বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

দেশদ্রোহী কারা? ~ অরিজিত গুহ



    ১৯২৮ সালের কংগ্রেসের কলকাতার অধিবেশন বসে পার্ক সার্কাস ময়দানে। বর্তমানে পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপোর সামনের যে রাস্তাটা সেই রাস্তা দিয়ে কংগ্রেসের অধিবেশনের মিছিল চলেছিল। রাস্তাটার নাম কংগ্রেস এগজিবিশন রোড আজও সেই কংগ্রেসের অধিবেশনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। 

     এই রাস্তা দিয়েই এক শীর্ণকায় ব্যক্তির নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল যোগ দিয়েছিল কংগ্রেসের সেই মূল মিছিলে। মিছিলটি বিশেষ একটি কারণে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কারন এর আগে কংগ্রেসের কোনো মিছিলে কলকারখানার শ্রমিক মুটে মজুরদের সেভাবে প্রতিনিধিত্ব ছিল না যা এই মিছিলের বিশেষত্ব ছিল। 

   এই অধিবেশনে মতিলাল নেহেরুর দ্বারা একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবটি ছিল ভারতের ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের। গান্ধীজি সেই প্রস্তাব সমর্থন করলেও জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বোস প্রভৃতি অল্প বয়সী নেতৃত্ব এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তাঁরা বিকল্প একটি প্রস্তাব পেশ করেন যা ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী। শীর্ণকায় ব্যক্তিটির নেতৃত্বে যে মিছিলটি এসেছিল, সেই মিছিলের প্রতিনিধিরা এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীর প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ায়। শীর্ণকায় ব্যক্তিটির নাম মুজফফর আহমেদ। যিনি কাকাবাবু নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। 

    মূল প্রস্তাবটি সংখ্যাধিক্যের জোরে একটি সংশোধনী সহ পাস হয়ে গেল। সংশোধনীটি ছিল যদি এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ রাজ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস মেনে না নেয় তাহলে পরের লাহোর অধিবেশন থেকে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করবে। যথারীতি ব্রিটিশ রাজ ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস মেনে নেয় নি এবং লাহোর অধিবেশন থেকে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলে আর ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে নিজেদের স্বাধীন ভারতের নাগরিক বলে ঘোষণা করে। 

   কংগ্রেসের প্রবীন নেতৃত্ব এবং তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে কলকাতার এই অধিবেশন থেকেই একটা মতানৈক্য দেখা দিল। এই মতানৈক্যের প্রভাব পড়ল ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় কাজ করা তরুণ বিপ্লবী দলের মধ্যে। তাঁরা আর এই আবেদন নিবেদনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী থাকতে পারছিলেন না। বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজনে গড়ে উঠল রিভোল্ট গ্রুপ। অনুশীলন সমিতির সতীশ পাকড়াশি, নিরঞ্জন সেন এবং যতীন দাসের উদ্যোগে যুগান্তর গোষ্ঠির বরিশাল শাখা, চট্টগ্রামের সূর্য সেন, মাদারিপুরের পঞ্চানন চক্রবর্তী (কাজী নজরুলের অভিন্নহৃদয় বন্ধু), এবং আরো ছোট ছোট গ্রুপ মিলে এই রিভোল্ট গ্রুপে সামিল হল। কর্মসূচি নেওয়া হল বিভিন্ন জেলায় ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হবে। এই কর্মসূচি যদি বাস্তবে রূপায়িত করা যায় তাহলে প্রবীন নেতৃত্বও ও আরো অন্যান্য বিপ্লবী গোষ্ঠি এই কর্মোদ্যোগে সাড়া না দিয়ে পারবে না।
 
    অ্যাকশন প্ল্যান একজিকিউট করার হেডকোয়ার্টার স্থির হল কলকাতার মেছুয়াবাজার। সেখানকার গোপন ডেরায় দিনের পর দিন বিপ্লবীরা মিলিত হতে থাকল। আগামী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা, বোমা তৈরির ফর্মুলা, ইস্তাহার বিলির কর্মসূচি এইসবে সরগরম করে উঠল সেই বিপ্লবী ঘাঁটি।
     খবর ফাঁস হয়ে গেল গোয়েন্দাদের কাছে। ১৯২৯ সালের ১৮ই ডিসেম্বরের কুয়াশাঘন গভীর রাতে সেই ডেরা ঘিরে ফেলল পুলিশ। গভীর রাতেই গ্রেপ্তার হল সতীশ পাকড়াশি ও নিরঞ্জন সেন। খবর না থাকায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু বোমার সেল আর পিস্তল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভোরবেলায় চট্টগ্রাম থেকে শিয়ালদা এসে সেই ঘাঁটিতে উপস্থিত হন সুধাংশু দাসগুপ্ত। সাথে সাথেই তিনিও গ্রেপ্তার হন। ঘাঁটি থেকে পাওয়া বিপ্লবীদের নাম ঠিকানা থেকে একে গ্রেপ্তার করা হল প্রমোদ দাসগুপ্ত, শচীন করগুপ্ত, মুকুল সেন, রমেন বিশ্বাস, নিশাকান্ত রায়চৌধুরী প্রভৃতি বিপ্লবীকে। শুরু হল মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলা।
    মামলায় দোষী হিসেবে সতীশ পাকড়াশি আর নিরঞ্জন সেনের হল সাত বছর দ্বীপান্তর, মুকুল সেন শচীন করগুপ্তের হল ছ বছর দ্বীপান্তর, সুধাংশু দাসগুপ্তের পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। প্রমোদ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কোনো সূত্র না পেলেও ব্রিটিশরা বুঝেছিল একে ছেড়ে রাখা ঠিক হবে না। কাজেই তাঁকে মেছুয়াবাজার ষড়যন্ত্র মামলায় জড়াতে না পারলেও বেঙ্গল ক্রিমিনাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে আটক করে রাখা হয় এবং বিভিন্ন জেল ঘুরে পরে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। 

   মেছুয়াবাজার থেকেই প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরিকল্পনা হয়েছিল। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে গণেশ ঘোষ অম্বিকা চক্রবর্তীরা সেই পরিকল্পনার সফল রূপায়ন ঘটালেন। যদিও ধরাও পড়লেন সকলে এবং গণেশ ঘোষ আর অম্বিকা চক্রবর্তীও এসে পড়লেন দ্বীপান্তরের সেলুলার জেলে। এর কিছুকাল পরেই মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী হয়ে সেলুলার জেলে এলেন মুজফফর আহমেদ।
 
   মেছুয়াবাজারের গোপন ঘাঁটি থেকে যে স্ফুলিঙ্গের উৎপত্তি হয়েছিল তা দেশব্যাপি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে নবজোয়ার আনে। বিপ্লবী জগদীশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় 'মেছুয়াবাজারে অবস্থিত গোপন বৈপ্লবিক ঘাঁটি থেকে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের যে বহ্নিশিখা একদা প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, সেই বহ্নিশিখাই পরবর্তীকালে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লেলিহান শিখার মত ছড়িয়ে পড়ল। কত ত্যাগ কত আত্মবলিদান স্বাধীনতা সংগ্রামের বেদীতলে সমর্পিত হল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। শত শত শহিদের রক্তরাঙা ইতিহাসে রচিত হল নব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর গাঁথা'। (শৈলেশ দে সম্পাদিত অগ্নিযুগ)

   কাকাবাবুকে সবাই চেনেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে সিপিআই(এম) দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
   প্রমোদ দাসগুপ্ত সিপিআই(এম) দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পলিট ব্যুরো সদস্য এবং আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের দলের রাজ্য সম্পাদক। 
   সতীশ পাকড়াশি সিপিআই(এম) দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন।
   নিরঞ্জন সেন সিপিআই(এম) দলের পক্ষ থেকে ১৯৬৭-৬৮ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন।
   সুধাংশু দাসগুপ্ত সিপিআই(এম) দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এবং দলের মুখপত্র দেশহিতৈষী পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। 
   শচীন করগুপ্ত ১৯৩৮ সালে আন্দামান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হন এবং সারা জীবন শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন।
   গণেশ ঘোষ সিপিআই(এম) দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গের বেলগাছিয়া বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন।

   কাজেই দেশদ্রোহী দাগিয়ে দেওয়ার আগে একটু ইতিহাসটা জেনে নেবেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার এই অগ্নিযুগ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছে। পুরো ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে দেখলে আরো অনেক নাম ও ঘটনা বলা যায়। তাতে লেখার পরিসরই বাড়বে শুধু। দেশ স্বাধীন করার জন্য বামপন্থীদের অবদান ইতিহাস এর পাতায় ছত্রে ছত্রে লেখা রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন