মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

নিরুপম সেন ~ অর্ক রাজপন্ডিত

আজ বছর দশ পর....

দশ বছর আগের ক্রিসমাস ইভ। ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। তখন আজকের মত পার্ক স্ট্রিটে 'বড়দিনের কার্নিভাল' ছিল না। তবে উৎসব ছিল বই কি! কলকাতা শহর, শহরতলি, মফস্বল থেকে তখনও মানুষ আসতেন বড়দিনে কলকাতায়।

চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, নিকো পার্কে তখনও বড়দিনের আগের দিন থেকেই ছিল বেলুনের জন্য শৈশবের বায়না। তখনও ছিল আইসক্রিমের জন্য কৈশোরের নাছোড়বান্দা আবদার। দশ বছর আগে বড়দিনের আগের দিন তখনও ছিল পার্ক স্ট্রিটে ভিড়।

যাই হোক, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। দশ বছর আগের ঠিক এই দিন ছিল বুধবার। আলো ঝলমলে বড়দিনের আগের দিন আলো ঝলমল ছিল মিলনমেলা আর উল্টোদিকের সায়েন্স সিটিতে।

দশ বছর আগে, ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর। সায়েন্স সিটিতে সেদিনের সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার'। দশ বছর আগে ঠিক এই দিনে শিল্পমেলার উদ্বোধন করেছিলেন নিরুপম সেন।

২০০৮ সালে মানে মহামন্দার শুরু। ঝাঁপ পড়েছে লেম্যান ব্রাদার্সে। ঝাঁপ পড়েছে মেরিল লিঞ্চে। নাসড্যাক থেকে সেনসেক্স দুনিয়ার সব শেয়ার বাজারে লালবাতি।

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে ২০০৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর 'ইন্ডিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগা ট্রেড ফেয়ার' উদ্বোধন করে নিরুপম সেন বলেছিলেন 'দুনিয়া জোড়া মন্দার আঁচ পড়েনি পশ্চিম বাংলায়। এখনও পর্যন্ত রাজ্যের একটিও নির্মীয়মান শিল্পে প্রভাব পড়েনি।'

মোট ৩০০টি শিল্প সংস্থা যোগ দিয়েছিল সেই মেলায়।

সেই সময়। কদিন আগেই সিঙ্গুর থেকে চলে গেছে মোটর গাড়ির প্রকল্প।

..................................

দশ বছর পর আজকের ক্রিসমাস ইভ। আজ পার্ক স্ট্রিটে 'কার্নিভাল' আছে চার দিন আগে থেকেই।

ঠিক দশ বছর পর ২০১৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। 'পিস ওয়ার্ল্ড'-র বরফে ঢাকা কফিনে ঘুমিয়ে আছেন নিরুপম সেন।

ভোর ৫টা দশ মিনিট। প্রয়াত হয়েছেন নিরুপম সেন।

এছাড়াও আজকের সন্ধ্যায় আরেকটা বড় খবর। রথযাত্রা নিয়ে বিজেপি-র চটজলদি শুনানির আবেদন বাতিল হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে!

দশ বছর আগের ২৪শে ডিসেম্বর। বাধা স্বত্তেও কর্মসংস্থানের স্বার্থে শিল্পে এগোনো। দশ বছর পর আজকের ২৪শে ডিসেম্বর। কাজ নয়, শিল্প নয়। বিতর্ক রথের পথ নিয়ে!

..............................

আজ থেকে ঠিক দশ বছরেরও বেশি আরেকটু সময়। সিঙ্গুরে মোটরগাড়ির কারখানা তখনও জিন্দা ছিল। রোজ সন্ধ্যায় প্রকল্প থেকে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতেন মৃণাল কান্তি খাঁড়া। তাঁর ঠাকুমা প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়া ছিলেন প্রকল্পে প্রথম জমি দাতা। প্রয়াতা মঙ্গলা খাঁড়ার নাতি মৃণালকান্তি খাঁড়া। সিঙ্গুর প্রকল্পের প্রথম জমিদাতা হিসাবে এখনও তাঁদের পরিবারের গর্ববোধ রয়েছে। সিঙ্গুর প্রকল্পে চার বিঘা জমি দিয়েছিলেন তাঁদের পরিবার।

'সেদিনটা এখনও ভুলতে পারি না, ২০০৬ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর। আমিই ঠাকুমাকে বাইক চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হল। বাইরের গেটে ভিড় বাড়ছে। বিডিও অপিস ঘিরে রেখেছে তৃণমূল। মমতা এলেন, আরও ঝামেলা বাঁধলো। বুড়ি ঠাকুমাকে নিয়ে কিভাবে বাড়ি যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না, বাইরে ঝামেলা হচ্ছে, কোন মতে ডি এম সাহেব একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে ঠাকুমাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন, সেদিন থেকে জমি দেওয়ার কারণে আমরা ছিলাম তৃণমূলের টার্গেট', বলেছেন মৃণালকান্তি।

এমন একটা দিন যায়নি যেদিন খাঁড়া পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়নি। মোটরগাড়ির কারখানা উঠে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ওঁদের বাড়িতে ঢিল পড়েছে, দরজা জানলা ভাংচুর হয়েছে। 'রোজ লুকিয়ে বাড়ি ফিরতাম, এই বুঝি কেউ মেরে দেয়, সব সময়ে থাকতাম ভয়ে ভয়ে', বলেছেন মৃণালকান্তি।

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মৃণাল কান্তি খাঁড়া কারখানায় চাকরির জন্য ট্রেনিং নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন বেলুড়ের পর গিয়েছিলেন পুনায়, উত্তরাখন্ডে টাটা মোটরস্‌ কারখানায় হাতে কলমে কাজ শিখতে। টাটা মোটরস্‌-র অফার লেটার, টাটা ভোল্টাস কোম্পানির সার্টিফিকেট সব এখনও সযত্নে রেখে দিয়েছেন মৃণালকান্তি।

দশ বছর পার করে মৃণাল কান্তি আজকের রাতে ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরেন, যেমন ফেরেন গত দশ বছর ধরেই।

এখন মৃণালকান্তি সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া মোড়ে দোকান দিয়েছেন। কালিমাতা রিপেয়ারিং শপ। স্টোভ আর গ্যাসের ওভেন সারান।

............................................

৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘটের বড় দাবি এরাজ্যে বন্ধ কারখানা খোলা। ধর্মঘটের বড় দাবি কর্মসংস্থান।

৮এবং৯ই জানুয়ারি অচল হবে দেশ। অচল করতে হবে বাংলা।

ধর্মঘটে জবাব দিতে হবে আজকের শাসককে। আসুন প্রস্তুতি নিই। আর নয়। আর নয় আমাদের অনুজ,সন্তান সন্ততিদের ভবিষ্যৎ এই নরখাদকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।

৮এবং ৯ই জানুয়ারির ধর্মঘট সফল করেই আসুন আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানাই কমরেড নিরুপম সেনকে।

কমরেড নিরুপম সেন লাল সেলাম। কমরেড নিরুপম সেন অমর রহে।

পুনশ্চ: সঙ্গে রইলো দশ বছর আগের ও দশ বছর পরের ঘটনাগুলির ছবি।

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

কেবলই স্বপন, করেছি বপন ~ অনামিকা

কেন আজ সিপিএম নেই ক্ষমতায়?
বিপ্লবীদের সে'টা দারুণ ভাবায়।
'অতি' বলে 'প্রতি' তোর মাথা অতি মোটা
বুঝিস না কিছুতেই সোজা অঙ্কটা।
অমুক সে বইটার তমুক পাতায়
লেখা আছে কী আগুন কত খাওয়া যায়।

প্রতি বলে, দাঁড়া আগে বেচে নিই ছবি।
সুবোধ্য হেসে ওঠে নেট বিপ্লবী।
নিও কম্যুনিজমের সোজা অঙ্কটি। 
ঢুকে যায় ফোকটিয়া প্রায় দুই কোটি।
গুরুতর চণ্ডাল আঁচ পেয়ে ঢিমে
আত্মপ্রসাদে মন ঢেলে দেয় মিমএ।

ফেসবুক বিপ্লবী বলে সাদা চুল
কমিউনে আজও কেন? এইটেই ভুল।
আলোকিত করেছে যে রাজ্য কমিটি
সপুত্র চেটে নিল নিজের বমিটি।
মহা বিপ্লবী হুঁ হুঁ... চাষার ব্যাটা সে
গলায় গামছা দিয়ে ক্ষমতার পাশে।

দু' বগলে ডিও যার। সেন্ট পারসেন্ট
ঘন বিপ্লবী হাঁকে চাই মুভমেন্ট
যে কৃষক হাঁটে, যার পা গিয়েছে ফেটে,
নেই বটে সে মিছিলে, এই মার্কেটে
মানসিক ভাবে আছি। ক'জনে তা' থাকে?
টিভিতে তরজা শুনি। চেনো তো আমাকে!

গরু বিপ্লবী বলে খেলবই জুয়া।
ত্রিপুরায় 'বিপ্লব'... এনেছে গেরুয়া।
ইভিএমে ডুবে মরে পাতি বিপ্লবী।
এত কথা শোনে, তবু ভুলছে না ভবি।
সে এত বোঝে না কিছু। হতাশা ও প্রেম
তার সব কিছু আজও বোকা সিপিএম।

শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

রাফাল ও মোদী সরকার ~ অবিন দত্তগুপ্ত

আমি আইন কানুন বিশেষ বুঝি না । কালকে একটা রুলিং দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট । তাতে বলেছে রাফায়েল বিমান কেনার ক্ষেত্রে কোন গড়মিলের হদিস তারা পায়নি । এই শুনে ব্রেনলেস্‌ বিজেপি সমর্থকরা যারপরনাই উল্লসিত । তা হতেই পারেন ,আসুন সকলেই একটু ভালো করে বুঝে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করি ।

১। রায় দেওয়ার বেসিস্‌ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট যে ডকুমেন্টের কথা বলেছে সেটা হলো সি এ জি রিপোর্ট বা Comptroller and General Audit Report . এই রিপোর্টে নাকি সরকার প্লেনের দাম সম্পর্কিত সমস্ত ডিটেল দিয়েছে । এবং এই ডিটেল নাকি শেয়ার করা হয়েছে Public Accounts Committe বা PAC-এর সাথে । উল্লেখ্য PAC একটি পার্লামেন্টারি কমিটি ।

২। এই রায়ের পর গতকাল-ই PAC-এর চেয়ারম্যান একটি প্রেস কনফারেন্স করেন এবং জানান সি এ জি কোন রিপোর্ট তাদের জমা দেন নি । শুধু তাই নয় , তিনি এটাও জানান যে সি এ জি-র কাছেও এই রিপোর্ট নেই বলে সি এ জি-র ডেপুটি কমিশনার তাকে মিটিং-এ জানিয়েছেন ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ,যে রিপোর্টটা বাস্তবে কোথাও নেই ,তার উপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল কেন ? অথবা সুপ্রিম কোর্ট তাহলে কি রিপোর্ট দেখে রায় দিল । রিপোর্ট তো সুপ্রিম কোর্টকে পেশ করেছে কেন্দ্র সরকার , তারা তবে কোথাকার PAC-র রিপোর্টের কথা বলছে ? কোথায় বসে সেই কমিটি ? আম্বানির বাড়িতে ? তার চেয়ারম্যান কে ? 

এই একটা প্রশ্নের উত্তরো কাল কেন্দ্রিয় সরকার দিতে পারে নি । এই দুরন্ত মিথ্যার উপর দাড়িয়ে গতকালের রায় ।
বাস্তব হচ্ছে , নরেন্দ্র মোদী তার প্রভু অনিল আম্বানিকে ৩০হাজার কোটি টাকা চুরি করতে সাহায্য করেছেন । যে লোকটা পেরেক পর্যন্ত ম্যানুফ্যাকচার্‌ করতে পারে না তাকে প্লেনের বরাত দিয়েছেন । রাষ্ট্রায়ত্ত HAL বা Hindustan Aeronautics Limited বহু বছর ধরে প্লেন বানালেও তারা বরাত পাননি । 
এখন অনিল আম্বানি তো পেরেক-ও বানাতে পারেন না ,প্লেন বানাবেন কিভাবে ? অতএব নরেন্দ্র মোদী ,ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে ফ্রান্সে গিয়ে ফ্রান্সের একটি কোম্পানিকে ৩৬টি রাফায়েল বিমান বানিয়ে অনিল বাবুকে বেচতে বলেছেন (ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এটা কনফার্ম করেছেন) । কতো দামে অনিল বাবু প্লেন কিনলেন সেটা জানতে চাওয়া হলে , আমাদের দেশের সরকার বলেছে এটা ন্যাশানাল সিক্রেট্‌। ফ্রান্সের প্রধান্মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে উনি অবাক হয়ে বলেছেন ,"আপনাদের দেশের লোকের ট্যাক্সের টাকায় কেনা জিনিস, আপনাদের দেশের লোকের কাছে সিক্রেট্‌ হবে কেন?" । এই দামের ব্যাপারেই সি এ জি রিপোর্ট আলোকপাত করতে পারত । এবং আপাতত সেটা কোথায় ,একমাত্র নরেন্দ্র বাবু বলতে পারবেন ।  অনিল বাবু তারপর আরও চড়া দামে এই প্লেন গুলি ভারতের সরকারকে বেচবে । 
অর্থাৎ আমার আপনার টাকা দিয়ে আম্বানিদের সিন্দুক ভরবে । ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে আম্বানির মেয়ের বিয়ে হবে । সেই বিয়ের ভিডিও আপনার কাছে আসবে ,আপনি আম্বানির জিও ডেটা খরচা করে সেটা গোগ্রাসে গিলবেন ।

বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮

স্বপ্ন যখন যৌথখামার.. ~ সুশোভন পাত্র

কি আছে বামপন্থীদের? কতটুকু ক্ষমতা? ঐ তো মরু রাজ্যের দুটো আসন। মেরেকেটে ৫রাজ্যে ৭.৮২ লক্ষ ভোট। গোটা দেশে ৪%। ২০টা সাংসদ নেই। দেড়শটা বিধায়ক নেই। কেরালা ছাড়া একটা রাজ্যেও সরকার নেই। সরকার গঠনে নির্ণায়ক কোন ভূমিকা নেই। ভোটের পরে কেনা-বেচার ২-৪টা ডাগর ঘোড়া নেই। রুদ্ধশ্বাস ক্যাবিনেট মিটিং'-এ ফটো ফিনিশেরও চান্স নেই। 
কি আছে বামপন্থীদের? রাস্তায় বেরোলে ১৫ ফুট হোর্ডিং-এ নেতাদের সদা হাস্য মুখ নেই। পাতা জোড়া বিজ্ঞাপন নেই। পার্টি ফান্ডে আম্বানি-আদানি'দের পয়সা নেই। সেলেব একটা ব্র্যান্ড-অ্যাম্বেসেডার নেই। চার্টার্ড বিমান চেপে নির্বাচনী প্রচার নেই। ভোটের মুখে রাম নাম নেই। পেট ভরে দু-মুঠো ঘুষ খাওয়ার স্টিং অপারেশন নেই। একটা তাগড়া আইটি সেল? ধুর ছাই, সেটাও নেই। 
কি আছে বামপন্থীদের? তৃণমূলের ৩৪টা সাংসদ, ২১জনই কোটিপতি। ৬জন ফিল্মস্টার। তাছাড়াও সরকারী প্রসাদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা আছেন। লেজুড়বৃত্তি করার লেখক-কবিরা আছেন। মঞ্চ আলো করে নায়ক-নায়িকারা আছেন। গৃহপালিত মিডিয়া আছে। ক্লাবে পোষা গুণ্ডা আছে। সিভিক-পুলিশ-প্রশাসন-সিআইডি-কমিশন, সব আছে। 
কি আছে বামপন্থীদের? বিজেপির ২৭২জন সাংসদ, ২৩৭জনই কোটিপতি। দিল্লির দীনদয়াল মার্গে ১.৭০লক্ষ বর্গফুটের অট্টালিকায় পার্টি অফিস আছে। বার্ষিক ১,০৩৪কোটি আয় আছে। ৫৩২কোটির কর্পোরেট ডোনেশেন আছে। আশোকা রোডে দু-তলা বাড়িতে সাজানো মিডিয়া সেল আছে। হিন্দু ধর্মের উপর নাকি বাপের জমিদারি আছে। 'স্বয়ং সেবক'দের লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। গুজরাট-মুজ্জাফরনগর কে নরক বানানোর গোলিয়াথরা আছে। 
কিন্তু মুশকিল হল, ইতিহাসে কোনদিন শেষ অবধি এই গোলিয়াথরা জেতেনি। জিতেছে ডেভিডরাই। ৫রাজ্যে ভোটের ফলের সংশ্লেষ বলছে, গ্রাম ভারতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে বিজেপি। মধ্যপ্রদেশের গ্রামে দখলে থাকা ৭৫টির বেশি বিধানসভা খুইয়েছে বিজেপি। রাজস্থানের প্রায় ৪০। ছত্তিসগড়ে ৩০। দেশে ৬২% মানুষ কৃষিজীবী। নাসিক থেকে মুম্বাইয়ের 'কিষান 'লং মার্চ' কিম্বা দিল্লির সংসদ মার্গে 'কিষান মুক্তি মার্চ' –গত দু'তিন বছরে চাষিরা যখন বারবার ফসলের ন্যায্য দাম চেয়ে পথে নেমেছেন, যখন ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার  হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন নিরভ মোদীর সঙ্গে দাভোসে গিয়ে ফটো সেশেন করেছেন। ৫রাজ্যের ভোটে কৃষক অসন্তোষের যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেদিন সেই কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
বছরে ২কোটি বেকারের চাকরি হয়নি। দেশ জুড়ে যখন বিভিন্ন মাঝারি শিল্পে ২৯লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তখন বেকারদের পোকোড়া ভাজতে উপদেশ দিয়েছেন।  শেষ ২০বছরের সমস্ত রেকর্ড টপকে ৬.৯% হারে দেশের বেকারত্ব যখন সর্বোচ্চ বেড়েছে, গোলিয়াথরা তখন ৩হাজার কোটির সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছে। ৫রাজ্যের ভোটে বেকার'দের পেটের জ্বালার যে ট্রেলর গোলিয়াথরা আজ দেখছেন, সেই বেকার'দের কাজের দাবিতেই প্রতিদিন রাস্তায় থেকেছে ঐ ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেবে 'কালো টাকা' ফেরত আসেনি। আপনার-আমার অ্যাকাউন্টে ১৫লাখ জমা পড়েনি। জাল নোটের রমরমা কমেনি। সন্ত্রাসবাদেরও মেরুদণ্ড ভাঙ্গা যায়নি। বরং এটিএম'র লাইনে দাঁড়িয়ে যখন প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক সাধারণ মানুষ, তখন বিজেপির বার্ষিক আয় বেড়েছে ৮৫%। পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন কাজ হারিয়ে দিশেহারা, তখন ১৬,০০০ গুন মাল কামিয়েছে অমিত শাহ'র পুত্ররা। ৫রাজ্যের ভোটে নোট বাতিলের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের অসন্তোষের যে ট্রেলর আজ গোলিয়াথরা দেখছেন, সেই নোট বাতিলের আপাদমস্তক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল ডেভিডরাই। বামপন্থীরাই।
তামাম দুনিয়ার সংগ্রামী ইতিহাস সাক্ষী, ডেভিডরা হারেনি। সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে তুরুপের তাস হয়ে উঠতে না পারলেও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার যন্ত্রণটার শীতলপাটি হওয়ার ক্ষমতা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। জান কবুল মান কবুল লড়াই'র হিম্মতটা বামপন্থীদের আগেও ছিল, এখনও আছে আর পরেও থাকবে। তাই যারা বিদ্রূপ করে জিজ্ঞেস করেন, '৫রাজ্যে বামপন্থীরা কটা আসন পেল?', কিম্বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন '১৯টি রাজ্যে আমরা ক্ষমতায়', তোরা কটায়?', কিম্বা ব্যাঙ্গ করে বলেন 'মধ্যপ্রদেশে বিজেপি হারলে কম্যুনিস্টদের কি লাভ?' -তাঁদের বলি, লাভ বামপন্থীদের একটা আছে। যতই হোক, পাড়ার পাগল কুকুর তো, মরলে গোটা পাড়ারই লাভ আছে।
আসলে মেহনতি মানুষের পক্ষ নিতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। হিটলার-মুসোলিনি-ফ্র্যাঙ্কো কিম্বা আজকের নরেন্দ্র মোদী –ফ্যাসিস্টদের ম্যাসকট'দের চিনতে কম্যুনিস্টদের কোনদিন ভুল হয়নি। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কম্যুনিস্টরা কোনদিন কসুর রাখেনি। আর রাইখস্ট্যাগের মাথায় লালপতাকা উড়িয়ে দেওয়ার আগে অবধি কম্যুনিস্টদের সেই লড়াই থামেনি। ১১৫২ খ্রিস্ট পূর্বের মিশরে ফেরাও'র বিরুদ্ধে রেশনের দাবি তে শ্রমিক ধর্মঘটই হোক কিম্বা ১৯৫৯'র সালে পুঁজিবাদের আঁতুড় ঘর আমেরিকার রাস্তায় ৫লাখ ইস্পাত শিল্পের শ্রমিক'দের মিছিল। ৭৪'র ইন্দিরার সরকারের বিরুদ্ধে রেল ধর্মঘটই হোক কিম্বা মার্গারেট থ্যাচারের দেশে খনি শ্রমিকদের অনশন, এই সেদিনের ৫০হাজার কৃষকের সিঙ্গুর থেকে রাজভবন অভিযানই হোক কিম্বা আজকের প্যারিসে পেট্রো-পণ্যের মূল্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ -পৃথিবীর যে প্রান্তে, যে কোণায় যখনই মেহনতি মানুষরা শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে, সেই লড়াইয়ে নেতৃত্বে কম্যুনিস্টরাই থেকেছে। 
তাই ঐ সব ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপে মুচকি হাসুন। আর বিনয়ের সাথে, ওঁদের কাঁধে হাত রেখে, মনে করিয়ে দিন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা মহাদেশের, প্রত্যেকটা দেশের, প্রত্যেকটা শহরের, প্রত্যেকটা গ্রামের, প্রত্যেকটা জনপদে; হয়ত কোন ফ্যাক্টরির গেটের সামনে, কিম্বা হয়ত কৃষকের এক ফালি জমির মাঝে, হয়ত কংক্রিটের মিছিলে বেকারের কাঁধে, কিম্বা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মেহনতির প্রতিবাদের ভাষায়, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে উদ্ধত শ্লোগানে সেজে, কখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে শান্তির পতাকা হয়ে কেস্তা-হাতুড়ি আঁকা ঐ একটুকরো লাল কাপড় কিন্তু ঠিক উড়ছে। আর উড়ছে, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি তে নয়, মহম্মদ আর রামের নামে মানুষ ক্ষ্যাপাতে নয়, উৎসব আর মেলায় মাতিয়ে রাখতে নয়। হক আদায়ের লড়াই করতে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ কে আগলে রাখতে। শোষণ-বঞ্চনাহীন নতুন ভোরের স্বপ্নটাকে সাচ্চা করতে।

চিকিৎসা ব্যবস্থা ~ ড: গৌতম মিস্ত্রি

যে ভাবে আমরা এখন হৃদরোগের চিকিৎসা করছি, তাতে সমাজের বৃহদাংশের সুচিকিৎসা সম্ভব নয়। একটা কাল্পনিক গল্পের মাধ্যমে প্রসঙ্গটা ব্যাখ্যা করি। একজন উচ্চশিক্ষিত সদ্য পাশ করা নবীন চিকিৎসক নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে গেছে। হঠাৎ দেখে, একজন মানুষ নদীতে ভেসে যাচ্ছে। নদীতে ঝাঁপিয়ে তাকে তুলে, নিজের সদ্যপ্রাপ্ত চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে তাকে সুস্থ করে তুললো। এর পর সেই নবীন চিকিৎসক দেখল,  কোন আশ্চর্য্য কারণে নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায় মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। বুদ্ধিমান নবীন চিকিৎসক তার বেশ কিছু সহকর্মীদের সাথে নিয়ে অক্লান্ত  প্রচেষ্টায় আরও কিছু মানুষকে বাঁচাতে পারলো। কিন্তু সেই নদীতে ভেসে আসা মৃতপ্রায়ের সংখা ক্রমেই বাড়তে লাগলো।  এরপর নবীন চিকিৎসকের দল যেটা করলো, তাতে সবাই সাধুবাদ দিলো। নদীর পাড়ে একটা হাসপাতাল গড়ে উঠলো চিকিৎসকদের উদ্যোগে আর পরোপকারী(!) কিছু ব্যবসায়ীদের অর্থে। অধিকাংশ মরণাপন্ন মানুষ নদীর জলে ভেসে গেলেও নদীতে ভেসে আসা কিছু মানুষ অবশ্য বেঁচে গেলো।  নদীপাড়ে গড়ে উঠলো বড় জনপদ, অনেক চিকিৎসকের কাজের সংস্থান হল আর হল ব্যবসায়ীদের অর্থ সমাগমের সুবন্দোবস্ত।  

এই সমাজকল্যাণ মূলক কর্মকান্ডে বাধ সাধলো গুটিকয় খুঁতখুঁতে চিকিৎসক।  এরা নদীর উজান বেয়ে অন্যভাবে হাওয়া খেতে গিয়ে দেখলো, এক দৈত্য একটা প্রকান্ড মুগুর নিয়ে মানুষ মেরে চলেছে। এই খুঁতখুঁতে চিকিৎসকের দল দৈত্যকে মেরে ফেললো।  হাসপাতালের ব্যবসায় মন্দা পড়লো, নবীন চিকিৎসকরা ক্ষুন্ন হলো, তবে সাধারন মানুষ বললো একটা সুচিকিৎসা হলো।

স্বাস্থ্যখাতে সরকারি আর বেসরকারি প্রচেষ্টায় যে পরিমান অর্থ ব্যয় হয়, তার মুখ্যভাগই খরচ হয়ে যায় গুটিকয় শহরের বড় হাসপাতালে।  কোন বেসরকারি হাসপাতালে কালেভদ্রে কোন জটিল অপারেশন হলে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় স্থান পায়। কিন্তু এতে সামগ্রিকভাবে সমাজের মোট রোগভোগের আর সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোন হেরফের হয় না। খবরের কাগজের এই চমক জাগানো খবরে হরিপদ কেরানির হাঁপানি রোগের সুরাহা হয় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি কোনমতেই আমাদেও মত উন্নয়নশীল দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সফলকাম হতে পারেনা।  আপৎকালীন চিকিৎসায় যৎকিঞ্চিত সরকারি পয়সাকড়ি আর স্বেছাসেবী সংস্থার উদ্যোগ নিশেঃষ না করে, প্রতিরোধমুলক চিকিৎসায় জোর দেওয়া হলে হরিপদদের মত মানুষগুলোর রোগের ফাঁদে পড়া আটকানো যায়।  ব্যক্তিগত ও সরকারি চিকিৎসাখাতে খরচের মুখ্যভাগই হৃদরোগ আর ডায়াবেটিস রোগে ব্যয় হয়ে যায়, যদিও এই দুই রোগের প্রকোপ অনেক অল্প খরচেই নিবারণযোগ্য।  যে দৃষ্টিভঙ্গিতে চিকিৎসা চলছে, তাতে মুষ্টিমেয় সচ্ছলের রোগউপশম (paliation), চিকিৎসকের আত্মশ্লাঘা পূরণ, আর সর্বোপরি বহুজাতিক ঔষধপ্রস্তুতকারি ও প্রযুক্তি নির্মাণকারী সংস্থার অর্থসমাগমের সুবন্দোবস্ত হচ্ছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আশু প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সহজবোধ্য অথচ সস্তা রোগ নিবারণে উদ্যেগের অভাব কেন?

আমার মত অল্পবুদ্ধি নগন্যকে এই সহজ প্রশ্নটা বেশ পীড়া দিলেও এর উত্তরটা বেশ জটিল।  কলেরা বা ডিপথেরিয়া রোগ প্রতিষেধকের মত হৃদরোগ প্রতিরোধের কোন টিকা নেই, যেটা কিনা অল্প আয়াসে প্রয়োগ করা যায়। হৃদরোগের নিবারণের জন্য চাই বৃহত্তর সমাজের জীবনযাত্রার আর অভ্যাসের পরিবর্তন।  এই বিপুল কর্মকান্ডের সুফল চটজলদি মেলেনা।  আর এর জন্যই এই আন্দোলনটা একক ভাবে অথবা সামগ্রিকভাবে (সরকারি অথবা বেসরকারি) আকর্ষক নয়।  কেবল এই বৈষম্যটাই পীড়াদায়ক, যখন দেখি, এইডসের (aquired immune deficiency syndrome) মত রোগ, যেটা কিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করে না, তার প্রতিরোধের বার্তা মিডিয়ার দৌলতে গ্রামে গঞ্জে পৌঁছে গেছে। প্রতিবেশী দেশ চিনেও ধূমপান বিরোধী সরকারি বিলবোর্ড আছে। চিনে প্রকাশ্যে, নিভৃতে  ঘরের কোণের বাইরে সিগারেট ফুঁকলে মোটা জরিমানা আপনাকে যৎকিঞ্চিত জরিমানার প্রতিদানে সুস্বাস্থ্য উপহার দেবে।  আমাদের দুর্ভাগ্য, মন্দির-মসজিদ আর সুউচ্চ মুর্তি খাড়া করার বাইরে সফল ও প্রয়োজনীয় জনহিতকার প্রকল্পের কল্পনাও দেশের কান্ডারীদের মাথায় নেই। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা  জানা আছে, কেবল জানা নেই তার সফল প্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক কুটনীতি।

একটা প্রাচীন প্রবচন আছে। চিকিৎসক তিন প্রকারের হয়। উচ্চশিক্ষিত, পরিশ্রমী ও সফলকাম চিকিৎসক জটিল ও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রয়োগে মরণাপন্ন রোগীকে সুস্থ করে তোলেন ।  এঁদের চেয়েও ভালো চিকিৎসক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা মাত্রই অল্প আয়াসে রোগমুক্তি ঘটাতে পারে।  সুচিকিৎসক তার বিদ্যার প্রয়োগে, রোগ নিবারণ করে থাকে। সুচিকিৎসকের কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেলে, প্রথমোক্ত চিকিৎসকদেও অবশ্য কর্মহীন হবার আশঙ্কা থেকে যায়।  সুচিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাঁদের নিষ্কন্টক কর্মকাণ্ড কামনা করি।

সোমবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮

মমতা ও আরএসএস ~ সুশোভন পাত্র

নিউটনের ঘরের কেয়ারটেকার সেদিন পরিচারিকা কে পই পই করে বলেছিলেন, "ডিমটা সেদ্ধ করে, বাবুকে খাইয়ে, তবেই আসবি।" কিন্তু গবেষণায় বিঘ্ন ঘটবে বলে, নিউটন নিজেই ডিম সেদ্ধ করে, সময়ে খেয়ে নেবার আশ্বাস দিয়ে তাঁর পরিচারিকা কে ফেরত পাঠিয়ে দেন। একঘণ্টা পর পরিচারিকা এসে দেখেন, সসপ্যানে রিষ্ট ওয়াচটা সেদ্ধ হচ্ছে আর নিউটন উনুনের সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে, হাতে ধরা ডিমের দিকে তাকিয়ে সময় দেখছেন।
টিকিট চেকার টিকিট চাইতেই আইনস্টাইন অনেক খুঁজেও টিকিটটা পেলেন না। টিকিট চেকার আইনস্টাইনকে চিনে বলেছিলেন, "আরে প্রফেসর, আর খুঁজতে হবে না। আমি নিশ্চিত আপনি টিকিট কেটেছেন।" কাতর স্বরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, "না, না খুঁজতে তো হবেই। ওটা না পেলে আমি জানব কি করে কোথায় যাচ্ছি!"
ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের পথিকৃৎ নিউটন ডিমের বদলে ভুল করে রিষ্ট ওয়াচ সেদ্ধ করেছিলেন। থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের জাদুকর আইনস্টাইন টিকিট আনতে ভুলেছিলেন। আর দিল্লীর মসনদ দখলের দিবাস্বপ্নে মশগুল আমাদের মুখ্যমন্ত্রী স্বরচিত ইতিহাসটাই ভুলে গেছেন। আসুন দায়িত্বশীল কামাল হাসানের ভূমিকায় সদমা সিনেমার শ্রীদেবীর যত্ন নিন। কর্তব্যপরায়ণ নাগরিক হিসেবে তাঁর কৃতকর্ম স্মরণ করিয়ে দিন।  
জরুরী অবস্থায় সিদ্ধার্থশংকর রায়ের তাঁবেদারি করে, জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির বনেটে নেচে ¹, ইন্দিরা হত্যার সহানুভূতির ভোটে প্রথম সাংসদ হয়ে ², শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আনন্দবাজারের হবু 'অগ্নিকন্যা'। ধর্মীয় মেরুকরণের চ্যাংড়ামি তে জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছে বি.জে.পি ³ । 'লৌহ পুরুষ' রথে চেপে, বাড়ি বয়ে বলে আসছেন 'মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'। অযোধ্যায় জুটছেন কর-সেবকরা। ৯২'র ৪ঠা ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শহীদ মিনারে জনসভা ডাকল বামফ্রন্ট। আর সেদিনই সিধো-কানহু ডহরে সভা করে 'ইন্ডিয়া ইয়ুথ কংগ্রেসের' সাধারণ সম্পাদিকা মমতা বললেন, ''সব সি.পি.এম'র ষড়যন্ত্র। বি.জে.পি অযোধ্যায় কিছুই করতে পারবে না। আসলে সি.পি.এম আমাদের আটকাতেই ক্যাডার জড়ো করছে" ⁴ ।  ৯৭'র ডিসেম্বরে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত মমতা'ই জোটসঙ্গী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "বি.জে.পি তো  অচ্ছুৎ নয়" ⁵।  বাস্তবেই ছুৎমার্গ শিকেয় তুলে ৯৮'র লোকসভা ভোটে‍‌ তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে খাতা খুলল বি.জে.পি। আর ৯৯' এ এন.ডি.এ'র শরিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন রেলমন্ত্রী ⁶।
ম্যাডাম, আজ আপনার বি.জে.পি কে 'সাম্প্রদায়িক' মনে হচ্ছে? কিন্তু আপনিই তো বি.বি.সি'র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বি.জে.পি নাকি তৃণমূলের "ন্যাচারাল অ্যালি" ⁷? গুজরাট দাঙ্গার সময়ে আপনি বাজপেয়ী সরকারে মন্ত্রী ছিলেন না ⁶?  সংসদ যখন গুজরাটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করছে তখন সরকারের পাশে দাঁড়াবার আশ্বাস দিয়ে বাজপেয়ী কে আপনি চিঠি লেখেননি ⁸? তবে যে আপনারই সাংসদ কৃষ্ণা বসু তাঁর 'অ্যান আউটসাইডার টু দি পলিটিক্স' বইয়ে লিখেছেন, লোকসভায় যেদিন গুজরাটে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে ভোটাভুটি হচ্ছে সেদিন আপনিই নাকি এন.ডি.এ সরকার কে ভোট দেবার হুইপ জারি করেছিলেন ⁹? আপনিই তো দাঙ্গা পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভের পর নরেন্দ্র মোদী কে অভিবাদন জানিয়ে পুষ্পস্তবক পাঠিয়েছিলেন ¹⁰। আপনিই তো ২০০৪'র লোকসভা এবং ২০০৬'র বিধানসভা নির্বাচনে বি.জে.পি'র সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলেন ⁴ । 
ম্যাডাম, আজ আপনি বলছেন আর.এস.এস 'ভয়ঙ্কর'? আর ২০০৩'র ১৫ই সেপ্টেম্বর দিল্লিতে 'পাঞ্চজন্য'র অনুষ্ঠানে আপনি সংঘ নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ''আপনারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আপনারা দেশকে ভালোবাসেন। আপনাদের ১% সাহায্যে আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারবো।'' মনে পড়ে গদগদ আর.এস.এস নেতারা আপনাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ''হামারি পেয়ারি মমতাদি সাক্ষাৎ দুর্গা'' ¹¹?  এই তো সেদিন 'দুর্গার' সাফল্যে খুশি হয়ে আর.এস.এস'র রাজ্য মুখপত্র 'স্বস্তিকা' সম্পাদকীয় তে লিখেছিল "দায়িত্বশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দুঃশাসনের অবসান" ¹² । এই তো সেদিন আর.এস.এস'র জাতীয় মুখপত্র 'ওর্গানাইজার' স্বর্ণাক্ষরে উত্তর-সম্পাদকীয় তে ছেপেছিল, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের সেই বিরলতম প্রজাতির রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক ভাবে সৎ। দেশে তাঁর মতই রাজনীতিবিদ প্রয়োজন" ¹³ ।
সাইকো-অ্যানালিস্ট গিরিন্দ্রশেখর বসু কে একদিন তাঁরই এক রোগী বললেন "স্যার, গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনি নর্দমায় পড়ে গেছেন; আর আমি আপনাকে অনেক কষ্টে ওঠাতে চেষ্টা করছি।" গিরিন্দ্রশেখের মুচকি হেসে বলেন, "আমি অত্যন্ত আনন্দিত আপনার সাহায্য পেয়ে। কিন্তু নর্দমায় আমাকে ফেলেছিল কে?" ম্যাডাম, আপনার রাজত্বে যখন গত পাঁচ বছরে পাঁচ গুন বেড়েছে আর.এস.এস'র শাখার সংখ্যা ¹⁴, আজ যখন অনাহারে মরা চা শ্রমিকের রাজ্যে যাদবপুরে 'গরু পূজার' ছ্যাবলামি করছে মাথায় গোবর ভর্তি সন্তানরা, আজ যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে তিন তালাকের সমর্থন জানাচ্ছে আপনারই মন্ত্রীরা, আজ যখন হাজিনগর থেকে ধুলাগড়ে ধর্মের নামে ঘরে ঘরে দাঙ্গার আগুন ছড়াচ্ছে আপনার ভাইরা; তখন  রাজনীতির অঙ্ক কষতে সিদিকুল্লা-তোহা সিদ্দিকী'দের মাথায় তুলে রাখছেন আপনি? মোহন ভাগবত'দের কলকাতায় সভা করে বিষ ছড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছেন আপনি? বি.জে.পি-সংঘ বিরোধিতায় ভেকধারী খড়গহস্ত হওয়ার তামাশা করছেন আপনি? গোটা রাজ্য কে ধর্মীয় মেরুকরণের বারুদে সাজিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে মুজরা দেখছেন আপনি? আগে বলুন তো মাননীয়া, এদ্দিন এরাজ্যে আর.এস.এস আগলে রাখল কে?  বলুন সম্প্রীতির বাংলায় বি.জে.পি'র বীজ বপন করেছিল কে? নিজের গোয়ালে, নিজের আঁচলে, লুকিয়ে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিল কে? আমি আনন্দিত আজ আপনি বি.জে.পি-সংঘের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আগে বলুন তো ঐ নর্দমায় আমাদের ফেলেছিল কে?   
একদিন মার্ক টোয়েন সকালবেলা শার্ট পরতে গিয়ে দেখলেন শার্টে বোতাম নেই। একটার পর একটা, তিনটে শার্ট বার করে পরতে গিয়ে দেখেন সব সার্টেই একটা করে বোতাম নেই। রাগে অকথ্য গালিগালাজ করতে করতে মার্ক টোয়েনে যখন চতুর্থ শার্টটা বের করছেন, তখন তাঁর রুচিশীল স্ত্রী, সব শুনে, স্বামীকে অপ্রস্তুত করার জন্যেই প্রত্যেকটি গালিগালাজ স্পষ্ট করে আবার উচ্চারণ করলেন। মার্ক টোয়েন সেটা শুনে বলেছিলেন, "তোমার শব্দগুলো সব ঠিকই আছে, কিন্তু... ইমোশনটা মিসিং।"
ম্যাডাম,  আজ আপনি বি.জে.পি -সংঘের বিরোধিতা করছেন বটে।  কিন্তু ঐ যে... ইমোশনটা মিসিং।

















শুক্রবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৮

দিল্লি চলো ~ অবীন দত্তগুপ্ত

বহুকাল লিখি না । কিছু কিছু মাহেন্দ্রক্ষনে লিখতে হাত নিশপিশ করে,কিন্তু লেখা বেরোয় না । আজকে লিখতেই হবে ,যে করে হোক , কিন্তু কিভাবে ? কোথায় একটা শুনেছিলাম , রবিকবি নাকি বলেছিলেন " লেখা না এলে ,অনুবাদ করো ।" আদপে বলেছিলেন কিনা জানি না ,কিন্তু আজ দুপুরে নিজের সুবিধার্থে বিশ্বাস করলাম । লেখার মতোই টিভিতে খবরও দেখিনা বহুদিন । কাহাতক আর বড়লোকের দালালি গেলা যায় ? গতকাল এক বন্ধু বললো , এন ডি টি ভি-তে রাভিশ কুমারের কাজগুলো দ্যাখ - অন্যরকম । আজ দুপুরে এন ডি টি ভি-তে কিষান মুক্তি মার্চের কভারেজ দেখলাম । সৎ মানুষ দেখলে আজকাল গায়ে কাঁটা দেয় , সৎ সাংবাদিক - ডায়নোসরের ডিম। আজ রাবিশবাবুকে দেখলাম । রাবিশ কুমার ইউনিকর্নের মতো ,বিলুপ্ত প্রজাতির । অদ্ভুত সুন্দর সাংবাদিকতা । শেষে একটা চিঠি পড়লেন ( চিঠির ছবি নীচে দিলাম) । বললেন লাল ঝান্ডা কাঁধে এক কৃষক গতকাল ওনাকে চিঠিটা দিয়েছে ।  শুনেই ঠিক করলাম এইবার আমার হাতের আড় ভাঙ্গার সময় হয়েছে । চিঠিটা অনুবাদ করব ।  অতএব ...

                         মাফ করবেন
আমাদের আজকের মিছিলে আপনার হয়তো অনেক অসুবিধে হয়েছে ।

আমরা কৃষক । আপনাকে বিরক্ত করার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই । আমরা নিজেরাই খুব অসুবিধের মধ্যে রয়েছি । আপনাকে এবং সরকারকে নিজেদের কষ্টের কথা বলতেই আমরা আজ বহুদূর থেকে এসেছি । আমরা আপনার ঠিক এক মিনিট সময় চাই । 

আপনি কি জানেন , ডাল,সব্জি,ফল বেচে আমরা কতো টাকা পাই আর আপনি কতোতে কেনেন ? 

মুগ ডালঃ আমরা বেচি - ৪৬টাকা কিলো । আপনি কেনেন ১২০টাকা কিলো ।
  টমেটোঃ আমরা বেচি - ৫টাকা কিলো  । আপনি কেনেন ৩০টাকা কিলো ।
  আপেলঃ আমরা বেচি - ১০টাকা কিলো  । আপনি কেনেন ১১০টাকা কিলো ।
      দুধঃ আমরা বেচি - ২০টাকা লিটার  । আপনি কেনেন ৪২টাকা লিটার ।

এটাই আমাদের অসুবিধা । আমরা সমস্ত জিনিস সস্তায় বেচি আর বেশী টাকায় কিনি । আমাদের জিবনটাও খুব সস্তা জানেন। গত ২০ বছরে তিন লাখের বেশী ,'আমরা' আত্মহত্যা করেছি । আমাদের মুশকিল আসান করতে পারে একমাত্র কেন্দ্র সরকার , কিন্তু আমাদের কথা তারা শোনে না । সরকার একমাত্র মিডিয়ার কথা শোনে , কিন্তু মিডিয়া আমাদের খুঁজেই পায় না । এই মিডিয়ার ঝুটিটা কিন্তু আপনার হাতেই ধরা । তাই আমরা নিজেদের দুঃখের- দুর্দশার গল্প আপনাকে বলতে এসেছি ।

আমরা শুধু চাই যে কৃষকদের সমস্যার কথা আলোচনা করার জন্য সংসদের একটি অধিবেশন ডাকা হোক । আমরা চাই, সেই অধিবেশনে দুটো আইন পাশ হোক ।
১। কৃষকের ফসলের সঠিক দাম ঠিক করার আইন
২। সমস্ত কৃষককে ঋণমুক্ত করার আইন । 
আমরা কি ভুল কিছু চাইছি ?

আমাদের কথা আপনার ঠিক মনে হলে ,আজকে আমাদের সাথে দুকদম হাটুন । কাল ৩০ নভেম্বর সংসদের সামনের রাস্তায় আমরা সকলে থাকবো । আপনি এলে আমাদের মনোবল বাড়বে । আসবেন তো ? "

বুধবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৮

বাংলা মিডিয়া ~ সুশোভন পাত্র

জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী। বুদ্ধবাবু ফি-বছরে ২লক্ষ চাকরি দেবেন বলে স্বপ্ন দেখান। সরকারী পয়সায় 'বেঙ্গল মিন্স বিজনেস'র আসর বসান। অমুক লগ্নি, তুমুক বিনিয়োগের গল্প শোনান। শিল্প ধরতে বিদেশ গিয়ে মিকি মাউসের পিয়ানো বাজান। অথচ, সেই বুদ্ধবাবুর নাকের ডগায় রাইটার্সে, বেকারির জ্বালায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন সঞ্জয় সাহা। দুধের শিশু কোলে নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে স্ত্রী শর্মিষ্ঠা বলছেন, এলাকার প্রভাবশালীর সিপিএম নেতার ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রোমোটারের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করায় দুদিন আগেই হেনস্তা হতে হয়েছিল তাঁর স্বামী কে। 
জাস্ট একবার ভাবুন। বুদ্ধবাবু গলার শিরা ফুলিয়ে 'জঙ্গলমহল হাসছে' বলে মঞ্চ কাঁপান। অলিতে গলিতে ২টাকা/কেজি চালের বাতেলা শোনান। সরকারী পয়সায় নিজের হোর্ডিং টাঙ্গিয়ে ফুটুনি মারান। আর পূর্ণাপানির শবররা অনাহারে-অপুষ্টি তে প্রিয়জন'দের লাশ কুড়ান। রেকর্ড ৩৪% বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা পঞ্চায়েতে লুটের রাজত্ব। 'হার্মাদ'দের তোলাবাজি তে বন্ধ গ্রামের রেশন। অবশ্য মুখে ভাত না থাক, এলাকায় চোলাই মদের কোন অভাব রাখেন না সিপিএম নেতারা। 
জাস্ট একবার ভাবুন, বুদ্ধবাবু বলছেন, 'উৎসব করব না তো কি শ্রাদ্ধ করব?।' বুদ্ধবাবু শবরদের গ্রামের বাইরে খাকি পোশাকের পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছেন। তাক লাগানো মেনুর সম্ভারে আহারে বাংলায় অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। হেলিকপ্টারে উড়ে জগদ্ধাত্রী পূজার উদ্বোধন করছেন। বুদ্ধবাবু ফিরে এসে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ক্যাডার মিটিং-এ দিল্লি জয়ের ডাক দিচ্ছেন।  
বুদ্ধবাবু-সিপিএম-আত্মহত্যা-চোলাই-অনাহার-হেলিকপ্টারর-পুলিশ। জমকালো স্টোরি লাইন না? ব্রেকিং নিউজে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' সাজানো প্লেট। প্লেটের উপর বামফ্রন্ট সরকার কে কচুকাটা করে সাজানো ডিশ। আর মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্য তো 'আইস অন দি কেক'। শর্মিষ্ঠা সাহা কে স্টুডিও তে বসিয়ে এক্সক্লুসিভ ইন্টার্ভিউ হবে। শবরের শব সাজিয়ে সিক্সটি পয়েন্টের হেডিং হবে। অনাহারদীর্ণ জঙ্গলমহল আর আহারে বাংলা -পাশাপাশি রেখে ভিসুয়াল হবে। বুদ্ধিজীবীরা ঘণ্টাখানেকে সিপিএম'র বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে দেবে। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী প্রতিদিন সকালে পাঁচ জন সিপিএম'র লাশ দেখতে চেয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলে দেবে। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন, দুধ জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।  
কিন্তু কি আশ্চর্য, এসব কিছুই হল না। ৯৯-র সাইক্লোনে গল্পের গরু গাছে চড়ানো মিডিয়া জানতেই পারলো না, সঞ্জয় সাহা খোদ নবান্নের সামনে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করল। মাননীয়া ছাড়া কারও তাঁবেদারি না করা মিডিয়া দেখতেই পেল না, সাতটা লাশের বিনিময়ে শবরদের পাতে আজ ভাত জুটল। সেদিন জঙ্গলমহলে আতস কাঁচে 'হার্মাদ ক্যাম্প' খোঁজা মিডিয়া প্রশ্নই করল না যে রেশনহীন গ্রামে বে-আইনি চোলাই মদের ভাটি চলছিল কার অনুপ্রেরণায়? আর শবর'দের লাশ সাজিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টার চাপার আহ্লাদিপনা করেন কার বাপের পয়সায়? করল না কারণ, মুখ্যমন্ত্রীর নামটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নয়। গত ১৫দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সিপিএম'র আমলে নয়। শাসক দলের সদর দপ্তর আলিমুদ্দিনে নয়। বরং কালীঘাটে। আর ঘটনা গুলো তৃণমূলের রাজত্বে। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুকুমতে। 
রেজ্জাক মোল্লা তখন সিপিএম। "হেলে ধরতে পারেনা কেউটে ধরতে গেছে" মন্তব্য তখন হট কেক। 'বাম বিদায়ের' কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে রেজ্জাক মোল্লার বিদ্রূপ কে দায়িত্ব নিয়ে বেডরুমে পৌঁছে দিয়েছিল মিডিয়া। আর আজকে সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক, পাঁচ বছর ক্যাবিনেটের সদস্য রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলছেন, "সিঙ্গুরে টাটারা কারখানা শুরু হলে সব কৃষকই জমি দিয়ে দিতেন। তাঁরা বুঝতেন এতে কাজ হবে, প্রশিক্ষণ মিলবে। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই টাটারা পুরো জমিটাই পেয়ে যেতেন। আর এটা সরকারের বিরাট সাফল্য হতো। সিপিএম আরও বেশ কিছুদিন রাজ্যের সরকারে থাকতে পারতো।" সেদিন রেজ্জাক মোল্লা কে বুদ্ধবাবুর "জনবিরোধী শিল্পনীতির" বিরুদ্ধে প্রক্সি-ওয়ারের ক্রুসেডর বানানো কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি রবীন্দ্রনাথ বাবুর বিবৃতি মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ছুঁড়ে মেরে সিঙ্গুরের 'জমি আন্দোলনের' ন্যাকামির কৈফিয়ত চাওয়ার? কোন মিডিয়ার হিম্মত আছে নাকি সিঙ্গুরের কৃষক'দের চাওয়া পাওয়ার সাচ্চা ময়নাতদন্ত করার? বাংলার বেকার'দের জীবন যন্ত্রণার আর্তনাদের প্রতিধ্বনি ছাপার?
নেই! কারণ এই গৃহপালিত মিডিয়াই তো সেদিন মমতা কে মসিহা বানিয়েছিল। চ্যাংড়া তৃণমূল কে 'কৃষক দরদী' সাজিয়ে পাড়া মাথায় তুলেছিল। 'পরিবর্তন চাই' বলে কাঁদুনি গেয়েছিল। আর এই গৃহপালিত মিডিয়াই সেদিন আপনাকে "৩৪ বছরে কিছুই হয়নি" বলতে শিখিয়েছিল। 
১৯৯৮-২০১০, রাজ্যে প্রতি বছর এস.এস.সি'র মাধ্যমে নিয়োগ হয়েছিল ১,৮৫,৮৪৫ জন। পেটো মস্তানদের ৮-১০লক্ষ ঘুষ দিতে হয়নি। হাইকোর্টের কাছে বারবার মুখ ঝামা খেতে হয়নি। ২০০৪-২০১০, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সাধের 'গুজরাট মডেল' কে টেক্কা দিয়ে সেরা হয়েছিল বাংলা। সরকারী পয়সায় মুখ্যমন্ত্রী কে বিদেশ সফরে যেতে হয়নি। 'বেঙ্গল মিন্স বিজনেস'র আদিখ্যেতা করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার মন্ত্রী-মেয়র'দের ক্যামেরার সামনে ঘুষ খেতে হয়নি। সাংসদ'দের চিট-ফান্ডের চিটিং বাজির জন্য জেলে যেতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী'দের ১.৮৬ কোটির ছবি বিক্রি করতে হয়নি। ডেলোতে সুদীপ্ত সেন'দের সাথে গভীর রাতে বৈঠক করতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, দলের চোর-লম্পট'দের আড়াল করতে সিবিআই তদন্তে বাধা দিতে হয়নি। বিজেপির সাথে সেটিং করে সিবিআই'র জুজুতে রাফালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, ১লক্ষ সরকারী শূন্যপদে নিয়োগ বাকি রেখে সরকার মোচ্ছবে মাতেনি। মহার্ঘ্য ভাতা বকেয়া রেখে ক্লাবে ক্লাবে গুণ্ডা পুষতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বাংলার রাজনীতি তে ধর্মের নামে ভোট চাইতে হয়নি, জীবন-জীবিকার সমস্যা কে আড়াল করে রথের চাকায় সাম্প্রদায়িকতার বারুদ সাজাতে হয়নি। ৩৪ বছরে কোনদিন, বুদ্ধিজীবী'দের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে সরীসৃপ সাজতে হয়নি। মিডিয়া কে এই নজিরবিহীন নির্লজ্জ স্তাবকতা করতে হয়নি। সীমাহীন ঔদ্ধত্য কে 'সততার প্রতীক' বলে চালাতে হয়নি। 
সত্যিই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ঠিকই বলেন, ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। গৃহপালিত মিডিয়া তো ঠিকই বলে ৩৪ বছরে তো কিছুই হয়নি। জাস্ট একবার ভাবুন তো, ৩৪ বছরে তো কত কিছুই হয়নি।

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৮

দাংগা ও দিদি ~ আরকাদি গাইদার

- তাড়াতাড়ি শেষ করো, অনেকক্ষন ধরে বসে আছি, এবার ক্লান্ত লাগছে।

- হ্যা, আর কয়েকটা বিষয় বাকি, সেগুলো আলোচনা করে নিলেই মিটিং শেষ।

- বলো, বলো।

- বিজেপি - আরএসএসের রথযাত্রা নিয়ে সেরকমভাবে কোন বিশেষ প্রশাসনিক পদক্ষেপের নির্দেশ পাইনি। ওটা কি করবো?

- কিছুই করবে না।

- কিছুই করবো না!

- না। পারমিশন আছে তো। নিয়ম মেনে সাথে এসকর্ট দেবে। ব্যাস, আরকি।

- কিন্তু..আসলে, মানে ব্যাপারটা তো এত সহজ না। এটা তো সাদামাটা রাজনৈতিক প্রচারযাত্রা নয়। এটার উদ্দেশ্য তো অন্য। সেই '৯২তে রথযাত্রা করেছিলো। যেখান দিয়ে রথ গেছিলো সেখানেই দাঙা লাগিয়েছিলো। এবারেও তাই করবে। গোটা বাংলা জুড়ে রথ চলবে, পেছনে গুন্ডা, দাঙাবাজদের দলবল থাকবে, সব জায়গায় দাঙার আগুন লাগবে।

- হুম।

- তাই বলছিলাম, একটু কড়া ভাবে যদি কন্ট্রোল করা যেতো। সেরকম নির্দেশ..

- আচ্ছা, এত বয়স হলো তোমার। রাজনীতি কবে বুঝবে? ধরো তোমার কথাই সত্যি। ওরা রথযাত্রা করলো। দাঙা লাগালো। সেটা ভালো না খারাপ?

- ভালো না খারাপ? ইয়ে, মানে?

- আরে ছাগল, দাঙা লাগলে কি হবে? বাড়ি ঘর জ্বলবে, অনেক লোক ঘরছাড়া হবে, ক্যাম্পে যাবে। কয়েকজন খুনও হতে পারে। তারপর সেই সমস্ত ছবি টিভিতে দেখানো হবে, পেপারে বেরোবে। তাতে কি হবে? লোক ভয় পাবে। ভয়, ভীতি, প্যানিক - এইগুলো হলেই মানুষ পরিত্রাতা খুজবে। সামনের বছরে নির্বাচন। ভয় পেলে মানুষ এই দাঙাবাজদের আটকাতে আমাদের দিকেই আসবে। 

- কিন্তু আগে থেকেই দাঙা আটকানো ভালো না?

- আগে থেকে আটকালে তো কোন ক্রাইসিসই হলো না। ভয় নেই। প্যানিক নেই। তখন দাঙা নিয়ে মানুষ চিন্তাভাবনা করবে? নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে না হলে মানুষ তখন অন্যান্য জিনিস নিয়ে ভাববে তো। তখন কি হবে ভেবে দেখেছো? 

- না, সেটা ভাবিনি।

- তাহলে ভাবো। কল্পনা করে নাও বাংলায় আমরা এর আগের কয়েকবছরে একটাও দাঙা ঘটতে দিইনি। কড়া হাতে দমন করেছি। কেউ মারা যায়েনি। কোন রক্ত ঝরেনি।  আজকের মতন মানুষ সাম্প্রদায়িক হিংসে নিয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে নেই। এরকম পরিস্থিতিতে এই যে আমাদের দলের প্রমোটারের অত্যাচারে বেকার যুবক নবান্নের সামনে এসে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলো বা তারপর ধরো ৭টা শবর অনাহারে মারা গেলো। তখন টিভি, পেপার, পাব্লিক স্পেসের আলোচনা-আড্ডা কি নিয়ে হতো? সেখানে আমাদের কি হাল হতো?

- এটা ভাবিনি।

- জানি। তাই ভাবতে বলছি। ধরো রথযাত্রা পরবর্তী হিংসেয় একজন মারা গেলো।  এই যে ৭জন শবর না খেতে পেয়ে মারা গেলো, তার থেকে দশগুন বেশি দৃশ্যমান হবে সেই ঘটনা। সবাই অনেক বেশি নাচানাচি করবে। কারন আপাতত বাজারে সাম্প্রদায়িকতার টিআরপি বেশি। তাহলে সেটা আমাদের জন্যে ভালো, না খারাপ?

- আপনি কি ব্যাটম্যান দেখেছেন? ওখানে জোকার এরকমই বলেছিলো - No one bothers when things go according to 'plan'..

- তুমিও কি বোকা লিবারবাল হয়ে গেলে নাকি? এরকম জ্ঞানপাপীদের মতন ডায়ালগ ঝাড়ছো কেন? যাই হোক, তাহলে এই নিয়ে আর কনফিউশন নেই তো? একটু ঝামেলা হলে ভালো। বাদবাকি দায়িত্ব লিবারবালরা নিয়ে নেবে। নেচে কেদে সমস্ত স্পটলাইট ওই দাঙাতেই ফোকাস করাবে। আর কিছু আছে?

- হ্যা, আর দুটো বিষয়। ওই শ্রমিক-কৃষক সংগঠনগুলোর পর পর কিছু দেশব্যাপী কর্মসূচী আছে।

- তাতে আমাদের কি?

- ওই কর্মসূচীগুলোর মধ্যে একটা ৮-৯ই জানুয়ারীর সারা ভারত সাধারন ধর্মঘট আছে। সেটা তো আমাদের রাজ্যেও হবে।

- সর্বশক্তি দিয়ে আটকাতে হবে। আমাদের রাজ্যে কোন শ্রমিক কৃষকের ব্যাপার নেই। ওসব যেন এখানে দৃশ্যমান না হয়। আজকে বলছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, কালকেই একই ইস্যুগুলো আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেবে। চাষ নিয়ে যা বলছে তা তো আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও সত্যি। তখন সামলাবো কি দিয়ে? আমাদের রাজ্যে যা হবে স্রেফ এই হিন্দু-মুসলমান-সেকুলার-দাঙাবাজ লাইনে, বুঝলে? নাহলে আমাদের চাপ আছে। শেষ বিষয় কি?

- ওই যে আপনি সরকারি ফুড ফেস্টিভাল করছেন না - আহারে বাংলা, আজ ওটার বাইরে বিরোধী বিধায়ক বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন ওই ৭ শবরের অনাহারে মৃত্যু নিয়ে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে তো আবার ওই কয়েকটা ছেলেকে মাওবাদী বলে গ্রেপ্তার করা হলো। এই ঘটনাটা সামনে চলে আসছে বারবার। 

- হুম। দেখি মিডিয়ার লোকজনের সাথে কথা বলে। শোভন আর বৈশাখীর ব্যাপারটা বেশি বেশি করে প্রচার করলেই লোকে আর অন্যকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবে না। দলেও বলে দেবো, এই বিষয় কিছু বাইট ফাইট দিয়ে পাব্লিক কে একটু বিভ্রান্ত রাখতে। আর কিছু?

- না। আসি তাহলে।

- এসো।

(প্রায় দু দশক আগে, লালুপ্রসাদ যাদব এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন - 'সরকার না চাওয়া, তো দাঙা না হোওয়া')


শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

বনপলাশীর পাখ-পাখালি ~ মিনহাজ

এই যে আমরা শহুরে বাঙালিরা ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে গিয়ে একটু খানি দম ফেলার ফুরসত পেলেই ছুটে যাই গ্রাম বাংলায় তার একটা উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভাবে গাছপালা নদী নালা পাহাড় টিলা র সৌন্দর্য্য আর সঙ্গে দূষন মুক্ত পরিবেশে ফুসফুসে কিছুটা বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়ে নেওয়া। তারপর ফিরে এসে নতুন উদ্যমে আবার দৌড় শুরু করা। কেউ ইঁদূরর আর কেউ বা বেড়াল হিসাবে।এরকম ই এক উদ্দেশ্যে গত পুজোয় ১১ জন বন্ধু বান্ধব কাচ্চা বাচ্চা মিলে ঘুরে এলাম মুরুগুমা। পুরুলিয়ার পশ্চিম প্রান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে মুরুগুমা ড্যাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রকৃতির কোলে ছবির মত সুন্দর রিসর্ট-বনপলাশী ইকো হাট। ছিম ছাম-খোলা মেলা গাছ গাছালি পুকুর- আড্ডা ঘর-গেজিবা সমেত একটা দারুণ ব্যাপার।প্রয়োজনীয় সব আছে কিন্তু বাহুল্য নেই। ড্যামের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা- পাকদন্ডি ধরে গাড়িচালিয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ে জঙ্গলে আদিবাসী গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে তিনটে দিন কেটে গেল হুস করে। মাঝে একটা দিন বাঁশপোড়া চিকেন আর ঝলসানো শোল মাছ সহযোগে খানাপিনা আর একটা সন্ধে পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নাচের আসর আমাদের বেড়ানোর আনন্দ কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল। সে কথা বিস্তারে লেখা যাবে অন্য কোন সময় । আজ লিখব একটু অন্য বিষয়ে।











এরকম পারিবারিক বেড়ানোর পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের একটি বিষয় হল পাখি। রঙ বেরঙ এর বিভিন্ন ধরনের দেশ বিদেশের পাখি বিভিন্ন সময় আসে আমাদের এই বাংলার আনাচে কানাচে। তাদের দেখা আর ছবি তোলার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ আছে। সেই কারণে কোথাও বেড়াতে গেলে আমার ক্যামেরার ব্যাগ টা সঙ্গে নিয়ে নিই।

মুরুগুমা আলাদা করে পাখির জন্য খুব একটা বিখ্যাত জায়গা না হলেও গাছ পালা-খাল বিল আছে আর পাখি থাকবে না এমন হয়?
পৌঁছনর পরের দিন তাই একটু ভোর ভোর উঠে আশপাশ টা ঘুরে দেখার বাসনায় বেরতে যাব ওমনি দেখি আড্ডা ঘরের খড়ের চালে বাসা বানাতে ব্যস্ত বেশ কয়েকটা মুনিয়া পাখি। এদের ইংরেজী তে বলে Silver bill। পাশেই ছোট্ট পুকুর। পুকুর পাড়ে মাছ কিম্বা ব্যাঙ পাকড়ানোর ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা বক (Little egret) আর ল্যাজ নেড়ে নেড়ে খেলা করছে ছোট্ট পাখি খঞ্জনা (White Wagtail)। সারা গরম কাল ইউরোপ আর উত্তরের দেশগুলোতে কাটিয়ে শীত পড়তে না পড়তে সে চলে এসেছে আমাদের বাংলায়। 

গেটের মুখে পৌঁছে দেখি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রবিন (Indian robin)খেলা করছেন ইতি উতি। রিসর্টের নামের সাথে সাযুজ্য রেখেই বনপলাশীর আঙিনায় রয়েছে বেশ কয়েকটা পলাশ গাছ। পলাশের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট সব পাখি। বসন্তে যখন পলাশ ফুটবে -পাখিদের আনা গোনাও নিশ্চয় বাড়বে। আপাতত দুর্গা টুনটনি (purple sunbird) আর pale billed flowerpecker দেখতে পেলাম। দূরে ক্ষেতের মধ্যে একটা ছোট পলাশ চারার ওপর চুপটি করে বসে আছে কাজল পাখি (Brown shrike)। চোখের ওপর কালো দাগ থেকেই এমন নাম তার। ওই টুকু ছোটো পাখি-কিন্তু কি জোর তার ওই টুকুনি ডানায়! যার ওপর ভরসা করে সুদূর মোঙ্গলিয়া কিম্বা সাইবেরিয়া থেকে পাড়ি দিয়েছিল আকাশ পথে একটু উষ্ণতার জন্য। জিপিএস নেই কম্পাস নেই-শুধু অভিজ্ঞতা আর দুডানায় ভরসা করে হাজার হাজার নটিক্যাল মাইল জিওডেসিক পেরিয়ে সে পৌঁছে গেছে আমাদের দেশে।সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল আমাদের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবে ওদেশে। ভিসা ও লাগবে না-ইমিগ্রেশনের ঝামেলা ও নেই। সংস্কৃত দেশ কথাটা র অর্থ যে ভৌগলিক সীমাবদ্ধ ভূখন্ড মাত্র নয়- এক ব্যাপক বিশাল পরিসর তা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা না বুঝলেও এই পুঁচকে পরিযায়ী রা বোঝে।আর তাই বুঝি ছুটে আসে সেই সূর্যের দেশে যেখানে সংগীত এর নাম দেশ।
আমাদের দলনেত্রী অঙ্কের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনার (বউ এর ও বন্ধু আমার ও বন্ধু) ও পাখি দেখার সখ আর বেশ ভালো কোম্পানির দূরবীন দুই ই রয়েছে। সে ও দেখি ভোর ভোর উঠে রাস্তার ওপর থেকে ড্যাম এর দিকে তাক করে পাখি খুঁজছে। তার দূরবীনের অভিমুখ অনুসরণ করে দেখি একদল বেশ বড়সড় বাঁকাঠোঁট ওয়ালা পাখি আপন মনে খাওয়া দাওয়া সারছে। ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখলাম লাল ঝুটি ওলা Black Ibis বা Red Naped Ibis (কালো দোচারা) এর দল রাস্তার ওপারে প্রায় ২০০ মিটার দূরে ড্যামের অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া অংশটায় চরে বেড়াচ্ছে। মিশরীয় হায়রোগ্লিফিক হরফে খুব দেখা যায় এই ধরণের পাখি র ছবি।আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম যদি একটু কাছ থেকে ওদের ছবি পাওয়া যায়। এইখানে বলে রাখি, পাখিরা কিন্ত খুব সহজেই বুঝতে পারে কেউ তাদের দিকে বাড়তি নজর দিচ্ছে কিনা।তাই যে পাখির ছবি তুলতে চান তার কাছাকাছি যাওয়ার উপায় হল তার দিকে নজর না দিয়ে এটা ওটা করতে করতে অন্যান্য দিকে তাকিয়ে রয়ে বসে এগোতে থাকা। মানে এমন একটা ভাব করা যেন ওই পাখি গুলিই সব থেকে তুচ্ছ আর বাকি সব কিছুই আপনার কাছে ভীষণ মূল্যবান। যাওয়ার পথে দেখা হয়ে গেল বেশ কিছু মাঠ চড়াই (Paddy Field Pipit) এর সাথে। তারা বেশ জোড়ায় জোড়ায় খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। তা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পৌঁছে গেলাম প্রায় আধ ঘন্টা মত সময় নিয়ে আইবিস গুলোর ৩০/৪০ মিটার এর মধ্যে। তারাও খুব বেশী গুরুত্ব দিলনা আমাকে। আর আমিও প্রাণ ভরে ছবি তুল্লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি উল্টো দিক থেকে দুজন মানুষ দুটো সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছেন পাখি গুলোর দিকে। এমনি তে পাখিরা এলাকার পরিচিত পোষাক আসাক পরা মানুষ দের খুব একটা পাত্তা দেয়না। তা বলে খুব কাছে চলে এলে ওরাই বা চান্স নেবে কেন? সাইকেল আরোহীদের কৃপায় আমিও পেয়ে গেলাম ফ্লাইং শট্। ব্ল্যাক আইবিস এর ডানার সাদা দাগ গুলো উড়ন্ত অবস্থায় যতটা পরিস্কার হয় বসা অবস্থায় ততটা হয় না। আইবিস এর ছবি তুলে ফিরছি তখন। রাস্তায় ওঠার মুখে একটা বন কলমি র জঙ্গল আছে।ওটার পাশ দিয়ে আসার সময় দেখি একজোড়া ছোট্ট পাখি মাটি ঘেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাভভাব আর আকারে অনেকটা ভিরিরি বা Bengal bush lark এর মত। কিন্তু দেখতে যেন একটু আলাদা! ক্যামেরার টেলি লেন্স এ চোখ লাগিয়ে বুঝলাম ইনিও Lark তবে Bushlark নন Sparrowlark। বাড়ি ফিরে Inskipp এর বই দেখে চিনলাম এর নাম Ashy Crowned Sparrowlark. এইটুকু রাস্তায় আরো চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! Sparrow Lark এর ছবি তুলে রাস্তায় উঠেছি অমনি দেখি মিহি সুরেলা গলায় ডেকে চলেছে একটি হলুদ চোখো ছাতারে (Yellow Eyed Babbler)। নামে এরা ছাতারে হলেও আমাদের পরিচিত ছাতারে বা সাতভাই এর থেকে আকারে অনেকটাই ছোটো, সুন্দর আর সুরেলা। 

ফিরে এসে আড্ডা ঘরে বসে নাস্তা সারতে সারতে ই দেখি পশ্চিমের মাঠে খেলা করছে একজোড়া ল্যাপউইং। বাংলায় আমরা যাদের বলি হো টি টি (Red Wattled Lapwing) এরা তাদের জাতভাই Yellow Wattled Lapwing. নীচে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে এদের নামের উৎস কি। ব্রেক ফাস্টের পর আমি আর আমার সদ্য কৈশোর পার করা ভাইপো প্রত্যয় মিলে একটু চরতে বেরোলাম যদি আর কিছু পাখির দেখা মেলে। রাস্তা ধরেই একটু এগিয়েছি-ওমনি দেখি একটা চন্দনা মাথার ওপর চক্কর কাটছে। ইংরেজি তে এদের বলে Alexandrine parakeet। চক্কর কাটতে কাটতে কি হল কে জানে-আমাদের বুঝি তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল-সে এসে বসল আমার একেবারে কয়েক হাতের মধ্যে একটা পলাশ চারার ওপর। আর আমিও কন্টিনিউয়াস মোড এ কতকগুলো স্ন্যাপ নিয়ে নিতে কসুর করলাম না। আর একটু ঘোরাঘুরি করে ভাইপো কে কিছু গাছ-পাখি চেনাতে চেনাতে ই বেশ রোদ উঠে গেল। আর রোদ কড়া হয়ে গেলে পোকা মাকড় রা ও গাছের পাতা- ছালের আড়ালে চলে যায়। ফলে পাখি দের ও আনা গোনা কমে যায়। তাই আমরা ও নিলাম ফেরার পথ। বনপলাশীর গেটে ঢোকার ঠিক আগে দেখলাম একটা কাঠ শালিখ বা Chestnut Tailed Starling শুকনো ডালের ওপর বসে আড়মোড়া ভাঙছে। কাঠ শালিখের ভঙ্গিমা ক্যামেরা বন্দি করে আর ক্যামেরা ব্যাগবন্দি করে ফেললাম সেদিন এর মত। কোলকাতা ফেরার দিন প্যাকিং এর ঠিক আগে সকাল সকাল একবার বেরিয়েছিলাম। সূর্য তখন উঠে গেছে।আগে শুনেছিলাম মুরুগুমা র ড্যামে পরিযায়ী হাঁসেরা নামে না। কিন্ত আকাশে ওগুলো কি উড়ছে দল বেঁধে? দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ক্যামেরার টেলি তে চোখ লাগিয়ে পরিস্কার দেখলাম বেশ বড় আকারের হাঁস! আলোর উল্টো দিকে থাকায় রঙ বুঝতে পারলাম না। কিন্ত এটা আশা করাই যায় যে মুরুগুমার জলে এবার হাঁস নামবে। 

আজ আর সময় নেই-ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এখনি। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। 'আবার আসিব ফিরে' -বনপলাশীর আঙিনায়-এবার বসন্তে।
  

নভেম্বর, ২০১৮

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮

ছবি ~ অভিজিৎ মজুমদার

বাঙালির কাঁদুনি গাইবার অভ্যেস আর গেল না। এখন নতুন কান্না, চলচ্চিত্র উৎসবে কেন মুখ্যমন্ত্রীর ছবি? আরে বাবা. এমন মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছিস আগে, যিনি আঁকেন, কবিতা লেখেন, গান লেখেন, গল্প লেখেন, গল্প মারেন, গানে সুর দেন, রাস্তায় গান গাইতে গাইতে পথ হাঁটেন? যাকে বলে সংস্কৃতির হদ্দমুদ্দ। সাধে কি আর কলকাতাকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে? এমনকি রানীধানীও বলা যায়। তাহলে?



আন্তর্জাতিক উত্সবে এমন সংস্কৃতিময়ী মুখ্যমন্ত্রীর ছবি থাকবে না তো কি বুড়ো হাবড়া মৃণাল সেনের ছবি থাকবে? যত্তসব। দেখছিস, সুশীলরা চুপ আছে তবু তোদের ঘ্যানঘ্যান থামে না। তোরা কি বেশি বুঝিস? আর চাদ্দিকে যে বচ্ছরের পর বচ্ছর ধরে এত রঙ্গতামাশা চলছে তার পরিচালনা কে করছে শুনি? শহীদ দিবসে নাচাগানা হয়, আগে কখনো শুনেছিলিস? তবে? আর বাকি রাজ্য? সে তো যাকে বলে,  ব্লকব্লাস্টার। ভায়োলেন্স চাই? আছে। হাস্যরস চাই? আছে। প্যাথোস চাই? আছে। পরকীয়া চাই? আছে। পেটমোটা ভিলেন চাই? আছে। হাত কচলানো পুলিশ চাই? আছে। তাহলে? তার ওপর আছে স্পেশাল এফেক্ট। কখনো হুড়ুম করে ব্রীজ ভেঙে পড়ছে, কখনো দুম করে হাসপাতালে আগুন লেগে যাচ্ছে। যাকে  বলে নাচে গানে অভিনয়ে জমজমাট। পুরো হুতোমের নক্সা।

এর পরেও বলবি ওনার ছবি কেন? তোদের তাহলে সংস্কৃতির প্রথম পাঠটাই হয় নি। 

যাহ্, কথাঞ্জলি পড় গিয়ে। তাপ্পর আসবি সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে। এখানে পাঁচতলার মল, পুরোটাই শাড়ি।


বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮

মূর্তি ও সভ্যতা ~ পুরন্দর ভাট

অনেকেই ইস্টার আইল্যান্ডের নাম শুনেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে সেই জনমানবহীন দ্বীপ যেখানে শ'য়ে শ'য়েঅতিকায় পাথরের মূর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্বিকরা গবেষণা করে জানতে পারেন যে আনুমানিক এক হাজার বছর আগে এই দ্বীপে 'রাপানুই' নামের এক বৃহৎ সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, যারা এই অতিকায় মূর্তিগুলো বানিয়েছিল। রাপানুইয়ের মানুষজন এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তি খোদাই করে, মাইলের পর মাইল তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মত প্রযুক্তি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল। প্রশান্ত মহাসাগরে যতগুলো দ্বীপপুঞ্জ আছে তার কোথাওই এত উন্নত আদিম সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বাকি সব দ্বীপেই আদিবাসীরা সামান্য কৃষিকাজ আর মাছ-শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো বা এখনো করে, কোথাওই কোনো নগর সভ্যতা বা বৃহৎ নির্মাণকাজের ইতিহাস নেই। সেই কারণেই ইস্টার আইল্যান্ড ব্যতিক্রম এবং রহস্য। তার চেয়েও রহস্যজনক হলো যে এই আদিম সভ্যতার সম্পূর্ণ বিলুপ্তিকরণ। ১৮ শতকে যখন প্রথম ইউরোপীয় নাবিকেরা দ্বীপটির খোঁজ পান তখন সেই দ্বীপে বসবাস করছিল মাত্র কয়েকশো আদিবাসী, যাঁদের মধ্যে রাপানুইয়ের উন্নত সভ্যতার কোনো চিহ্নই ছিল না। প্রশান্ত মহাসাগরের বাকি দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের মতোই তারা ছিল প্রযুক্তিগত ভাবে অনুন্নত। সেই সুবিশাল পাথরের মূর্তি খোদাই করা এবং তাদের টেনে নিয়ে আসার পদ্ধতি সম্পর্কেও সেই আদিবাসীদের কোনো ধারণা নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইস্টার আইল্যান্ডের কবর ও ধ্বংসাবশেষ খোঁড়াখুঁড়ি করে অনুমান করেছেন যে রাপানুই সভ্যতার স্বর্ণযুগে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি ছিল। তাহলে সেই রাপানুই সভ্যতার মানুষরা কোথায় গেল? সভ্যতার এক শিখরে পৌঁছে কী ভাবে তারা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল? শত্রুর আক্রমণ? কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ? মহামারী? না, এর কোনটারই প্রমাণ কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে পাননি। যা প্রমাণ মিলেছে তা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে হঠাৎ করে কোনো একটা ঘটনার জন্য সভ্যতাটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। বরং দু তিনটে প্রজন্ম ধরে ক্ষয় হতে হতে ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু কেন হলো এমন ক্ষয়? তার আগে ইস্টার আইল্যান্ড নিয়ে আরেকটা রহস্য সম্পর্কে বলা প্রয়োজন। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে এই হাজার হাজার টনের পাথরের মূর্তিগুলো দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কী ভাবে। ইস্টার আইল্যান্ড প্রায় সম্পূর্ণভাবে গাছপালশূণ্য, শুধু ঘাসে ঢাকা। তাই কাঠের চাকা অথবা গাছের গুঁড়ি ব্যবহার করে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এই রহস্যের কিনারা করেন শেষ অবধি উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। তাদের গবেষণায় উঠে আসে যে এই দ্বীপ একসময় বড় বড় গাছপালায় ঢাকা ছিল, চাষাবাদও হত খুব ভালো কারণ দ্বীপের মাটি ছিল উর্বর। কী হলো সেই গাছপালা, চাষাবাদের? এর উত্তর আছে সেই অতিকায় মুর্তিগুলোতেই। বিশ্ববিখ্যাত নৃতত্ববিদ জ্যারেড ডায়মন্ড দীর্ঘ গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে এই অতিকায় সব মূর্তিই কাল হয়েছিল রাপানুইয়ের। মূর্তিগুলো সবই রাজা বা প্রভাবশালী পূর্বপুরুষদের। রাপানুইয়ের মানুষজন কোনো অজানা কারণে এই অতিকায় মূর্তি নির্মাণে এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের সমস্ত শ্রম, উৎপাদনের সমস্ত উদ্বৃত্ত ব্যয় হতো শুধুই মূর্তি বানাতে। এর ফলে এক সময় ব্যাহত হতে থাকে চাষাবাদ, মাছ-শিকার। অর্থাৎ একটা সভ্যতা নিজের সমস্ত ধন দৌলত দিয়ে, সমস্ত পুঁজি দিয়ে শুধুই অতিকায় মূর্তি বানিয়ে চলেছে, উৎপাদনবৃদ্ধি বা প্রযুক্তিগত উন্নতির কথা না ভেবে। এই মূর্তি বানানোর পাগলামির ফলে আরেকটি ক্ষতিও হয়। পাথর টেনে আনার জন্য দ্বীপের অধিকাংশ বনস্পতিই কেটে ফেলে রাপানুইয়ের মানুষজন। সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হতে থাকে চাকা, সিঁড়ি। পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিন্দুমাত্র না ভেবে তারা এই ধ্বংসকাজে লিপ্ত হয়। এর ফলে একটা সময় গিয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট হতে থাকে, চাষাবাদ ভেঙে পড়ে, যে টুকু গাছ অবশিষ্ট ছিল তাও নষ্ট হয়ে যেতে থাকে জমি অনুর্বর হয়ে যাওয়ার ফলে। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ক্রমশ উন্নত নগরসভ্যতার পতন হয়, জনসংখ্যা কমতে থাকে। একটা সভ্যতা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায় কারণ নিজের উদ্বৃত্তকে উন্নতির কাজে না লাগিয়ে, উৎপাদনের কাজে না লাগিয়ে, তাই দিয়ে শুধু মূর্তি বানানোর ফলে।
 
গুজরাটে বল্লবভাই প্যাটেলের মূর্তি বসেছে, উচ্চতা ১৮২ মিটার, খরচ ৩ হাজার কোটি টাকা। মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার শিবাজির একটি মূর্তি নির্মাণ করছে যার উচ্ছতা হবে ২১২ মিটার, খরচ ৪ হাজার কোটি টাকা। যোগী আদিত্যনাথ বলেছে উত্তর প্রদেশে একটি রামের মূর্তি নির্মাণ করা হবে ১০০ মিটার উচ্চতার, যার জন্য আনুমানিক খরচ হবে ২ হাজার কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

স্ট্যাচু ~ সুদীপ মিঠি খবরওয়ালা

তিন হাজার কোটি টাকা। মানে ৩০,০০০,০০০,০০০ টাকা। ঠিক কী কী হয় তিন হাজার কোটি টাকায়? ধরা যাক আপনি শ্যামবাজার ক্রসিংয়ে। শতচ্ছিন্ন নাকে-সর্দি বাচ্চাটা এসে ঝুলে পড়ল, কাকু দুটো পয়সা দাও। আপনি খানিক মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পারলেন না, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী করবি? উত্তর এল, ভাত  কিনে খাব। অমনি আপনি ক্যাঁক করে চেপে ধরলেন। ইয়ার্কি পায়া হ্যায়? খাবার নামে অন্য ধান্দা! চল দেখি কোথায় ভাত পাওয়া যায়। তোকে বসিয়ে খাওয়াবো। যাস কোথায় বাছাধন? পাশের এঁদো গলিটা ঘুরেই বেঞ্চিপাতা একটা দোকানে হাঁক দিলেন, একটা সবজি ভাত দিন তো দাদা। তাড়াতাড়ি। আর ওমা, হাভাতের মতো গিলতে লাগল ছেলেটা ! এক্কেবারে হাভাতের মতো ! আপনাকে লুকিয়ে দোকানদারটা এক পিস মাছের টুকরোও তুলে দিল পাতে। আপনি আড়চোখে দেখলেন। মগের জলের ছলাৎছল পেরিয়ে প্যান্টের পেছনে হাত মুছে কালো কালো দাঁত বের করে যখন ঢিপ করে পেন্নাম করল ছোঁড়াটা, আর আপনি লংহর্নের ওয়ালেট থেকে তিরিশটা টাকা বের করলেন, অমনি দোকানদার আপনার হাতদুটো ধরে বলল, দাদা, কুড়ি টাকা দিন, মাছটা আমিই দিলাম। বেশ। আপনি আত্ম্ভরিতার ঢেকুর তুলে গাড়ির সীটে মাথা এলিয়ে দিলেন। হালকা এসিতে  তন্দ্রা এসেছে সবে। আধোঘুমে কে যেন হঠাৎ বলে উঠল, তিন হাজার কোটি টাকা ! ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় এরকম হাকুচ্ছিত হাড়হাভাতে ১৫০ কোটি ছেলেমেয়েকে একবেলা পেটপুরে খাওয়ানো যেত !  ১৫০ কোটি জনকে ! আরে মোলো যা ! বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা !

কিংবা ধরুন আপনার  ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর খানিক বাতিক আছে। জঙ্গলমহল বা অযোধ্যার কোলে গাঁয়ে গাঁয়ে চলে যান কখনো। শাল-মহুয়ার দেশে। আপনার পায়ের তলায় আলতো আলতো ভাঙে শুকনো পাতার সারি। পাশে পাশে হাঁটে পাহাড়ী নদী তিরতির। আর আগুনরঙা পলাশ কৃষ্ণচূড়া রাঙিয়ে থাকে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। ঊষর টাঁড় মাটির বুকে ভূমিপুত্ররা আখ-টম্যাটো ফলায়। টম্যাটো বেচে পঞ্চাশ পয়সা কিলো। হ্যাঁ, পঞ্চাশ পয়সা ! মুখযুগুলো জানেও না ওদের বেচে দেওয়া  টম্যাটো আপনি -- আপনারা কেনেন কুড়ি টাকায়। মানিকতলা-ফুলবাগানে স্করপিও থামিয়ে। তা ধরা যাক আপনারা গুটিকয় বন্ধু তাদের মাঝে করেন মেডিক্যাল ক্যাম্প, একদিন পেটপুরে খিচুড়ি লাবড়া খাওয়ান, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার উৎসাহ জোগাতে হাতে তুলে দেন খাতা-পেন।  মেডিক্যাল ক্যাম্পটা আপনার চিকিৎসক বন্ধুদের নীরব সেবা। দিনের শেষে আপনি যখন খতিয়ান নিয়ে বসেন, দেখেন খরচ হয়েছে সাকুল্যে হাজার পনেরো-কুড়ি।  আর আপনি মাটির ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে চমকে ওঠেন। তিন হাজার কোটি টাকা ! এই তিন হাজার কোটিতে তো এরকম পনেরো লক্ষ আদিবাসী গ্রামকে সেবা করা যেত ! আর আপনার পায়ের তলায় টলে ওঠে মাটি !  কে জানে প্রেসারটা বাড়ল কিনা !

বাড়বেই। যা চাপ নিচ্ছেন ! তারচে' বরং চলুন মানভূমের ছোট্ট একটা গ্রামে। যেখানে কোনো কোনো দেবী, কোনো কোনো দেবতার বাস। সেইসব দেবদেবীরা তৈরি করেছেন গুটিকয় স্কুল। প্রবল বাধাবিপত্তি পেরিয়ে জুটিয়েছেন অর্ধউলঙ্গ বাচ্চাগুলোকে। হামদের ছিলাগুলান পেন্দাই লিখাপঢ়া শিখ্যে  কী কইরবেক গ ! বুঝিয়েছেন অবুঝ মানুষগুলোকে। আর চমকে উঠেছেন এই জেনে যে এই স্বচ্ছ আলোকপাতের  যুগেও এমন জায়গা আছে যেখানে প্রাতঃকৃত্য যে এক দৈনন্দিন স্বাস্থকর শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, এটুকু ধারণাও নেই।  সেইসব কপর্দকহীন বোধহীন মাড়ভাতভোজী ছেলেপুলেদের জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন অবৈতনিক আবাসিক বিদ্যালয়। সব দায়িত্ব সমেত। ধরা যাক আপনারা কয়জন পথচলতি হাজির হয়ে গেছেন অকুস্থলে। জনসেবার আত্মপ্রসাদবলে জানতে চেয়েছেন প্রয়োজন। উত্তর পেয়েছেন, মাসে হাজার কুড়ি হলে দেড়শো-দুশো বাচ্চার থাকা-খাওয়া-পরা-শিক্ষার সব খরচ চালানো যায়। আর নিমেষে আপনার চোখ চলে গিয়েছে আপনারই খুলে-রাখা পাঁচহাজারী উডল্যান্ডসের জুতোজোড়ার দিকে। চোখ যখন তুললেন, ভিজে গেছে চশমার কাঁচ।  বাঁশের খুঁটিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। আপনার মাথা কাজ করছে অল্পই। তবু হিসেব করে চলেছেন, তিন হাজার কোটি ! তিন হাজার কোটি টাকা মানে এরকম প্রতি দেড়শো-দুশো বাচ্চার দশ হাজারটা স্কুলের এক মাসের যাবতীয় খরচ ! খানিক দূরেই ভেসে আসছে খলবলে শিশুগুলোর কলকাকলি।       

কী সব ভ্যাজর ভ্যাজর করছেন মশাই ! এ হল নয়া ভারত। শাইনিং ইন্ডিয়া।তার মাঝে এইসব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আনলে চলে?  বেশ ! তবে খানিক অন্য কথা হোক। সামান্যই। এই ধরুন, ভারতের মঙ্গল অভিযান, মার্স মিশন, যা নিয়ে তদানীন্তন দেশপ্রেমী জনতা রে রে করে উঠেছিল, "ভারতের মতো গরীব দেশে এসব চূড়ান্ত  বিলাসিতা"। সেই মার্স মিশন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল অভাবনীয় কম খরচে এত বড় সাফল্যের পরাকাষ্ঠা হিসেবে। বিশ্ববিজ্ঞানের দরবারে সামান্য হলেও এগিয়ে দিয়েছিল দেশকে।  তা সেই মার্স মিশনে কত খরচ হয়েছিল জানেন? সাকুল্যে ৪৫০ কোটি টাকা। এইবার ভাবুন, ঐ তিন হাজার কোটি টাকায় মেরেকেটে এরকম খানছয়েক বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সফল রূপায়ণ ঘটানো যেত। যার যে-কোনো একটাই ঐ স্ট্যাচুর চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে মাথা তুলে ধরতে পারত দেশের। জানি, আপনি বলবেন, কিছু হচ্ছে তো! যে দেশে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমতে কমতে জি-ডি-পি-র মাত্র ২.৭ শতাংশ (তুলনীয় ডেনমার্ক ৮.৭, নিউজিল্যান্ড ৭.২, সুইডেন ৭.০, জার্মানি ৫.১, মায় চীন ৭.৫ শতাংশ। ছোট দেশগুলো, যাদের ১২-১৩ শতাংশ, তাদের কথা বাদই দিলাম। -- তথ্য উইকি), সে দেশে এই 'কিছু'টা যে কতোখানি, এ আপনি দিব্যি জানেন মশাই !  তা যাকগে। তখন থেকে বড্ড জ্বালাতন করছে মাছিটা ! 

ও হ্যাঁ, তিন হাজার কোটিতে একটা স্ট্যাচু হয়। একটা অর্থহীন স্ট্যাচু। সে যত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরই হোক না কেন। আদপে অর্থহীন।  
 

পুনঃ -- আপনার পাল্টা যুক্তি থাকতেই পারে।

বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮

শ্রেণী ~ আর্কাদি গাইদার

সে এক সময় ছিলো বটে। তখন ফেসবুক, টিভি, কিছুই ছিলো না। রেডিও ব্যাপারটা অর্ধেক লোক চেনে না। সংবাদপত্র পড়বার মতন শিক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠের নেই। তখন যদিও নারী ছিলো। নারীদের লড়াই ছিলো। সম কাজে সম বেতনের দাবিতে লড়াই। কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের দ্বারা হেনস্থাকে প্রতিহত করবার লড়াই। নারীদের ভোটাধিকারের লড়াই। নারীদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই। শিক্ষার অধিকারের লড়াই। অনেকেই জানেন না, বা ভুলে গেছেন হয়তো, রুশ বিপ্লবটা শুরুই হয়েছিলো ৮ই মার্চ, ১৯১৭ এর পেত্রোগ্রাদে মহিলা শ্রমিকদের মিছিল দিয়ে। International Working Women's Day র মিছিল। 

তারপর ভলগা থেকে গঙ্গা হয়ে বহু জল গড়িয়েছে। এর মধ্যে Working টা বাদ পড়ে গিয়ে International Women's Day হয়ে গেছে। আমরা পুরনো প্রাচীনপন্থী ধ্যানধারণা ত্যাজ্য করে নতুন করে ভাবতে শিখেছি। আমাদের শেখানো হয়েছে যে নারীর ক্ষমতায়নের মাপকাঠি হলো সে কতটা দক্ষতার সাথে অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভেঙে ক্ষমতার কাঠামো বেয়ে উঠছে, এবং স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতে সাহায্য করছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন 'দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী নারী'দের লিস্ট ছাপিয়েছে বছরের পর বছর। সেখানে স্থান পেয়েছেন পেপসিকোর সিইও ইন্দ্রা নুয়ী। কারন তিনি নারী হয়ে সেই কোম্পানির সর্বোচ্চ স্তরে পৌছাতে পেরেছেন, যারা এই দেশের মাটিতে পানীয় জলস্তরকে নিঃশেষ করেছে, হাজার হাজার একর জমিকে বিষিয়ে দিয়ে নষ্ট করেছ। স্থান পেয়েছেন হিলারি ক্লিন্টন। কারন তিনি আরেকটু হলেই হাতে পেতেন দুনিয়ার সবচেয়ে ভীতিপ্রদর্শক সামরিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ, তার হাতে থাকতো মার্কিন পারমাণবিক শক্তি সমাহারের বোতাম, যা এতদিন ছিলো শুধু পুরুষদের কুক্ষিগত। স্থান পেয়েছেন বায়োকনের কিরণ মজুমদার শ, এবং তার পরেই তার খ্যাতির জৌলুষ নিয়ে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর পাশে দাড়িয়েছেন। স্থান পেয়েছেন অরুন্ধুতী ভট্টাচার্য্য, যিনি স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান থাকাকালীন রিলায়েন্সকে বানিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের প্রমোটার, আর রিটায়ারমেন্টের পরেই রিলায়েন্সের ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা হাততালি দিচ্ছি, কারন স্বাধীন ভারতের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ভরা বাজার, যা এতদিন ছিলো শুধু অবাঙালি পুরুষদের কুক্ষিগত, সেখানে মাথা উচু করে প্রবেশ করেছেন একজন বাঙালি নারী।

না, ফোর্বসের এই লিস্টে স্থান পাননি জগমতি সাংগোয়ান, যিনি বছরের পর বছর গোবলয়ের খাপ পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। স্থান পাননি সোনি সোরি, যার সারা শরীরে পুলিশ লিখেছে সন্ত্রাসের উপকথা, আর যার মুখে এসিড ছুড়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে দেশভক্ত নাগরিক। স্থান পাননি দীপিকা সিং রাওয়াত, যিনি নিজের পেশায়, নিজের পরিসরে, নিজের সমাজে সম্পূর্ন একা হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একটি আট বছরের শিশুকন্যার বিধ্বস্ত লাশের হয়ে। স্থান পাননি অংগনওয়াড়ি কর্মীদের বহু বছরের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া ডাক্তার হেমলতা। কারন এনারা কেউই সেই অমোঘ কাঠামোর অদৃশ্য কাঁচের সিলিং ভাঙতে পারেননি হয়তো। আমরা তো তাই শিখেছি, আসল ক্ষমতায়ন তো সেইখানেই - যখন কাঠামো আপন করে নেয় প্রান্তিক পরিচিতিকে, যখন 'মুসলমান' কালাম রাষ্ট্রপতি হন, যখন 'নারী' অরুন্ধুতী ডিরেক্টর হন, যখন 'কালো' ওবামা প্রেসিডেন্ট হন, যখন আমাদের শেখানো হয় 'বাঙালি' প্রধানমন্ত্রী তোমার চাহিদা, কারন তুমি বাঙালি - আর কাঠামো বলে - দেখো, ক্ষমতায়ন একেই বলে, পরিচিতির স্বীকৃতি আমার থেকে ভালো আর কে দিতে পারবে?

আর চারিদিকে এই হিন্দু, মুসলমান, বং, গুজ্জু, খোট্টা ইত্যাদি আইডেন্টিটির ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যেতে থাকেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মানেক হোমি আর জামশেদজি টাটার ভাইপো, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য এবং এমপি সাপুরজি সাক্লাতওয়ালা, দুই পারসি কমিউনিষ্ট, যারা একইসাথে ডান্ডিতে আর জামশেদপুরে লেবার ইউনিয়নের স্ট্রাইক শুরু করেছিলেন, পারসি মালিকানার টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে। হারিয়ে যায় তাদের পারসি পরিচিতি, যেমন হারিয়ে যায় সেই লোকটির পরিচিতি যাকে টাটারা জামশেদপুরে নিয়ে এসেছিলো 'প্র‍্যাগম্যাটিক' ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হিসেবে এবং যিনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাটিয়ে স্ট্রাইক ভেস্তে দেন। হারিয়ে যায় টাটাদের ভরসার সেই দুর্দান্ত তরুন নেতা সুভাষ চন্দ্র বোসের 'বাঙালি' পরিচিতি। পারসি, বাঙালি, ভারতীয়, ব্রিটিশ সব ছাপিয়ে একটাই পরিচিতি মূখ্য হয়ে ওঠে - শ্রেণী।

রাজনৈতিক দলের পুজোর বুকস্টলে ঘুরতে ঘুরতে দেখি স্টল সাজানো হয়েছে পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দিয়ে। রাজস্থানে শম্ভুলাল রেগারের হাতে আফরাজুলের খুনের খবর। সেইসময়কার শিরোনামের সাথে মেলাতে চেষ্টা করি - 'রাজস্থানে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হলো বাঙালিকে', 'রাজস্থানে খুন মুসলিম'। মেলাতে পারি না। খবরের কাগজের শিরোনাম গালে সপাটে থাপ্পড় মারে - 'রাজস্থানে আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হলো শ্রমিককে'। কেউ যেন মুখের সামনে চিৎকার করে - শ্রেণী, শ্রেণী, শ্রেণী। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর পাশ থেকে একজন প্রৌঢ়া বই ওলটাতে ওলটাতে মন্তব্য করে - রাজস্থানে দারুন ব্যাপার ঘটছে, বলো? ওরকম একটা গোবলয়ের অঞ্চলে কৃষকদের লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আমাদের রাজ্যের লোক। উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘুরে দাড়াই, ভাবি বলবো - হ্যা, ভেবে দেখেছেন, একজন বাঙালি মুসলমান, হান্নান মোল্লা, তার নেতৃত্বে রাজস্থানের এতগুলো চাষী এরকম মারমুখী হয়ে নেমেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। যেন ম্যাজিক। 

কিন্তু বলবার আগেই থেমে যাই, নিজেকে শুধরে নিই। ম্যাজিকের কি আছে এতে? পরিচিতির ভরাবাজারে যাকে যাদুমন্ত্র মনে করছি - শ্রেনী, শ্রেনী, শ্রেনী! - আসলে একমাত্র সেই পুরনো সাবেকি unfashionable ব্যাপারটাই তো বাস্তব। বাকিটাই আমাদের বোকা বানানোর ম্যাজিক।

সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

নেতাজী, বাড়ি আছো? ~ রজত শুভ্র বন্দোপাধ্যায়

নেতাজী, বাড়ি আছো?
"জয় হনুমান" ফেলছে না আর সাড়া,
হঠাৎ দ্বারে তেনার কড়া নাড়া – 
নেতাজী, বাড়ি আছো?

হুশপুশিয়ে বাড়ছে তেলের দাম,
গৌসেনাদের চিৎকারে হাড় হিম,
শুকিয়ে যাচ্ছে শ্রমিক, চাষীর ঘাম,
মাথায় ধরে ঝিম –
নেতাজী, বাড়ি আছো?

দিন চলে যায়, বেড়েই চলে ক্লেশ,
লোন বাগিয়ে সবাই যে দেশ ছাড়া,
জমাট দেহে আবছা ঘুমের রেশ,
সহসা কড়ানাড়া - 
নেতাজী, বাড়ি আছো?

( ২২-১০-২০১৮)

.

[With due apologies to Shakti Babu]

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৮

ফুটবল মাঠ ~ অর্ক ভাদুড়ী


একটা ফাঁকা ফুটবল স্টেডিয়ামে বসে থাকার কথা কথা বলেছিলেন এডুয়ার্দো গালিয়েনো। খেলা শুরুর সময় সেন্টার লাইনের মাঝখানে ঠিক যেখানটায় বল রাখেন রেফারি, সেখানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে বলেছিলেন। মনখারাপের দিনে আমি এমন বসে থেকেছি, বহুবার। বাবা মারা যাওয়ার দিন বসেছি, প্রেমিকা চলে যাওয়ার দিন বসেছি। প্রিয়তম মানুষকে ছেড়ে আসার পর, বড্ড বেশি ঠকে যাওয়ার পর, বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার পর— বসেছি। যেদিন শেষবারের মতো বেরিয়ে এলাম পার্টি অফিস থেকে, গলি পেরনোর পর শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম রংচটা প্রাণের নিশান, সেদিনও বসেছি। ফাঁকা স্টেডিয়ামের মাঝমাঠে বসলে মনে হয়, মাটি থেকে উঠে আসছে মায়ের আঁচলের মতো গন্ধ। মাটি মাটি, বিকেল বিকেল। সেই গন্ধ আমায় ছেড়ে যাবে না কখনও। আমিও যাব না তাকে ছেড়ে।
দু'পাশে দু'টো গোলপোস্ট, জাল নেই। হাজার হাজার চেয়ার, শব্দহীন। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই, উত্তেজনা নেই, চিৎকার নেই। উল্লাস-কান্না-গালাগালি কিচ্ছুটি নেই। একটা আস্ত ফাঁকা স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে আমি বসে থেকেছি, একা।
ফুটবল ঠিক যেন মরে যাওয়া বাপমায়ের মুখ, যে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। আমি ধর্ম বদলে ফেলতে পারি, মতাদর্শ বদলে ফেলতে পারি, নাম বদলে ফেলতে পারি, দেশ-বাড়িঘর-প্রেম-সম্পর্ক সবকিছু বদলে ফেলতে পারি, শুধু প্রিয় ফুটবল দলের নাম বদলায় না কখনও। বদলানো যায় না। ফুটবল রক্ত-ঘাম-হাড়েমাংসে মিশে যায়।


আমার দাদু আর দিদা একে অন্যকে প্রথম দেখেছিল মনুমেন্টের নীচে। চল্লিশের দশক। রশিদ আলি দিবসের মিছিল ফেরত দিদাকে উয়াড়ি ক্লাবের প্র্যাকটিশ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দাদু যখন প্রথম দেখে, তখন ময়দান জুড়ে নেমে এসেছে কনেদেখা বিকেল। তারপর মেঘে মেঘে বেলা বেড়েছে। মোহনবাগানের খেলা থাকলে কমিউনিস্ট পার্টির কার্ড হোল্ডার আমার দাদু মাঠে যাওয়ার আগে ঠাকুরঘরে ঢুকত একবার। সেদিন সকাল থেকে উচাটন। উল্টো করে বিড়ি ধরত, তাতে মোহনবাগানের শনি কেটে যায়। শুনেছি, ফুটবলের মাঠ থেকে ছেলেরা ঢুকে পড়ত ব্রিটিশবিরোধী মিছিলে। পুলিশ তাড়া করত, ঘোড়সওয়ার পুলিশ।

শুনেছি, দেশভাগ। শুনেছি, দাঙ্গা। আমাদের কলেজ স্ট্রিটের বাড়ির আশেপাশে তখন গোপাল মুখার্জির রাজত্ব। ইতিহাস যাঁকে মনে রেখেছে গোপাল পাঁঠা নামে। অনেক পরে গোপালবাবু সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি, ওঁর ঈশ্বর ছিলেন সুভাষচন্দ্র আর মন্দির মোহনবাগান। তখন অবশ্য সকলেই প্রায় মোহনবাগান। এগারোর স্মৃতিতে ভর করে ওড়ে স্বাধীনতার বিজয়কেতন। দাদুর বন্ধু নাসিমসাহেব মহামেডান ক্লাবের কর্তা ছিলেন। ইস্টবেঙ্গল তখনও সে অর্থে বড় দল নয়। দেশভাগের পর আচমকা বদলে গেল শহরটা। অদ্ভূত ধরণের বাংলা বলা হাজার হাজার লোক ভিড় করল শিয়ালদহ, হাওড়া স্টেশনে। আগে শহরে বাড়িওয়ালারাই তোয়াজ করতেন ভাড়াটিয়াদের। এবার ভাড়া পাওয়ার মতো বাড়ি মেলাই হয়ে উঠল দুষ্কর! কোথায় যাবেন এত মানুষ! কোথায় মাথা গুঁজবেন! শহরের আদি বাসিন্দাদের একাংশের অনুযোগ, লাখ লাখ উদ্বাস্তুর ভিড় শহরটাকে নোংরা করে তুলছে। কথাটা মিথ্যেও তো নয়। যে মানুষের থাকার জায়গা নেই, যাকে সাত পুরুষের ভিটে থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, সে শুরু করল জবরদখল। বাগানবাড়ি, ফাঁকা জমি, খালপাড়— সব। হাতে হাতে বসতি গড়ে উঠল। জঙ্গল সাফ হল। তৈরি হল দরমার বেড়া দেওয়া স্কুলঘর। সন্ধ্যা গড়ালে সেই দাওয়ায় আড্ডা বসল— 'আমাদের পুকুর আছিল, পুকুরে মাছ আছিল, বাগান আছিল! কত গাছ, কত গরু, কত দুধ! আর এখন……।' কেউ বিশ্বাস করে না সে সব কথা। হাভাতের প্রলাপ। অফিসকাছারিতে খিল্লি হয়। কয়েকজন বুদ্ধিমান আগে থেকেই আঁচ বুঝে প্রপার্টি এক্সচেঞ্জ করে ঠাঁই পেয়েছে ভদ্রপাড়ায়। তাদের মুখেও মাঝেমধ্যে ফেলে আসা ঐশ্বর্যের গল্প। সে নিয়ে হাসাহাসি। ভাষাটাও যেন কেমন! খিল্লি। এই সব শুনে গজরাতে থাকা বরিশালের মানুষ, ঢাকা, বিক্রমপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফেনি, রংপুরের মানুষ ফুটবল ময়দানে ঢুকে পড়ল। সুরেশ চৌধুরির ক্লাবের হয়ে গলা ফাটাল। গালাগালি দিল। রোজকার জীবনের হাজার না-পাওয়া মুছিয়ে দিল লাল-হলুদ জার্সির নায়করা। জন্মের কয়েক দশক পর নতুন করে জন্মাল ইস্টবেঙ্গল ক্লাব।


ফুটবলের ঠিক কত শতাংশ ওই চৌকো মাঠটায় খেলা হয়? জানি না। সেন্টার লাইন পেরিয়ে, কর্ণারের দাগ পেরিয়ে ফুটবল ঢুকে পড়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। ফুটবল এই দুনিয়ার সব হেরে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার, বাঁচিয়ে রাখার অভিজ্ঞান। কখনও কখনও মৃত্যুরও বটে। সাদা চামড়ার তাড়া খেয়ে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে পালাতে পালাতে রঙিন মানুষেরা একটা আস্ত ফুটবল দর্শনের জন্ম দিতে পারে। দুনিয়া কাঁপানো বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যের সঙ্গে ফুটবল খেলা যায়। বন্ধ কারখানার শ্রমিকের ছেলে ঘাস উঠে যাওয়া এক টুকরো জমিতে ড্রিবল করতে করতে টপকে যায় তার স্কুলে না যাওয়া শৈশব, প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলার ক্ষত। যে ছেলেটির চাকরি চলে গিয়েছে, যে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায় প্রিয় দলের গোলে। মানুষকে মেরেও ফেলে ফুটবল। পুড়িয়ে পুড়িয়ে আংরা করে দেয় তাকে।
মনে করুন উরুগুয়ের কিংবদন্তী আবদিয়ন পোর্তেকে। আজ থেকে প্রায় ১০৮ বছর আগের কথা। ১৯১০ সাল। পোর্তে খেলতেন মাঝমাঠে। প্রথম বছর কোলন ক্লাব। সেখানে এক বছর কাটিয়ে লিবের্তাদ ক্লাবে। তারপর ১৯১১ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত একটানা নাসিওনাল ক্লাবে। ১৯১৭ সালে সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা উরুগুয়ের অন্যতম নায়ক পোর্তেকে আদর করে সমর্থকেরা ডাকতেন 'এল ইন্দিও' বলে। ক্লাবের হয়ে ২০৭টি ম্যাচ খেলা, ১৯টি ট্রফি দেওয়া পোর্তের জীবনটা বদলাতে শুরু করল আঠেরো সালেই। সে বছর বুড়ো কিংবদন্তীর বদলি খুঁজে নিলেন কর্তারা। তাঁকে রিজার্ভ বেঞ্চে পাঠিয়ে প্রথম দলে চলে এলেন আলফ্রেদো সিবেচি। বসে থাকতে থাকতে ভিতরে ভিতরে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষক হয়ে গেলেন পোর্তে। ঘন্টার পর ঘন্টা অনুশীল করলেন, নিংড়ে দিলেন নিজেকে। লাভ হল না। ৪ মার্চ, ১৯১৮। শেষ ম্যাচ খেললেন নাসিওনালের হয়ে। দল জিতল ৩-১ গোলে। কিন্তু পোর্তে গোল পেলেন না। বুড়ো, বাতিল হয়ে যাওয়া ঈশ্বরের দিকে সমর্থকেরা টিটকিরি ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, 'ও এখন একটা কচ্ছপকেও কাটাতে পারে না।' মাথা নীচু করে সবকিছু মেনে নিলেন হেরে যাওয়া, শেষ হয়ে যাওয়া কিংবদন্তী ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার।


ম্যাচের পর অনেকগুলো ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। অবসন্ন, একা পোর্তে একটা ট্রামে উঠলেন। তখন মাঝরাত। গন্তব্য, এস্তাদিও গ্রাণ পার্কে সেন্ট্রালে— নাসিওনাল ক্লাবের তাঁবু। ক্লাব শুনশান, একটা আলোও জ্বলছে না। বাইরে বসে ঢুলছেন একজন সিকিউরিটি গার্ড। পোর্তে ধীর পায়ে মাঠের ঠিক মাঝখানে পৌঁছলেন। গালিয়েনো যেমন বলেছিলেন, তেমনই। বসে পড়লেন সেন্টার লাইনের মাঝখানে। মাথা নীচু। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলেন চুপ করে। তারপর পকেট থেকে রিভলভার বের করলেন। মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপলেন।
গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। পরদিন সকালে স্টেডিয়ামে হাঁটতে এসেছিলেন সেভরিনো কাস্তিত নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁর কুকুরই প্রথম দেখতে পায় এল ইন্দিও'কে।


অনেক পরে গালিয়েনো লিখেছিলেন, 'ফুটবল মাঠই হল সেই জায়গা, যেখানে অতীত এবং বর্তমানের দেখা হয়ে যায়। তারা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। পরস্পরকে বুকে টেনে নেয়।'

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৮

আড্ডা ও বাঙ্গালী ~ সমরেন্দ্র দাস


বহু চেষ্টা করেও ইংরেজিতে 'আড্ডা'র একটা জুতসই প্রতিশব্দ জোগাড় করা গেল না। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য আরও কয়েকধাপ এগিয়ে গোটা পৃথিবীর কোনও ভাষাতেই 'আড্ডা'র আদৌ কোনও প্রতিশব্দ আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছে, পৃথিবীর অন্য দেশে আড্ডার মেজাজ নেই, বা থাকলেও তার জন্য যথোচিত পরিবেশ নেই। উন্নাসিক কেজো লোকেরা মনে করেন, যাঁরা কাজের মানুষ তাঁরা আড্ডা মারেন না, কিন্তু আমাদের প্রতিটি মুহূর্তই যদি শুধু কাজের হয়ে উঠত তা হলে কী নিছক যান্ত্রিকতাতেই ভরে যেত না জীবন?

স্বয়ং রাজশেখর বসু আড্ডার অর্থ লিখেছেন 'কু-লোকের মিলনস্থান'। অথচ কে না আড্ডা মেরেছেন বলুন তো! আর যাঁদের কথা বলতে যাচ্ছি তাঁদের অকর্মণ্য কিংবা কু-লোক বলি এমন সাধ্য আছে কার?

বুদ্ধদেব বসু কি লিখছেন পড়ুন, "ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে আমি আত্মহারা। সভায় যেতে আমার বুক কাঁপে, পার্টির নামে দৌঁড়ে পালাই, কিন্তু আড্ডা!! ও-না হলে আমি বাঁচি না। বলতে গেলে আড্ডার হাতেই আমি মানুষ। বই পড়ে যা শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আড্ডা দিয়ে।"

আড্ডার ফসল মহাভারত!

মহাভারতের কথা ধরা যাক, একেবারে গোড়াতেই ব্যাসদেব জানাচ্ছেন– একদিন নৈমিষারণ্যে সারা দিনের কাজ শেষে মহর্ষিরা সবাই সমবেত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একটু আড্ডা মারছিলেন। হঠাৎ ঋষি লোমহর্ষণের ছেলে সৌতি এদিক সেদিক ঘুরে সেখানে এসে হাজির হলেন। তাঁর আবার বৈঠকি ঢঙে গল্প করার অভ্যেস। সুযোগ পেয়ে তিনিও বলে গেলেন তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা, আর মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে গেলেন বাকি সবাই। আড্ডা যখন ভাঙল দেখা গেল মহাভারতের আঠারোটা পর্বই নাকি বলা হয়ে গিয়েছে। ম্যারাথন আড্ডার ইতিহাসে এটাই সম্ভবত দীর্ঘতম।

এই ঘটনা থেকে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তিনটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন, এক, আড্ডার একটা ইতিহাস আছে এবং তা সুপ্রাচীন। দুই, শুধু বখাটে ছোকরা নয়, মুনি-ঋষিরাও আড্ডা দিতেন। তিন, আড্ডা থেকে মহাভারতের মতো মহাকাব্যও সৃষ্টি হতে পারে।

গ্রিসেও আড্ডা!

সত্যজিৎ রায় তাঁর 'আগন্তুক' ছবিতে কিন্তু আড্ডার উদ্ভাবনকে বাংলা বা ভারত ছেড়ে গ্রিসে নিয়ে গেছেন। তিনি মনে করেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিস দেশের অ্যাথেন্সের জিমনেসিয়ামে অনেক উন্নত মানের আড্ডা হত। সে যুগে অ্যাথেন্সবাসী একই জায়গায় শরীর ও মনের এক্সাসাইজ করতেন। ওই সব আড্ডায় আসর জমাতেন সক্রেটিস কিংবা প্লেটোর মত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আর সেই আড্ডা থেকে সৃষ্টি হত উন্নত মানের শিল্পসাহিত্য ও  জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারনা।

রসদ-জোগানদার

প্রত্যেক আড্ডাতেই দু-একজন এমন থাকেন যাঁদের রসদ-জোগানদার বলা যেতে পারে। এঁরা হলেন আড্ডার প্রাণপুরুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং আড্ডার বিচারে নানা রসদ-জোগানদার পাওয়া যাবে। এঁদের কেন্দ্র করেই আড্ডা আবর্তিত হতে থাকে। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সময়ের ভিত্তিতে তাঁর দেখা সেরা পাঁচ রসদ-জোগানদারের নাম বলেছেন এই রকম – দাদাঠাকুর, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (বুড়োদা), নলিনীকান্ত সরকার, কাজী নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক বিশ্বপতি চৌধুরি। আড্ডার আসরে দাদাঠাকুরকে যিনি প্রত্যক্ষভাবে না দেখেছেন তিনি নাকি জীবনের একটা মধুরতম স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বুদ্ধিদীপ্ত সরস আলাপে অগ্রগণ্য প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন আলাপচারী শিল্পীদের রাজা। একই ভাবে বিদ্রোহী নজরুল আড্ডার আসরে ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, তিনি নাকি তখন কড়িকাঠ ফাটানো হাসি হাসতেন।

আড্ডার স্থান-কাল-পাত্র, সঙ্গে আড্ডাবাজেরা

আড্ডার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কালের দরকার হয় না। যখন তখন যেখানে সেখানে আড্ডা শুরু হতে পারে। খোলা আকাশের নিচে খেলার মাঠে, পুকুর ঘাটে, নদীর ধারে, লেকের পাড়ে, চায়ের দোকানে, পার্কে গাছের ছায়ায়, বসার বেঞ্চে, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, আড্ডা বসতে পারে। আবার আড্ডা হতে পারে বারান্দায়, ঘরের ভেতরে, ছাদের ওপরে, অফিসের কমন রুমে, কলেজের ক্যান্টিনে, খাওয়ার টেবিলে, হোটেলের লবিতে, রেস্টুরেন্টে, কফি শপে, বইয়ের দোকানে, পত্রিকা দপ্তরে, রঙ্গমঞ্চের পিছনে– কোথায় নয় বলুন তো?

বিশ্ব তো কোন ছাড়, গোটা ভারতে বাংলার মতো এমন আড্ডাস্থল ও আড্ডাবাজ কোথায়! এবারে কিছু সেরা আড্ডাস্থল ও আড্ডাবাজের হালহদিশ নিয়ে খোঁজখবর করা হল। এর পরেও বাকি থেকে গেল অসংখ্য আড্ডাস্থল, বাদ পড়ে গেলেন টেনিদা, ঘনাদা বা ব্রজদার মতো রসদ-জোগানদার এবং হাবুল, ক্যাবলা ও প্যালার মতো অগন্য চরিত্র। তাঁদের সবার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

বাড়ির আড্ডা

কলকাতার নানা বাড়ি আড্ডার সুবাদে বিখ্যাত হয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির 'দক্ষিণের বারান্দা'র কথা বলা যায়। সেখানে নানা ধরনের আড্ডা হত। রোটেনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ এই বারান্দাতেই।

বঙ্গীয় কলা সংসদের আড্ডা বসত অবনীন্দ্রনাথের বৈঠকখানায়। কখনও চৈতন্য লাইব্রেরিতে।  সেখানে আসতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাপ্রসাদ-সহ সমসাময়িক প্রায় সকল শিল্পী। এই বৈঠকি আড্ডার কোনও সময় ছিল না। নন্দলাল বসুর হাতিবাগানের বাড়িতে আড্ডা দিতে আসতেন তত্কালীন নামী–দামি প্রচুর শিল্পী। ১৯১৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত হেমেন্দ্রকুমার মজুমদারের উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের বাড়িতেও চিত্রশিল্পীদের একটি আড্ডা গড়ে উঠেছিল।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন্সের বাড়ির প্রতি রবিবারের আড্ডায় হাজির হতেন কলকাতার বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, প্রবীন ও নবীন সাহিত্যিক দল। বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটা থেকে শুরু হয়ে তিনটে-সাড়ে তিনটে অবধি গড়াত সেই আড্ডা।

কালীঘাটে সদানন্দ রোডে থাকতেন কবি অরুণ মিত্র। তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আড্ডার আসর বসত। নিয়মিত আসতেন বিজন (গোষ্ঠ) ভট্টাচার্য। গৃহকর্তা সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন তাঁর বড় মামা। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এই আসরে এসেছেন অনেকেই। যেমন, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, গোপাল ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। ততদিনে 'অরণি' পত্রিকার প্রকাশ ঘটে গেছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যয়, রাম বসু, সিদ্ধেশর সেন-এর মত কবিরা। পরবর্তীকালে এই আড্ডা ৪৬, ধর্মতলা স্ট্রিটে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের দপ্তরে সরে যায়। এখানে মাঝে মধ্যে আসতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় সেহানবিশ, সুধী প্রধান প্রমুখ। ধর্মতলার অফিস থেকে বেরিয়ে অরুণ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিজন ভট্টাচার্য, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা বাড়ি ফেরার পথে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে বসেও আড্ডা দিতেন। চলত যৌথ গান। পরবর্তীকালে অরুণ মিত্রদের সদানন্দ রোডের এই বাড়ি গণনাট্য সংঘের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।        

রবি ঘোষের বাড়ি ছিল একটা ছোটখাটো আড্ডার বাজার। সেখানে নিয়মিত আসতেন শর্মিলা ঠাকুর-সহ নানা রসিকজন। আড্ডা দেওয়ার ব্যাপারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মন। একসময় প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই নাকি তাঁর বাড়িতে ম্যারাথন আড্ডার আসরে বসতেন 'এক্ষণ' পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, আই পি টি-র নির্মল ঘোষ, অভিনেতা রবি ঘোষ প্রমুখ।

প্রথমে লেক অ্যাভিনিউ, পরে ৩ লেক টেম্পল রোড এবং একেবারে শেষে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। বাড়ি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়ির আড্ডারও স্থানবদল হয়েছে। রবিবার সকালের রায়বাড়ির আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। আসতেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, ডি জি কিমারের বেশ কিছু সহকর্মী, অমল সোম, কালীকিঙ্কর রাহা, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, অশোক বসু, সৌমেন্দু রায়, পূর্ণেন্দু বসু, নিমাই ঘোষ, দুলাল দত্ত, টিনু আনন্দ, রবি ঘোষ, তপেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। প্রতি রবিবারে না হলেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাসে অন্তত দুটি রবিবারে আসতেন। এই আড্ডার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কামু মুখোপাধ্যায়। সস্ত্রীক আসতেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। কিছুদিন এসেছেন ও সি গাঙ্গুলি কিংবা হরিসাধন দাশগুপ্তও। সকাল নটা-সাড়ে নটা থেকে শুরু হওয়া আড্ডা গড়াত বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত। সেখানে শুধু যে গুরুগম্ভীর আলোচনা হত তা কিন্তু নয়, কামু মুখোপাধ্যায় বা রবি ঘোষের হালকা রসিকতা উপভোগ করতেন স্বয়ং সত্যজিৎ থেকে শুরু করে বাকি সবাই। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে আসত সুরভিত দার্জিলিং চা, ডালমুট ও বিস্কুট। কখনও শিঙারা বা চপ। অন্দর সামলাতেন বিজয়া রায় স্বয়ং।


মেসবাড়ি

কলকাতার আড্ডার ইতিহাস নানা মেসবাড়ির ভূমিকাও আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পশ্চিম কোণে 'সাকি' মেস। সেখানে থাকতেন মুকুল গুহ। তাঁর লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, সেখানে নাকি আড্ডার তাণ্ডবনৃত্য চলত। মেসে থাকতেন শিল্পী প্রতাপচন্দ্র চন্দ, খেলোয়ার অজয় দাশগুপ্ত, ভাষ্যকার শরদিন্দু দত্ত-সহ অনেকেই। ছন্নছাড়া অথচ আন্তরিক এই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন প্রসূন মিত্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্কর ঘোষ। আসতেন দেবব্রত বিশ্বাস (জর্জদা)ও।

মির্জাপুরে ত্রিপুরা হিতসাধিনী হলের পাশে একটি মেসবাড়িতে তেলেভাজা আর মুড়ি সহযোগে আড্ডায় হাজির থাকতেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, গোকুল নাগ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে। এই আড্ডাকে অনেকে বলতেন কল্লোলীয় আড্ডা।

পত্রিকা দপ্তর

ভাবা যায়, মানসী পত্রিকার অফিসে আড্ডা মারতেন নাটোরের মহারাজ জগদানন্দ রায়! আর আড্ডার মৌতাত জোগান দিতেন বিখ্যাত দুই রাশভারি ব্যক্তিত্ব – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এই আড্ডার দ্বিতীয় অধিবেশন নাকি হত নাটোরের রাজবাড়িতে। আর তা শেষ হতে হতে রাতের তৃতীয় প্রহর হয়ে যেত, যখন শহর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

পটুয়াটোলার লেনের একটি ছোট্ট দোতলা বাড়ির একটি ছোট্ট ঘরে 'কল্লোল'-এর জন্ম এবং সেটাই ছিল আড্ডাঘর। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পবিত্র গাঙ্গুলি থেকে শুরু করে অনেকেই আসতেন সে আড্ডায়। তাছাড়া সমসাময়িক 'শনিবারের চিঠি'-র আড্ডার কথাও সর্বজনবিদিত। 'কল্লোল' ও 'শনিবারের চিঠি'- এই দুই আড্ডার রেষারেষি এক সময় নাকি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় তাঁর বাড়িতে দুই দলকে ডেকে সাহিত্যের প্রথম 'সামিট মিটিং'-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় 'কল্লোল'-এর আড্ডার কিছু কিছু হদিশ পাওয়া যায়।

'বঙ্গশ্রী' পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে  সন্ধের দিকে আড্ডার আসর জমে উঠত। আসতেন যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কবিশেখর কালিদাস রায়, জগদীশ গুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, বন্দে আলি মিঞা, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, রাসবিহারী মণ্ডল, শক্তিপদ রাজগুরু, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস সরকার প্রমুখ। 'অর্থনীতি, সমাজনীতি, বেকারত্ব, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, গ্রহ-নক্ষত্র, স্বপ্নতত্ত্ব, ধর্ম ও দর্শন, চিত্রকলা, যাদুবিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান, ভূ-তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, মঞ্চ ও চিত্রাভিনয়, নারীপ্রগতি, বিবাহ ও লোকচরিত্র প্রভৃতি সবই ছিল আড্ডার আলোচ্য বিষয়; সঙ্গে কিছু টীকা-টীপ্পনি হাস্যরস।'

'যুগান্তর' পত্রিকা দপ্তরের কেন্দ্রমণি ছিলেন পরিমল গোস্বামী। আসতেন দাদাঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, মণীশ ঘটক (যুবনাশ্ব) ইত্যাদি ব্যক্তিত্ত্ব। এইরকম পত্রিকা দপ্তরের আড্ডা হত আরও অনেক জায়গায়। যেমন, 'দৈনিক নবযুগ' পত্রিকায় কাজি নজরুল ইসলামকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত আড্ডার আসর।

কলেজ স্ট্রিটের একটা এঁদো বিশাল বাড়ির এক কোণের এক চিলতে ঘরে ছিল 'চতুষ্কোণ'-এর অফিস। দেয়ালের দিকে দুটি ছোট ছোট টেবিল, দুটো চেয়ার আর সামনে গোটা আটেক চেয়ার। এখানেও দারুণ আড্ডা জমত। আসতেন তত্কালীন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক ও কবিকূল।

আড্ডা হত 'পরিচয়' পত্রিকা দপ্তরেও। থাকতেন বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, গোপাল হালদার, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখার্জি এবং পরবর্তীকাল দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, দেবেশ রায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখ।

'কৃত্তিবাস'-কে ঘিরে একসময় উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। শক্তি-সুনীল-সন্দীপন-শ্যামল-দীপক-সমরেন্দ্র-শরৎ-ভাস্কর-বেলাল এবং আরও অনেক তত্কালীন তরুণ তুর্কীর সেই জমাটি আড্ডা তো ইতিহাস হয়ে থাকবে।

প্রকাশনা দপ্তর  

বিংশ শতকের প্রথমদিকে কলেজ স্কোয়ারের পিছন দিকে ছিল 'বুক-কোম্পানি' নামে এক বইয়ের দোকান। ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে বই আসত এখানে। পেছন দিকে গুদামঘরে নতুন বইয়ের বিচিত্র গন্ধের মাঝে জাহাজ থেকে আসা বাক্স ভর্তি বই আর মেঝেতে ছড়ানো মোটা মোটা কাগজকে আসন বানিয়ে আড্ডা দিতেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কিংবা প্রমথ চৌধুরির মতো ব্যক্তিত্ব। বুক-কোম্পানির ভেতরের ছোট্ট একটা ঘরে আড্ডা দিতেন মালিক গিরিনবাবু, আনন্দবাজারের সুরেশচন্দ্র মজুমদার এবং আরও অনেকে।

মিত্র ও ঘোষের দোকানে আড্ডা দিতে আসতেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নীহারঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ। স্বয়ং গজেন্দ্রকুমার মিত্র মহাশয় তো থাকতেনই।

এম সি সরকারের দোকানের আড্ডার কথা অনেকেই জানেন। মধ্যমণি ছিলেন মালিক সুধীরচন্দ্র সরকার, বাইরে গম্ভীর প্রকৃতির হলেও অন্তরে তিনি ছিলেন শিশুর মতো। বহু শিল্পী ও সাহিত্যিককে সেখানে দেখা যেত। আসতেন প্রবাসী সম্পাদক কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, তুষারকান্তি ঘোষ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধ কুমার সান্যাল, শিবরাম চক্রবর্তী, মনোজ বসু, ভবানী মুখোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, সুশীল রায় এবং আরও অনেকে।

থিয়েটার

থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চের আড়ালে আড্ডা দিতেন অভিনেতা শিশিরকুমার ভাদুড়ি। সমাজের তাবড় হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গে সেই আড্ডার দুর্নিবার আকর্ষণে ছুটে আসতেন স্বয়ং শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। আড্ডাধারীদের কাছে শিশিরকুমারের পরিচয় ছিল সুধাদা নামে। শোনা যায়, শরত্চন্দ্রের ইচ্ছে ছিল বিস্ময়কর ও বিচিত্র ব্যক্তিত্বের সুধাদার চরিত্র অনুসরণে কোনও সাহিত্য সৃষ্টির।   

পরবর্তীকালে নাট্যকার ও পরিচালকদের আড্ডা বসত শ্যামবাজারের মোড়ে পবিত্র পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে। আশেপাশের রিহার্সাল রুম থেকে রিহার্সাল সেরে বিভাস চক্রবর্তী কিংবা অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতো গ্রুপ থিয়েটারের পরিচালকরা আড্ডায় আসতেন। নাটক নিয়ে আড্ডা হত।

রেষ্টুরেন্ট ও কফি হাউস

কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস যেন আড্ডার মক্কা। কোন আড্ডাবাজ এখানে আড্ডা দিতে আসেননি সেটাই বিস্ময়ের। বছরের পর বছর ধরে বাঙালির আড্ডা-মানচিত্রে কফি হাউস এক ও অদ্বিতীয় হয়ে রয়েছে। এই আড্ডার একটা চিত্র দিই।

পঞ্চাশের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে জাঁকিয়ে বসে থাকতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, হিরণ সান্যাল, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। আরও কিছু পরে যুক্ত হলেন শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শঙ্কর দে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, উত্পলকুমার বসু, দীপক মজুমদার, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বেলাল চৌধুরি, অরবিন্দ গুহ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শেখর বসু, রমানাথ রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নিখিল সরকার, সুব্রত চক্রবর্তী, ভাস্কর চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-সহ আরও অনেকে। এই সময়কার মহিলা আড্ডাবাজদের মধ্যে কৃষ্ণা মিত্র, মীনাক্ষী সরকার, সন্ধ্যা বসু, প্রণতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করা যেতে পারে। টেবিল ভাগাভাগি করে আড্ডা হত তখন। রবিবার বেলা ১০-১১টা নাগাদ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আড্ডা দিতেন নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে। তাঁদের ওখানেই আসতেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তী কিংবা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

যাঁদের কথা লিখলাম এঁরা যে সবাই প্রতিদিন আড্ডায় আসতেন এমন নয়, তা ছাড়া কেউ কেউ হয়ত কলকাতার বাইরেও থাকতেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ মিললে তাঁদের এই তীর্থস্থান একবার ঘুরে দেখা চাই-ই চাই। এই ছিল আড্ডাবাজদের মনের অন্দরের কথা। আর সেই আড্ডার ধারা আজও অব্যাহত আছে।

রাধাপ্রসাদ গুপ্তের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৪৫-৪৬ সালে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে জমাটি আড্ডা বসত। এখানে লাঞ্চের সময় নিয়মিত ভাবে যাঁরা আড্ডা দিতে আসতেন তাঁরা হলেন – সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ নিয়োগি, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, কালিসাধন দাশগুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যেন মৈত্র, সুভাষ ঘোষাল, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রনেন রায়, প্রতাপ রায়, জেড এইচ (বান্টি) খান প্রমুখ। মাঝে মধ্যে দেখা যেত পরিতোষ সেন, শুভো ঠাকুর, প্রদোষ দাশগুপ্ত, গোপাল ঘোষকেও। একটা টেবিলে নাকি নিয়মিত এসে আড্ডায় মাততেন তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ সেক্রেটারি-সহ সব বড় বড় আমলারা।

এই আড্ডা নিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লিখছেন, '.. সেই টেবিলে যে দুনিয়ার কত জিনিস নিয়ে কতরকমের আলোচনা হত তার কোনও ইয়ত্তা ছিল না। .. হলিউড আর বিলিতি ফিল্ম ছাড়া ইউরোপীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আমাদের আড্ডায় যে সব সে সময় কথাবার্তা হত তখন ভারতের অন্য জায়গায় বিদগ্ধ বাবুরা তা নিয়ে ভাবতেই শুরু করেন নি। .. ' ফিল্ম সোসাইটি তৈরির ভাবনা প্রথম সেখানেই শুরু হয়েছিল। 'দি রিভার' ছবির স্যুটিং চলাকালীন স্বয়ং জা রেনোয়া ওই আড্ডাস্থলে বারকয়েক আসেন। আসতেন মৃনাল সেন, অম্লান দত্ত, হামদি বে, গৌরকিশোর ঘোষ ছাড়াও রবি সেন, সমর সেন, অশোক মিত্র, শেখর চট্টোপাধ্যায়, উত্পল দত্ত প্রমুখ।

দেশপ্রিয় পার্কের 'সুতৃপ্তি', কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের 'বসন্ত কেবিন' কিংবা উত্তরের 'ফেভারিট কেবিন'-এ চায়ের কাপে তুফান তোলা আড্ডা জমত। আড্ডা হত দক্ষিণের 'স্যাঙ্গুভ্যালি'-তেও। সুতৃপ্তি-র রবিবারের সকালের চমৎকার আড্ডায় জমায়েত হতেন মূলত দক্ষিণ কলকাতায় থাকা লেখকরা। শংকর চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন প্রমুখ।

শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কাছে এসব ছিল নিজস্ব ভুবন। গড়িয়াহাটার মোড়ে 'পানিয়ন' বলে একটি রেস্টুরেন্টে জমাটি আড্ডার আসরে মধ্যমণি ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। আসতেন উত্পল দত্ত, রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, এন বিশ্বনাথন, শেখর চ্যাটার্জি। কমলকুমারের আকর্ষণীয় কথায় উঠে আসত শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস-ভূগোল ও আরও নানা বিষয়।

চা দোকান

কত অসংখ্য অকিঞ্চিত্কর চা-এর দোকানে যে কত মহান আড্ডা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। একটা উদাহরণ।

কালিঘাট ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে এক চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন সাগরময় ঘোষ। দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন এমন অনেক সাহিত্যিক সেখানে জমায়েত হতেন নির্ভেজাল আড্ডার লোভে। যেমন, চেতলা থেকে বিমল মিত্র, ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকের অমৃত ব্যানার্জি রোড থেকে রমাপদ চৌধুরি, চারু অ্যাভিনিউ থেকে হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় আর ব্যতিক্রমী ব্যাঙ্কের কেরানি কিন্তু সাহিত্যানুরাগী বিশুদা ওরফে বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। আশ্চর্য হলেও যেটা সত্যি তা হল এই বিশুদাই ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। সন্ধে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে সবাই এসে হাজির হতেন সেখানে। আর রবিবারে নিয়মিত ভাবে আড্ডা বসত সকালবেলায়। সকালের আড্ডায় আসতেন শচীন বন্দ্যোপাধ্যায় বা স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

পার্ক

কলকাতার নানা পার্কে আড্ডা হত। এখনও হয়। একটা উদাহরণ দিই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমল কর আনন্দবাজার দপ্তর থেকে বেরিয়ে আগের মতো কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে না গিয়ে তরুণ ও মধ্যবয়সি লেখকদের সঙ্গে কার্জন পার্কের সবুজ ঘাসের ওপরে বসে আড্ডা দিতেন। তার আগে কে সি দাশের চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া হত। বেশির ভাগ দিন বিমল কর নিজেই চায়ের দাম মেটাতেন। সেই আড্ডায় থাকতেন সমরেশ মজুমদার, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশু ঘোষ, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন, অভ্র রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, রমানাথ রায়, শেখর বসু, কণা বসু মিশ্ররা।

চিত্রশিল্পীদের আড্ডা  

পার্ক স্ট্রিটে বেঙ্গল ল্যান্ড হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন বা জমিদার সভার ঘরে ছবির প্রদর্শনীর পাশাপাশি নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত সুভো ঠাকুরের উদ্যেগে গঠিত 'ক্যালকাটা গ্রুপ'-এর ৫, এস আর দাস রোডের ঠিকানায় রথীন মৈত্র, প্রাণকৃষ্ণ পাল, নীরদ মজুমদার, প্রদোষকুসুম দাশগুপ্ত প্রমুখ শিল্পীদের আড্ডায় ভিড় করতেন শাহেদ সুহরাবর্দী, জন আকুয়িন, বিষ্ণু দে, বিনয় সরকার, নীহাররঞ্জন রায়, স্নেহাংশুকান্ত আচার্য।

ধর্মতলার মোড়ে জি সি লাহার দোকানের উল্টোদিকে অধুনালুপ্ত 'নিউইয়র্ক সোডা ফাউন্টেন'-এ ছিল চিত্রী আর ভাস্করদের প্রাধান্য। শুভাপ্রসন্নের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে যে সেখানে নিয়ম করে আসতেন গনেশ পাইন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে এসেছেন মুস্তাফা মানোয়ার, সাহাবুদ্দিন, কামরুল হাসান। তাছাডা় তখনকার তরুন চিত্রীদের মধ্যে সেখানে নিয়মিত দেখা যেত রবিন মণ্ডল, সুহাস রায়, সুনীল দাসদেরকে। 'সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি'র সদস্যরা, ক্যালকাটা পেন্টার্সদের প্রায় সব সদস্যদেরই আনাগোনা ছিল এই ঠেকে।' অনিয়মিত ভাবে আসতেন অহিভূষণ মালিক, শ্যামল দত্তরায় কিংবা গৌরকিশোর ঘোষ।

আকাশবাণী

একসময় 'আকাশবানী'কে ঘিরে বিস্তর আড্ডা হয়েছে। তখন বাঙালির সাংস্কৃতিক  কর্মকাণ্ডের অন্যতম শরিক ছিল 'আকাশবানী' দপ্তর। কবিতা সিংহ জানাচ্ছেন, 'দাদাঠাকুর ছিলেন এই আড্ডার ধূমকেতু জ্যোতিষ্ক। এলেই মাত।'  সেখানে যাঁরা আসতেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন অন্তরাল এবং মঞ্চের সেলিব্রিটি। যেমন ধরুন, হীরেন্দ্রনাথ বসু, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বাণীকুমার, মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, সুরেশ চক্রবর্তী, কাজি নজরুল ইসলাম প্রভৃতি। আর এঁদের ডাকে মধ্যে মধ্যে আড্ডায় এসে হাজির হতেন পরিমল গোস্বামী, সজনীকান্ত দাস, নিরোদ সি চৌধুরি, এন কে জি, নলিনীকান্ত সরকারের মতো ব্যক্তিত্ব। এই আড্ডায় বসে গান বাঁধতেন নজরুল। নতুন নাটকের মহড়া দিতেন বাণীকুমার-বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। 'আর চলত পান আর চা। চা আর পান। চাপান-উতোর। উতোর-চাপান।'

আড্ডা দিতে দিতেই একদিন কেয়া চক্রবর্তীকে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়া হয় চার চরিত্রের একটি কাব্য নাটক। বিমল মিত্রকে দিয়ে গাওয়ানো হয় গান।

প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ হিসেবে চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখার্জি, অভিনেতা বিকাশ রায়, অতুল মুখোপাধ্যায়, সবিতাকুমার মিত্র মুস্তাফি প্রভৃতি এবং প্রোডিউসার হিসেবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভি জি যোগ, দীপালি নাগ চৌধুরি, লীলা মজুমদার প্রমুখ আসতেন। এঁরা এলে কাজের পাশাপাশি আড্ডাও হত। 'যুববাণী' দপ্তরে আড্ডা মারতে আসতেন তখনকার নতুন প্রজন্ম।

দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল চমত্কার 'পান' করতে পারতেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একদিন খুব বাজে (অকথ্য তেতো) চা এল। দীপ্তেন্দ্রবাবুর মন্তব্য ছিল এইরকম –

"যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই

যাহা পাই তাহা 'চা'ই-ই না।"

কৃতজ্ঞতাঃ কলকাতার আড্ডা (সমরেন্দ্র দাস সম্পাদিত)

(লেখাটি 'আজকাল সুস্থ' পত্রিকার অক্টোবর ২০১৫ সংখ্যায় কভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত হয়। কভার স্টোরির বিষয় ছিল 'আড্ডা'।)