শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৩

ভানুকাকার তেইশ-ছাব্বিশ - প্রদীপ দাশগুপ্ত

মানুষপুর।

স্থানীয় নাগরিক কমিটি বছরে যে ক’টি অনুষ্ঠান নিষ্ঠাভরে পালন করে থাকে, তার মধ্যে বছরের শুরুতেই আসে তেইশে জানুয়ারি। আর তার পরেই ছাব্বিশে।
তেইশে, সুভাষ বসুর জন্মদিনে, প্রধান বক্তা হিসাবে ডাকা হ’ল যথারীতি আমাকেই। যেহেতু, এলাকার একমাত্র হাইস্কুলের আমিই প্রধান শিক্ষক।
আমি সবিস্তারে বললাম ওঁর দীর্ঘ জীবনের বীরত্বের কাহিনী। কিভাবে কংগ্রেস ছেড়ে, ফুয়েরার হিটলারের রণ-মিত্র-দেশ জাপানে গিয়ে, - শেষমেশ – রাসবিহারী বসুর কল্যাণে - আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতাজী হয়ে ওঠা; এ-সবই বললাম। আমার নজর পড়েছিল বাচ্চাদের দিকে। তাই তাদের ভালোলাগার মত করেই বললাম। এতে শুধু বাচ্চারা নয়, বড়রাও সশব্দ হাততালিতে অভিনন্দন জানালেন।
সভার শেষে গোল বাধল ভানুকাকাকে নিয়ে! সবার সামনেই চীৎকার করে বলে উঠলেন,-‘হারামজাদা, ভুলইয়া গ্যাছস, তুই এককালে একখান কালেজে রাষ্ট্র-বিজ্ঞান পড়াইতিস?’
সভাপতি-সহ উপস্থিত সবাই ওকে নেহাতই খুড়ো-ভাইপোর ব্যাপার হিসাবে নিয়ে মজা পেলেও, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম যে,  ওই সম্ভাষণটা ছিল নিছক ভূমিকা মাত্র। বাড়ী যাবার পরে, আমার কপালে দুঃখ আছে।  
বাড়ি ফিরে আমিই বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান, তাঁরা তো কেউ রাজনীতি করেননা। নাগরিক কমিটির অনুষ্ঠান দু’টির পিছনে প্রেক্ষিত হিসাবে রাজনৈতিক ইতিহাস থাকলেও, যেহেতু এখানকার নাগরিকগন এমন এক আর্থ-সামাজিক ধাপের মানুষ, দেশের শাসনকারী-প্রভুদের ঘেন্না-ধরানো রাজনীতিতে প্রভাবান্বিত হয়ে, রাজনীতির প্রতি বিবমিষা প্রকাশটাকেই এঁরা সুবিধাজনক মনে করেন। অতএব, পূর্বোক্ত দু’টি অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বিশুদ্ধ অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান হিসাবেই তুলে ধরার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালান। একটা অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে আমি কি করে .... ।
শেষ করতে না দিয়েই ভানুকাকা পড়লেন আমাকে নিয়ে।
 ‘অরে গাধা, এমন এক অসমান সমাজে অরাজনৈতিক কোন কিছু যে হয় না, হেয়া তুই জানস না? প্রকাশ্য দিবালোকে – মাইকে-মুখ-দিয়া তুই কইতে পারলি – তারা-তো কেউ রাজনীতি করেন না? সব শালা করে, লুকাইয়া করে, শোষক-শ্রেণীর মগজ-শাসনে নিজের অজান্তেও করে। নিজেদের শ্রেণী-অবস্থান টিকাইয়া রাখনের স্বার্থে, নিজেরেই ঠকাইয়া মিছা কথা কয়। এইয়ার নাম ভদ্রলোক। বোঝজো?’ বলতে লাগলেন যে, কেন রাজনীতি শব্দটা  ওঁদের কাছে ‘ট্যাবু’। ‘চউক্ষে কি দ্যাখতে পাওনা, দ্যাশের শাসকরা, দ্যাশের মাইষের টাকা লূঠ কইরা ক্যামনে ল্যাংটা হৈয়া নাচে? নিজেগো কামড়া-কামড়ি থিকা - দুই-একখান ধরা পড়লে,  নিজেগো কাগজ দিয়াই প্রচার চালায়,- কয় – “কেলেঙ্কারি”। ,  হে তো ক্যাবল, টিপ-অব-দি-আইসবার্জ! নিজেগো এক ভাগের বিরুদ্ধে এই বদনাম-এর পিছনে কৌশলডা কিয়ের লেইগগা? ভাবজোস কোন দিন? এই সকল পোলিটিক্যালি আধা-সেন্সিটিভ মানুষগো,- “সব-ঝুট-হ্যায়”-মার্কা এক দর্শনে পৌঁছাইয়া দিতে। অহন তো প্রচারের আর এক কায়দা ধরছে, হ্যাগো মুখ দিয়া এই কথা বাইর করতে সফল হইছে যে, - যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবন; দ্যাখতেই পায়না, – কে-কোন সোসিও-ইকনমিক ক্লাসের সেবা করে!  হ্যাগো ওই কৌশলেই তো এ্যারা অ-রাজ-নোইতিক! হেয়া বোজোনা?’
 ‘সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়’,- কে বলেছিল? বাম-ডান, হিন্দু-মুসলিম ,- চরম-নরম, - সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়ে উনি কোন শ্রেণীর স্বার্থে ঘা দিচ্ছিলেন, কার কার ষলা-ষড়যন্ত্রে উনি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন?  দেশেরই স্বাধীনতার জন্য লড়তে গিয়ে ওঁকে দেশটাই কেন ছাড়তে হ’ল? যারা আজ ওঁকে মহান দেশপ্রেমিক নামে ডেকে প্রায় পুজা বেদীতে বসাচ্ছেন, কেন তাদের একথা ভুলে যাওয়া সুবিধাজনক  মনে হয় যে, স্বাধীনতার পরেও, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানীদের শাস্তি দেবার জন্য বিচার সভা বসে?  কেন স্বাধীন ভারতে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানীদের মুক্তির জন্য বামপন্থীদেরই আন্দোলন করতে হয়েছিল? ‘এসবই হইল গিয়া বিরাজনীতিকরণের কায়দা। হ্যারা  প্রকৃত গণতন্ত্রে, – অর্থাৎ সকল মানুষের অধিকার-কর্তব্য-সচেতনায় ভয় পায় দেইখাই, - মুখে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র শান্তি-শান্তি কইরা গলা ফাডায়। এগো ভন্ড কইলে প্রকৃত ভন্ডগো, চোর কইলে চোরেগো অপমান হইব ’।  মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, মায় নাতিনাতনি-সহ, সকলের সামনেই বিস্তর গালি-যোগে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে, এ ভাবেই, ভানুকাকা প্রায় তিন ঘন্টা ধরে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন।  
     
          দ্বিতীয় তারিখটিতে, “আজকের প্রজাতন্ত্র দিবসে ---”  ইত্যাদি বলে গলা ফাটিয়ে যিনি এতক্ষণ ঘোষণা করছিলেন, সভাপতি তাঁর কানে কানে কি যেন বলতেই, তিনি দুম করে ‘সংক্ষিপ্ত’ বক্তা হিসাবে ঘোষণা করে বসলেন ভানুকাকার নাম। আমি প্রমাদ গণলাম। ভানুকাকা আজ  ইউনিভার্সিটির ক্লাস-রুম না ভেবে বসেন। এইসব ভদ্রমানুষজনেদের ‘বোর’ না করে ছাড়বেননা। এঁদের মনের মত করে, ভানুকাকা কি করে এমন এক বিষয়ে অরাজনৈতিক বক্তৃতা পরিবেশন করবেন? তা’ও আবার, সংক্ষেপে?
যথারীতি, বক্তৃতার শেষে, বাচ্চারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। বড়রা বেশির ভাগই মুখ নীচু। আর সভাপতি এবং তাঁর পাশে দাঁড়ানো কয়েকজনের শুধু নিদারুণ-কষ্টের-হাসিমুখ নিয়ে গদ্গদ ভানুকাকার দিকে তাকিয়ে। সভাপতির তোয়াক্কা না করেই, ঘোষকই – মাইকে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট উচ্চারণ করলেন,-‘সভা শেষ’।
আমি এমন শ্রুতিধর নই যে ভানুকাকার দীর্ঘ বক্তৃতার সবটাই আপনাদের কাছে পরিবেশন করব সংক্ষিপ্ত-সারটাই আপনাদের জানালাম।
ভানুকাকা প্রথমে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটা নিয়েই পড়লেন। প্রজাতন্ত্র আবার কি? সাধারণতন্ত্র। শব্দটা রাষ্ট্রনৈতিক। সাধারনে যাকে বলে রাজনৈতিক। এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শব্দ। প্রজাতন্ত্র  বললেই তো রাজার কথা চলে আসে। ইংরাজি শব্দটা হ’ল – “রিপাবলিক”,- ‘হ্যোয়ার দেয়ার ইজ নো মনার্ক, এ্যান্ড সুপ্রিম পাওয়ার ইজ ভেস্টেড উইথ দ্য পিপল’। আমি মনে মনে বললাম কি সব্বোনাশ! এ তো মারাত্মক কথারে বাবা, চরম ক্ষমতা থাকবে দেশের মানুষের হাতে!
‘রাজা থাকবে না; চূড়ান্ত ক্ষমতা থাকবে মানুষজনের হাতে’, ভানুকাকা বললেন। ‘অনেকে জিগাইবেন, হেইডা আবার ক্যামনতারা কথা? ক্ষ্যামতা তো হগলডিই – রাজার! জিগাইবেন,- তুই বইয়ের কথাগুলান এইরোম মাথায় ধইরা রাখোস ক্যান? মরবি, মরবি! এইয়াই হইতেছে দেশের একেবারে গোড়ার সমস্যা! বিচ্ছিন্নতাবাদ! বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞানচর্চা পইড়া থাকে একদিকে। ব্যবহারিক আচার-আচরণ হাঁটে আর একদিকে! উচ্চারণ আর আচরণের এই বিচ্ছিন্নতাবাদ,- শুধু দেশে বা সমাজে নয়, পেশার ক্ষেত্রে – এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও নানান আপদের আমদানি করে।
খুব রেগে গেলে, ভানুকাকা মাতৃভাষা ছেড়ে, বেশীরভাগ সময়ে, ক্লাস-নেবার সময়কার শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করেন। ভানুকাকা বলে চলেন,-‘অধিকাংশ দেশেই সকল মানুষকে - স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে রাজাকে খেদিয়ে দেওয়া হ’লে কি হবে? দেশের মানুষ সে স্বাধীনতা কাকে বলে শাসকরা তা বুঝতে দিতে চাইলেই তো? অল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী যাঁরা শিক্ষার সুযোগ তথা সব ব্যাপারটা বোঝার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাও নিজশ্রেণী স্বার্থ ব্জায় রাখতেইবুঝতে চাননা। বেদের আমলের ধ্যান-ধারনার অভ্যাসে, মগজে রাজশাসনও অবিকল ছাপ নিয়ে আছে। রাজা যায়। রাজার আমলের সংস্কৃতি অর্থাৎ - শুধু গান-বাজনা না,- ভাবনা-চিন্তা-আচরণ দিব্যি জাঁকিয়ে বসে আছে। রাজভক্তি আর মগজ থেকে যেতেই চায়না! এখনও বহু রাজাকেই ঠাকুর-দেবতা সাজিয়ে পূজা করে!  এমনকি, নিজের ছেলের নামও, পরম স্নেহে রাখেন – ‘রাজা’! তো, এহেন মানুষদের কি করে বোঝান যাবে গণতন্ত্রের রূপে সব মানুষের স্বাধীনতা? ‘সাধারণতন্ত্র-দিবস’-কে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? সাধারন মানুষ তো প্রশ্ন করতেই পারে। মুশকিল হচ্ছে,- আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, (আমি স্বগতোক্তি করি, মরেছে, বক্তৃতাতেও আবার আমাকেই আক্রমণ!) হে-তো হ্যাডমাষ্টার, হ্যাও বাদ যাননা। এ-গো বোঝানো রীতিমত মুশকিল যে, উচ্চারিত শব্দগুলো আসলে,- একজনের চিন্তার – অর্থাৎ - মগজের ‘হার্ড-ডিস্কে’,- আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের পেয়াদাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব-পরিবেশের দ্বারা  আগের থেকেই ‘প্রোগ্রাম’ করা চিন্তার প্রকাশ মাত্র।  ‘প্রজাতন্ত্র’ কথাটার মধ্যে ‘প্রজা’ শব্দটাই - মনের গোপন কোনে – অবচেতন মনে - চাগিয়ে তুলবে ‘রাজা’-সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণাগুলো। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র ক’ন,- এদেশে গণতন্ত্র অনেকখানি বিকাশ লাভ করিয়াছে। কোন পর্যন্ত? ভোটদান পর্যন্ত? ভোটদানের পিছনে, বিচার-বুদ্ধির বিস্তার কতদূর? যাকে ক্ষমতা দিলাম, তিনি বা তার দল গণতন্ত্রের পক্ষে, অর্থাৎ - বেশীরভাগ মানুষের পক্ষে কাজ করেন কিনা, তার দৈনন্দিন খবর  নেবার সময় খরচ করতে আমরা রাজী থাকিতো? এই রকম খবর রাইখা ভোট দেওয়া মানেই যে এই রকম - চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রয়োগ,- এইডা যদ্দিন না বুঝতাছেন, যদ্দিন এই দায়িত্ব বুঝিয়া না লইতেছেন- তদ্দিন গণতন্ত্র ঠিক মতো মগজে জায়গা পাইবনা। গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণাগুলান – পোলাপানের মতো ইমম্যাচিওরই থাকবো। এ সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ধারণা মগজে জায়গা  না পাইলে কি হয়?’ প্রশ্নটা তুলে, জবাব দিলেন ভানুকাকা নিজেই।
‘মগজে ভরা রাজা।- রাজার আমলের ধারণায়, জান-মালের সব দায়িত্ব রাজার। এদিকে রাজা তো খুঁইজা পাইতেছেন না। কি করা যায়? নিজেদের হাতে দায়িত্ব নেবার জন্য মগজ তৈরী হয় নাই। কারে দায়িত্ব দেওয়া যায়? ক্যান? একজন – অমুক-বাবা, অমুক-মা, কি একজন দাদা-দিদি হইলেই চলে। অতএব, কলৌ নামৈব কেবলম! কলি কালে নামই শ্রেষ্ঠ,নাম করলেই চলব। মন্ত্র-তন্ত্র, ধ্যান-জ্ঞান, পূজা-পদ্ধতি,- কিছুই জানার দরকার নাই। শুধু নাম করলেই চলব। এইয়ার চাইয়া সুবিধাজনক আর কি হইতে পারে! ব্যক্তিগত জীবনের এই আধ্যাত্মিক-ভক্তিবাদ যদি রাজনীতিতে আমদানি করি , তা’ হইলে তা’ হইবে আধ্যাত্মিক্তার ক্যারিকেচার। এই ক্যারিকেচারের পাপেই কপাল ভাঙ্গবে।
তখন আর,- পোলাটা ক্যান চাকরি পায়না, লাখের বেশি টাকা খরচ করিয়া যে পোলাটারে কম্প্যূটার-ইঞ্জিনিয়ার বানাইলাম – তারে ক্যান ভূতের মতন খাটাইয়া – একজন রাজমিস্ত্রির মজুরি দিতেও মালিক রাজি হয়না, ক্যান খাদ্যের-ওষুধের দাম বাড়তেই থাকে, দ্যাশের কারখানা বন্ধ হয়, আর বিদেশের ছাপমারা জিনিষে বাজার ছাইয়া থাকে,- এই স ক ল প্রশ্নের জবাব পাউবেন না!
অন্যদিকে,- অহন আবার, রাষ্ট্র-বিজ্ঞানে পড়া শব্দগুলার মানেটাই বদলাইবার আমল চলতাছে।  পৃথিবীর নানান দ্যাশে গণতন্ত্র আছে কিনা পরীক্ষা নেওয়ার এক স্ব-ঘোষিত মুরুব্বি জুটছে। তার কাছে, দ্যাশে দ্যাশে গণতন্ত্রের বেদী স্থাপনের মানে হইল গিয়া, সে দ্যাশটাতে দাঙ্গা লাগাইয়া, একটা হট্টচট্ট পাকাইয়া, নির্বাচনে রিগিং কইরা, নিজেগো দালাল বসানোর ঠিকা নিছে; যাতে সে মুরুব্বি তাদের সুবিধা মত, সে দ্যাশটারে পরাণ-ভইরা লুঠ করতে পারে। ইরাক থিকা ইউক্রেন – একই জিনিষ দ্যাখতেপাইবেন! আবার, ‘এম্পায়ার’ শব্দটারও, নতুন অর্থ আমাগো শিখানোর লাইগা, একদল বুদ্ধিজীবীরে কামে লাগাইছে। আর, এই পোড়া বাংলায় তো, হ্যাগো মাইষে আমাগো শিখাইবার জন্য উইঠা-পইড়া লাগছে, যাতে দলতন্ত্রের হিটলারী-পণারেই  আমরা গণতন্ত্র বলিয়াই মানিয়া লই’।      
 ভাক্তি যোগ্যরে ভক্তি করা খারাপ না। ঐটা দরকার। তবে, এইখানে, আমগো সকলেরই প্রণম্য, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের একখান কথা আপনেগো মনে করাইয়া দিতে চাই। শাস্ত্রী মশয় কইছেন,- “ভক্তিবাদ গাঢ় হইয়া একবার মস্তকে প্রবেশ করিলে লোকের বুদ্ধিখানি উচ্চতর সমালোচনায় কিরূপ অপারগ হয় তাহা আমরা প্রত্যহ দেখিতে পাইতেছি”। আইজও কি আমরা দেখিনা? আমরা নিজেরাই কি ‘গাঢ ভক্তিবাদে আক্রান্ত না? সন্দেহ নাই , এয়াতে সুবিধার অন্ত নাই। পড়া-জানা-বোঝা ,- কিছুরই দরকার নাই; ঐ যে আগেই কইছি,- মন্ত্র-তন্ত্র-ধ্যানজ্ঞানের দরকার নাই!
সুবিধা, সুবিধা, সুবিধা। অতএব, এই সুবিধাবাদেই আমরা গা ভাসাইলাম। এয়াতে আর যাই হউক।‘প্রজাতন্ত্র’ সফল হইতে পারেনা। বুদ্ধি,- কারো কম কি বেশী থাহেনা। যে যতটা কাজে লাগায়, তারে তত বুদ্ধিমান কয়। আমার ফার্ভেন্ট আপীল,- বুদ্ধি কামে লাগাইয়া, ওই চূড়ান্ত, ক্ষমতা,- এই সবের দায়িত্বটা একটু বুঝিয়া ল’ন। প্রজাতন্ত্ররে সফল করেন।
‘শেষ প্রশ্ন”। না, ভয় পাইয়েন না, আমার না,- “অমর কথা শিল্পী শরৎচন্দ্রের”। [মাইক থেকে মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নীচু স্বরে বললেন, ‘শরৎচন্দ্র কি ল্যাখছেন শোন, একটু মেমরাইজ করিস’।]
শরৎচন্দ্র লিখছেন,- ‘মানুষে অনেক ভুল, অনেক ফাঁকি নিজের চারপাশে জমা করে স্বেচ্ছায় কানা হয়ে গেছে। আজও তাকে বহু যুগ যুগ ধরে অনেক অজানা সত্য আবিষ্কার করতে হবে, তবে যদি একদিন সে মানুষ হয়ে উঠতে পারে’।
এইখানে উপস্থিত সকলেই আপনেরা সম্মানিত মানুষ, শ্রদ্ধেয় মানুষ; আপনেগো কওয়ার অধিকারি বলিয়া – আমি নিজেরে মনে করিনা। কিন্তু, আমার ভ্রাতুষ্পুত্র,- তিনিও একজন সম্মানিত। প্রধান শিক্ষক। কিন্তু, পরিবারে - আমি তার গুরুজন। - পুরানা সমাজের সেই হিসাবের সূত্রে তারেই কই যে, তুই দেবানন্দপুরের কুলাঙ্গার! দেবানন্দপুরের মানুষ হইয়া শরৎচন্দ্ররে পড়স না, জানস না, চিনস না?  নিজের চৌদিকে ‘ফাঁকি’ জমাইয়া ‘কানা’ হইয়া থাকবি?    
কয়েক সেকেন্ডের ‘পজ’ দিয়ে ভানুকাকা মন্ত্রের মতন করে উচ্চারণ  করলেন,- ‘সকলকে প্রণাম।’    
সভা শেষে, বাড়ী আসা পর্যন্ত গোটা রাস্তাটাই ভানুকাকা নিঃশব্দে এলেন। ভাবলাম, যাক বাবা, নিজের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে, ভানুকাকা নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়েছেন। আমার ফাঁড়া কাটল!
বাড়ীতে ঢুকতে না ঢুকতেই হাঁক দিলেন,-‘বৌঠান! অর কাকিরে ক’ন তো, আমার ল্যাখার নূতন খাতাটা লইয়া আসতে!’
কাকীমা নয় , গোলমাল আন্দাজ করে বোধ হয়, – আমার মাতা ঠাকুরাণীই স্বয়ং ফাইলটা নিয়ে এলেন। তা’ থেকে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে, বললেন, ‘গাধা, পড়’!
এ কি! এ যে রবিঠাকুরের একগাদা উদ্ধৃতি। ‘বাতায়নিকের পত্র’। .মাথাটা ঘুলিয়ে গেল,- দেশ, সাধারণতন্ত্র, সার্ব্বভৌমত্ব, শরৎচন্দ্র,- শেষে – রবীন্দ্রনাথ! ওফ!
  “৫ই জৈষ্ঠ, ১৩২৬” (ইং ১৯১৯) “জাহাজের খোলের ভিতরটায় যখন জল বোঝাই হয়েছে – তখনি জাহাজের বাইরের জলের মার সাঙ্ঘাতিক  হয়ে ওঠে। ভিতরকার জলটা তেমন দৃশ্যমান নয়, তার চাল-চলন তেমন প্রচন্ড নয়, সে মারে ভারের দ্বারা, আঘাতের দ্বারা নয়, এই জন্যে বাইরের ঢেউয়ের চড়-চাপড়ের উপরই দোষারোপ করে তৃপ্তি লাভ করা যেতে পারে; কিন্তু হয় মরতে হবে, নয় একদিন এই সুবুদ্ধি মাথায় আসবে যে আসল মরণ ঐ ভিতরকার জলের মধ্যে, ওটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেঁচে ফেলতে হবে। ..... এ কথা মনে রাখতে হবে, বাইরের বাধা-বিঘ্ন বিরুদ্ধতা চিরদিনই থাকবে,  থাকলে ভাল বৈ মন্দ নয় – কিন্তু অন্তরে বাধা থাকলেই বাইরের বাধা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই জন্য ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে সাধনার দিকে তাকাতে হবে, তাতে অপমানও যাবে, ফলও পাব”।
পড়া শেষে,চোখ তুলতেই, বললেন, ‘সেই বাংলা ১৩২৬ সনে, মানে আজ থিকা চৌরানব্বই বছর আগে, ত’গো শুদ্ধিকরণের লইগগা ঋষি-কবি লেইখখা গ্যাসেন! রবি ঠাকুররে ত’রা চিনস?’
    -----------
                                                            ৪ঠা আগস্ট, ২০১৩।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন