শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

কৃষি আইন ~ সুশোভন পাত্র

লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন, লেটস টক অ্যাবাউট কিষান টু-নাইট! 
না এরকম কোন মিডিয়া বলেনি। বলেনি কারণ কিষান মিডিয়াতে নন ইস্যু! কিষান মানে ঐ, যাদের সৌজন্যে আপনি তুলতুলে রুটি পুরুষতান্ত্রিকতার ঝোলে ডুবিয়ে প্রাইমে টাইমে রিয়া চক্রবর্তীর গুষ্ঠি উদ্ধার করেন, সেই কিষান। কিষান মানে ঐ, যাদের সৌজন্যে আমারা ধোঁয়া ওঠা ভাতের উপর তৃপ্তির ঘি ছড়িয়ে IPL-র ফটো ফিনিশ উপভোগ করি, সেই কিষান। 
কিম্বা ধরুন, ভারতে প্রতি ১২ মিনিটে যাদের একজন কে ঋণের দায়ে আত্মঘাতী হতে হয়, সেই কিষান। কিষান মানে, যাদের রক্ত জল করা উপার্জনের টাকা সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে, জন্মদিনের পার্টি তে  পপ গায়ক এনরিকে ইগলেসিয়াসের সুরে কোমর নাচিয়ে, নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, বিজয় মালিয়া নিশ্চিন্তে বিদেশে গিয়ে বসে থাকতে পারেন, সেই কিষান। 
এককালের 'জয় জওয়ান জয় কিষানদের' দেশে আজকাল নাকি 'সব চাঙ্গা সি'! তাই জোরজবরদস্তি কৃষি বিল পাশ করানো ছাড়া সরকারের মনসুন সিজনে আর কোন কাজই নেই! অপরিকল্পিত লকডাউনের জন্য কত পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে -শ্রম মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। কোভিড সংক্রমণের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ে কতজন ডাক্তারের প্রাণ গেছে -স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। কত মানুষ আধ পেটা রইলো, কত মানুষ না খেতে পেয়ে মরল -খাদ্য মন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। দেশে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন -অর্থমন্ত্রকের কাছে ডেটা নেই। 
ডেটা নেই। তাই সমস্যা নেই। সমস্যা নেই তাই সমাধানের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই তাই সরকারের কাজ নেই। Ignorance is bliss, ১৭৪২-এ বলেছিলেন ব্রিটিশ কবি থমাস গ্রে। Ignorance is governacne, ২০২০ তে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। সরকার নয়, সার্কাস চলছে বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপি।  
সার্কাসের রিং মাস্টার নরেন্দ্র মোদী কিষান'দের উদ্দেশ্যে বলেছেন 'কৃষকদরদী বিল', 'ঐতিহাসিক বিল'। তা এমন 'ঐতিহাসিক বিল' মুখ লুকিয়ে পাশ হল কেন? 'কৃষকদরদী বিল' যখন দেশের কিষানরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে কেন? যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় রাজ্য সরকারের মতামত নেওয়া হল না কেন? সম্প্রচার বন্ধ করে রাজ্যসভায় মার্শাল লেলিয়ে গলার জোরে ভোট করাতে হল কেন? চোরের মন এক পুলিশ পুলিশ কেন? আসলে ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি! বিল ঐতিহাসিকই, তবে কিষানদের জন্য নয়, রিং মাস্টারের পীরিতের কর্পোরেট শিল্পপতিদের জন্য। কেন? সিম্পল! 
অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংশোধনীতে বলা হচ্ছে, চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-গম-ভোজ্য-তেল তৈলবীজ নাকি যত ইচ্ছে মজুত করা যাবে। প্রশ্ন হল মজুত করা তো যাবে, কিন্তু করবে কে? আপনার-আমার মত ছা-পোষা সাধারণ মানুষ? না, গড়ে ২ হেক্টরের কম জমির মালিক দেশের ৮৬% চাষি? আসলে মজুত করবে তারাই যাদের মজুত করার মত পকেটের জোর আছে। ব্যাঙ্কে ব্যালেন্স আছে। পরিকাঠামো আছে। পাতি অর্থে কর্পোরেট। 
কথায় বলে There is always a method in madness; একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় এই দেশের অগ্রণী শিল্পপতি কে? নো পয়েন্ট গেসিং! তিনি মোদীর নির্বাচনী প্রচারে চার্টার্ড বিমান সাপ্লাইকারী গৌতম আদানি। আফ্রিকা-ইউরোপ ছাড়াও আদানি-উইল্মারের খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। বিনিয়োগ হচ্ছে বাংলাতেও। 
APMC অ্যাক্টের হাত ধরে ভারতে কিষান মান্ডির পথ চলা শুরু ষাটের দশকে। সংখ্যায় অপ্রতুল ও দুর্নীতি সহ বহু সমস্যায় জর্জরিত হলেও আজও ৭.৫ হাজার মান্ডি চাষিদের কাছে বটবৃক্ষের প্রশস্ত ছায়ার মত। যে ছায়ার শীতলতা দিনের পর দিন লোভী ব্যবসিকদের লালসা থেকে চাষিদের রক্ষা করেছে। সম্মিলিত ভাবে কৃষকদের দরকষাকষির সুযোগ দিয়েছে। অন্তত খাতায় কলমে MSP-র একটা নিশ্চয়তা রয়েছে। কৃষিপণ্য ব্যবসা বাণিজ্য উন্নয়ন অর্ডিন্যান্সের উদ্দেশ্যই হল মান্ডির বাইরেও প্রাইভেট মার্কেট তৈরি করা এবং মার্কেট গুলি কে রাজ্য সরকারের ট্যাক্স বা সেসের আওতার বাইরে রেখে সেখানেই চাষিদের ফসল বেচতে বাধ্য করা।
তাই ব্রহ্মা জানেন, রিং মাস্টার টুইটে যতই 'একদেশ একবাজারের' গুলতানি করুন না কেন, এই প্রাইভেট মার্কেট গুলি অচিরেই কিষান মান্ডি গুলির বিলুপ্তির অনুঘটক হবে। MSP-র নিশ্চয়তা কর্পূরের মত উবে যাবে। আর মান্ডির অনুপস্থিতিতে প্রাইভেট মার্কেট গুলির হাত ধরে কর্পোরেটই সরকারের রেশন ব্যবস্থার মুখ্য জোগানদার হয়ে উঠবে। এতদিনের সরকার ও চাষির মধ্যে ফসল কেনাবেচার সম্পর্কে হাড্ডি হিসেবে আবির্ভাব ঘটবে কর্পোরেট ফোঁড়েদের।  
টেকনিক্যাল দুনিয়ায় প্রোটোটাইপ মডেলিং বলে একটা টার্ম চালু আছে। ঐ ডাবু দিয়ে কয়েকটা ভাত তুলে একটু টিপে সেদ্ধ হয়েছে কিনা বুঝে নেওয়া কিম্বা সরষে ইলিশে নুনটা ঠিকঠাক পড়েছে কিনা একটু চেখে দেখে নেওয়ার মত আর কি। মান্ডি তুলে দিয়ে প্রাইভেট মার্কেট তৈরির প্রোটোটাইপ মডেল বিহারে ২০০৬ থেকেই চালু। অভিজ্ঞতা কি বলছে? বিহারের একজন কৃষকের গড় মাসিক অ্যায় ৩,৫৩৮টাকা। যা দেশের কৃষকদের মাসিক গড় আয় ৬,৪২৬টাকার তুলনায় ৪৫% কম। আর দেশের যে দুই রাজ্যে মান্ডির রমরমা সেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা তে কৃষকদের গড় মাসিক আয় ১৮হাজার এবং ১৪হাজারের তুলনায় ৮০% এবং ৭৫% কম। 
রইলো বাকি কন্ট্রাক্ট ফার্মিং। আমেরিকায় গত ৬দশক ধরে চালু আছে প্রাইভেট কন্ট্রাক্ট ফার্মিং-র মডেল। তবুও ১৯৬০'র পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে কমেছে কৃষকদের আয়। বেড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ। বর্তমানে প্রায় ৪২৫ বিলিয়ন ডলার। বেড়েছে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা। আমেরিকার সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় ৪৫% বেশি। ইউরোপের কৃষি ব্যবস্থাও দাঁড়িয়ে  আছে প্রাইভেট মার্কেটের জোরে না বরং ফি-বছরে সরকারের ১০০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকির সৌজন্যেই।    
১৯৩০-র গ্রেট ডিপ্রেশনের মোকাবিলায় সোভিয়েতে স্তালিনের হাত ধরে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নিউ ইকনমিক পলিসিতে  ছিল দ্রুত শিল্পায়ন এবং কৃষির সমষ্টিকরণ। রাশিয়ার জমিদার-জোতদার কুলাকদের হাত থেকে জমির দখল নিয়ে ছোট-মাঝারি কৃষকদের সমষ্টি চাষের প্রথা শুরু হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কৃষির সমষ্টিকরণের মাধ্যমই। কৃষির অগ্রগতির ব্যাপক সাফল্যই রসদ জুগিয়েছিল সোভিয়েতর রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে দ্রুত শিল্পায়নে। পুঁজিবাদী দেশের মুখে ঝামা ঘষে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সৌজন্যেই সোভিয়েত বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে।  
প্রায় ৯০ বছর পর, প্যান্ডেমিকের ক্যাসক্যাডিং এফেক্টে বিশ্বে অনুরূপ আর্থিক মন্দার প্রেক্ষাপটে ভারত চলেছে ঠিক উল্টো পথে। রেল কিম্বা কয়লা, শিক্ষা কিম্বা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র -আত্ম-নির্ভরতার মুখোশে প্রতিদিন ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বিক্রি হচ্ছে দেশ। কিষানদের পেটে লাথি মেরে আঁকা হচ্ছে আম্বানি-আদানিদের পকেট ভরানোর নীল নকশা। 
তাই কর্পোরেটদের মালাই চেটে চর্বি জমানো এই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই হবে রাস্তায়। যে লড়াইয়ে হিসেব হবে ফসলের দামের। পেটের খিদের। বেকারের কাজের। যে লড়াইয়ে হিন্দুর শিরা ভেসে যাবে মুসলিম রক্তে। ব্রাহ্মণ মেয়ের হাত ধরবে দলিত ছেলে। যে লড়াইয়ে 'মহুল ফুটবে শৌখিনতার গোলাপ কুঞ্জে/সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে'। 
আপনি বরং ঠিক করুন সেই লড়াইয়ে আপনি কোন পক্ষে। সরকারের পক্ষ, না মানুষের পক্ষ। পক্ষ দুটো। চয়েস একটাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন