--'যাত্রা দেখে আলেন বুঝি, মাঠান?' প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলেন নিভাননী। হেমন্তের ভোর। সবে আলো ফুটছে। সে আলোয় যেটুকু ঠাহর হয়, তাতে মনে হল, বারান্দায় চাদর মুড়ি দিয়ে চেয়ারে বসে আছে যেন কেউ। প্রশ্নটা তারই। হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছিলেন তিনি। পাড়ার বাকি মেয়ে-বউরা পিছনে পড়ে গেছে। চেয়ার ছেড়ে ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে লোকটা। হাতের কাঁসার গেলাসটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল," একটু চা করে খেয়েছি। তা' আমি কায়েতের ব্যাটা, রান্নাঘর অশুদ্দু করিনি আপনের।"
--"কিন্তু তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না, বাবা--"
--"চেনার কথাও নয়, আজ্ঞে। আমি চোর।" বিনীতভাবে কথাটা বলেই বারান্দার কোন থেকে কাপড়ের পুঁটলিটা তুলে নিয়ে একলাফে নিমেষে ধাঁ হয়ে গেলো লোকটা। নিভাননী ততক্ষণে সিঁড়িতেই বসে পড়েছেন ধপ করে।
কর্তা ঘুম থেকে উঠে সব শুনে বললেন," বাঃ, বেশ সপ্রতিভ চোর তো! পাকা চোরকে কেমন হতে হয়, জানো? শূদ্রকের 'মৃচ্ছকটিকে' শর্বিলক নামে আর এক চোরই বলে দিয়েছে সে কথা। সে হবে আক্রমণে বিড়াল, পলায়নে হরিণ, লুঠে বাজ, গৃহস্থ জেগে না ঘুমিয়ে, তা শুঁকে বোঝায় কুকুর, চলনে সাপ, স্থিরতায় পর্বত, গতিতে পক্ষীরাজ,পর্যবেক্ষণে গরুড়, কেড়ে নিতে চিতা আর শক্তিতে সিংহের তুল্য।" এদিকে ঘরে ঢুকে নিভাননীর তখন মাথায় হাত।, রান্নাঘরের বাসন বেবাক ফাঁকা করে গেছে এযুগের শর্বিলক। মৃচ্ছকটিক শোনার চেয়ে তাঁর কাছে জরুরি এখন, দুপুরে ভাত বাড়ার জন্যে কলাপাতা কেটে আনা।
চুরি ব্যাপারটা গৃহস্থের কাছে সুখকর না-হতে পারে, কিন্তু একে চৌষট্টি কলার অন্যতম বলে স্বীকৃতি দিয়ে জাতে তুলে দিয়েছেন বাৎস্যায়ন। বাকি সব বিদ্যার মতো এই চৌর্যকলাও যে রীতিমত গুরুসঙ্গ করে 'অধ্যয়ন' করতে হত, তার প্রমান, 'ষন্মুখকল্পম' বা 'চৌরচর্যা'র মতো চৌরশাস্ত্র। এই 'ষন্মুখ' বা ষট মুখ হলেন দেবসেনাপতি, কুমার কার্তিকেয়। তস্করকুল 'শুভকাজে' হাত দেবার আগে ছয় মুখ, বারো হাত, সোনার বরণ এই সুদর্শন দেবতাটিকেই যথাবিহিত আরাধনা করে। "ওঁ বন্দেঅহং মহাত্মানং ময়ুরোপরি সংস্থিতম। / বিশ্বেশং শত্রূহন্তারম দ্বাদশাস্ত্রৈচ শোভিতম।/ তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভম নানালংকারভূষিতম।/ ষন্মুখং পুত্রদায়কম তস্করাধিপতিম সুরম।" একদিকে যিনি সুরলোকের রক্ষক, অন্যদিকে তিনিই চোর চূড়ামণি ।
তস্কর সমাজে গোত্রভেদ অতি প্রবল। ডাকাতের সঙ্গে সিঁধেল চোরকে, ছিঁচকের সঙ্গে গাঁটকাটাকে গুলিয়ে ফেলা সেখানে অমার্জনীয় অপরাধ। ডাকাতিতেপ্রাধান্য পায় পেশিশক্তি আর নৃশংসতা, তুলনায় চুরির কারুকাজ অনেক বেশি। চৌর্যকর্মটি নির্বিঘ্ন করতে শাস্ত্রমতে চোরকে মারণ, উচাটন, স্তম্ভন, বশীকরণ ও শান্তিকর্ম এই পাঁচটি তান্ত্রিক আভিচারিক ক্রিয়া করতে হত বটে, কিন্তু সচরাচর খুনির তকমাটি তারা এড়িয়েই চলত। চুরিবিদ্যায় হাতেকলমে শিক্ষার ছবি পাই মনোজ বসুর 'নিশিকুটুম্ব'তে। .
'...ঘরে ক'জন?
-- দু-জন।
--ঠিক করে বলছ বটে?
-- হ্যাঁ, দু'রকমের নিশ্বাস ঘরের মধ্যে। দুরকম ছাড়া তিনরকম নয়, একরকমও নয়। তবে মানুষ নয় দুজনাই, একটি ওর মধ্যে বিড়াল। বিড়াল ঘুমুলে ঘু-উ -উ একটা শব্দ হয়।
--সাবাস বেটা। কী মানুষ,দেখি বলতে পারিস কিনা।
--মেয়েমানুষ। সধবা।
--পুরুষ নয় কেন? সধবাই বা কেন?
--পাশ ফিরলেই চুড়ির আওয়াজ। বিধবা বা পুরুষ হলে হাতে চুড়ি থাকতনা।
কিন্তু এমন চোরচক্রবর্তী তো সকলে হয় না। কোথাও আবার বুদ্ধিতে গৃহস্থ তাকে হারিয়ে দেন। একা মহিলা ঘুমিয়ে আছেন কোলে শিশুটি নিয়ে। চোরের খুটখাট শুনে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পড়ে। কিন্তু চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করার বোকামিটি না করে মরীয়া হয়ে শুধু একটু অভিনয় করলেন তিনি। পাশের কোলবালিশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ে ফিসফিস করে (যা পাশের ঘরে শোনা যায়) বললেন, "শুনছ, ঘরে মনে হয় চোর ঢুকেছে। ওঠ শিগগির। তোমার পিস্তলটা কি বালিশের তলায় নাকি দেরাজে তুলে রেখেছ আবার? কতবার বলেছি লোডেড বন্দুক নাগালের মধ্যে বাচ্চার নাগালের মধ্যে রাখবে না। নাও ওঠ এখন। প্রাণের মায়া বড় মায়া। বালিশে মাথা রেখেই একাকিনী টের পান, 'অতিথি'র নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ।
সে একটা সময় ছিল, যখন চোরেদের মধ্যে সিঁধেলরা ছিল কুলীন। শিক্ষাশেষে গুরুর আশীর্বাদধন্য সিঁধকাঠি হাতে পাওয়াই ছিল যৌবরাজ্যে অভিষেক। শ্মশানের কয়লা আর রক্ত দিয়ে রাক্ষসমুখ, নারীমুখ, মৎস্যমুখ, চাঁদ, সূর্য বা পদ্ম এঁকে সেই বরাবর সিঁধ কেটে ঢুকতে হবে। ওস্তাদেরা বলতেন, সিঁধ এমন হবে যে পরদিন প্রতিবেশী চোরের বাপান্ত করলেও সিঁধের প্রশংসায় যেন পঞ্চমুখ হন। সিঁধ কেটে প্রথমেই মাথা গলিয়ে দিতে নেই। আগে নকলি বা পুতুল ঢুকিয়ে ভিতরের পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে প্রথমে গলাতে হবে পা। তারপর সন্তর্পণে এমন ভাবে গলিয়ে দিতে হবে শরীর। বরাত খারাপ হলে তার আগেই গৃহস্থ যদি পা ধরে ফেলে তাহলে মুশকিল। একজন ধরা পড়লে পুরো দলটাই ধরা পড়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে কোন সময় হতভাগ্য চোরটির পরিচয় হাপিস করতে তার মাথাটাই কেটে নিয়ে গেছে স্যাঙাতরা এমন নজিরও আছে।
কথায় বলে, 'চোরে কামারে দেখা হয় না'। চৌর্যশাস্ত্রের বিধিই তাই। কামারের ঘরে চুপি চুপি এসে কাঁচা টাকা রেখে সিঁধকাঠির বরাত দিয়ে চলে যাবে চোর। নির্দিষ্ট সময় পরে ঠিক সেখানেই তৈরি থাকবে কাঠি। ক্রেতা-বিক্রেতা সাক্ষাৎ হওয়া মানা। ঘুমপাড়ানি মন্ত্রবলে ঘরের মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে চোর যখন ঢুকবে তার সঙ্গে থাকবে আলোর পোকা আর বীজ। পোকা ডানার ঝাপটায় প্রদীপ নিভিয়ে দেবে। মাটিতে টাকাকড়ি, সোনাদানা পোঁতা থাকলে মন্ত্রপূত বীজ সেখানে পড়লে ফুটে যাবে ফটফট করে। চোখে মায়াকাজল লাগিয়ে অদৃশ্য হওয়া বা চুরিতে কেউ বাধা দিলে গুপী গায়েনের মন্ত্রী মশাইয়ের মতো 'থেমে থাক' বলে তাকে স্থানু করে দেওয়ারও তন্ত্রবিধি রয়েছে শাস্ত্রে।
সিঁধ কাঠি আবার শহরে অচল। রাত দুপুরে খড়খড়ি জানালার তলা দিয়ে ঢুকে আসে লম্বা লগি। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছেলে-ছোকরারা কাটা ঘুড়ি ধরে যা দিয়ে, তেমনি। সত্তরোর্ধ বৃদ্ধা বিছানা থেকে দেখেন, সে লগির চলন সিধে তার আলনাটির দিকে। বাটা খুলে একটি পান মুখে দিয়ে তিনি ধীরেসুস্থে গিয়ে জেঁকে বসেন লগির ওপর। চোর পড়ল বিপাকে। লগি নড়ে না কেন দেখতে কার্নিশে উঠে সোজা বুড়ির সঙ্গে চোখাচোখি -- "ওমা, হারু! তুই আবার চুরি ধরলি কবে থেকে?" হারু ততক্ষণে লগি-টগি ফেলে দে-ছুট! বুড়ি চিনে ফেলেছে। আজকে চোর হলেও তারও একটা টুনটুনির বইয়ের শৈশব ছিল। ঊর্ধশ্বাসে পালাবার সময় সেই বইয়ের ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতির পাতা থেকে যেন জ্যান্ত হয়ে ওঠে পান্তা বুড়ির অবয়ব। পান্তা চোরকে শিক্ষা দিতে যে কিনা হাঁড়িতে শিঙি মাছ, উনানে বেল, দোরে গোবর আর ঘাসে ক্ষুর রেখে দিয়েছিল। হারুর বোধের মধ্যে কোথায় যেন পাড়ার এই খুনখুনে ঠাকমা আর পান্তাবুড়ি একাকার হয়ে যায়।
চোরেদের কথা উঠলে আশপাশে সকলের ঝুলি থেকে চোর-পাকড়ানো, চোর-তাড়ানো বা নিদেন চোর-পালানোর এক-আধটা গল্প উঁকি দেবেই। তারমধ্যে রোমহর্ষক ভয়ের গল্পের পাশাপাশি থেকে যান পঞ্চার পিসে, যিনি নাকি পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয় ঘুম চোখে আয়নায় নিজের গেঞ্জিপরা চেহারা দেখে চোর সন্দেহে গুটিগুটি এগিয়ে রামধাক্কা খেয়েছিলেন আলমারিতে। শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে পিসি চিৎকার জোড়েন, "পাকড়ো পাকড়ো , চোর হ্যায়।" পিসে তার মুখে হাত চাপা দিয়েও থামাতে পারেন না। রঘুর বোন-ভগ্নিপতি জামাই-ষষ্ঠীতে এসেছে। পাশাপাশি দু'ঘরের মাঝে একটিই বাথরুম। মাঝরাতে জামাই সেখানে যেতে গিয়ে শাশুড়ির ঘরের শিকল তুলে খুলতে ভুলে গেছে। ওদিকে দরজা খুলছে না দেখে মা-ছেলে ভাবল, নির্ঘাত চোর পড়েছে। ছেলে রাম ভীতু। বলল, "দাঁড়াও, আমরা সজাগ আছি দেখলে চোর পালাবে। রাত আড়াইটায় তবলা টেনে নিয়ে বাজাতে বসল রঘু। রাতের নিস্তব্ধতা খান-খান করে তবলার বোল পিলে চমকে দিল গোটা পাড়ার।
সময়ের সঙ্গে চুরিও তার চরিত্র বদলেছে। সাইবারক্রাইমের হাইটেক শিল্পসুষমা মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে অনায়াসে। নব অবতারে সিঁধ হয়েছে গ্যাস-কাটার, কংক্রিট থেকে ইস্পাত কিছুই তার অভেদ্য নয়। আরও মহিমময় হয়েছে সাহিত্যে চুরি -- কুম্ভীলকবৃত্তি। তার বাড়বাড়ন্তে দোসর হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াও। তবে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক চুরি বোধহয় সেটি যা চোরকে বিন্দুমাত্র ধনী না করেও তার শিকারকে করে দেয় নির্ধন, নিরালম্ব। নিছক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বেমালুম লোপাট হয় ব্যক্তির সম্মান। মনে পড়ে ওথেলো নাটকের সেই দীর্ঘশ্বাস – "But he that filches me my good name / Robs me of that which not enriches him / And makes me poor indeed."
আজ সাতসকালে এই চোর-চর্চার মূলে আছেন চৌর্য কূলাধিপতি কুমার কার্তিক। বাঙালির মাসাধিককাল লম্বা পুজো-মরসুম আজ শেষ হচ্ছে তাঁর আরাধনা দিয়ে।
শুভ চৌর কার্তিক পূজা!
তথ্যসূত্র:
চৌর্যসমীক্ষা -- ডঃ পুরীপ্রিয়া কুনডু
নিশিকুটুম্ব -- মনোজ বসু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন