শনিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০১৯

বামপন্থীদের কথা বিশ্বাস করবেন না ~ সুশোভন পাত্র

বামপন্থীদের কথা বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করতে হলে আনন্দবাজার কে করবেন, চোস্ত ইংলিশে স্টুডিও কাঁপানো অর্ণব গোস্বামীদের করবেন, বিকাশের চৌকিদার কে করবেন, সততার পিসি কে করবেন, গেরুয়া কামিজে নিমেষে ঠ্যাং মাথায় তুলে দেওয়া 'বাবা' কে করবেন, তিন হাত লম্বা দাড়িওয়ালা ভাষণবাজ 'মৌলবি' কে করবেন। কিন্তু এক গলা গঙ্গা জলে ডুবে বললেও খবরদার, বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না।

২৮ বছর আগে,আর্থিক সংস্কারে বায়নায় দেশের 'হটডগ' বাজার পৃথিবীর জন্য মুক্ত করে দিয়ে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং পার্লামেন্টে বলেছিলেন "এই সংস্কার আর্থিক সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করবে। পাঁচ বছর পর দেশে আর কেউ গরীব থাকবে না।" মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে ভেসে গিয়েছিল মগধ থেকে পাটলিপুত্র, ছাতনা থেকে ছিন্নমস্তা। রাম-শ্যাম-যদু-মধু সমস্ত রাজনৈতিক দল কোরাস গেয়ে বলেছিল, "বাহ! ওস্তাদ বাহ!।" একমাত্র ঐ হাতে গোনা বামপন্থীরাই সেদিন বিরোধিতা করে বলেছিল, এই নীতি অচিরেই দেশজুড়ে আর্থিক বৈষম্য আরও প্রশস্ত করবে। ধনীরা আরও ধনী হবে। গরীবরা আরও গরীব। 

২৮ বছর পর, অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, একদিকে দেশের ১% মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৭৩% কুক্ষিগত। আর অন্যদিকে বিশ্বের ১/৪ ক্ষুধার্তের ঠিকানা আজ ভারতবর্ষ। একদিকে শেষ যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে। কি ভুলই না বলেছিলে সেদিন বামপন্থীরা! তথ্যই বলে দিচ্ছে, বামপন্থীদের মুখে ছাই দিয়ে, গত ২৮ বছরে দেশে কেমন 'আর্থিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়' প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গরীব খুঁজতে তো আজকাল গ্যালিলিওর দূরবীনও ভাড়া করে মিউজিয়ামে যেতে হচ্ছে। ঐ যে বললাম বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। 

রঙ্গরাজন এবং কিরীট পারিখ কমিটির সুপারিশে, সরকার তখন পেট্রোল-ডিজেলের দাম বিনিয়ন্ত্রণ করছে। কেতাদুরস্ত অর্থনীতিবিদরা বললেন, ভর্তুকির গলদঘর্ম ত্যাগ করলে, ৮০% তেল আমদানি করা ভারতে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য কমলেই তার সরাসরি সুবিধা পাবেন আম জনতা। কংগ্রেস বলল 'বহুত আচ্ছা'। বিজেপি বলল 'মাশা আল্লাহ'। আর আম্বানিরা-আদানিরা বলল, 'জিও পাগলা'। একমাত্র ঐ হাতে গোনা বামপন্থীরাই সেদিন বিরোধিতা করে বলেছিল, বিনিয়ন্ত্রণ আসলে খুড়োর কল। অপরিশোধিত তেলের মূল্য বাড়লে তার দায় সাধারণ মানুষের ঘাড়েই চাপানো হবে। আর কমলে, তেল উত্তোলনকারী মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মুনাফা ভোগ করবে। 

২০০৪-এ পেট্রোল-ডিজেলের দাম ছিল ৩৬.৪৯টাকা, ২৪.৩৫ টাকা। আর এখন? তাহলেই ভাবুন, কি ভুলই না বলেছিলে সেদিন বামপন্থীরা! বিনিয়ন্ত্রণের পর অপরিশোধিত তেলের মূল্য কমলে, সরাসরি সুবিধা আপনি পাচ্ছেন তো? গত চার বছরে ডিজেলে এবং পেট্রোলের বর্ধিত 'এক্সাইস ডিউটি' আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়ে আপনার বারান্দায় টপকে পড়েছে তো? বেশ সস্তায় আপনার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ঘরে ডেলিভারি হচ্ছে না? আর মুনাফার অভাবে, অনটনে নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচা করে কোন ক্রমে মেয়ের বিয়ে দিতে আম্বানিরা বাধ্য হচ্ছে না? ঐ যে বললাম বামপন্থীদের কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। 

জঙ্গলমহল তখন ভিজে যাচ্ছে রক্তে। সালকু'র লাশটা যখন পাওয়া গেলো শরীরের চামড়া তখন পচে গলে যাচ্ছে। পোকাতে কুরে খাচ্ছে সারা দেহ, চারিদিকে দুর্গন্ধ। অথচ মাওবাদী'দের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, মৃতদেহ সৎকারে সাহস করছে না ধরমপুর গ্রামের কেউ! শীতের রাতে, দুবরাজপুর গ্রামে, বাদল আহির কে মাওবাদীরা খুন করল গোটা শরীরে গুণে গুণে পেরেক পুঁতে। 

বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য তখন সানগ্লাস। বুদ্ধিজীবীরা তখন লালগড়। বিসেলারির বোতলে তখন 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের' তুফানি চুমুক। এ যুগের পাবলো পিকাসোর ছবি তখন বিক্রি হচ্ছে ১.৮৬ কোটি টাকায়। হবু মুখ্যমন্ত্রীর 'সঙ্গে সুমন' হেলিকপ্টারে চেপে তখন কুচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। বামপন্থীরা বলেছিল, দিনে যারা তৃণমূল, তাঁরাই রাতে মাওবাদী। বামপন্থীরা বলেছিল, এতো টাকার উৎস কি? ডেলোর বাংলো তে গভীর রাতের কেলোর মিটিং'র রহস্য কি?  চ্যানেলে টেনের সীমাহীন স্তাবকতার রেসিপি কি?  সো হোয়াট, জঙ্গলমহলের বেতাজ বাদশা অবশ্য তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেই 'প্রকৃত কমিউনিস্ট' দেখতে পেলেন।

তারপর একদিন সেই 'প্রকৃত কমিউনিস্ট'ই মুখ্যমন্ত্রী হলেন। দফায় দফায় সেজেগুজে, পাউডার মেখে বিপ্লবী 'মাওবাদীরা' মহাকরণের অলিন্দে পৌঁছে গেলেন। কেউ আত্মসমর্পণের প্যাকেজ পেলেন। কেউ সরকারী চাকরী পেলেন। সুচিত্রা মাহাতো তৃণমূল নেতা প্রবীর গড়াই কে বিয়ে করলেন। পয়সা হল, গাড়ি হল, বাড়ি হল। পরের বৈশাখে, সুদীপ্ত সেনও গ্রেপ্তার হল। তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদরা আর্থিক তছরুপের দায়ে জেলের ঘানি টানল। মুকুল রায়ও বিজেপি যোগ দিয়ে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে গেলো। সবই হল, শুধু 'প্রকৃত কমিউনিস্ট'র রাজত্বেই কিষানজি কে এনকাউন্টারে মরতে হল। আর আমানতদারীদের টাকাটা আজও বিশ বাঁও জলেই ডুবে রইলো।   

কি ভুলই না বলে বামপন্থীরা! তাই না? তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিন। রাজনৈতিক সমীকরণের সংকীর্ণ স্বার্থেই সারদা-নারদা তদন্তে সিবিআই তৎপর হচ্ছে না কিম্বা সিবিআই'র জুজুতেই মুখ্যমন্ত্রী আজ রাফালে নিয়ে সাত চড়েও রা কাটছে না; রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তীর নামে রাজ্যে ধর্মীয় মেরুকরণের তাস সাজাচ্ছে বিজেপি, কিম্বা ফেডারেল ফ্রন্টের নামে বিজেপি বিরোধী ঐক্য কে ভাঙতে চাইছে তৃণমূল, মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা থেকেই দৃষ্টি ঘোরাতে রামমন্দিরের হিড়িক তুলছে বিজেপি, কিম্বা  বিজেপি সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ধর্মঘট কে রুখতেই 'কর্মসংস্কৃতির' ন্যাকামি করছে তৃণমূল -এক গলা গঙ্গা জলে ডুবে বললেও খবরদার, বামপন্থীদের এসব কথা বিশ্বাস করবেন না একদম। 

আর গঙ্গা জলে ডুবে বললেই বিশ্বাস করবেনই বা কেন বলুন তো? গঙ্গার জল কি আদেও পবিত্র নাকি? 'নমামি গঙ্গার' ঢপ বাজিতে গঙ্গার জল আদেও পরিষ্কার নাকি? দূষণ মুক্ত হয়েছে নাকি? আবার শুনছি, ঐ গঙ্গার জলে তর্পণ করেই, চৌকিদাররা রাফালে চুক্তি তে চুরি করেছে নাকি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন