বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

যাযাবর, তার দৃষ্টিপাত আর আমি .... ~ তমাল রাহা


প্রথম পর্ব:

আজও মুখস্ত কথাগুলি, হয়ত আরও অনেক বাঙালী ছেলের মতো, ........:প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।

ভাবা যায়? ...........

বয়সটা তখন ১৬-১৭, বইটা পড়তে পড়তে আমি নিজেকে যে কখন চারুদত্ত ভাবতে শুরু করেছিলাম, নিজেই জানি না! আসলে তখন বয়সটাই ছিল ঐরকম। সুন্দরী দেখলে মনের কোণে কথায় কথায় হেমান্তবাবুর গান বেজে ওঠে " আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি।"

আর বারবার পরা "দৃষ্টিপাত" এর সেই লাইনগুলো ........ যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিষ্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন।

পড়তাম, আর ভাবতাম প্রেম টা বোধহয় ছেলেদের জিন-এ আছে। তাই প্রেম পেতেই হবে ... যেনতেন প্রকারেণ।

জানি না বাকিরা একমত হবেন কিনা, তবে এই বইটা ছিল qoute -এর খনি। আমার নিজের সৌভাগ্য হয় নি সেভাবে এর সুযোগ নেওয়ার। তবে পরোক্ষ ভাবে কিছুটা হলেও কাজে লেগেছিল। একটু গুছিয়ে লিখতে পারতাম বলে বন্ধুদের অনেকের প্রেমপত্র লেখার ভার ছিল আমার ওপরে। সেখানে চুটিয়ে quote করেছি এই বইটা থেকে। উফফ, সে কি লেখা! আমার বন্ধুরা তো মুগ্ধ হতই, ওদের বান্ধবীরাও নিশ্চয় হতেন!

বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়  (যাযাবর), তার এই উপন্যাসের জন্যে এক অসাধারণ আঙ্গিক বেছেছিলেন। বিলেত ফেরত এক বাঙালী যুবক আসেন দিল্লি তে, ক্রিপস মিশন সম্পর্কে লেখার জন্য। কাজের ফাঁকে সে তার বান্ধবী-কে যে চিঠি লিখত তারই সংকলন এই উপন্যাসের আঙ্গিক। যুবক-এর নাম জানা যায় না। সবাই 'মিনি সাহেব' বলেই ডাকত। কি অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা দিল্লি শহরের! আমি দিল্লি অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু শহরের অনেক কিছুই চেনা মনে হযেছিল 'মিনি সাহেব' এর দিল্লি-র বর্ণনা পড়ে। কিন্তু, এই লেখার বিষয় 'মিনি সাহেব' এর দিল্লির বর্ণনা নয়। কাজের সুত্রে মিনি সাহেব এর আলাপ হয় এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ-এর, নাম চারুদত্ত অধারকার। আমার লেখার উপজীব্য আজ সেই চারুদত্ত অধারকার এর সাথে এক বিবাহিতা বাঙালী রমনীর 'ভালবাসা', কাছে আসা, আবার দূরে সরে যাওয়া। হ্যা, সুনন্দা বানার্জি-র কথাই বলছি, যার প্রেম চারুদত্ত অধারকার-এর জীবনকে দিয়েছিল ঐশ্বর্য্য আর প্রবঞ্চনা দিয়েছিল 'দাহ।

মারাঠি যুবক চারুদত্ত আধারকারের সঙ্গে এক বিবাহিতা বাঙালিনী সুনন্দার প্রেমকাহিনী। সুনন্দাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে আধারকার বাঙলা শিখলেন, পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। সুনন্দাও অকুণ্ঠ চিত্তে আধারকারকে দিলেন তাঁর হৃদয়। আর মিনি সাহেব লিখলেন …..উভয়ের উদ্বেলহৃদয়ের গভীর ভাবাবেগ সমাজ-সংসারের সমস্ত ক্ষুদ্রতা ও কলঙ্কের উর্ধে দেবমন্দিরের পবিত্র হোমাগ্নির মত যেন জ্বলতে লাগল।

বিজ্ঞানের চোখে ভালোবাসা- "পেরেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট" "সারভাইভাল স্ট্রাটেজি" "ইনস্টীঙ্কট".... সাহিত্যের চোখে তা- "দিবস রজনী বেদনা"..... ধর্মের চোখে- "ব্যভিচ্যার".... আধ্যাত্মবাদিদের চোখে- "সাধনা"।
ফলে, যা হওয়ার তাই হলো। নিভে গেল সেই আগুনের শিখা। কেন? হ'তে পারে সুনন্দার  মোহমুক্তি …. কিম্বা কলঙ্কের দায়।মিনি সাহেব কি লিখছেন এরপর বান্ধবীকে তাঁর চিঠিতে?.... সে (সুনন্দা) নারী। প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে.....তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন

সুনন্দা-কে ভালো লাগত। যদিও কখনই সে  "কালবেলা"-র অনিমেষের মাধবীলতা নয়। তবে ভালো লাগাটা কিন্তু নির্মল। আর, চারুদত্ত তো বাঙালী প্রেমিক-দের রোল মডেল! আসলে চারুদত্ত নাম-টাও বোধহয় এই উপন্যাসের একটা strategic choice ছিল।

স্বভাববসত-ই মিনিসাহেব, স্পষ্টতই পক্ষপাতদুষ্ট।  আর যাযাবর-এ লেখক প্রেম-এ প্রত্যাখ্যাত চারুদত্ত কে দিয়ে বলালেন ... , (আমি) পরিহাসকে মনে করেছি প্রেম; খেলাকে ভেবেছি সত্য। কিন্তু আমি তো একা নই। জগতে আমার মতো মুর্খরাই তো জীবনকে করেছ বিচিত্র; সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত। .....তাদের , ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গান, শিল্পী অঙ্কন করেছেন চিত্র, ভাস্কর পাষাণখণ্ডে উত্কীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা

হয়ত চারুদত্ত ওই কথাগুলোর মধ্যে খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন সুনন্দা কে হারানোর সান্তনা। হয়ত বা তা ছিল 'মিনি সাহেব' এর চারুদত্ত-র ওপরে অন্ধ ভালবাসার আর মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। বাঙালী কিন্তু চারুদত্ত অধারকার-কে নায়কের সম্মানই দিয়েছে। এযাবৎ অনেক বন্ধু বা পরিচিতকে দেখেছি "চারুদত্ত অধারকার" হতে, বিবাহিত বা অবিবাহিত মহিলার প্রেম-এ পরে। চারুদত্ত অধারকার তো তখন আমারও নায়ক। ভাবতুম, আহা আমি যদি চারুদত্ত-র মত গুছিয়ে বলতে পারতাম! নিদেন পক্ষে 'মিনি সাহেব' এর মত। এত প্রতিভাবান ব্যক্তি কেন তার ভালবাসা-কে পেলেন না, যত ভেবেছি ততই অবাক হযেছি। চারুদত্ত তো তখন সেই ট্রাজিক হিরো! গভীর অভিমান সুনন্দ দেবীর প্রতি ......... আর মনের মধ্যে ওই কথাটাই বারবার ঘুরেফিরে আসত ...

..........:প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কি? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।

কোনো কথা হবে না …..

আরেক চারুদত্ত-কে মনে পরে?
শূদ্রক রাজার রচিত 'মৃচ্ছকটিক' নাটকে  দেখা যায় চারুদত্ত নামে একজন সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শিক্ষিত ব্যাক্তি বসন্তসেনা নামে এক বারাঙ্গনার জন্যে শূলে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করতে গিয়েছিলেন। যাযাবর-এর চারুদত্ত শূলে চড়ে মৃত্যুবরণ না করলেও দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ  হয়ে হয়ে মরেছিলেন।

বাঙালী প্রেম-এ পরলেও খোজে রবীন্দ্রনাথ কে, আবার বিরহেও …..  আমার চারুদত্ত-এর কথা পড়তে গিয়ে তখন মনে হত সেই লাইন গুলি ….

…........ ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,   গগনে গগনে ডাকে দেয়া।
কবে নবঘন-বরিষনে গোপনে গোপনে এলি কেয়া ॥
পুরবে নীরব ইশারাতে   একদা নিদ্রাহীন রাতে
হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া--
আষাঢ়ের খেয়ালের কোন্‌ খেয়া ॥
যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা   কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা।
বুঝি এলি যার অভিসারে   মনে মনে দেখা হল তারে,
আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া--
আপনায় লুকায়ে দেয়া-

আহা, চারুদত্ত-র জন্যে যে কত কষ্ট পেয়েছি ওই বয়সে!

বাংলা সাহিত্য আমার মতে শ্রেষ্ট দেবদাস কে জানেন? চারুদত্ত আধারকর।
মিনি সাহেব কিন্তু খুব সুন্দর ভাবে এই আবেগটা পাঠকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। হ্যা, আমার মধ্যেও। মিনি সাহেব এর মত আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি তখন ... সত্যি হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।
একটা সময় তো মনে হয়েছিল খুঁজে বের করি সুনন্দা বানার্জি কে। একবার জিগ্যেস করি "কেন এমন করলেন বলুন তো চারুদত্ত-র সাথে?"

সময় বদলেছে। এখন বয়সটা পাকা। তাই একটু অন্যভাবে ভাবি আজকাল। সুনন্দা বানার্জি-র নিশ্চয় কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল। মিনি সাহেব যেটা আমাদের বলেন নি।

এখন আবার মনে হয় একবার সুনন্দা বানার্জি-র সাথে দেখা হলে মন্দ হয় না। তবে এবার কোনো প্রশ্ন করব না। শুধু শুনব, মিনি সাহেব শুধু চারুদত্ত-র কথাটাই বলেছিলেন। সুনন্দা দেবীর কথা কিন্তু শোনা হই নি আমাদের কারো! হয়ত ওনার-ও কিছু বলার ছিল, যা আমরা আজো জানতে পারি নি।  কিন্তু চারুদত্ত আধারকারের বঞ্চনার জন্য সুনন্দা কতটা দায়ী সে বিতর্ক এখনো আমার মনে রয়ে গেছে।

দ্বিতীয় পর্ব

লেখাটা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। খাপছাড়া ছিল, কিন্তু কিভাবে শেষ করব জানা ছিল না। কিন্তু প্রথম পর্বটা ঘটনা চক্রে গিয়ে পরলো সুনন্দা বানার্জি-র হাতে। জিগ্যেস করতে হয় নি। সুনন্দা শোনালো তার কথা। আসলে সুনন্দ-র কথাগুলো আমায় বার ভাবাল। তাই ভাবলাম যে সুনন্দার ক´থাটাও লেখা দরকার।

সুনন্দা-ও খুঁজছিলেন কাউকে। কিন্তু সে বোধহয় মিনি সাহেবের "চারুদত্ত" নয়। হতে পারে সে "কালবেলা"-র অনিমেষ। এই সুনন্দা লেখাটা পরে বলল, কে বলেছে  যে  নারী মাত্রেই প্রেম-এ উল্লাস নেই? কে বলেছে যে তার কাছে প্রেম নিতান্তই সাধারণ ঘটনা?বিশ্বাস করি না . হ্যা, তবে এটা সত্যি যে নারী স্বভাবজাত সাবধানী ....

ঠিক এই ভাবে ভেবে দেখি নি। তবে একটা প্রশ্ন এলো মনে, নারী যদি সাবধানী হয় তবে শুরুতেই সে সাবধানী ছিল না কেন? নাকি সেটা ছিল চারুদত্ত বা মিনি সাহেব-এর বোঝার ভুল?

… সুনান্দারা ভাবে বোধহয় যে তাদের প্রেম-এ কেউ পরে না। তাই চারুদত্ত-দের সাথে  মেলামেশার সময় তার মাথায় আসে না যে এটা প্রেম। যখন সে বোঝে তখন তখন সে হয়ে ওঠে সাবধানী। কিন্তু যখন তারা সাবধানী হয়, তখন চারুদত্ত-কে বোঝার ক্ষমতাও থাকে না। না, আমি সুনান্দাদের দায়ী করছি না। this just mere ignorance from her side... অকপট স্বীকারোক্তি সুনন্দার ….

ঠিক তা নয়, আমার অপ্রতিরোধ্য দামাল স্বভাব সব উড়িয়ে দিতে চায়, জানো? বোধহয় কেমন একটা নিজের কাছেই লজ্জা পাই। তাই এসব আমল না  দেবার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে আমার। হয়ত, আমি চাই নি চারুদত্ত কে ! ভালোলাগা আর ভালবাসার ভেদ করে উঠতে পারি নি। এটাই আমার ভুল ….....
অস্বীকার করি না যে নারীসুলভ সাবধানতা থেকে হয়েছিলাম স্খলিত … ওটা একটা  টানাপোড়েন … টানা আর পোড়েন -এর মাঝে কখনো কখনো  সাবধানতা স্খলিত হয়। আমারও হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে উপলব্ধি করেছিলাম এ সম্পর্কের কোনো পরিনতি নেই। মেয়েরা পরিনতি চায়। বোধহয় কেমন নিজের কাছেই লজ্জা পেয়েছিলাম ….......

পরের কথা গুলো  মনে দাগ কেটে গেল … সুনন্দা-র গলায় নির্মলেন্দু গুনের কবিতা-টা বড় অদ্ভূত সুন্দর শোনালো …

"বৃথাই বুকে পুষে বেড়াও গ্লানি
বৃথাই তুমি নিজেকে দাও দণ্ড;
দুই খণ্ডে সমাপ্ত যে-বইখানি
তুমি ছিলে মাত্র তার এক খণ্ড!!

… না গ্লানি নেই আমার কোনো। সেই মুহুর্তে  সেই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত।

এরপরই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে আজকের সুনন্দা, "কালবেলা"-র অনিমেষ কে কোথায় পাই বলো তো? তাহলে সত্যি আমি প্রেম-এ  পরবো এবার।

আজকের সুনন্দা। যে তার ভালোলাগা আর ভালবাসা কে আলাদা করতে জানে।

আজকের সুনন্দা। যে মিনি সাহেব এর লাগিয়ে দেওয়া ছাপ-এর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত জানাতে দ্বিধা বোধ করে না।

আমি ভাবি সুনন্দা-রা কি বদলে গেছে? নাকি ´মিনি সাহেব´-এর বোঝার ভুল! কে জানে? …...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন