অদ্ভুত আজগুবি চিন্তা ভাবনা এবং যখন তখন আইডিয়া প্রসব করার সুনাম বা দুর্নাম আমার আজকের নয়, বহুদিনের সঙ্গী। আজকে লিখবো এরকম ই এক আইডিয়া এবং তার অকালমৃত্যু নিয়ে।
অনেক অনেক অনেক দিন আগে, যেদিন কলেজ হস্টেলে ল্যান্ড করেছিলাম, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে... ঘটনাটা সেই কালের।
আমাদের হস্টেল গুলো, কলেজ বিল্ডিং থেকে খুব দূরে না হলেও, বেশ দূরে ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অতটা হেঁটে কলেজ যাওয়ার জন্য তো অনেকটাই দূর৷ তাই আমরা অধিকাংশই সাইকেলে ভরসা করতাম। সাইকেল অবশ্য নতুন কেউই কিনতাম না। পাসিং আউট ইয়ারের দাদারা ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের দিয়ে যেতো। দিয়ে মানে দান করে যাওয়া নয়, বেচে দিয়ে যেত। তিনশো,চারশো এরকম সব দামে। যে দাদারা ক্যাম্পাস থেকেই সাত আটশো টাকা মায়নার একটা চাকরি লড়িয়ে দিত... তারা দু এক জন দানছত্র করে থাকলেও থাকতে পারে। আমার জানা নেই। সেই সাইকেল কেনাটাও হত শেয়ারে। ফার্স্ট ইয়ারের দুই রুমমেট মিলে একটা সাইকেল কিনলো শেয়ার করে... এই সব হত। আমিও কিনেছিলাম। জোট বেধে আমার রুমমেট কৌশিকের সাথে। আমরা বলতাম ডাব্লিং। মানে একজন চালাবো আরেকজন সামনের রডে। এভাবেই চার বছর...
সাইকেল ছাড়া আমরা অসহায় ছিলাম। শুধু তো কলেজ যাওয়া নয়, ক্যান্টিন, টাউনে বিকেলে গিয়ে টাউনের মেয়েদের সাথে তিস্তা উদ্যানে লাইন মারা, সিনেমা হলে যাওয়া, টাউনে টিউশন করতে যাওয়া, টাউনে ক্যালাকেলির খবর এলে দ্রুতগতিতে স্পটে পৌঁছে যাওয়া.... প্রচুর প্রচুর কাজ ছিল সাইকেলের।
এই সাইকেলের অপরিহার্যতা কে আমি একটা অপরচুনিটি হিসেবে দেখেছিলাম। একটা স্কোপ, একটা স্টার্ট আপ...
মাথায় অনেকদিন ধরে ব্যাপারটাকে খেলিয়ে তারপর কোন এক ইউনিয়ন মিটিং এ প্রস্তাব টা রেখেছিলাম।.... " হোয়াই সাইকেল? হোয়াই নট গরু?!!"
আমরা সাইকেল ব্যবহার না করে যদি গরু ব্যবহার করি তাহলে কত গুলো দিগন্ত খুলে যাবে আমাদের সামনে ভেবে দেখুন জনগণ।
সাইকেলের বদলে গরু কেনার প্রথম ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে যার যার বাবাকে৷ পে ব্যাক ইন সিক্স মান্থস। দুই রুমমেট মিলে ভাগাভাগি করে যদি এই কচি বয়সে আমরা সাইকেল কিনে ফেলতে পারি তাহলে দুই বাবা এই দামড়া বয়সে ভাগাভাগি করে একটা গরু কিনতেই পারে। নো বিগ ডীল। ইউনিয়নে সর্বাসম্মতিক্রমে পাস হলে আমিই প্রথম আমার বাবাকে পোস্ট কার্ডে লিখে জানাতে রাজি... এতদূর পর্যন্ত কমিটমেন্ট ছিল আমার৷
প্রথমেই যা হয়। পিপুল উইথ নো আইডিয়া, খিল্লি,খিস্তি এসব ই করে। আমার সাথেও সেটাই হয়েছিল। আমি দমে যাই নি। এক এক করে, চুন চুন কে অ্যাডভান্টেজ ব্যাখ্যা করেছিলাম। কি রকম?
প্রথম : ক্যাম্পাসে একমাত্র দুধের সাপ্লায়ার ভজুয়া। ওর আছে তিনটে গরু। আজ নয়। বহুকাল ধরেই আছে। গরু বাড়ে না কিন্তু নতুন নতুন খরিদ্দার যতই বাড়ুক ওর, মানা করে না। কারণ... ওর পাতকুঁয়াটা। আজ ক্যাম্পাসের চারশো জনের মধ্যে দুশো জন ওর থেকে দুধ নেয়। কাল, রাতারাতি তিনশো লোক চাইলেও ও ঘাড় নাড়িয়ে রাজি হয়ে যায় এবং সাপ্লাই ও দেয়। হাউ? এমন কি প্রফেসর কোয়ার্টারেও ঐ একটাই পাতকুঁয়া দুধ দেয়। আর আমরা, বাবাদের এত কষ্টের পয়সা, দুধ খাবো বলে নির্লজ্জের মত পোস্টকার্ডে লিখে লিখে এক্সট্রা টাকা চাই... সে কি না ঐ কুঁয়ার জল কেনার জন্য?!!!
নিজের নিজের গরু থাকলে খাটি টাটকা দুধ। এক বালতি করে রোজ। ব্রেকফাস্ট এ দুধ মুড়ি, লাঞ্চে দুধ কলা ভাত, ডিনারে দুধ রুটি। ভাবা যায় কি সেভিংস!! মেস বিলের এই চোখ রাঙানির অন্তর্জলি যাত্রা, পার্মানেন্টলি।
নেক্সট : গোবর৷
ভজুয়ার তিনটে গরুর পিছন পিছন কতগুলো গোবর কুড়ানি মেয়ে, বউ ঘোরে রোজ, খেয়াল করেছিস? একটা বাইপ্রোডাক্ট নিয়েও ভজুয়া রংবাজি এবং *গীবাজি... দুটোই করে যাচ্ছে... বছরের পর বছর৷ কি অপরিসীম সম্ভাবনা আছে কারো নজরেই আসছে না?
ঠিক এইসময় আমাদের প্রদ্যোত দা নড়েচড়ে বসেছিল মনে আছে আমার। ওর ফ্যান্টাসি ছিল গোবরকুড়ানিরা। যা হয়... মহিলা বিহীন ক্যাম্পাস...আগুণের মত বয়স। যেই না বলেছি... আমাদের নিজস্ব অত গুলো গরু, কত্ত কত্ত গোবর, অনেক অনেক গোবরকুড়ানি মেয়ে বউ... প্রদ্যোত দা.... " সহমত গুরু, পাশে আছি " ঝেড়েই দিয়েছিল উত্তেজনায়। ওকে শান্ত করে... গোবরকুড়ানি এবং ঘুঁটে বেচার লভ্যাংশ ইকনমিক্স টা বোঝানোর পরে.... আনন্দে হল ছেড়ে ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে বিড়ি ধরিয়ে কার যেন গোবর কোড়ানো দেখাও শুরু করে দিয়েছিল, লোকে বলে।
এতো গেল অর্থনৈতিক দিক। এবারে আসছে প্রতিরক্ষা মানে ডিফেন্স।
টাউনের ছেলেদের সাথে মারামারি লেগেছে... আমরা কতগুলো মর্চে পড়া সাইকেল নিয়ে ডাবলিং করে ক্যাঁচকোঁচ করে হাজির হচ্ছি ... এটা কারেন্ট সিচুয়েশন। একটা গ্ল্যামার হীন, ক্যারিশমাহীন, শিভালরিহীন এন্ট্রি৷ এবারে ভাব... পঞ্চাশ টা ইঞ্জিনয়ারিং কলেজের ছেলে... হাতে টী স্কেল.,হকি স্টীক,ক্রিকেট ব্যাট.. পঁচিশটা গরুর পিঠে চেপে ঠ্যাকাঠ্যাক ঠ্যাকাঠ্যাক করে রূপমায়া হলে ঢুকছি.,ক্যালাকেলি করতে..... এমনিতেই টাউন কেঁপে উঠবে। তখন তো বাহুবলী সিনেমাটা হয় নি। নয়তো আমার বোঝাতে সুবিধাই হত৷
এত দূর বলার পরেই, অ্যান্টি গোষ্ঠী জেগে উঠলো। আমার প্রোপজালটাকে নস্যাৎ করে দিতে।
পুরুলিয়ার কোন এক গ্রাম থেকে আসা এক পাকা ছেলে... প্রথম ইস্যুটা ছাড়লো।..... " সারা বছর দুধ পেতে গেলে অনেক ষাঁড় লাগবে। ভজুয়া মাঝে মাঝে যে রোমিওটাকে ধরে এনে ওর তিনটে গরুর সাথে নষ্টামি করায়... তার একার পক্ষে দুশো গরুর সাথে ইয়ে করা সম্ভব হবে না। আর আমরা কেউ ষাঁড় কিনতে রাজি নই। দুধের ডিল না হলে... শুধু গোবর দিয়ে আমাদের বাবাদের ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট পে ব্যাক হবে না। বে ফালতু ষাঁড় গুলো মস্তি নেবে আর আমরা আঙুল চুষবো... এটা হতে পারে না।
ইন্দ্রজিৎ দা তখন টাউনের কেতকীর সাথে হেব্বি লাইন মারছে। সাহস পেয়ে ও বলে উঠলো... " সামনের রডে বসিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটা আলাদা চার্ম৷ গরুর পিঠে শাড়ি পরে ওঠা ডিফিকাল্ট। আর পিডি গার্লস এর ইউনিফর্ম শাড়ি করে দিয়েছে ক্লাস নাইন থেকেই। বেরোলে কলেজ কেটেই বেড়োতে হয়। "... এটাতে দেখলাম প্রবল সমর্থন পেয়ে গেল প্রতিপক্ষ।
আমার বুকটা একেবারেই ভেঙে গেল যখন আমার নিজের রুমমেট... চূড়ান্ত ঘষু ( ঘষু মানে.. সারাদিন বই ঘষা পাব্লিক) কৌশিক বলে বসলো... অতগুলো গরুকে কলেজের ঐ টুকু সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে ক্লাসে গিয়ে যদি দেখে সবকটা মিলে হাম্বা হাম্বা করছে... কিচ্ছু শুনতে পাবে না, নোট নিতে পারবে না... তাছাড়াও বিকেলে একটা টাউনের মেয়েকে টিউশন পড়াতে যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে বলে মাসে একশো টাকা দেয়, নয়তো এমনিতে রেট সত্তর টাকা। সেখানে ও ছাত্রীবাড়ির বাইরে গরু বেঁধে পড়াতে ঢুকলে ওর এবং কলেজের মান সম্মান দুটোই যাবে। স্যাট করে একশোটা সত্তর হয়ে গেলে ওকে আবার চার্মিনার স্পেশাল ছেড়ে বিড়িতে ফিরতে হবে। একেবারেই আনডিজায়ারেবেল সিচুয়েশন হবে সেটা।
গুরুর ফ্যান... সোমদত্ত... প্রতি সিনেমা ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো আজ ও মারে... ও দেখলাম প্রতিবাদ করে উঠলো...। হলে দুটাকায় সাইকেল রেখে ঢোকা যায়৷ এত গুলো গরু সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে গুরুর সিনেমায় কন্সেন্ট্রেট করা যাবে না। সাইকেলে চেন মেরে, লক করে যাওয়া যায়। গরু কেউ স্ট্যান্ড থেকে খুলে নিয়ে চলে গেলে বাবার যখন চিঠি আসবে... " বাঃ গরু, তুমি গরুটাও হারালে?"... খুব বাজে ইজ্জতে লেগে যাবে। "
শেষ বারের মত ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছিলাম...." ভেবে দেখ, আজ টায়ার,কাল ব্রেক,পরশু স্পোক হাজার মেইন্টেনেন্স ঝামেলা। গরুতে এসব ঝামেলাই থাকবে না। "
উড়িয়ে দিল আমাকে সবাই৷
আজ খুব খুব কষ্ট হচ্ছে মনে৷
এই দিলীপদার দেওয়া তথ্য গুলো যদি সেদিন জানতাম...জাস্ট অর্থনৈতিক অ্যাঙ্গেল দিয়েই বাজি মাত করে বেরিয়ে আসতাম। ক্যাম্পাস আজ গরুতে গরুতে ভরে থাকতো... আর ফার্স্ট ইয়ার থেকে লাস্ট ইয়ার মায় আমাদের ফ্লুইড ডায়নামিক্স, স্ট্রেংথ অফ মেটেরিয়াল, কম্বাশচন ইঞ্জিন পড়ানো প্রফেসর গুলোও এই মোটা মোটা সোনার হার,বালা,বাউটি পরে বাপ্পি লাহিড়ীর মত ঘুরতো।
একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু... এ ছাড়া আর কি ই বা বলবো একে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন