বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২০

করোনার প্রেতাত্মা ~ ইন্দ্রনীল মজুমদার

সহসা অস্থিসন্ধি ও পেশীতে প্রবল ব্যথা অনুভব করিলাম। সঙ্গে খকখক কাশি। শ্বাসরোধ হইবার উপক্রম হইলো। গৃহিনী এক প্রৌঢ় বিলাতফেরত বৈদ্যের শরনাপন্ন হইলেন। তিনি অবিলম্বে আমাকে এক বৃহৎ চিকিৎসালয়ে ভর্তি করিয়া লইলেন। কিছু পরেই মহাকাশচারীর বেশ ধরিয়া আবার বৈদ্যমহাশয় আবির্ভূত হইলেন।
 বলিলেন, হাঁ করুন। সিগারেট কলঙ্কিত দন্ত বিকশিত করিলাম। লালারস লইলেন। হাঁ করিয়াই রহিলাম। বৈদ্য গম্ভীরভাবে বলিলেন মুখ বন্ধ করুন। করিলাম। বৈকালে সংবাদ আসিলো। সম্প্রতি এক রোগ আসিয়াছে নাকরো-৯১। উহাই আমার ফুসফুসে চাপিয়াছে। নাসিকায় নল ঢুকাইয়া বিশুদ্ধ বায়ু প্রবেশ করানো হইলো। তথাপি খাবি খাইতেছি দেখিয়া বৈদ্যমহাশয় বিজাতীয় ভাষায় বলিলেন... ভেন্টিলেটর। কিছুতেই কিছু হইলো না। সহসা ফট করিয়া একটি আওয়াজ শুনিলাম। দেখিলাম আমি জানালার ওপর বসিয়া আছি। আবার শয্যাতেও শুইয়া আছি। বুঝিলাম আমি মরিয়া গিয়াছি। ওই আমার পার্থিব দেহ। এতোদিন বৃথাই বস্তুবাদের সাধনা করিয়াছি। আজ বুঝিলাম আত্মা আছে। ঈশ্বর, আল্লা, গড, ভূত, প্রেত, ঘোস্ট, জিন, স্বর্গ, দোজখ সঅঅঅব সত্য। যাহা হউক, জানালায় ঝুলন্ত অবস্থায় সব দেখিতেছিলাম। বিলাতফেরত বৈদ্য পরিস্কার লিখিয়া দিলেন যে আমি নাকরো-৯১ রোগে মরিয়াছি। চিকিৎসালয়ের প্রধান আসিয়া বলিলেন আপনি বলিলে তো আর হইবে না। নদীর তীরে জমিদারনীর 'দুর্ভিক্ষ' নামের প্রাসাদ হইতে যতোক্ষণ না বলা হইতেছে...। বিলাতফেরত বৈদ্য জ্বলিয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমি চিকিৎসা করিলাম... আর কি রোগে মরিলো বলিবে পঞ্চা তেলী? প্রধান জানাইলেন তিনি নিরুপায়। আর জমিদারনীর নিজেরও বিদেশী ডিগ্রী আছে। তদুপরি তিনি ৯১ টি বই লিখিয়াছেন। তাই নাকরো-৯১ রোগ সম্পর্কে  বলিবার তিনি বিশেষ অধিকারিনী। বিলাতফেরত বিখ্যাত বৈদ্য অপমানিত বোধ করিয়া চিকিৎসালয় ত্যাগ করিলেন। ধাপার মাঠে দেহের সদ্গতি হইলো।
আমার লঘু আত্মা হাওয়ায় ভাসিয়া ' দুর্ভিক্ষ' প্রাসাদে উপনীত হইলো। খুব ইচ্ছা করিতেছিলো এই প্রবলপ্রতাপশালিনী জমিদারনীকে একটি প্রণাম ঠুকিবার। প্রাসাদের সর্বোচ্চ তলে তিনি অধিষ্ঠিতা। বামপার্শ্বে বসিয়া আছেন বৈদ্যকূলের পিতামহপ্রতিম অতিপ্রবীন 'সুমু'- বাবু। দক্ষিণে বসিয়াছেন তাঁহারই ছাত্রতুল্য 'অচ'- বাবু। অচ- বাবু যকৃত লইয়া কাজ করেন। ফুসফুসের রোগের সহিত তাঁহার ওঠাবসা নাই। তবে মাঝে মাঝে কবিতা বলেন বলিয়া কবিতাপ্রেমী জমিদারনী তাঁহাকে দলে টানিয়াছেন‌। সুমুবাবু এবং অচবাবু'র মধ্যে বয়সের প্রভূত ফারাক। জমিদারনী তথাপি দুজনকেই সুমুদা এবং অচদা বলিয়া ডাকিতেছিলেন। জমিদারনী বলিতেছিলেন একটা লোক মরিয়াছে আজ। অমুক বৈদ্য বলিতেছে নাকোরো- ৯১... কি করা যায়? সুমুদার বয়স হইয়াছে। বলিয়া ফেলিলেন, ও... অমুক বলিয়াছে? খুব ভালো শিষ্য ছিলো আমার। ও যখন বলিয়াছে তখন নাকরো -৯১ হইবেই। জমিদারনীর মুখ ভার হইলো। অচদা উঠিয়া গিয়া সুমুদার কানে কানে কি বলিলেন। বৈদ্যরাজ সুমুদা যেন সহসা ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিলেন। বলিলেন... উহার কি পূর্বতন কোনো রোগ ছিলো? অচদা বলিলেন উনি লকডাউনে ঘরে বসিয়া কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগিতেছিলেন। ওনার স্ত্রী সিগারেট বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। জমিদারনী বলিয়া উঠিলেন... ইউরেকা। তাহা হইলে লিখুন লোকটা অর্শে মরিয়াছে। দেখিলেন তো কেমন ফটাফট সমাধান দিলাম। তাহা হইলে মৃত্যুসংখ্যা আর বাড়াইয়া কাজ নাই। ওই সাতজনই রহিল। অচদা আপনি ফেরার সময় ভবানীপুরে আমার ওই তাজা ছেলেটাকে একটু দেখিয়া আসিবেন তো! পরপর দু'বার নির্বাচনে পরাজিত হইয়া কারনসেবা বাড়াইয়া দিয়াছে। উহার যকৃতটা একটু দেখিয়া আসিবেন। অচদা বলিলেন আমাদের দুজনকেও একটু দেখিবেন। জমিদারনী মুচকি হাসিলেন।
আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উড়িয়া চলিলাম। শেষ অবধি কোষ্ঠকাঠিন্যে মৃত্যু!! উড়িতে উড়িতে অনেক বন্ধু পাইলাম। সকলেই দুঃখিত। কেউ নতুন জীবাণুতে মৃত্যুর সম্মান পায় নাই। জমিদারনী প্রাসাদে বসিয়া সুমুদা, অচদার সাহায্যে  সবার ভাগ্য বদলাইয়া দিতেছেন। এমত ক্ষমতাশালী জমিদারনীর প্রজা ছিলাম বলিয়া গর্ব অনুভব করিলাম। দুঃখ ঘুচিয়া গেলো। মহানন্দে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন