বুধবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৮

তারপর কি হোল ~ আর্কাদি গাইদার

'তারপর একদম অন্তিমলগ্নে এসে ওরা মরিয়া হয়ে উঠলো। আর মরিয়া হলেই মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। টিক্কা খানের তত্ত্বাবধানে শুরু হলো 'অপারেশন সার্চলাইট'। বেছে বেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকারদের তালিকা বানানো হলো। সিদ্ধান্ত হলো, একসাথ এদের সবাইকে নিকেশ করতে হবে। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে যেন বুদ্ধির চর্চা করানো, প্রশ্ন করা শেখানো, ভাবানোর জন্যে কেউ না থাকে। যারা ভাবতে পারে না, প্রশ্ন করতে পারে না, তারা বাধ্য, অনুগত প্রজা হয়ে থাকবে।'

'তারপর কি হলো?'

'তারপর ওরা রাতের বেলায় অন্ধকারে এলো। সরকারি উর্দি পড়া এক দল আর উর্দি ছাড়া তাদের চ্যালাচামুন্ডারা। ঘরে ঘরে ঢুকে তালিকা মিলিয়ে শুরু করলো ধরপাকড়। চোখে কাপড় বেধে, পিছমোড় করে হাত বেধে, একে একে নিয়ে যাওয়া হলো রায়েরবাজার, মিরপুর, রাখালপাড়া, মহম্মদপুরের টর্চার ক্যাম্পে।'

'কাদের নিয়ে গেলো?'

'দেশদ্রোহীদের। তখন তো দেশ মানে পাকিস্তান। তাই যারা পাকিস্তান বিরোধী তারাই তো দেশদ্রোহী। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর হুমায়ুন কবীর, জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দচন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, রশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান। ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্রকার জাহির রায়হান। ছিলেন সংগীতশিল্পী আলতাফ মেহমুদ। ছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, আইনজীবি এবং ছত্তিসগড়ে দীর্ঘদিন মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী সুধা ভরদ্বাজ।'

'ছত্তিসগড়? দাঁড়াও দাঁড়াও, আমরা তো অপারেশন সার্চলাইট..'

'ছিলেন দলিত আন্দোলনের কর্মী প্রফেসর আনন্দ তেলতুমড়ে। ছিলেন কবি ভারভারা রাও। আরও ছিলেন সাংবাদিক গৌতম নভলাখা। যিনি গত একবছর ধরে অনুসন্ধান করে একের পর এক লেখায় রাফায়েল স্ক্যামের তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছেন।'

'রাফায়েল স্ক্যাম? দাদু, তুমি কিসব বলছো?'

'এখানে শেষ না। তারপরে ছিলেন উত্তরবাংলার চা বাগানের চা শ্রমিক সমন পাঠক। ছিলেন উত্তর ৩৪ পরগনার শ্রমিক নেতা আহমেদ আলি খান..'

'আরে দাঁড়াও তো। বাংলাদেশ থেকে কোথায় চলে এলে! তোমার বয়সের সাথে সাথে মাথাটা গেছে! সব গুলিয়ে ফেলছো।'

'গুলিয়ে ফেলছি? না না। গোলাচ্ছি না। কিচ্ছু গোলাচ্ছি না।'

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮

একটি অবাস্তব, কষ্টকল্পিত, তৃতীয় শ্রেণীর, মেলোড্রামাটিক গপ্পো ~ বিষাণ বসু


ডিসক্লেইমার -

১. লেখাটা সাইজে বড়ো। অন্তত ফেসবুকের আন্দাজে। মাঝপথে গালি দেবেন না।

২. শিরোনামের প্রতিটি বিশেষণ সত্যি। কোনো বিনয়ঘটিত নয়।

৩. লেখাটি প্রমথনাথ বিশীর একখানি ছোটোগল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। না, অনুপ্রাণিত নয়, একেবারে নির্লজ্জভাবে ঝেড়ে দেওয়া। যাঁরা গল্পটি পড়েছেন, তাঁরা জানেন। বাকিরা দুধের স্বাদ ঘোল নয়, পিটুলিগোলা জলে মেটানোর ব্যর্থ প্রয়াসে ব্রতী হোন।

৪. বাংলা সিরিয়াল বন্ধের মতো একটি জাতীয় ক্রাইসিসের হাত থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্যে আমরা মহান নেত্রীর প্রতি চিরঋণী রইলাম। মালদার গণি খান ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রছাত্রীরা, অনশনরত ডাক্তারেরাও একদিন নেকনজর পাবেন, এই আশা নিয়ে আসুন, সিরিয়াল দেখি।

আর, ও হ্যাঁ, গল্প শুরু করি।

তিন বন্ধু।

একজন শিক্ষক, আরেকজন ডাক্তার। তৃতীয়জন সাধারণত টিভি সিরিয়ালে, আর মাঝেমধ্যে সিনেমার পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে থাকেন।

সেই স্কুলজীবনের পরে দেখা হচ্ছে আজ। এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। উন্নয়নের জোয়ারে রাজ্য ভেসে গিয়ে সারা দেশ ভাসবো ভাসবো করছে। পাহাড়-জঙ্গলমহল ছেড়ে খাস কলকাতা শহরও হাসছে।

ঘনঘোর বাম আমলে কবি জানিয়েছিলেন, "সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়…", কিন্তু, এখন দিন বদলেছে। উজ্জ্বল এই সময়ে, তিন বাল্যবন্ধু ঠিক করেছিলেন, যে, তাঁরা দেখা করবেন, ছেলেবেলার মতো হইহুল্লোড় করবেন, অন্তত একটিদিনের জন্যে।

বেশ কথা। কিন্তু, দেখা করা যায় কোথায়? কারোর বাড়িতে হলে চলবে না, কেননা, বৌ-ছেলেমেয়ের সামনে কৈশোরে ফিরে যাওয়াটা একটু মুশকিলের। অতএব, শপিং মল। আইডিয়াটি অভিনেতা-বন্ধুরই। তাছাড়া, বিগত এক-দুইদশকে বাঙালীজীবনে আধুনিকতার মহৎ প্রসার ঘটার দরুণ, সামনে একটু গেলাস না থাকলে বন্ধুরা আড্ডা মারতে পারেননা, অথবা সুরাহীন আবহে কথাবার্তা বলতে থাকলেও তা আড্ডা বলে মেনে নিতে পারেন না। কাজেই, একটি শপিং মলের বারেই মিলিত হচ্ছেন আজ সেই তিন বন্ধু।

প্রথমেই একটু খটাখটি হয়ে যাচ্ছিলো। ডাক্তার বা অভিনেতা, নিজের পয়সায় মদ্যপানের অভ্যেস এঁদের থাকে না বললেই চলে। কাজেই, বিল কে মেটাবে, শুরুতেই এই আলোচনায় গেট টুগেদার প্রায় ভেস্তে যাওয়ার যোগাড়। শেষ পর্যন্ত, সমান শেয়ারের সমাধানসূত্রে সবাই সম্মত হয়েছেন।

হ্যাঁ, আসুন, আলাপ করিয়ে দিই।

ওই যে, আটপৌরে পোশাকে, একটু সঙ্কুচিত, আসছেন বরুণ। স্কুলশিক্ষক। বিগত পঞ্চায়েতে গণতন্ত্রের অবাধ উৎসবের হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তারপর থেকেই রাত্রে ঘুম হয়না ভালো, মাঝেমধ্যেই চমকে চমকে ওঠেন। রামদেব-সদগুরু ইত্যাদি অনেক করেছেন, তাও স্ট্রেস কাটছেনা। তাছাড়া, যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মতোই, তিনিও সুখী মানুষ নন। 

বরুণের ডানদিকে তরুণ। পেশায় চিকিৎসক। স্যুটবুট পরিহিত। হাসপাতাল থেকে সোজা আসছেন। কাজেই, পুরোদস্তুর ফর্মাল পোষাকে। বরুণের চাইতে বছরপাঁচেকের বড়ো দেখতে লাগছে তরুণকে, যদিও দুজনে সেই নার্সারি থেকেই সহপাঠী।

আর, ওই যে অরুণ। অভিনেতা। আলাপ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, আশাকরি। যুগপুরুষ আশারাম সিরিয়ালে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। তাছাড়াও সন্ধ্যের দিকে টিভির বিতর্কসভায় প্রায়শই হাজির থাকেন। আজ পরণে জিন্স-টিশার্ট। চোখে সানগ্লাস। সানগ্লাসের ওপার থেকেই নজর রাখছেন, সবাই তাঁকে চিনতে পারছেন তো!!

আমি বুঝতে পারছি, আপনি উশখুশ করছেন। ভাবছেন, আজ আমি আর কতোক্ষণ হ্যাজাবো। অথবা, আপনি অলরেডি লাইক দিয়ে পরের পোস্ট চলেই গ্যাছেন।

তাই, চলুন, একটু ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে এগিয়েই যাই।

আপাতত, এখন তিনজনেরই নেশার পারদ চড়েছে। সামান্য কথাতেই বেশী হেসে উঠছেন প্রত্যেকেই। তাঁদের কথোপকথন যদি তাঁদের মুখের ভাষায় দিতে যাই, তাহলে আমার বর্তমান ফ্রেন্ডলিস্টের আদ্ধেক বন্ধুবান্ধবী আমার লেখা পড়া ছেড়ে দেবেন। কাজেই, প্লীজ, একটু এডিটেড ভার্সানেই খুশী থাকুন।

তিনজনের মধ্যে বরুণের মুখের হাসিটা যেন ততো উজ্জ্বল নয়। সে একটু যেন সঙ্কুচিত। বন্ধুদের চোখ এড়ায় না সেটা। তাদের বিস্তর চাপাচাপিতে, নাকি সুরার নেশায়, অবশেষে, সে মুখ খোলে।

"শোন, একটা বড়ো আঘাত পেয়েছি। না, তোরা যেমন ভাবছিস, তেমন কিছু নয়। প্রেমটেম কিছু নয়। বরুণাকে আমি এখনও তেমনই ভালোবাসি, যেমন বাসতাম প্রথম আলাপের সময়। ছেলেটাও আমার চোখের মণি। কাজেই…..

"আসলে, হয়তো, আমারই ভুল। পড়ানোটাকে আমি কখনোই চাকরি ভাবিনি। ভাবতাম, আমরা, মানে শিক্ষকেরা জাতির মেরুদন্ড। ভাবতাম, সমাজে আমাদের রোল একটা আলাদা ধরণের। আমাদের দায়িত্ব অনেক।

"কিন্তু……

"একদিন, একটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে আমার ধারণা বদলে গ্যাছে। আর, সেই বদলটার সাথে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিনা।

"বিয়েবাড়ি। পাশের টেবিলের আলোচনা কানে আসছিলো। জানিসই তো, মফস্বলের একটি স্কুলে আমি পড়াই।

"প্রথমজন বললো, জানিস তো, অমুক গ্রামের মাস্টারটা বিষ খেয়েছে। আমি বুঝলাম, রমেশের কথা হচ্ছে। হ্যাঁ, রমেশ। পাশের গ্রামের স্কুলে পড়ায়। একই সাথে জয়েন করেছিলাম চাকরিতে। খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও বেশ ভালোভাবেই চিনতাম। পঞ্চায়েত ভোটের ডিউটি পরবর্তী চাপ-অপমান অসহ্য হওয়ায় রমেশ বিষ খেয়েছে শুনেছিলাম। কাজেই, বলতে লজ্জা নেই, একটু কান পেতেই আলোচনা শুনছিলাম।

"একজন, শুনি, বলছে, শালা টিচারটা মরেছে, বেশ হয়েছে। কোনো কম্মের নয়। আমার ভাইটা টেট-এর জন্যে দশ লাখ লাগিয়ে বসে আছে। চাকরিটা হচ্ছে না। এরকম দুদশটা মরলে যদি কিছু হয়। না, রমেশ এখনো মারা যায়নি। কিন্তু, এমন শুভেচ্ছা বর্ষণে চমৎকৃত হলাম 

"পাশের লোকটা সেই সুরেই বললো, আরে, এই সব টিচারগুলোই হারামী। ইস্কুলে পড়ায় না, পরীক্ষায় নম্বর দেয়না, খালি টিউশনির ধান্দা। জানোয়ার একটা। ওই যে একটা মাল মরলো না ভোটের বাজারে রেললাইনের ধারে, ওইরকম করে শালারা ইঁদুরের মতো মরলে তবে ঠিক হয়।"

"আরেকজন বললো, আমাদের সময় যেসব টিচার ছিলেন, দেবতুল্য মানুষ সব। এগুলো তো শিক্ষক নামের কলঙ্ক। পড়ানোর নাম নেই, কাজে নিষ্ঠা নেই, খালি পয়সার নেশা আর ডিএ বাড়ানোর আন্দোলন। অপদার্থ সব।"

"দ্যাখ, আগেই বললাম, রমেশকে আমি চিনি বহুবছর। ছাত্র-অন্তপ্রাণ। স্কুল আর ছাত্র, এর বাইরে ভাবতেই পারতোনা। সিধে মেরুদন্ড। কোনো রাজনৈতিক নেতাকেই তোয়াক্কা করতো না। স্কুলের পরেও বস্তিতে গিয়ে গরীব বাচ্চাদের পড়াতো নিয়মিত।

"ভাব একবার, তাকে নিয়ে এমন কথা!!! এই অবস্থাতেও, তাকে নিয়ে এই অনর্গল বাজে কথায়, কেউ এতোটুকু প্রতিবাদ করছে না!! তাহলে, আমার পেছনে কী বলবে?"

অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে, বরুণ একটু থামতেই, নাকি থামার আগেই, কথা শুরু করে তরুণ।

"আরে, ছাড়। তোর তো অন্য লোকের গল্প। আমার নিজের অভিজ্ঞতা শোন।

"খুড়তুতো-জ্যেঠতুতো-পিসতুতো ভাইয়েরা সবাই মিলে গ্রুপ পিকনিক। হইহই ব্যাপার। আমবাগানে। পুকুরের পাড়ে।

" যেমন হয়, ছুটির দিনে আরো অনেক পার্টি একই ভেনুতে হইচই করছে, বাচ্চারা খেলছে।

"আমরা ভাইয়েরা, যেমন হয়, বোতল খুলে বসেছি। আর, যেমন হয়, সাড়ে এগারোটার মধ্যেই আমি আউট। একটু নাটক করার জন্যে, অরুণ, জানিসই তো, শুধু তুইই নোস, আমারও নাম আছে।

"তা সেইদিন, নৌটঙ্কি করার জন্যে, গিয়ে দাঁড়িয়েছি এক্কেবারে পুকুরের পাড়ে। আর, একেবারে শোলের ধর্মেন্দ্রর স্টাইলে বলতে শুরু করেছি, গাঁওয়ালোঁ, আজ এইখানে আমি যদি পুকুরে পড়ে যাই, তাহলে, দেশ হারাবে এক উদীয়মান প্রতিশ্রুতিবান ডাক্তারকে।

"কথা শেষ হওয়ার আগেই, মাইরি, বললে বিশ্বাস করবি না, দৌড়ে এলো একটা অপরিচিত ছেলে। বোধহয় অন্য কোনো পিকনিক পার্টি থেকেই। মুখে খিস্তি। খানকির ছেলে ডাক্তার, শালা তোদের মরাই ভালো। বলে এক ধাক্কায় আমাকে ফেলে দিলো পুকুরের মধ্যে। 

"সত্যি বলছি, মেজদা টাইম করে ঝাঁপিয়ে না বাঁচালে আমি এতোদিনে ছবি বিশ্বাস হয়ে যেতাম।

" আরো খারাপ লাগে ভাবলে, ছেলেটাকে কেউ তেমন করে কিছু করলো না। অনেকেই বললো, ছেলেটি নাকি পরিষ্কার মনের। অন্যের বিপদে আপদে ঝঁপিয়ে পড়া নাকি ওর অভ্যেস। অসুস্থ মানুষের জন্যে টাটা ভেলোর দৌড়ানোয় ওর জুড়ি মেলা ভার। ভীষণ পরোপকারী নাকি ছেলেটি। এখানকার ডাক্তারদের চেহারা জানতে ওর কিছু বাকি নেই। আজ একটু মালফাল খেয়ে হয়তো বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, কিন্তু ইত্যাদি ইত্যাদি।"

গল্প বলতে বলতে, তরুণ শিউরে উঠলো।

দুজনের কথার শেষে, একটু অবশ্যম্ভাবী নীরবতা।

অরুণ গলাখাঁকারি দেয়। কথা শুরু করে।

"আমি তোদের দুজনেরই মানসিক সিচ্যুয়েশান বুঝি। এও বুঝি, তোরা মানুষের উপর বিশ্বাস হারাচ্ছিস। কিন্তু, দ্যাখ, বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।"

অরুণের এই উচ্চাঙ্গের বাণী-কন্ঠস্বর-বাচনভঙ্গির সাথে, সান্ধ্য টিভির সুবাদে, কেউই অপরিচিত নয়। তাই, দুজনের কেউই, বিদ্যাসাগরের ব্যাপারটা শুধরোতে যায় না। তাছাড়া, আশেপাশের টেবিল থেকে, বেশ কয়েকটি উৎসুক মুখ উঁকিঝুঁকি মারছে, সেইটাও ব্যাপার।

ঈষৎ জড়ানো গলায়, অরুণ চালিয়ে যায় - 

"না, অভিজ্ঞতাটা সরাসরি আমার নয়। তবে আমি সেখানে ছিলাম। ঘটনাটা তোদেরও মনে থাকতে পারে, কেননা মিডিয়া খুব কভার করেছিলো।

"হ্যাঁ, আমি বুবুদা আর পর্ণাদির ঘটনাটা বলছি। জানিসই তো, বুবুদা-পর্ণাদির মধ্যে একটা ইন্টুসিন্টু ছিলো। তার কতোটা সত্যি, আর কতোটা সিনেমার পাবলিসিটির জন্যে, আমিও জানি না পুরোপুরি।

"তা সেইসময় জয়তু বাবা শিবনাথ বইয়ের শ্যুটিং চলছে। সেই হিট গানটা। ড্রিম সিকোয়েন্স। আইটেম নাম্বার টাইপের। বল বল বলরে কোকিল, তুইই হবি আমার উকিল। চারবারেও শট ওকে হয়নি। বুবুদার মটকা গরম। পর্ণাদির সাথে জোর খ্যাঁচাখেঁচি লেগে গ্যাছে। প্রায় কাঁচা খিস্তাখিস্তির যোগাড়। জানিসই তো, পর্ণাদি রাগলে পুরো কর্পোরেশনের ড্রেন।

"এইসব ঝগড়া-ঝামের সময়, কী করে কেউই দ্যাখেনি ঠিক, বুবুদা গ্যাছে লেকের মধ্যে পড়ে। অমনি, কী বলবো মাইরি, শ্যুটিং দেখতে আসা পাব্লিক, মিডিয়ার লোক সব্বাই মিলে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। সে কী সীন, বলে বোঝাতে পারবোনা।

"মিডিয়ার মধ্যে যারা ঝাঁপিয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন আবার সাঁতার জানতো না। পিওর আবেগের বশে ঝাঁপিয়েছে। মিডিয়ার মাল তো জানিস, ঝাঁপাবে আগে, তলিয়ে দেখবে পরে। দুজন আবার ক্যামেরা নিয়েই ঝাঁপিয়েছে। সে এক কেলো মাইরি।

"এদিকে, বুবুদা তো ডুবসাঁতারে এক্সপার্ট। ও তো এইসব সীন দেখে ডুব দিয়ে উল্টোপারে উঠেছে। কিন্তু, বাকি মালগুলো সব জলটল খেয়ে একাকার।

" তো সেইদিন দেখলাম, মানুষের আবেগ ভালোবাসা কী জিনিস। আর, একটা বড়ো শিক্ষা পেলাম। তুমি যদি মানুষের জন্যে কাজ করো, মানুষের কাছে থাকো, মানুষের পাশে থাকো, মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে। তোমার জন্যে জান লড়িয়ে দেবে।

"ওইটাই বড়ো ব্যাপার ভাই। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া।"

এরপরে আর কথা চলে না।

সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতও বাড়ছে। 

অরুণকে চিনতে পেরে, তার এই অনির্বচনীয় কাহিনী শুনে, টেবিলের চারপাশে বেশকিছু সুবেশ-সুবেশার ভিড়ও জমেছে। রেস্তোরাঁর পেপার-ন্যাপকিন বাড়িয়েও দিচ্ছে কয়েকজন, সইয়ের আশায়। লাজুক মুখে অরুণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

তরুণ আর বরুণ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বাইরে তখন নীলসাদা আলোয় ধোয়া এক উন্নততর রাত্রি। হোর্ডিং-প্ল্যাকার্ড অথবা মানুষের মুখ, সব্বার মুখে হাসি ছাড়া অন্যকিছুই দৃশ্যমান নয়।

বাড়ির পথে যেতে যেতে, দুজনের মনেই ঘুরতে থাকে অরুণের কথাগুলো।

আর, হঠাৎই মনে হয়, যাঃ, একদম ভুল হয়ে গিয়েছে দুজনেরই। জিজ্ঞেস করা হলো না তো, ঠিক কী করলে মানুষের পাশে থাকা হয়!! ঠিক কেমনভাবে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়!!!

অভিনয়, শুধু অভিনয় আর জৌলুশই কি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর একমাত্র পথ?

শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮

অসুস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ~ বিষান বসু

তিনটে ঘটনা। গত এক সপ্তাহের মধ্যেই।

১. কলকাতা থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে। উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ। প্রাইমারী হেলথ সেন্টার। ডাক্তার আছেন। আর বিশেষ কিছু নেই। হার্ট এট্যাকের জটিল রোগীর চিকিৎসা সম্ভব কিনা সেখানে, বুঝতে ডাক্তারি পড়তে হয় না। এমন এক রোগী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এলে, চিকিৎসক রেফার করেন সরকারি সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। রোগী সেইখানে পৌঁছানোর আগেই মারা যান। পরিজন চড়াও হন চিকিৎসকের উপর। নৃশংস মার। লাথিঘুঁষি। এমনকি, ধাতব টেবিল দিয়েও। ডাক্তারবাবু, নিজেই, সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি।

২. খাস কলকাতা। ঢাকুরিয়া আমরি হাসপাতাল। ক্রনিক এলকোহলিক এক যুবক। বয়স কুড়ির কোঠায়। অত্যধিক মদ্যপানজনিত প্যানক্রিয়াটাইটিস। সাথে মাল্টি-অরগ্যান ফেইলিওর। অনেক চিকিৎসার শেষে রোগীর মৃত্যু। পরিজন বিক্ষুব্ধ। ডাক্তাররা খুনী। গ্রেফতার চাই, সম্ভব হলে যাবজ্জীবন বা ফাঁসি। প্রকাশ্য রাজনৈতিক মদতে চলতে থাকে অবরোধ। চিকিৎসকেরা হাসপাতাল থেকে বেরোতে পারেন না অনেক রাত্রি অবধি। পুলিশ-র‍্যাফ নীরব দর্শক।

৩. ভার্চুয়াল দুনিয়া। ফেসবুকে। একটি ছবি। ঝাঁচকচকে এক করিডোর। বসার জায়গা। কেউ বসে নেই অবশ্য। জনশূন্য সেই সুদর্শন করিডোরের নীচে ক্যাপশন। না, বিদেশ নয়, এয়ারপোর্টও নয়। বনগাঁর সরকারি হাসপাতালের ছবি এটি। একজন আবার অত্যুৎসাহী হয়ে, শঙখ ঘোষের লাইন বদলে, লিখে ফেলেন, "দেখ খুলে তোর ত্রিনয়ন/ রাস্তাঘাটে, হাসপাতালে, দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন"। অবশ্য, উন্নয়ন যে রাস্তাঘাট পার হয়ে হাসপাতালে ঢুকে পড়েছে, এই নিয়ে, বোধ হয়, সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকেরা দ্বিমত হবেন না। কিন্তু, থাক সে কথা।

তিনটে ঘটনা। আপাতবিচ্ছিন্ন। যোগসূত্রহীন।

কিন্তু, আসুন না, একটু গভীরে যাই।

শুধু ঝাঁচকচকে করিডোর দিয়ে হাসপাতাল হয় না। হলে ভালো হয় নিশ্চয়ই, কিন্তু, না হলেও চলে। আসল কথা, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। তার ব্যবস্থা কতোটুকু?

চকচকে সুপারস্পেশ্যালিটির গল্পের পর অনেক বছর পার হলো। সুপারস্পেশ্যালিস্ট মিললো কি? ডাক্তার ছাড়াই অত্যাধুনিক চিকিৎসা!! উন্নয়নে বিশ্বাসী হলেও, এতোটা হজম হবে কি?

কিন্তু, ডাক্তার নেই কেন?

উলটো প্রশ্ন করি? ডাক্তার থাকবে কেন?

সরকারি চাকরিতে সুযোগসুবিধা, এখন, নামমাত্র। থাকার ব্যবস্থা প্রায় নেই। হাসপাতালের পরিকাঠামো নড়বড়ে। বিল্ডিং নয়, বাকি যন্ত্রপাতি-ওষুধ এইসবের কথা বলছি। যন্ত্র থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। আর নিরাপত্তা? হাসাবেন না, প্লীজ।

মাইনে? মহারাষ্ট্র সরকার, প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তার নিয়োগের জন্যে মাসিক তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত বেতন ধার্য করেছেন। এখানে, মেরেকেটে পঞ্চাশ হাজার। এমডি-ডিএম করার শেষে এই মাসমাইনেতে ডাক্তার পাওয়া তো স্রেফ আকাশকুসুম।

এরপরেও ডাক্তাররা সরকারি চাকরি করতে চাইতেন। কেননা, অনেকেই, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, সনাতন আদর্শে উদবুদ্ধ হয়ে ডাক্তারিটা করতে চাইতেন। আর, এখনো চান। হ্যাঁ, বিশ্বাস করুন, লাখ-লাখ টাকা উপার্জনের লোভে, বা হীরের চচ্চড়ি খাওয়ার আশায় সবাই এলাইনে আসেন না। কিন্তু, বর্তমানে, স্বাস্থ্যআমলাদের আশ্চর্য তুঘলকি সিদ্ধান্তে, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারি কঠিন হয়ে উঠেছে। সাথে সাথে রয়েছে কিছু লুম্পেননেতার দাদাগিরি। সম্মান আর সরকারি ডাক্তারি, প্রায় পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আর, সরকারি চাকরিতে উচ্চশিক্ষার যে সুযোগ বা অধিকার ছিলো, সরকারবাহাদুর তার সঙ্কুচনে চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। তারসাথে, চাকরি ছাড়তে চাইলে আবেদন প্রত্যাখ্যান, সঙ্গে এতোবছর চাকরির সুযোগসুবিধে হারানো।

অতএব, সরকার বিজ্ঞাপন দিয়েও ডাক্তার পাচ্ছেন না।

সমস্যাটা, বা অসন্তোষের কারণ, সরকার জানেন না, এমন নয়। কিন্তু, তাঁরা ভোট চান, ভোটের জন্য অর্থ চান। সমাধান নয়।

প্রথম, ভোট। ডাক্তারেরা সংখ্যায় হাতেগোনা। ভোটের হিসেবে তাঁদের না আনলেও চলে। কিন্তু, স্বাস্থ্যপরিষেবায় সরকার সচেষ্ট নন, এই বার্তা গেলে, ভোটের রাজনীতিতে বিপদ আছে। তাই, চকচকে বিল্ডিং, নিত্যনতুন শিলান্যাস। সাথে ফাটা রেকর্ড। চেষ্টা করেও ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। মিডিয়াও এই মেসেজই প্রচার করে চলেছে। স্বভাবতই, মানুষের কাছে বার্তা যাচ্ছে, সরকার চাইলেও, ডাক্তারদের অনুৎসাহের কারণেই সদিচ্ছা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ক্ষোভের অভিমুখ সেই চিকিৎসকের প্রতি।

দ্বিতীয়ত, পার্টি ফান্ড। ভোটের খরচ। না, এখানে হিসেবটা ততোখানি সরলরৈখিক নয়। বোঝানোর চেষ্টা করি তাও। মানুষের অসুখবিসুখ তো হবেই। হাসপাতালে যেতে হবেই। বিশেষত, এমন দেশ, যেখানে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বা রোগপ্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ প্রায় নেই। তা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মানুষ চিকিৎসা চাইবেন না, এমন তো নয়। অতএব, লাভ কার? আজ্ঞে হ্যাঁ, বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবসায়ীদের।

সব বেসরকারী পরিকাঠামো একই নয়। মফস্বল বা ছোটো শহরে বেশ কিছু ছোটো নার্সিং হোম আছে, যেখানে সাধ্যের মধ্যে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিলো, বা এখনও আছে। ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের প্যাঁচে ফেলে তাদের নাভিশ্বাস তোলার ব্যবস্থা হলো। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়েছেন। আবার, কিছু বৃহৎ বেসরকারী স্বাস্থ্য-কনগ্লোমারেট, জেলায় ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে, অধিগ্রহণের চেষ্টাও করছেন। কলকাতা শহরে চিকিৎসাব্যবস্থা, এখন, প্রায় পুরোপুরিই, কর্পোরেট দখলে। আগামী এক দশকে, জেলা শহরেও এই চিত্রই দেখা যাবে।

কাজেই, শেষ পর্যন্ত, জয় হোক কর্পোরেটের। এঁদের অশ্বমেধের ঘোড়া আটকায়, এমন বুকের পাটা কার!!

একটু ভেবে দেখুন, দশ বছর আগেও, বাবা-কাকা অসুস্থ হলে, আপনি ছুটতেন অমুক ডাক্তারবাবুর কাছে। রোগ জটিল হলে, অমুক নামী ডাক্তারের চেম্বারে। এখন কিন্তু, আপনি আর ডাক্তারের নাম খোঁজেন না, আপনি যান নামী হাসপাতালে। পার্থক্যটা কিন্তু অনেক।

হাসপাতালের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত চেম্বারে যে ডাক্তারবাবু আপনাকে দেখলেন, তিনিও জানেন, আপনি মোটেই তাঁর কাছে আসেন নি, এসেছেন সেই হাসপাতালের ভরসায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে আপনার সেই রোগীকে পাঠিয়েছেন মাত্র। তিনি যদি রোগীপরিজনকে সন্তুষ্ট ক্রেতা হিসেবে সার্ভিস না দিতে পারেন, তারসাথে হাসপাতালকে যথেষ্ট ব্যবসা দিতে না পারেন, তাহলে কিন্তু পরের বার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে পাঠাবেন, একই হাসপাতালে, পাশের চেম্বারে অপেক্ষারত ডাক্তারের কাছে। আবার, কোনো ডাক্তারবাবু, যদি নিজগুণে রোগীদের কাছে পছন্দের হয়ে ওঠেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ, সচেতনভাবেই, রোগীদের অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠাতে থাকেন। হ্যাঁ, ডাক্তারকে ইনসিকিওর রাখা বা ডাক্তারকে কখনোই হাসপাতালের ব্র‍্যান্ডের চেয়ে বড়ো হতে না দেওয়া, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রায় ঘোষিত নীতির মধ্যেই পড়ে।

মনে রাখবেন, এই কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে সবচেয়ে আদরের কর্মী কিন্তু কোনো ডাক্তার নন। এঁদের নয়নের মণি মার্কেটিং স্টাফ। অর্থাৎ, যাঁরা হাসপাতালে রোগীর জোগান অব্যাহত রাখেন। মার্কেটিং-এর অনেকেই ডাক্তারদের চাইতে অনেকটাই বেশী আয়ও করে থাকেন।

কিন্তু, সরকারের ভূমিকা এখানে কী?

এখনো বলে দিতে হবে? নাঃ, আপনি দেখছি একেবারেই নাদান!

এক, ডাক্তাররা যদি সরকারি চাকরিতে না যান, তাহলে যাবেন কোথায়? আইনের মারপ্যাঁচে ছোটো চেম্বারের দিন শেষ। অতএব, কর্পোরেট। দেশে ডাক্তারের ঘাটতি থাকলেও, কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের সামনে চাহিদার তুলনায় ডাক্তারের জোগান বেশী, মানে যেমনটি তাঁরা চান। ইনিসিকিওর ডাক্তারদের একাংশ আপোস করতে রাজিও থাকেন। কর্পোরেট ব্যবসার রমরমা এভাবেই।

দুই, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি ভেঙে পড়তে দিয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে রোগীর জোগান নিশ্চিত করা।

আর, এর পরে, সরকারবাহাদুর যদি হাসপাতাল চালাতে অপারগ হয়ে, পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ করার কথা বলেন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। টেনশন করবেন না, সুখের সেইদিন আর বেশী দূরে নয়।

এতো প্রাপ্তির শেষে, কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসায়ীরা যদি খুদকুঁড়ো ভরে দেন দলীয় তহবিলে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!!

হ্যাঁ, এরপরেও কর্পোরেট হাসপাতালে বিল দেখে অবস্থান-বিক্ষোভ চলবে। মিডিয়া ডেকে ক্যামেরার সামনে বেসরকারী হাসপাতালের কর্তাদের চমকানো চলবে। কেননা, পাছে চিকিৎসাব্যয়ে ঘটিবাটিবেচা মানুষের ক্ষোভ সরকারের পানে ধেয়ে আসে, সেই সম্ভাবনাটি অঙ্কুরেই বিনাশ করা। প্লাস, রুটিন ভেট আসার মাঝে এইটুকু ব্ল্যাকমেইলিং না হলে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে হাতখরচা আসবে কোত্থেকে!

আপনি হয়তো অতো ভেবে দেখেন না। খামোখা অতো ভাবতে আপনার বয়েই গ্যাছে।

কিন্তু, যদি একবার ভেবে দ্যাখেন।

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার প্যাঁদানোতে নির্বিকার থেকে, আপনি কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটিকেই ভেঙে পড়তে দিচ্ছেন।

আর, অন্যদিকে, কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কিন্তু লোকসানে চলে না। রাজনৈতিক দলের কাছে তোলা পৌঁছানো বা ভাঙচুরের পর মেরামতি, ঘুরপথে খরচ জোগান পরের রোগীরাই।

কেমন হবে, সেই পরের রোগীটি আপনাকেই হতে হয়?

রাজনীতির কারবারি আর স্বাস্থ্যব্যবসায়ী, তাঁদের কিন্তু সেটিং হয়েই আছে।

আপনার?

মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১৮

চা বাগানে ধর্মঘট ~ আর্কাদি গাইদার

বীরপাড়া টি এস্টেট: ৩২(৪৭)
গাংগুরাম টি এস্টেট: ২৩(৪৮)
ডিমডিমা টি এস্টেট: ৩৩(৫১)
মধু টী গার্ডেন: ৩৪(৫০)
রেড ব্যাংক টি গার্ডেন: ৩০(৫২)

প্রথম সংখ্যাটা হলো এই বাগানগুলোতে অভুক্ত থেকে অপুষ্টিতে কতজন চা শ্রমিক মারা গেছেন। ব্র‍্যাকেটে গড় বয়স। এগুলো স্রেফ কয়েকটা বাগানের হিসেব। 

২৭৩ - এটা হলো উত্তরবাংলার টি এস্টেটের সংখ্যা।

৩৫১ - মূখ্যমন্ত্রী যে হুংকার দিয়েছেন উনি এক্ষুনি আসামে চলে যাবেন বাঙালীদের রক্ষা করতে, এই সংখ্যাটা সেই আসামের চা বাগানের নির্ধারিত দৈনিক মজুরী।

১৫৯ - এই সংখ্যাটা রাজ্যের একজন  চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরী।

১৭২ - লাগাতার আন্দোলনের পর রাজ্য সরকার মধ্যস্থতা করে এই সংখ্যাটা দৈনিক মজুরী নির্ধারিত করেছে।

২৩৯ - শ্রমিকরা যে দৈনিক মজুরীর দাবিতে আন্দোলন করছে।

২৪,০০,০০,০০০ - চা শ্রমিকদের ন্যায্য প্রফিডেন্ট ফান্ডের মূল্য যা সামগ্রিক ভাবে ৫৫ টা চা বাগানের মালিকরা ফাঁকি দিয়েছে।

২০১৬ - এটা হলো সেই সাল যবে থেকে সমস্ত চা বাগানে সরকারি রেশন ব্যাবস্থা বন্ধ।

৪ - এটা হলো তত বছরের সংখ্যা যত বছর ধরে বাগানগুলোয় গ্র‍্যাচুইটি বন্ধ।

৪ - এটা হলো উত্তরবাংলার সমস্ত চা বাগানের থেকে ধর্মঘটে সামিল হওয়া শ্রমিকদের লাখে সংখ্যা।

১৩ -  সরকার এত টাকা দৈনিক মজুরী বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

 ৮৫০০ - মূখ্যমন্ত্রীর পুরনো মাইনে।

২৭,০০১ - বিধানসভায় বিল পাশ করিয়ে মাইনে বাড়ানোর পরে মূখ্যমন্ত্রীর নতুন মাইনে।

০ - এখনো অবধি টিভি চ্যানেলে এত মিনিটের কভারেজ দেওয়া হয়েছে এই ধর্মঘটকে।

০ - এখনো অবধি চা শ্রমিকদের নিয়ে কলকাতায় বিকেলের চায়ে চুমুক দিতে দিতে এত মিনিট কেউ মাথা ঘামিয়েছেন।

ওহা! ওস্তাদ তাজ বলিয়ে ~ তাপস দাস

তাজমহলের সামনে ওস্তাদ জাকির হুসেন বলতেন-"ওহা! ওস্তাদ ওহা! তাজ বলিয়ে।" বাড়িতে আপ্যায়ন মানেই চা। চা মানেই বাগান। রোমান্টিক আনাগোনা । বাগান মানেই কুলি কামিন। সাগিনা মাহাতো। চা বাগান মানেই লক আউট। গলা চিরে চিৎকার- " দিনু পরছ্ । দিনু পরছ্ । হুনদই ন। হুনদই ন। মিনিমাম ওয়েজ দিনু পরছ্।

সারে চার লক্ষ শ্রমিক। প্রায় কুড়ি থেকে পঁচিশ লক্ষ পেটের পরিবার। ২৭৮টি বাগান। উত্তরবঙ্গ। ২০১৬ সালে গত ১০০ বছর থেকে চলতে থাকা রেশন বন্ধ করেছে সরকার। এমন কোন বাগান নেই যেখানে বিদ্যুৎ. লকড়ি, বিজলি,স্বাস্থ্য শিক্ষা কোনটার দায়িত্ব পালন করছে সরকার । ২০১৪ সালে শেষ ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী ১৩২ টাকা দৈনিক মজুরি। মাজাক আর কি! ১৭ তে চুক্তি শেষ। শ্রমিকেরা মেনে নেয় নি। ২০১৪ সালে থেকে চলছে জয়েন্ট ফোরামের নেতৃত্বে আন্দোলন । ২০১৮ সালে ২৩ শে জুলাই থেকে ছিল শ্রমিকদের ঘোষিত বাগান ধর্মঘট। শ্রমিকেরা থেমে যায়। সরকার অনুরোধ করে। শ্রমিক সরকারকে সময় দেয় ৩০শে জুলাই পর্যন্ত। রাজ্যে যে উন্নয়নের সরকার চলছে, মিটিং হবে উত্তর কন্যায়।

৬ই আগস্ট। আজ ছিল ত্রিপাক্ষিক বৈঠক, শিলিগুড়ির সাধের উত্তর কন্যায়। নজিরবিহীন ভাবে এই প্রথমবার কোন সরকার শ্রমিকদের সাথে কোন আলোচনা না করে করেই একতরফা ১৭২ টাকা দৈনিক মজুরি ঘোষণা করে, কোন রকম আলোচনা, সৌজন্য না দেখিয়েই, একতরফা ভাবে ত্রিপাক্ষিক সভা ভেঙ্গে চলে যায়। অতীতে যা কখনও হয়নি, কোন সরকারের আমলে। 

তাহলে এবার শ্রমিকেরা কী করবে ? জয়েন্ট ফোরাম কী করবে? ঘরে ফিরবে ? সহ্যের একটা সীমা থাকে।

না। উত্তর কন্যায় অবস্থান চলছে। চলবে। চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত, সরকার আবার ত্রিপাক্ষিক সভা পুনরায় ডেকে শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসা পর্যন্ত। ততক্ষণ পর্যন্ত । অনির্দিষ্ট কালের জন্য। পেটের টানে লাগাতার আন্দোলন।

বাগানে বাগানে ধর্মঘট।

বাগানের হাজারে হাজারে কুলি কামিন, শ্রমিক মার্চ করবে উত্তর কন্যা শিলিগুড়ির দিকে।

বাকিটা ইতিহাস বলবে। খালি পেট থেকে দলা পাকানো বেরিয়ে আসা স্লোগান বলবে।

P. S উত্তরকন্যার গেট বন্ধ করে দিয়ে খাবার জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ভিতরে আটকে রয়েছে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে গিয়ে অবস্থান শুরু করা চা শ্রমিক নেতৃত্ব। পুরো ফ্যাসিস্ট কায়দায় আটকে ফেলা হল সব নেতৃত্বকে। কাউকে বার হতে দেওয়া হচ্ছেনা। খাবার, জল সরবরাহের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জীবন জীবিকার যুদ্ধে চা শ্রমিকদের পক্ষ নিন। রুটি রুজির লড়াইয়ের পক্ষ নিন।

প্রশ্ন কোরোনা ~ আর্যতীর্থ

( আবার রোগীর মৃত্যুতে তান্ডব রায়গঞ্জের হেমতাবাদ প্রাথমিক সাস্থ্যকেন্দ্রে!)




ও কেন মারেনি প্রশ্ন কোরোনা, সিলেবাসে মার ছিলো না,
রোগী দেখে রোজ গাল খেতে হবে, এই জ্ঞান তার ছিলোনা।
অথচ এ দেশে সবচেয়ে যদি অকুলান কোনো পেশা হয়,
সেটা ডাক্তার, দিন চলে যায় জীবন ও জীবিকা মেশানোয়।

অদ্ভূত দেখো, কোটি মামলার যেখানে পাহাড় জমেছে,
সেখানে উকিলি স্ট্রাইকের চোটে কেজো দিনগুলো কমেছে
মৌন সেখানে সব আদালত, লাভ নেই ফরিয়াদে,
মুখরতা শুধু ফিরে আসে ঠোঁটে ডাক্তারী প্রতিবাদে।

এক ডাক্তারে রোগী সামলায় এগারো হাজার করে,
( উচিত হাজারে একজন থাকা , 'হু' য়ের হিসেব ধরে।)
ক্লান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসলে, বিশ্রাম নেওয়া মানা,
পান থেকে চুন খসলে কি হবে বহুকাল থেকে জানা।

ডাক্তার ধরে ফেসবুকে যারা গণপিটুনির পক্ষে,
অসুখবিসুখে তারা যায় কোথা জিজ্ঞেস করি লোককে।
পুজোপার্বণ ঝঞ্ঝাবাদল বাছো না যে কোনোদিন,
রোজ থেকে যায় স্টেথোদের কাছে কিছু জীবনের ঋণ।

আপনারা, যাঁরা ডাক্তার মেরে ফেরেন বীরের মতো,
কালিদাস হয়ে নিজেদেরই দেন আগামীকালের ক্ষত।
চিকিৎসা হলে ওষুধই কেবল হয়ে যেতো নেটে তবে, 
বাড়তি যেটুকু , এখন ভাগ্যে ক্রমে অকুলান হবে।

যাকে আজ তুমি দিলে বেধড়ক , সত্যি বা ফেসবুকে 
সে ছাড়াও আরো হাজার বৈদ্য খোলসে পড়লো ঢুকে।
যত বড় হও অমুক তমুক অথবা নেতার শিষ্য,
ইচ্ছেবিহীন চিকিৎসা জেনো ভিখারীর মতো নিঃস্ব।

ও কেন মারেনি প্রশ্ন কোরো না, সিলেবাসে সে তা শেখে নি,
অশ্রু বাঁচিও তাদের জন্য, আগামীকে যারা দেখেনি।

শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৮

কিসান সভার সংসদ অভিযান ~ সুশোভন পাত্র

৩০ মিনিটে কি হয়? ৩০ মিনিটে এদেশে ডমিনোসের চিজ বার্স্ট পিৎজার হোম ডেলিভারি হয়। ৩০ মিনিটে এদেশে আইপিএল'র পাওয়ার-প্লে তে 'মনোরঞ্জন কা বাপ' খোঁজা হয়। ৩০ মিনিটে এদেশে অ্যামাজন-মিন্ত্রা'র ফ্ল্যাশ সেলে ব্র্যান্ডেড পণ্যে ছাড় দেওয়া হয়। ৩০ মিনিটে এদেশে নিয়ম করে ইষ্টিকুটুমের ন্যাকামি পরিবেশন করা হয়। ৩০ মিনিটে এদেশে 'মন কি বাতে' গল্প দাদুর আসর জমানো হয়। আর প্রতি ৩০ মিনিটে, এদেশে একজন কৃষক কে আত্মহত্যা করতে হয়¹। 

এই যে আপনি-আমি, প্রতিদিন ডিজিটাল ইন্ডিয়া-বুলেট ট্রেনের গল্প শুনি, ছিমছাম ক্যান্ডেল লাইটে ডিনার সারি; এই যে আপনি-আমি নগর সভ্যতার ভিড় করা ইমারতে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখি, ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা শপিং মলে 'উন্নয়ন' খুঁজি, হ্যালোজেনের নিয়ন আলোয় ভিজে বিশ্বায়নের ইঁদুর দৌড়ে মাতি; ঠিক সেই হ্যালোজেনের ঘুপচি কোণের অন্ধকারেই বাস করে আরেকটা 'ইন্ডিয়া'। যে 'ইন্ডিয়া'র কৃষক'দের আজও 'মাইক্রো ফাইনান্সের' চক্রব্যূহে 'বউ বন্দক রেখে' ব্যাঙ্কে ঋণ নিতে হয়²। যে 'ইন্ডিয়া'র দলিত বৌ'দের আজও পানীয় জল জোগাড় করতে 'বেশ্যা' বৃত্তি করতে হয়³। আর যে 'ইন্ডিয়া' তে ১৯৯৫-২০১৩ অবধি ২,৯৬,৪৬৬ জন কৃষক কে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করতে হয়। 

এই ২,৯৬,৪৬৬ কৃষকের লাশ দিয়ে, ইডেন গার্ডেনস ৪.৫বার কানায় কানায় ভরিয়ে দেওয়া যায়। এই ২,৯৬,৪৬৬ কৃষকের লাশ দিয়ে ভারতবর্ষের প্রমাণ মাপের ট্রেন কে ২০০বার রিজার্ভড করা যায়। এই ২,৯৬,৪৬৬ কৃষকের লাশে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার এয়ারবাস কে ৬০০বার টেক-অফ করানো যায়⁴। অবশ্য বিজেপি সাংসদ গোপাল শেট্টি'রা বলেন, কৃষকের আত্মহত্যা স্রেফ নাকি 'ফ্যাশান'⁵! 

গোপাল শেট্টি'দের রিং-মাস্টার নরেন্দ্র মোদী ২০১৪'র নির্বাচনী প্রচারে বাড়ি বয়ে বলে গিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে কৃষক'দের আত্মহত্যার মিছিল থামিয়ে দেবেন। ২০০৬ থেকে নর্থ ব্লকের ডাস্টবিনে পড়ে থাকা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করবেন। শুধু বলেননি ওনার কাছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি গুলো আসলে চুইংগামের মত। 'যো চাবায়া অর ফেক দিয়া'। তাই গত সাড়ে চার বছরে অক্লান্ত বিদেশ সফরের মাঝে যে নরেন্দ্র মোদী কৃষক'দের জীবন যন্ত্রণার চার আনারও হিসেব রাখার ফুরসৎ পাননি; সেই নরেন্দ্র মোদীই আজ ২০১৯'র নির্বাচনী দামামা বাজতেই খরিফ শস্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য(MSP) বাড়ানোর আইওয়াশে বলছেন "প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, MSP বৃদ্ধি তে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে বিজেপি⁶।" 

ডিয়ার নরেন্দ্র মোদী, আপনি কি জানেন না যে, স্বামীনাথন কমিশন রিপোর্টে বলেছিল শুধুমাত্র সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, ডিজেল ইত্যাদির মোট ব্যয়(A2) এবং কৃষক পরিবারের মোট শ্রম(FL) যুক্ত করে ফসলের উৎপাদন খরচা নির্ধারণের মান্ধাতার আমলের যে ফর্মুলা সিএসিপি ব্যবহার করে তা যথেষ্ট নয়? আপনি কি জানেন না যে, এই ফর্মুলার সাথে জমির খাজনা লিজ এবং ঋণের খরচ যোগ করে উৎপাদন খরচা(C2) নির্ধারণ এবং তার উপর ৫০% লাভ রেখে MSP ধার্য করার কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছিল ঐ রিপোর্টেই? আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, A2+FL ফর্মুলায় ধানের উৎপাদন মূল্য ১,১৬৬টাকা/কুইন্টাল। যার উপর ৫০% লাভে MSP দাঁড়ায় ১৭৫০টাকা/কুইন্টাল। আর স্বামীনাথন কমিশনের(C2) ফর্মুলায় উৎপাদন মূল্যের উপর ৫০% লাভে MSP হওয়া উচিৎ ২৩৪০টাকা/কুইন্টাল। জনাব প্রধানমন্ত্রী, তাহলে পাটিগণিতের ঠিক কোন নিয়মে 'প্রতিশ্রুতি পূরণ' হল একটু বলবেন? বাস্তবে যখন দেশের মাত্র ৬% কৃষকের সরকার ঘোষিত MSP নসিব হয় তখন শুধু ঘোষণায় ঠিক কার লাভ হল একটু বলবেন? আর আজ আপনার ১৩% MSP বৃদ্ধি যদি 'ঐতিহাসিক পদক্ষেপ' হয়, তাহলে ২০০৮ ইউপিএ'র ৬৫% MSP বৃদ্ধির গিমিকটা ঠিক কি পদক্ষেপ ছিল একটু বলবেন⁷ ⁸?

গত চার বছরে ভারতবর্ষে কৃষিজ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ১.৮৬%। কৃষক'দের আয় বৃদ্ধির হার .৪৪%। ২০বছর আগে এনডিএ'র সময়েও মুখ থুবড়ে পড়েছিল গ্রামীণ অর্থনীতি। ১৯৯৮-২০০৪ কৃষিজ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল ১.৭৬% আর কৃষক'দের আয় বৃদ্ধির হার .৫৫%⁹। আন্তর্জাতিক সংস্থা OECD বলেছে, পৃথিবীর যে মাত্র ৩টি দেশে কৃষিকাজ লোকসানে চলছে তার অন্যতম ভারত¹⁰। বিজেপির ক্ষমতায়নের সাথে গ্রামীণ অর্থনীতির ধসের পুনরাবৃত্তি নেহাত কাকতালীয় নয়। আসলে, ধর্মের জিগিরের আড়ালে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারিগর সেদিন অটল বিহারি বাজপেয়ীও ছিলেন আজ নরেন্দ্র মোদীও আছেন। কৃষিতে বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা পরিষ্কার করে কৃষক'দের চিতা সেদিন লালকৃষ্ণ আদবানিও সাজাতেন আজ অমিত শাহও সাজান। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর দুর্ভাগ্য যে সেই চিতার আগুনই দাবানল হচ্ছে আজ। ২০১৪'তে যেখানে কৃষক বিক্ষোভের সংখ্যা ছিল ৬২৮, ২০১৬ তে সেটা ৮গুন বেড়ে ৪,৮৩৭⁹ ¹¹। আর তাই ভয় পেয়েই দশলাখি স্যুটের প্রধানমন্ত্রী এখন কৃষক'দের সান্তাক্লজ সেজে রাজ্যে রাজ্যে ছুটে বেড়াচ্ছেন ভোট ভিক্ষা করতে। 

ছুটুন প্রধানমন্ত্রী, ছুটুন। আপনি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী ছুটুন। আম্বানি-আদানি'দের চার্টার্ড বিমানে চেপে কৃষক দরদী সাজুন। প্রতিশ্রুতির প্যান্ডোরার বক্স হাতে নিয়ে ধাপ্পাবাজি করুন। আধপেটা খেয়ে থাকা ভারতবর্ষের চাষা গুলোর মধ্যে জাতপাতের ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করুন, ধর্মের বিষে শ্রমিক ঐক্য হিন্দু-মুসলিমে ভাঙ্গার চেষ্টা করুন। কারণ ঘৃণাই আপনার রাজনীতির ইউএসপি। ভাঙাই আপনার রাজনীতির কৌশল। আপনি বিলক্ষণ জানেন, যেদিন দেশের বঞ্চিত চাষা গুলো একসাথে বলবে 'কৃষক' আমার 'জাতি' আর 'চাষ'ই আমার 'ধর্ম', যেদিন শ্রমিকরা হিন্দু-মুসলিম ভুলে একসাথে তাঁদের রক্ত-ঘামের হিসেব কষবে, ঠিক সেদিনই আপনাদের সুবিধাবাদী রাজনীতির ভ্যালিডিটিও শেষ হয়ে যাবে। 
আর ভাঙ্গা-গড়ার এই লড়াইয়ে, আপনার 'শ্রেণীশত্রু' হিসেবে বিপক্ষে থাকবো আমরা। ঘৃণা ছড়ানোর কাজটা আপনি করুন ভালোবাসা দিয়ে বঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক ঐক্য গড়ে তুলব আমরা। বছর বছর বিগ-বিজনেস হাউসের কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়া গেলে দেশের কৃষক'দের ঋণ মকুব করা যাবে না কেন- ৯'ই আগস্ট জবাব চাইবো আমরা। ৫'ই সেপ্টেম্বর দিল্লীর রাজপথ শ্রমিক'দের রক্তভেজা লাল পতাকায় মুড়িয়ে দিয়ে শ্রমের ন্যায্য মূল্য চাইবো আমরা। ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, জাতের নয়; ভাতের লড়াইয়ে, হকের লড়াইয়ে আপনার নিশ্চিন্ত ঘুম উড়িয়ে দেব আমরা।











শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১৮

মহাকালের প্রহেলিকা - ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা ~ দীপক সেন


সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সরাইঘাটের * শেষ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেছেন । যারা এইসব কথা বলছিলেন, তাদের অনেককেই এন আর সি র দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশ হওয়ার পর মিষ্টিমুখ করতে দেখলাম। আমি তো ইতিহাসের ছাত্র নই, অত শত বুঝি না, বোধহয় ওরা বিজয়োৎসব করছেন। কিন্তু এন আর সি তো "লিস্ট অফ ইনক্লুশন" " লিস্ট অফ এক্সুলশন" নয়।  তাদের নাম থাকার আনন্দে উল্লাস না চল্লিশ লক্ষ নাম বাদ পড়ায় উল্লাস। আমি অত শত বুঝি না, শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে দেখি সব কিছু আর ক্ষুধিত পাষানের মেহের আলীকে মনে করি। 
         এই চল্লিশ লক্ষের মধ্যে কয়েক লক্ষ নাম আবার অন্তর্ভুক্ত হবে নিশ্চিত, কয়েক লক্ষের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা তাদের হাতে কোন কাগজের নথি নেই, আছে শরীরে পতিত জমি আবাদ করার সোঁদা গন্ধ। কয়েক সহস্র " বিদেশী " কে সনাক্ত করা যাবে যারা অর্থনীতির নিয়ম মেনে কাঁটাতার অতিক্রম করেছিলেন বাঁচার সংগ্রামে।
              আবহমান কালের প্রব্রাজনেই মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল বা হচ্ছে।আফ্রিকার ঘন জঙ্গলে থেকে হোমোসেমিন্স নামে যে প্রজাতি জন্ম নিয়েছিল বিবর্তনের সূত্র মেনে সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে এই প্রজাতি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগালিক পরিবেশে বর্ধিত বিকশিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে সমাজ দেশ রাষ্ট্র। সমাজ দিয়েছে অনুশাসন রাষ্ট্র দিয়েছে শাসন, সমাজ বানিয়েছে নিয়ম রাষ্ট্র বানিয়েছে আইন।
        কিন্তু এত সব আয়োজন তো মানবতার স্বার্থে। কিন্তু মানবতাকে অস্বীকার করে যদি কোন সমাজ বা রাষ্ট্র,তবে সমাজবিজ্ঞানের নিয়মে ঝড় উঠে তারপর আবার শান্ত হয়। নির্মল আকাশে আবার শুকতারা ধ্রুবতারা উজ্বল আলো দেয়। এমনি বহমান সভ্যতার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই উল্লাসের ঝড় বড় ক্ষণস্থায়ী। 
       অভিজিৎ নীলোৎপলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে যাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, হীমা দাসের গৌরবে যাদের বক্ষ স্ফীত হয়, পতিত জমি আবাদ করতে যাদের শরীর ঘর্মাক্ত হয়, শুধু কাগজের  নথির জন্য তাদের আবেগ ভালোবাসা মাটির মাকে সম্মান করা কোন স্বীকৃতি পাবে না? হে মহাভারত ভুলিও না অর্জুন তোমার একমাত্র বীর নয় একলব্যকে যতই ব্রাত্য কর স্বমহিমায় সে ভাস্বর। হে অর্জুন জননী কুন্তি তুমি কর্ণ কে যতই জলে ভাসাও নিয়তি তাকে ডেকে আনবেই, তোমার অর্জুনকে সে প্রত্যাহ্বান জানাবে , আবার তাচ্ছিল্যে তার প্রাণ ভিক্ষা দেবে। ইতিহাস শুধু বিজয়ীকে মনে রাখে না, ব্রাত্য একলব্যকেও সম্মান করে মনে রাখে।
           চল্লিশ লক্ষকে ব্রাত্য করার আনন্দে যদি কেউ মিস্টি মুখ করে থাক তবে তুমি রবীন্দ্রনাথের "গোরা" পড়নি, কেননা আমাদের আত্মপরিচয় বা জন্মপরিচয়ের ফানুশ  কখন চুপসে যাবে কেউ জানি না। যাদের কে শত্রু পক্ষে ঠেলে দিয়ে অস্ত্রে  শান দিচ্ছ ,যেদিন জানবে সে তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠী সেদিন কি করবে? গ্রীক মহাকাব্যের ট্র‍্যাজিক নায়কদের মত কৃপা ধন্য হবে। ওঅদিপাউসকে ভুলে যেওনা, ভুলে যেও না আউরঙ্গজেবের ছেলে মহম্মদকে। 
      সরাইঘাটের শেষ যুদ্ধের কথা বলছিলে না, তবে শোনো- মহম্মদ আলী জিন্না, কায়েদ ই আজম জিন্নার দুহিতা কোনদিন পাক সীমান্তের ওপারে পা রাখেননি, নেতাজী কন্যা এ দেশের নাগরিকত্ব নেননি। ভায়া, মহাকালের প্রহেলিকাকে মনে রেখ, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতাকে মনে রেখ। সামলে চল ভায়া।
* সরাইঘাটের যুদ্ধ--১৬৬৯ সালে মুঘল সেনাপতি রাজা রাম সিংহের সঙ্গে অহম রাজের সেনাপতি লাচিত বড়ফুকনের যুদ্ধ।
------------------------------------
লেখাটি অসম থেকে পাঠিয়েছেন দীপক সেন গুপ্ত।
১/০৮/২০১৮

অসম সমস্যা ~ শান্তনু দত্তচৌধুরী


   অসম ১৮২৬ সালে অহম রাজা ও আরাকান রাজা দের হাত থেকে ব্রিটিশ শাসনে আসে।তার আগের ইতিহাসে যাচ্ছিনা।ইংরেজরা প্রথমে এই রাজ্যটি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মধ্যে রেখেছিল।ওই সময় থেকে সরকারি কাজে নিয়োগের জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে শিক্ষিত বাঙালিদের(মূলত: হিন্দু)  আনা শুরু হয়।
        চা বাগান পত্তন হওয়ার পর ক্লারিকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রেও একই ধারা বজায় থাকে।অপর দিকে অসমের রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পূর্ব বাংলার কৃষকদের (মূলত:মুসলমান)নিয়ে এসে এককালীন ২ টাকা খোরাকি ভাতা দিয়ে বসানো শুরু হয়।অহম ও অন্য জনজাতি- গুলি অনগ্রসর জুম প্রথায় চাষ করতো।অসমের কৃষিকাজ  ও কৃষির বিকাশে এই বঙ্গভাষী কৃষকদের বিশেষ অবদান আছে।এইভাবে অসমে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।চা বাগানের শ্রমিকের কাজে নিয়ে আসা হয় বিহার(ঝাড়খন্ড),মধ্যপ্রদেশ
(ছত্রিশগড় ) থেকে আদিবাসীদের।
           ১৮৩৮ সালে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও অসমে অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ করা হয়।
            ১৮৭৩ সালে অসমকে পৃথক প্রদেশ করা হয়।এই সঙ্গে বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলাকে অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।বাংলা ও অসমের মধ্যে গভীর আদান প্রদান গড়ে ওঠে। অহম সমাজের মধ্য থেকে এই সময় আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন,হেমচন্দ্র বড়ুয়া,গনাভিরাম বড়ুয়ার মতন সংস্কারকরা বেরিয়ে আসেন।তাঁদের চেষ্টায় অসমিয়া ভাষাকে এই সময় অসমের অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ হিসাবে ঘোষণা করা হয়।পরবর্তী সময়ে বিংশ শতকে অসমিয়া ভাষার বিকাশে স্যার আশুতোষ মুখার্জি ও ভাষাচার্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভূত সহায়তা করেন।
           ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হবার পর স্বাধীনতা আন্দোলনে ক্রমশ অসমের জনসাধারণও অংশগ্রহণ করতে থাকে।১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও বিশেষ করে ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলনে অসমের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। শহিদ কনকলতা বড়ুয়া ও ভৃগুমনি ফুকনের বীরত্বগাথার কাহিনী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।কুশল কোনোয়ারের ফাঁসি হয়।দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন অসমে কংগ্রেস ছিল প্রধান রাজনৈতিক দল।কিন্তু কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে গড়ে উঠছিল তীব্র অসমীয়া জাত্যাভিমানি শক্তি,যারা মনে করতো এবং এখনো মনে করে বাঙালি ও বাংলা ভাষা অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেবে।

              এই উগ্র অসমীয়া শক্তির চাপে স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময় ১৯৪৭ এর অক্টোবরে  অসমের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদোলুই এক ছাত্র সমাবেশে বলেন 'নিঃসন্দেহে অসম অসমিয়াদের জন্য'।মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন 'অসম যদি হয় অসমিয়াদের জন্য তাহলে ভারতবর্ষটা কাদের জন্য'? 
            ৭ মে,১৯৪৯ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বরদলুই প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে চিঠি দিয়ে বলেন 'পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের অসমে পুনর্বাসন দিলে রাজ্যে জমির উপর চাপ বাড়বে'।১৮ মে এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী নেহরু জানান অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অসমে জমি অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্ব কম।তাই এখানেই অসমের সীমান্তবর্তী পূর্ববঙ্গের মানুষরা আসলে তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে।জমি বন্টনের ক্ষেত্রেও কেন্দ্র সরকার জানিয়ে দেয় স্থানীয় মানুষজন ও উদ্বাস্তুদের মধ্যে উদ্বৃত্ত খাস জমি ৫০:৫০ হারে বিলি করতে হবে।সমস্ত ক্ষেত্রেই পন্ডিত নেহরুর উদ্বাস্তুদের পক্ষে গৃহীত কড়া মনোভাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেল সমর্থন করেন।উদ্বাস্তু সরকারি কর্মচারীদের অসম সরকারে চাকরি দিলে স্থানীয়রা চাকরি পাবেনা শ্রী বরদলুই -এর এই বক্তব্যও নেহরু গ্রহণ করেননি।তাঁর যুক্তি ছিল এই কর্মচারীরা দেশভাগের জন্য যেখানে যাবেন সেই রাজ্যেই চাকরি পাবেন এটাই প্রতিশ্রুতি।আর তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়।যাই হোক এ সম্পর্কিত চিঠিপত্র প্রয়োজনে সবিস্তারে দেওয়া যাবে। 

                 হতাশ অসমীয়া উগ্রপন্থীরা প্রথম ১৯৫০ সালে বাঙালিদের ওপর প্রবল আক্রমন চালায়।কয়েক হাজার বাঙালি ব্রম্ভপুত্র উপত্বকা ছেড়ে পশ্চিম বাংলা ও বরাক উপত্যকায় আশ্রয় গ্রহণ করে।আবারও ১৯৬০সালে অসমীয়া জাত্যাভিমানি শক্তি বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করে।এদের চাপে অসম সরকার ১৯৬১ সালে বিধানসভায় রাজ্যভাষা বিল পাস করে যাতে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

            এরই বিরুদ্ধে বাংলাভাষীদের তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের ওপর ১৯ মে,১৯৬১ অসম রাইফেলস এর গুলি চালনা যার ফলে ১১ জন শহীদ হন।এর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ  হয়।এই গুলিচালনা সরকারের নীতি নয় বলা সত্বেও অসমের বিমলাপ্রসাদ চালিহার মন্ত্রিসভা তীব্র নিন্দার সম্মুক্ষীন হয়।সারা দেশে এর প্রভাব পড়ে।ওই সময়ে দুর্গাপুরে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে পন্ডিত নেহরু সহ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ কাছাড়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করেন।কেন্দ্র সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী অসমে যান। তিনি অসম সরকারকে জানান বরাক উপত্বকার জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিতে হবে।ফলে নূতন অধ্যাদেশ জারি করে বাংলা ভাষাকে বরাক উপত্যকার তিন জেলার প্রধান সরকারি ভাষা করা হয় যা এখনও জারি আছে।

             ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস সারা দেশের মতন অসমেও ক্ষমতা হারায়।ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টি।যার মধ্যে ছিল জনসংঘ(বিজেপি), সোসালিস্ট প্রভৃতি দল।এতদিনে অসমীয়া জাত্যাভিমানি শক্তি সম্পূর্ণ নিজেদের একটি সংগঠন পেলো।এই জনতা দলের জঠরেই জন্ম নিল অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন(আসু) এবং অসম গণ পরিষদ(অগপ)। এবং এদের নেতৃত্বে শুরু হল নতুন করে 'বঙ্গাল খ্যাদা'।ইন্ডিয়ান অয়েল-এর নবীন ইঞ্জিনিয়ার রবি মিত্রকে হত্যা করা হল।শুরু হল চূড়ান্ত অরাজক অবস্থা।

              জনতা দলের শিথিল শাসনে আসু ও অগপ'র লাগাতর আক্রমণে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে।সকলেই নাকি অনুপ্রবেশকারী।এই প্রচার এখনো চলছে।১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অসমের 'নেলি'তে এক ভয়াবহ আক্রমণে দুই সহস্রাধিক সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হয়।তখন ওখানে রাষ্ট্রপতির শাসন ছিল।আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা হয়।কিন্তু তা সত্বেও ১৯৮৩'র নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করে।হিতেস্বর সাইকিয়া মুখ্যমন্ত্রী হন।এই সুদক্ষ প্রশাসক ও সংগঠক এই অসমিয়া শভিনিস্টদের আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠেন।

             অসমে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত উদার মনোভাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি ১৯৮৬ সালে আসু'র সঙ্গে অসম চুক্তি সম্পাদন করেন।নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়।নতুন করে ১৯৮৬ তে নির্বাচন করার জন্য সাইকিয়া পদত্যাগ করেন।অগপ ক্ষমতায় আসে।কিন্তু এই সরকার তথাকথিত বিদেশি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়।১৯৯১ সালে পুনরায় নির্বাচনে হিতেস্বর সাইকিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে।১৯৯৬ সালে তাঁর মৃত্যু দেশের পক্ষে এক বিরাট ক্ষতি।তিনি কঠোর ভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দিয়ে অহম প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে পর্যুদস্ত করেছিলেন।পরবর্তী কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈও অসমে শান্তি শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় - ভাষিক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বজায় রেখেছিলেন।তাঁদের শাসনামলেই শিলচরে 
অসম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ,মেডিক্যাল কলেজ ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি স্থাপিত হয়।
           ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি প্রচার চালান ক্ষমতায় এলে তাঁরা সব বিদেশিকে (পড়ুন মুসলমান) বিতারণ করবেন, ছিটমহল বিনিময় হতে দেবেন না ইত্যাদি।বিজেপি ভালো ফল করে।ক্ষমতায় এসে কিন্তু মোদিকে ছিটমহল বিনিময় করতে হয়েছে।২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অসমে বিজেপি,অগপ ও বোরো উগ্রপন্থীদের রামধনু জোট ক্ষমতায় এসেছে।বদরুদ্দীন আজমলের ইউডিএফ বাঙালি মুসলমানদের দল।এরা বহু আসনে প্রার্থী দেয়। কংগ্রেসের সঙ্গে ভোট বিভাজনের ফলে ওই বিজেপি জোট জয়লাভ করে।বাঙালি হিন্দুদের এক বড় অংশ বিজেপির প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে ওই রামধনু জোটকে ভোট দেয়।তারা ভেবেছিল নাগরিকত্বের প্রশ্নে হিন্দু বলে তারা রক্ষা পাবে। কিন্তু পরিস্থিতি ভয়াবহ।সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ চলছে তার প্রাথমিক তালিকায় তিনপুরুষের বাসিন্দাদের নামও বাদ পড়েছে।অসমীয়া জাত্যাভিমানীদের মতে বাংলাভাষী মানেই অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশি।এদের মতে ১৯৭১ সালকে যে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে তা আইন নয়,একটি গেজেট নোটিফিকেশন মাত্র।সংবিধান যেদিন গৃহীত হয়েছে সেদিন (১৯৪৯ এর ২৬ নভেম্বর)যারা এই ভূখণ্ডে ছিলেন তারা বা তাদের বংশধররা নাগরিক, এটাই আইন। 
            কার্যত নাগরিক পঞ্জিকরণ আদৌ ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে হচ্ছে না।জমির দলিল,পূর্বপুরুষের ১৯৫১ সালের ভোটের লিস্টে নাম আছে কি না, আবেদনকারী প্রকৃতই বংশধর কি না,বার্থ সার্টিফিকেট(সেটিও আবার জন্মানো মাত্র সংগৃহিত হতে হবে,পরে সংগৃহিত হলে হবে না) এরকম নানা শর্তাবলী।

            এখন মোদি সরকার আরএসএস এর পরামর্শে ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ (সংশোধনী)বিল এনে বাঙালিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজনের কৌশল এনেছে।এই বিলে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের আগে প্রতিবেশী দেশগুলি অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা,বাংলাদেশ,পাকিস্তান, আফগানিস্তান,মায়ানমার থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক হিংসার কারণে যেসব হিন্দু , বৌদ্ধ , শিখ,জৈন, খৃস্টান ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা নাগরিকত্ব পাবে ,কিন্তু কোনো মুসলমান পাবেনা।প্রথমত এই আইন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী ,দ্বিতীয়ত ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব ভারতীয় সংবিধান বিরোধী।

               এবার বিজেপির জোটসঙ্গী অগপ , বোরো ও অন্যান্য গোষ্ঠী জানিয়ে দিয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেবার চেষ্টা হলে তারা জোট ত্যাগ করবে।মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও বলেছেন তিনিও এই বিল মানবেননা ও প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন।এদের বক্তব্য, এই বিল এর দ্বারা অনুপ্রবেশকারী হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব ও বৈধতা দেওয়া হবে।এর ফলে অসমীয়ারা চিরতরে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে।

            এই পরিস্থিতিতে ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় অসমের বাঙালিদের ভাষাভিত্তিক পরিচয় পাল্টে অসমীয়া হবার পরামর্শ দিয়েছেন। এরকম পরামর্শ পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে বঙ্গভাষীদের দিয়ে বলেছিল তোমরা উর্দু ভাষাকে তোমাদের মাতৃভাষা বলে গ্রহণ কর।
           এবার অসম সরকার ২৫ বৈশাখ কবিগুরুর জন্মদিনে স্কুল ,কলেজে ছুটি দেয়নিIগত বছরও এই সিধ্যান্ত নিয়ে পরে তা বাতিল করেছিল।রাজ্যের এক মন্ত্রী বলেছেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালি কবি , অসমে তার জন্মদিন কেন পালন করা হবে ?কোনও দেশের কোনও সরকার তাদের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টাকে এমনভাবে অপমান করেনি।
           অবস্থা এমন যে, ভাষা আন্দোলনের ধাত্রীভূমি শিলচরের বিজেপি বিধায়ক 
দিলীপ পাল 'দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে' রাজ্যের ডেপুটি স্পিকার পদ ছেড়েছেন।
         নাগরিক পঞ্জিকরণের দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশিত হবার পর দেখা যাচ্ছে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে।সকলেই বাঙালি।এদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের মানুষই রয়েছেন। আসু ও গণ সংগ্রাম পরিষদ এর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছে।
           যাদের নাম বাদ গেল তাঁরা কোথায় যাবেন? বাংলাদেশ এদের গ্রহণ করবে? এর উত্তর হচ্ছে ' না'। এরা কি তাহলে রাষ্ট্রহীন হয়ে থাকবেন?
            বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন এই  পঞ্জিকরণ সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে হয়েছে।তাদের কিছু করার নেই।কথাটি বাস্তবে সঠিক নয়।কাজটি করেছে রাজ্য সরকারি কর্মী ও আধিকারিকরা।প্রতীক হাজেলা যিনি এই পঞ্জিকরণের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত সেন্ট্রাল ক্যাডারের IAS অফিসার, তিনি কি প্রতিটি case নিজে verify করেছেন?
          আর বিজেপির স্থানীয় নেতা দিলীপ ঘোষ আস্ফালন করে বলেছেন তাঁরা নাকি এই বঙ্গেও পঞ্জিকরণ করবেন ও সবাইকে  মেরে বার করে দেবেন।এই দলটি ৪ বছর হলো ক্ষমতায় এসে ভাষা, ধৰ্ম , বর্ণের ভিত্তিতে দেশ জুড়ে বিভাজন সৃষ্টি করেছে।একটি শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীল দেশকে অস্থিতিশীল বিবাদ ও সংঘাতের লিলাভূমিতে পরিণত করেছে।

          ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতায় এসে এই কাজটিই করেছিল।
         The welfare state
          has become a
          plunderous  state
         --.ঐতিহাসিক স্পিয়ার।