রবিবার, ২ জুন, ২০২৪

এবারের ভোট এবং আমার মা ~ সুমিত চট্টোপাধ্যায়

মাকে নিয়ে আর কখনো ভোট দিতে যাব না। এই আমি নাক মুলছি, কান মুলছি।

অন্যান্যবার একাই যায়। 
এবার বাতের ব্যথা বেড়েছে। ফ্যামিলি ব্যারাম। দিদার ছিল। দিদিমা অবশ্য বেশ মোটাসোটা ছিল, মা ছিল রোগা প্যাংলা। কিন্তু বছর চার পাঁচ হল মাও বেশ মুটিয়ে গেছে ফলে ডায়াবেটিস ধরেছে, আর বংশগত বাতের ব্যথাও বেড়ে গেছে। তাই এবার মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হলো।  
পই পই করে বলে রাখলাম- বাড়িতে বাজে বকো ঠিক আছে, কিন্তু ওইখানে গিয়ে মুখ বুজে থাকবে। 

মা ভীষণ জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তখনই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি।

গাড়ি করে গেলাম।
যদিও খুব দূরে বুথ নয়, তবুও।
কাছাকাছি যেতে সিআরপিএফ আটকে দিল। 
মা গাড়ি থেকে নেমে এক গাল হেসে তাকে বললো- ভালো আছো তো? বাড়িতে সবাই ভালো? 
আমি চমকে গেলাম। 
মা একে চেনে ?
এখন আমি আর পাড়ায় থাকি না। কিন্তু এইসব আর্মির লোক তো শুনেছি অন্য রাজ্য থেকে আসে। বেশিরভাগই বিহার ইউপি। 
আর্মি ছেলেটি অবশ্য অল্প হেসে বলল- সব ঠিকঠাক হায়, আপ আগে বাড়িয়ে।

ঢোকার মুখে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম- কি ব্যাপার, তুমি একে চেনো নাকি? 
আরে, এই ছেলেটাই তো আগের বছর ছিল। এই একই পোশাক পরে।
তোমার মুন্ডু। এটাই এদের পোশাক। আগের বছর অন্য ছেলে ছিল। সেই জন্য তোমার মনে হচ্ছে একই ছেলে। 
মা দমে যাওয়ার পাত্র নয়। বলল- তোর মুন্ডু। 

লোকাল একটা স্কুলে ভোট দিতে হয়। 

সারা জীবন সেখানেই ভোট দিয়ে আসছি। মা ওই স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনাও করেছে। নতুন রং হয়েছে। সিঁড়িগুলোর ধাপে ধাপে অ্যালজেবরার সব ফর্মুলা লেখা আছে। এ প্লাস বি হোল স্কয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি। 
মা পাড়া কাঁপিয়ে ওইদিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো- দেখলি এদের এতদিনে বুদ্ধি হয়েছে!

কেন, কি হয়েছে? 
আমি যখন ছাত্রী ছিলাম তখন এসব লেখা থাকলে অংকে কি ফেল করতাম! 
তা বটে। 
মাকে বললাম এখন এরকম অনেক লেখা থাকে। 
ডেকাথেলন বলে একটা দোকান আছে- খেলাধুলার জিনিসপত্র বিক্রি হয়।  সেখানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে ধাপে ধাপে লেখা থাকে তোমার কত ক্যালরি খরচা হলো। 
মা দরাজ হয়ে সার্টিফিকেট দিল -যাই বল, এখনকার যুগই ভালো। 

আমি বেশি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়ালাম ।

ঘরে ঢোকার আগে আমাদেরকে আটকে দেওয়া হলো। আর্মি ছেলেটি বলল- স্যারেরা টিফিন খাচ্ছেন। একটু ওয়েট করিয়ে।
মাকে একটা চেয়ারে বসালাম।
মা বললো -বাবু ,পা সামলে দাঁড়া।
এই মরেছে, পা সামলে দাঁড়াবো কেন। পা-তো ঠিকই আছে ,সেই জন্যই তো দাঁড়াতে পাচ্ছি। 

আরে না সেজন্যে না। পেপার পড়িস না? এই মিলিটারি ছেলেগুলো মাঝেমধ্যেই বন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে দুমদাম গুলি চালিয়ে ফেলে। এরা দেখ বন্দুকের মুখ নিচের দিকে করে এদিক-ওদিক ঘুরছে । ফট করে কিছু হয়ে গেলে তোর পায়ে গুলি লেগে যাবে। 
অনবদ্য অবজারভেশন। 
তুমি এত কথা বোলোনা তো -একটু রাগত কন্ঠে বললাম, তবে সত্যি বলতে কি একটু একটু ভয় হল। বন্দুকগুলো সত্যিই নিচের দিকে মুখ করা। জুতোর মধ্যেই আঙুলগুলো গুটিয়ে নিলাম। 

খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ একটা বিকট রিংটোন বেজে উঠলো- দমাদাম মস্ত কালান্দার। 
কে রে ভাই?
আর কে রে ভাই। 
মা শত ব্যস্ত হয়ে ব্যাগ হাটকাতে শুরু করলো- ওই, নিশ্চয়ই মানি ফোন করেছে। মানি মানে আমার বোন।
আর্মি লোকটা ছুটে এলো। আরে মাজি, আপ ফোন লেকে কিউ ভোট দেনে আয়ে? 
কেন আনব না, আমার ছেলেও তো এনেছে। 

মিলিটারি  কটমট করে আমার দিকে তাকালো। 
আপনি ফোন এনেছেন? 
দেখো কান্ড। 
ফোনটা সাইলেন্ট করে হিপ পকেটে রেখেছি। কি কুক্ষণে মাকে বলতে গেছিলাম।
আমি আমতা আমতা করে বললাম- ইয়ে মানে না, মানে এরোপ্লেন মোডে রেখেছি। 
মা মিলিটারিটার দিকে কটমটতরো করে তাকালো। 
আরে ভাই হামারা বেটা ডক্টর হে, উসকো তো মোবাইল রাখনা জরুরি হে।
আমি বলে উঠতে যাচ্ছিলাম- আরে ঠিক আছে গালতি হো গেয়া, ছোড় দিজিয়ে। তবে দেখলাম মায়ের বলাতে পুলিশটা থুড়ি মিলিটারি টা একটু শান্ত হল- ও আপ ডক্টর হ্যায় , ঠিক হ্যাঁয় ফোন রাখিয়ে, লেকিন ইস্তেমাল মত করিয়ে। 
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে মায়ের ফোনটাকেও সুইচ অফ করলাম।

অবশেষে শান্তি। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকলো না।

খানিকক্ষণের মধ্যেই মা অস্থির হয়ে উঠলো, বাবু দেখ তো এরা কি খাচ্ছে? এতক্ষণ ধরে কি খাচ্ছে এরা? 
আমি বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম- নিশ্চয়ই স্যান্ডউইচ টাইপের কিছু খাচ্ছে। 
মা মাথা নাড়িয়ে বলল- হতেই পারে না। এত সময় লাগছে, নিশ্চয়ই মুড়ি খাচ্ছে। বাঙালি এই মুড়ি খেয়েই মরল। 
আর্মির পাহারাদারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো - হা, ইয়ে লোগ মুড়ি খা রাহা হে। 
মা গর্বে ফেটে পড়লো। 
দেখলি?
আমিও মিন মিন করে হাসার চেষ্টা করলাম। 

যাইহোক একটু পরে খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। মাকে বলা হলো ভেতরে যেতে। 
আমাকে এলাও করা হলো।

মা গিয়েই  চেঁচিয়ে উঠলো -আরে হারু! তোমায় দেখতে পাই না কেন? তোমার বউ কেমন আছে? বাচ্চা কোন ক্লাসে উঠলো? 
হারু আমাদের পাড়ার ছেলে। ভালো নাম অনুসূয়ক মিত্র। আমাদের থেকে অনেকটাই ছোট। গত বছর বিয়ে করেছে। এখনো বাচ্চা হয়নি ফলে ক্লাসে ওঠার কোন প্রশ্নই নাই। ডেডিকেটেড পার্টি ওয়ার্কার। সে এজেন্ট হয়ে বসেছে। মা তাকে দেখে হল্লা জুড়ে দিয়েছে। 
হারু বেচারা তো মুখ লুকোতে পারলে বাঁচে। 
আমি পেছন থেকে ধমক দেয়ার চেষ্টা করলাম- আরে কি করছো? এখানে এসব বলতে নেই।
 
মা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল- চেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবো না! এই জন্যই এখনকার যুগ আমার ভালো লাগেনা।
 
আহা কথা বলবে না কেন? কিন্তু এইখানে বেশি কথা না বলাই ভালো। তোমায় তো বারণ করলাম। তুমি সেই বকবক করেই যাচ্ছ। 
মা একটু ব্যাকফুটে চলে গেল- বলল তোকে আমার সঙ্গে আনলাম বলে এরকম করে বলছিস? পাঁচ বছর পরে হয়তো আমি থাকবোই না, দেখবি তখন মন খারাপ লাগবে। 

সেন্টু খেয়ে গেলাম। 

প্রিসাইডিং অফিসার গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো- আপনাদের মা ছেলের কথাবার্তা শেষ করে যদি একটু দয়া করে ভোট টা দেন তাহলে আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারবো। 

নিশ্চয়ই- মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আপনার বাড়ি কোথায় ?

এই খেয়েছে। 

আমি বললাম- আরে, তুমি আগে ভোটটা দাও তো। তারপর বকবক করবে। যাও -আঙুলে কালি দিয়ে ওইখানে ভোট দাও। দুটো ঘেরা জায়গা আছে, দুটো জায়গাতেই ভোট দেবে।।

ডাবল ভোট কেন দেবো?! ভোট তো একটাই দিতে হয় জানি- মা খুব আপত্তি জানালো। 
আরে বাবা, আমাদের এখানে বিধানসভা, লোকসভা দুটো ভোটই হচ্ছে সেই জন্য দুটো ভোট দিতে হবে। 
সারা ভারতে একটা ভোট হচ্ছে আর আমাদের এখানে দুটো ভোট হচ্ছে, মা যেন আকাশ থেকে পড়ল। 
হচ্ছে তো।
আমাদের জায়গাটা তার মানে বেশ বিখ্যাত বল? তোর বাবা ভালো জায়গাতেই জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছিল, কি বল।
আমি বললাম - সে আর বলতে।
আমার বাবা বেশ বুদ্ধিমান লোক ছিল সেটা অস্বীকার করার কিছু নেই তবে বাবা যে একটা ব্যাপারে মোক্ষম গন্ডগোল করে ফেলেছিল সেকথা এখন আর ভেবে লাভ নেই।

যাই হোক। 
ঘেরা জায়গায় মাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। 
এবারেও একটু আপত্তি জানাচ্ছিল - আঙুলে নাকি বেশি কালি দেওয়া হয় গেছে। 
তাতে কালি লাগানোর লোকটা ভয়ানক চটে গেল। কি বলছেন !! খামোকা বেশি কালি লাগাতে যাব কেন! আমাদের কি এক্সট্রা কালি আছে নাকি? 
যাই হোক ঘেরাটোপের আড়ালে মা গেল, আর গেল তো গেলই। কোন সাড়া শব্দ নেই। না মায়ের না মেশিনের। 
আমি প্রিসাইডিং অফিসারের দিকে তাকালাম, প্রিসাইডিং অফিসার আমার দিকে তাকালো। 

তারপর নীরব সম্মতি নিয়ে গলা তুলে বললাম- মা বোতাম টিপেছ? 

কি করে টিপবো? 
মায়ের বিরক্তভরা গলা ভেসে এলো- কিছু দেখা যাচ্ছে না। ভয়ানক অন্ধকার। শুধু একটা প্লাস্টিকের কৌটো দেখতে পাচ্ছি। 
ওটা ভি ভি প্যাট। ওটাতে কিছু করতে হবে না মাসিমা- অফিসার আর্তনাদ করে উঠলো।
 
আমি বললাম- ওখানে কি একটু আলোর ব্যবস্থা করা যায়? বয়স্ক মানুষ বুঝতেই পারছেন। 
অফিসারের এতক্ষণে ধৈর্যচুতি হয়ে গেছে। 
দাঁতমুখ খিচিয়ে বলল- এর থেকে অনেক বয়স্ক লোক ভোট দিয়ে চলে গেছে শুধু আপনার মায়েরই দেখছি যত রাজ্যের অসুবিধা। 
বাকবিতন্ডা বেশি বাড়ার আগেই ট্যাঁ করে শব্দটা ভেসে এলো। 
আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। 
মা বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বললো- অনেকক্ষণ থাকলে অন্ধকার সয়ে যায় তো, সেই জন্য দিতে পারলাম। এবার এই কি পাশেরটায় যাব?
 
মা আস্তে আস্তে বের হতে লাগলো। 
আমি আমার ভোটটা দিলাম। দেওয়ার সময় চোখে পড়ল প্রিসাইডিং অফিসার আর তার সহযোগী আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে নীরবে নমস্কার করছে আর ফিকফিক করে হাসছে।
একটু লজ্জা লজ্জা করছিল আবার একটু রাগও হচ্ছিল। ভাবলাম দু-এক কথা শুনিয়ে দিই। কিন্তু বাবার একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাবা অনেকদিন আগে প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছিল। তখন বলেছিল- এদের নাকি অনেক ক্ষমতা, চাইলে এরেস্ট করে দিতে পারে। 
ফলে কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম।
মায়ের অবশ্য কোন বিকার নেই।
বাইরে বেরিয়ে দেখি মা আবার মিলিটারিটাকে নিয়ে পড়েছে- এই, আমার ফোনটা চালু করে দেবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন