বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ভারতের অর্থনীতি ~ শতদ্রু দাস

ভারতের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে জাতীয় আয় কমেছে ২৪%। অর্থাৎ গত বছর ওই তিন মাসে ভারতীয়দের যা গড় আয় ছিল এই বছর তার থেকে ২৪%, বা প্রায় এক চতুর্থাংশ কম। কাজ হারিয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ। এরকমটা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আগে কখনো হয়নি। অনেকেই বলবেন যে এতে সরকারকে দোষ দেওয়া যায় না, নির্মলা সিতারামন যেমন বলেছেন যে এসব "দৈবের দোষ।" কিন্তু করোনা মহামারী আর তার জন্যে অর্থনৈতিক লকডাউন তো শুধু এদেশে হয়নি, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, ক্যানাডা, ব্রাজিল - সর্বত্রই হয়েছে। কিন্তু আর কোনো দেশের অর্থনীতির এইরকম পতন হয়নি। হ্যাঁ, করোনার জেরে হওয়া  অর্থনৈতিক পতনে ভারত প্রথম স্থান অধিকার করেছে। 

কিছু বিজেপি আইটি সেলের কর্মী সকালবেলা এদিক ওদিক লোককে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল যে আমেরিকার অর্থনীতির পতন হয়েছে ৩২%, ভারতের থেকেও বেশি কিন্তু সেসব ঢপবাজি ধরা পড়ে গেছে। চলুন আমেরিকার কথাই ধরি কারণ এখনও অবধি করোনা সংক্রমণে সব থেকে বেশি মানুষ মরেছে ওই দেশে। কতটা পতন হয়েছে ওদের অর্থনীতি? ওই তিন মাস, মানে এপ্রিল-জুনে ওদের জাতীয় আয় সংকুচিত হয়েছে গত বছরের তুলনায় ৯.২%। তাহলে যে বলছিলো ৩২%? ওটা বার্ষিক হিসেব, অর্থাৎ বাকি বছরও যদি এই হারে অর্থনীতি সংকুচিত হয় তাহলে সংখ্যাটা ৩২% তে দাঁড়াবে। ওই একই বার্ষিক হিসেব যদি ভারতের ক্ষেত্রে লাগাই তাহলে ভারতের অর্থনীতি সংকোচনের হারটা  গিয়ে দাঁড়াবে ৬৭% তে। ৬৭%! আর কোনো দেশই এত বড় অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন নয়, শুধু ব্রিটেন কিছুটা কাছাকাছি। এমন কেন হলো? কেন ভারতের চেয়ে  ১০-১২ গুন বেশি মাথাপিছু  মৃত্যু হার হওয়া সত্বেও ইউরোপ আমেরিকার অর্থনীতি এত গভীর সংকটে পড়লো না? 

কারণ হলো এই সমস্ত দেশগুলোর সরকার যাতে সাধারণ মানুষ লকডাউনে কাজ না হারায়, আর কাজ হারালেও যাতে রোজগার না হারায় তার জন্য দরাজ হাতে খরচ করেছে। ওই সমস্ত দেশে শুধু বড় ব্যবসায়ীই নয়, ছোট ছোট ব্যবসায়ী আর দোকানদারদের সরকার ক্যাশ টাকা দিয়েছে যাতে তারা কর্মচারী ছাঁটাই না করে। ও দেশের সরকার লক্ষাধিক  ক্যাশ টাকা দিয়েছে উচ্চবিত্ত বাদে সমস্ত  মানুষের একাউন্টে। এর ফলে চাহিদায় কোনো খামতি হয়নি, লকডাউন শিথিল হতেই মানুষ দোকান বাজার থেকে  সামগ্ৰী কিনেছে হাত খুলে। আমাদের দেশে মে মাস থেকে লকডাউন শিথিল হলেও কোটি কোটি রোজগার হারানো বা রোজগার কমে যাওয়া মানুষের পক্ষে খাদ্য বাদ দিয়ে আর কিছু কেনা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশে সরকার যে অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার ৮৫% হলো বড় ব্যবসায়ীদের জন্য, কাজ হারানো মানুষের জুটেছে শুধু মাসে বিনামূল্যে ৫ কিলো চাল, ব্যাস। তাই আমাদের অর্থনীতি মে জুন মাসেও খুঁড়িয়েছে। চাহিদা নেই বলে এখনো বহু দোকান বন্ধ পড়ে রয়েছে শহরগুলোতে। চাহিদা নেই বলে অধিকাংশ কারখানা একটা শিফটে উৎপাদন করছে। এতটা জনবিরোধী নীতি বোধয় আর কোনো দেশের সরকার নেয়নি। ট্রাম্পের আমেরিকা, জনসনের ব্রিটেন বা বলসনারোর ব্রাজিলও অনেক বেশি দরদ দেখিয়েছে সে দেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি। 

তবে কেউ যদি মনে করেন যে সংকটের এখানেই শেষ তাহলে খুব ভুল ভাবছেন। ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা আর সস্তায় ঋণ দিয়ে কোনো লাভ হয় না যখন বাজারে তাদের উৎপাদিত পণ্যের কোনো চাহিদা না থাকে। আর তাই ভারতের কর্পোরেট সেক্টরের আয়ও কমবে ব্যাপক হারে। ব্যাংকের কাছে কর্পোরেটদের প্রচুর ঋণ, আয় না হলে সেই ঋণ শোধ দেবে কী ভাবে? আগস্টের শেষ অবধি ঋণের ওপর মরাটোরিয়াম বা স্থগিতাদেশ ছিল, অর্থাৎ শোধ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে কিন্তু ফের শোধ দিতে হবে ঋণ আর তখনই টের পাওয়া যাবে অনাদায়ী ঋণের বোঝা কতটা বাড়ল। জুলাই মাসে প্রকাশিত, আরবিআইয়ের ফাইন্যান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট বলছে যে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে ৪০-৭০% অবধি। এর ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়বে ব্যাংকগুলো, ব্যাংকের একাউন্টে সাধারণ মানুষের আমানত সুরক্ষিত থাকবে কি না সেটাও বলা যাচ্ছে না। সরকার তার ওপর সুপ্রিম কোর্টে আজকে জানিয়েছে এই মরাটোরিয়াম দু বছর অবধি বাড়ানো যেতে পারে কিন্তু আরবিআই জানিয়ে দিয়েছে যে সেরকম চেষ্টা করলে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে যাবে। এই যে আশু ব্যাংক সংকট, এর থেকে কী ভাবে মুক্তি আসবে কেউ জানে না। সরকার ব্যাংক বেসরকারীকরণ করার কথা বলছে কিন্তু কে কিনতে চাইবে বিপুল অনাদায়ী লোনে জর্জরিত ব্যাংক? সংকট থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বোধয় সরকারের কোষাগার খালি করে, ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া যাতে এই অনাদায়ী ঋণের জন্য হওয়া ক্ষতি ভরণ করা যায়। কিন্তু সরকারই বা কোথা থেকে পাবে টাকা? সরকার কি ধনীদের ওপর কর চাপাবে? সেটা যে এই সরকার করবে না তা ইতিমিধ্যে সবাই বুঝে গেছে, পুরো বোঝাটাই গরিব মানুষের কাঁধেই পড়বে। বেচে দেওয়া হবে এলাইসি, রেল, হ্যাল, সেলের মত সরকারী সংস্থাগুলোকে। যেহেতু কর্পোরেটদের কাছেও টাকার টান তাই বেচতে হবে জলের দরেই। ছাঁটাই হবে বহু সরকারী কর্মচারী, বন্ধ হবে নতুন নিয়োগ। আগামী তিন চার বছরে ব্যাপক হারে খরচ কমবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোয়। 


রেলের আর সরকারের স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষার ফল বেরোচ্ছে না বলে লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীর হা হাকার শুরু হয়েছে, সকলেই দেখেছেন, ১০ লক্ষ যুবক যুবতি ইউটিউবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় ডিসলাইক বোতাম টিপে এসেছে। আগামী এক দু বছরে এই চাকরির হাহাকার আরো ব্যাপক হবে। অন্য অর্থনীতিগুলো সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে কিন্তু ভারতের সামনে পথ খুব সঙ্গীন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন