সোমবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৯

হিন্দু কোড বিল ~ শুভদীপ দে

ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম অ্যাসিড টেস্টঃ হিন্দু কোড বিল।

স্বাধীনতার পর গণপরিষদের অন্যতম বড় টাস্ক ছিল হিন্দু বিবাহ ও সম্পত্তি আইনের কোডিফিকেশন, একীকরণ ও সংস্কার । বি এন রাউ এর করা খসড়া-র রিভিশনের ভার পড়ে সিলেক্ট কমিটির হাতে, যার মাথায় ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী বাবাসাহেব আম্বেদকর । 

নতুন আইনের অন্যতম সূচীমুখ ছিল- স্বামী বা পিতার সম্পত্তিতে স্ত্রী ও কন্যার অধিকার, সেপারেটেড স্ত্রীর খোরপোষের অধিকার, বিবাহবিচ্ছেদ এর অধিকার,   সকল প্রকার ইন্টারকাস্ট বিবাহের অধিকার, সন্তান দত্তকের অধিকার, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি । 

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হয়তো মনে হবে, এগুলো খুবই মিনিমাম দাবী, এটা তো সাধারণ অধিকার, এ নিয়ে এত মাতামাতির কী হল ? কিন্তু আজ থেকে সত্তর বছর আগে ব্যাপারটা মোটেই সহজ হয়নি । ব্রাহ্মন্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজপতিরা মেয়েদের এইটুকু অধিকার দিতেও রাজী হচ্ছিল না । পেছনে যুক্তি কী ছিল ? সতীদাহ, বিধবাবিবাহ থেকে শুরু করে শবরীমালা অবধি এদের যে দাবী, হিন্দু কোড বিলের ক্ষেত্রেও তাই ছিল- "ট্র্যাডিশন" । যদিও বাবাসাহেব প্রথমেই এদের সঙ্গে অফেন্স এ যাননি, বরং প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র থেকে রেফারেন্স টেনে এনে দেখাতে চেয়েছিলেন যে শাস্ত্রে স্ত্রীকে পুরুষের দাসী বানানোর কথা বলা হয়নি । এইভাবে বাবাসাহেব আসলে রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের পথই ফলো করছিলেন, তবে তাতে করে ব্রাহ্মন্যবাদীদের টলানো যায়না, যায়নি । 

বিলের প্রথম বিরোধিতা আসে গণপরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান তথা পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের পক্ষ থেকে । যার যার ওনার সম্পর্কে খুব গ্রেট ফীলিং আছে, তাদের প্রণিধানের জন্য বলে রাখি- কংগ্রেসের যে লবি সুভাষ বসুকে দলছাড়া করিয়েছিলেন, বাবুজী ছিলেন সেই লবির সেনাপতি বিশেষ । হিন্দু কোড বিল নিয়ে তার বক্তব্য ছিলো, স্ত্রী অধিকার, সমানাধিকার এসব বিদেশী আইডিয়া, মুষ্টিমেয় কিছু লিবেরাল লোকজন এসব বিদেশী জিনিস ভারতের হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে । হায়, উনি সতীদাহ নিবারণের সময় থাকলেন না, থাকলে কী বলতেন শোনার ইচ্ছে ছিল । যাই হোক, শোনা যায় রাজেন্দ্রপ্রসাদ নেহরুকে এই নিয়ে একটি কড়া চিঠি লিখেছিলেন, সেটা পাঠানোর আগে কংগ্রেসে তার লবির অন্যতম সুহৃদ সর্দার প্যাটেলকে সেটা দেখিয়েছিলেন । প্যাটেলের মনে কী ছিল জানা নেই, তবে বাস্তববাদী পলিটিশিয়ান হিসেবে উনি প্রসাদকে বুদ্ধি দেন চেপে যেতে, কারণ গণপরিষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছিল, ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে কংগ্রেসের মেজরিটি দক্ষিণপন্থী লবির পছন্দ ছিলেন প্রসাদ, ওদিকে নেহরুর পছন্দ ছিলেন রাজাগোপালাচারী । এই চিঠি নেহরুর কাছে পৌঁছলে তিনি প্রসাদের নামে ভেটো দিয়ে দিতেন, এবং কংগ্রেস ভাঙ্গনের দিকে চলে যেতো । বন্ধুর সুপরামর্শে বাবুজী সরাসরি বিরোধিতার পথ থেকে সরে আসেন । এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ।

ঘরের চাড্ডীদের সামলে উঠতে পারলেও পিকচার এখনো অনেক বাকি ছিল । ধর্মশাস্ত্রে হাত পড়ছে, হিন্দু সংসারের বেসিক স্ট্রাকচার ভেঙ্গে দিতে চাইছে এই বিলেত ফেরত নেহরু আর আম্বেদকার, এইসব বক্তব্য দিয়ে গঠিত হল হিন্দু কোড বিল বিরোধী কমিটি । একে একে জুটলো ধর্মীয় গুরু,  পেটোয়া সাধু সন্ন্যাসী যারা নামে সন্ন্যাসী হলেও পুরোপুরি গার্হস্থ্য জীবনযাপন করেন । আজকের দিনেও এদের দেখতে পাবেন, আরএসএস আয়োজিত মঞ্চে এসে কখনো এরা রামমন্দির চায়, কখনো শবরীমালা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আর পিনারাই বিজয়নের মুন্ডপাত করে ।  দ্বারকার শঙ্করাচার্য্য এই বিলের বিরুদ্ধে ফতোয়া গোছের দিলেন । ১৯৪৯ এর ১১ই ডিসেম্বর, দিল্লীর রামলীলা ময়দানে আরএসএস হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে সমাবেশ করলো, সেখানে বলা হল নারীর সম্পত্তি ও ডিভোর্সের অধিকার আসলে হিন্দুধর্মের ওপর পরমাণু বোমার আঘাত । নারী অধিকার পেলে হিন্দু সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে । একজন  নেহরুর ফাঁসিও চেয়েছিল । এক বক্তা বলেছিল "আম্বেদকর অস্পৃশ্য সমাজের লোক, হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিধান দেওয়ার কোনো অধিকারই ওনার নেই" । এর পঞ্চাশ বছর পর আরেক শঙ্করাচার্য্য একই কথা বলবেন, তারও পনেরো বছর পর এই ভন্ড সাধুসন্ন্যাসীরা প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আলো করে বসে থেকে সরকারের মনোভাবের আবরণ উন্মোচন করবেন, অবশ্য ততোদিনে আমরা সহ্য করতে শিখে গেছি, থাক সে কথা । 
কোড বিল বিরোধী বিক্ষোভের মাথা ছিলেন আরেক ভন্ড সাধু, স্বামী কর্পাত্রি মহারাজ । তিনি আরএসএস ও অন্যান্য সংগঠনের উদ্যোগে দেশজুড়ে উস্কানি দিয়ে বেড়ালেন । দাঙ্গা হাঙ্গামার হুমকি দিলেন । দেশ ভেঙ্গে টুকরো করার হুমকি দিলেন । রাষ্ট্রপতির চেয়ার নিশ্চিত হওয়ার পর মাঠে নেমে পড়লেন বাবুজীও, বললেন তিনি এই বিলে সই করবেন না । এই জায়গায় পিনারাই বিজয়ন থাকলে হয়তো আরএসএস-জনসঙ্ঘ নেতাদের স্ত্রীদের দিয়ে ডিভোর্স করিয়ে নিতেন, জ্যোতি বসু থাকলে দলের লোকজন দিয়ে এসব ভন্ড সাধুদের তুলিয়ে হিমালয়ে দিয়ে আসতেন, কিন্তু নেহরুর ততোটা জোর তখনও ছিল না । শশী থারুরের মতো ওনারও লিবেরাল জহরকোটের আড়ালে ভোটব্যাঙ্ক নির্ভর পলিটিশিয়ানের কম্পমান হৃদয় ছিল । উনিও আর ভোটের আগে এই নিয়ে এগোলেন না । অপমানিত, ভগ্নহৃদয় হয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকর পদত্যাগ করলেন । 

তবে নেহরু আর যাই হোক, শশী থারুর নন । নির্বাচনী প্রচারে বারবার করে হিন্দু কোড বিলের কথা উনি তুলেছিলেন দেশজুড়ে । সমর্থন চেয়েছিলেন, যাতে প্রথম পার্লামেন্ট এ বিল পাশ করা যায় । তার বিরুদ্ধে এলাহাবাদ আসনে জনসঙ্ঘ-রামরাজ্য পরিষদ- হিন্দু মহাসভা যৌথ প্রার্থী করেছিল কোড বিল বিরোধী হাঙ্গামার অন্যতম নায়ক প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারীকে । সেই আসনে নেহরু বিপুল ভোটে জয়ী হন । দ্বিতীয় হয়েছিলেন কৃষক মজদুর প্রজা পার্টির প্রার্থী বংশীলাল । ব্রহ্মচারী ফুটে যান । 

প্রথম লোকসভায় হিন্দু কোড বিল চার খন্ডে ভাগ হয়ে পাশ হয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন