শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪

ইস্কুল, মিড ডে মিল ও তাঁর নিজস্ব অনুভব ~ সীমান্ত গুহঠাকুরতা

 

"মাস দুয়েক হল এক চরম অভাবের সংসারের কর্তা সেজে বসেছি। এ এক অদ্ভুত 'নেই-রাজ্য'। স্কুল-বাড়ি ভেঙে পড়ছে -- রক্ষণাবেক্ষণের পয়সা নেই, শিক্ষক নিয়োগ হয় না -- আংশিক সময়ের শিক্ষকের বেতন দেবার সামর্থ্য নেই,  বাচ্চারা প্রচন্ড গরমে কষ্ট পাচ্ছে -- পর্যাপ্ত পাখা কেনার ফান্ড নেই, স্কুল চত্বরে রাত্রে বহিরাগত সমাজবিরোধী ঢুকছে – নিরাপত্তা রক্ষী রাখার অনুমতি-অধিকার কোনোটাই নেই। বাচ্চাগুলো ক্ষিধেয় মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ায় -- তাদের পাতে একটু সুখাদ্য তুলে দেবার ক্ষমতাও নেই। মাথাপিছু বরাদ্দ যা, তা দিয়ে ওই ডাল-ভাত-আলু কুমড়ো অথবা আলু-সয়াবিনের 'থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোর' চালিয়ে যেতে হয় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। 

কিন্তু ভালোবাসা? সেটুকু কি আছে আমাদের? শাস্ত্রে বলেছে 'শ্রদ্ধায়া দেয়ম্‌', অর্থাৎ যাকে যেটুকু দেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবে। শ্রদ্ধা তো অনেক বড় ব্যাপার, বাচ্চাগুলোর পাতে দুপুরের অন্নটুকু তুলে দেবার সময় সামান্য দরদ বা ভালোবাসাটুকুও কি আমাদের থাকে? আমরা, পেটমোটা মধ্যবিত্তের দল আজও তো মিড-ডে মিলটাকে নিছক দয়া হিসেবেই দেখি, ভাবি রাষ্ট্রীয় খয়রাতি। আর আমার মত যারা ব্যবস্থাটার সঙ্গে জড়িত তারা তো এটাকে পড়াশুনার সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা উটকো ঝামেলা হিসেবেই গণ্য করি। তাই গ্রামের সেলফ-হেলফ গ্রুপের মহিলারা রান্না করেন, বাচ্চাগুলো থালা হাতে গিয়ে দাঁড়ায়, ভচাৎ করে এক থাবা ভাত আর এক হাতা ডাল এসে পড়ে, সেই থালা নিয়ে গিয়ে ওরা কোনো কোনায় গিয়ে বসে গপগপ করে গেলে। কেউ কোনোদিন ওদের ডেকে জিজ্ঞেসও করে না, 'কীরে, পেট ভরেছে?' কিংবা 'আরে একটু ভাত বা তরকারি নিবি?' কেউ ভুলেও জানতে চায় না, 'আজকের রান্নাটা কেমন হয়েছে রে?' 

মাঝে মাঝে পরিদর্শকরাও আসেন। তিনি রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর বা খাবার ঘর – কোথাও উঁকিটিও মারেন না। এসেই অফিসঘরে খাতা-পত্তর নিয়ে বসে যান, অর্থাৎ কাগজ-পত্রে হিসেব-নিকেশ ঠিক থাকলেই তিনি খুশি। সেই হিসেব উপর-মহলে গেলে উপর-মহলও খুশ্‌। বাচ্চাগুলো খাচ্ছে, নাকি কাগজপত্র খাচ্ছে – বোঝা দায়!! প্রতিবার পরিদর্শনের শেষে তিনি যখন প্রসন্ন চিত্তে গাড়িতে উঠে বসেন, তোতাকাহিনীর সেই নিন্দুকের মত তাঁকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, 'মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?' 

ছোটবেলায় দেখেছি চূড়ান্তের অভাবের সংসারে মা কচু-ঘেঁচু কত কিছু রাঁধত। কিন্তু যা-ই রাঁধুক না কেন, খাবার সময় তা থালায় করে তা সাজিয়ে দিত পরম যত্নে। মায়ের সেই ভালবাসাটুকুই তো অর্ধেক পেট ভরিয়ে দিত। আমি তাই জানি, পাতে কী তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল সেই খাবারের সঙ্গে মিশে থাকা দরদটুকু, যত্নটুকু, ভালোবাসাটুকু। 

আজ সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। আবহাওয়া মনোরম। হুকুম দিয়েছিলাম, আজ তবে খিচুড়ি হোক। সঙ্গে ভাজাভুজি কিছু হবে না? ডোন্ট পরোয়া। খিচুড়িতেই পড়ল আলু, টমেটো আর ডিম ভুজিয়া। লোভ সামলাতে না পেরে থালা হাতে দাঁড়িয়ে গেলাম ওদের সঙ্গেই এক লাইনে। আনন্দে হইহই করে উঠল ভৈরব বাহিনী। তারপর ওদের সঙ্গেই বসে সুড়ুৎ-সুড়ুৎ করে গরম-গরম খিচুড়ি আর অঢেল গল্প। একজন বলল, 'স্যর, আজ কিন্তু খিচুড়িটা হেব্বি হয়েছে'। বললাম, 'যা, আরেকটু নিয়ে আয়'। একগাল হেসে ছেলে দৌড় মারল থালা হাতে। আরেকজন খেলার টানে অর্ধেক খেয়ে উঠে যাচ্ছিল, বাকিরা ধমক দিল, 'অ্যাই, স্যর বলেছে না, ভাত নষ্ট করতে নেই'। সে বেচারি কাচুমাচু মুখে আবার খাবারে মন দিল। 

'দেশে-বিদেশে'-তে মুজতবা আলি পাঠানদের মেহমান-নওয়াজীর বর্ণনা দিতে গিয়ে দিয়ে একটি বাক্যে লিখেছেন, 'দোস্ত/তুমহারে রোটি, হামারে গোস্ত', অর্থাৎ 'তুমি যে আমার বন্ধু এই আমার পরম সৌভাগ্য, শুধু শুকনো রুটি আছে? কুছ পরোয়া নেই, আমি আমার মাংস কেটে দেব'।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন