সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

কবিতা থেকে মিছিলে ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর জন্মদিন যে লেখাটা লিখেছিলাম তাতে এক বন্ধু মন্তব্য করেছেন, "রবীন্দ্রনাথের কবিতা নাৎসী বাহিনীর বাঁদরামো থামাতে পারে নি। পেরেছিলো স্তালিনের লালফৌজ৷ ফ্যাসিবাদ আটকানোর একমাত্র রাস্তা পালটা বলপ্রয়োগ। এছাড়া কোনো বিকল্প রাস্তা নেই।" এই প্রসঙ্গে আমার সামান্য কিছু বলার আছে। কমেন্ট হিসেবে লম্বা বলে আলাদা লিখলাম। 

ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকা কবিতাটি লেখেন ও নিজেই সেটির ইংরেজি অনুবাদ করে পাঠান অমিয় চক্রবর্তীর কাছে যিনি সে সময়ে ইংল্যান্ডে ছিলেন।জেনারেল ফ্ল্যাঙ্কোর নেতৃত্বে স্পেনে শুরু হয় ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন। এর বিরুদ্ধে তৈরি হয় পপুলার ফ্রন্ট, ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড। নৈতিক ও দৈহিক সমর্থন দেন বহু বুদ্ধিজীবী যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ।

মার্চ, ১৯৩৭, স্পেন এর গৃহযুদ্ধের সময় পিপলস ফ্রন্ট এর সাহায্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "স্পেনের জনগণের এই চরম দুঃখ ও অবিচারের দিনে আমি মানবতার বিবেকের কাছে আবেদন রাখছি: স্পেনের পিপলস ফ্রন্ট কে সাহায্য করুন
জনগণের সরকার কে সাহায্য করুন, সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলুন, প্রতিক্রিয়াকে রুখে দিন"। স্পেনের ঘটনার পরপরই '‌লিগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার'–এর ভারতীয় শাখা তৈরি ও সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন

ফ্যাসিস্ট জাপানি সৈন্যবাহিনীর হাতে নানকিং শহরের পতনের পরে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে নিহত হন। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় বিচলিত হয়ে লেখেন চিরস্মরণীয় কবিতা: "নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,"

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ইতস্ততঃ করছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেবেন কি দেবেন না বলে। হিটলার বাহিনীর কাছে ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করার পরে রবীন্দ্রনাথ এক তারবার্তায় তৎকালীন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে মিত্রপক্ষে যোগদান অনুরোধ জানান দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে। টেলিগ্রামে লিখলেন - "Today, we stand in awe before the fearfully destructive force that has so suddenly swept the world. Every moment I deplore the smallness of our means and the feebleness of our voice in India so utterly inadequate to stem in the least, the tide of evil that has menaced the permanence of civilization.

All our individual problems of politics to-day have merged into one supreme world politics which, I believe, is seeking the help of the United States of America as the last refuge of the spiritual man, and these few lines of mine merely convey my hope, even if unnecessary, that she will not fail in her mission to stand against this universal disaster that appears so imminent."

শুধু বিদেশের রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি নয়, দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও কবি প্রতিবাদ করেছিলেন ফ্যাসিজমের। ১৯৩৯ সালের ১৭ মার্চ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে কবি বলেন— '‌অবশেষে আজ কংগ্রেস মঞ্চ থেকে হিটলার নীতির নিঃসঙ্কোচ জয় ঘোষণা শোনা গেল। ছোঁয়াচ লেগেছে। আমাদের এই গুরুভজা দেশে লাগবার কথা। স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করবার জন্য যে বেদী উৎকৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিস্ট সাপ ফোঁস করে উঠেছে।'‌ কিছুদিন পরে লেখা সেই অমিয় চক্রবর্তীকেই এক পত্রপ্রবন্ধে (‌২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯)‌ রবীন্দ্রনাথ সরাসরি ফ্যাসিজমের পরাজয় কামনা করলেন। সেই লেখার মধ্যে তিনি বললেন—"এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়ী হোক একান্ত মনে এই কামনা করি। কেননা মানব–ইতিহাস ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না।'‌

কেউ বলতেই পারেন যে এসবে প্রমাণিত হয় যে কবি সমাজ সচেতন ছিলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবর রাখতেন ও সাধ্যমত তার কবিতা ও লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতেন কিন্তু তার অভিঘাত কতটুকু। এর উত্তরে স্রেফ দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। জার্মান নাৎসি, কুখ্যাত প্রচারমন্ত্রী জসেফ গোয়েবলস একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এর ভক্ত হয়ে ছিলেন। স্পেনে পপুলার ফ্রন্ট কে কবি খোলাখুলি সমর্থন করার পরে গোয়েবলস সেই রবীন্দ্রনাথকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করে আক্রমণ করেন ও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেন। জাপান ডায়েট সিদ্ধান্ত নিয়ে কবির বক্তৃতা সেন্সার করা শুরু করে।

এবার আসা যাক লালফৌজের হাতে ফ্যাসিস্টদের পরাজয় প্রসঙ্গে। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই দুটি কথা মানেন। এক. স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধটাই ছিল ডিসাইসিভ, ফলাফল নির্ধারক। দুই. সমরবিজ্ঞানের সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেবার লালফৌজ জয়লাভ করেছিল। কেন করেছিল তার বহু কারণ ও ব্যাখ্যা আছে। একটি কারণ উল্লেখের জন্য জার্মান ইতিহাসবিদ Jochen Hellbeck এর সাহায্য নেওয়া যাক।

তার সুবিশাল "স্ট্যালিনগ্রাদ প্রটোকল" এ উল্লেখ করেছেন যে ১৯৪২ এর আগস্ট আর অক্টোবর মাসের মধ্যে কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ড ঝোলানো সদস্য সংখ্যা ২৮,৫০০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩,৫০০ এবং লালফৌজ ভাবতে শুরু করে যে তারা তাদের নাৎসি প্রতিপক্ষ বাহিনীর চেয়ে রাজনৈতিক ও নৈতিক ভাবে শ্রেষ্ঠ। [Der Spiegel magazine]। ব্রিগেডিয়ার কমিসার ভাসিলিয়েভ এর ভাষায় "It was viewed as a disgrace if a Communist was not the first to lead the soldiers into battle."

এই যে নৈতিক বলে বলীয়ান হয়ে একটা ফৌজ তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী বিরোধীকে রুখেদিল, বেসামরিক জনগণ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে প্রতিরোধ করলো এ জিনিষ মানব সভ্যতার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তার প্রেরণার উৎসমূলে আমাদের ফিরে যেতেই হবে।

এখানেই প্রশ্ন আসে নীতি, নৈতিকতা, মতাদর্শ এসব এবস্ট্রাক্ট জিনিসের ব্যবহারিক মূল্য। এগুলোর যোগান দেন চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী আদর্শবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধে তাই কবিকে প্রয়োজন। বন্দুক দু পক্ষের হাতেই আছে বা থাকবে। কোন পক্ষ চূড়ান্ত জয়লাভ করবে সেটা বলে দেবে কবি কোন পক্ষে আছেন। স্রেফ বন্দুক দিয়েই লড়াই জেতা যাবে না।

"মহাকালসিংহাসনে
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী,
কুৎসিত বীভৎসা‌ পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন.‌.‌.‌'‌

তাই বন্ধু কিছু মনে করবেন না, বোধহয় শুধু ফৌজ বা শুধু কবিতায় হবে না। ফৌজের সাথে কবি ও কবিতাকেও চাই। আজ কবি জয়দেব বসুর জন্মদিন। এই লেখাটা তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে নিবেবন করলাম।

কবিতা থেকে মিছিলে .......

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন