বুধবার, ১২ জুন, ২০২৪

জলছবিতে ছায়াপথ ~ মলয় চ্যাটার্জী

"আবার নিজের খেয়ালে ডুবে যায় সুমিতা। মানিকের কথা ফেলতেও পারছে না, আবার মেনে নিতেও বাধছে ওর। সুমিতা নিজে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। সেই যাদবপুর, যেখানকার ছাত্র ছিল কবি তিমিরবরণ সিংহ। সব ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিলো কৃষকদের সংগঠিত করতে। ৭১-এর ২৪শে ফেব্রুয়ারি বহরমপুর জেলে পুলিশ গুলি করে মেরেছে তাকে। আর শুধু কি তিমিরবরণ? পুলিশের গুলিতে তো আরও তিন কবি খুন হয়ে গেছে। কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ, অমিয় চট্টোপাধ্যায় আর মুরারি মুখোপাধ্যায়। এদের মাঝে অমিয় চট্টোপাধ্যায় তো বেহালা পৌরসভার কাউন্সিলরও ছিলেন। পুরুলিয়ার গ্রামে 'সাগর' নাম নিয়ে কৃষকদের মাঝে কাজ শুরু করেছিলেন। তাকেও গ্রেপ্তার করে জেলের মধ্যেই হত্যা করে পুলিশ। হুগলি জেলায় চারু মজুমদারের ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো দ্রোণ। পুলিশের হাতে ধরা পরে ঠাঁই হয় হুগলী জেলেই। সেখানেই পুলিশ পিটিয়ে মারে তাকে। আর মুরারি ছিল সত্যিই লড়াকু। গ্রেপ্তার হওয়ার পড়েও জেল থেকে তার মাকে চিঠিতে লিখেছিলো, "ওরা আমাদের জেলে ঢোকাচ্ছে, হত্যা করছে, কিন্তু মূর্খ ওরা। তুমিই বলো মা, হাত দিয়ে কি সূর্যের আলোকে আটকানো যায়?" সেই মুরারিকেও হাজারীবাগ সেন্ট্রাল জেলে হত্যা করে পুলিশ।
আর এই তো গতবছরের সেপ্টেম্বর মাসে, মনে করলে যেন এখনও সেদিন মনে হয় সুমিতার, পুলিশ গুলি করে মারলো অনিল চক্রবর্তী কে।
নাম অনিল চক্রবর্তী, কিন্তু বেহালার আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত শুধুই নীল নামে। প্রথমে সিপিআই(এম) করলেও ঊনসত্তরের সিপিআই(এমএল)-এর একেবারে শুরুর দিন থেকেই সে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলো নীল। সুমিতা এবং আরও অনেকের প্রিয় নীলদা।
মনে আছে সুমিতার, ও তখন সবে ঢুকেছে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে, সে সময়েই একদিন গিয়েছিলো বেহালা হরিসভার কাছে ওর বন্ধু পিউয়ের সাথে তার মাসির বাড়িতে। বিকালে সে বাড়িতে পৌঁছে আধঘন্টা কাটিয়ে যখন বেরিয়েছিল, তখন ওই পিউ দেখিয়েছিলো এক বছর ছাব্বিশ সাতাশের ছেলেকে। পেটানো চেহারার ছেলেটাকে দেখিয়ে পিউ শুধু বলেছিল সুমিতাকে...
-- এই সুমি, দেখে রাখ, ওটাই নীলদা।
-- দেখলাম, কিন্তু তুই দেখাচ্ছিস কেন বুঝলাম না।
-- আরে ওর সঙ্গেই তো আমার মাসতুতো দিদির...হি হি হি...
-- মানে তোর ভবিষ্যতের জামাইবাবু বল।
এবার উদাস হয়েছিল পিউ...
-- সেটা জানিনা রে...
-- জানিসনা! কেন?
-- তুই জানিস না? নীলদা তো নকশাল। আর শুধু নকশাল, ও তো পুরো লিডার এখানকার।
সেই পিউয়ের থেকেই শুনেছিলো সুমিতা যে নীলদা নাকি বক্সিং করতো বেহালা ক্লাবে, আর ভালোবাসতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান গুনগুন করে গাইতে। তবে এলাকায় দাপট এতটাই ছিল যে বেহালার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মেয়েরাও রাত বিরেতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে আর ভয় পেতো না। তারা জেনেই গিয়েছিলো যে, তাদের কারও হাত ধরে টানা তো দূর, যদি কেউ একটা বাজে কথাও বলে আর সেটা তাদের নীলদার কানে যায় তো নির্ঘাৎ দলবল নিয়ে এসে যে ওসব বলার সাহস দেখাবে, মেরে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে দেবে।
তবে সব থেকে আশ্চর্য্য হয়েছিল এর কিছুদিন পর, যখন শুনেছিলো যে অজন্তা সিনেমা হলের সামনে নাকি টিকিট ব্ল্যাক করা বন্ধ হয়ে গেছে। আর ওই অঞ্চলেরই আশেপাশে লোহার ছাঁটের যে বিশাল কালোবাজার আর তাকে ঘিরে কংগ্রেসি গুন্ডাদের দাপাদাপি, সেটাও হঠাৎ করেই থেমে গেছে। আর এই সবকিছুর পিছনেই নাকি আছে নীলদা। সে নাকি সাফ বলে দিয়েছে এদেরকে যে রাস্তার ধারে বসে সবজি বিক্রি করলেও কিছু বলবে না, কিন্তু এলাকায় কোনও তোলাবাজি ও বরদাস্ত করবে না কিছুতেই।
আর নীলদার মারা যাওয়ার ঘটনাও পরে শুনেছে ওর পুলিশে কাজ করা মেসোর থেকে। সে সময় নাকি বর্ধমানের গোপন কোনও আস্তানায় ছিল নীলদা। সেখান থেকেই দলের নির্দেশ দিয়েছিলো দলের কিছু সাথীকে। ওই বর্ধমানেরই এক জোতদার বাড়িতে মজুত করে রাখা দুটো বন্দুক লুঠ করে আনতে। যারা গিয়েছিলো সেই নির্দেশ পালন করতে, তারা বন্দুকের সাথে সাথে বাড়ির মেয়েদের গয়নাও নিয়ে এসেছিলো লুঠ করে। যা দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হয় নীলদা। পরিষ্কার বলে দেয় যে এটা পার্টির কর্মসূচির মধ্যে পড়েনা। আরও বলে যে পরের রাত্রে ও নিজেই গিয়ে সে বাড়ির মেয়েদের গয়না ফেরৎ দিয়ে আসবে। আর তার সাথে নিজের পার্টি কমরেডদের করা গর্হিত কাজের জন্য ক্ষমাও চেয়ে আসবে সে বাড়ির মহিলাদের কাছে। পুলিশ ইনফর্মারের কাজ করে এই খবরটাই কাছের থানাকে জানিয়ে দিয়েছিলো নীলদারই এক বিশ্বস্ত সঙ্গী। পরের রাতে সে বাড়িতে গিয়ে গয়না ফেরৎ দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছে তখনই পুলিশ চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে এরেস্ট করে নীলদাকে। এমনকি নিজের কোমর থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটা বার করার সময়ও পায়নি সে। সেই রাতেই খবর পাঠানো হয় বেহালা থানাকে। একেবারে সকালেই বর্ধমান পৌঁছে অনিল চক্রবর্তী, এলিয়াস নীলকে শনাক্ত করে বেহালা থানার পুলিশ। দেরি না করে সেদিনই নিয়ে আসা হয় তাকে বেহালা থানায়। বেহালা থানার দায়িত্বে তখন নকশাল দমনের জন্য বিশেষভাবে নিয়োগ করা ওসি সুবীর ঘোষ। তিনি অবশ্য সে দায়িত্বে এখনও আছেন। পুলিশের ওপর নির্দেশ ছিল যে এনকাউন্টার দেখিয়ে নীলকে গুলি করে মারার। কিন্তু মেসোর কাছে শুনেছে সুমিতা , বেহালা থানার পুলিশরাই নাকি বেঁকে বসেছিল। তারা নাকি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো যে নীলের মতো ছেলেকে গুলি করা তো দূর, ওর গায়ে হাত দিতেও পারবে না তারা। কিন্তু কংগ্রেসের কোনও এক অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার নির্দেশেই নাকি, লালবাজার থেকে ফোর্স নিয়ে এসে পরদিন কাকভোরে হাতকড়া পরানো নীলকে পুলিশ ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোঙার বনের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে। সেখানেই ভ্যান থেকে নামিয়ে একেবারে পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করা হয় নীলকে।
নীলের মৃতদেহ যখন নিয়ে আসা হয়েছিল বেহালা থানায়, তারপর তার বাড়িতে খবর দিয়ে ডেকে আনা হয়েছিল ওর মাকে। দূর থেকে শুধু একবার ছেলের মৃতদেহ দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ওনাকে। স্থানীয় এক ডাক্তারকে দিয়ে লেখানো হয়েছিল ডেথ সার্টিফিকেট। কোনও পোস্ট মর্টেম হয়ইনি। সোজা নীলের মৃতদেহ নিয়ে কালীঘাট শ্মশানের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন পুলিশ।
সত্যজিৎ রায়ের সীমাবদ্ধ রিলিজ করেছে ঠিক তার আগের দিন। অজন্তা সিনেমা হলেও এসেছে সে চলচ্চিত্র। আর বেহালার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলো বেহালা থানার সামনে। তাদের দাবী, নীলের মৃতদেহ তুলে দিতে হবে তাদের হাতে। সবাইকে অবাক করে সে মানুষদের সাথে মিশে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছিল অজন্তা সিনেমাহলের সামনে একসময় টিকিট ব্ল্যাক করা ব্ল্যাকাররাও। যাদের টিকিট ব্ল্যাক করা বন্ধ করে দিয়েছিলো নীল একসময়, সেই ব্ল্যাকাররা। অবশেষে লালবাজার থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী এসে সেদিন উত্তেজিত জনতাকে স্রেফ লাঠিচার্জ করেই হঠাতে পেরেছিলো।"
---------------------
ওপরের অংশটুকু নেওয়া হয়েছে এই অধমেরই লেখা "ছায়াপথ" উপন্যাস থেকে। কিন্তু সে উপন্যাস লিখতে গিয়ে যে সব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম আমি, যত মানুষের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল, যত জায়গায় ঘুরেছি, তার মনে হয় সিকিভাগও লিখতে পারিনি উপন্যাসে। আর তা ছাড়া নিজেই তো ভেবেছি বহুবার যে গণহত্যা কী আদৌ কোনো দলীয় লাইন হতে পারে? না হওয়া উচিত?
আজ সেই দুমলাটের বাইরে থাকা কিছু কথা জানাই বরং। এই সব কথাই আমি সংগ্রহ করেছিলাম একেবারে ব্যক্তিগত কিছু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে।
বেহালা অঞ্চলের ডাকাবুকো নকশাল নেতা নীল চক্রবর্তীর সম্মন্ধে তথ্য সংগ্রহ করার সময় সত্যিই পড়েছিলাম ঝামেলায়। নিজে থাকি বেহালায়। বেহালার ওঠাপড়া অনেক কিছুরই সাক্ষী আমি। কিন্তু নীলের বাড়ি আর কিছুতেই পাই না খুঁজে।
ধরলাম বেহালার আরেক পুরোনো নকশাল নেতা পরিতোষ ভট্টাচার্যকে। বর্তমানে নামের আগায় চন্দ্রবিন্দু বসে গেলেও ইনি ছিলেন বেহালার আর এক ডাকাবুকো নকশাল নেতা আশুতোষ ভট্টাচার্যের ছোটভাই। এবং এই দুই ভাই মিলেই বেহালা রবীন্দ্রনগরে স্থাপনা করেছেন চারু মজুমদার এবং সরোজ দত্ত'র আবক্ষ মূর্তি। পরিতোষ ভট্টাচার্য আমাকে যার সন্ধান দিলেন তিনি নীল চক্রবর্তীর একদা সহযোগী। তিনি অবশ্য সহযোদ্ধা বলেই করলেন সম্বোধন। ওঁর নাম? নাম ধরুন...ধরুন...ধরুন বুড়ো। আমি যদিও প্রথম সাক্ষাতেই ডেকে বসলাম বুড়ো'দা বলেই।
এবার প্রথম সাক্ষাতেই প্রশ্ন করে বসলেন এই বুড়ো'দা।
-- নকশাল নিয়ে লিখে কত লেখক তো বিখ্যাত হয়ে গেল। কিন্তু কাউকে দেখলাম না আসল কিছু ঘটনা লিখতে। সে বুঝি যে অনেকে জানেই না সব কিছু তো লিখবে কী? কিন্তু তুমি হঠাৎ এতদিন পর খোঁজ করছো নীলের? কেন বলো তো?
বললাম আমার উদ্দেশ্য ও বিধেয় সব। শুনে তিনি বললেন যে তুমি এক কাজ কর। তুমি সামনের সপ্তাহে এস। ততদিন আমি একটু মনে করে রাখি বরং।
গেলাম অগত্যা পরের সপ্তাহেই। আবার হাজির হলাম বুড়ো'দার ভাঙাচোরা ঘরে। এবার প্রথমেই তিনি বললেন যে শুধুমাত্র একটা কারণেই আমায় কিছু খোঁজ খবর দেবেন। কারণ উনি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে শুধু বেহালা নয়, গোটা রাজ্যেই এই প্রথম কেউ নীলের সম্মন্ধে কিছু লিখতে চাইছে।
বুড়ো'দা এখনো বর্তমান। বয়স আশি ছাড়িয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালে ওঁর বয়স সম্ভবত ছিল তিয়াত্তর কী চুয়াত্তর। ওই বয়সেও ছ'ফুটের ওপর লম্বা মানুষটা বেঁকে যাননি একটুও। ঘরে থাকলে প্রায় সময়ই পরনে থাকে একটা লুঙ্গি। আর ঊর্ধাঙ্গ থাকে অনাবৃত। এবং দিনে মোটামুটি প্যাকেট দেড়েক বিড়ি তো লাগেই। সেই বিড়িই এবার আয়েশ করে ধরালেন একটা। তারপর শুরু করলেন বলতে।
-- বুঝলে, যদি এককথায় জানতে চাও তাহলে বলব যে নীল ওয়াজ আ জেম। আ আনকাট জেম।
-- এককথায় তো জানতে চাইছি না দাদা। আপনি বরং কথাগুলোকে বিস্তৃত করুন।
-- নীল ছিল হারা চক্রবর্তীর ভাই। এই অঞ্চলে তখন হারা'দা ছিল সিপিএম-এর একনিষ্ঠ কর্মী। নীল নিজেও আগে ওই সিপিএম পার্টি দিয়েই শুরু করেছিল জীবন। রাধিকাদা খুব ভালোবাসত নীলকে। ওর বয়স যখন কুড়ি হল, তখন ওই রাধিকাদাই ওকে ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটানিয়ায়। সেটা মনে হয় '৬৬ সাল হবে। সিপিএম করার সময় নীলকে একবার ধরেওছিল দেবী রায়ের পুলিশ। ওই রাধিকাদাই ছাড়ায় তখন ওকে।
এবার আমি পড়ি ধন্দে। এই রাধিকাদা'টি আবার কে। ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানির কোনো হোমরা চোমড়া নাকি। সে কথা শুধাতে উত্তর এল -- রাধিকা'দা মানে সিপিএমের রাধিকা রঞ্জন ব্যানার্জী। কামারহাটির এমএলএ ছিলেন।
নিভতে বসা বিড়িতে আবার দুটো টান দিয়ে শুরু করলেন বুড়ো'দা।
-- বিশালাক্ষীতলার যে খালপাড়ের বস্তিটা আছে, ওই বস্তিতেই জন্মেছিল নীল। ওখানেই ছিল ওদের ঘর। চারদিকের ওই খিস্তি খেউড় আর মদ গাঁজার চাষের মধ্যে থেকেও ও ছেলে জীবনে কোনোদিন কোনো নেশাও করেনি আর ওর মুখে কেউ কোনোদিন একটা নোংরা কথাও শোনেনি। ব্রিটানিয়াতে চাকরি করতে করতেই ওর মোহভঙ্গ হয় পার্টির প্রতি। ও চলে আসে এদিকে। অ্যাই তুমি তো বাইক নিয়ে এসেছ তাই না?
কোন কথা থেকে কোন কথা! হচ্ছিল নীল চক্রবর্তীর কথা। সেখানে আমার সাধের বাইকটা এল কোথা দিয়ে সেটাই এবার মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করলাম আমি। ওদিকে বুড়ো'দা দেখি ততক্ষণে গায়ে একটা ফতুয়া পরে নিয়েছেন।
-- চল চল...তোমায় একটা জিনিস দেখিয়ে নিয়ে আসি।
বের হলাম অগত্যা। বাইক স্টার্ট দিয়ে দেখি বুড়ো'দা ওই লুঙ্গি পরিহিত অবস্থাতেই একদিকে পা দিয়ে উঠে বসলেন বাইকের পিছনে। ওঁর দেখানো রাস্তাতেই এবার ছুটল বাইক। এসে পৌঁছলাম বিশালাক্ষীতলার খালপাড়ের সেই বস্তিতে। আগে ছোট থাকলেও খালের জমি জবরদখলের কারণে বস্তি এখন কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। বস্তিতে ঢোকার মুখেই বড় রাস্তায় একটা বেশ বড় ধরনের স্কুলও আছে। তকমায় সে স্কুল হায়ার সেকেন্ডারি। স্কুলবাড়ির গায়ে দিব্যি পরেছে নীল সাদা রঙের পোঁচ। আর বস্তির ভিতরে ছোট্ট একটি বাড়ির সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করালেন বুড়ো'দা। সে বাড়ি দেখিয়ে এবার বললেন...
-- এই যে বাড়িটা দেখছ, এই বাড়িটায় একসময় ছিল প্রাইমারী স্কুল। আর এটা বলতে গেলে একাই তৈরি করেছিল নীল। ওদের ঘর ওই বাঁদিক দিয়ে গেলে পড়বে। এই জমিটা তখন ছিল খালি। সঙ্গে আরও দু'চারজন ছেলে জুটিয়ে এ জমিতে বাঁশ পুঁতেছিল ও। তার পরদিন এখানেই দরমা আর টালি দিয়ে তিনটে ঘরও ফেলল বানিয়ে। আর বলে দিল যে বস্তির বাচ্চারা এখন থেকে এখানে এসে পড়ালেখা করবে। তখন কতই বা বয়স ছিল ওর? ওই আঠারো উনিশ হবে মনে হয়।
দেখলাম সেই বাড়ি। সে বাড়ির দশাও একেবারে তথৈবচ। সেটাই বললাম এবার। শুনে দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন বুড়ো'দা...
-- এখন এই বাড়ির আর সে পরিচয় নেই ভাই। চল, এবার ফিরে যাই আমরা।
সেদিনের কথার সেখানেই ইতি টানা হলেও পরদিন আবার আমি হাজির বুড়ো'দার ঘরে। আজ বুড়ো'দা পরেছেন ফতুয়া এবং পাজামা। এবার বাইকে বসে দিকনির্দেশ করলেন তিনি। আর বাইক চালিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম বনমালী নস্কর রোডের সমান্তরাল এক ছোট্ট রাস্তায়। এ রাস্তাতেও দেশলাই বাক্সের মত বেশ কিছু ফ্ল্যাটবাড়ী মাথা তুললেও একটি বাড়ি যেন আজও রয়েছে রংচটা মলিন অবস্থাতেই। সে বাড়ির সামনে এসে হাঁক পারলেন বুড়ো'দা...
-- গৌরা আছিস নাকি রে?
ভাঙ্গা লোহার দরজা খুলে যিনি বের হলেন তিনিও বুড়ো'দার সমবয়সীই হবেন। তবে উচ্চতায় অনেক কম। ডেকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভিতরে। সে বাড়িতে ঢুকেই ডানহাতের একটি ঘরে এসে বসলাম আমরা। এ ঘরে আছে একটি তক্তপোষ আর একটি মাত্র চেয়ার। আমি বসলাম সেই চেয়ারেই। বুড়োদা বসলেন তক্তপোষে। সে ভদ্রলোকের দিকে দেখিয়ে বললেন...
-- দেখে রাখো। এ হচ্ছে গৌর। আর এই হচ্ছে সেই ঘর।
দেখলাম, এবং কিছুই বুঝলাম না। আমার অবস্থা বুঝেই এবার আবার বললেন তিনি...
-- এই গৌরের বাড়িতে, এই ঘরেই হয়েছিল সিপিআই( এম এল) - এর ফার্স্ট পার্টি প্লেনাম।
এমন একটা কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। শুনে কেমন জানি একটা ঘোর লেগে গেল আমার। শুধু বলতে পারলাম...
-- এই ঘরে???
-- হ্যাঁ ভাই। এত লোক তো লেখে নকশালদের নিয়ে। কিন্তু ক'জন জানে এই কথা?
-- বুড়ো'দা, ফার্স্ট পার্টি প্লেনাম মানে তো তখন সিপিআই(এম এল)-এর সব প্রথমসারির নেতাই এসেছিলেন?
-- হ্যাঁ, এসেছিলেন তো। কে আসেননি সেদিন? সিএম তো ছিলেনই...
-- সিএম মানে?
-- চারু বাবু। তোমরা যাকে চারু মজুমদার নামেই চেন। ওঁর নাম আর পদবীর আদ্যক্ষর নিয়েই ওই সিএম তৈরি হয়। পার্টিতে উনি সিএম নামেই পরিচিত ছিলেন।
-- বুঝলাম। আর কে কে ছিলেন দাদা?
-- কে ছিলেন না সেটা বলো? সিএম নিজে ছিলেন। এ ছাড়া সরোজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু স্যানাল, কাকা...মানে অসীম চ্যাটার্জী, মেদিনীপুর থেকে বাবলু মজুমদার, ওড়িশা থেকে আপ্পাসুহৃৎ পট্টনায়েক, জঙ্গল সাঁওতাল...সবাই ছিলেন সেদিন।
এবার একটু থেমে আবার শুরু করলেন তিনি।
-- সিএম, সুশীতল রায়চৌধুরী আর কানু স্যানালকে নিয়ে আসা হয়েছিল হাইড রোড দিয়ে। জিনজিরার পোল টপকে পর্নশ্রীর ঝোপ ঝাড় আর খাল পার করে সে ট্যাক্সি এসেছিল এখানে। কাকার সঙ্গে এসেছিল বাবলু মজুমদার আর আপ্পাসুহৃৎ পট্টনায়েক। আর জঙ্গল সাঁওতালকে সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যুর এক ডেরা থেকে নিয়ে এসেছিলাম আমি নিজে। এই বেহালার থেকে সেদিন উপস্থিত ছিল নীল, আশু ভটচাজ আর গণেশ ঘোষাল।
-- কিন্তু বুড়ো'দা, চারু মজুমদারের ট্যাক্সি রাস্তা চিনে এ বাড়িতে এল কীভাবে?
এবার হাসলেন বুড়ো'দা। হেসে বললেন -- ও ট্যাক্সির সামনে বসেছিল নীল নিজে। তবে সবচেয়ে মজা হয়েছিল সরোজ দত্তের বেলা।
-- মজা?
-- তবে আর বলছি কী। '৬৯ এর ২২শে এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনের দিন তৈরি হল পার্টি। ১লা মে প্রথম মিটিং হল ময়দানে। ওইদিনই সবাই জানলো পার্টির নাম। সরোজ দত্তের ওপর সেদিন থেকেই পুলিশ রাখছিল নজর। জুন মাসে হয়েছিল প্লেনাম।এবার প্লেনামের দিন সকালে সরোজ দত্ত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন যে নিউ আলিপুরের বুড়ো শিবতলায় এক পরিচিতর বাড়িতে আসবেন সন্ধ্যাবেলায়। সেই মতো বেরও হলেন বাড়ি থেকে। কবি মানুষ। গায়ে সাদা পাঞ্জাবির ওপর কাঁধে ঝোলানো একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। সবাই জানে যে ও ব্যাগের ভিতর কবিতার খাতা ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু সেই ব্যাগে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবিও নিয়েছেন তিনি।
-- বুঝেছি। মানে রাস্তাতেই ওই পাঞ্জাবি বদল করে...
-- উঁহু অতটা সোজা নয় গো। উনি আসলেন সেই পরিচিতর বাড়ি। ওদিকে পুলিশের ফেউ পিছন পিছন এসে অপেক্ষা করতে থাকল রাস্তায়। আর উনি পাঞ্জাবি পাল্টে সে বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এলেন এখানে সুচিত্রা সিনেমার পিছনের রাস্তায়। তখন বেহালা থানাটা ছিল বনমালী নস্কর রোডে ঢুকে বাঁদিকে। উনি একে তাকে জিজ্ঞাসা করে যেন কিছুই জানেন না এমন ভাবে আর্য সমিতির পাশের গলি দিয়ে হেঁটে আসলেন হরিসভার সামনে। ওখান থেকে দলের ছেলেরা নিয়ে আসলো এই বাড়িতে।
কোনো ক্রাইম থ্রিলারের চেয়ে কম নয় এই কাহিনী। আমি শুনছি আর কুড়িয়ে নিয়ে জমানোর চেষ্টা করছি সেদিনের সব ঘটনাবলী। বুড়ো'দা খানিক হাসলেন এবার। একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন...
-- এ ঘরে ওই জানালার ধার ঘেঁষে বসেছিলেন চারুবাবু। দুপাশে বসেছিলেন কানু স্যানাল এবং সরোজ দত্ত। এই ঘরে সেদিন পার্টির ফার্স্ট প্লেনামের সাথে সাথেই তৈরি হয়েছিল বি আর এস এফ।
-- সেটা আবার কী দাদা?
-- বেহালা রিজিওনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন। আসলে প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে এই প্লেনাম হবে যাদবপুরের কোথাও। কিন্তু আশুদা বলে পাঠালো যে যাদবপুরের প্রায় প্রতিটা ঘরের দিকেই নজর রেখেছে পুলিশ। নীল শুনে বলল যে তাহলে আমরা ব্যবস্থা করি।
-- আশুদা মানে...
-- আরে আশু মজুমদার। আমাদের বেহালার সঙ্গে তখন যাদবপুরের যোগাযোগ থাকত শুধু হাবুলের মাধ্যমেই। এটা যদিও ওর আসল নাম নয়। এটা ছিল পার্টির ভিতরের নাম। আর জানো তো, এই হাবুলকে কিন্তু কোনোদিন ধরতে পারেনি পুলিশ।
-- এ তো পুরো গুপ্তচর দাদা।
-- তবে আর বলছি কী। এমনিতেও হাবুল কাজ করত ভবানীপুরের একটা ট্রান্সপোর্ট অফিসে। আর নেশার মধ্যে ছিল তাস খেলা আর পান খাওয়া। পুলিশ কোনো সন্দেহই করেনি কোনোদিন।
-- কেন দাদা?
-- আরে সন্দেহ করবে কী? একে তো হাবুলের চেহারা ছিল একদম সাদামাটা। তার ওপর ওই পান জর্দার নেশা।
-- কিচ্ছু বুঝলাম না দাদা।
-- শোনো, তুমি ক'জন পার্টির লোককে দেখেছ বলো তো যাদের পান জর্দার নেশা আছে? প্রায় নেই বললেই চলে। পার্টির ছেলেরা করতো বিড়ির নেশা। অতএব...
কথা এগোনোর সাথে এবার ঘরে ঢুকলেন গৃহকর্তা গৌরদা নিজে। পিছনে একটি বাচ্চা মেয়ে। এ মেয়েটি গৌরদার নাতনি। সে বয়ে নিয়ে এসেছে চায়ের কাপ আর বিস্কুট সমেত একখানা ট্রে। বিস্কুট সহযোগে সেই চা খেতে খেতেই শুনলাম এবার অনিল চক্রবর্তী ওরফে নীলের কাহিনী। দুজনেই বললেন নিজেদের মতো করে। কথাপৃষ্ঠেই বললেন বুড়ো'দা...
-- বর্ধমান থেকে ধরে নিয়ে এসে আলিপুর জেলে রাখা হয়েছিল নীলকে। সেখান থেকেই সিআরপি আর বেহালা থানার পুলিশ বের করে আনে নীলকে। কোনো কোর্টের অনুমতি ছাড়াই সেদিন এ কাজ করেছিল পুলিশ।
আমি নিশ্চুপ হয়ে শুনে চলেছি সেদিনের সেই ঘটনার কথা। গৌর'দা এবং বুড়ো'দা দুজনে মিলেই একসাথে জানালেন এবার...
"চোঙারবনে ভ্যান থেকে নামিয়ে নীলের পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছিল অবশ্য বেহালা থানারই দুজন। তারা হল..."
না, সে নাম সেদিন শুনলেও প্রকাশ করতে অপারগ আমি। কারণ শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে কোনো কিছুই লেখা উচিত নয়। কিন্তু এরপর যা শুনলাম তাতে মাথাটা আমার কেমন জানি ঘুরেই গেল এবার।
-- শুধু কি পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি? মৃত্যু নিশ্চিত করতে এবার রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে কেটে দেওয়া হয় নীলের গোড়ালির ওপর দু'পায়ের শিরা।
এরপরই নীল চক্রবর্তীর প্রাণহীন নিথর দেহ নিয়ে পুলিশের কালো ভ্যান এসে পৌঁছায় বিশালাক্ষীতলার বস্তির সামনে। সকাল তখন সবে সাত কী সাড়ে সাত হবে। নীলের মা'কে ডেকে নিয়ে এসে দেখানো হয় ছেলের মৃতদেহ। এরপরই ভ্যান ঘুরিয়ে চলে যায় আবার বেহালা থানার উদ্দেশে। সে ভ্যানের সামনে থাকা জিপে তখন ড্রাইভারের পাশের আসনে বসে আছেন বেহালা থানার ওসি সুবীর ঘোষ। কড়া হাতে নকশাল দমন করার জন্য যাকে বিশেষ ভাবে নিযুক্ত করেছিলেন ডিসি ডিডি দেবী রায় নিজে।
যদিও থানায় সে ভ্যান ফিরে যাওয়ার আগে দাঁড়িয়েছিল আরো একবার। বনমালী নস্কর রোড সংলগ্ন এক গলির সামনে দাঁড়িয়েছিল সেই ভ্যান। সামনের জিপ থেকে নেমে গলিতে ঢুকেছিলেন ওসি সুবীর ঘোষ। সে গলির ভিতরের এক বাড়ির থেকে টেনে বের করা হয়েছিল বছর বাইশ তেইশের এক তরুণীকে। জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে দেখানো হয়েছিল নীলের রক্তাক্ত মৃতদেহ। সে তরুণীর অপরাধ? অপরাধ একটিই। সে ছিল নীলের প্রেমিকা। সে তরুণীর নাম? নাম ধরে নিন না মহুয়া...মৌপিয়া...মহানন্দা...অথবা...মন্দাক্রান্তা।
শেকসপিয়র তো কবেই বলে গেছেন...নামে কী এসে যায়।
চা শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। আয়েশ করে বুড়ো'দা এবার নিজে একটা বিড়ি ধরিয়ে গৌরদাকেও এগিয়ে বিড়ির প্যাকেট। দুজনে মিলে একসাথে বিড়ি টানবার ফাঁকেই আবার বললেন বুড়ো'দা...
-- বেলা ওই দুটো আড়াইটে নাগাদ নীলের বডি যখন নিয়ে আসা হয়েছিল ক্যাওড়াতলায়, আমরা তখন হাজির হয়েছিলাম খালের উল্টো দিকে কটা কালীর চায়ের দোকানের সামনে। অনেকেই ছিলাম বুঝলে। আমি, পল্টু, বাবু দত্ত, দ্বারকা, কান্ত, কানু, মন্টু সবাই ছিলাম সেদিন ওখানে। ওখান থেকেই স্লোগান দিচ্ছিলাম আমরা কমরেড নীল চক্রবর্তী অমর রহে।
-- সেকি বুড়োদা! পুলিশ তাড়া করেনি আপনাদের।
-- আরে খালের ওপার থেকে সবই দেখছিল পুলিশ। কিন্তু কিছু বলতে করতে পারছিল না। আসলে আমাদের সেদিন গার্ড দিয়ে রেখেছিল ভীমের ছেলেরা।
-- ভীম মানে...?
-- ভীম মানে চেতলার ভীম। ও নিজে ছিল কংগ্রেসের। কিন্তু নীলের থেকে ওর গোটা ফ্যমিলি আর চেতলার অনেক ছেলে এত উপকার পেয়েছিল যে ও বলেছিল --"তোরা খালের এ পাড়ে দাঁড়া। গোটা চেতলার ছেলেরা আজ তোদের সঙ্গে আছে। আজ পুলিসকে খাল পোল টপকাতে দেব না কিছুতেই।"
অনেকক্ষণ বসলাম গৌরদার এই বাড়িতে। এবার ওঠার পালা। বুড়োদাকে আবার ছেড়ে দিয়ে আসবো বাড়িতে। ওঠবার মুখেই কেমন জানি হতাশ মুখেই বললেন এবার তিনি...
-- আসলে কী জানো? মরতে নীল'কে হতই। হয় দলের ভিতরের কেউ মারতো। আর নয়তো বাইরের কেউ। পুলিশ শুধু সেদিন গুলি করেছিল।
-- সে কি বুড়ো'দা? এত কিছুর পর এখন আপনি বলছেন এই কথা?
-- বলব না? আজকাল তো কথায় কথায় তোমরা ব্যবহার করো সোশ্যাল রিফর্মার কথাটা। কিন্তু আদতে ক'জন হয় বলো তো ওই সোশ্যাল রিফর্মার? নীল ছিল সেই সত্যিকারের সমাজ সংস্কারকদের একজন।
-- কেন বলছেন দাদা এই কথাটা?
-- ভেবে দেখো। একটা ছেলের মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আর ওই বয়সের মধ্যেই ও নিজের বস্তিতে একটা প্রাইমারী স্কুল চালু করেছিল। ওই তারাতলার ওপারটা ছিল মন্টুর, আর এপারটা ছিল মোটুর দখলে। শঙ্কর পাইক ওই মোটুর দলেই ছিল। পরে তো মোটুকে মেরে নিজেই...। সে হোক, ওদের ওই লোহার ছাঁটের ব্ল্যাক মার্কেট আর তা নিয়ে খুনোখুনি মারামারি বন্ধ করে দিয়েছিল নীল। অজন্তা সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক বন্ধ করে দিল। এখন তো ক্রেডিট নিতে অনেকেই আসে। কিন্তু ওই ব্ল্যাকারদের ও নিজে বসিয়ে দিয়েছিল ঘোলসাহাপুর বাজারে। বলেছিল এখানে বসে সবজি বিক্রি কর সবাই, কিন্তু টিকিট ব্ল্যাক চলবে না। তা ছাড়া গোটা এলাকার মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে শুরু করেছিল ও দলের ছেলেদের নিয়ে। সেই দলেরই অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেল ও।
-- কেন বুড়ো'দা?
-- কেন আবার? Mass Annihilation এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছিল। বলতে শুরু করেছিল যে গণহত্যা কোনো দলের লাইন হতে পারে না। বাইরে শত্রু, দলে শত্রু। প্রচুর শত্রু বানিয়ে ফেলেছিল বুঝলে। সমাজের সংস্কার চেয়েছিল। সেই সমাজই শেষে ওকে মারলো।
বাইক চালিয়ে আবার এলাম বুড়ো'দার বাড়ির সামনে। ফেরার আগে শুধু কৌতূহলবশতঃই বলে বসলাম আমি।
-- ও বুড়ো'দা...একটা কথা বলব?
-- হ্যাঁ, বলো না।
-- মানে একটা আবদার আর কি।
-- আরে শুনিই না।
-- বলছি যে ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করা যায় একবার?
-- কোন মহিলা গো?
-- ওই যে... নীল চক্রবর্তীর বান্ধবী।
-- অ্যাই...যাও তো তুমি। আমার মেলা কাজ আছে এখন।
ঘরে ঢুকে যান বুড়ো'দা। কিন্তু একটা জেদের বশেই আবার পরদিন হাজির হই ওঁর বাড়িতে। অনুরোধ আবদার সব ওই একটাই। দেখি সেটা পূরণ হয় কিনা।
বহুক্ষণ ধরে বুড়ো'দাকে বোঝানোর পর রাজি হলেন তিনি। ঠিক হলো পরের সপ্তাহে যাব সেই মহিলার বাড়ি। তবে পইপই করে বলেও দিলেন বুড়ো'দা যে আমি যেন বাড়তি কথা একেবারেই না বলি সেখানে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় জানালেন যে শুধুমাত্র নীল চক্রবর্তীর বান্ধবী হওয়ার কারণেই তাকে একসময় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পাঁচ বছর জেলে থেকে '৭৭ সালে আর সবার সঙ্গেই ছাড়া পান তিনি। বুড়ো'দা নিজেও জেল থেকে ছাড়া পান ওই সময়ই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েক মাস পর দলেরই অন্য এক কমরেডের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কারণ নিজের বাড়িরই কেউ আর ঠাঁই দিতে রাজি হয়নি ওঁকে। বিয়েটা বলতে গেলে এই বুড়ো'দাদের গ্রুপেরই সবাই মিলে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন দুজনকে। বিয়ে হয়েছে। কিন্তু মহিলা থেকে গেছেন নিঃসন্তান হয়েই। কারণ? কারণ অতি সামান্যই। গ্রেপ্তারের পর তখনকার মত পুলিশি অত্যাচার সামলে নিলেও সন্তান ধারণের ক্ষমতাই আর ছিল না ওঁর।
প্রায় দু'সপ্তাহ পর বুড়ো'দা আমায় নিয়ে চলেছেন শহরের উপকন্ঠের এক বাড়িতে। সেখানেই থাকেন তিনি। স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর হল। এখন একাই থাকেন। স্বামী কাজ করতেন এক প্রাইভেট কোম্পানীতে। সেখানে কাজ করেই যেটুকু জমাতে পেরেছেন, সেই জমানো টাকার সামান্য সুদেই এখন জীবন নির্বাহ করেন তিনি।
আজ আর বাইক নয়। আজ উবের বুক করেই চলেছি দু'জনে। যেখানে এসে থামলাম তার সামনেই ইট বাঁধানো রাস্তার ওপর ছোট্ট একটি দেড়তলা বাড়ি। দরজা খুললেন সেই মহিলাই। এবং প্রথম দর্শনেই মনে হল যে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন যেন বয়সটা খানিক বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। দরজা খুলেই ডাক দিলেন তিনি...
-- আয় বুড়ো'দা। এস ভাই। ভিতরে এসে বসো।
ভিতরে ঢুকে বসলাম সে বাড়ির দুটি ঘরের একটিতে রাখা চেয়ারে। তিনি গেলেন অন্য ঘরে। খানিক পর দুটো থালায় চারটে করে রুটি আর খানিকটা তরকারি নিয়ে এসে দাড়ালেন তিনি।
-- বুড়োদা, এই রাত আটটায় এসেছিস। এখান থেকেই খেয়ে যা। নাও ভাই, তুমিও খাও।
ঠিক বুঝতেই পারছি না যে কী করব? কী করা উচিত? এই সত্তরোর্ধ্ব মহিলা এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমিও কতকালের চেনা। বুড়ো'দা দেখলাম বিনা বাক্যব্যয়ে শুরু করে দিলেন খাওয়া। ইশারায় বললেন যে আমিও যেন শুরু করেই দিই।
খাওয়া শেষে আবার সামনে এসে বসলেন তিনি। এবার ঝকঝকে একটা হাসি হেসে বলে উঠলেন...
-- তুমি নাকি আমাকে দেখতে চেয়েছো? কেন বলো তো? এই বুড়িকে দেখে তোমার কী কোনো আনন্দ হবে?
খুবই আমতা আমতা করে বললাম এবার আমার উদ্দেশ্য। উত্তরে তিনি জানালেন যে শুধুমাত্র একটি কারণেই তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। কারণ এতদিন পরে হলেও কেউ তো অন্তত দুকলম লিখতে চায় নীল চক্রবর্তীর সম্মন্ধে।
ওঁর পিতৃগৃহের ফটো আগেই তুলেছিলাম মোবাইলে। সেটাই এবার দেখালাম। ফটোটা দেখতে দেখতে খুবই মৃদু স্বর শোনা গেল সেই কন্ঠ থেকে।
-- '৭৮ সালে বিয়ের পর থেকেই আর যাইনি ও বাড়িতে। কেন যাব? যেখানে কেউ চায় না আমায়, যেখানে সবাই আমায় মনে করে অবাঞ্ছিত, সেখানে আর যাবই বা কেন আমি?
এবার তিনি মুখ ঘোরালেন বুড়ো'দার দিকে।
-- বাড়িটা সেই একই রকম রয়ে গেছে। তাই না রে বুড়ো'দা?
বুড়ো'দা নিশ্চুপ। মহিলা এবার বাড়ির ছবিটার সামনে এক জায়গায় আঙুল রেখে আমায় উদ্দেশ করে বললেন...
-- এই জায়গা...বর্ধমান যাওয়ার আগে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়েই বলে গিয়েছিল সে -- আসি রে। ভাবিস না, ঠিক ফিরে আসব আমি।
ঘরের আবহাওয়া কেমন জানি গুমোট হয়ে উঠেছে এখন। রাতও হয়েছে। বাড়ির দিকে ফিরতে হবে এবার। ওঠার আগে সামনের টেবিলে রাখা একটা খাম নিয়ে আমার হাতে দিলেন তিনি।
-- তুমি এটা রাখো। ওর মনে হয় আর কোনো ফটোই নেই। ব্রিটানিয়ার কয়েকজন মিলে ঘুরতে গিয়েছিল আগ্রায় তাজমহল দেখবে বলে। তখনই শখ করে তুলেছিল এই ফটোটা।
আমি পুরো বিহ্বল এইবারে।
-- সেকি!!! এ ছবি তো আপনার সম্পত্তি। আমায় দিচ্ছেন কেন?
-- না ভাই। এতদিন তো কাছেই রেখে দিয়েছিলাম। এখন তুমি রাখো। লেখো সেই মানুষটার কথা। যে কিনা একদিন দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছিল।
শুধু জিজ্ঞাসা করতে পেরেছিলাম সেদিন যে -- আপনার রাগ হয় না? কষ্ট হয় না এখন?
হেসেই উত্তর দিলেন তিনি...
-- কষ্ট তো একটু হয়ই। তবে রাগ হয় না। আমি সবাইকেই ক্ষমা করে দিয়েছি এখন। এখন বুঝি যে রাগ হিংসা দ্বেষ এগুলো শুধু ক্ষতিই করে আমাদের। আর সত্যিই তো, হত্যা বা গণহত্যা, মানুষ মেনে নেয় না কোনোটাই।
ফিরে আসলাম সেদিন।
আর মনের মাঝে যেন গুমরে উঠতে থাকল কবি আরণ্যক বসুর মনে থাকবে- র কতকগুলো লাইন...
....
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই__ মিলিয়ে নিও!পরের জন্মে তোমায় নিয়ে…
বলতে ভীষণ লজ্জা করছে
ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে
পরের জন্মে তোমায় নিয়ে…
মনে থাকবে?
সেদিন ফিরে আসার এতদিন বাদে লিখলাম সেই মানুষের কথা। সেই নীল চক্রবর্তী এবং তার কর্মকাণ্ডের কথা।
ওপরের ছবিতে তাজমহলের সামনে বসে থাকা নীল চক্রবর্তী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন