সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৪

আরজিকর কাণ্ড ~ ডাঃ বিষাণ বসু

আরজিকর কাণ্ডের পনের দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর, আমার যেটুকু ব্যক্তিগত উপলব্ধি, তাতে মনে হয়, সেই রাত্রে ঠিক কীভাবে কী ঘটেছিল, তা কখনোই আর পুরোপুরি স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে আসবে না। শুরুর দিনকয়েক কলকাতা পুলিশ যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে 'তদন্ত' করেছে, তাতে এখন শার্লক হোমস এরকুল পয়রো ব্যোমকেশ বক্সী একযোগে নামলেও পরিপূর্ণ সত্য উদঘাটনের সম্ভাবনা কম। জড়িত কেউ স্বীকারোক্তি জাতীয় কিছু দিলে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আপাতত তেমন সম্ভাবনা তো কিছু দেখছি না।
অতএব, হয়ত 'প্রমাণ' হয়ে যাবে, যে, সঞ্জয়-ই এক এবং একক অপরাধী। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া স্পেসিমেন-এর সঙ্গে তার ডিএনএ-ও নাকি মিলেছে, অতএব…
মদ খেয়ে চুর একজনের পক্ষে প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়েকে মারধর করে খুন ও ধর্ষণ এতসব করা সম্ভব কিনা, এসব প্রশ্নও, হয়ত, প্রশ্ন-ই রয়ে যাবে। আমাদের মেনে নিতে হবে, ধর্ষণ যদি সঞ্জয় করে থাকে (মেয়েটির জীবিত অবস্থায় বা মৃতদেহের উপর), তাহলে খুন-ও সে-ই করেছে। হয়ত সঞ্জয় সাজা পাবে, অথবা যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে গুরু দণ্ড কিছু পাবে না। এই সব কিছুর সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। এদেশে যেমন হয় আর কি!
এখানে পুলিশ অপরাধী ধরার চাইতে অপরাধের প্রমাণ লোপাট করার কাজে বেশি দক্ষ।
এদেশে সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা, তাদেরও অপরাধী ধরার রেকর্ড তেমন ঈর্ষণীয় কিছু নয়।
এদেশে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত আগ বাড়িয়ে শুনানি করতে ডেকে আদ্ধেক শুনে পনের দিন বাদে বাকিটা শুনবেন বলেন।
এমতাবস্থায় আমজনতা যায় কোথায়? খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো, মোবাইল ফোনে ভেসে আসা অজস্র খবরের মধ্যে আশার আলো খোঁজেন। যে খবরের অনেকটাই কল্পিত। গুজব। কিন্তু আশা করতে যে বড় ভালো লাগে! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, অমুকের দিকে সিবিআই এবার নজর দিচ্ছে... তমুকের সঙ্গে অমুকের যোগসাজশ প্রকাশ হয়ে যাবার মুখে...
আশায় আশায়, অনেকেই, খুব খুউব রাগ নিয়ে রাস্তায় নামেন। হাতে হাত রেখে লড়তে চান। প্রশ্ন করেন - এবারেও, এই এত বড় ঘটনার পরেও, কেউ ধরা পড়বে না? অনেকবার আশাহত হতে হলেও, আবারও আশায় থাকেন…
কোনও কোনও সাংবাদিক, দেখলাম, হয়ত শ্লেষের সুরেই তাঁদের প্রশ্ন করছেন - 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' বলে তো মিছিল করছেন, তা জাস্টিস-টা কার কাছে চাইছেন? শুনতে যতোই বিরক্তিকর লাগুক, প্রশ্নটা কিন্তু ভ্যালিড। এমতাবস্থায়, এই আশ্চর্য অবস্থায়, ন্যায় বলতে কী বুঝব? আর সেই ন্যায় কার কাছে চাইব??
দেখুন, এখনও অব্দি 'তিলোত্তমা'-র মৃত্যুরহস্যের সমাধান না হলেও একটা বড় রহস্য কিন্তু প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মানে, ওখানে আর অতখানি রহস্য নেই। এবং 'তিলোত্তমা'-র ধর্ষক-খুনীর পরিচয় ততখানি স্পষ্ট না হলেও, এই রহস্যের কুশীলবদের নাম যথেষ্ট স্পষ্ট। সীমাহীন দুর্নীতি ও সেই দুর্নীতির কাণ্ডারীর নাম। নয়ই আগস্ট রাত্তিরের ঘটনা একা সঞ্জয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা, সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকলেও এই দুর্নীতি যে একা সন্দীপ ঘোষের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, এবিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। খুন-ধর্ষণের দায় একা সঞ্জয়ের কাঁধে ফেলা সম্ভব হলেও হতে পারে - কিন্তু আরজিকর-এর অরাজকতার দায় একা সন্দীপের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা সফল হওয়া মুশকিল।
এবং এই দুর্নীতি - যা আরজিকর মেডিকেল কলেজে উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল অবশ্যই - কিন্তু তা কেবলমাত্র এই একটি মেডিকেল কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল, এমন কখনোই নয়। কথাটা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপকদের সকলেই জানেন - জানতেন অনেকদিন ধরেই - তবে এখন হয়ত কেউ কেউ সেটা মুখে স্বীকার করতে পারবেন। আর ডাক্তারি-জগতের বাইরের লোকজন হয়ত কথাটা - দুর্নীতির এই লেভেলটা - সে বিষয়ে সদ্য জানলেন। মানে, বর্তমান আমলে দুর্নীতি যে কমবেশি সব জায়গায়ই চলে (আর স্বাস্থ্য-দফতর, প্রায় ঐতিহাসিকভাবে, ঘুঘুর বাসা), এটা সবাই জানেন - কিন্তু চিকিৎসা-শিক্ষার দুনিয়ায় তা যে এই স্তরে পৌঁছেছে, সেটা এখন জানতে পারলেন।
অনেকে হয়ত বলবেন, লাগামছাড়া এই দুর্নীতির শুরু ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই। হতেও পারে। হতেই পারে। কিন্তু, বর্তমান শাসকদলের একান্ত বিরোধী হয়েও বলি, আমার তেমনটা মনে হয় না। মানে, দুর্নীতি অবশ্যই ছিল - কিন্তু ব্যাপারটা এই স্তরে পৌঁছেছে গত কয়েক বছরে। মোটামুটি বলতে পারি, বিগত মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনটি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সে নির্বাচনে ঢালাও দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটেছিল - সে আর কোন নির্বাচনে ঘটে না!! - কিন্তু সেই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শাসকদলের এমন একটি গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, যাঁরা 'চিকিৎসক' হিসেবে বিবেচ্য হওয়ার যোগ্য কিনা, সে কথা তো ছেড়েই দিন, যাঁরা মানুষ হিসেবেই 'ভিন্ন' স্তরের। চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তা হয়ে বসলেন এমন নীতিবোধহীন কিছু 'চিকিৎসক', সেই দুর্ভাগ্যজনক সত্যির বাইরে আরও বড় বিপদ - এঁদের ক্ষমতা স্রেফ মেডিকেল কাউন্সিলে সীমাবদ্ধ রইল না। মেডিকেল কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ থেকে ডিন, সর্বত্র নিযুক্ত হতে থাকলেন এঁদের পছন্দের লোক - সবাই ধামাধরা এমন বলব না, কিন্তু অধিকাংশই তেমনই - স্বাস্থ্যশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিতদের ক্ষেত্রেও তা-ই। দেখুন, আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনায় মেডিকেল কাউন্সিলের এক কর্ণধার চটজলদি সেখানে হাজির হন, কাউন্সিলের আরও কিছু তরুণ সদস্যদের নিয়ে। মেয়েটির বাবা-মাকে আত্মহত্যার খবর জানানো হলেও, সেই একই সময়ে (বা তার আগেই) তিনি জেনেছিলেন ধর্ষণ ও খুনের খবর - একথা তিনি নিজেই মিডিয়াকে জানান। পুলিশের তদন্তের সময়কালে (নাকি আগেই) তিনি কেন এসেছিলেন? তিনি কেন ধর্ষণ খুনের ঘটনা বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন? যে সন্দীপ ঘোষ বিষয়ে এত কথাবার্তা উঠছে, কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মাসকয়েক আগেই তাঁকে ঢালাও সার্টিফিকেট দিয়েছেন। কাউন্সিলের তরুণ তুর্কীদের প্রায়শই দেখা যেত আরজিকর-এ - এমনকি মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনের 'বিজয়োৎসব' প্রথম পালিত হয় ওই আরজিকর-এই। মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নাক গলাচ্ছেন, এমন এর আগে ঘটেনি।
মেডিকেল ছাত্র-রাজনীতিতেও একটা বড় বদল এসেছে এঁদের কল্যাণে। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নির্বাচন তুলে দেওয়ার সুবাদে ছাত্র-রাজনীতি বলতে মূলত দাদাগিরি - তোলাবাজি ইত্যাদি - ও পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো কমানো। শাসক-ঘনিষ্ঠ ছাত্র-রাজনীতি ও শাসক-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক-রাজনীতি যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও দুইয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল - দূরত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক, এবং বাঞ্ছনীয় - বর্তমানে সেটি মুছে ফেলা গেছে। ছাত্র-নেতারা অধ্যাপকদের 'চমকায়' - অধ্যাপকরাও তাদের তোয়াজ করে চলেন, কেননা বদলি থেকে পদোন্নতি, সবই তরুণ তুর্কীদের হাতে। এবং স্বাস্থ্য-দফতরের শীর্ষ আমলা শাসকদলের ছাত্র-সংগঠনের অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন - গদগদ হাসি মুখে পুষ্পস্তবক হাতে ছবি তোলেন - অতএব, আনাড়িরাও চট করে বুঝে যান, ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ঠিক কোনখানে।
তো পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা, এই মুহূর্তে, শাসকদলের যে গোষ্ঠীর দ্বারা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে - অনভিজ্ঞ আনাড়ি দুর্নীতিগ্রস্ত মূল্যবোধহীন কিছু জুনিয়র ডাক্তারের দ্বারা, মূলত - সঙ্গে কিছু ঘোড়েল ও ধান্দাবাজ সিনিয়র তো আছেনই, যেমন থাকেন - তার খোলনলচে না বদলালে কিছুই কাজের কাজ হবে না।
জাস্টিস চাই, বলতে - অন্তত এটুকু হোক।
সরকারি কর্মী হিসেবে এবং রাজ্যের একজন নাগরিক হিসেবে, আমার জাস্টিস-এর দাবি আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক হিসেবে দাবিটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছেও।
সিবিআই তদন্ত করতেই পারে - মহামান্য আদালত বিভিন্ন আকর্ষণীয় 'অবজারভেশন'-এর পর পরবর্তী শুনানির তারিখ শোনাতেই পারেন - কিন্তু নিজের দলের সীমিত কয়েকজন গোষ্ঠীবদ্ধ মাফিয়া সিন্ডিকেট গোছের কিছু চালিয়ে গেলে তা শুধরানোর দায় সেই দলের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের। এখানে 'তদন্ত চলছে' বা 'বিষয়টি বিচারাধীন' বলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সব জানার পরেও - বিশেষত সব প্রকাশ্যে আসার পরেও - না শুধরাতে চাইলে ধরে নিতে হবে, এই অনাচার চলে এসেছে (এবং চলতে দেওয়া হবে) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে।
তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুলিশমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ জাতীয় কিছু দাবি আমার এখুনি নেই - গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে গেলে ভোটের মাধ্যমেই সরাতে হবে, পদত্যাগের মাধ্যমে নয় - কিন্তু, জাস্টিস চাই বলতে আমি চাই রাজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের খোলনলচে বদল। প্রকাশ্যে যে মুখগুলো রয়েছে - চিকিৎসক-প্রশাসক থেকে শুরু করে আমলা অব্দি সকলেই - এবং আড়াল থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছে, তার প্রতিটি স্তরে এখুনি বদল জরুরি। এবং যে চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভালের দায়িত্ব যে মেডিকেল কাউন্সিলের, সেই স্টেট মেডিকেল কাউন্সিলের শীর্ষ সদস্যদের নাম যখন দুর্নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, তখন সেই কাউন্সিলকে যে বরখাস্ত করা একান্ত জরুরি, সে তো বলা-ই বাহুল্য।
এটুকু-তে সর্বজনস্বীকৃত জাস্টিস হবে কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু অন্তত এটুকুও না হলে যে স্বাস্থ্য-প্রশাসন ও সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা ফিরবে না, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এবং, আমার মতোই, রাস্তায় যাঁরা আছেন, বিশ্বাস করুন, এই পোস্ট হতাশার পোস্ট নয়। অন্তত এই দাবিটুকু যদি আদায় হয়, তা, অন্তত স্বাস্থ্যব্যবস্থার পক্ষে, মস্ত বড় বদল। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং আগামী প্রজন্মের ডাক্তারি শিক্ষা - এই দুইয়ের পক্ষেই, এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চাহিদা এখুনি মনে পড়ছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন