বৃহস্পতিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৯

মকর সংক্রান্তি ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

উত্তরায়ণ সংক্রান্তি  সমাগত, সে দিনে সকাল সকাল মকর স্নান করার জন্য মাতা যশোমতী বালক শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রে বলেছেন-
"আসিল যে পৌষ মাস শুনহ রাজন।
দ্বিদশ  নবম  দিন  দিল  দরশন ॥

সকালে স্নান শুনেই শ্রীকৃষ্ণের পেট গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল, সেই ঠাণ্ডা জলে স্নান সে একমাত্র বহু কষ্টে সরস্বতী পুজোর দিন করে তাও যদি দেবী রুষ্ট হয়ে অঙ্কে ফেল করিয়ে দেন সেই ভয়ে, তাই কৃষ্ণ মাতা যশোমতীকে নানা অজুহাত দেওয়া শুরু করল। যশোমতী আবার এসব স্কুলে বহুদিন আগেই পড়াশুনো করেছেন, সুতরাং শ্রীকৃষ্ণের শরীর ভাল নেই, সর্দি লেগেছে। গা ম্যাজম্যাজ করছে বিশেষ পাত্তা পেল না। যশোমতী বললেন হ্যাঁ রে এই যে সারা দুপুর টোটো করে ঘুরে বেড়াস, বাঁশি বাজাস, ২০-২০ খেলিস তখন তো তবিয়ৎ আচ্ছা থাকে, যশোমতী বহুদিন মথুরায় ছিলেন তাই কথায় মাঝে মধ্যে হিন্দি শব্দ ঢুকে পড়ে।

শ্রীকৃষ্ণ শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রস্তাব দিলেন গরম জলে স্নান করলে হবে না, শুনে যশোমতী যেন আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন আরে এ স্নান গঙ্গাসাগরে করতে হবে, অনেক দূরের পথ, রাত থাকতে বেরতে হবে, শেলদা, ডায়মন্ড হারবার, নামখানা গঙ্গাসাগর। শ্রীকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা এ পথে কি তিব্বত ডোকালামও যাওয়া যায়? যশোমতী তখন কয়লার উনুনে রুটি ভাজছিলেন, বললেন সে আমি অত জানি না, দরকার হয় তো গুগুল ম্যাপ দেখে নে।

মোবাইল তখন চার্জে বসানো, শ্রীকৃষ্ণ দেখেন একগাদা মেসেজ, হোয়াটসএপে হ্যাপি মকর সংক্রান্তির ছবি, শুভেচ্ছা ভর্তি, একজন সাধু একগলা জলে দাড়িয়ে পুণ্যস্নান করছেন আর সূর্যপ্রনাম করছেন। শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে ভাবলেন কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ।তবে আগে স্নান না আগে সূর্যপ্রণাম এ নিয়ে তিনি ভয়ানক দ্বন্দে পড়ে গেলেন। উপায়, উপায় একটাই বেনিমাধব শীলের হাফ পঞ্জিকা, কিন্তু কাজের সময় কি সে হাতের কাছে পাওয়া যাবে?

 

যশোমতী পিঠে বানাবেন, নারকেল, খেজুর গুড়, চালের গুড়ো সব বাজার থেকে শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে আনিয়েছেন, বালক শ্রীকৃষ্ণর আজ ভারি মজা, রুটি তরকারি খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেছে, খাওয়াদাওয়াতে খানিক ভ্যারাইটি না হলে হয়, ইদানিং আবার অনলাইনের এক ফ্যাসান হয়েছে, সেদিন ধৃতরাষ্ট্র জ্যাঠার বাড়ি অনলাইনে আনা পাটিসাপটা দিয়েছিল জেঠি সে যে কি অখাদ্য যে না খেয়েছে কি বুঝবে। ওদিকে দুর্যোধন কানের কাছে ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে আমাদের হয়ে লড়াই করুন, সকাল বিকেল পাটিসাপটা পায়েস ফ্রি। শুনে কৃষ্ণ তো বলেই বসলেন তোরা খালি কখন অনলাইনে সেল লাগে সেই খোঁজ রাখ আর যত পুরনো এক্সপায়ার পিঠে , পায়েস খেয়ে দুহাত তুলে নাচ। আসিস সংক্রান্তির দিন, পেট ভরে পিঠে খেয়ে যাস।

শুনে গান্ধারী বললেন কি করি বল, এখন আর সেই নারকেল কোড়ানো, চাল গুড়ো করা, দুধ জাল দেওয়া, সরুচাকলি বানানো একহাতে পেরে উঠি না। তাই অগত্যা।

 

ওদিকে ভীষ্ম শরশয্যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিনে অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রথ থেকে মাটিতে পড়ে যান, তিনি জানতেন মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপগ্রস্ত হয়ে ইহলোকে মনুষ্য হিসাবে কৃতকর্ম ভোগের জন্য জন্ম নিয়েছিলেন। হিসেবমত তাঁকে দেবলোকে ফিরে যাবার কথা, কিন্তু প্রবলেম হল দক্ষিনায়নের সময় দেবলোকে রাত্রি, সবকিছু বন্ধ থাকে, অনেকটা সেই স্কয়ান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মত, সুতরাং অপেক্ষাই যখন করতে হবে তিনি মনস্থ করেছিলেন পৃথিবীতে থাকবার। অন্তত কিচু চেনা মানুষজন দেখা যাবে, দু একটা সুখ দুঃখের কথা বলা যাবে আর দেবলোকের বাইরে সেই অন্ধকারে অপেক্ষা করবার কোন অর্থ হয় না, না সেখানে মোবাইল সিগন্যাল আছে না আছে ঘণ্টাখানেক সুমন।

ভোর হয় হয়, পৌষ সংক্রান্তি, উত্তরায়ণের প্রারম্ভ। সেই সাগরে হাজায় মানুষের সাথে শ্রীকৃষ্ণ ডুব দিলেন, তিনি ভুলেই গেছেন এ বিশ্ব সংসারের তিনিই স্রষ্টা, বিধাতা, নিয়ন্তা।

পিতামহ ভীষ্ম সদ্য শরীর ত্যাগ করেছেন চলেছেন দেবলোকের পথে।
 
যশোমতী আজ উঠোনে সকাল সকাল আলপনা দেবে, পিঠে বানাবে আর সেই আতপ চাল, নারকোল, গুড়ের গন্ধে ভেসে যাবে বিশ্ব চরাচর।

শুভ মকর সংক্রান্তি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন