বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

'মহিষাসুরমর্দিনী’ ~ কেয়া মুখোপাধ্যায়

১৯২৭ সাল। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে বোম্বের এক বেসরকারি সংস্থা ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসের একটি ভাড়া বাড়িতে চালু করল রেডিয়ো স্টেশন। অধিকর্তা স্টেপলটন সাহেব। ভারতীয় অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন ক্ল্যারিনেট বাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার আর প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল। সে সময়ে হাতে-গোনা কিছু অভিজাত পরিবারেরই শুধু শোভা পেত রেডিয়ো। 

১৯৩০-এর ১লা এপ্রিল সরকারী পরিচালনাধীনে এর নতুন নামকরণ হল 'ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস'। পরে ১৯৩৬-এ এই রেডিয়ো স্টেশনের নাম হয় 'অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো', আরও পরে, ১৯৫৭ সালে 'আকাশবাণী।'

১৯২৮ সালে রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে রেডিয়ো স্টেশনে চাকরি নিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস আর সংস্কৃতে 'কাব্যসরস্বতী' উপাধি পাওয়া বৈদ্যনাথ রেডিয়োতে যোগ দিয়ে নতুন নাম নিলেন 'বাণীকুমার'। বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভা তাঁর। 

ওই সময়েই রেডিয়ো থেকে একটা নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ওরফে 'বুড়োদা' এলেন সে মুখপত্র সম্পাদনার জন্যে। ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করল রেডিয়োর নিজস্ব পত্রিকা 'বেতার জগৎ'।

রেডিয়োর অনুষ্ঠানকে আরোও সৃজনশীল, আরোও জনগ্রাহী করার জন্য প্রায়ই আলাপ-আলোচনা হত। সেরকমই এক আলোচনায় একবার বুড়োদা মত প্রকাশ করলেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। বললেন:
"এই তো বাণী রয়েছে- সংস্কৃতের তো আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে। ও-ই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক, রাই (রাইচাঁদ বড়াল) সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক। ভোরবেলায় লাগিয়ে দাও, লোকের লাগবে ভালো৷"

কথাটা বেশ মনে ধরল নৃপেন মজুমদারের৷ বাণীকুমারও ভাবতে লাগলেন৷ এসব যখন কথা হচ্ছে, তখন দুর্গাপুজোর আর একমাস দেরি৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রস্তাব দিলেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে৷ সকলেই সমর্থন জানালেন৷ কিন্তু একটু দ্বিধার ছোঁয়াও ছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো কায়স্থ৷ তিনি চণ্ডীপাঠ করলে, শ্রোতারা সকলে মেনে নেবেন তো? নৃপেনবাবু বললেন:
"প্রোগ্রাম করবে, তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান- খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী সবাই তো বাজাবে। তাহলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়৷ তা ছাড়া আমরা একটা বিরাট উত্সবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই প্রোগ্রাম করব। এতে কার কী বলার আছে?..."
বাণীকুমার তখন হেসে উঠে বলেছিলেন, যাই হোক না কেন, বীরেনবাবু ছাড়া আর কাউকে তিনি এ কাজের জন্যে ভাবতেই পারেন না৷

এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার আগে, ১৯৩২ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের চৈত্রমাসে 'বসন্তেশ্বরী' নামে একটি গীতিআলেখ্য সম্প্রচার করে কলকাতা বেতার৷ বসন্তেশ্বরী আলেখ্য দিয়ে সূচনার পর, সে বছরই ষষ্ঠীর দিন ভোরে বাণীকুমারের লেখা আর একটি গীতি-আলেখ্য সম্প্রচারিত হল। বিষয়- মহিষাসুর বধ। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল 'শারদীয় বন্দনা'। 'শারদীয় বন্দনা'-র ভাষ্যকে পরিমার্জনা করেই সৃষ্টি হল কালজয়ী সঙ্গীতালেখ্য, 'মহিষাসুরমর্দিনী'।

বাণীকুমার লিখছেন:
"...বন্ধুবর সঙ্গীতপণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালীর সুর-সর্জনে রাগ বসন্ত এবং দেশী, দেবগিরি, বরাটী, তোড়ী, ললিতা ও হিন্দোলী- এই ছয় রাগিনী বাণী সংযোগে এক অপূর্ব রসের সঞ্চার হয়৷ অন্যান্য গানের সুর দেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, কয়েকটি নাট্য- কথাসূত্র ও গীতাংশ গ্রহণ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং আমি শ্রীশ্রীচণ্ডীর কতিপয় শ্লোক আবৃত্তি করি৷ বন্ধুবর রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত-পরিচালনায় ও আমার প্রবর্তনায় অনুষ্ঠানটি রসোত্তীর্ণ হয়৷ এই অনুষ্ঠানটিই 'মহিষাসুরমর্দিনী' পরিকল্পনার উত্স৷ 

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কলমেও 'মহিষাসুরমর্দিনী'র সেই প্রথম  প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা বড় আকর্ষক:
''পঙ্কজ সুর তুলে ও সুরারোপ করে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে গান তোলাতে লাগলেন। রাইচাঁদও এক বিরাট অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সেকালের সবচেয়ে বড় বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।''
১৯৩৪-এর ৮ই অক্টোবর প্রথমবার মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হল অনুষ্ঠানটি।
যেটুকু জানা যায়, প্রথম প্রচারের পর 'শারদীয় বন্দনা' খুবই ভালো লেগেছিল শ্রোতাদের। 
প্রথমদিকে কয়েক বছর পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল৷ অধিকাংশ গানের সুরই পঙ্কজ কুমার মল্লিকের। পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী সুর দিয়েছিলেন 'অখিল বিমানে তব জয়গানে' আর 'বিমানে বিমানে আলোকের গানে' গান দু'টিতে। 'শান্তি দিলে ভরি দুখরজনী গেল তিমির হরি'-র সুর উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ-র।  'নিখিল আজি সকল ভোলে' গানে সুর দিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়ালের। তবে এই গানটি পরে বাদ যায়৷

প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পীদের এক চমৎকার সমাবেশ ঘটেছিল 'মহিষাসুরমর্দিনী'-তে৷ আদিযুগে বাজাতেন মুন্সী (সারেঙ্গি), আলী (চেলো), খুশী মহম্মদ (হারমোনিয়াম), অবনী মুখোপাধ্যায় ও তারকনাথ দে (বেহালা), সুরেন পাল (ম্যান্ডোলিন), সুজিত নাথ (গিটার), দক্ষিণামোহন ঠাকুর (এসরাজ), শান্তি ঘোষ (ডবল বাস্), রাইচাঁদ বড়াল (পিয়ানো ও অর্গ্যান) ইত্যাদি আরও কয়েকজন৷ পরে বংশীবাদক গৌর গোস্বামী, হিমাংশু বিশ্বাস, শৈলেন দাস, অনিল দাস ও আরো অনেক যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয় ঘটল সেই অনুষ্ঠানে। এক সময় সঙ্গীত-আয়োজনের মূল কাজ শুরু হয় সুরেন্দ্রলাল দাসের পরিচালিত 'যন্ত্রীসঙ্ঘ'-র মাধ্যমে৷ পরবর্তীকালে, এই কাজের মূল দায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেছেন ভি. বালসারা৷

'মহিষাসুরমর্দিনী'-র প্রাণ তিনজন মানুষ - এই আশ্চর্য সৃজনের তিনটি স্তম্ভ। রচনা ও প্রবর্তনা- বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন- পঙ্কজ কুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।  

ছোটবেলায় শরতের ঝকঝকে নীল আকাশটা দেখলেই মনের মধ্যেও একদল মেঘ খুশিতে আমাদেরই মতো হুটোপাটি করে উঠত। তখনই একদিন ভোরবেলা বেজে উঠত এক অপার্থিব আলোর বেণু। মন্দ্রকন্ঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উচ্চারণে যেন কৈলাস থেকে আশ্চর্য নীলকন্ঠ পাখিটি উড়ে আসত শারদপ্রাতে। আসতেন মা দুগগা।

আজ যখন শরতের পাল্টে যাওয়া রোদ্দুরের রং জানান দেয় মহিষাসুরমর্দিনী আসছেন, এক অজানা মনখারাপ ছেয়ে ফেলে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, চার পাশে প্রিয় মানুষ যত আছে, তার চেয়ে বড় কম নয়, যারা আর আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই। আজ শরতে আমার মহালয়া মানেই এক রকমের মনখারাপের অতীতে ফেরা।

শরৎ এলে হারিয়ে যাওয়া সবাই নাকি ফিরে আসে। শরতের রোদ্দুর হয়ে, শরতের আলোর রথে চড়ে। এই ফিরে আসাটাই বোধহয় মহালয়া। এ মহালয়ায় কোনও আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। গঙ্গা আর পুরুতমশাই থাকে না। শুধু শরতের আকাশ-বাতাসে ভেসে থাকা অদৃশ্য অতীতের ছোট ছোট কণাই অমোঘ মন্ত্র হয়ে ওঠে। তাতে মিশে থাকে কিছু সুর, কিছু ছন্দ, উচ্চারণ, অনুভব। 
বড় অনিবার্যভাবে থাকেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।  বাণীকুমার। পঙ্কজ কুমার মল্লিক।

ঋণ:  
'মহিষাসুরমর্দিনী': বাণীকুমার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন