বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪

রসেবশে রসায়ন ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ভাইরা তো ভাই-ই হয়। কিন্তু ভায়রাভাই আলাদা জিনিস। দুই ভায়ের বউরা যেমন পরস্পরের জা (বা ভাজ), দুই বোনের বররা তেমনি পরস্পরের ভায়রাভাই। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গাতেই পুরুষতন্ত্রের প্রাদুর্ভাবহেতু একান্নবর্তী পরিবারে বিবাহিতা মহিলাদের অনেককেই জা-র মুখঝামটা সহ্য করতে হয়, কিন্তু বিবাহিত পুরুষরা ভায়রাভাই-এর ঝামেলা থেকে সাধারণভাবে মুক্ত।
 
যারা ততটা মুক্ত ছিলেন না, তাদের একজোড়ার কথা বলা যাক।
 
এঁদের একজন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, একজন আইরিশ। ব্রিটিশদের সঙ্গে আইরিশদের সম্পর্ক অনেকক্ষেত্রেই আদায়-কাঁচকলায়। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকেই আইরিশ বিপ্লবীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হতেন, আমেরিকায় গদর পার্টি আইরিশ সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ব্যাপারটা আলাদা। ব্যবসার স্বার্থে তারা জাতীয়তা-টতার মতো ক্ষুদ্রতাকে বিসর্জন দিয়ে বৃহত্তর মানবতার আদর্শে বিশ্বাসী। আফটার অল সবার ওপরে টাকাই, থুড়ি পাউন্ডই, সত্য, তাহার ওপরে নাই।
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ। বাষট্টি বছরের প্রৌঢ় আইরিশম্যান আলেকজান্ডার বেরি নরিস, তাঁর চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট স্বদেশীয়া বউ ফেবকে বললেন, ছেলেমেয়েগুলো এত বড় হয়ে গেল, এরা কি বিয়ে ফিয়ে করবে না?
 
ফেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সে আর আমি কী করে বলব, বলো! তুমি নিজেও তো ঠিক সময়ে বিয়েটা করোনি। আমার ভাগ্যটা যেমন! কপালে জুটল আধদামড়া পঁয়তিরিশ-ছত্তিরিশ বছর বয়সী বর। তাও যে গোটা পাঁচেক বাচ্চার জন্ম দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সে কেবল পরম করুণাময় ঈশ্বরের করুণা।
আলেকজান্ডার এই দীর্ঘনিশ্বাসের মর্ম জানেন। বছর তিনেক আগে তাঁদের তৃতীয় সন্তান, ষোড়শী কন্যা ফেব, মারা গেছে। তার মৃত্যুর পর মেয়েদের বিয়ের চিন্তা তাঁর মাথায় আসেনি। এদিকে দেখতে দেখতে বড় মেয়ে অলিভিয়ার বয়স হয়ে গেল চব্বিশ, মেজ এলিজাবেথও বাইশ। অ্যান নামে এক ষোড়শী কন্যা ও আলেকজান্ডার নামে পনের বছর বয়সী পুত্রও আছে তাঁদের।
 
আলেকজান্ডার মোমবাতি তৈরি করে বিক্রি করেন। আয়ারল্যান্ডে এই ব্যবসা খারাপ চলছিল না, তবে খবর পেলেন ডলারের দেশ আমেরিকায় নাকি হাওয়ায় ডলার উড়ছে। তাই পাততাড়ি গুটিয়ে জমিজমা বেচেবুচে পরিবার নিয়ে জাহাজে চেপে চলে এলেন সিনসিনাটি। পুরো সিনসিনাটি গ্রাম যেন এক বিশাল কসাইখানা। এখানে বড়সড় শুয়োর-কাটার স্লটার হাউস আছে, সস্তায় অঢেল চর্বি পাওয়া যায়। এই চর্বি দিয়ে কেউ মোমবাতি তৈরি করে, কেউ তৈরি করে আলো জ্বালানোর তেল, কেউ সাবান।
মেয়েদের বিয়ের কথা ভাবলেই তো হয় না, পাত্রও খুঁজতে লাগে। সিনসিনাটি গ্রাম এমন কিছু বড় না, ব্যবসায়ী হিসাবে তাঁদের চেনাশোনার পরিধি কম না। একদিন কথায় কথায় আলেকজান্ডার বউকে বললেন, আচ্ছা, আমাদের জেমস ছোকরাটাকে তোমার কেমন লাগে?
 
ফেব বললেন, কোন জেমস? জর্জবাবুর ছেলে জেমস? সে তো সোনার টুকরো ছেলে। একেবারে আমাদের পালটি ঘর। জেমস তো শুনছি সাবানের কারখানা খুলেছে।
আলেকজান্ডার বললেন, হ্যাঁ। ওরাও আয়ারল্যান্ড থেকে এ দেশে এসেছে, তা প্রায় চোদ্দ বছর হয়ে গেল। ইলিনয় যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। যাচ্ছিলেন ওহায়ো নদীতে বোটে চেপে। সেই অবস্থায় অসুস্থ বোধ করায় তাদের সিনসিনাটিতে নেমে পড়তে হয়। জর্জবাবু নার্সারি খুলেছিলেন। জেমস সাবান তৈরি শিখে এখন সাবানের কারখানা তৈরি করে ব্যবসা করবে। জেমসের বয়স তিরিশ বছর। আমাদের অলিভিয়ার সঙ্গে ওকে ভালো মানাবে না?
 
ফেব বললেন, খুব ভালো মানাবে। তুমি কথাবার্তা বলো। সামনের রোববারে ওদের ডাকো না আমাদের বাড়িতে।
 
কিন্তু ভাবলেই তো হ'ল না। দেখা গেল জেমসের প্রতি অন্য একজন অনুরক্তা। কাজেই তার সঙ্গে অলিভিয়ার বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। সেই অন্য একজন আবার এই বাড়িরই। অলিভিয়ার বোন এলিজাবেথ। তাতেও সমস্যা নেই। এলিজাবেথের সঙ্গেই তাহলে জেমসের বিয়ে পাকা করা যেতে পারে। কিন্তু বড় বোনের আগেই কি মেজ বোনের বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে?
 
এই সব মহান সমস্যায় যখন নরিস পরিবার বিব্রত, তখন মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিল আর এক উদীয়মান সম্ভাবনা। এই ছেলেটি আবার তাঁর মতোই মোমবাতির ব্যবসায় আগ্রহী। মাত্র বছরখানেক আগে সে সিনসিনাটিতে এসে আস্তানা গেড়েছে। এর নাম উইলিয়াম। উইলিয়াম প্রোক্টর।
 
তবে সমস্যা নেই, তা নয়। এক তো এ হচ্ছে ইংরেজ। আর দুই, এর একবার বিয়ে হয়ে গেছে। তবে সেই বউ আর বেঁচে নেই। ছেলেটার মাথা ভালো, লেখাপড়া জানা। লন্ডনে কাপড়ের দোকান দিয়েছিল, সে দোকান লুটপাট হয়ে যায়। বাজারে অনেক দেনা, তার এক বন্ধুর পরামর্শে সে পালিয়ে আসে আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কে এসে উঠেছিল বছর তিনেক আগে, সেখানেই শুরু করে মোমবাতি তৈরি ও বিক্রি। কিন্তু মোমবাতির কাঁচামালের জন্য নিউ ইয়র্ক মোটেই ভালো জায়গা না। তারই সন্ধানে সে যাত্রা শুরু করে পশ্চিমে, হাজির হয় সিনসিনাটিতে। এখানে পৌঁছাতেই বেচারার বউটা অকালে মারা যায়, তাই এই জায়গা ছেড়ে তার আর অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি।
 
এক শুভদিনে একই সঙ্গে অলিভিয়া আর এলিজাবেথের বিয়ে হয়ে গেল। চব্বিশ বছর বয়সী অলিভিয়ার বর বত্তিরিশ বছরের বিপত্নীক ইংরেজ উইলিয়াম। বাইশ বছর বয়সী এলিজাবেথের বর তিরিশ বছর বয়সী আইরিশ জেমস।
 
বিয়ের পর সুখেই জীবন চলছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎই আমেরিকায় নেমে এল ব্যবসায়িক মন্দা – ইকনমিক রিসেশন। জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য হ'তে শুরু করল। ব্যবসাপাতি চালানো মুশকিল হতে শুরু করল।
 
বৃদ্ধ আলেকজান্ডার নরিস দুই জামাইকে একসঙ্গে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাবাজিরা, শোনো, আমার তো বয়স কম হ'ল না, আমি অনেক বছর ধরে এখানে ব্যাবসাপাতি চালাচ্ছি। আমি জানি, এই দুর্দিন বেশিদিন চলবে না। এক সময় এ থেকে আমরা বেরিয়ে আসব। কিন্তু সেটা ঠিক কবে, তা কেউ জানে না। দুর্দিনই মানুষের চরিত্রের আসল পরীক্ষা নেয়। এ সময় যারা শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারে, সৎভাবে ব্যবসা করতে পারে, তারাই জীবনে উন্নতিলাভ করে। তোমরাও সে ভাবেই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারবে। আমি বলি কী, তোমরা দু'জনে আলাদা আলাদাভাবে ব্যবসা করার বদলে একসঙ্গে মিলে একটা ব্যবসা চালু করো। যে জিনিস থেকে মোমবাতি তৈরি হয়, তা থেকেই তৈরি হয় সাবান। সুতরাং যৌথ ব্যবসায় কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তোমাদের।
 
দুই ভায়রাভাই মন দিয়ে শ্বশুরের কথা শুনল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু হ'ল তাদের যৌথ ব্যবসা। উইলিয়ম প্রোক্টর ও জেমস গ্যাম্বলের সেই 'প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল' এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর বহুজাতিক সংস্থা।

* * *
'রসেবশে রসায়ন' সিরিজের দু-নম্বরী নিবেদন 'বীকার থেকে বাজারে' আপাতত প্রস্তুতিপর্বের শেষ অধ্যায়ে। তার একটা পৃষ্ঠা হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে গেল বলে ভাবলাম সেটা এই সুযোগে ফেসবুকে সেঁটে দেওয়া যাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন