বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

ফিলিস্তিন ~ স্বাতী মৈত্র

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ভাগের প্রস্তাব পাশ করে। ক্রমবর্ধমান ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ ও জায়নবাদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবার এটাই ছিল তাঁদের সমাধান, যদিও ডেভিড বেন গুরিয়নের মতন জায়নবাদী নেতৃত্ব সেই সময় থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে এটা প্রথম ধাপ মাত্র। ততদিনে আমাদের পরিবারগুলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে, বহু মানুষ তখন উদ্বাস্তু। 

সে সময় পোস্ট-ওয়ার অর্ডারের সময়। জাতিসংঘ সব সামলে দেবে, এই প্রত্যয়ের সময়। 

নতুন দেশ ভারত ও পাকিস্তান যখন ১৯৪৮ সালে রিফিউজি ও সাম্প্রদায়িক হিংসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, কাশ্মীরে ১৯৪৭-৪৮ সালের প্রথম যুদ্ধ লাগিয়ে ফেলেছে, তখনই ফিলিস্তিনে জায়নবাদী শক্তিগুলো শুরু করে ১৯৪৮ সালের ফিলিস্তিন যুদ্ধ। আমাদের পরিবারগুলো তখন ক্যাম্পে, জবরদখল কলোনিতে। হয়তো খবর এসেছিল, হয়তো আসেনি, কিন্তু সেই সময়েই ফিলিস্তিনে উদ্বাস্তু হলেন অন্তত ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনবাসী, এক বিধ্বংসী হিংস্র শক্তির হাতে। এই ঘটনাকে বলা হয় নকবা, অথবা মহাবিপর্যয়। 

দেশভাগ শেষ হয়নি। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষ এটা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। মানচিত্রের ভাগ আমরাই চেয়েছিলাম, কিন্তু হাঁড়ি ভাগ হলেই যে নাড়ির যোগ ছিন্ন হয়না, তা আমরা একবিংশ শতকে বসে ভালোই বুঝতে পারি। 

শেষ হয়নি নকবাও। তার ফল আরো অনেক বিধ্বংসী, ভয়ঙ্কর। সেখানে এক পক্ষের হাতে পরমাণু বোমা আর আরেক পক্ষের হাতে ক্রুড রকেট ও কয়েকটা কালাশনিকভ। আমরা অন্তত স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীন হয়নি ফিলিস্তিন। 

গাজার সাম্প্রতিক গণহত্যা পৃথিবীর প্রথম গণহত্যা নয়, কিন্তু এই গণহত্যা যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। হাসপাতালে বোমা, স্কুলে বোমা, রিফিউজি শেল্টারে বোমা, তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বোমা, আটা নিতে গিয়ে হত্যা, কোয়াড কপ্টার-স্নাইপার দিয়ে হত্যা, শিশুহত্যা, স্নাইপার দিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে শিশুহত্যা, ধ্বংসস্তূপে হত্যা, খাবার নিতে গিয়ে হত্যা, ওয়াইট ফসফরাস (টুইটারে ফিলিস্তিনিদের বক্তব্য অনুযায়ী) দিয়ে হত্যা, তাঁবুতে আইভি ড্রিপ-সহ কিশোরকে পুড়িয়ে হত্যা, খেতে না দিয়ে হত্যা, জ্বালানি না দিয়ে হত্যা, মাছ ধরতে না দিয়ে হত্যা, আরও কত কত রকমের হত্যা - এবং সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়ে যাওয়া - এটাই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। জাতিসংঘ একটা ইয়ার্কির নাম। 

ভারতবর্ষের মানুষ মানতে চান, না চান, ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতনে মিডনাইটস চিলড্রেনের মতন এক সূত্রে আমরা গাঁথা। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা শুধু ফিলিস্তিনের নয়, আমাদের স্বাধীনতা। ফিলিস্তিন হারলে, নিঃশেষ হয়ে গেলে, ম্যাপ থেকে মুছে গেলে আমাদের হার, কারণ তা আন্তর্জাতিক আইনের হার, তৃতীয় বিশ্বের সুরক্ষা কবচের অন্তিম অন্তর্ধান, নব্য-সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ জয়। 

একদিকে স্বাধীনতা, অন্য দিকে মহাবিপর্যয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন