শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০

গিরগিটি বনাম লাল ঝান্ডা ~ সুশোভন পাত্র

শুভেন্দু অধিকারী বিজেপি জয়েন করল। মহম্মদ ইলিয়াস রয়ে গেলো।
ওহ, ওয়েট! আপনি বোধহয়য় মহম্মদ ইলিয়াস কে চিনতে পারছেন না। তাই তো? স্বাভাবিক। মিডিয়া তে শুভেন্দুর মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবি আর অমিত শাহ'র হেলিকপ্টার –এর বাইরে মহম্মদ ইলিয়াসের 'সাধারণ' রাজনৈতিক জীবনে ফোকাস করার মত আপনার সময় কোথায় বলুন!
১১ বছর আগের একটা স্টিং অপারেশন। নন্দীগ্রামের সিপিআই'র বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেওয়া হল ১০,০০০ টাকা। বিধানসভায় জমা পড়ল স্টিং অপারেশনের সিডি। চিত্রনাট্যর স্ক্রিপ্ট মেনেই, স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনলেন নারদা কাণ্ডে অন ক্যামেরা ৫লাখ ঘুষ খাওয়া সৌগত রায়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করলেন ইলিয়াস।
আচ্ছা, মনে করুন তো ঐ স্টিং অপারেশনে করেছিল কোন মিডিয়া? সুদীপ্ত সেনের সারদার চিট ফান্ডের কালো টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা চ্যানেল টেন। ঐ স্টিং অপারেশনে সাংবাদিক কে সেজেছিলেন? তৃণমূলের প্রাক্তন, বিজেপির বর্তমান কচিনেতা শঙ্কুদেব পাণ্ডা। আর ঐ স্টিং অপারেশনের মাস্টার মাইন্ড কে ছিলেন? তৃণমূলের প্রাক্তন, বিজেপির বর্তমান 'জননেতা' শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামে বামফ্রন্ট বিরোধী বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের পার্ট অ্যান্ড পার্সেল -স্টিং অপারেশন।
আজ, ২০২০-র ডিসেম্বর। আজ অবধি তদন্তে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে প্রমাণ হলনা কিছুই। হওয়ার ছিলোওনা। আজ যখন শুভেন্দু তৃণমূল থেকে বিজেপি হলেন তখন গুরুতর অসুস্থ ইলিয়াস। দু-বিঘা জমি বেঁচে তাঁর চিকিৎসা চলছে। সংসার চলে কোনওমতে, বিধায়কের পেনশনে। কিন্তু আজও আদর্শের সাথে এক ইঞ্চি আপোষ করেননি ইলিয়াস। আজও লাল ঝাণ্ডার রাজনীতি থেকে এক পা সরে আসেননি ইলিয়াস। আজও ইনকিলাবি স্লোগানে সমাজ পরিবর্তনের ফিনিক্স স্বপ্ন বন্ধক দেননি ইলিয়াস।
সুশান্ত ঘোষের দিকে আঙুল দেখিয়ে বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "ঐ লোকটাই কঙ্কাল কাণ্ডের নায়ক না"। বলেছিলাম "মিডিয়া বলে। আমরা বলি না। বিশ্বাসও করি না"। দীর্ঘ আইনি লড়াইর পর আমাদের বিশ্বাসটাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। CID তথাকথিত 'কঙ্কাল কাণ্ডে'র DNA টেস্টের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনতে পারেনি, অভিযোগের প্রামাণ্য নথি আদালতে জমা দিতে পারেনি, পুলিশও চার্জশিট গঠন করতে পারেনি। আর তাই হাজার চেষ্টা করেও সুশান্ত ঘোষ কে নিজের ভিটে থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত সফল হয়নি।
সেদিন মিথ্যে মামলায় সুশান্ত ঘোষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর, এই শুভেন্দু অধিকারীই বলেছিলেন "জঙ্গলমহলে লাল ঝাণ্ডা ধরার লোক থাকবে না"।  ৯ বছর পর জঙ্গলমহলে ফিরেছেন সুশান্ত ঘোষ। ধামসা-মাদল বেজেছে। মিছিল সেজেছে। মঞ্চ বেঁধে মিটিংও হয়েছে।
যে মঞ্চে ছিলেন ছিতামণি সরেন। ছিতামণি সরেন সালুকর মা। ঐ যে সালকু'র গলায় ছ-খানা টাঙ্গির কোপ পড়েছিল, লাশটা লালগড়ের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিলো; সেই সালুকর মা। শরীরের চামড়া পচে গলে যাচ্ছে, পোকাতে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চারিদিকে দুর্গন্ধ; অথচ মাওবাদী'দের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, যে সালকুর মৃতদেহ সৎকারের সাহস করেননি ধরমপুর গ্রামের কেউ; সেই সালুকর মা! সিপিআই(এম) মধ্যমকুমারি শাখার পার্টি সদস্য ছিল যে সালকু; সেই সালুকর মা!
সালকুর খুনের পর এই শুভেন্দু বলেছিলেন, "ও সব সিপিএম-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব"। আজ শুভেন্দুর সৎ সাহস আছে নাকি একবার ছিতামণি সরেনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। হিম্মত আছে লালগড়ের পার্টি অফিসে আজও যে এক টুকোর লালপতাকা সালকুর রক্ত গায়ে মেখে পতপত করে ওড়ে সেটার দিকে মাথা তুলে তাকানোর?
শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপি জয়েন করল! ছিতামণি সরেন রয়ে গেলো।
কদিন আগে হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতেই বুদ্ধবাবু নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁকে আলাদা VIP পরিষেবা দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চিকিৎসা পরিষেবার কোন ক্ষতি হচ্ছে নাকি? আচ্ছা ইনিই কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে লোকটার "আমরা ২৩৬ ওরা ৩৬"-র গালভরা মন্তব্যে মিডিয়া ঔদ্ধত্য'র মহাভারত লিখেছিল? ইনিই কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়ে যার সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, "বুদ্ধদেবের পাঞ্জাবি তে রক্তের দাগ" –বলতেন? ইনি কি সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যার সম্পর্কে শুভেন্দু অধিকারী "খুনি বুদ্ধর ফাঁসি চাই" স্লোগান দিয়ে মেদিনীপুরের রাস্তায় মিছিল বের করতেন?
বুদ্ধবাবুর তো নিশ্চয় আজ কোন ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই? ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অধরা কোন স্বপ্ন নেই? অমুক কমিটির তমুক মেম্বার হয়ে আখের গোছানর ব্যাপার নেই? নিদেনপক্ষে প্রোমোট করার জন্য নাদুস-নুদুস একটা ভাইপোও নেই? তবুও মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কোনক্রমে ফিরে আসা এই লোকটা জ্ঞান ফিরতেই হাসপাতালের সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা কেন জিজ্ঞেস করছে বলুন তো?
উত্তর খুঁজবেন। একদিকে এই মহম্মদ ইলিয়াস, ছিতামনি সরেনরা। আর অন্যদিকে মিডিয়ার বানানো মুকুল রায় কিম্বা শুভেন্দু অধিকারীর মত 'দোর্দণ্ডপ্রতাপ' তৃণমূলর প্রথম সারির নেতারা। একদিকে সব হারিয়েও লালঝাণ্ডাতেই আস্থা রাখার স্পর্ধা। আর অন্যদিকে ঘুষ খেয়ে, দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড না হতে পেরে; লাইন দিয়ে বিজেপি-তে গিয়ে আখের গোছানোর ধান্দা। পার্থক্যটা কোথায় বলুন তো? সততার? রাজনৈতিক আদর্শের? না মূল্যবোধের? উত্তর খুঁজবেন।
আজকাল 'সততা', 'রাজনৈতিক আদর্শ', 'মূল্যবোধ' -শব্দ গুলোই বড্ড ক্লিশে হয়ে গেছে রাজনীতি তে। অর্ণব গোস্বামী, সুধীর চৌধুরী, সুমন দে'র সৌজন্যে আপনারও মনে হতে শুরু করেছে শুভেন্দু ইন্সটলমেন্টে বিজেপি তে যাবে –সেটাই তো রাজনীতি। 'ভাগ মুকুল ভাগ' বলা বিজেপি মুকুল কে সংগঠনের মধ্যমণি করে পুষে রাখবে -সেটাই তো রাজনীতি। তোয়ালে মুড়ে মেয়র ঘুষ খাবে -সেটাই তো রাজনীতি। নেতা-মন্ত্রীরা আদর্শ বেচে ভোটের মরশুমে গিরগিটির মত রং বদলাবে -সেটাই তো রাজনীতি।
আসলে এই গিরগিটীময় রাজনীতির রসদ আছে আপনার চারপাশেই। আপনার পরিবারেই, আপনার বন্ধু মহলেই। দেখবেন এই কদিন আগেও আপনার দুঃসম্পর্কের যে আত্মীয় তৃণমূলের শুভেন্দু কে সকাল-সন্ধ্যা খিস্তি করছিল, তারাই কাল থেকে সবার আগে গায়ে শুভেন্দুর নামাবলী জড়িয়ে বসে আছে, নির্দ্বিধায়! আপনার যে বন্ধুরা তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে চায়ের দোকানে মাতিয়ে দিচ্ছিল তারাই মুকুল রায়ের ঘুষ খাওয়ার ভিডিও দেখে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে, নিঃসংকোচে! অবিকল মানুষের মত দেখতে এই প্রাণী গুলোই আসলে গিরগিটী। আদ্যোপান্ত ধান্দাবাজ। আপাদমস্তক সুবিধাবাদী।
তাই কেবল শুভেন্দু-মুকুল নয়, যে রাজনীতি, যে রাজনৈতিক দল এই গিরগিটীদের দল চালানোর দায়িত্ব দেয়, নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে মাথায় তুলে নাচে; আর আমার চারপাশে যে মানুষ গুলো সেই রাজনীতি সমর্থন করে, গিরগিটীদের নেতা মানে, এদের প্রত্যেক কে আমি ঘেন্না করি। আমার গর্ব, আমার অতিক্ষুদ্র রাজনৈতিক সামর্থ্যে, আমি এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়াই করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন