শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪

ইমনকল্যান ~ বিমোচন ভট্টাচার্য

একটা গল্প লিখি আজ। গল্পই। লিখবো ভেবেছি অনেক দিন। লিখে উঠতে পারি নি। আজ লিখেই ফেলি।

এক ভদ্রলোক, তার নাম দিলাম সুদীপ। সুদীপ ব্যানার্জী। একটি প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরী করেন। বনেদী বাড়ির ছেলে। সুদর্শন। ভাল গান করেন। বিন্দাস, প্রাণোচ্ছল মানুষ। দু মিনিটে আপনাকে তুই বলতে শুরু করে দেবেন আর আপনি তাতে খুশীই হবেন। স্ত্রীও ডাকসাইটে সুন্দরী। এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি বি ই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে।
সুদীপবাবুর সমস্যা এই ছেলেকে নিয়েই।

ছেলে ছোট থেকেই সব ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পারে। সুদীপবাবু নাম রেখেছিলেন ইমনকল্যান। তো ইমন কিছুতেই চাকরী করবেনা। সে মিউজিক ডাইরেক্টর হতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো আর হওয়া যায় না। নিজেই গান লিখে, সুর দিয়ে ইমন গান করে। বাবা, মা দিদি আত্মীয়স্বজন প্রশংসা করে। কিন্তু একটা এন্ট্রি তো চাই? হয় না। সুদীপবাবু কিন্তু এনকারেজই করেছেন ছেলেকে।
একদিন হঠাৎ এক বন্ধুর সাহায্যে ইমনের যোগাযোগ হয় এক বিখ্যাত সুরকারের সংগে। আমরা তার নাম দিলাম ইন্দ্রজ্যোতি মিত্র। ক্যারিস্ম্যাটিক চরিত্র। এক বিখ্যাত সুরকারের সংগে সংগীতজীবন শুরু করেন। কথা বলা শুরু করলে আর কাউকে কথা বলতে দেন না। অনর্গল কথা বলতে পারেন। বীটোফেন থেকে সুমন। বব ডিলান থেকে অনুপম সবাই কি নোট কোন গানে লাগিয়েছেন সব মুখে মুখে বলে দেন। ইমনকে তাঁর পছন্দ হয়।বলেন - লেগে পড় আমার সাথে। তবে পয়সা কড়ি পাবে না কিন্তু। সুদীপবাবু আর তাঁর স্ত্রী খুব খুশী। ইমনতো আরো খুশী।
বেশ কিছুদিন কেটে যায় এর মধ্যে। দু একটা প্রোগ্রামে ইমন গীটার বাজায়। দু একটা সিনেমায় সহকারী হিসেবে ইমনের নাম বেরোয়।

ইন্দ্রবাবু এরপর তাঁর কেরিয়ারের সব চেয়ে বড় ব্রেক পান। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক মনিপর্ণা দাসগুপ্ত তার একটা ছবিতে ইন্দ্রজ্যোতিকে ডাকেন সুর করার জন্যে। ইন্দ্র খুব খুশী হলেন। ইমনকে বললেন- তুই তো খুবই লাকীরে আমার জীবনে। কাল মনিদির বাড়ি যাব। তুইও চল আমার সাথে।
ইমন বাড়ি ফিরলো মিষ্টি নিয়ে। সবাই খুব খুশী। সুদীপবাবু একান্তে স্ত্রীকে বললেন - বাবুর মুখটা দেখেছো? মনে হচ্ছে যেন হাতে করে চাঁদ ধরেছে।
নির্দিষ্ট দিনে ইন্দ্রজ্যোতির সংগে ট্যাক্সি করে ইমন পৌঁছলো মনিপর্ণার "আলিশান" বাংলো বাড়িতে। ঢুকতেই মনিপর্ণা জিজ্ঞেস করলেন - এই বাচ্ছা ছেলেটা কে রে ইন্দ্র? ভারি মিষ্টি দেখতে তো! ইন্দ্র উত্তর দিলেন - আমার সংগে কাজ করছে দিদি। মনিপর্ণা বললেন - বাহ।

দুজনে স্ক্রিপ্ট নিয়ে পড়লেন। ইমনের দিকে নজরই নেই দুজনেরই। মুগ্ধ হয়ে দেখছিল ইমন মনিপর্ণাকে। পরচুলা পরেন। তবে খুব মন দিয়ে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না। যখন অভিনয় করতেন তখন যা গ্লামার ছিল এখন যেন তার চেয়ে অনেক বেশী গ্লামারাস।

ওদের কথাবার্তা শেষ হলে মনিপর্ণা একটা গানের সিকোয়েন্স বললেন ইন্দ্রকে। বললেন - পরে যেদিন আসবি গানটা করে নিয়ে আসিস। । আমি শ্রীকে বলে দিচ্ছি তোকে গানটা লিখে মেল করে দিতে। আসার সময় ইমনের গাল টিপে মনিপর্ণা বললেন - পরের দিন এস ইন্দ্রর সংগে।তোমার সংগে তো কথাই বলা হল না।

গানটা পাঠিয়ে দিলেন শ্রী। ইন্দ্র পড়লেন গানটি নিয়ে। গানটির সুর দিলেন ইন্দ্র। কেন জানি না গানটা পছন্দ হল না ইমনের। কথা গুলো মুখস্থ হয়ে গেছিল ইমনের। দু দিনের মধ্যে নিজেই একটা সুর করে ফেললো গানটার। ইন্দ্রদাকে অবশ্য সে কথা বললো না।

আবার একদিন মনিপর্ণার বাড়ি গেল ওরা।। সেদিন ওখানে আরো অনেক মানুষ। অনেককেই চেনে ইমন। ইন্দ্রদা গানটি শোনালেন। গীতিকার শ্রীও ছিলেন সেখানে। মনিপর্ণা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে তারপর বললেন - এ কি সুর করেছিস ইন্দ্র!!

ছ্যা ছ্যা। তুই আবার বড় বড় কথা বলিস এর সংগে কাজ করেছিস, ওর সংগে কাজ করেছিস! তুই তো সিচুয়েশনটাই বুঝিস নি। দুর, তোর দ্বারা হবে না। খুব খারাপ লাগছিল ইমনের ইন্দ্রদার জন্যে। মুখ চুন করে বসে আছেন। অনেক ভেবে ইমন বললো - আমি একটা সুর করেছি ম্যাডাম এই গানটার। ইন্দ্রদা জানেন না। ইন্দ্রদা বললে আর আপনি শুনতে চাইলে শোনাতে পারি। ইন্দ্রদা চোখের ইশারায় বারণ করলেন গাইতে কিন্তু তার আগেই মনিপর্না বললেন- ইন্দ্র আবার কি বলবে! গাও তো তুমি। তাও ইন্দ্রদার দিকে তাকালো আবার ইমন। ইন্দ্রদা ইশারায় বললেন গাইতে তবে ইন্দ্রদা যে পছন্দ করলেন না ব্যাপারটা সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল।
গীটারটা নিয়ে চোখ বন্ধ করে গাইলো ইমন গানটা। গান শেষ হলে হাততালির শব্দে চোখ খুললো ইমন। সবাই হাততালি দিচ্ছে। মনিপর্ণা এসে জড়িয়ে ধরলেন ইমনকে - বললেন- তুই তো জিনিয়াস রে বাবু। একেবারে এইটাই আমি চাইছিলাম। এই ইন্দ্র, এইটাই নিলাম। টাইটেল কার্ডে ওর নাম দিবি।

ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়ি আসা পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি ইন্দ্র ইমনের সংগে। ইমন দু বার চেষ্টা করেছে কথা বলতে ইন্দ্র উত্তর দেয় নি।
নিজের বাড়ি ঢুকে প্রথমেই ইমনকে বললো - গীটার নিয়ে গানটা আর একবার কর, আমি রেকর্ড করবো। গাইলো ইমন।শেষ হলে রেকর্ডার বন্ধ করে ইন্দ্র বললো - তুই কি ভেবেছিস রে শুয়োরের বাচ্ছা। তুই ইন্দ্রজ্যোতি মিত্রর চেয়েও বড় মিউজিক ডিরেক্টর হয়ে গেছিস। শোন বোকা**, কাল থেকে এ বাড়ির ত্রিসীমায় আসবি না। এলে গাঁড়ে তিনটে লাথি মেরে বের করে দেব তোকে। ইমন বললো বাপ তুলছো কেন? আমি তো তোমার কাছে ক্ষমা চাইছিলাম ট্যাক্সিতে। তেড়ে এল ইন্দ্র - বেশ করেছি তোর বাপ তুলেছি।বেরো শুয়োরের বাচ্চা আমার বাড়ি থেকে।

ইমন বেরিয়ে এল ইন্দ্রর বাড়ি থেকে। মনে হচ্ছিল সুইসাইড করে। কানদুটো দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিল ইমনের। বাড়ি ফিরেই গীটারটা আছড়ে ভেঙ্গে ফেললো ইমন। সুদীপবাবু,ওঁর স্ত্রী ছুটে এলেন। ছুটে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল ইমন।

দুদিন পর বাবা মা কে সব বললো ইমন কিন্তু বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ করে দিল। কিছুদিন পর মানসিক রোগী হয়ে গেল ইমন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন সুদীপবাবু। কাউন্সিলিং হল। বছর খানেক পর একটু নর্মাল হল ইমন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিল ভাল ভাবেই। চাকরী পেল একটা ভাল কোম্পানীতে। ব্যাঙ্গালোরে পোস্টিং হল। সুদীপবাবুরা একটু নিশ্চিন্ত হলেন। কিছুদিন ছেলের কাছে থেকে ফিরে এলেন কলকাতায়।
ইতিমধ্যে সেই বাংলা ছবিটা রিলিজ করেছে। সেই গানটা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। না কোথাও ইমনের নাম নেই।

একদিন একটা বাঙ্গলা চ্যানেল দেখছিল ইমন। সেখানে ইন্দ্রজ্যোতি বলছিল সেই গানটি নির্মানের নেপথ্য কাহিনী।বলছিল- মনিদি তো প্রথম শুনেই রিজেক্ট করে দিয়েছিল গানটা। একটা জেদ চেপে গেল জানেন, পনেরো দিন ধরে রাতদিন এক করে গানটি তৈরী করেছি। গানটি গাইলো ইন্দ্র। নোট বাই নোট ইমনের সুর দেওয়া গানটিই রেখেছে সে। ইমনের এক বন্ধু ছিল ঘরে। পরে সে বলে - গানটি শেষ হবার সাথে সাথে একটু আসছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ইমন। তারপর তেরো তলার ছাদ থেকে লাফ মারে ইমন। স্পট ডেড।
বিষাদ প্রতিমা হয়ে বেঁচে আছেন সুদীপবাবু সস্ত্রীক। আর ইন্দ্রজ্যোতি মিত্র। এখনো অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। বীটোফেন থেকে সুমন। বব ডিলান থেকে অনুপম।
বলেই চলেছেন......।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন