বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

বোকা বিকাশ, চতুর সুব্রত আর শ্রী জগন্নাথ ধাম ~ ধ্রুবজ্যোতি প্রামাণিক


দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা এবং দ্বার উন্মোচন হল। আমার মাথায় কয়েকটা প্রশ্নও এল। প্রথম প্রশ্ন হল, সব ধর্মের মানুষের ভোটে জিতে আসা একটি সরকার কি জনতার করের পয়সায় মন্দির তৈরি করতে পারে ? সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দ্বিতীয় প্রশ্ন, এটি কি আদৌ মন্দির নাকি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ? কারণ সরকারিভাবে এটিকে শ্রী জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা হচ্ছে। তৃতীয় প্রশ্ন, এই যে বলা হচ্ছে দিঘা জগন্নাথ ধামকে কেন্দ্র করে পর্যটনের ঢল নামবে এবং এলাকার অর্থনীতিতে আমূল বদল আসবে, এই দাবি কতটা মজবুত ? এবারে এক এক করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। 

প্রশ্ন ১ : সরকার কি জনতার করের টাকায় মন্দির বানাতে পারে ? সংবিধান বলছে, না, পারে না। ভারতীয় সংবিধানে, ধর্মাচরণের অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু তা নাগরিকের জন্য। সরকারের জন্য নয়। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ভারতে, যে কোনও নাগরিকের, বিনা বাধায় ধর্মাচরণ এবং ধর্ম প্রচারের অধিকার আছে। ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যে কেউ বা বিধিবদ্ধ ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনও সংস্থা, ধর্মাচরণ, ধর্ম প্রচারের উদ্যেশ্যে ধর্মস্থান নির্মাণ, বিস্তার এবং পরিচালনা করতে পারে। এখানেও সরকারের কোনও স্থান নেই। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, ২৭ নাম্বার ধারা। আপনাদের সুবিধের জন্য, আমি ধারাটি এখানে তুলে দিচ্ছি। 
27. Freedom as to payment of taxes for promotion of any particular religion.

No person shall be compelled to pay any taxes, the proceeds of which are specifically appropriated in payment of expenses for the promotion or maintenance of any particular religion or religious denomination.

~ "Article 027 (Freedom as to payment of taxes for promotion of any particular religion)" -Part III - Fundamental Rights (12–35)
মানে দাঁড়াল এই যে, নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হবে, এমন কোনও খরচের জন্য জনতাকে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না। দিঘা জগন্নাথ ধাম নির্মাণে ২০ একর জমি দিয়েছে সরকারি সংস্থা দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ। এরপর, হিডকো, মানে আরেক সরকারি সংস্থা, পশ্চিমবঙ্গ আবাস পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ ধাম তৈরি করেছে। সংবিধান অনুযায়ী জনতার করের টাকা সরকার বাহাদুরের কাছেই গচ্ছিত থাকে। অতএব এই ২৫০ কোটি টাকা আমার আপনার করের টাকা। তাই দিঘা জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ আদৌ সাংবিধানিক কাজ কিনা, সেই প্রশ্ন থেকে গেল। 

প্রশ্ন ২ : দিঘা জগন্নাথ ধাম কি আদৌ মন্দির ? অনেকেই বলছেন, এ তো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা তো হতেই পারে। হক কথা। কিন্তু এখানে কোন সংস্কৃতি চর্চা হবে ? এমন কোনও তথ্য কোথাও পেলাম না। বৈষ্ণব মতাবলম্বীরা বলেন, প্রভু জগন্নাথ, কৃষ্ণেরই রূপ, সেই অর্থে বিষ্ণুবতার। যদিও শৈব এবং শাক্ত মতাবলম্বীদের একটা অংশ মনে করেন, প্রভু জগন্নাথ, ভৈরবের একটি রূপ বা ভগবান শিবের অবতার। স্কন্দ এবং ব্রহ্ম পুরাণে প্রভু জগন্নাথের উল্লেখ রয়েছে। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর কথা যদি হয়, তাহলে ভারতে মূলত তিন স্থাপত্য শৈলীর মন্দির দেখা যায়। উত্তরের নাগারা শৈলী, দক্ষিণের দ্রাবিড় শৈলী এবং বাকি মোটামুটি, ভেসারা বা মিশ্র শৈলী। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কলিঙ্গ শৈলী আসলে মিশ্র শৈলী। আমার প্রশ্ন, দিঘা জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কি পুরাণ, মন্দির স্থাপত্যশৈলী ইত্যাদি নিয়ে চর্চা বা গবেষণা হবে ? এমন তথ্য কোথাও পেলাম না। বরং দেখলাম, বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। হিন্দু ধর্ম সাকার সাধনায় বিশ্বাসী। তাহলে সংস্কৃতি কেন্দ্র নাম দিয়ে যাই বলার চেষ্টা হোক না কেন, বিষয়টা কি সংবিধানসিদ্ধ কাজ হল ? প্রশ্ন রয়েই গেল। এই প্রসঙ্গে বলি, আমাদের দেশে, মূলত দক্ষিণ ভারতে, তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্নাটকে মন্দির পরিচালন এবং পরিচালন ব্যবস্থায় দখলদারির বহু মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট, সব ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করেছে। 

প্রশ্ন ৩ : দিঘা জগন্নাথ ধামের হাত ধরে, এলাকায় পর্যটনের জোয়ার আসবে কিনা বা পর্যটন অর্থনীতিতে গতি আসবে কিনা। এককথায় উত্তর হল হ্যাঁ। বহু মানুষ এখন মন্দির দেখতে যাবেন। কিন্তু তার মধ্যেও খানিক স্তরবিভাজন আছে। সে প্রসঙ্গে আসছি। তার আগে একটু পরিসংখ্যান দিই। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তথ্য বলছে, কোভিডের পর, পশ্চিমবঙ্গে দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সাড়ে চোদ্দ কোটি পর্যটক (রাজ্যের পর্যটক ধরে) নানা জায়গা ঘুরেছেন। জাতীয় নিরিখে অষ্টম স্থান। তৃণমূল আমলে, রাজ্যের ভূবৈচিত্র, ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরতে নানা কাজ হয়েছে। সরকার এক্ষেত্রে একাধিক পেশাদার এবং বেশ কয়েকটি পেশাদারি সংস্থার পরামর্শ শুনে কাজ করেছে। পর্যটন শিল্পে বৃদ্ধি তারই প্রতিফলন। এরই সুফল হিসেবে একটু একটু করে বেড়েছে বিদেশি পর্যটকও। ২০২৩ সালের তথ্য বলছে, বিদেশি পর্যটক আসেন প্রায় ২৭ লক্ষ। তবে এই হিসেবে জল হয়ে ঢুকে আছেন বাংলাদেশিরা। জল কেন বলছি ? আসলে ওই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ১২০০/১৫০০ টাকা হোটেলের বাংলাদেশি পর্যটকরা, বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়াতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভরতে তাঁদের বিরাট অবদান আছে, তা মানছেন না রাজ্যে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত পেশাদাররা। বরং তাঁদের ভয়, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে, ভিসা নিয়ে কড়াকড়ির জেরে, ২০২৪ এ পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা অনেকটা কমে যেতে পারে। আচ্ছা, পর্যটন ব্যবসায় বিদেশি পর্যটক এত গুরুত্বপূর্ণ কেন ? কারণ, ডলার। যত ডলার আমদানি, পর্যটন অর্থনীতিতে তত জোশ। কারণ কী জানেন, ন্যাপা, শ্যামা, পল্টু, মানে আপনার আমার মতো মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা স্বল্পবিত্তদের কৃপায়, দিঘাতে ডিম-পাওরুটি বা কাঁকড়া ভাজার ষ্টল আরও কিছু বাড়তে পারে, বিয়ার পাব, ভাল হোটেল আরও কয়েকটা বাড়তেই পারে। কিন্তু পর্যটন শিল্পে গতি এনে পর্যটন অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তার জন্য দরকার পয়সাওয়ালা দেশি খদ্দের বা বিদেশি পর্যটক। 
দিঘা এখনও পয়সাওয়ালা দেশি পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় নেই। কারণ বিচ ট্যুরিজম বলতে যা বোঝায়, দিঘাতে সেই পরিকাঠামো নেই। আজকের বাজারে পর্যটন পণ্য বিপণনের দুই মন্ত্র। ন্যাচারাল বা ইনহেরিটেড কোনও পণ্য আপনার দখলে থাকলেই হল না, তাকে কেন্দ্র করে ম্যানমেড পণ্য তৈরি করে একটা সুসংহত পণ্য তৈরি করতে হয়। দিঘাতে যতদিন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বা ওয়াটার স্পোর্টসের পেশাদার পরিকাঠামো না হচ্ছে, ততদিন দিঘা 'দীপুদা'র দিঘা হয়েই থেকে যাবে। 
রাজ্যের পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত পেশাদাররা বলছেন, সুন্দরবনকে কীভাবে আরও বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরা যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। উত্তরবঙ্গের পাহাড় জঙ্গলে, কী করে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। কলকাতায় হেরিটেজ ওয়াক কী করে বিদেশিদের কাছে, ভিন রাজ্যের পয়সাওয়ালা পর্যটকদের কাছে বেচা যায়, সেই চেষ্টা করা যেত। রাজ্যে ১৩ টি শক্তি পীঠ রয়েছে। সুসংহত পরিকল্পনা করে, শক্তিপীঠ সার্কিট করা যেত। তাতে ডলার আমদানি হত। অথচ রাজ্যের অর্থনীতিতে পর্যটনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ১৩ শতাংশ। এটাই আরও বাড়ানো যেত। কিন্তু দিঘার জগন্নাথ ধাম সামনে রেখে সেই বৃদ্ধি অসম্ভব। 

বোকা বিকাশ আর চতুর সুব্রতর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আপনাদের তো বলিইনি যে এই দুই চরিত্র কারা। দুজনেই কলকাতার প্রাক্তন মেয়র। একজন বিকাশ ভট্টাচার্য। অন্যজন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সুব্রতদা গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর একটি কথা আজ খুব মনে পড়ছে। সুব্রতদা তখন প্রথম তৃণমূল সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। একদিন আড্ডা হচ্ছে। কথায় কথায় কলকাতায় জল জমার প্রসঙ্গ উঠল। সুব্রতদা বললেন, বিকাশবাবু কিন্তু খুব ভাল কাজ করেছেন। যাঁরা জানেন না, তাঁদের বলি, কলকাতায় জল জমার সমস্যা সমাধানে, প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে, জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে বিকাশ ভট্টাচার্য মেয়র থাকাকালীন একটা বিরাট কাজ হয়। প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার প্রকল্প। সেই টাকায় কলকাতায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি ভূগর্ভস্থ ইটের নিকাশি নালা সংস্কার করে, বিশেষ প্লাস্টিকে তৈরি আস্তরণ দিয়ে মজবুত করা হয়। আজ যে কলকাতায় জল জমার সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে, তার কারণ, ওই কাজ। সুব্রতদা তার কথাই বলছিলেন। প্রশ্ন করেছিলাম, দাদা, এই কাজের প্রস্তাব তো আপনি মেয়র থাকার সময়ের। আপনি করেননি কেন ? সুব্রতদা সেই ট্রেডমার্ক হাসি হেসে, অননুকরণীয় ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলেছিলেন, ধুর, ভোটে জিততে গেলে, এমন কিছু করতে হয়, যা পাবলিক চোখে দেখতে পায়। আমাদের দেশের পাবলিক ওতেই খুশি। মাটির তলায় ৩৫০ কোটি টাকা ঢেলে কী হত ? পাবলিক দেখতে পেত ? বিকাশবাবু ভোটে জিততে পেরেছেন ? 

দিঘার জগন্নাথ ধামের উচ্চতা দেখলাম, ২১৩ ফুট। বহুদূর থেকে দেখা যাবে।

জয় জগন্নাথ। ভুল ত্রুটি মার্জনা কোরো প্রভু….

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন