মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

পরিযায়ী শ্রমিক ও আমাদের সরকার ~ উদিত সেনগুপ্ত

কয়েক ঘন্টা আগেই দেখলেন কী কান্ড টা ঘটে গেছে বান্দ্রা স্টেশন চত্বরে? প্রায় সহস্রাধিক পরিযায়ী শ্রমিক জড়' হয়েছিলেন এই ভেবে যে আজ লকডাউনের পরিসমাপ্তি ঘটছে এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারবেন। সকাল ১০টার স্পীচ শোনার সুযোগ তাদের ঘটেনি কিংবা ঘটে থাকলেও তা মান্য করার মত বাস্তবতা তাদের ছিল না। কেন' ছিলনা সেই বাস্তবতা? কারণ তাঁদের নো ওয়ার্ক নো পে জীবনের রোজগার বন্ধ গত তিন সপ্তাহ ধরে লকডাউনের কল্যাণে, NGO দের মারফৎ পাওয়া চাল আলু ও হয় শেষ হয়ে গেছে, বা হওয়ার মুখে। তাঁরা তো কেউ প্যাকেজ ট্যুরে মুম্বই দর্শন করতে আসেন নি উত্তর প্রদেশ, মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে, এসেছিলেন পেটের দায়ে মূলতঃ নির্মাণকর্মী কিংবা দর্জির কাজ নিয়ে। এবং তাঁরা বাড়ি ফিরতে চান আরো একটা কারণে। তাঁদের করোনা হলে তার দায়িত্ব বা চাল আলু ফুরোলে তা পুনরায় তাদের কে তা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব কারা নেবে, সে বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা। কেন অনিশ্চয়তা? কারণ একটা জরুরি শব্দ ইতিমধ্যে আপনারা মিস করে গেছেন।

 কোনো সরকার নয়, NGO নিয়েছিল গত তিন সপ্তাহে তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা। খেয়াল করে দেখুন বা টিভি/অনলাইন খবর পড়ে দেখুন শ্রমিকরা বলছে যে কিছু NGO এইটুকু অন্ততঃ করেছে, তাদের মালিক/ঠিকেদার নয়, সরকার নয়। এই সকল NGO শব্দবন্ধের সাথে তাদের পরিচিতি অল্প কিছুদিনের, কিন্তু চিরপরিচিত মালিক/ঠিকেদার/সরকার, অর্থাৎ যে কোনো শ্রমিকের প্রাথমিক নিরাপত্তাবোধের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জন্য এগিয়ে আসে নি। এতএব, প্রবল এই নিরাপত্তাহীনতা। ফলতঃ ঘটল' লাঠিচার্জ এবং বর্তমানে টুইটার যুদ্ধ চলছে মহারাষ্ট্র সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে, কে কার দায়িত্ব পালন করেনি, সেই নিয়ে। আর আমি প্রবল আতঙ্কে টিভি চ্যানেলে এই সব দেখে প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করছি যে সমষ্ঠিগত সংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ফলে আগামীকালের করোনা কাউন্ট কত' দাঁড়াবে। 

কোনোদিন নির্মীয়মাণ বান্দ্রা মেট্রো স্টেশনের সাইটে গিয়ে দাঁড়ান কয়েক মুহূর্ত। হঠাৎ ই আপনার মনে হবে ২০০০ কিমি দূরে আরব সাগরের পাড়ে এত বাংলা ভাষার স্রোত কোথেকে ভেসে আসছে?! সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করুন এ দেশের "ক্যানারি ওয়ার্ফ" বান্দ্রা কুরলা কমপ্লেক্সের দিকে। নির্মীয়মাণ মেট্রোর লাইন বরাবর শুনতে পাবেন মুর্শিদাবাদ, মালদা, এমনকি পুরুলিয়ার ডায়ালেক্টে বাংলা ভাষা। পাশেই নির্মীয়মাণ বহুতল বাণিজ্যিক বিল্ডিংগুলোর দিকে এগিয়ে যান। শুনতে পাবেন ছাপড়া, সিওয়ান, সীতামরহি, বারাবাঁকি, সাসারাম, বিজনৌর, শামলির ভাষা। অপেক্ষা করুন দিনের আলো ফুরনো অবধি। তারপরে ভাষার এই কলকল স্রোতের পিছু পিছু হাঁটতে থাকুন। পৌছে যাবেন প্যাটেল নগর, কালিনা হয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মার্গ ধরে সুন্দরনগর, আজাদ নগর, ভীম নগর, সূর্যনগর, কাজুপাড়া, মোহিলিগাঁও, মিলিন্দনগর। এই প্রত্যেকটি অঞ্চল আসলে একেকটি বৃহৎ বস্তি অঞ্চল। এই সব মানবস্রোতের আশ্রয়স্থল। বান্দ্রা থেকে একদিকে গেলে ধারাভি (এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি অঞ্চল) হয়ে সায়ন-মাহিম; আরেকদিকে কুরলা থেকে ঘাটকোপার হয়ে মুলুন্ড অবধি, প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৮০% মানুষ বাস করে এই সকল বস্তিতে। এই সকল গতরে খেটে খাওয়া মানুষ ২১ দিন ধরে কোনো রোজগার না করে, কিছু NGOর ভরসায় বেঁচে আছে। তারাই আজ বাড়ি ফেরার তাগিদে, প্রাণের দায়ে জড়' হয়েছিল' বান্দ্রা স্টেশনে। 

না না, আমি জানি যে আপনি এর মধ্যে পদবী খুঁজতে চাইছেন এবারে!! ব্যাপার টা কে "that one particular community" বলার জন্য আপনার জিভ সকসক করছে এই মুহূর্তে!! দাঁড়ান! এরা কেউ কোনো মার্কাজ বা কেত্তন বা অমুকনবমী বা অমুকলালা'র উৎসব পালন করতে জড়' হয়নি। ভরসার অভাবে, মানে রাষ্ট্রের কোনোরকম আস্থাপ্রদানকারী পদক্ষেপের অভাবে এরা নিজেদের সংসারে, পরিবারে ফিরতে চেয়েছেন। টাকা নয়, জমি নয়, মন্দির নয়, মসজিদ নয়, এরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপার্জনের অভাবে, খাদ্যের অনিশ্চয়তায় তাদের শেষ নিরাপত্তার খুঁটিটাকেই আঁকড়ে ধরতে, নিজের গ্রামে, নিজের ঘরে ফিরতে। করোনায় মৃত্যু হতে পারে, এই জ্ঞানটুকু থাকা সত্ত্বেও তারা মরিয়া। 

এইবারে আপনি ওই "দ্যাট পার্টিকুলার কমিউইনিটি" থেকে হাল্কা সরে গিয়ে "কী আর করা যাবে বল' " বলতে চাইছেন। উত্তর টা হলঃ অনেক কিছুই করা যেত'। ২২শে মার্চ অবধি বিদেশী বিমান চলতে না দেওয়া যেত'। ৩০শে জানুয়ারি এলার্ম পাওয়ার পর থেকে দু তিন সপ্তাহের মধ্যে স্পেশাল ট্রেনের এরেঞ্জমেন্ট করে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কে বাড়ি ফিরিয়ে এনে ফুড কর্পোরেশনের পর্যাপ্ত স্টক থেকে খাদ্যশষ্যের রেশনের ব্যবস্থা করা যেত', এককালীন পদক্ষেপ হিসেবেই ১৫ লাখ না হোক, ৫০০০ টাকা করেই না হয় এদের জন ধন একাউন্টে ঢালা যেত' এবং প্রতিটা স্টেশনে অন্ততঃ থার্মাল স্ক্যানিং করানো যেত' (অবশ্যই সম্ভব)। সরকার বাহাদুর তিনটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিপীড়িত মানুষকে নাগরিকত্ব প্রদান করতে মানবিক আশঙ্কায় সদা উদগ্রীব আর নিজের দেশের এই বিশ্বকর্মাদের প্রতি এত অনীহা, এত অবহেলা?! নাকি এঁরা নাগরিক ন'ন? যদি নাই হ'ন, এঁদের ঘামের মধ্যে দিয়ে সৃষ্ঠ শ্রমদিবস মেনে নিচ্ছিলেন কেন? এঁদের কে দিয়ে সব শয়ে শয়ে কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প করাচ্ছিলেন কেন? কোথায় এদের ঠিকেদার রা? সেই ঠিকেদার দের রাজনৈতিক মুরুব্বি রা? লাঠিচার্জ টা আজ বিকেলে এদের ওপর হল' কেন? করোনা ছড়ানোর দায়ে মহামারি আইন ও পীনাল কোডের আওতায় এঁদের ঠিকেদার আর সরকারের শ্রম দপ্তর বা সমাজকল্যাণ দপ্তরের কর্তা-কত্রীদের উপর লাঠি চার্জ বা জামিন-অযোগ্য ধারায় কেস করা হচ্ছে না কেন? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজ্যসরকারের বিরুদ্ধে যাদের কাছে জনগণের অর্থে নিজ নিজ রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সৎ প্রয়াসের বদলে মন্দির- কুম্ভমেলা- ক্লাবতোষণ- পীরভাতা- মস্তানদের Y category র নিরাপত্তাপ্রদাণ অগ্রাধিকার পায়? কেন' লাঠিচার্জ হবে না সেই সকল রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে যারা এই জাতীয় সঙ্কটের সময়েও বিধায়ক কেনা বেচার জন্য রোলস রয়েস থেকে বিলাসবহুল রিসর্টে অর্থের হড়কা বান এনে ফেলছেন অথচ' রিলিফ দেওয়ার বেলায় রেশনের আটা, চালের বস্তায় নিজেদের "বিকাশপুরুষ", "মা জননী", "লৌহপুরুষ" দের সহাস্য ছবি লাগিয়ে "দান" করছেন? কেন' লাঠিচার্জ করা হবে না সেই সকল রাজ্যের সরকার কে, যাদের রাজ্য থেকে এই সকল পরিযায়ী শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে আটকে পড়েছেন অথচ' তারা স্রেফ সরকারি লেটারহেডে একটা করে চার লাইনের চিঠি লিখে দায়িত্ব সম্পাদন করে ফেলেছে? 

এই সকল শ্রমিকের এই সব শহরের বাসস্থানগুলিতে ঢুকুন। বুঝবেন যে আন্দামানের সেই কুখ্যাত সেলুলার জেলের একেকটি খুপড়িতে মাথাপিছু যতখানি স্কোয়ারফুটের মধ্যে দ্বীপান্তরী মানুষরা বাস করতেন, তার চেয়েও মাথাপিছু কম স্পেসে এই সব অঞ্চলে পেটের দায়ে একেকটি শ্রমিক বাস করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর (প্রোফেসর  ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তর কাছে কৃতজ্ঞ এই বস্তুনিষ্ঠ তুলনাটা আজ সকালেই করার জন্য)। এদের কে "বিপ্লবী" বলবেন না আপনারা, বর্ষাকালে ধ্বস নামার ফলে (হ্যাঁ, মুম্বই শহরের বহু বস্তি অঞ্চলে ফী বর্ষায় ধ্বসে যায় মাটি) যখন এঁদের কেউ না কেউ অকালে মরে যায়, তাঁদের "শহীদ" বলেন না আপনারা। অথচ' খেয়াল করে দেখুন, আপনার পিপিটি প্রেজেন্টেশনের যাবতীয় সুচারু বক্তব্যে যখন এ দেশটা কে "ইনভেস্টমেন্ট ডেস্টিনেশন" প্রমাণ করতে আপনি ব্যাগ্র হয়ে ওঠেন, আপনি আদতে এই শ্রমিকগুলোর কথাই বলছেন কিন্তু। আপনার অর্থনৈতিক মহাযুদ্ধের শহীদ এঁরাই, আপনার যাবতীয় লক্ষ্মীদেবীর মহাযজ্ঞের সমিধ থেকে হবি সবটাই এঁরা। 

কিন্তু এতখানি পড়ার পর ও আপনি ওই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন নিয়েই ভেবে ঘেমে যাছেন। অবিশ্বাসের, অসহায়তার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন গত ৩০ বছর ধরে উত্তোরত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে, যা বিগত ছ' বছরে বিমুদ্রাকরণ থেকে আজকের ওই চূড়ান্ত অপরিকল্পিত লকডাউনের মধ্যে দিয়ে, হিন্দু-মুসলমান প্রফিটেব্ল ব্যবসার মধ্য দিয়ে তা প্রায় প্রতিটি গৃহস্থালি অবধি পৌছে গেছে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে। স্যানিটাইজার খুঁজছেন? আছে। কিন্তু তা বোতলে বিক্রী হয়না। একমাত্র বোধ ও চেতনার বিকাশেই তা পাওয়া যাবে। আর তদ্দিন অবধি দেখতে থাকুন কোন বারুদ কোথায় কখন সামাজিক অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন