ভেনেজুয়েলা ,২০০২ । প্রেসিডেন্ট বামপন্থী উগো চ্যাভেজ । একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বড়লোকের কোমর ভাঙ্গছেন - শক্তিশালী হচ্ছে ভেনেজুয়েলার প্রান্তিক দরিদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ । জমিদারদের হাত থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে আদিবাসী মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন , একের পর এক জাতীয়করণ করছেন দেশের সমস্ত তৈলখনি । আমেরিকান তেলের কোম্পানির মালিকদের আর তাদের দেশীয় দালালদের তো মাথায় হাত । এতোদিন ধরে ভেনেজুয়ালার প্রাকৃতিক সম্পদ(তেল) লুঠ করত আমেরিকান বেনিয়ারা । আর এই কাজে তাদের সহায়তা করত ভেনেজুয়ালার ধনিক শ্রেণীর দালালরা । চ্যাভেজের উত্থান অতএব আটকাতেই হবে । যে করে হোক সরাতে হবে ফিদেলের শিষ্য ,উগো চ্যাভেজকে । অতএব তারা ফন্দি আটলেন । তারা মানে কারা ? কারা কারা ফন্দি আটলেন ? ভেনেজুয়েলার ধনিক শ্রেণী , আমেরিকার সরকার,তাদের ভেনেজুয়েলার দালাল, ভেনেজুয়ালার সামরিক বাহিনীর এক অংশের সাথে হাত মেলালো ভেনেজুয়ালার বাজারি প্রচার মাধ্যম । সামরিক বাহিনী যখন চ্যাভেজকে বন্দি করছে , যখন তার পদত্যাগের মিথ্যা খবর রটাচ্ছে ধনিক শ্রেণী ঠিক তখন ভেনেজুয়ালার বাড়িতে বাড়িতে প্রতিটি টি.ভি-তে প্রতিটি চ্যানেলে মেগা সিরিয়াল বা চটূল নাচের প্রোগ্রাম দেখানো হচ্ছিল । প্ল্যান ছিল নিঃশব্দে চ্যাভেজ-কে সরিয়ে দেওয়ার । কিন্তু সেনাবাহিনীর নীচের তলার লোকজন বেঁকে বসলো । তারাই খবর পৌছালো শ্রমিক মহল্লায় ,কৃষক পাড়ায় । লক্ষ মানুষের মিছিল ৪৭ ঘন্টা বাদে উদ্ধার করলো তাদের প্রেসিডেন্টকে । তারপর থেকে মৃত্যুর আগে অব্দি চ্যাভেজ অপরাজিত ছিলেন । এই পুরো ঘটনা নিয়ে , ২০০৩ সালে একটি সিনেমা তৈরি হয় - The revolution will not be Televised .
হঠাত সিনেমাটার কথা মনে পড়ার কারণ , কিছুক্ষন আগে মেসেঞ্জারে পাওয়া একটি ভিডিও । এটা ভারত ,২০১৭ । ২০০৯এর ইউ পি এ (দুই) সরকার যে শ্রমিক-কৃষক বিরোধী নীতির এরোপ্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড় করিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন , ২০১৪র বি জে পি সরকার গত তিন বছরে সেই প্লেনকে আকাশে তুলে নিয়ে , সুপার সনিক গতিতে এগিয়ে চলেছেন । এদের গন্তব্যের নাম বিকাশ(বা ডেভেলপমেন্ট) যা আদতে এই দেশের শ্রমিক এবং কৃষকের ডেথ্ সেন্টেন্স । ১০০ দিনের কাজের মজুরি না পাওয়া মজুর বলুন বা অঙ্গনওয়ারীর কাজ করা শ্রমিক - ক্রমশ বেড়ে যাওয়া জিনিসপত্রের দামের কাছে , নিজেদের ছোট্ট মায়না নিয়ে তারা প্রত্যেকে অসহায় । অনেক আলাপ আলোচনার পর তাদের মূল দাবীগুলোকে এক জায়গায় করে এই সাতদিন আগে তারা দিল্লী গিয়েছিল । ভাবুন , সারা দেশ থেকে তিনদিন পর পর লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পার্লামেন্টের সামনে ধর্নায় বসে আছেন । তাদের দাবী ,যে কোন সভ্য দেশের মৌলিক দাবীগুলির মতোই - চারজনের সংসার চালানোর জন্য মাসে ন্যুনতম ১৮,০০০ টাকা মজুরী , এক ধরনের কাজে একই বেতন ,ঠিকা শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি । তা এর ঠিক এক সপ্তাহ সারা ভারতের লাখ লাখ কিষানের জমায়েত হচ্ছে এখন দিল্লীতে । তারা পার্লামেন্টের সামনে কৃষক সংসদ বসিয়েছেন । কেন ? আমরা সকলেই জানি , কৃষি কাজের মূল চালিকা শক্তি সরকারি ভর্তুকি । বাজারে যে ফসল কিনতে আপনার হাত পুড়ে যায় , বস্তা বস্তা সেই ফসল বেঁচেও কৃষকের এক পকেট টাকা হয় বলতে পারেন । মাঝে টাকা মেরে যায় ফড়ে - যাদের সাথে সরকারের সাঁট থাকে । তা ক্রমবর্ধমান কৃষক আত্মহত্যার কারণে আগের সরকার স্বামিনাথন কমিশন গঠিত করেন । কমিশন রিপোর্ট দেয় যে , কৃষকদের বাঁচাতে হলে তাদের ফসল দেড়গুন সহায়ক মূল্য দিয়ে সরকারকে কিনতে হবে । কিন্তু সে রিপোর্ট সার- সহায়ক মূল্যে কোন ফের বদল ঘটে না । কৃষকদের ব্যঙ্কে অনাদায়ী ঋণের পরিমান দেড়শো কোটি মতো । আম্বানি-আদানি-মালিয়া-টাটা-বিড়লার অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ প্রায় দেড়লক্ষ কোটি টাকা । বড়লোকদের দালাল সরকার বড়লোকের সব ঋণ মাফ করে দিলেও ছোট লোকের ভাগ্যে সে শিকে ছেড়েনি । অতএব কৃষক মারা গিয়েছেন হাজারে হাজারে - মধ্যপ্রদেশ,মহারাষ্ট্র, রাজস্থান,গুজ্রাট,তামিলনাডু,বাংলা ইত্যাদি সর্বত্র । এর বিরুদ্ধে সারা দেশের কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে - এখন ঢেউ আছড়ে পড়ছে সংসদের গেটে । কিন্তু এর কিছুই আপনি জানেন না । আপনি জানেন না কারণ একটিও সংবাদপত্র একটিও খবরের চ্যানেল এই খবর দেখাচ্ছে না । আপনি দেখছেন পদ্মিনীর নাক-কান-মাথা কাটার মেগা সিরিয়াল ।
এই মুহূর্তে আপনি রাজস্থানের ইতিহাস ঘাটছেন , কয়েকটা ছাগল টি ভি র সামনে খোলা তলোয়ার নিয়ে লাফাচ্ছে - আপনি গিলছেন , পদ্মিনী ইতিহাস না কল্পনা তর্ক করছেন , শিল্পের উপর এরকম খবরদারি একেবারে উচিৎ নয় বলে বক্তব্য রাখছেন ,টুইট্ করছেন । এগুলো প্রয়োজনীয় নয় , এমনটা নয় । কিন্তু ভারতবর্ষের খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাসে , পদ্মিনীর কোন জায়গা নাই । মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ,এই সিনেমাটির কোন অবদান থাকবে বলেও মনে হয় না । একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে দেখবেন , এর পুরোটাই স্ক্রিপ্টেড্ । ভারতের শাসক শ্রেণীর হাঁটু কাপিয়ে দিয়েছে মারুতির শ্রমিক , শীকরের-মান্দোসারের-বিদর্ভের কৃষক । অতএব তারা আপনাকে বিদ্রোহের ছবি দেখাবে না । বাজার আপনাকে তার মৃত্যুঘণ্টার শব্দ শুনতে দেবে না । আর ঠিক তাই - "The revolution Will not be Televised"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন