শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১

মনোরঞ্জনবাদ ও তৃণমূল সরকার ~ সংঘমিত্রা ব্যানার্জী

তৃণমূল কংগ্রেসের নীতি-আদর্শ বা মতবাদ বলে কিছু নেই। বামপন্থীরা হামেশাই একথা বলেন। কথাটি কিন্তু ঠিক না। নীতি বা মতবাদ ব্যতীত কোন রাজনৈতিক দল কখন‌ও এই রকম সাফল্য পেতে পারেন না। তৃণমূলে কংগ্রেসেরও নীতি আছে, আছে নির্দিষ্ট মতবাদ। যে রাজনৈতিক মতবাদটি তৃণমূল কংগ্রেস গ্রহণ করেছেন, সেটি নিয়েই সমগ্র বিশ্বে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা এখন চর্চায় ব্যস্ত। রাজনীতির এই ধারাটির নাম 'লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজম'। 

'লোকরঞ্জনবাদ' কি? এই মতবাদের সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্কই বা কি? আমি এই লেখায় আমার সীমিত ক্ষমতায়, তা আলোচনা করব। পরে আমি লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের পিছনে যে কারণগুলি আছে এবং তার পরিণতি কি --- সেই বিষয়গুলিকে বন্ধুদের সাথে আলোচনার জন্য সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। সমগ্র বিশ্বে লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের যুগে তৃণমূল কংগ্রেস কি সুন্দরভাবে এই রাজ্যে সেই মতবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছেন, তা দেখে আমি নিজেই বিস্মিত। 

বামপন্থীদের জনসমর্থন হ্রাস পাওয়ার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যের কারণগুলিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে, জনগণ এবং সমাজের স্বার্থে বামদের পক্ষে কখনোই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। তাই এইসব নিয়ে চর্চার খুবই প্রয়োজন। 

'লোকরঞ্জনবাদ'-র সেই রকম কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কিন্তু আছে, সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, যা সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি যতটুকু পারি, আমার সীমিত জ্ঞানে, তা আলোচনা করব। 

'Oxford Handbook of Populism'-এ  লেখা হয়েছে––
"লোকরঞ্জনবাদ (Populism) হল নির্বাচনে জয়লাভের এবং ক্ষমতায় আরোহনের কিছু কৌশল এবং তার কার্য-পদ্ধতির রূপ"। লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে থাকেন, কোন ক্যারিশম্যাটিক নেতা বা নেত্রী। প্রতিষ্ঠিত দলগুলিকে নিয়ে জনগণ যখন ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েন, সমাজে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং অসমতা বাসা বাঁধে, তখন জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে ঐ নেতা-নেত্রীরা উঠে আসেন। এঁরা ক্ষমতায় এসে, প্রথমেই গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেন। ডানপন্থীরা যেমন লোকরঞ্জনবাদকে আঁকড়ে ধরতে পারেন, তেমনি বামপন্থী ঘরানায়‌ও লোকরঞ্জনবাদ সম্ভব। 

আমেরিকার ট্রাম্প, ব্রাজিলের বোলসোনারো এবং আমাদের মোদীজী যেমন ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী, তেমনি বলিভিয়ার ইভো মোরালেস এবং ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ বামপন্থী ঘরানার লোকরঞ্জনবাদী। পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলিতে মার্কসবাদীদের প্রভাব ছিল, বিশেষ করে সেই দেশগুলিতে গত কয়েক বছরে বামপন্থী ঘরানার লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় এসেছেন। এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়াতেও ২০১৭ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন, আর এক লোকরঞ্জনবাদী নেতা মুন জায়ে ইন। দেশের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এঁদের উত্থান ঘটে। 

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে একই সময়ে সারা ভারতবর্ষে যেমন ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী নরেন্দ্র মোদীর উত্থান ঘটেছে, তেমনি এই রাজ্যে বামপন্থীদের মোকাবিলায় বাম ঘরানার লোকরঞ্জনবাদী মমতা ব্যানার্জীর উত্থান ঘটেছে। দুই জন পরস্পরের রাজনৈতিক শত্রু হলেও অবিশ্বাস্য রকমের মিল খুঁজে পাবেন দুজনের মধ্যে; কারণ দুজনেই একই ধারার রাজনীতির লোক।

সাধারণভাবে 'লোকরঞ্জনবাদ' হল "To support the interest of mass people." অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জণগণের স্বার্থ দেখা। এ তো খুব ভালো কথা। বামেরাও তাই বলে। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। আপনার বাচ্চা যদি পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে কেবল ফাস্ট ফুড খেতে চায় এবং যদি তার ঐ ফাস্ট ফুড খেতে চাওয়ার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেন, তাহলে তো আপনি তার ফেবারিট বাবা হয়ে যাবেন। কিন্তু তাতে কি আপনার বাচ্চার সত্যিকারের স্বার্থ রক্ষিত হয়? জনগণের কাছে যা জনপ্রিয় তা যদি অন্যায়, অনৈতিক হয়, তা সত্ত্বেও তাকে সমর্থন করাই হল 'লোকরঞ্জনবাদ'।  জণগণের বঞ্চনা এবং হতাশাজনিত আবেগকে কাজে লাগিয়ে লোকরঞ্জনবাদীরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়। বাস্তবে রূপায়ণ সম্ভব না জেনেও, দেয় ঢালাও প্রতিশ্রুতি। চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা এবং আচরণের দ্বারা, নির্বাচনে জনগণের হৃদয় জয় করাই এঁদের উদ্দেশ্য। এঁরা কৌশল হিসাবে কোন তথ্য ছাড়াই বিভিন্ন অভিযোগ এনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ায়। এঁরা জনগণের সব দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসাবে কিছু শত্রুকে নির্দিষ্ট করে দেন। লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় এলে, এঁদের প্রধান কাজ হয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাবকে সীমিত করা। তাই সমালোচকরা লোকরঞ্জনবাদকে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। শেষ অবধি, এই মতবাদ যে রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে, তা হল মূলত নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ববাদ বা একক শাসন। এই মতবাদের সব থেকে মজার বিষয়টি হল, ফলাফল কি হতে পারে, সেটি বিবেচনায় না রেখে, সমস্যার গভীরে না গিয়ে, দেশের জটিল ইস্যুগুলি সমাধানের জন্য সহজ পথ ধরা (এই রাজ্যে অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড)। আরো কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, এই ধারার রাজনীতির। ঘুরপথে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানানো। আদর্শবাদী প্রধান ধারার রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে, 'লোকরঞ্জনবাদ' জনগণের মনে এক ধরণের উদাসীনতা তৈরি করেন। এমন এক ধরণের বিভাজন তৈরি করেন যে, সমাজের মঙ্গলে রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যমতে আসা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই মতবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বললেও ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার অধিকার এবং বহুত্ববাদকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। 

পরিশেষে বলি, 'লোকরঞ্জনবাদ' হল বর্জনমূলক ধারার রাজনীতি। কোন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী কিংবা দলকে বর্জনের কথা বলে।

মমতা ব্যানার্জীর দু-একটি সিদ্ধান্তকে তুলে ধরলেই, বুঝবেন তিনি কি সুচতুর ভাবে এই মতবাদকে প্রয়োগ করছেন।

১। আগে চলচ্চিত্র উৎসব ছিল সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশের জন্য। সেখানে মূলত আর্ট ফিল্ম এবং তার পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাই গুরুত্ব পেতেন। মমতা দেবী ক্ষমতায় আসার পর শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, তপন সিনহা ছেড়ে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, জয়া বচ্চন, .. এবং মূলধারার ছবিকে ধরলেন। চলচ্চিত্র উৎসবকে করে দিলেন সর্বধারণের।

২। সাধারণভাবে পরীক্ষায় ভালো ফল করলে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কলারশিপ পায়। উনি ঘোষণা করলেন, যে সমস্ত ছাত্রী পঞ্চাশ শতাংশের নিচে নন্বর পাবে তাদের  স্কলারশিপ দেওয়া হবে। 

৩। সরকারি কর্মীদের বর্ধিত ডি.এ. যা আইন অনুযায়ী সরকার দিতে বাধ্য, তা উনি দিলেন না। বরং তিনি সেই অর্থ থেকে ছয় হাজার টাকা মাইনেতে কিছু প্রান্তিক নারী-পুরুষকে কাজে নিয়োগ করলেন। 

৪। খেলা, মেলা, উৎসব বিশেষ করে দুর্গা পুজো সহ নানা পুজোকে গুরুত্ব দেওয়া।

৫। কখনো সম্ভব না জেনেও নানা প্রকল্প ঘোষণা। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর ঘোষণাগুলি তিনি নিজেই ভুলে গেছেন। জনগণও অবশ্য ভুলে গেছেন। 

৬। প্রথম দিকে সিপিআই(এম) দলকে বর্জনের রাজনীতি করা। ঘৃণা ছড়ানো। প্রতিদিন একটি করে সিপিআই(এম)-র লাশ কিংবা সিপিআই(এম)-কে বিষাক্ত সাপের সাথে তুলোনা করা। তথ্য ছাড়াই নানা অভিযোগ করে ঘৃণা ছড়ানো। টালা ট্যাঙ্কের জলে বিষ মেশানো, এই রকম নানা অপপ্রচার। সব দোষ সিপিআই(এম)-এর উপর চাপানো। নবজাতকের ওজন কম হলেও দোষ সিপিআই(এম)-এর।
  
৭। গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, এই সব তিনি অনেক দিন আগেই পকেটে পুরে নিয়েছেন।

৮। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাব সীমিত করা। নির্বাচিত পৌরসভাগুলিকে (হলদিয়া, হালিশহর, দাঁইহাট সহ অসংখ্য উদাহরণ আছে) গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া।

৯। বিচার প্রক্রিয়াকে পাত্তা না দেওয়া (নারদ নিয়েই দেখুন)। রাজ্য সরকার কোর্টে হলফনামা দিয়েছেন যে, নারদে ঘুষ নেওয়াকে তাঁরা অপরাধ বলেই মনে করছেন না।

১০। ফলাফল না ভেবে সহজ উপায়ে কঠিন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। আগেও উল্লেখ করেছি অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে সেরা হল অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড।

মনোরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদদের চরিত্র আন্তর্জাতিকস্তরে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তার সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের চরিত্রের হুবুহু মিল পাওয়া যায়। রাজনীতির এই ধারাকে সামনে রেখে সচেতন এবং সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষজ্ঞদের (পিকে এবং আরো অনেকের) সাহায্য নিয়ে তিনি তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছেন। আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠ  মানুষ অবশ্যই খুশি। কিন্তু ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে গিয়ে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের সর্বনাশ নিশ্চিত। বিশ্বাস না হলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখুন।

আমি তৃনমূল কংগ্রেস ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে।

যাঁরা শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন, তাঁদের আরো‌ গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করে নতুন পথ খুঁজতে হবে।


রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

নির্বাচন ও সিপিআইএম ~ অর্ক রাজপন্ডিত।

হিমাচল প্রদেশে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন। ওডিশাতে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। বিহারে সিপিআই(এম) বিধায়ক তিনজন।

আসামে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন। তামিলনাড়ুতে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। রাজস্থানে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। মহারাষ্ট্রে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন।

কেরালায় সিপিআই(এম) বিধায়ক ৬২জন। ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) বিধায়ক ১৬জন।

বাংলায় সিপিআই(এম) বিধায়ক একজনও নেই, শূণ্য।

বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে কমিউনিস্টদের, বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলবে, তর্ক বিতর্ক চলবে। আগামী দিনের পথ চলার ক্ষেত্রে তা জরুরি, তা আবশ্যক।

কেন 'শূণ্য'? এই কারণের উত্তরের সন্ধান হতে হবে 'ডায়লেক্টিকাল', 'কমন সেন্স' নির্ভর নয়।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে বামপন্থী কর্মী সমর্থক এমনকি নেতৃত্বের মধ্যেও উঠে এসেছে খানিক যেন 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের হারের পর একই ভাবে 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা চোখে পড়েছে।

যেমন, 'আমরা জনগনকে বোঝাতে পারিনি'। যেমন 'শাসকশ্রেণি বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে যে বাইনারি তৈরি করেছে তা ভাঙা যায়নি'। যেমন 'আমাদের মানুষ শক্তিশালী নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসাবে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি', 'বিভাজনের রাজনীতির আবহে, পোলারাইজেশনের আবহে রুটিরুজির স্লোগান মিলিয়ে গিয়েছে', ইত্যদি ইত্যাদি।

এই 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর সন্ধানের মধ্যে কিছু চটজলদি প্রত্যক্ষ সমাধানের নিদানও আছে। যেমন, 'আমাদের কথা পৌঁছতে পারেনি মানুষের কাছে, আমাদের ডেটা অ্যানালাইসিস দুর্বল', 'সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে টার্গেট করে আমাদের কথা পৌঁছতে পারিনি', 'কমরেড ওরা আমাদের কথা বলবে না, আমাদের আগে একটা টিভি চ্যানেল চাই', ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রবণতাগুলিকে এক কথায় চিহ্নিত করা যায় 'প্রশান্ত কিশোর সিনড্রোম' হিসাবে।

এই 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর বার বার বলা মানে হয় যেন আমাদের সব ঠিকই ছিল শুধু ডেটা অ্যানালাইসিস ঠিক না হওয়ার জন্যই যেন বিপর্যয়! বা আমাদের সব ঠিকই ছিল শুধু একটা টিভি চ্যানেল না থাকায় মানুষ জানতে না পারায় আমাদের কথায় তাই এই বিপর্যয়!

ঠান্ডা মাথায় প্রথমে যেটা মানতে হবে, 'পিপলস রিজেকশন'। জনগণের প্রত্যাখান। যতক্ষণ না এই 'প্রত্যাখান' আমরা স্বীকার করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সব সমাধানের উত্তর খোঁজাই হবে 'কমন সেন্স' নির্ভর।

যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন 'কমন সেন্স' নির্ভর বিশ্লেষণ ও সমাধানের রাস্তায় না হেঁটে 'ডায়লেক্টিকাল সেন্স'এ উত্তর খোঁজার চেষ্টা, দ্বান্দিক পদ্ধতিতে ভাবনা।

বিজেপি-তৃণমলের বিভাজনের রাজনীতির কথা আমরা বলেছি। বার বার।

এরাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতির কথা আমরা বলেছি। বার বার।

ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজনের রাজনীতির কথা আমরা মানুষকে বলেছি । বার বার।

প্রশ্ন হল এই বিভাজনের রাজনীতিকে হারানোর জন্য, এই পোলারাইজেশনকে হারানোর জন্য, এই বাইনারিকে ভাঙার জন্য আমাদের পদক্ষেপ কি ছিল? কি কি আমরা করেছি?

'বিভাজনের রাজনীতি'কে কিভাবে ভাঙতে হয় কিভাবে 'মেরুকরণ'কে ভেঙে এগোতে হয় সারা দেশকে শিখিয়েছে এই বাংলাই।

১৯৪৬'র ভয়াবহ দাঙ্গা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নির্মিত মেরুকরণ, বিভাজনের রাজনীতিকে ভেঙে দিয়েছিল তেভাগার আন্দোলন। ১৯৪৬'র আগস্ট'এ কলকাতা জুড়ে দাঙ্গা। রাস্তায় রাস্তায় লাশ। ধর্মের নামে নারকীয় গণহত্যা। আর ঠিক পাঁচ মাস মাত্র পরেই গ্রাম গ্রামে জ্বলে উঠলো তেভাগার অনির্বাণ আগুণ। দুই বাংলা জুড়েই সশস্ত্র কৃষকরা।

১৯৮৬ সালে এআইকেএস থেকে প্রকাশিত আবদুল্লা রসুলের 'তেভাগা স্ট্রাগল অফ বেঙ্গল'এ রসুল সাহেব লিখছেন, 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য মেরুকরণ, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই তেভাগা আন্দোলন ছিল শক্তিশালী প্রত্যাঘাত। হিন্দু মুসলমান ধর্মের পরিচয় ভুলে কৃষকের পরিচয়ে তেভাগায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে'।

১৯৪৬'র দাঙ্গা, সেই সময়ের বিভাজন, মেরুকরণকেও থামিয়ে দিতে পেরেছিল দুর্ধর্ষ কৃষক আন্দোলন। সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজন ঠেকাতে হাতিয়ার করেছিল 'বেসিক ক্লাশ'কেই, মৌল শ্রেণিকেই।

আজকের মেরুকরণ, আজকের বিভাজন, আজকের পোলারাইজেশনকে রুখে দেওয়া গেল না কি 'বেসিক ক্লাশ'র আন্দোলনের অভাবে? শ্রমিক কৃষক খেতমজুর, গ্রামীণ সর্বহারা যাঁরা জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগ তাঁদের নিয়ে দুর্বার শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলা গেল না কেন?

অন্য সব রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক জোট বা রাজনৈতিক সমীকরণের থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে আলাদা করে চেনা যায় একটিই কারণে, কমিউনিস্ট পার্টি যে কাজই করুক না কেন তার মধ্যে একটিই ভাবনা থাকে পুঁজিবাদকে কিভাবে হারানো যায়, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তোরণের পদ্ধতিতে। জর্জ লুকাচ বলেছেন 'অ্যাকচুয়ালিটি অফ রেভোলিউশন', আমি যাই করি না কেন তা হবে 'বিপ্লবের বাস্তবতা'র সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে 'অ্যাকচুয়ালিটি অফ রেভোলিউশন' মানে এমনও নয়, যে বিপ্লব আসন্ন।

যদি সাময়িক সঙ্কটের জন্যও এক্ষুনি ও এখনকার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়াও হয়ে থাকে তার মধ্যে থাকতে হবে পুঁজিবাদকে উত্তরোণের রসদ, আর পুঁজিবাদকে খতম করার লক্ষ্য বাদ দিয়ে যা কিছুই ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেন তা হবে চটজলদি প্রত্যক্ষ সমাধানবাদ।

কমিউনিস্ট পার্টিতে চটজলদি প্রত্যাক্ষ সমাধানবাদের প্রবণতা বাড়তে থাকলে পার্টির সঙ্গে মৌল শ্রেণির বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে, ফলত 'পার্টি স্বার্থ' বড় হয়ে যায় বেসিক ক্লাশের 'শ্রেণি স্বার্থ'র থেকে।

নির্বাচনে কিছু আসন দরকার, লোকসভায় প্রতিনিধি দরকার, বিধানসভায় কিছু বিধায়ক দরকার, এই ধরণের 'পার্টি স্বার্থ' রক্ষার জন্য চটজলদি সমাধান কিছু নেওয়া হলে সেখানে থাকে না 'বেসিক ক্লাশ'র শ্রেণি স্বার্থ। চটজলদি সমাধানবাদকে এখনই যদি রোখা না যায় তাহলে 'পার্টি স্বার্থ' রক্ষা করতে গিয়ে আগামীতে পার্টি যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে সেই শ্রেণির স্বার্থ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। চটজলদি সমাধানবাদ কমিউনিস্ট পার্টিকে তখন অন্য চার পাঁচটা রাজনৈতিক দলের থেকে আলাদা করতে পারে না জনগণের কাছে।

কোন পথে ঘুরে দাঁড়াবে কমিউনিস্ট পার্টি? এই নিয়েও চর্চা চলবে, তর্ক বিতর্ক চলবে। কিছু ওপিনিয়ান পেজ লেখক মূলত কয়েকটি সমাধান হাজির করেন বামপন্থীদের ভালো চেয়ে! যেমন কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হয়ে উঠুক তারা সাম্রাজ্যবাদের 'পুরোন বস্তাপচা ধারণা'কে ছেড়ে দিক।

আবার কেউ কেউ বলেন কমিউনিস্ট পার্টির ভালোর জন্যই এই ধরনের 'সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক' টাইপ স্লোগান ছেড়ে সব অংশের কাছে অ্যাপিলিং হয়ে উঠতে পারে। যাঁ তাঁরা বলেন না কমিউনিস্ট পার্টি যাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে 'বেসিক ক্লাশ', শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুর যাঁরা জনসংখ্যার আশি শতাংশ, যাঁরা নয়া উদারবাদী আক্রমনের প্রতিনিয়ত শিকার, যে নয়া উদারবাদের নিয়ন্ত্রক আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি যা আজকের সমসাময়িক সাম্রাজ্যবাদের মূল আকর।

আজকের এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরোণের জন্য শুধু রাস্তায় থাকতে হবে বা রাস্তাই একমাত্র রাস্তা বলার থেকেও জরুরি কোন রাস্তায় থাকবো? কোনটা ঠিক রাস্তা? সঠিক রাস্তার সন্ধান না পেলে একই রাস্তায় বার বার ঘুরে ঘুরে থাকার বিভ্রান্তি আরও চটজলদি সমাধানবাদ হাজির করতে পারে।

ইতিহাস দেখিয়েছে বারে বারে কমিউনস্টদের হারানো গণভিত্তি ফিরে পেতে এলে চটজলদি সমাধানবাদ কাজে লাগে না, একটাই সমাধান তখন ফিরে যাও 'বেসিক ক্লাশ'র কাছে। মৌল শ্রেণির কাছে ফিরে যাও।

এইরকম সঙ্কটের সময়ে পার্টি নেতৃত্বের ভূমিকা হবে সব থেকে কার্যকরি। লেনিন বার বার জোর দিয়েছোন 'ক্লাশ লিডারশিপ'র কথা, সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে হলে পার্টি কমিটি ভরিয়ে দাও 'বেসিক ক্লাশ' কে নিয়ে এসে, কমিটি ভরিয়ে দাও মজুর, কৃষক, খেতমজুরদের দিয়ে।

১৯২২ সালে রুশ পার্টির পার্টি কংগ্রেসে চিঠি লিখে লেনিন প্রস্তাব দিয়েছেন 'কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমার মনে হয় পার্টির অধিকার আছে দাবি করার যে সিসি'তে ওয়ার্কিং ক্লাশের প্রতিনিধি ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০জন করতে হবে। এই ধরণের ব্যবস্থা পার্টিকে আরও সুসংহত করতে কবে লড়াইতে। পার্টি নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি বাড়ালে পার্টি হাজারগুণ বেশি সুসংহত হবে'।

বারে বারেই শিখিয়ে যান ভ্লাদিমির। 

বালাসাহেব ঠাকরে ~ ঋতুপর্ণ বসু

বিরাট বোম্বে শহরে বাল কেশব থ‍্যাকারে নামে এক  সাদামাটা তরুণ  আর পাঁচজন নিম্নবিত্ত মারাঠির মতই লোকাল ট্রেনে চেপে অফিস যান। 

তার কাঁধে ঝোলানো ব‍্যাগে থাকে রং, তুলি,পেনসিল,  আ্যলুমিনিয়ামের টিফিন বক্স। 

ফ্রি প্রেস জার্ণাল কাগজের ব‍্যঙ্গচিত্রী তিনি । বেতন ৭৫ টাকা। 

ওই অল্প টাকায় সংসারের খরচ চলে না বলে তাকে  মারাঠা,  কেসরী, ধণুর্ধারী প্রভৃতি পত্রপত্রিকা ও  বিজ্ঞাপন সংস্থার জন‍্যেও ছবিও আঁকতে হয়। আঁকতে হয় সিনেমার শো- কার্ড। 

অফিসে এতদিন তাঁকে বসতে দেওয়া হত টেলিফোন অপারেটরের পাশে।

 খবরের কাগজের অফিসে বিরামহীনভাবে ফোন আসতেই থাকে। কার্টুন আঁকতে গিয়ে  কার্টুনিস্টের মনঃসংযোগ নষ্ট হয় বারে বারে। 

কর্তৃপক্ষের কাছে ক্রমাগত আবেদন করে কিছুদিন হল একটা নতুন জায়গা পেয়েছেন তিনি।  

এই কাগজের আরেক স্টাফ কার্টুনিস্ট এক তরুণ  দক্ষিন ভারতীয়। নাম আর. কে. লক্ষণ। কর্তৃপক্ষের স্নেহধন্য  লক্ষণের জন‍্য অফিসে রয়েছে আলাদা চেম্বার। 

.............................................................................

" বালাসাহেব ঠাকরের উত্থান আমার চোখের সামনেই ঘটেছিল। 

যেদিন ফ্রি প্রেস জার্ণালে যোগ দিই, সেদিনই প্রথম আলাপ করিয়ে দেন এক সহকর্মী। 

"ইনি হলেন মিঃ ঠাকরে। আমাদের কাগজের কার্টুনিস্ট।" 

 ক্ষীণকায় তরুন মিঃ ঠাকরের ঘন  চুলগুলি ব‍্যাকব্রাশ করা । চোখে চশমা, মুখে চুরুট। 

ওইসময় আমাদের অফিসে দুজন চুরুট খেতেন। সম্পাদক ও ব‍্যঙ্গচিত্রী।  সম্পাদক নটরাজনের  দামী  চুরুটের  হালকা গন্ধটা বিশেষ প্রিয় ছিল আমার।

কার্টুনিস্টের চুরুটের ঘ্রাণ  ছিল উগ্ৰ, কড়া। মোটেই ভাল লাগত না। 

বালাসাহেব একটা বড় কাঠের বোর্ডের ওপর কাগজ রেখে টুলির একটানে বড় বড় ছবি এঁকে ফেলতেন। 

আঁকার সময় কখনও কখনও  একটি পাইপ ধরিয়ে নিতেন দেখেছি। 

আরেক ব‍্যঙ্গচিত্রী আর. কে. লক্ষণের নিজস্ব সাউন্ড প্রুফ ঘর ছিল। তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত এক চাপরাশী  তাঁর ফাইফরমাশ খাটার জন‍্য। 

মিঃ ঠাকরের ঘরটিকে আমরা বলতাম লাইব্রেরি। কারণ  রিভিউ হবার জন‍্য যত রাজ‍্যের বই অফিসে দেওয়া হত, সেগুলি স্তূপ হয়ে পড়ে থাকত ওখানে।

মিঃ ঠাকরেকে  ফিল্ম পেজ এডিটর ও এক করণিকের সঙ্গে ঘরটিকে ভাগ করে নিতে হয়েছিল। 

মিঃ ঠাকরে ছিলেন অর্ন্তমুখী, মৃদুভাষী, ভদ্র, সংযত। 

আমরা গর্বিত ছিলাম আমাদের কার্টুনিস্টকে নিয়ে। 
তাঁর দুটি ব‍্যঙ্গচিত্র একটি ব্রিটিশ কার্টুন সংকলনে স্থান পেয়েছিল। লক্ষণের কার্টুন কিন্তু মনোনীত হয়নি। 

একবার একটি আমেরিকান সংবাদপত্র ফ্রি প্রেস জার্ণালে প্রকাশিত মিঃ ঠাকরের কার্টুন পুনর্মুদ্রণ করে। সাম্মানিক হিসেবে কার্টুনিস্টের উদ্দ‍্যেশ‍্যে একটি ভদ্রস্থ পরিমাণ ডলারের চেক পাঠায়। 

সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ কিন্তু পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করলেন। মিঃ ঠাকরেকে বলা হল, তাঁর কার্টুন ফ্রি প্রেস জার্ণালের সম্পত্তি। 

মিঃ ঠাকরে ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। অন্ততঃ, তাঁর মত একজন  নিরীহ ভদ্রলোকের পক্ষে যতটা রাগ করা সম্ভব !! 

আমাদের সংবাদপত্রের কর্তাব‍্যক্তিরা অধিকাংশই ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয়। " 

 স্মৃতিচারণা করেছেন প্রখ‍্যাত সাংবাদিক ও কলাম লিখিয়ে বেরহাম কন্ট্রাকটর, তাঁর  " Busy Bee ; Best of 1996 - 97 " ( Oriana Communications, 1998 )  বইতে। 
….............................................................................

১৯৫২ সালে  মাদ্রাজ প্রদেশের তেলুগু  ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা রাজ‍্যের দাবীতে পট্টি শ্রীরামালু ৫৬ দিন অনশন করে মৃত‍্যুবরণ করেন।

 কানাড়া ভাষাভাষী একটি প্রদেশ তৈরীর দাবি নিয়ে জোর সওয়াল করেন আলুরু বেঙ্কট রাও। 

১৯৫৩  সালে রাজ‍্য পুনর্গঠন কমিশন  তৈরী করা হয়েছিল। এই কমিশন ভারতে ভাষাভিত্তিক ১৪টি রাজ‍্য বিভক্ত করার সুপারিশ করে। সাথে থাকবে ৬টি  কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। 

১৯৫৬ এ পাশ হয় রাজ‍্য পুণর্গঠন আইন। 

ব্রিটিশ আমলে তৈরী বম্বে প্রদেশকে বিভক্ত করে  গুজরাটি ও মারাঠিভাষী রাজ‍্য তৈরির জোরদার দাবী উঠতে থাকে। 

কিন্তু রাজ‍্য পুণর্গঠন কমিশন অদ্ভুতভাবে গুজরাতি ও মারাঠি ভাষাভাষী এলাকাগুলি জুড়ে একটি দ্বিভাষিক রাজ‍্য তৈরীর প্রস্তাব দেয়। সেইসঙ্গে বিদর্ভ অঞ্চলকে একটি আলাদা রাজ‍্য হিসাবে গঠন করার সুপারিশ। 

এর বিরুদ্ধে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতির নেতৃত্বে  তুমুল আন্দোলন হয়। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, প্রাবন্ধিক কেশব সীতারাম ঠাকরে ছিলেন এই আন্দোলনের একজন বর্ষীয়ান  নেতা। 

চিত্রশিল্পী , নানারকম বাদ‍্যযন্ত্র বাজাতে সিদ্ধহস্ত , শাস্ত্রীয় সংগীতে পারদর্শী, সাহিত‍্যে অগাধ পান্ডিত্য -  এহেন বহু গুণের অধিকারী কেশবে ঠাকরের নিজস্ব পারফর্মিং ট্রুপ বা  মারাঠি লোকায়ত নাচগানের দল ছিল। 

 তরুন বয়সে জ‍্যোতিবা ফুলের জাতপাতবিরোধী "সত‍্যশোধক" আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, একসাথে কাজ করেছেন বাবাসাহেব বি.  আর. আম্বেদকরের সাথে। 

প্রখ‍্যাত ইংরেজি সাহিত‍্যিক উইলিয়ম মেকপিস থ‍্যাকারের ভক্ত কেশব নিজের পদবীর বানানটি লিখতেন " Thackeray". 
তাঁর " প্রবোধন"  পত্রিকা মহারাষ্ট্রে তুমুল জনপ্রিয়।  "প্রবোধন"  কথাটির অর্থ " নবজাগরণ"। 
মারাঠা মুলুকে কেশব " প্রবোধঙ্কর"  নামেই অধিক পরিচিত। 
সিনিয়র ঠাকরে সারা জীবনে  অর্থ ছাড়া আর সবকিছুই উপার্জন করেছেন। 
জীবনের নানা ওঠাপড়ার সুন্দর বিবরণ তিনি দিয়ে গেছেন "  মাঝি জীবনগাথা ; (The Collected Works of Pravodhankar Thakre, Volume 1,  মহারাষ্ট্র রাজ‍্য সাহিত্য আণি সংস্কৃতি মন্ডল, মুম্বই,) বইতে। 

এই ঠাকরেরা চান্দ্রসেনীয় প্রভু কায়স্থ। 

মহারাষ্ট্রে কায়স্থদের  সংখ‍্যা কম। চান্দ্রসেনীয় প্রভু কায়স্থদের  নিবাস ছিল কোলাবা জেলা ও তার আশেপাশে। এঁদের আচার ব‍্যবহার উচ্চবংশীয় ক্ষত্রিয়ের মত। কায়স্থ প্রভুরা মূলতঃ মসীজীবী।

 ব্রাহ্মণদের সঙ্গে একসময় এঁদের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। বুদ্ধিবলে কেউ খাটো নয়, তাই এদের ঝগড়াঝাটি সর্বত্র সর্ব কার্যে চলেছে।
ছত্রপতি  শিবাজীর বিশ্বস্ত সেনাপতি বাজী প্রভুর বীরত্বের কথা, ছত্রপতিকে রক্ষা করার জন‍্য তাঁর পাবনখিন্ডের লড়াইয়ে আত্মদানের কথা  মহারাষ্ট্রে কে না শুনেছে ? 

শিবাজী মহারাজ কত দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। তাঁর একটা সার্বজনীন ভাব ছিল। তাঁর আমলে তিনি দপ্তরে, পল্টনে তিনি সব জাতি, সব ধর্মকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি মারা যাবার পর ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণে রেষারেষি ক্রমশ বেড়ে উঠেছিল। 

অনেকে বলেন যে এই কায়স্থ প্রভুরা মহারাষ্ট্রের সাবেক বাসিন্দা নয়, উত্তর ভারত থেকে এসেছে। 
এঁদের কূলদেবী বিন্ধ‍্যাচলবাসিনী -- দেবীর মন্দির মির্জাপুরের কাছাকাছি বিন্ধ‍্যপর্বতে অবস্থিত, দক্ষিণদেশে নয়। 

মারাঠাশাহীর সময় কেশব সীতারাম ঠাকরের এক পূর্বপুরুষ ধোপড়ে অঞ্চলের দুর্গরক্ষক ছিলেন। 

লড়াইয়ের সাথে তাঁরা  অপরিচিত নন। 

..............................................................................

মহারাষ্ট্র বিবিধ  চিন্তাধারা ও আদর্শের উৎসভূমি। 

বাল গঙ্গাধর তিলকের স্বরাজ‍্য আন্দোলন, জ‍্যোতিবা ফুলের সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এখান থেকেই শুরু হয়েছে। 

নাগপুরের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ধীরে ধীরে সারা দেশে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে। 

বাবাসাহেব আম্বেদকরের দলিত চেতনা মহারাষ্ট্রের ব‍্যাপ্তি ছাড়িয়ে দেশের দূরতম প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। 

বম্বে শহরে কমিউনিস্ট ট্রেড ইউনিয়নের রমরমা। 

কিন্তু এইসব তত্ত্বের প্রবক্তারা মারাঠি মানুষের সংস্কৃতি, জীবিকা , বাসস্থান নিয়ে কিছু বলছে কি ?

 স্বাধীনতার বেশিদিন হয়নি, অথচ আজ  নিজের শহরেই অবাঞ্ছিত মহারাষ্ট্রের ভূমিপুত্ররা।  যারা এককালে ছিল ছত্রপতি শিবাজীর ফৌজের গর্বিত যোদ্ধা, তারা আজ সারা শরীরে আত্মগ্লানি মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

পশ্চিমঘাটের গ্ৰাম‍্য, দরিদ্র  মানুষের বম্বেতে একটাই পরিচয় --- "ঘাটী"। এই  মলিন ঘাটীরা সুসজ্জিত বিপণীতে ঢুকে পড়লে বম্বের বাবুরা হাসে। 
এই ঘাটি বা গরীব মারাঠিদের   পিওন, মুটে, অটোচালক আর পুলিশ কনস্টেবল হিসাবে দেখা যায়। এই পুলিশের হাবিলদারদের অমারাঠিরা ব‍্যঙ্গ করে বলে "পান্ডু"। 

সারা শহর জুড়ে মাকড়সার জালের  মত রেল লাইন  --- কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন। বস্তাবন্দি আলুপটলের মত বোঝাই হয়ে লোক চলেছে।  হট্টগোলের মধ‍্যে কান পাতলে মারাঠি কথা কানে  আসে খুব কম। 

চোখের সামনে দিয়ে মারাঠি মানুষের নিজের শহরটা, মুখের রুটিটা চুরি হয়ে গেল, তার খেসারত কে দেবে ? 

মুম্বাদেবীর স্নেহধন্য এই শহর মুম্বই, আজ নিজের মারাঠি নামটাও হারিয়ে ফেলেছে। 

  "ওরা" অবশ‍্য বলে যে কসমোপলিটান বম্বে শহরকে নাকি গড়ে তুলেছে পার্সী, আর্মেনিয়ান, বোহরা মুসলীম আর গুজরাটি জৈনরা। মারাঠিরাই এখানে  বেমানান, বহিরাগত। 

বম্বের স্টুডিওগুলিতে চোপড়া, কাপুর, আনন্দদের একাধিপত‍্য !  

শহরের উদিপী রেস্তোরাগুলির মালিক  দক্ষিণ ভারতীয়রা। রয়েছে পার্সী টি হাউস। 

 বাল ঠাকরে লক্ষ‍্য করেছেন দক্ষিণ ভারতীয়রা সবসময়  পরস্পর নাকশোঁকাশুকি করে চলে, ভুলেও মারাঠিদের চাকরীতে বহাল করে না। 

 অফিস কাছারী রেস্তোরাঁ মাদ্রাজী   "আন্না"দের, সিনেমাজগত পাঞ্জাবীদের, ইন্ডাস্ট্রিগুলো গুজরাটি আর পার্সীদের ---  কেবল গালিগালাজ ও বিদ্রুপ  মারাঠিদের জন‍্য বরাদ্দ !!! 

বিদর্ভ ও কোঙ্কন অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ  বম্বের কাপড়ের মিলে কাজ করেন। কিন্তু মিলগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মারাঠি "কামগার" ( শ্রমিক )  
পরিবারে যাদের চাকরির বয়স হয়েছে, সেইসব বেকার যুবকদের মধ‍্যে তৈরী হয়েছে  তীব্র ক্ষোভ। 

বম্বের অপরাধ জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে যারা , সেই বরদারাজন মুদেলিয়র, হাজী মাস্তান আর করিম লালা পাঠান কেউই মারাঠি নয়। এটা বাল ঠাকরেকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। 

 নানা জাতি, নানা ধর্মের ভিড়ে ধুঁকতে থাকা একটা তৃতীয় বিশ্বের শহর  কখনই অপরাধ মুক্ত হবে না।

 ফলে মহারাষ্ট্রেও গুন্ডা-মাফিয়া-অপরাধী থাকবেই। মারাঠি গুন্ডা যদি তৈরি না হয়, জায়গা ফাঁকা থাকবে না। ভিন্ন জাতির লুম্পেনরা অপেক্ষা করছে।

 অতএব বিজাতীয় গুন্ডার থেকে "আমচি মূলে" (আমাদের ছেলেরা)  কম বিপদজনক।  কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডে "মারাঠি ডন"  কোথায় ? 

এইসব চিন্তা করতে করতে  যখন বাল ঠাকরের মন আনমনা, হঠাৎ ধাক্কা লাগল উল্টোদিক থেকে আসা এক পথচারীর সাথে। 

রাগের মাথায় মানুষের মুখ দিয়ে  মাতৃভাষা বেরোয়। লোকটি বাল ঠাকরেকে যা তা গালমন্দ করতে লাগল। 

লোকটার অনর্গল  আ্যন্ডাপ‍্যান্ডা য়ান্ডুগুন্ডু  শুনে রাগের চেয়ে হাসি পেল বেশি।

মাদ্রাজীদের   কি আজব ভাষা !! 

তবে  এই " য়ান্ডুগুন্ডু"গুলোর বড্ড বাড় বেড়েছে। 

মালাবার থেকে আসা  হকারগুলো শহরের ফুটপাতগুলোতে যত স্মাগলড জিনিস ফিরি করে বেড়ায়। 

বাইরে থেকে যতরাজ‍্যের লোক  এসে শহরটাকে ঘিঞ্জি আর অপরাধপ্রবণ করে তুলেছে !!! 

কিছু একটা করা দরকার !! 

…….......….....................................................

  দাদারের ৭৭এ, রানাডে রোডের বাড়িতে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের ভিড় লেগেই থাকে। কাছেই শিবাজী পার্ক। 

১৯২৫ সালে এ পার্ক স্থাপিত হয়। তখন এর নাম ছিল মাহিম পার্ক। ১৯২৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিএমসি কাউন্সিলর অবন্তিকাবাই গোখলের উদ্যমে এ পার্কের নামকরণ হয় শিবাজি পার্ক। জনগণের চাঁদায় এখানে শিবাজির একটি মূর্তি স্থাপিত হয়।

 বাড়ির হৈ হট্টগোলের মধ‍্যেই  বসার ঘরে চৌকি পেতে বাল ঠাকরে কার্টুন এঁকে চলেন। ইদানিং সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলনের সমর্থনে প্রায় আটটি কাগজে ব‍্যঙ্গচিত্র আঁকছেন " মাওলা " ছদ্মনামে।  মহারাষ্ট্রের পার্বত‍্য অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের বলে "মাওলা"। এঁরাই শিবাজীর বিশ্বস্ত সৈনিক ছিল। 

মোরারজী দেশাই কিছুতেই আলাদা রাজ‍্য দেবেন না মারাঠিদের। শহরের ফ্লোরা ফাউন্টেন এলাকায়  (  এখন হুতাত্মা চৌক )  বিক্ষোভরত আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে পুলিশ ১০৫ জনকে মেরে ফেলল। 
" বম্বে" নামে একটি কাগজে ঠাকরের কার্টুন প্রকাশিত হল। মোরারজি দেশাইকে নররাক্ষস রূপে খুলির পাহাড়ের ওপর বসে আছেন। 
পুলিশ কেস নথিভুক্ত করল, ফলে কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হল বাল ঠাকরেকে। 

...........................................................................

শেষ পর্যন্ত ফ্রি প্রেস জার্ণালের চাকরি ছেড়ে দিলেন বাল ঠাকরে। মহারাষ্ট্রের খ‍্যাতনামা নেতা এস. কে. পাতিলকে আক্রমণ করে করা  কার্টুন নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তীব্র মতান্তর হয়েছে সদ‍্য। এছাড়াও নানা কারণে মনটা তিক্ত হয়ে আছে। 

  ঠিক করলেন, একটি কার্টুন সাপ্তাহিক বের করবেন। সেইসময় মহারাষ্ট্রে স্ত্রী, কিরলোসকার, মৌজ, জ‍্যোৎস্না ইত‍্যাদি পত্রিকা থাকলেও কোন কার্টুন সাপ্তাহিক ছিল না। কেবলমাত্র দিল্লি থেকে বেরোত ইংরেজি "  শংকরস উইকলি "  নামে মূলত কার্টুন ও ফিচারধর্মী পত্রিকা। 

" খিঁচো না কামান    
 না তলওয়ার নিকালো
 জব তক মুকাবিল হো
 তো আখবার নিকালো। " 

তুলিকলমের জোরই আসল জোর।
প্রবোধঙ্কর ঠাকরের এক গুণমুগ্ধের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক অনুদানে প্রকাশিত হল একটি পত্রিকা। 
১৯৬০ সালের ১৩ই এপ্রিল , স্থানীয় বালমোহন বিদ‍্যামন্দিরে  বাল ঠাকরের পত্রিকার  আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষ‍্যে এসেছিলেন তৎকালীন মুখ‍্যমন্ত্রী ওয়াই.  বি.  চবন। প্রবোধঙ্করের গুণমুগ্ধ তিনি। 
সমস্ত মারাঠি জনগণের মর্মস্থলের আশা ভরসা থেকে উৎসারিত হয়েছে বলে প্রবোধঙ্কর এর নাম রেখেছেন " মার্মিক"। প্রচ্ছদ জুড়ে  বাল ঠাকরের কার্টুন। সঙ্গে কড়া সম্পাদকীয়,  শ্লেষাত্বক নিবন্ধ ও সিনেমার পাতা।  
ধীরে ধীরে মারাঠি মানুষের মনে জায়গা করে নিল এই পত্রিকা। রবিবাসরীয় ক্রোড়পত্র "রবিবারচি যত্রা" ছিল অন‍্যতম আকর্ষণ। 

.......................................................................

 আর্কিটেক্ট মাধব দেশপান্ডে, পদ্মাকর অধিকারী, শ‍্যাম দেশমুখ এবং বসন্ত প্রধান (  রেলকর্মী ও পরবর্তীতে আইনজীবি )  বম্বে শহরের বিভিন্ন গণেশ  মন্ডল, স্থানীয় ক্লাব ও ব‍্যায়ামশালায় গিয়ে মারাঠি তরুনদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতেন।  

ওই সময়  " মার্মিক " একটি জনপ্রিয় পত্রিকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। প্রায় ৫০,০০০ কপি বিক্রি হত, প্রায় দু লক্ষ মানুষ পত্রিকাটি পড়তেন। 
একদিন তাঁরা ওই পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দেখলেন। মারাঠিদের স্বার্থরক্ষার জন‍্যে  নিজস্ব সংগঠন তৈরী হবে। 
তাঁরা বুঝলেন তাঁদের উদ‍্যোগের সাথে এই প্রচেষ্টা পুরোপুরিভাবে মিলে যাচ্ছে। তাঁরা সদলবলে বাল ঠাকরের সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসা করলেন, এই সংগঠনের কোন কাঠামোর বিষয়ে মিঃ ঠাকরে কিছু ভেবেছেন কিনা। 
"কাঠামো ? কিসের কাঠামো ?  আমি রয়েছি, কিছু বন্ধু রয়েছেন, আর এই পত্রিকাটা রয়েছে।" বাল ঠাকরে সবিস্ময়ে  বললেন। 
 মাধব দেশপান্ডে ও তাঁর সাথীরা মিঃ ঠাকরেকে বোঝালেন শুধুমাত্র সীমিত লোকবল ও  পত্রিকার প্রচারের ওপর ভরসা করলে চলবে না। 

পেশাদার দক্ষতায় তাঁরা নতুন  দলের সাংগঠনিক কাঠামোর রূপরেখা এঁকে দিলেন। বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এলাকাভিত্তিক ম‍্যাপকে সামনে রেখে প্রতিটি ওয়ার্ডে শাখা প্রমুখের নেতৃত্বে বিভাগ প্রমুখ, ও বিভাগ প্রমুখের অধীনে সাধারণ কর্মীদের মধ‍্যে  দায়িত্ব কিভাবে ভাগ হবে, তার একটি নীল নকশা তৈরি করলেন। 

একটা জিনিস তাঁরা লক্ষ‍্য করেছিলেন, যে পত্রিকা সম্পাদককে  যদি তাঁর কমফর্ট জোন থেকে একবার  বাইরে বার করে এনে মঞ্চে  তুলে দেওয়া যায়, তবেই কেল্লাফতে। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথা শোনে। 
এই নিঃস্বার্থ কর্মীরা একমত হলেন যে মারাঠি অস্মিতার মুখ হবেন একজনই -- বালাসাহেব ঠাকরে। 

( তথ‍্যসূত্র : হিন্দু হৃদয় সম্রাট ; সুজাতা আনন্দন, হারপার কলিন্স। ) 
.............................................................................

" আমি ১৯৬৯ সালে  পুনে থেকে বম্বেতে ডেপুটি কমিশনার হিসাবে বদলি হই। জোন থ্রি এলাকাটি আমার দায়িত্বে ছিল। এখানেই শিবাজী পার্ক, বালাসাহেব ঠাকরের খাসতালুক।  তাঁর সাথে আমার বেশ কয়েকবার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছিল।

 একটা ইন্টারেস্টিং চরিত্র উনি। ওনার সাথে কথা বললে মোটেই রাগ হত না  আমার। তবে ওনাকে ক্রমাগত ট‍্যাকল করতে হত প্রশাসনের তরফ থেকে।  

আমাকে বারবার বলতে হত -  আপনি এটা করতে পারবেন না  -- এটা করলে আম‍রা এই ব‍্যবস্থা নিতে বাধ‍্য হব। 

তখন উনি আমাদের সাথে তর্ক করতেন, কিন্তু কোথাও  যেন ওনার মধ‍্যে  পুলিশ প্রশাসনের প্রতি একটা রেসপেক্ট ছিল। উনি জানতেন, একমাত্র আমরাই ওঁকে রুখে দিতে পারি। 

মিঃ ঠাকরের সাথে কথা বলে তাঁকে মোটের ওপর মিশুকে ও  বন্ধুবৎসল বলেই মনে হয়েছে। তবে  বক্তৃতা দেবার সময় যেন তাঁর ঘাড়ে ভূত চাপত। তাঁর কথার তোড়ে সকলে ভেসে যেত। গল্পের ঢংয়ে যখন কথা বলতেন তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত মাঠভর্তি লোক। 

 মানুষ তাঁর কথায় হাসত, কাঁদত, ক্রুদ্ধ হত  -- মারাঠি হিসাবে গর্ব অনুভব করত। মিঃ ঠাকরে না থাকলে এই নবীন প্রজন্মের ছেলেরা হয়ত বামপন্থী দলে যোগ দিত, অথবা জর্জ ফার্নান্ডেজের সোসালিস্ট পার্টির দল ভারী করত। 

 তৎকালীন কংগ্রেস মুখ‍্যমন্ত্রী বসন্তরাও নায়েকের সস্নেহ সমর্থন পেতেন মিঃ ঠাকরে। সেসময় অনেকেই ওনার দল  শিবসেনাকে ব‍্যঙ্গ করে বলত "বসন্তসেনা"।   আরো বিভিন্ন প্রভাবশালী ব‍্যক্তি ও গোষ্ঠীর  মদতও ছিল। তাঁরা চাইতেন মিঃ ঠাকরে কমিউনিস্টদের উৎখাত করুন শহর ও রাজ‍্য থেকে। 

 আবার বলছি,  মিঃ ঠাকরে  খুব বুদ্ধিমান মানুষ  --- মানুষের ওপরে প্রভাব বিস্তার করার  একটা অদ্ভুত  ক্ষমতা ছিল ভদ্রলোকের।  আমাদের পুলিশ ফোর্সের জুনিয়র অফিসার ও কর্মীদের  পুরোপুরি নিজের দিকে করে নিতে পেরেছিলেন। এদের সকলেই ছিল  মারাঠি।
আমার স্টেশন হাউস অফিসারদের মধ‍্যে বাল ঠাকরের অসংখ‍্য গুণমুগ্ধ ছিল। আমি  দৈনিক  "পুলিস নোটিশ" এর মাধ‍্যমে তাদের বার্তা দিতাম যে কোন পুলিশকর্মী যদি   রাজনৈতিক পক্ষপাতের কারনে  কর্তব‍্যের সাথে আপোষ করে তবে  বিভাগীয় ব‍্যবস্থা নেওয়া হবে। 

প্রখ‍্যাত  পুলিশ অফিসার জুলিও রিবেইরো। 
মুম্বই মিরর, সেপ্টেম্বর, ২০১৯
...................................................................

 বালাসাহেব ঠাকরের সভাপতিত্বে কোলাপুরে অনুষ্ঠিত কার্টুনিস্টদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি সেখানে সকলের সামনে নানা ধরনের ক‍্যারিকেচার এঁকে দেখিয়েছিলেন। 
 কার্টুন আঁকায় এ্যনাটমির গুরুত্ব,  ক‍্যারিকেচার কিভাবে অল্প রেখায়  পরিচিত মানুষের ব‍্যক্তিত্বের নির্যাস ফুটিয়ে তোলে, রাজনৈতিক কার্টুন কাকে বলে  -- এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি  আলোচনা করেন। 

পরবর্তীকালে ভিলে পার্লে ও গিরগামে অনুষ্ঠিত  কার্টুনিস্টদের কনভেনশনেও  তিনি সাগ্ৰহে যোগদান করেন। মহারাষ্ট্রে কার্টুনশিল্পের প্রচার ও প্রসারে তিনি অকুন্ঠভাবে সাহায্য করেছেন। 

 ২০০০  সালে মহারাষ্ট্রের বিখ‍্যাত কার্টুনিস্ট শিবরাম দত্তাত্রেয় ফডনিসের ৭৫  বছরের জন্মদিনে যে  অনুষ্ঠান হয়, তাতে বালাসাহেব উপস্থিত হয়ে সম্বর্ধনা জানান --  ভূয়সী প্রশংসা করেন বর্ষীয়ান শিল্পীর। 

"  ফাডনিস ক‍্যাপশনলেস কার্টুনের একজন সার্থক রূপকার। আমার কার্টুনে অবশ‍্য সংলাপ থাকত, কারণ আমার অধিকাংশ বক্তব‍্যই ছিল রাজনৈতিক।"  বলেছিলেন বালাসাহেব ঠাকরে। 

লক্ষণের " কমনম‍্যান" এর  মতই বালাসাহেবের" মারাঠী মানুস"  ছিল কাক্কাজী। এই গোবেচারা, প্রৌঢ় মারাঠি পারিপার্শ্বিক চাপে বিপর্যস্ত। 

" মার্মিক ছাড়াও বালাসাহেবের কার্টুন আমি নিয়মিত দেখতাম আওয়াজ, নবযুগ, কেশরী, নবশক্তি ইত্যাদি পত্রপত্রিকায়। আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁর রেখা ও বক্তব‍্য।"  জানান ফাডনিস। ফডনিসের  সংলাপহীন কার্টুনের বই " Laughing Gallery"  সারা ভারতের কার্টুনিস্টদের কাছে পরিচিত। 
.............................................................................

বালাসাহেব ঠাকরে ও আর. কে. লক্ষণ ছিলেন একে অপরের কাজের গুণমুগ্ধ। দুজনেই প্রবাদপ্রতীম ব্রিটিশ কার্টুনিস্ট ডেভিড লোকে অনুসরণ করতেন। 
২০১০ সালে একটি স্ট্রোকের পরে  লক্ষণ যখন অসুস্থ, বালাসাহেব এসেছিলেন বন্ধুকে দেখতে তাঁর পুনের বাসভবনে। 

"  রাজনৈতিক নেতা বালাসাহেব ঠাকরে নন, কার্টুনিস্ট বালাসাহেবকে আমাদের বেশি পছন্দ। ঠাকরে পরিবারের সাথে বরাবরের  আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ওঁর প্রয়াত স্ত্রী মীণাতাই আমার বান্ধবী ছিলেন। ১৯৫০ সালে লক্ষণ ফ্রি প্রেস জার্ণালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় যোগ দেন। ওখানে চাকরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের দিকে ঝুঁকে থাকায় কাজের পরিবেশ ছিল না। 

দক্ষিণ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বালাসাহেবের দলের আন্দোলন, সেটির প্রকাশ‍্য  সমালোচনা  তাঁর সতীর্থ লক্ষণ কখনও করেননি। এমনকি, কোন কার্টুনও আঁকেননি।
মাঝে মাঝে অবশ‍্য বলেছেন, ও কি পাগল হয়ে গেল ? 
 অথবা, এতটা বাড়াবাড়ির কোন দরকার ছিল না। 
কিন্তু বন্ধুর রাজনৈতিক বাধ‍্যবাধকতা ভেবে বিষয়টা নিয়ে সোচ্চার হননি। 

 হয়ত, নীরব থাকাও একরকমের প্রতিবাদ। " 

 বলেছেন কমলা লক্ষণ।  আর. কে. লক্ষণের স্ত্রী। 

মৃত্যুর দুদিন আগেও বালাসাহেব ঠাকরের সঙ্গে ফোনে কথা হয় লক্ষণের স্ত্রীর। 
" আমি প্রস্থানের পথে। "  বালাসাহেব জানিয়েছিলেন তাঁকে। 
বালাসাহেব ঠাকরে ও আর. কে লক্ষণ প্রয়াত হন যথাক্রমে ২০১২  ও ২০১৫ সালে। 

.............................................................................

"  আমি একজন কার্টুনিস্ট। সকলে খবর পড়ে আর আমি খবরের ভিতরে থাকে যে খবরটা, তা দেখতে পাই।" 
পৃথীশ নন্দীকে দেওয়া একটি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি। 

" মানুষ আমার হুলটাকে নিয়েই ব‍্যতিব‍্যস্ত। কিন্তু আমি যে মধুটা তৈরী করি, সেটার আস্বাদ পায় খুব কম লোক।" 
 ছদ্ম আক্ষেপ করে বলেছিলেন বালাসাহেব। 

 বালাসাহেব ঠাকরের নির্বাচিত কার্টুন সংকলন  "ফটকারে" ( কশাঘাত )  প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২  সালের অক্টোবর মাসে। ১৯৪৭  থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত তাঁর  ব‍্যঙ্গের অভিব‍্যক্তি যে  মারাঠি মানুষকে আলোড়িত করেছিল, তাঁর প্রত‍্যক্ষ প্রমাণ এই বইটি। 
চার্চিল, স্ট‍্যালিন, টিটো, নাসের, মাও সে তুং থেকে নেহরু, ইন্দিরা, মহারাষ্ট্রের নানা রাজনৈতিক কুশীলবদের নানা কান্ডকারখানার তীর্যক অবলোকন রয়েছে এই কার্টুনের বইটিতে। 

পোস্ট  ;  ঋতুপর্ণ বসু
কৃতজ্ঞতা ;  প্রসন্ন মাঙ্গরুলকর

তথ‍্যসূত্র; 

The Sena Story by Vaibhav Purandare (Business Publications Incorporated)

 Marathi Manoos by Sujata Anandan  (Harpercollins)

 The Emergence of Regionalism in Mumbai: History of the Shiv Sena by Sudha Gogate (Popular Prakashan Private Limited )

মঙ্গলবার, ১১ মে, ২০২১

রেড ভলান্টিয়ার্স ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

১৯৪২ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বিধস্ত মানুষদের ত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পার্টির ডাকে গড়ে ওঠে পিপলস্‌ সাইক্লোন রিলিফ কমিটি। ১৯৪৩ সালের বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে পার্টির ডাকে আবার গড়ে ওঠে "পিপলস ফ্লাড রিলিফ কমিটি"। প্রথম কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হন কৃষকসভা,শ্রমিক সংগঠণ, ছাত্র -শিক্ষকরা, দ্বিতীয়টিতে যুক্ত হন মেডিক্যাল ছাত্ররা। 

১৯৪৫ সালের ১লা মে থেকে পি আর সি দপ্তরের বহির্বিভাগে প্রথমে বিনামূল্যে রোগী দেখা শুরু হলো। পরে ২আনা করে ফি ধার্য হয়। বহু স্বনামধন্য চিকিৎসকরা এই অভিযানে এগিয়ে আসেন। ওই বছরই শুরু হয় অ্যাম্বুল্যান্স বাহিনী। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে দাঙ্গার কারণে বহু মানুষ ঘরছাড়া হলে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার কাজও শুরু হয় পি আর সি-র উদ্যোগে। 

এর পরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকায় পিআরসি এর উদ্যোগ্যে স্বাস্থ্যশিবির খোলা হয় শরণার্থীদের জন্য। পার্টির ডাকে বহু চিকিৎসক যোগ দেন। দুটি উল্লেখযোগ্য নাম সূর্যকান্ত মিশ্র ও লক্ষ্মী সায়গল।

সারা পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ দেশে নিজস্ব ঢঙ্গে পথ চলার সময় প্রেরণার উৎস হিসেবে ১৮৭১ সালে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, শিশু রাষ্ট্র পারি কমিউনকে স্মরণ করে এসেছে। এই কমিউনকে  প্রতিবিপ্লবী আক্রমণকারী বুর্জোয়াদের (যাদের ঘাঁটি ছিল ভার্সাই) আক্রমণ থেকে বাঁচাতে প্যারিসের অলিগলিতে, পাড়ায় মহল্লায় গড়ে উঠেছিল জনগণের সশস্ত্র বাহিনী। নারী কমুনার্ডরা প্রথমদিকে আহতদের সেবা, এম্বুলেন্স সার্ভিস, কমিউনিটি ক্যান্টিন চালানো এই সব কাজে নিযুক্ত থাকেন,গড়ে ওঠে Union des Femmes pour la Defense de Paris et les Soins aux Blesses (দি ইউনিয়ন অফ উইমেন ফর দ্যা ডিফেন্স অফ প্যারিস এন্ড এইড টু দ্যা উন্ডেড)। 

সেই সময় থেকে পিপলস রিফিল কম্যুনিস্টদের কাছে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গণ্য। আর পাঁচটি এনজিও বা এফবিও এর সাথে এই রাজনৈতিক কর্মসূচির তফাৎ কোথায় সেটা বুঝতে গেলে ১৯৪৩ সালের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি পার্টি চিঠির অংশ উদ্ধৃত করা হল। শিরোনাম ছিল - - - "মহামারীর হাত হইতে বাংলাকে বাঁচাও/মেডিক্যাল স্কোয়াড গঠন কর" (বানান অপরিবর্তিত) 

(১) সহরে সহরে সভা ও শোভাযাত্রা করিয়া জনগনের মধ্যে মহামারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার বানী প্রচার কর। গভর্নমেন্ট যাহাতে আরও ঔষধ পত্রের ও চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করে তাহার দাবী জানাও এবং গভর্নমেন্ট ও মিলিটারী যেখানে সাহায্য দান করিতেছে তাহার সঙ্গে সহযোগিতা করিবার জন্য জনগনকে উদ্বুদ্ধ কর।
আমলাতন্ত্রের অব্যবস্থাই প্রধানত: দুর্ভিক্ষ ও মহামারী সৃষ্টি করিয়াছে। সেই মহামারী রোধ করিবার জন্য আমলাতন্ত্রই আজ আবার কাজ করিতে বাধ্য হইতেছে। ইহা আমলাতন্ত্রের পরাজয়ের নিদর্শন। সেই জন্য সেই কাজে সহযোগিতা করিলে আমলাতন্ত্রকে সাহায্য করা হয় না। ইহাতে আমলাতন্ত্রের পরাজয়কেই সাহায্য করা হয় এবং জনগনও রক্ষা পায়। 
(২) সমস্ত শ্রেণীর, সমস্ত দলের লোকের নিকট এই কাজে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাও।
(এখানে কংগ্রেস, লীগ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা, কর্মীদের কী আহ্বান জানাতে হবে, তার বিবরণ ছিল। উল্লেখ করলাম না। বড় হয়ে যাবে বলে।)
আমাদের প্রধান শ্লোগান হইবে মহামারীর হাত হইতে জনগনকে রক্ষা করিবার জন্য সকল দলের ঐক্য চাই। 
(৩) ঔষধের চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি কর।
(৪) ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্রদের মহামারীর বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ কর।

"মেডিক্যাল স্কোয়াড গঠন কর"
------------------------------------------------
(১) স্থানীয় এক এক জন ডাক্তারকে রাজী করাইতে হইবে যিনি স্কোয়াডের নেতা হইবেন। পার্টির আর তিন চার জন স্বাস্থ্যবান কর্মীকে শিক্ষা দেওয়া হইবে।
(২) স্কোয়াডগুলি পার্টি কর্মীদের চিকিৎসার কাজ প্রথম আরম্ভ করিবে। মনে রাখা দরকার যে, পার্টি কর্মীরাই যদি রোগে ভুগতে থাকে কিংবা মারা যায়, তাহা হইলে মহামারীর বিরুদ্ধে কোন লড়াই হইবে না, বরঞ্চ মহামারীই পার্টিকে গ্রাস করিবে।
(৩) এই সব স্কোয়াডের কর্মীদের অত্যন্ত সংযত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করিতে হইবে। স্কোয়াডগুলি রিলিফ কমিটির কাজ করিবে বটে, কিন্তু সবাই বুঝিতে পারিবে যে, এগুলি কম্যুনিস্ট পার্টির স্কোয়াড।

"হুঁশিয়ার! এ-সব কাজ করিও না।"
-------------------------------------------------
(১)অনর্থক রাজনৈতিক বাগ বিতন্ডা সৃষ্টি করিও না।.... আবার স্কোয়াডগুলি যে রাজনৈতিক আলোচনা করিবে না---তাহাও নয়। স্থান, কাল পাত্র বুঝিয়া রাজনৈতিক আলোচনা করিতে হইবে।
(২) কাজে, কর্মে, আলাপে পার্টিগত সংকীর্ণতার পরিচয় দিও না কিংবা পার্টি লইয়া বড়াই করিও না।
(৩) আড্ডা দিয়া সময় নষ্ট করিও না।
(৪)স্থানীয় পার্টি ইউনিটের উপর মাতববরি করিও না।

ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি এই পিপলস রিলিফ কাজের একটি বিরাট ঐতিহ্যবাহী লিগ্যাসি পরম্পরা বহন করে। ১৯৪৩ এর কমিটির স্বেচ্ছাসেবক থেকে আজকের রেড ভলান্টিয়ার - সবাই জনগণের পাশে তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়ান ত্রানকাজে এটা জেনেই যে তাদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা অপ্রতুল। তবুও জনগণের বিপদের সময় ঘরে বসে  বিবৃতি না দিয়ে (সেই সময় ফেসবুক ছিল না) তারা জীবন তুচ্ছ করে রাস্তায় নেমেছিলেন এটাই বোঝাতে যে ভূস্বামী-পুঁজিপতিদের পরিচালিত সরকার ও তার আমলাতন্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বারবার ব্যর্থ। কারণ তাদের শ্রেণী চরিত্রই এই ব্যর্থতার মূলে। 

তাই আজ ২০২১ সালে অক্সিজেন এর কালোবাজারি হয় দেশ জুড়ে, যার পয়সার জোর আছে সে কিছুটা সেবা কিনতে পায়, যার নেই সে পথে বসে মরে। শত বিজ্ঞানীর সাধনার ফল ভ্যাকসিন শেষ পর্যন্ত মুনাফা কামানোর একটি হাতিয়ার মাত্রে পরিণত হয়। এই সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই রাস্তায় নামা রেড ভলান্টিয়ারদের। পাঁচ বছর বাদে ভোটের সময় কে এই সেবা কাজের কথা মনে রেখে কাস্তে-হাতুড়িতে বোতাম টিপবে সে জন্য "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য" মনোভাব নিয়ে রেড ভলান্টিয়াররা রাস্তায় নামছে না। বামপন্থায় আস্থা রাখা প্রতিটি মানুষের কাছে আবেদন এদের উৎসাহ দিন - এরা আমার আপনার ঘরের ছেলেমেয়ে। এরা পারি কমিউন এর সেই অসীম সাহসী কমুনার্ডদের উত্তরাধিকারী। এদের সবাইকে লাল সেলাম।

[পার্টি চিঠির জন্য কৃতজ্ঞতা: কমরেড ডা: Avijit Dasgupta  ও।সাংবাদিক চন্দন দাস]

#RedVolunteers 

নির্বাচনের খরচ খরচা ~ সুশোভন পাত্র

- মিনিমাম ৪০-৪৫ লাখ খরচা করার ক্ষমতা না থাকলে ইউটিউবে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দেবেন না। লাভ নেই! আর এই বাজেটেও আপনার বিজ্ঞাপন ৪.৫ মিলিয়নের বেশি ইউনিক ইউজারের কাছে পৌঁছাবে না, ২০ মিলিয়নের বেশি টোটাল ভিউ হবে না। সার্ভিস ক্লসের জন্য আমি বলতে পারবো না যে তৃণমূল-বিজেপি ইউটিউবের বিজ্ঞাপনে কত টাকা খরচা করছে। শুনলে আপনাদের মাথায় হাত পড়ে যাবে!       

ফোনের অপর প্রান্তে যিনি কথাগুলো বলছিলেন তিনি আমাদের দেশের গুগলের পলিটিক্যাল বিজ্ঞাপনের মার্কেটিং হেড। ইউটিউবে তৃণমূল-বিজেপির বিজ্ঞাপনের বাজেট সম্পর্কে প্রাথমিক একটা ধারণা করতে চাইলে শুনুন, নির্বাচনী প্রচারের মোটামুটি ৫০ দিনে আপনি যদি ইউটিউব সার্ফ করে কমপক্ষে ৫০ বার তৃণমূল-বিজেপির বিজ্ঞাপন দেখেছেন তাহলে বাজেটটা ৫ কোটি। আর দিনে ২ বার করে গড়ে ১০০ বার দেখে থাকলে ১০ কোটি। 

- ২০ হাজার সেকেন্ড বিজ্ঞাপনের জন্য আমাদের FM চ্যানেলের কোটেশন হল ২০ লাখ! 

ফোনের অপর প্রান্তে যিনি কথা গুলো বলছিলেন তিনি কলকাতার জনপ্রিয় FM চ্যানেলের মার্কেটিং টিমের কর্মী। মানে একটা FM চ্যানেলে, আপনার একটা ২০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন, নির্বাচনী প্রচারের ৫০ দিন, সকাল ৭ থেকে রাত ১২টা, মোট ৮৫০ ঘণ্টায়, গড়ে ১ বার করে প্রায় ১০০০ বার চললে, খরচা ২০ লাখ। ৫টা FM চ্যানেলে হলে ১কোটি। যারা শহর বা শহরতলি তে FM শোনেন, তারা জানেন নির্বাচনী প্রচারের ৫০ দিনে যে কোনও FM চ্যানেলে ঘণ্টায় ১০ বার তৃণমূল-বিজেপির বিজ্ঞাপন শোনাটা জাস্ট জল ভাত! 

KMC-র ওয়েবসাইট ঘাঁটলে দেখবেন ৮০০ sq ft পর্যন্ত কলকাতা শহরে হোর্ডিং বিজ্ঞাপনের ট্যাক্স, লোকেশন অনুযায়ী ১.৮-৩ লাখের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আচ্ছা নির্বাচনী প্রচারের সময় শহর কলকাতা তে তৃণমূল-বিজেপির বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং-র সংখ্যা কত ছিল? ৫০০ ধরলে খরচাটা ১০ কোটি। ১০০০ ধরলে ২০ কোটি।  

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের তথ্য অনুসারে স্রেফ মার্চ মাসে দিল্লির রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেছে প্রায় ১৫০টি চার্টার্ড বিমান। কত খরচা হয় দিল্লি থেকে কলকাতার চার্টার্ড বিমান সার্ভিসে? আনুমানিক ১২ লাখ। আর এই যে ভোটের মরশুমে বাংলার আকাশে কাক-চিলের মত দাপিয়ে বেড়াল হেলিকপ্টার! তার খরচা? ১.৫লাখ/ঘণ্টা। 

না ঘাবড়াবেন না। তৃণমূল-বিজেপির নির্বাচনী খরচা সম্পর্কে এই অবধি আপনি যা শুনলেন, সেগুলো জাস্ট টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। এর মধ্যে টিভি, প্রিন্ট-মিডিয়া, অন্য ডিজিটাল স্পেস, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখই নেই। আই-প্যাক কিম্বা অ্যাসোসিয়েশেন অফ বিলিয়ন মাইন্ডস-এর মতো বিভিন্ন পেশাদারী সংস্থার খরচার উল্লেখ নেই। প্রার্থীদের নিজের বিধানসভা কেন্দ্রের কোন খরচা উল্লেখ নেই। আন্ডার দা টেবিল কোনও খরচার উল্লেখ নেই। কেন্দ্রীয় ভাবে তৃণমূল-বিজেপির মতো রাজনৈতিক দলগুলির খরচার উল্লেখ নেই। আসলে সব মিলিয়ে বাংলার সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি ঠিক কত টাকা খরচা করছে, তার কোন হিসেবই নেই! 

কোথা থেকে আসছে এতো টাকা? বিজেপির না হয় ইলেক্টোরাল বন্ড? PM Cares? কিন্তু 'লেসার ইভিল' তৃণমূলের? বালি খাদানের মাফিয়া রাজ? কয়লার কালো বাজারি? না গরু পাচারের সিন্ডিকেট? আচ্ছা বুকে হাত রেখে বলুন তো, নির্বাচনের পর বহু রাজনৈতিক পণ্ডিতরা তো ফেসবুকে, মিডিয়ার প্রাইম-টাইমে সিপিএম-র পিণ্ডি দান করছেন, তাঁদের কাউকে তৃণমূল-বিজেপির এই বিপুল নির্বাচনী খরচার স্বচ্ছ হিসেব চাইতে দেখেছেন? যে 'নো ভোট টু ওয়ালারা' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ক্লাসিক্যাল বামপন্থী  'ক্লাস ক্যারেক্টারের' রিফ্লেকশন দেখতে পান তারা কি এই ব্যায়ের হিসেব চাইতে পারবেন? আছে হিম্মত?  
কী বলছেন? অ্যাপোলোজেটিক? আজ্ঞে না! শুষ্ক সিম্প্যাথির জন্য এসব বলছি? আজ্ঞে না! সিপিএম-এর টাকা নেই তাই হেরে যাচ্ছে টাকা থাকলে জিতে যেত, এটা বলতে চাইছি? আজ্ঞে না। বরং আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাইছি, কেবল নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর নয়, সিপিএম দীর্ঘদিনই সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচনী অ্যায়-ব্যায়ের এই পক্ষপাতদুষ্ট বিষয়টির বিরুদ্ধে লড়ছে, অন অ্যান্ড অফ দি ফিল্ড। ঠিকই, লড়ে হারছে, হোঁচট খাচ্ছে, আঘাত পাচ্ছে, শিখছে; কিন্তু তারপর, আবার লড়ছে। অ্যাটলিস্ট গ্যালারি তে বসে 'লেসার ইভিল'এর নামে লেজুড় বৃত্তি করছে না!

'লেসার ইভিল'এর তাত্ত্বিকদের অবগতির জয় জানাই, বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এন.ডি.এ সরকার ক্ষমতায় এসেই, 'ন্যাশনাল এজেন্ডা ফর গভর্ণেন্স'র ২২নং অনুচ্ছেদে, 'গোস্বামী কমিটির' সুপারিশের ভিত্তিতে এই নির্বাচনী ব্যবস্থা কে দুর্নীতি এবং অপকর্ম মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রবীণ সাংসদ ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত'র নেতৃত্বে, সোমনাথ চ্যাটার্জি, মনমোহন সিং-দের নিয়ে গঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি। 

সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক শেষে; মেম্বারশিপ ফিজ ছাড়া পার্টি ফান্ডে সমস্ত প্রাইভেট অনুদান বন্ধ, শুধুমাত্র সরকারি বরাদ্দ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলির নির্বাচনী তহবিল গঠনের আইনানুগ বাধ্যবাধকতা, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের রাজ্য শাখায় নির্দিষ্ট এবং সমান ভর্তুকি প্রদানসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবের পাশাপাশি কমিটি সেই রিপোর্টে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিল, ভবিষ্যতে সরকারি বরাদ্দের মধ্যেই সম্পূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা কে সীমায়িত করা না গেলে এই দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। 

খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, সেদিনও সিপিএম সহ বামপন্থী দলগুলি ছাড়া পার্টি ফান্ডে কর্পোরেট ডোনেশেন বন্ধের প্রস্তাব সমর্থন করেনি কেউ। বিজেপি-কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ নিজেও। স্বাধীন ভারতের অন্য অনেক কমিটি আর কমিশনের পাতা জোড়া রিপোর্টের মতোই, ঐ রিপোর্টেরও জায়গা হয়েছে ডাস্টবিনেই।

আর আপনার যারা কেউ কেউ সিপিএম-এর রোগ সারানোর জন্য মিডিয়া কিম্বা ফেসবুকে ফুটেজ খাচ্ছেন, দশ-বারো দফা প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছেন; যারা ঠাট্টা করছেন, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন, খিল্লি করছেন, খিস্তি করছেন, অলঙ্করণে ব্যক্তি আক্রমণ করছেন, তরুণ তুর্কি থেকে সো-কলড 'পক্বকেশ', পলিটব্যুরো থেকে সিপিএম দরদী শিল্পী-সাহিত্যিক এমনকি লেনিন-স্তালিন কাউকেই বাদ দিচ্ছেন না; তাদের সকলের সমালোচনা কে স্বাগত জানিয়েই মনে করিয়ে দিই, আপনারা সিপিএম-এর লড়াইটা যতটা সহজ ভাবছেন, যতটা লিনিয়ার ভাবছেন ঠিক ততটা নয়! রাজনৈতিক নাবালকত্ব কাটলে নিশ্চয় বুঝবেন! 

ধৈর্য্য ধরুন। যদি মনে হচ্ছে বহু ধৈর্য্য আপনি ধরে নিয়েছেন এবার অধৈর্য্য হওয়াই আপনার পবিত্র কর্তব্য পারলে তাহলে একটু ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন, ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের রক্ত-ঘাম-অশ্রু-আত্মত্যাগের বিশাল ইতিহাস। সেই ইতিহাসের প্রতি বাঁক বামপন্থীদের জন্য সুখের ছিল কি? ২০০৯-২০২১ যে প্রবল আক্রমণ ও সন্ত্রাসের মুখে সিপিএমের অসংখ্য কর্মী সমর্থকদের এ রাজ্যে পড়তে হয়েছে ভূ-ভারতে জ্ঞানত তার কোন তুলনা আপনারা দিতে পারেন কি?

সিপিএম-এর নিশ্চই দুর্বলতা আছে, সাংগঠনিক ও কৌশলগত ত্রুটিও আছে। নির্বাচনী পরাজয়ে তার মুখ্য দায়ও আছে। কিন্তু সার্বিক ভাবে সেই সমস্যার বিশ্লেষণ করা, সমাধান খোঁজা এবং প্রয়োগের কাজ ধারাবাহিক ও জটিল। আপনি যদি বামপন্থীদের নির্বাচনী পরাজয়ের সমব্যথী হন তাহলে নির্বাচনী পরাজয়ের পর সমস্যা গুলো সিপিএম নেতৃত্বের বা সদস্যদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে বরং আসুন সেই ধারাবাহিক ও জটিল প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করুন। খামকা ফেসবুকে কিম্বা মিডিয়া তে টেনিদা সেজে হতাশার চাষ করবেন না।  

হতাশ লাগলে একঝাঁক বামপন্থী তরুণ তুর্কি প্রার্থীর কথা ভাবুন, যারা এই ভোগবাদী সমাজের মধ্যে থেকেই পার্টির জন্য নিজেদের কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে এই কঠিন লড়াইর ব্যাটন তুলে নিয়েছে। হতাশ লাগলে লকডাউনের সময়, অনলাইন জনস্বাস্থ্য, পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য, শ্রমজীবী ক্যান্টিন, বিনামূল্যে বাজার, আম্ফানের ত্রাণ -রাজ্যের প্রতি কোণাতে বামপন্থীদের মানবিক উদ্যোগে যে অসংখ্য নতুন মুখের ভিড় এসেছে তাঁদের কথা ভাবুন। হতাশ লাগলে, এই কোভিড সংক্রমণের বারুদ স্তূপে বসে যে হাজার হাজার বামপন্থী ছেলে মেয়ে রেড ভলান্টিয়ার্সের কাজ করছেন তাঁদের কথা ভাবুন। বামপন্থী কর্মী-সমর্থক-দরদী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন তো, তাহলে শৃঙ্খলাটা শিখুন। সদস্য নাই বা হলেন। 
আসল কী জানেন, কমিউনিস্ট পার্টি তো। সদস্য হয়ে কেউ শৃঙ্খলা শেখে না। শৃঙ্খলা শেখে বলেই সদস্য হয়।