মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৯

মেল গ্যেজ বনাম পুরুষের মুগ্ধতা ~ উর্বা চৌধুরী

এই তো সেদিন গড়িয়াহাটের চারমাথা থেকে পার্কসার্কাসের সাতমাথায় যাব বলে অটোরিকশায় উঠেছি। পাশে যে মেয়েটি  বসেছিল, সে এক অপূর্ব সুন্দর মেয়ে। চোখ ফেরানো যায় না। তাও যদি বা আমার চোখ ফেরে, অটোচালকের চোখ তো মোটেই ফেরে না। ডানদিক-বামদিক যখন যে আয়না দিয়ে সম্ভব একজোড়া চোখ দেখে চলে। নিষ্পলক। মধ্যে মধ্যে মনে হচ্ছিল বলি, "ভাইয়া, সামনে দেখকে চালায়েঙ্গে!" কিন্তু বলতে আর পারি কই! অমন ব্যাকুল চাহনিকে কি আর ফিরত যেতে বলা যায়!

'মেল গ্যেজ' শব্দখানা ব্যবহার করতে হলে বড় নির্দয় লাগে নিজেকে। খুব বেশিদিন এ শব্দের অতিপ্রয়োগ চলছে তা নয়। ক'বছর হল। তাবলে পুরুষের চাহনি নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করিনি তা তো নয়! খারাপ ভাবে তাকানো, বিশ্রীভাবে তাকানো, লোলুপ চোখ, কামুক চোখ এসব তো বলতামই। 

আবার মুগ্ধ চোখের কদরও যে করিনি তেমনটা নয়! চাঁদ দেখতে গিয়ে তোমায় দেখে ফেলা চোখের জন্য আহ্লাদও নেহাত কম থাকে না। 

তেমনটাই ছিল অটোচালকের চোখে। হিমসিম খাওয়া মুগ্ধতা! নাচার মুগ্ধতা! পনেরো মিনিটের পথে যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থাকার মতো মুগ্ধতা!

মুগ্ধতাই তো! একই সমাজে বাঁচব। একই পৃথিবীতে বাঁচব। একই সঙ্গে বাঁচব! স্বস্তিতে বাঁচব! আনন্দে বাঁচব! তৃপ্তিতে বাঁচব! মুগ্ধ হব না! সে মুগ্ধতা প্রেমের হোক বা বাৎসল্যের, যৌনতার হোক বা স্নেহের, উচাটনের হোক বা আরামের, শেষতক, মুগ্ধতাই তো! 

তবে কোনোদিন সেই মুগ্ধতা যদি ঘুচবে, তবে এমনভাবে ঘুচবে যে, দেখার মানুষটি বেঁচে থেকেও মৃতের মতো বীভৎস ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। ফ্যাটফ্যাটে হয়ে যাবে। সেদিন আর তার সে সৌভাগ্য থাকবে না, যে সৌভাগ্যে চাইলেই পলাশকে আগুন লাল রঙে দেখা যায়, শ্বেতকাঞ্চনের দিকে তাকালে আরাম পাওয়া যায়, স্থলপদ্মের হরেক রঙ খুঁজে পাওয়া যায়। 

সীলড্ বটল্। কীই বিস্ময়! আমার সহনাগরিক, আমাকে এমন একটি জড়বস্তুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, যার না আছে বুকের ধুকপুকানি, না আছে স্পর্শের রকমফের, না আছে চাহনির কোনো বার্তা, না আছে দেহের ভাষা, না আছে দাবি, না আছে ইচ্ছা, না আছে কোনো আগ্রহ। যৌন আবেদন! আছে! তাও তো নাই! 

আমার সহনাগরিক আমার মর্যাদা এমন মাটিতে মেশান যে, মাথা কুটে মরলেও তিনি আমার কাছ থেকে কণামাত্র মানবিক ছোঁয়াটুকুও আর পান না। আমাকে তিনি আস্ত একখানা জড়বস্তু বানিয়ে ছেড়ে দেন। 

শিক্ষক আকাশ থেকে পড়েন না। আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও নির্দিষ্ট কোনো সামাজিক সংস্কৃতি থেকে কোনো সুইচ টিপে ভিন্ন হয়ে যায় না। 

টেলিভিশনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের অধ্যাপক কনক সরকার প্রসঙ্গে বলতে শুনলাম, "যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে..."!

মন খারাপ লাগছিল ভেবে যে, বাচ্চা বাচ্চা কিছু ছেলেমেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে গর্বের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে গিয়ে থমকে যাচ্ছে। মন খারাপ লাগছিল ভেবে যে, তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরও যে একটি গড়পড়তা বাস্তব ছবি রয়েছে, তা হুট্ করে দেখতে পেয়ে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। 

কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বাস্তবতার একটি বাস্তবতা এরকমই। 

সব প্রতিষ্ঠানেরই এমন এক একটি কান্না পেয়ে যাওয়ার মতো বাস্তবতা থাকে। সে বাস্তবতা সবটা নয়। তবে কিছুটা যেহেতু বটেই, তাই বারবার ফিরে যেতে হয় সেই অটোচালকটির কাছে, যাঁর মুগ্ধ চোখের ব্যাকুল চাহনিকে মোটেই ফিরত যেতে বলা যায় না। তিনি অন্তত জানেন, কামনার মানুষটির দিকে জড়ভ্রমে তাকাতে নাই। 

অধ্যাপক কনক সরকারের মতো বুরবকেরা নারীর মর্যাদাহানি করুন, ক্লেদে ডুবে থাকুন...তাই বলে ভাববেন না, নারীকে দেখার মতো মুগ্ধ পুরুষচোখের অভাব ঘটবে, ওটি আপনিই জুটে যাবে। নিত্যদিন!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন