বৃদ্ধ কর্ণেল এবং তাঁর হাঁপানিতে ভোগা স্ত্রী-এর কাছে কোনও টাকাপয়সা ছিল না। তাঁদের একমাত্র ছেলেকে নিষিদ্ধ পত্রিকা বিলি করবার অভিযোগে গুলি করে মারা হয়। কর্ণেলের কাছে ছিল একটা লড়ুয়ে মোরগ, যেটা আগামী শীতে মোরগ লড়াইতে নামবে বলে গোটা শহর তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা বাজী রেখেছে। কর্ণেল এবং তাঁর স্ত্রী নিজেরা না খেয়ে মোরগটাকে খাওয়াতেন । আর সহস্র দিনের যুদ্ধে অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়বার জন্য সরকার যে পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কর্ণেল গত পনেরো বছর ধরে সেই চিঠির অপেক্ষায় বসে ছিলেন। প্রতি শুক্রবার নতুন মেল আসবার দিন পোস্ট অফিসে হানা দিতেন তিনি, এবং প্রতি সপ্তাহেই পোস্টম্যান ব্যতিক্রমহীন উচ্চারণ করে যেত, 'কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না'।
চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও কর্ণেল তাঁর মোরগটাকে বিক্রি করেন নি। কারণ ওটা একদিন লড়াইতে জিতবে, জিতবেই। আর সেই লড়াইয়ের দিন আসার আগে নিজেদের খাবার জুটবে কীভাবে? কেন? সেই চিঠিটা যে আসবে? সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু? যেটার জন্য পুত্রহীন কর্ণেল সমস্ত অসম্মানকে সহ্য করে যাচ্ছেন! আর চিঠি যদি না আসে? তাহলে না খেয়ে থাকবেন, তবু মোরগটাকে লড়াইতে জেতাবেনই !
বিধাননগরের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন দাস। তাঁর উনিশ বছরের মেয়ে রিয়া চলে গিয়েছে ডেঙ্গুতে ভুগে। এবং মেয়ের মৃত্যুর পরে চিত্তরঞ্জন দাস দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই করে গিয়েছেন। একটা ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য, যেটাতে লেখা থাকবে মৃত্যুর কারণ আসলে ডেঙ্গু। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসক, সম্ভবত সরকারী অদৃশ্য নির্দেশনামা মেনেই, ডেঙ্গু লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। সন্তানহারা চিত্তরঞ্জন সারাদিন হাসপাতালে পড়ে থেকেছেন। ছোটাছুটি করেছেন থানাতেও। শুধুমাত্র যেন ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু লেখা হয় এটুকুই দাবী ছিল তাঁর । কেন এরকম দাবী ? এতে করে তো আর রিয়া ফিরে আসবে না ! কারণ, চিত্তরঞ্জনের ভাষায়, "লিখিতভাবে ডেঙ্গু থাকলে সেটা নিয়ে স্থানীয় পুর-প্রশাসনকে সতর্ক করা সম্ভব, যাতে অন্য অনেকের এই রোগ না হতে পারে"।
একটা মারণ রোগ সরকারী সহায়তায় যখন শহরের ওপর থাবা বিস্তার করছে, তখন এই ব্যক্তিগত প্রতিরোধগুলোর গল্পও আর্কাইভড থাকুক। এই পৃথিবীর কোনও এক গুপ্ত পোস্ট অফিসে কর্ণেলের চিঠিটি সযত্নে রক্ষিত আছে, এবং এই পৃথিবীর এমন কোনও তৃণমূল সরকার নেই যা চিত্তরঞ্জন দাসের প্রতিজ্ঞার সামনে অটল থাকবার ধক দেখাবে--এই বিশ্বাসটুকু না থাকলে এই লেখাটার কোনও অর্থই থাকত না। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের , মামাটি উৎসবের , টলিউড চিত্রতারকাদের নিয়ে নাচগানের উৎসবের অথবা বিশ্বকাপ ফুটবলের শহরজোড়া পোস্টারে সহাস্য নেত্রীর মুখের কদাকার ছবিটিকে ম্লান করে দিয়ে আশ্চর্য্যভাবে একদিন উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এই ব্যক্তিগত প্রতিরোধগুলির গল্প, ডাক্তার অরুণাচল দত্তচৌধুরীদের কাহিনী, যেগুলো একদিন না একদিন সমষ্টিতে মিলবেই , এবং মোরগটা শেষ লড়াইতে জিতে যাবে তখন -- এই বিশ্বাসটুকুকে কি বলা যেতে পারে? ডেঙ্গুর দিনগুলিতে প্রেম?
কর্নেল চিত্তরঞ্জন দাস , মার্কেজের ভাষাতেই, 'is the orphan of his child'। এই অনাথ পিতার প্রতিজ্ঞাকে এক সামান্য কলমের পক্ষ থেকে সহস্র তোপধ্বনি।
(সূত্র ঃ এবেলা, ১৪/১১/২০১৭)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন