় দেখি রোজ, তোমারি মতন দাড়ি-মুখ, হাসি চোখ;
যে বিপ্লব তুমি শুরু করেছিলে সেদিন; কিশলয় থেকে মহিরূহে পৌঁছোক।
অনিমেষ, কেন সত্যিই মনে হয়, "রঞ্জনা" আর "বেলা বোস" আজ আমি…
কাজলেতে ঢাকি প্রাত্যহিকের ক্লান্তি, চশমায় ঢাকি স্বপ্নের হাতছানি।
কি-বোর্ড চালিয়ে ক্ষয়াটে আঙুল আমর, লালিমা হারিয়ে হয়েছি কর্পোরেট…
যে মাধবীর সঙ্গী ঝর্ণা-কলম,দূর থেকে অস্ফুটে বলে… 'চেকমেট' !!!
শুকনো পাতারা সমব্যাথী বুঝি আমার, যেখানেই যাই টুপটাপ খসে পড়ে,
দিনে রোদ্দুর… রাতে বৃষ্টি-ঝড়… বোবা চাউনিতে স্বপ্নরা পুড়ে মরে।
মাধবীকে - খোলা খামে...
আমার শহর - একলা কোণ,
বারোয়ারী এক ফালি উঠোন,
দশ ফুট বাই বারো ফুট জোড়া ঘর -
দিন আসে দিন চায়ের গ্লাস,
জীবন-যাপনে মিডল ক্লাস,
ভিতর-সত্ত্বা যান্ত্রিক যাযাবর।
সকাল এখনো আলি আকবরে,
শুরু হয়ে - চলে ঘুর পথ ধরে;
মন চোরাস্রোতে হারাতে দিইনি কিছু।
দিনান্তে রাত চোখে ঘুম আনে,
অনেক টুকরো কথা বাজে কানে;
ফেলে আসা পথে সময় নিয়েছে পিছু।
কলেজ ফেরত বাইপাসে হাঁটা,
লাল রঙে লেখা পোষ্টার সাঁটা,
বাপিদা-র চায়ে চুমুকে তুলেছি ঝড়।
কলেজ জীবন স্বপ্ন দেখাতো,
দিন-যাপনের সূত্র শেখাতো,
হিসেব মেলেনি - বছর সাতেক পর।
এখনো যখন কেরালার গ্রামে,
"কমরেড", বলে দৃঢ় গলা থামে,
তাদের চোখেও সে আগুন দেখি - যেমনটা ছিলো তোর।
অনিমেষ আজও এ'ভাবেই বাঁচে,
পুড়তে পুড়তে আগুনের আঁচে;
মাধবীলতার জন্য থাকুক "অন্য গানের ভোর"।
ফিরে দেখলাম তোমায়…
মাধবী আজ আর জবাব চায় না, ঠান্ডা স্রোতে স্তব্ধ,
শরীর জুড়ে ক্লান্ত ভীষণ, মনের জানলা বন্ধ।
অনিমেষ, তুমি একই রয়ে গেলে, উদ্ধত; বিপ্লবী…
মধ্যবিত্ত সহজ বুনোটে খামখেয়ালের ছবি।
দিন কাটে তোমার মিটিংএ-মিছিলে জবাবী স্লোগান দিয়ে-
শ্রমিক স্বার্থে আগ্রাসী তুমি আগুনের রূপ নিয়ে।
যে আগুনে আমিও প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলাম কোথাও-
নিভে গিয়ে শেষে জ্বললো না আর,পরম ব্যর্থ তাও।
অনিমেষ, বড় হিংসে হচ্ছে, কেন তুমি সংগ্রামী?
কিসে জিতলাম; কি চেয়েছলাম; কিইবা পেলাম আমি।
অনিমেষ, আমি হেরে গেছি আজ "মাধবীলতার" কাছে,
তোমার মাধবী "শ্রেণী" খুইয়েছে বহুজাতিকের পাশ-এ।
মাধবীর ঘর শ্মশান- স্তব্ধ, জ্বলে টিমটিমে দীপ..
চাওয়া-পাওয়ার শরিকের মাঝে জীবন্ত শহীদ।
স্বপ্ন ছিলো ধরব আকাশ সাথের সাথীকে নিয়ে;
বালি হয়ে তা ঝরেছে কখন আঙুলের ফাঁক দিয়ে…
মাস কেটে যায় রুটিনমাফিক, মেশিনের মত ঠিক।
কুয়াশায় ঢাকা ভাবুক চোখের শূন্যস্থানে শীত।