জয় বাবা ফেলুনাথ ছবি যখন প্রথম দেখি, তখন কিশোর মনে ফেলুদা আর মগনলাল মেঘরাজের উপস্থিতি বড়ই প্রবল। আর বেশি কিছু চোখে পড়েনি। আমার সেই বয়সে পরিবেশ বেশ দুষিতই ছিলো, মানে বইমেলাটেলা সব কাছেপিঠেই হত, নাগালের মধ্যে। সেরকমই একটা বইমেলা থেকে পেয়েছিলাম সত্যজিত রায়ের লেখা “একেই বলে শ্যুটিং"। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে পড়েছিলাম “ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে”। সেই প্রথম কাশীকে চেনা। তারপরে খুঁজে পেলাম, অপুর সঙ্গেও কাশীর যোগাযোগ রয়েছে। সেই থেকে বেনারসের ওপরে একটা টান জন্মে গিয়েছিলো। তার পরে বিভিন্ন ছবি আর লেখায় বেনারসকে পেয়েছি। “টোয়েন্টি সেভেন ডাউন” বলে একটা ছবিতে বেনারস এসেছিলো একদম শেষে। আর “লাগা চুনরি মে দাগ” ছবিতে একদম শুরুতেই। মোটের ওপর সব মিলিয়ে কাশী বা বেনারস বা বারানসি, যাই বলুন, দেখার বড়ই সখ ছিলো। আমার আবার ভ্রমনের ঝুলিটি বেশ বিদঘুটে। হিমালয়ের বরফ, রাজস্থানের মরুভুমি ( থার মরুভূমি – থর নয়), কচ্ছের রান, দক্ষিনের মন্দির এমনকি ক্যালিফোর্নিয়াও দেখা হয়ে গেছে । কিন্তু দেখিনি বেনারস। পুরি ও প্রথম গেছি বছর আষ্টেক আগে প্রথম বার। শিলং টিলং তো দেখাই হয়নি। মোটের ওপর ভ্রমনের ঝোলাটা বেখাপ্পা আর জোড়াতাপ্পি দেওয়া। আমি ঘুরেছি হয়ত কিছু জায়গায়, কিন্তু কিছু দেখে তার স্থানমাহাত্য অনুভব করার মত স্পর্শকাতর মন আমার নেই। আমি আধ্যাত্মিক নই, ধর্মের টান আমার নেই। আমি লেখক নই, ভ্রমনকারি নই, ফোটোগ্রাফার নই, বার্ধক্যেও আসিনি এখনো। কাজেই বাঙালির বেনারস ভ্রমনের কোনো কারনই আমার নেই। কিন্তু যাঁরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁরা এই পর্যন্ত এসে মুচকি হাসছেন। ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের একটা সাক্ষাতকারে শুনেছিলাম, বিসমিল্লাহ বলছেন “বানারস – যো বনা রস্ সে”। এইবার ঠিক ধরেছেন। রসের খোঁজেই এই অধম ছুটেছিলো কাশী। বেনারস নাকি বিখ্যাত “ষাঁড়,পাঁড় অউর রাঁড়” এর জন্যে। ষাঁড় তো জানি। পাঁড় হলো বাবা বিশ্বনাথের পান্ডা। আর রাঁড় হলো রূপজীবিনি। কিন্তু আমি গিয়েছিলাম কোন রসের খোঁজে? সঙ্গীত বিষয়ে আমার জ্ঞানগম্মি প্রবাদপ্রতিম। একবার চেন্নাইতে অফিসের অনুষ্ঠানে দু কলি বাংলা গান গেয়েছিলাম। দক্ষিনি বন্ধুরা স্থির চোখে তাকিয়েছিলেন, আর আমার এক দেশোয়ালি সহকর্মী চুপি চুপি বলেছিলেন, গানখানি রবী ঠাকুরের হলেও সুরে আর গায়কিতে আমার নিজস্বতা স্পষ্ট। কিন্তু এসব ছাড়া রস নেই, সেকথা কে বলেছে? জিলিপিতে রস নেই? রাবড়ি? আর গরম কচুরি কিম্বা গাজরের হালুয়া? যাক। আপনাকে বেশি বোঝাতে হয়নি। আমার বেনারস যাবার কারন সম্পর্কে আপনি তাহলে পরিস্কার।
বেনারসের ধর্মতলা হলো গোধুলিয়ার মোড়। ধর্মতলা বললে হয়তো ঠিক বোঝানো হয়না। ধর্মতলায় চওড়া রাজপথ আছে, ফাইভ স্টার হোটেল আছে, পাতাল রেল, বাস ডিপো আছে। গোধুলিয়ায় এসব কিছুই নেই। কিন্তু গোধুলিয়ার আছে বিটকেল জট। আছে থিকথিকে ভিড়, সরু রাস্তা, কান ফাটানো চিৎকার, গানের জগঝম্প, ছাই মাখা সাধু, গরম জিলিপি আর কচুরি, ষাঁড়, ঠেলা গাড়ি, শয়ে শয়ে রিক্সা, বাঙালি ট্যুরিস্টের দোকানে ঢুকে বিকট হিন্দিতে দরাদরি, বিদেশী ট্যুরিস্টের দামি ক্যামেরা আর কামানের মত দেখতে লেন্স ঝুলিয়ে হাঁটা, বৌদ্ধ লামাদের হাসি হাসি মঙ্গোলীয় মুখ, দক্ষিনি তীর্থযাত্রিদের হাত আর জামা ধরে লাইন করে হাঁটা, খাস বেনারসি পুরুত পান্ডার পান খাওয়া ঠোঁটে শুদ্ধ হিন্দি, নিশ্চিন্ত আর ঘুমন্ত পুলিস, ঘাড়ে উঠে পড়া মোটর সাইকেল, কখনো গাড়ি, আর আছে এক হাত অন্তর হোটেলের দালাল আর নৌকার মাঝি। আপনাকে ওপারে নিয়ে যাবার জন্য বড়ই ব্যস্ত। তবে সেটা গঙ্গা না বৈতরণী সেটা তর্কসাপেক্ষ। ফুটপাথ বলে একটা কিছু হয়ত হাজার খানেক বছর আগে ছিলো, কিন্তু এখন সেখানে কেবলই দোকান। সেই দোকানের চালা ভেদ করে পেছনের বাড়ি গুলো দেখার চেষ্টা করা বৃথা। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে স্বয়ং সুর্য্যদেব সেখানে ঢুকতে পারেননি, আপনি আমি তো কোন ছার। কিন্তু আধুনিকতা যাবে কোথায়? হাল ফ্যাশনের ঝকঝকে ল্যাপটপ বা ট্যাব, মিউজিক সিস্টেম, ইলেক্ট্রনিক্সের টুকিটাকি সবই পাবেন। সূর্যের আলোর মতো সোজা চলবার বালাই নেই, তাই বিশ্বায়ন ঢোকে চোরা পথে। গোধুলিয়া আসলে একটা চৌমাথার মোড়, গঙ্গার দিকে দু পা এগোলেই বাঁ হাতি বিশ্বনাথের গলি, আর সোজা একটূ এগোলেই দশাশ্বমেধ ঘাট। এই রাস্তা হলো দশাশ্বমেধ রোড। যদিও হাঁটা দুস্কর, তবুও হিউয়েন সাং, ঔরঙ্গজেব, মার্ক টোয়েন, বিভুতিভূষন, ফেলুদা, সবাই হেঁটেছেন এ রাস্তায়। তবে কিনা এ স্থল বাবা বিশ্বনাথের খাস জায়গীর, কাজেই নন্দী-ভৃঙ্গী দের কথা না বলে ছাড়ি কি করে? আজ্ঞে হ্যাঁ, মহাকায় কিছু ষাঁড় ও আছেন। দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরছেন এদিক ওদিক। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লে রাস্তার একদম মাঝখানে আয়েস করে বসে বসে জাবর কাটছেন। আয়েস দেখে মনে হতেই পারে, নন্দী মশায় বোধহয় গুলকন্দ-জর্দা দেওয়া মঘাই পানই মুখে পুরেছেন। তবে কিনা রাস্তায় ইতি-উতি প্রাকৃতিক কর্মও করছেন। এক সায়েব কে দেখলাম কয়েক লাখ টাকা দামের এক খানা বিশাল ক্যামেরা বাগিয়ে গোবরের ছবি তুলতে। কেন বাওয়া? তোমার দেশে কি গরু বা ষাঁড়ের ইয়ে অন্য রকম দেখতে? নাকি তুমি আমাদের গোবরে তাজমহলের কারুকাজ আশা করছো? ও তো আর কমোডে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কম্মটি করতে পারে না, আর এখানে এ হোল ওর খাস জায়গা। অগত্যা রাস্তাতেই। তোমাদের গরুর খোঁয়াড় কনক্রিটের। এখানে তো খোলা রাস্তা, ওখানে তো সায়েব, তোমার গরু, তোমার ঘরের ভেতর কম্মটি করে। সে দিক দিয়ে দেখলে আমাদের এনাদের সিভিক সেন্স বেশি।
দশাশ্বমেধ রোড দিয়ে গাড়ি চলা নিষেধ। সে নিয়ম বেনারসি আম আদমী নিষ্ঠা ভরে মানেন। যদিও এনাদের বেশ কয়েক হাজার বছরের নাগরিক জীবন, তবুও ওই রাস্তায় গাড়ি ঢোকাবার মত হিম্মত, কারোর কলিজায় থাকতে পারেনা। রাস্তায় কি কি আছে, তা আগেই বলেছি। তা, সে তো ভারতের বহু রাস্তায়ই আছে। এখানে নতুন কি? নতুন যেটা, সেটা হলো, এ রাস্তায় পা দিয়ে, সবাই একটু বাবা বিশ্বনাথের ভক্ত হয়ে পড়ে বোধহয়, তাই জাগতিক ব্যাপারে কিঞ্চিত অনিহা এসে যায়। ধীর গতি, কেউ সরেনা, নড়ে না, গপ্প জমায়, ষাঁড়ের মতই অলস ভাবে রোমন্থন করে চলে, স্মৃতির। শুধু ব্যস্ততা কিছুটা থাকে কচুরি-মিঠাইয়ের দোকানির আর নৌকোর মাঝির। আইনষ্টাইন বলেছিলেন, সবই আপেক্ষিক। এখানে সেটা কিছুটা আক্ষরিক এবং একটু অন্য অর্থে প্রয়োগ করা যায়। এত ভিড় কিন্তু কেউ ব্যস্ত নয়। অপেক্ষা এখানে গত কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ, আসল ভারতবর্ষের বৈঠকি মেজাজ, এখানে আজও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। পাশ্চাত্য কুইক টার্নওভারের বর্বরতা এ রাস্তায় এখনো ঢোকেনি। গোধুলিয়া পেরিয়ে দশাশ্বমেধ রোডে ঢুকতেই ডানহাতি এক বিরাট আস্তাঁকুড়। ওদিকে তাকাবেনা। আপনি ওটা দেখতে এখানে আসেন নি। আস্তাঁকুড় কোন দেশে নেই মশায়? সভ্যতা থাকলে সে সভ্যতার পরিষিষ্টও থাকবে প্লাস্টিকের প্যাকেট হয়ে, কখনো ফলের খোসা হয়ে, কখনো অন্য কোন জঞ্জাল হয়ে। ওগুলোর জন্য আস্তাঁকুড় আছে বলেই না আপনার ঘরখানা এমন খাশা ঝকঝকে। আর সে জঞ্জাল জড়ো করে জাহাজে চড়িয়ে আটলান্টিক পেরিয়ে আফ্রিকার কোন গরিব দেশে জমা করার মত রেস্ত আমাদের নেই বলে, আমেরিকান ট্যুরিস্ট ভারতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে নোংরার ছবি তুলতে পারেন। রাস্তার মোড়ে বেশ কিছু পুলিস, কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন বৈঠকি মেজাজ। চৌমাথার ওদিকে রাস্তার দু ধারে কতগুলো খাবারের দোকান। তাতে মিঠাই রাবড়ি আছে, চাট ভান্ডার আছে, এমনকি বাংলায় “জলখাবার” লেখা একটা দোকানও আছে। আর আছে রাস্তার একদম মোড়ে পানের দোকান। মঘাই পান। কিন্তু ওদিকে যাবোনা। যাবো গঙ্গার দিকে। রাস্তার মাঝামাঝি লোহার রেলিং দিয়ে রাস্তা ডাইনে বাঁয়ে ভাগ করা। রেলিঙের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে এক গাদা ঠেলাগাড়ি। তাতে সাজানো হরেক রকম পশরা। তাতে আছে জিলিপি, আছে আমসত্ত্ব, আছে পেঠা বা কুমড়োমেঠাই, আছে বাদাম ভাজা, আছে চুড়ি, জামাকাপড় আরো কত কি। রাস্তার দু ধারেও এরকম জিনিসের দোকান। দশাশ্বমেধের দিকে যত এগোবেন, ততই দোকানের পরিসর ছোট হবে আর বৈচিত্র বাড়বে।
বিশ্বনাথের গলির মুখটায় একটা তোরন। তবে সেটা বোধহয় অতটা পুরোন নয়। সামনে দাঁড়িয়ে দু জন বন্দুকধারী সেপাই। আজকাল ভগবানও নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। ও গলির ভেতরে আলাদা জগৎ, আর তার আলাদা গল্প। আমাদের আজকের দৌড় ওই দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত। বিশ্বনাথের গলি পেরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে পড়বে একটা মিঠাইয়ের দোকান। স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের স্নেহধন্য নিশ্চই, না হলে সাদামাটা প্যাঁড়ায় অমন স্বাদ আসতেই পারেনা। এইখানে এসে রাস্তাটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা সরু হয়ে সোজা গিয়ে পড়েছে ঘাটে। সে রাস্তা নোংরার বেহদ্দ, সবজির বাজার আর দুর্গন্ধ। তবে ঘাটে যাবার এটাই সোজা রাস্তা। আর একটা রাস্তা ডান দিকে ঘুরে গেছে। সেদিকটায় বেশ বাজার মত। দু ধারে মনিহারি দোকান সাজানো। রাস্তার মুখেই গোটাকতক পানের মশলার দোকান। আজ্ঞে হ্যাঁ পানে যে মশলা দিয়ে খাই, সেই মশলার দোকান। এমন তার জাঁক জমক, দেখলে মনে হয় যেন গয়নার দোকান। তবে খ্যাতিতে বেনারসি পান, গয়নার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে বইকি। যদিও আমার মনে হলো, বেনারসি মঘাই পানের ঐতিহ্যে যেন কিঞ্চিত ভাটার টান লেগেছে। সে দোকানের পরেই একটা সিঙ্গাড়া কচুরির দোকান। এইখানেই রাস্তার ডান দিকে বাঁক সুরু, আর ঠিক এখানেই আপনার কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকবে একটা সাইনবোর্ড দেখে। রঙচটা লাল রঙের একটা বোর্ড। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, বিশ্বনাথের গলির ঠিক উলটো প্রান্তে ওটা সিপিআইএমের জোনাল অফিসই বটে। শুনলুম এই বাড়িগুলোর পেছন থেকেই কাশীর বিখ্যাত বাঙালিটোলার শুরু।
যাই হোক, ডান হাতি বাঁক নিয়ে এগোতে থাকলে ক্রমশঃ এ রাস্তাও সরু হয়ে আসে। বেনারসে সাধারনতঃ আর পাঁচটা হিন্দু তীর্থস্থানের মত আমিষ নিরামিষের ছুৎমার্গ নেই। যদিও রাস্তায় রাস্তায় যা বিক্রি হয় তার পনেরো আনাই নিরামিষ। আমিষ রয়েছে বটে, তবে একটু যেন তফাতে, একটু রেখে ঢেকে। গোধুলিয়া থেকে দশাশ্বমেধের রাস্তায় তো একেবারেই নেই। কিন্তু এ রাস্তায় আরো কয়েক পা এগোলে সন্ধ্যের দিকে একটা জিভে জল আনা গন্ধ পা্বেন। ডিম ভাজার গন্ধ। সামনেই দু খানা দোকানে ঝড়ের গতিতে ডিম ভাজা চলছে। ডিম সেদ্ধ ও পাওয়া যাচ্ছে। হাঁসের বা মুরগির, যেমন ডিম চান পাবেন। এরকম নির্ভেজাল ডিমের দোকান আমাদের এদিকে দেখিনি। সামনে রাস্তাটা আবার বাঁহাতি ঘুরে গিয়ে পড়েছে ঘাটের সিঁড়ি তে। সিঁড়ির ঠিক সামনেই একটা ছোট্ট মন্দির। ভেতরে হনুমানের মূর্তি। এ তল্লাটে হনুমান খুবই জাগ্রত দেবতা। সামনে দেখেছিলাম এক সুদর্শন ছোকরা জিন্সের প্যান্ট আর চামড়ার জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে। পায়ে হাই হিল বুট, পকেট থেকে ঝুলছে হাল ফ্যাশনের রোদচশমা। ছোকরার বাবরি চুল কোঁকড়ানো, থাকে থাকে নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। পান খেয়ে ঠোঁট দুটি রাঙা লঙ্কা, আর কপালে মস্ত এক খানা সিঁদুরের টিকা। আরো দু পা এগোলে বাঁ হাতি এক খানা চায়ের দোকান। সে দোকানের মালিক ও কর্মী একজনই গম্ভীর মুখের প্রৌঢ়। সম্ভব হলে এ দোকানে একবার চা খেয়ে দেখতে পারেন। কর্পূর আর তুলসীপাতা যে আমাদের চেনা চায়ে এতটা বৈচিত্র আনতে পারে তা আন্দাজ করিনি।
সিঁড়িতে পা রাখলেই ঘাটের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়া। এতক্ষনের চেনা রাস্তার সঙ্গে কিন্তু ঘাটের কোন মিল নেই। রাস্তা পুরোপুরি বেনারসি, কিন্তু ঘাট একেবারেই আন্তর্জাতিক। এক আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান বন্দর ছাড়া এই এত রকম জাতের জগাখিচুড়ি আর কোথাও দেখিনি। বাঙালি পরিবার আছে, খাস বেনারসের লোকজন আছে, আছে মঙ্গোলিয় মুখের লামা, আছে জাপানি ট্যুরিস্টের দল, আছে একলা আমেরিকান - চরস বা গাঁজার সাহায্যে কিঞ্চিত সাধনাতীত মোক্ষের লক্ষ্যে, আছে উত্তর ইয়োরোপের ইয়া ঢ্যাঙ্গা সোনালী চুলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আছে ভাষা সমস্যায় পড়া ইতালিয়ান দম্পতি, আছে বাংলাদেশ থেকে আসা আজমিড়ের যাত্রি, আছে পাঠান, তাদের সিলওয়ার মেহেদি রাঙানো দাড়ি সমেত, খুব আশ্চর্য হলেও আছে কিছু আরব ট্যুরিস্ট, প্রধানত সিরিয়ান, এদের নিজেদের খাবারের দোকান ও আছে বেনারসে, আছে কোরিয়ান ব্যাবসাদার, আছে সাধু, আছে আরো সাধু, আধা-সাধু, সাজা সাধু, ভন্ড, দালাল, ভিখিরি, দোকানদার, ফুল ওয়ালি, নাপিত, পূরোহিত আরো কত কে তার ঠিক নেই। তবে এত রকমের লোকজন থাকলেও তাদের উদ্দ্যেশ্য কিন্তু মোটামুটি তিন রকম। প্রথম হলো ভক্তি ও গঙ্গা স্নান। এরাই হলো ঘাটের লোকজনের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশী। এর পর রয়েছে ফোটোগ্রাফারের দল। বিশালাকৃতির ক্যামেরা ও ভিষনদর্শন লেন্স সমেত তারা চারিদিকে ভনভন করছে। একটু সাজু গুজু করা সাধু, উদাস ভিখিরি বা ষাঁড় দেখলেই তারা ময়রার দোকানে মাছির মত ভিড় করে ঠেলাঠেলি করে ছবি তুলছে। এদের সিংহভাগই বিদেশি অথবা বাঙালি। তৃতীয় ভাগে আছে দোকানি, পুরোহিত, দালাল, মাঝি, নাপিতের দল। অর্থাৎ যারা প্রথম দলের ওপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে।
ঘাটের সিঁড়িতে মাঝে মধ্যেই একটা করে চত্ত্বর মতো করা। সেখানে চৌকি পাতা। কিছু জায়গায় বাবাজিরা সেগুলো দখল করে আছেন। কিছু ফাঁকা। বসলে কেউ কিছু বলেনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলে ঘাটে লোকসমাগম বাড়ে। আস্তে আস্তে আলো জ্বলে ওঠে। ঘাটের ধাপগুলোতে লোকজন এসে বসতে থাকে। ফুলওয়ালিরা পুজোর ডালি নিয়ে ঘুরছে। একটা ছোট্ট চ্যাঙাড়ি, তাতে গোটা কয়েক ফুল, একটা ছোট্ট প্রদীপ। প্রদীপ জ্বেলে ওগুলো গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। এ হলো সন্ধ্যার গঙ্গা পূজো। ভোরবেলায় অবশ্য স্নানার্থীরা কোমরজলে দাঁড়িয়ে, গঙ্গা জলেই গঙ্গাপূজো করেন। ভিড়ের বাড়তে থাকা গুঞ্জন একসময়ে হঠাৎ ধাক্কা খায়। ডুগ্ ডুগ্ করে ডমরু বেজে উঠেছে কোথাও। এক মুহর্ত পরে তার সঙ্গে যোগ হলো মৃদঙ্গ। বহুমুখি জনসমাগম এক লহমায় অ্যাটেনশন্ ভঙ্গি তে তাকালো সামনের চত্ত্বরের দিকে। দেখি সেখানে আবির্ভূত হয়েছেন জনা পাঁচেক পুরোহিত। পরনে পট্টবস্ত্র, উত্তরীয়, কামিজ। বেশ কায়দা করে পরা। বয়স সকলেরই ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। একটা স্ট্যান্ডে মাইকের মাউথপিস লাগানো। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন পাঁচজনে এক সঙ্গে। গঙ্গার স্তব – জয় জয় গঙ্গে , জয় মা গঙ্গে। অবাক হয়ে দেখুন, চারিদিকে নানা জাতীর মানুষ চুপ করে বসে শুনছেন, এবং গান প্রথম বার অন্তরা ঘুরে এলে, অনেকেই আস্তে আস্তে গলা মেলাতে শুরু করেছেন। যেখানে পুরোহীতরা দাঁড়িয়ে তার ঠিক ডান দিকে একজন মহাকায় প্রৌঢ় একটা মোটা কাছি ধরে প্রানপনে টান লাগালেন। প্রথমটা বোঝা যায়না কি ঘটছে। তারপরে মাথার ওপরে ঢং করে বেজে ওঠে এক মহা্কায় ঘন্টা। তার পর এদিক ওদিক আর অনেক গুলো ঘন্টা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগে, তার পরে তাকালেই দেখাযায় পূরোহিতরা মাইকের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখুন, ওনারা আলাদা আলাদা চৌকির সামনে গিয়ে বসেছেন। সেখানে বসানো অতিকায় পিলসূজ প্রদীপ, আরতীর জন্য। আরো কত কি।
এবারে আবার গান আরম্ভ হলো। ঘণ্টা এবারে তালে তালে বাজছে। পূরোহিতরা উঠে দাঁড়ালেন। হাতে একটা বড় আঙটা, যাতে কর্পুরের আগুন জ্বলছে। আঙটার মাপ প্রায় আমাদের ভাত খাবার থালার মতো। এবারে আরম্ভ হলো আরতী। পূরোহীতরা নেচে নেচে আরতী করছেন জ্বলন্ত আঙটা হাতে নিয়ে। প্রত্যেকের এক ভঙ্গি, এক মুদ্রা একই পদক্ষেপ। এতটাই তাল মেলানো, যে এর কাছে হয়ত সোনা জেতা অলিম্পিকের সিনক্রোনাইজড সুইমারও লজ্জা পাবেন। এ নাচের মধ্যে চটুলতা নেই, বরং আছে মনকে আচ্ছন্ন করা ছন্দ। আঙটার পর প্রদীপ, তারপর চামর। চারিদিকের থিকথিকে ভিড় তন্ময়, নিশ্চুপ। মায়ের কোলের বাচ্ছারাও কাঁদেনা। কেন কাঁদেনা, বলতে পারবো না। হয়তো এই অপার্থীব মুহুর্তের স্বাদ তারাও পায়। এ তো যুক্তি দিয়ে বোঝার ব্যাপার না। শুধুই অনুভুতি। এর মধ্যে ধর্ম নেই, ভগবান নেই, বিশ্বাস নেই। আছে শুধু ওই অনুভুতি। জাগতিক বাস্তব সমস্ত কিছুর বাইরে, কিছুর অস্তিত্ব। নিজের সম্পর্কে নতুন করে ধারনা তৈরি হওয়া। একদিকে আমি কে, আমার পরিচয় কি, আমি কোথা থেকে এসেছি এসব কিছু ভুলে যাওয়া, অন্য দিকে এই পরিবেশে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া। আরতীর শেষ। পুরোহীতরা গঙ্গায় ফুল ভাসালেন। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একজন পুরোহিতকে কেমন চেনা চেনা লাগলো। ও হরি, এ তো সেই হনুমান মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো জিন্স পরা ছোকরা। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, আমরা সকলেই আসলে ওই জিন্স পরা ছোকরা। ওপর থেকে অনেক কিছু পরে আছি। এক এক রকমের আস্তরন। এক এক রকমের অহংকার, যা হয়তো আমার মধ্যে থাকা আসল আমিকেই ঢেকে ফেলেছে। যেদিন সেই আস্তরন, অহংবোধ থেকে মুক্ত করতে পারবো নিজেকে, সেদিন হয়ত চারিদিকের এই জগৎটাই আমার কাছে নতুন করে ধরা দেবে।
ঘাটের সিঁড়ি ধাপে থাপে নেমে গেছে গঙ্গার জল পর্য্যন্ত। ছলাত ছলাত করছে জল। ঠিক এইখানে এসে, বেনারসের যাবতীয় হই হট্টগোল থেমে যায়। এর সীমানা এই পর্যন্ত। এর পরেই আবহমানকালের গঙ্গা। হাজার বছর ধরে এই ভাবে বয়ে চলেছে। শত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে। যদিও নিজে পাল্টায়নি একটুও। গঙ্গার ওপাড়ে ধু ধু বালিয়াড়ি। পশ্চিম দিকে রামনগর, দেখা যায়না। বেনারসের হইচই কে যেন ব্যালেন্স করে দিয়েছে ওপারের নৈশব্দ আর শান্ত সমাহিত রূপ। বেনারস যদি আবার যাই, তাহলে যাবো ঐ লোভেই, আর পারলে নিজের কয়েকটা আস্তরন খুলে ফেলে।
[যদি কেউ উৎসাহী হন, তাহলে লেখকের অপটু হাতের তোলা কয়েকটি ছবি দেখতে পারেন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে
বেনারসের ধর্মতলা হলো গোধুলিয়ার মোড়। ধর্মতলা বললে হয়তো ঠিক বোঝানো হয়না। ধর্মতলায় চওড়া রাজপথ আছে, ফাইভ স্টার হোটেল আছে, পাতাল রেল, বাস ডিপো আছে। গোধুলিয়ায় এসব কিছুই নেই। কিন্তু গোধুলিয়ার আছে বিটকেল জট। আছে থিকথিকে ভিড়, সরু রাস্তা, কান ফাটানো চিৎকার, গানের জগঝম্প, ছাই মাখা সাধু, গরম জিলিপি আর কচুরি, ষাঁড়, ঠেলা গাড়ি, শয়ে শয়ে রিক্সা, বাঙালি ট্যুরিস্টের দোকানে ঢুকে বিকট হিন্দিতে দরাদরি, বিদেশী ট্যুরিস্টের দামি ক্যামেরা আর কামানের মত দেখতে লেন্স ঝুলিয়ে হাঁটা, বৌদ্ধ লামাদের হাসি হাসি মঙ্গোলীয় মুখ, দক্ষিনি তীর্থযাত্রিদের হাত আর জামা ধরে লাইন করে হাঁটা, খাস বেনারসি পুরুত পান্ডার পান খাওয়া ঠোঁটে শুদ্ধ হিন্দি, নিশ্চিন্ত আর ঘুমন্ত পুলিস, ঘাড়ে উঠে পড়া মোটর সাইকেল, কখনো গাড়ি, আর আছে এক হাত অন্তর হোটেলের দালাল আর নৌকার মাঝি। আপনাকে ওপারে নিয়ে যাবার জন্য বড়ই ব্যস্ত। তবে সেটা গঙ্গা না বৈতরণী সেটা তর্কসাপেক্ষ। ফুটপাথ বলে একটা কিছু হয়ত হাজার খানেক বছর আগে ছিলো, কিন্তু এখন সেখানে কেবলই দোকান। সেই দোকানের চালা ভেদ করে পেছনের বাড়ি গুলো দেখার চেষ্টা করা বৃথা। শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেছে স্বয়ং সুর্য্যদেব সেখানে ঢুকতে পারেননি, আপনি আমি তো কোন ছার। কিন্তু আধুনিকতা যাবে কোথায়? হাল ফ্যাশনের ঝকঝকে ল্যাপটপ বা ট্যাব, মিউজিক সিস্টেম, ইলেক্ট্রনিক্সের টুকিটাকি সবই পাবেন। সূর্যের আলোর মতো সোজা চলবার বালাই নেই, তাই বিশ্বায়ন ঢোকে চোরা পথে। গোধুলিয়া আসলে একটা চৌমাথার মোড়, গঙ্গার দিকে দু পা এগোলেই বাঁ হাতি বিশ্বনাথের গলি, আর সোজা একটূ এগোলেই দশাশ্বমেধ ঘাট। এই রাস্তা হলো দশাশ্বমেধ রোড। যদিও হাঁটা দুস্কর, তবুও হিউয়েন সাং, ঔরঙ্গজেব, মার্ক টোয়েন, বিভুতিভূষন, ফেলুদা, সবাই হেঁটেছেন এ রাস্তায়। তবে কিনা এ স্থল বাবা বিশ্বনাথের খাস জায়গীর, কাজেই নন্দী-ভৃঙ্গী দের কথা না বলে ছাড়ি কি করে? আজ্ঞে হ্যাঁ, মহাকায় কিছু ষাঁড় ও আছেন। দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরছেন এদিক ওদিক। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লে রাস্তার একদম মাঝখানে আয়েস করে বসে বসে জাবর কাটছেন। আয়েস দেখে মনে হতেই পারে, নন্দী মশায় বোধহয় গুলকন্দ-জর্দা দেওয়া মঘাই পানই মুখে পুরেছেন। তবে কিনা রাস্তায় ইতি-উতি প্রাকৃতিক কর্মও করছেন। এক সায়েব কে দেখলাম কয়েক লাখ টাকা দামের এক খানা বিশাল ক্যামেরা বাগিয়ে গোবরের ছবি তুলতে। কেন বাওয়া? তোমার দেশে কি গরু বা ষাঁড়ের ইয়ে অন্য রকম দেখতে? নাকি তুমি আমাদের গোবরে তাজমহলের কারুকাজ আশা করছো? ও তো আর কমোডে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে কম্মটি করতে পারে না, আর এখানে এ হোল ওর খাস জায়গা। অগত্যা রাস্তাতেই। তোমাদের গরুর খোঁয়াড় কনক্রিটের। এখানে তো খোলা রাস্তা, ওখানে তো সায়েব, তোমার গরু, তোমার ঘরের ভেতর কম্মটি করে। সে দিক দিয়ে দেখলে আমাদের এনাদের সিভিক সেন্স বেশি।
দশাশ্বমেধ রোড দিয়ে গাড়ি চলা নিষেধ। সে নিয়ম বেনারসি আম আদমী নিষ্ঠা ভরে মানেন। যদিও এনাদের বেশ কয়েক হাজার বছরের নাগরিক জীবন, তবুও ওই রাস্তায় গাড়ি ঢোকাবার মত হিম্মত, কারোর কলিজায় থাকতে পারেনা। রাস্তায় কি কি আছে, তা আগেই বলেছি। তা, সে তো ভারতের বহু রাস্তায়ই আছে। এখানে নতুন কি? নতুন যেটা, সেটা হলো, এ রাস্তায় পা দিয়ে, সবাই একটু বাবা বিশ্বনাথের ভক্ত হয়ে পড়ে বোধহয়, তাই জাগতিক ব্যাপারে কিঞ্চিত অনিহা এসে যায়। ধীর গতি, কেউ সরেনা, নড়ে না, গপ্প জমায়, ষাঁড়ের মতই অলস ভাবে রোমন্থন করে চলে, স্মৃতির। শুধু ব্যস্ততা কিছুটা থাকে কচুরি-মিঠাইয়ের দোকানির আর নৌকোর মাঝির। আইনষ্টাইন বলেছিলেন, সবই আপেক্ষিক। এখানে সেটা কিছুটা আক্ষরিক এবং একটু অন্য অর্থে প্রয়োগ করা যায়। এত ভিড় কিন্তু কেউ ব্যস্ত নয়। অপেক্ষা এখানে গত কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্য। আজ্ঞে হ্যাঁ, আসল ভারতবর্ষের বৈঠকি মেজাজ, এখানে আজও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। পাশ্চাত্য কুইক টার্নওভারের বর্বরতা এ রাস্তায় এখনো ঢোকেনি। গোধুলিয়া পেরিয়ে দশাশ্বমেধ রোডে ঢুকতেই ডানহাতি এক বিরাট আস্তাঁকুড়। ওদিকে তাকাবেনা। আপনি ওটা দেখতে এখানে আসেন নি। আস্তাঁকুড় কোন দেশে নেই মশায়? সভ্যতা থাকলে সে সভ্যতার পরিষিষ্টও থাকবে প্লাস্টিকের প্যাকেট হয়ে, কখনো ফলের খোসা হয়ে, কখনো অন্য কোন জঞ্জাল হয়ে। ওগুলোর জন্য আস্তাঁকুড় আছে বলেই না আপনার ঘরখানা এমন খাশা ঝকঝকে। আর সে জঞ্জাল জড়ো করে জাহাজে চড়িয়ে আটলান্টিক পেরিয়ে আফ্রিকার কোন গরিব দেশে জমা করার মত রেস্ত আমাদের নেই বলে, আমেরিকান ট্যুরিস্ট ভারতের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তে নোংরার ছবি তুলতে পারেন। রাস্তার মোড়ে বেশ কিছু পুলিস, কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন বৈঠকি মেজাজ। চৌমাথার ওদিকে রাস্তার দু ধারে কতগুলো খাবারের দোকান। তাতে মিঠাই রাবড়ি আছে, চাট ভান্ডার আছে, এমনকি বাংলায় “জলখাবার” লেখা একটা দোকানও আছে। আর আছে রাস্তার একদম মোড়ে পানের দোকান। মঘাই পান। কিন্তু ওদিকে যাবোনা। যাবো গঙ্গার দিকে। রাস্তার মাঝামাঝি লোহার রেলিং দিয়ে রাস্তা ডাইনে বাঁয়ে ভাগ করা। রেলিঙের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে এক গাদা ঠেলাগাড়ি। তাতে সাজানো হরেক রকম পশরা। তাতে আছে জিলিপি, আছে আমসত্ত্ব, আছে পেঠা বা কুমড়োমেঠাই, আছে বাদাম ভাজা, আছে চুড়ি, জামাকাপড় আরো কত কি। রাস্তার দু ধারেও এরকম জিনিসের দোকান। দশাশ্বমেধের দিকে যত এগোবেন, ততই দোকানের পরিসর ছোট হবে আর বৈচিত্র বাড়বে।
বিশ্বনাথের গলির মুখটায় একটা তোরন। তবে সেটা বোধহয় অতটা পুরোন নয়। সামনে দাঁড়িয়ে দু জন বন্দুকধারী সেপাই। আজকাল ভগবানও নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন। ও গলির ভেতরে আলাদা জগৎ, আর তার আলাদা গল্প। আমাদের আজকের দৌড় ওই দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত। বিশ্বনাথের গলি পেরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে পড়বে একটা মিঠাইয়ের দোকান। স্বয়ং বাবা বিশ্বনাথের স্নেহধন্য নিশ্চই, না হলে সাদামাটা প্যাঁড়ায় অমন স্বাদ আসতেই পারেনা। এইখানে এসে রাস্তাটা দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা সরু হয়ে সোজা গিয়ে পড়েছে ঘাটে। সে রাস্তা নোংরার বেহদ্দ, সবজির বাজার আর দুর্গন্ধ। তবে ঘাটে যাবার এটাই সোজা রাস্তা। আর একটা রাস্তা ডান দিকে ঘুরে গেছে। সেদিকটায় বেশ বাজার মত। দু ধারে মনিহারি দোকান সাজানো। রাস্তার মুখেই গোটাকতক পানের মশলার দোকান। আজ্ঞে হ্যাঁ পানে যে মশলা দিয়ে খাই, সেই মশলার দোকান। এমন তার জাঁক জমক, দেখলে মনে হয় যেন গয়নার দোকান। তবে খ্যাতিতে বেনারসি পান, গয়নার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে বইকি। যদিও আমার মনে হলো, বেনারসি মঘাই পানের ঐতিহ্যে যেন কিঞ্চিত ভাটার টান লেগেছে। সে দোকানের পরেই একটা সিঙ্গাড়া কচুরির দোকান। এইখানেই রাস্তার ডান দিকে বাঁক সুরু, আর ঠিক এখানেই আপনার কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকবে একটা সাইনবোর্ড দেখে। রঙচটা লাল রঙের একটা বোর্ড। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছেন, বিশ্বনাথের গলির ঠিক উলটো প্রান্তে ওটা সিপিআইএমের জোনাল অফিসই বটে। শুনলুম এই বাড়িগুলোর পেছন থেকেই কাশীর বিখ্যাত বাঙালিটোলার শুরু।
যাই হোক, ডান হাতি বাঁক নিয়ে এগোতে থাকলে ক্রমশঃ এ রাস্তাও সরু হয়ে আসে। বেনারসে সাধারনতঃ আর পাঁচটা হিন্দু তীর্থস্থানের মত আমিষ নিরামিষের ছুৎমার্গ নেই। যদিও রাস্তায় রাস্তায় যা বিক্রি হয় তার পনেরো আনাই নিরামিষ। আমিষ রয়েছে বটে, তবে একটু যেন তফাতে, একটু রেখে ঢেকে। গোধুলিয়া থেকে দশাশ্বমেধের রাস্তায় তো একেবারেই নেই। কিন্তু এ রাস্তায় আরো কয়েক পা এগোলে সন্ধ্যের দিকে একটা জিভে জল আনা গন্ধ পা্বেন। ডিম ভাজার গন্ধ। সামনেই দু খানা দোকানে ঝড়ের গতিতে ডিম ভাজা চলছে। ডিম সেদ্ধ ও পাওয়া যাচ্ছে। হাঁসের বা মুরগির, যেমন ডিম চান পাবেন। এরকম নির্ভেজাল ডিমের দোকান আমাদের এদিকে দেখিনি। সামনে রাস্তাটা আবার বাঁহাতি ঘুরে গিয়ে পড়েছে ঘাটের সিঁড়ি তে। সিঁড়ির ঠিক সামনেই একটা ছোট্ট মন্দির। ভেতরে হনুমানের মূর্তি। এ তল্লাটে হনুমান খুবই জাগ্রত দেবতা। সামনে দেখেছিলাম এক সুদর্শন ছোকরা জিন্সের প্যান্ট আর চামড়ার জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে। পায়ে হাই হিল বুট, পকেট থেকে ঝুলছে হাল ফ্যাশনের রোদচশমা। ছোকরার বাবরি চুল কোঁকড়ানো, থাকে থাকে নেমে এসেছে ঘাড়ের ওপর। পান খেয়ে ঠোঁট দুটি রাঙা লঙ্কা, আর কপালে মস্ত এক খানা সিঁদুরের টিকা। আরো দু পা এগোলে বাঁ হাতি এক খানা চায়ের দোকান। সে দোকানের মালিক ও কর্মী একজনই গম্ভীর মুখের প্রৌঢ়। সম্ভব হলে এ দোকানে একবার চা খেয়ে দেখতে পারেন। কর্পূর আর তুলসীপাতা যে আমাদের চেনা চায়ে এতটা বৈচিত্র আনতে পারে তা আন্দাজ করিনি।
সিঁড়িতে পা রাখলেই ঘাটের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়া। এতক্ষনের চেনা রাস্তার সঙ্গে কিন্তু ঘাটের কোন মিল নেই। রাস্তা পুরোপুরি বেনারসি, কিন্তু ঘাট একেবারেই আন্তর্জাতিক। এক আন্তরাষ্ট্রীয় বিমান বন্দর ছাড়া এই এত রকম জাতের জগাখিচুড়ি আর কোথাও দেখিনি। বাঙালি পরিবার আছে, খাস বেনারসের লোকজন আছে, আছে মঙ্গোলিয় মুখের লামা, আছে জাপানি ট্যুরিস্টের দল, আছে একলা আমেরিকান - চরস বা গাঁজার সাহায্যে কিঞ্চিত সাধনাতীত মোক্ষের লক্ষ্যে, আছে উত্তর ইয়োরোপের ইয়া ঢ্যাঙ্গা সোনালী চুলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আছে ভাষা সমস্যায় পড়া ইতালিয়ান দম্পতি, আছে বাংলাদেশ থেকে আসা আজমিড়ের যাত্রি, আছে পাঠান, তাদের সিলওয়ার মেহেদি রাঙানো দাড়ি সমেত, খুব আশ্চর্য হলেও আছে কিছু আরব ট্যুরিস্ট, প্রধানত সিরিয়ান, এদের নিজেদের খাবারের দোকান ও আছে বেনারসে, আছে কোরিয়ান ব্যাবসাদার, আছে সাধু, আছে আরো সাধু, আধা-সাধু, সাজা সাধু, ভন্ড, দালাল, ভিখিরি, দোকানদার, ফুল ওয়ালি, নাপিত, পূরোহিত আরো কত কে তার ঠিক নেই। তবে এত রকমের লোকজন থাকলেও তাদের উদ্দ্যেশ্য কিন্তু মোটামুটি তিন রকম। প্রথম হলো ভক্তি ও গঙ্গা স্নান। এরাই হলো ঘাটের লোকজনের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশী। এর পর রয়েছে ফোটোগ্রাফারের দল। বিশালাকৃতির ক্যামেরা ও ভিষনদর্শন লেন্স সমেত তারা চারিদিকে ভনভন করছে। একটু সাজু গুজু করা সাধু, উদাস ভিখিরি বা ষাঁড় দেখলেই তারা ময়রার দোকানে মাছির মত ভিড় করে ঠেলাঠেলি করে ছবি তুলছে। এদের সিংহভাগই বিদেশি অথবা বাঙালি। তৃতীয় ভাগে আছে দোকানি, পুরোহিত, দালাল, মাঝি, নাপিতের দল। অর্থাৎ যারা প্রথম দলের ওপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে।
ঘাটের সিঁড়িতে মাঝে মধ্যেই একটা করে চত্ত্বর মতো করা। সেখানে চৌকি পাতা। কিছু জায়গায় বাবাজিরা সেগুলো দখল করে আছেন। কিছু ফাঁকা। বসলে কেউ কিছু বলেনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলে ঘাটে লোকসমাগম বাড়ে। আস্তে আস্তে আলো জ্বলে ওঠে। ঘাটের ধাপগুলোতে লোকজন এসে বসতে থাকে। ফুলওয়ালিরা পুজোর ডালি নিয়ে ঘুরছে। একটা ছোট্ট চ্যাঙাড়ি, তাতে গোটা কয়েক ফুল, একটা ছোট্ট প্রদীপ। প্রদীপ জ্বেলে ওগুলো গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হয়। এ হলো সন্ধ্যার গঙ্গা পূজো। ভোরবেলায় অবশ্য স্নানার্থীরা কোমরজলে দাঁড়িয়ে, গঙ্গা জলেই গঙ্গাপূজো করেন। ভিড়ের বাড়তে থাকা গুঞ্জন একসময়ে হঠাৎ ধাক্কা খায়। ডুগ্ ডুগ্ করে ডমরু বেজে উঠেছে কোথাও। এক মুহর্ত পরে তার সঙ্গে যোগ হলো মৃদঙ্গ। বহুমুখি জনসমাগম এক লহমায় অ্যাটেনশন্ ভঙ্গি তে তাকালো সামনের চত্ত্বরের দিকে। দেখি সেখানে আবির্ভূত হয়েছেন জনা পাঁচেক পুরোহিত। পরনে পট্টবস্ত্র, উত্তরীয়, কামিজ। বেশ কায়দা করে পরা। বয়স সকলেরই ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। একটা স্ট্যান্ডে মাইকের মাউথপিস লাগানো। সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গান ধরলেন পাঁচজনে এক সঙ্গে। গঙ্গার স্তব – জয় জয় গঙ্গে , জয় মা গঙ্গে। অবাক হয়ে দেখুন, চারিদিকে নানা জাতীর মানুষ চুপ করে বসে শুনছেন, এবং গান প্রথম বার অন্তরা ঘুরে এলে, অনেকেই আস্তে আস্তে গলা মেলাতে শুরু করেছেন। যেখানে পুরোহীতরা দাঁড়িয়ে তার ঠিক ডান দিকে একজন মহাকায় প্রৌঢ় একটা মোটা কাছি ধরে প্রানপনে টান লাগালেন। প্রথমটা বোঝা যায়না কি ঘটছে। তারপরে মাথার ওপরে ঢং করে বেজে ওঠে এক মহা্কায় ঘন্টা। তার পর এদিক ওদিক আর অনেক গুলো ঘন্টা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগে, তার পরে তাকালেই দেখাযায় পূরোহিতরা মাইকের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়েছেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখুন, ওনারা আলাদা আলাদা চৌকির সামনে গিয়ে বসেছেন। সেখানে বসানো অতিকায় পিলসূজ প্রদীপ, আরতীর জন্য। আরো কত কি।
এবারে আবার গান আরম্ভ হলো। ঘণ্টা এবারে তালে তালে বাজছে। পূরোহিতরা উঠে দাঁড়ালেন। হাতে একটা বড় আঙটা, যাতে কর্পুরের আগুন জ্বলছে। আঙটার মাপ প্রায় আমাদের ভাত খাবার থালার মতো। এবারে আরম্ভ হলো আরতী। পূরোহীতরা নেচে নেচে আরতী করছেন জ্বলন্ত আঙটা হাতে নিয়ে। প্রত্যেকের এক ভঙ্গি, এক মুদ্রা একই পদক্ষেপ। এতটাই তাল মেলানো, যে এর কাছে হয়ত সোনা জেতা অলিম্পিকের সিনক্রোনাইজড সুইমারও লজ্জা পাবেন। এ নাচের মধ্যে চটুলতা নেই, বরং আছে মনকে আচ্ছন্ন করা ছন্দ। আঙটার পর প্রদীপ, তারপর চামর। চারিদিকের থিকথিকে ভিড় তন্ময়, নিশ্চুপ। মায়ের কোলের বাচ্ছারাও কাঁদেনা। কেন কাঁদেনা, বলতে পারবো না। হয়তো এই অপার্থীব মুহুর্তের স্বাদ তারাও পায়। এ তো যুক্তি দিয়ে বোঝার ব্যাপার না। শুধুই অনুভুতি। এর মধ্যে ধর্ম নেই, ভগবান নেই, বিশ্বাস নেই। আছে শুধু ওই অনুভুতি। জাগতিক বাস্তব সমস্ত কিছুর বাইরে, কিছুর অস্তিত্ব। নিজের সম্পর্কে নতুন করে ধারনা তৈরি হওয়া। একদিকে আমি কে, আমার পরিচয় কি, আমি কোথা থেকে এসেছি এসব কিছু ভুলে যাওয়া, অন্য দিকে এই পরিবেশে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া। আরতীর শেষ। পুরোহীতরা গঙ্গায় ফুল ভাসালেন। ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একজন পুরোহিতকে কেমন চেনা চেনা লাগলো। ও হরি, এ তো সেই হনুমান মন্দিরের সামনে দাঁড়ানো জিন্স পরা ছোকরা। ঠিক সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, আমরা সকলেই আসলে ওই জিন্স পরা ছোকরা। ওপর থেকে অনেক কিছু পরে আছি। এক এক রকমের আস্তরন। এক এক রকমের অহংকার, যা হয়তো আমার মধ্যে থাকা আসল আমিকেই ঢেকে ফেলেছে। যেদিন সেই আস্তরন, অহংবোধ থেকে মুক্ত করতে পারবো নিজেকে, সেদিন হয়ত চারিদিকের এই জগৎটাই আমার কাছে নতুন করে ধরা দেবে।
ঘাটের সিঁড়ি ধাপে থাপে নেমে গেছে গঙ্গার জল পর্য্যন্ত। ছলাত ছলাত করছে জল। ঠিক এইখানে এসে, বেনারসের যাবতীয় হই হট্টগোল থেমে যায়। এর সীমানা এই পর্যন্ত। এর পরেই আবহমানকালের গঙ্গা। হাজার বছর ধরে এই ভাবে বয়ে চলেছে। শত পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে। যদিও নিজে পাল্টায়নি একটুও। গঙ্গার ওপাড়ে ধু ধু বালিয়াড়ি। পশ্চিম দিকে রামনগর, দেখা যায়না। বেনারসের হইচই কে যেন ব্যালেন্স করে দিয়েছে ওপারের নৈশব্দ আর শান্ত সমাহিত রূপ। বেনারস যদি আবার যাই, তাহলে যাবো ঐ লোভেই, আর পারলে নিজের কয়েকটা আস্তরন খুলে ফেলে।
[যদি কেউ উৎসাহী হন, তাহলে লেখকের অপটু হাতের তোলা কয়েকটি ছবি দেখতে পারেন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন