বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২

লুম্পেন পুঁজি ~ অবীন দত্তগুপ্ত

সহজ টিকা - লুম্পেন পুঁজি বলতে বেআইনি অর্থ লগ্নি কারবারের টাকাকে বোঝায়, অর্থাৎ সারদা-নারদা, ঘুষ, ১০০ দিনের কাজের টাকা মারা ,চালচুরি , বালি খাদান - পাথর খাদানের উপর কাটমানি , তোলাবাজি ইত্যাদি। সনাতন পুঁজি উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্বৃত্তমূল্য আহরণ করে ক্রমে স্ফীত হয়ে ভার্টিকাল বা উল্লম্ব বৃদ্ধি ঘটায়, লুম্পেন পুঁজির ক্ষেত্রে উৎপাদনের গল্প নেই, প্রতারণা বা জবরদস্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তা আহৃত হয়। এর বিস্তার হরাইজন্টাল বা অনুভূমিক, মেলা-খেলা-উৎসব-মোচ্ছবেই এর উপযোগ।

এই উপরের টিকাটা দেওয়ার কারন ,আমি নিজেও এই শব্দের একটা মোটামুটি আভিধানিক মানে খুজছিলাম ,আমার অন্য কাজের ফাঁকে । এবার পয়েন্টে আসা যাক । 

আজকে রাত ৮টা নাগাদ নদিয়ার এক পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীর মাথায় গুলি লেগেছে । উনি বোধহয় বাঁচবেন না । এই প্রসঙ্গে দুইটা কথা আমার বলার আছে ।

১। এখন মোটামুটি আপনারা বুঝতে পারছেন রামপুরহাট কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । ২০১৫র পুরসভা নির্বাচন থেকে যা শুরু , তা ২০১৮-র বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত ভোট দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে ।  ২০২১র কোলকাতা সহ সমস্ত মিউনিসিপালিটির সমস্ত ওয়ার্ড জিততে চাওয়া সেই ঝোঁকের-ই আরো জোরালো রূপ । এরপর আসছে পঞ্চায়েতের নির্বাচন । মূল কথা হল , পশ্চিমবঙ্গ এই মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জী শাসন করছেন না । শাসন করছে লুম্পেন পুঁজি ( যার টিকা টা উপরে দিলাম ) । এই লুম্পেন পুঁজির Horizontal growth -এর জন্যই , সব কটা ওয়ার্ড ,সব কটা গ্রাম পঞ্চায়েত দরকার । তবেই লুঠ বাড়ানো সম্ভব । কেন বাড়াতে হবে ? কারন কর্মহীন মানুষ বাড়ছে । লুম্পেন প্রলেতরিয়েতের সংখ্যা বাড়ছে । তাদের ভাড়া খাটাতে চাই আরো টাকা । আরো টাকা খাটালে চাই আরো মুনাফা । এই যে দ্বন্দ্ব দেখছি আমরা ,এই যে খুন ওটা এই লুম্পেন পুঁজির অন্তর্দ্বন্দ্ব । যত বেশী এলাকা দখল তত বেশী Horizontal growth । 
এ একটা টাইম বোম্ব । অনেক দিন ধরে সলতে পাকাচ্ছিল । এখন ফাটছে । আরো ভয়ানক বিস্ফোরণ ,এবং ক্রমাগত বিস্ফোরণ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । মমতা এ বিষয় কিছুই করতে পারবেন না ,কারন ওনার দলটা তৈরি হয়েছে স্রেফ এর ভিত্তিতেই । এটা ভাঙতে গেলে তৃনমুল ভাঙতে হবে । 

মাঝখান থেকে মরে যাবে অনেক সাধারণ মানুষ । কলেটারেল ড্যামেজ । 

২। এই যে পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী গুলি খেল , পঞ্চায়েত প্রধান গুলি খেল না কেন ? তারও কারন বামফ্রন্ট এর স্বপ্নের পঞ্চায়েতের চরিত্র বদল । পঞ্চায়েত ছিল গ্রামের মানুষের নিজের সরকার । প্রান্তিক মানুষের স্বনির্ভর হওয়ার জায়গা । প্রান্তিক মানুষ মানে শুধুই ক্ষেতমজুর বা জাতি ধর্ম নয় , প্রান্তিক মানুষ মানে নারীও বটে । আমাদের সমাজে ,যে সমাজে পঞ্চায়েত এসেছিল ,সে সমাজে অবশ্যই । একজন মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান মানে নারীর ক্ষমতায়ন । এই তো আইডিয়া । 

এখন মহিলা সংরক্ষিত সিটে যিনি বসছেন ,তিনি পুতুল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ,পঞ্চায়েত চালান বাবা,ভাই বা স্বামী । পুরো ইউ পি-বিহার-রাজস্থান হয়ে গেছি এই ফিল্ডে । একেকটা পঞ্চায়েত এ খরচ হচ্ছে ৮-১০ লাখ টাকা । ৫ বছরে তুলতে হবে কয়েক কোটি । এই তো সহজ হিসেব ।

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০২২

শিল্পকলা ও বাজার ~ বিষাণ বসু

(বিষয়টা একটু জটিল। একটু নয়, অনেকখানিই। এমন বিষয় সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার উপযুক্ত কিনা, জানি না। কিন্তু সবার মতামত পাওয়ার অন্য পথ আমার হাতে এখুনি নেই।

আমার অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানগম্যি যেহেতু শূন্যের কোঠায়, কথাগুলো মনে এলেও গ্রসলি ভুলভাল ভাবছি কিনা, সে নিয়ে সংশয় ছিলই। অগত্যা অগ্রজসম এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদকে ভাবনাগুলো লিখে জানালাম। তিনি জানালেন, বক্তব্যের মধ্যে অর্থনীতির যুক্তিতে বিশেষ ভুল নেই। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বাকি যে কথোপকথন, তা বর্তমান আলোচনায় অবান্তর। তাঁর জন্য রইল আমার মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা, যেমন থাকে সবসময়ই। অকারণ তাঁকে ট্যাগ করে বিরক্ত করতে চাইছি না। 😊

লেখাটা পড়ে আপনারা সবাই যদি মতামত জানান খুশি হবো। এবং সত্যিই উপকৃত হবো।)

এক ভ্রাতৃসম শিল্পীর সঙ্গে কথোপকথন হচ্ছিল। গুণী শিল্পী। চমৎকার আঁকে। চর্চা জারি রাখে। এই শেষ কথাটা আলাদাভাবে উল্লেখের যোগ্য, কেননা এই কথাটির গুরুত্ব কেন ও কতখানি, তা চারুশিল্পজগতের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানবেন।

তো তাঁকে বলছিলাম, শিল্পজগতে ক্রেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। বলছিলাম, শিল্পীর ক্ষেত্রে দ্বৈত অস্তিত্ব বজায় রাখার গুরুত্বের কথা। একটি অস্তিত্ব সৃষ্টিশীলতার ও অপরটি বিক্রেতার। এবং তার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই, বিশেষত এই বর্তমান সময়ে। দুটি সত্তাকে পৃথক রাখতেই হয়, কেননা বিক্রেতা-সত্তা শিল্পী-সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করলে মুশকিল। (তার উদাহরণ কি কিছু কম নাকি!)

আলোচনার মাঝপথে আচমকা এক তরুণ শিল্পী এসে পড়লেন এবং জানালেন, আমার ভাবনার পথে কিছু 'বেসিক ভুল' আছে। কেননা, শিল্পী কোনও 'মুদিখানার দোকানদার' নন (যদিও তিনি ডিসক্লেইমার দিলেন, তিনি নাকি কাউকেই 'ছোট' করতে চাইছেন না)। শিল্প-সংগ্রাহক ও ক্রেতার মধ্যে নাকি বিস্তর ফারাক আছে। এবং শিল্পবস্তু নাকি 'পণ্য' নয়, পণ্য হতেই পারে না। এইসব কথাবার্তার মধ্যেই মাঝেমধ্যে আমার উদ্দেশ্যে বিস্তর শ্লেষবাক্যও ছিল, আমার তরফে প্রত্যুত্তরও। আপাতত সেসব অগ্রাহ্য করে মোদ্দা কথাটুকুতেই মনোনিবেশ করা যাক।

তরুণ শিল্পীর কথাগুলো নতুন নয়। বিশেষত, ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে প্রায়শই দেখি, জনগণ কলেজ স্ট্রীটই হোক বা বইমেলা, কখনোই বই কেনেন না - শুধু সংগ্রহ করেন। পয়সা দিয়েই 'সংগ্রহ' করেন।

সত্যিই তো, বাজার কেনাবেচা ইত্যাদি অশ্লীল শব্দের সঙ্গে শিল্পচর্চা সাহিত্যচর্চার মতো মহৎ ক্রিয়াকলাপের যোগাযোগ থাকা নিতান্তই অনুচিত। কেনাবেচা বাজার - এসব হয় মুদিদোকানে, সবজিওয়ালা বা মাছওয়ালার কাছে। যদিও কেউই 'ছোট' নন, তবুও…

তা আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ভাই, পণ্য মানে ঠিক কী? ছবি যখন কেনাবেচা হয়, তা কেন পণ্য নয়? পণ্য শব্দটিকে এমন নেগেটিভ বা খারাপ অর্থে ধরার যুক্তি কী (যদিও কাছেপিঠের পণ্য বিক্রয়ের কেন্দ্র, যেমন মুদিখানার দোকান ইত্যাদি, উঠে গেলে বিস্তর অসুবিধে হয়)?? শিল্পী শুধুমাত্র বিক্রির উদ্দেশ্যেই শিল্পচর্চা করেন, বা যা বিক্রি হবে তা-ই আঁকেন, এমন কখনোই নয়। কিন্তু তাঁর ছবি যখন কেউ কেনেন, তাঁকে সংগ্রাহকই বলুন বা শিল্পপ্রেমী, আদতে তিনি কি ক্রেতা নন?

তিনি জানালেন, আমি যদি সেটা এতদিনেও না বুঝতে পেরে থাকি, তাহলে নাকি এই বয়সে এসে আর বুঝতে পারব না। শ্লেষের সুরে জানালেন, "সরি কাকু। আলু পটল ছবি সব এক। দিনের শেষে পচে যায়। ভুল হয়ে গেছে আপনার আঁতে ঘা দিয়ে।"

শ্লেষ-বিদ্রূপের ব্যাপারে আমারও এলেম নেহাৎ কম নয়। অতএব, প্রত্যুত্তরে জানানো গেল, না না ভাই, পটল ফ্রিজে রাখলে বেশ কয়েকদিন থাকে। আলু তো ফ্লিজের বাইরেও অনেকদিন। কিন্তু সব ছবির ক্ষেত্রে অতটা বলতে পারা মুশকিল।

কিন্তু আলোচনাটা আবারও পারস্পরিক তর্কাতর্কি কথা চালাচালির গল্পের দিকে চলে যাচ্ছে। তরুণ শিল্পীদের মধ্যে শিল্পকে 'পণ্য' না ভাবার ঔদ্ধত্য স্বাগত - যেকোনও রকম ঔদ্ধত্য, এমনকি হোলিয়ার-দ্যান-দাউ মানসিকতাও স্বাগত - ওটুকু না থাকলে এই মরা গাঙে বসে তাঁরা শিল্পচর্চা চালিয়েই যেতে পারবেন না। আমাদের মধ্যবিত্তপনা অতিক্রম করে আশার ঝলকানি তাঁরাই। অতএব আমার এই লেখাটি সেই তরুণ শিল্পীর প্রতি দ্বেষবশত নয়, বা কোনোরকম খাপ বসানোর মানসিকতা প্রসূতও নয়। আমার উদ্দেশ্য, তাঁর বক্তব্যের যাথার্থ্য বা ভ্যালিডিটি খতিয়ে দেখা।

প্রথমেই বোঝা জরুরি, পণ্য ব্যাপারটা কী? যেহেতু অর্থনীতির ছাত্র হওয়া তো দূরের কথা, সে বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানটুকুনিও আমার নেই, এদিক-ওদিক ঘেঁটে একখানা সংজ্ঞা খুঁজে আনলাম -

"কোনও বস্তুর মধ্যে যদি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উপলব্ধিযোগ্য গুণ থাকে ও তা মানুষের অভাব/চাহিদা পূরণ বা সন্তুষ্টি বিধানের সমর্থ হয় এবং বিক্রেতা কর্তৃক বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে তা ক্রেতাদের নিকট বিক্রয়ের নিমিত্তে উপস্থাপন করা যায় তাকে পণ্য বলে।"

কথাগুলো খুব সরল বাংলায় হয়ত বলা নয়, তবে বারকয়েক পড়লে ধরতে অসুবিধে হবে না।

এই সংজ্ঞাকে শিরোধার্য করলে, এবং শিল্পবস্তু মানুষের কোনও না কোনও অভাব/চাহিদা পূরণে সক্ষম (যেমন ধরা যাক, নান্দনিক চাহিদা) ও তা বিক্রির জন্য বাজারে হাজির করা হয় নিয়মিতভাবে, এইটুকু মেনে নিলে, শিল্পবস্তুকে পণ্য না ভাবার যুক্তি নেই।

এখন কেউ তাকে ভোগ্য পণ্য (যে সকল পণ্য চূড়ান্ত ভোক্তা ব্যক্তিগত ভোগের উদ্দেশ্য ক্রয় করে) ভাবতে পারেন, কেউ হয়ত লোভনীয় পণ্য (যে পণ্য দোকানে দেখে ক্রেতা ক্রয়ের প্রয়োজন অনুভব করে), বিরল কেউ কেউ নান্দনিক চাহিদায় বড় গুরুত্ব আরোপ করে শিল্পবস্তুকে আবশ্যক পণ্যও (প্রতিনিয়ত আমাদের বাসা বাড়িতে বা চলতে-ফিরতে প্রয়োজন হয় এমন পণ্য) ভাবতে পারেন। কিন্তু পণ্য শব্দটি নিয়ে খুব বেশি সংশয়ের অবকাশ থাকে কি? বিশেষত তা যখন 'বিক্রয়ের নিমিত্ত উপস্থাপিত' হচ্ছে সবসময়ই?? 

এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাজার ঠিক কী? আবারও কিছুক্ষণ খুঁজেপেতে জানা গেল -

"বাজার এমনি একটি লেনদেন পদ্ধতি, সংস্থা, সামাজিক সম্পর্ক অথবা পরিকাঠামো যেখানে মানুষ বস্তু বা অন্য কর্ম-দক্ষতা বিনিময় করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করে। এটি ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী একটি কর্ম ব্যবস্থা।"

বাজার সম্পর্কে ঘেন্নাপিত্তি বিদ্বেষভাব কাটিয়ে উঠে ঠান্ডা মাথায় ভাবলে স্পষ্ট, বাজার একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে পণ্যের আদানপ্রদান ঘটে। বিক্রেতা ও ক্রেতা, কিংবা শিল্পী ও সংগ্রাহক - বাজার বিনা এঁদের দেখা হতো কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে? ঘরে বসে শিল্পীপ্রবর মাস্টারপিস এঁকে রাখলেও দুনিয়া খবর পেত কী করে, বাজারের উপস্থিতি ছাড়া?

শিল্প ব্যাপারটা প্রথম থেকেই রাজানুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। রাজার পছন্দমতো বা বরাত-অনুসারে শিল্পীরা শিল্পসৃষ্টি করতেন - দক্ষ কারিগরের তুলনায় আলাদা করে বাড়তি সম্মান তিনি পেতেন না। শিল্পচর্চার মধ্যে দিয়ে শিল্পীর নিজস্ব বোধ মনন বা একান্ত নিজস্ব শিল্পব্যক্তিত্বের প্রকাশ ইত্যকার ভাবনার শুরু ওই রেনেসাঁস পরবর্তী ইউরোপে। একইসঙ্গে, ঠিক সেই সময়েই শিল্পকলার উপভোক্তার শ্রেণীবিন্যাসও বদলাতে শুরু করেছে। সরাসরি রাজানুগ্রহের 'পরে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ধনাঢ্য বণিক ও অভিজাত শ্রেণীর চাহিদা মেটানোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে শিল্পের বাজার - অর্থাৎ শিল্পের ক্রেতা ও শিল্পীর বিনিময়স্থল। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর ব্যক্তিত্বের নিবিড় যোগাযোগের কাহিনীর বাড়বাড়ন্তর শুরুটাও ওই সময়েই - সেটা সুনির্দিষ্ট মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি কিনা বলা মুশকিল, তবে সেটিই শিল্প বিষয়ে তৎপরবর্তী ধ্যানধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবং সেই যে নড়বড়ে পায়ে শিল্পের বাজার চলতে শুরু করল, আজ তার দাপাদাপি দেখে গা ছমছম করে। পরবর্তী সময়ে শিল্পী ও ক্রেতার মাঝে মধ্যসত্ত্বভোগীরা এসেছেন - গ্যালারি, আর্ট ডিলার, নীলামঘর ইত্যাদি - এবং ধীরে ধীরে তাঁরাই বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে শিল্পরুচিরও।

বাজার আজ শিল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে কিনা, বা বাজারই আজকাল শিল্পরুচির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে কিনা - এ নিয়ে তর্কাতর্কির জায়গা অবশ্যই রয়েছে। এবং যদি সেটি সত্যিই ঘটে থাকে, তা যে শিল্পের পক্ষে নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক, সে নিয়ে তর্কের অবকাশও নেই। তারপরও বলা যায়, এমন কুফলকে কারণ ঠাউরে বাজারকেই বাতিল করতে চাওয়া আর জটিল অসুখে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকা একইরকম ভ্রান্তি। যদি ধরেই নেওয়া যায় যে শিল্পীরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছবি আঁকছেন, বাজারের অনুপস্থিতিতে তার বিকল্পটি কেমন হতে পারত? আদর্শ ব্যবস্থা বলতে, যেমন ছিল বাজারের আগে? বাজারের অনুগ্রহের পরিবর্তে রাজানুগ্রহ?? 

শিল্পতাত্ত্বিক জন বার্জার অবশ্য মনে করতেন, শিল্পবস্তু, বিশেষত মহান শিল্পকলার নিদর্শনসমূহ, ক্রয়বিক্রয়ের আওতায় আসা অনুচিত, কেননা সেগুলি মানবসভ্যতার মহোত্তম সম্পদ। গ্রেট আর্ট-কে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে তা থাকা উচিত রাষ্ট্রের অধিকারে - জনগণের অধিকারে। আমি জন বার্জারের শিল্পভাবনার বাড়াবাড়ি রকমের গুণগ্রাহী। কিন্তু তাঁর এই ভাবনাটি মধ্যে - বা বলা ভালো, ভাবনাটি ভালো হলেও সেটি ঠিক কোন পথে বাস্তবায়িত করা যেতে পারে, তার মধ্যে - অল্পবিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। ধরুন, মহান শিল্প সবসময় যে সমকালেই মহান শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়, এমন তো নয়। ততদিন সেইসব ছবি/ভাস্কর্য থাকবে কার অধিকারে? ব্যক্তি-সংগ্রাহকের কাছে এবং সেখান থেকে মহান শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরিত হবে? সেক্ষেত্রে, বাজারের অনুপস্থিতিতে, হস্তান্তরের মূল্য ধার্য হবে কোন নিক্তিতে? নাকি রাষ্ট্র ভালোমন্দ বিচার না করেই, যাবতীয় শিল্পবস্তু রাখবেন নিজের অধিকারে, বা জনগণের অধিকারের অছি হিসেবে? তা কি আদপেই সম্ভব? আর তা যদি অসম্ভব হয়, রাষ্ট্র যদি বেছে শিল্প সংগ্রহ করতে থাকেন, রাষ্ট্রের পছন্দসই শিল্পই সেক্ষেত্রে একমাত্র চর্চা হয়ে উঠবে না? মানে, রাজা কিংবা চার্চের পছন্দসই শিল্প থেকে আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির পছন্দের মাপে মানিয়ে নেওয়া শিল্প? অথচ, প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ভাবনাকে অতিক্রম করতে পারা - সেই সুবাদে প্রয়োজনে প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারা - মহৎ শিল্পকৃতির অন্যতম গুণ? শিল্পকে যদি শেষমেশ রাষ্ট্রদ্বারা মানবিচারের ভরসায় থাকতে হয়, সে তো নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক। (শিল্পবস্তু, বিশেষত কালজয়ী শিল্পকলা, সন্দেহাতীতভাবে মানবসভ্যতার স্থায়ী সম্পদ। সে সম্পদ ব্যক্তিমালিকানাধীন হলে আমজনতার পক্ষে তা দেখতে পাওয়ার সুযোগটুকুও মেলে না। রাষ্ট্র আর্ট মিউজিয়াম করে তেমন শিল্পকে সবার দেখার জন্য খুলে দিক, এটিই কাম্য। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে জনগণের অছি হিসেবে কেমন করে তা করে ওঠা সম্ভব, সে নিয়ে ভাবনাচিন্তার সুযোগ রয়েছে। এবং তা বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়।)

রাষ্ট্রের পরিবর্তে বর্তমানে চালু শিল্পবাজারই শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা কিনা, সে নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে৷ কিন্তু, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে, দোষগুণ মিলিয়ে, দ্বিতীয়টিই যে কম খারাপ বা অধিকতর সম্ভাবনাময়,  সে কথা অস্বীকার না করা-ই ভালো। আপাতত বাজারের উপস্থিতি মেনে নিয়ে এবং অদূর ভবিষ্যতে শিল্পবাজার ব্যাপারটা উধাও হয়ে যাচ্ছে না ধরে নিয়েই কিছু কথা বলা যাক।

সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজারের অস্তিত্ব শিরোধার্য করলে ক্রেতার চাহিদা মেনে শিল্পসৃষ্টির প্রবণতাও কি অনিবার্য নয়? এক কথায় উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে বাজারটা সর্বস্তরে প্রসারিত ও বিস্তৃত হতে পারলে, বাজারে বিভিন্ন সামর্থ্য ও রুচির ক্রেতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এবং বাজার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হলে, উত্তরটা, সম্ভবত, না। 

আমার প্রিয় তরুণ শিল্পীদের নরম মনে আঘাত লাগতে পারে ধরে নিয়েও উদাহরণটা দিই - যতদিন বাজারে সবধরনের রুচির ক্রেতার আনাগোনা চালু থাকবে, ততদিন বাজারে সব্জিওয়ালা মাছওয়ালা মাংসের দোকান সবই চালু থাকবে। কিন্তু আচমকা পাড়ার সবাই উদ্বুদ্ধ হয়ে ভেগান হয়ে গেলে সব্জিওয়ালা বাদে কারও ব্যবসা চলতে পারবে না। এতে মাছওয়ালা সপরিবারে না খেতে পেয়ে পথে বসবেন, নাকি তিনি মাছের পরিবর্তে সব্জির ঝুড়ি নিয়ে ওই বাজারেই বসবেন, তা আগাম অনুমান করা মুশকিল। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হলো, বাজারকে গালি না দিয়ে বাজারে সর্বস্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিল্পবাজারের ক্ষেত্রে, সবধরনের রুচির সবরকম পকেটের ক্রেতার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। আবার শিল্পের বাজারে অংশগ্রহণের জন্যে বিক্রেতাদের জন্য ধার্য যে চড়া প্রবেশমূল্য, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মূল্য - এককথায় এন্ট্রি বেরিয়ার - তা দূর করাও সমান জরুরি। বর্তমান বাস্তবতায় এসব কীভাবে সম্ভব, বা শিল্পবাজারের খোলনলচে না বদলে আদৌ সম্ভব কিনা, সে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে। এবং আলোচ্য হিসেবে খুবই ভ্যালিড সে প্রসঙ্গ। এগোনোর জন্য সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা আলোচনা এই মুহূর্তে নিতান্ত জরুরি।

কিন্তু যতদিন অব্দি শিল্পীরা বাজার ব্যাপারটিকেই নিচু চোখে দেখছেন এবং নিজেদের শিল্পচর্চার এন্ড-রেজাল্টটিকে শিল্পবাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে ভাবতে বা দেখতে অস্বীকার করছেন, বা অস্বীকার করার মাধ্যমে ভাবের ঘরে চুরি করছেন - অবশ্যই আমি বাজারের 'রুচি' অনুসারী নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পচর্চাই পথ বা বাজারের স্বীকৃতিলাভই চূড়ান্ত মোক্ষ হোক, এমনতর কথা বলছি না - ততোদিন অব্দি তো পরিস্থিতির কোনোরকম বদলের সম্ভাবনাই আকাশকুসুম, তাই না?

বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২

সন্ত্রাস ~ অর্ক ভাদুরী

তৃণমূল জিতেছে৷ কিন্তু তাঁর পরিবার তৃণমূল প্রার্থীকে সমর্থন করেনি ভোটপর্বে। সেই অপরাধে বাড়ির দরজার এঁকে দেওয়া হয়েছিল তিন বোনের ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি। বুধবার ভোটের ফল বেরনোর পর বাড়িতে চড়াও হয়ে দেওয়া হচ্ছিল ধর্ষণ করে খুনের হুমকি। সঙ্গে বোমাবাজি, দরজায় লাথি। সম্ভাব্য অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন ১৯ বছরের তুহিনা খাতুন। তাঁর বাবাও তৃণমূলেরই কর্মী। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার স্বর্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে একটি জেলাসদরের ঘটনা।

বর্ধমান পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ড।   তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে বসিরুদ্দিন ওরফে বাদসা নামে যে ব্যক্তি নির্বাচনে লড়েছিলেন, তাঁকে মেনে নিতে পারেননি এলাকার তৃণমূল কর্মীদেরই অনেকে। মুক্তার মিঞা নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার অনুগামীরা বসির আহমেদের বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বসির তোলাবাজ, এলাকায় ডন হিসাবে পরিচিত। তাঁকে প্রার্থী করা যাবে না।

স্থানীয় বাসিন্দা জুনাই শেখ। তিনিও তৃণমূলের সমর্থক। মুক্তারের অনুগামী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। কিন্তু জোড়া ফুলের টিকিট পাওয়া 'ডন' বসিরকে মানতে পারেননি। গোটা ভোটপর্ব জুড়ে তাঁকে এই বিরোধিতার মাশুল দিতে হয়েছে।

কেমন মাশুল? জুনাই শেখের তিন মেয়ে। তাদের খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি। বাড়ির বাইরে বোমাবাজি। দরজার লাথি। বাড়ির দেওয়ালে একটা গাছে ঝুলন্ত তিনটি মেয়ের ছবি এঁকে দিয়ে গিয়েছেন জোড়া ফুলের নেতা বসিরের কর্মীরা। তিনটি মেয়ে। নিজেদের লাশের ছবি বাড়ির দেওয়ালে নিয়ে থাকছিল এই গোটা ভোটপর্বে। প্রতিদিন শুনত, শুধু ভোটের ফল বেরনোর অপেক্ষা। তারপর এই ছবিটা সত্যি হবে। ধর্ষণ করে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে গাছে।

বুধবার নির্বাচনের ফল বেরল। তৃণমূল প্রার্থী বসির জিতে যাওয়ার পরেই শাসকদলের লোকজন জুনাই শেখের বাড়িতে চড়াও হয়। শুরু হয় বোমাবাজি৷ বাড়িতে তখন ছোট মেয়ে তুহিনা খাতুন একা। দরজায় লাথি মারতে থাকে বসিরের বাহিনী৷ দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। ১৯ বছরের মেয়েটি আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায়। তারপর সম্ভাব্য অত্যাচার থেকে বাঁচতে একটি ঘরে ঢুকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তৃণমূলের ঝঞ্ঝাবাহিনী দেওয়ালে যে ছবি এঁকে গিয়েছিল, তা সত্যি হয়ে ওঠে। ১৯ বছরের মেয়ে তুহিনা খাতুন, বর্ধমান রাজ কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী তুহিনা খাতুন, তৃণমূল কর্মী জুনাই শেখের মেয়ে তুহিনা খাতুন তৃণমূলেরই জয়োৎসবের বলি হয়, তার শরীরটা লাশ হয়ে ঝুলতে থাকে বর্ধমান শহরের মাঝখানে।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন ভোটে বড় কোনও গোলমাল হয়নি। তিনি ফ্যাসিবাদ রুখতে উত্তরপ্রদেশে গিয়েছেন। মাননীয়া, যে মেয়েটিকে আপনার দলের কর্মীরা লাশ বানিয়ে দিল, সে কিন্তু আপনাকেই মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাইত। তার বাবা আপনার দলেরই কর্মী। এটা যদি বড় ঘটনা না হয়,তাহলে বড় ঘটনা কোনটা, মাননীয়া? 

এ যদি ফ্যাসিবাদ না হয়, তাহলে কাকে ফ্যাসিবাদ বলে? যাঁরা এখনও এই শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছেন না, ঝুঁকি নিতে চাইছেন না, আপনাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে অসুবিধা হচ্ছে না?

আনিস খান হত্যার বিচার চাই।
তুহিনা খাতুন হত্যার বিচার চাই।