'এক্সকিউজ মি, প্লিজ'। ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে এলো বাজখাঁই আওয়াজটা, একদম বিশুদ্ধ ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিল বেড়িয়েছিলো অমৃতসরে। সেই মিছিলেই কালা আদমিদের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো এক ধলা, হাতে তার মোমবাতি। আবার গর্জে উঠলো তার বাজখাঁই কণ্ঠ: " উই ওয়ান্ট জাস্টিস"। কাম সারসে, এ যে স্বয়ং জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার!
- মানে? আপনিই তো গুলি চালালেন? আপনার আবার কিসের জাস্টিস চাই?
- আমি চক্রান্তের শিকার। আমরা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করেছিলাম। ডিপ্রেশনে ভোগা দেশিগুলো সব কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করল। প্রমাণ আছে আমার কাছে,মৃতদের পকেট থেকে প্রেসক্রিপশন পাওয়া গেছে।
হতভম্ব জনতাকে আরো অবাক করে দিয়ে মিছিলের আরেকদিকে তখন আবির্ভুত হয়েছেন আরেক সাদা চামড়া। ওরে বাবা, এযে পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও'ডায়ার!
- আপনি তো সেদিনই বললেন ডায়ার যা করেছে ঠিক করেছ। আপনি আবার এখানে?
- উই ওয়ান্ট জাস্টিস।কিছুলোক পাঞ্জাবকে বদনাম করতে চাইছে। এই প্রতিবাদ মিছিলেও সশস্ত্র হামলাকারী মিশে আছে, হয়তো তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে চায়। তাছাড়া এটাও জানানো দরকার আমাদের সেক্যুলার গভর্নমেন্ট কিন্তু এখানেও সেক্যুলার কাজই করেছ।
- মানে ?
- মানে হিন্দু-শিখ নির্বিশেষে সেদিন সবাইকে মারা হয়েছ। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে রেয়াত করা হয়নি।
ততক্ষনে মিছিলে হাজির বুদ্ধিজীবী শিরোমনি প্রখ্যাত সাহিত্যিক রুডিয়ার্ড কিপলিং।
- আপনি না সাম্রাজ্যবাদের প্রবল সমর্থক? আপনার মতে তো আবার ডায়ার নাকি ভারতের রক্ষাকর্তা! তা এদিকে কি পথ ভুল করে?
- উই ওয়ান্ট জাস্টিস। এখন রাস্তায় না নামলে আমার বইয়ের বিক্রি কমে যাবে। বিবিসি রেডিওতে 'ঘন্টাখানেক সঙ্গে ছিঁড়ুন' অনুষ্ঠানেও ডাক পাবো না আর। জবাব চাই, জবাব দাও।
- কার থেকে জবাব চাইছেন ?
- আপনাদের টেগোর এর থেকে।
- কেনো? উনি আবার এখানে কি দোষ করলেন ?
- আদিখ্যেতা হচ্ছে? নাদের শাহের সেনা যখন দিল্লীতে অতো মানুষ মারলো ,তখন নাইট উপাধি প্রত্যাখানের কথা মাথায় আসেনি ?কেবল দুনিয়ার সামনে ব্রিটিশরাজকে বদনাম করার ফিকির।
রবি ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালে। ১৭৩৯ সনে নাদের শাহের আক্রমণের সময়ে তার বয়েস ঠিক কত ছিল সেই কঠিন অঙ্ক কষতে মিছিলের জনতা যখন ব্যস্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে উল্টোদিক থেকে একটা ছ্যাকরা গাড়ি এসে থামলো মিছিলের মুখে। আজ শুধুই অবাক হবার দিন। কারণ গাড়ি থেকে নামলেন খোদ দেশের ভাইসরয়, চেমস্ফোর্ড সাহেব। পরনে ধপধপে সাদা জামা, নীল কোট, পায়ে হাওয়াই চটি আর সাথে তার পোষা একঝাঁক বিড়াল। সাহেব আদর করে এদের নাম রেখেছেন লি-বেড়াল। সে এক আশ্চর্য জানোয়ার মশায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে কোথাও কিছু অন্যায় দেখলে এরাই ভোল পাল্টে সিংহবিক্রমে গর্জে ওঠে সুতীব্র প্রতিবাদে। আর দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই অমনি চেমস্ফোর্ড সাহেবের চটিচাটা মিউমিউ মেনিবিড়াল। আবেগমথিত কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করলেন চেমস্ফোর্ড সাহেব:
" জনতার আবেগকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এর চেয়ে অনেক বড়ো নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে মরক্কোতে, যেখানে শাসক স্প্যানিশ; এ্যাঙ্গোলাতে পর্তুগিজ, কঙ্গোতে বেলজিয়ান বা লিবিয়াতে ইতালিয়ান শাসকদের বর্বরতার কথাও ভুললে চলবেনা। আমরা জানি এই মিছিলেও এইসব ব্রিটিশবিরোধী শক্তির প্রত্যক্ষ মদত আছে। যাইহোক, জনদরদী ব্রিটিশ সরকার নিহতদের পরিবারবর্গকে আর্থিক সাহায্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মৃতের প্রোফাইল অনুযায়ী তার রেটকার্ড ধার্য হয়েছে। পাঁচ হাজার থেকে রেট শুরু ,আর কেউ ডাক্তার হলে তার পরিবার দশ লক্ষ টাকা পাবে। এছাড়া হান্টার কমিশন গঠিত হয়েছে, তাই অপরাধীদের নিস্তার নেই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস।"
এতদূর শুনে মিছিলের মাঝে দাঁড়িয়ে চোয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে জেনারেল ডায়ারের স্বগোতক্তি:
" ধুর মরা এই হয়েছে এক হান্টার কমিশন। গত ছদিন যাবৎ আমাকে ডেকে ডেইলি সাতঘন্টা ধরে সেই একই প্রশ্নগুলো করে যাচ্ছে আর আমিও চপ-সিঙ্গারা গিলতে গিলতে সেই একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। এত চপ-সিঙ্গারা খেয়ে আমার শালা অম্বল হয়ে গেলো"।
এদিকে কখন আবার মিছিলে যোগদান করেছেন সিডনি রাওলাট সাহেব। তার হাতে প্ল্যাকার্ড : 'এক দুই তিন চার, জনবিরোধী রাওলাট আইনের বহিস্কার'।
- এ আবার কেমন আঁতলামি? আপনিই তো যত নষ্টের গোড়া। এ তো আপনার কমিটির তৈরী আইন !
- আমরা আইনের রচয়িতা। ল এনফোর্সমেন্টের দায় কেন নিতে যাবো? তাই সবার সাথে আজ আমিও প্রতিবাদে সামিল। উই ওয়ান্ট জাস্টিস"।
তারপর মিছিলটা অমৃতসর থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার হয়ে হাতিবাগান পেরিয়ে যেইনা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঢুকেছে, ওমনি--------------------------------------------------------------
ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। উল্টোপাল্টা খেয়ে পেটগরমের স্বপ্ন আরকি। বাস্তবের কোন ঘটনার সাথে মিল খুঁজেতে যাবেননা আবার। এক্সকিউজ মি, প্লিজ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন