শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

লক্ষীর ভাণ্ডার ~ শতদ্রু দাস

লক্ষীর ভান্ডার নিয়ে কয়েকটি শুকনো পরিসংখ্যান: 

প্রথমত, এই প্রকল্পের আওতায় আসতে গেলে কী কী যোগ্যতাপূরণ করতে হবে সেটা দেখে নেওয়া যাক - ১) পশ্চিমবঙ্গবাসী হতে হবে ২) মহিলা হতে হবে ৩) বয়স ২৫-৬০ এর ভেতর হতে হবে ৪) সরকারী চাকুরিরতা বা পেনশনভোগী হওয়া চলবে না।

দ্বিতীয়ত, কত টাকা পাওয়া যাবে? জেনারেল ক্যাটাগরি হলে ৫০০ টাকা, সংরক্ষিত ক্যাটাগরি হলে ১০০০ টাকা।

তৃতীয়ত, সরকারের হিসেব অনুযায়ী কতজন উপভোক্তা ও কত কত খরচ হবে? সরকারী হিসেবে ১.৬ কোটি উপভোক্তা এবং মাসে ১১০০ কোটি টাকা খরচ হবে। অর্থাৎ মাথাপিছু ৬৮৮ টাকা। 

সরকারের হিসেব কি সঠিক? পশ্চিমবঙ্গে, ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী ১৫-৫০ বছর বয়সী মহিলার সংখ্যা ছিল ২.৫৪ কোটি। ২০২১-এ এসে এনাদের বয়স হবে ২৫-৬০। এঁদের মধ্যে সরকারী চাকরি বা পেনশনভুক্ত হবেন খুব বেশি হলে ৪-৫ লক্ষ। ধরে নিচ্ছি আরো ১৫-২০ লক্ষ মহিলার অবস্থাপন্ন পরিবার হওয়ার কারণে এই প্রকল্পে আগ্রহী হবেন না। সে ক্ষেত্রে ২.৩ কোটি মহিলা এই প্রকল্পে যুক্ত হতে চাইবেন বলে ধরা যায়। অর্থাৎ, সরকারের ১.৬ কোটি উপভোক্তার হিসেব ভুল অথবা তারা সকলকে এই প্রকল্পের আওতায় আসতে দেবে না, কোনো ছুতো দিয়ে বাধা দেবে। সরকারের মাথাপিছু ৬৮৭ টাকার হিসেবও কি ঠিক? ৬৮৭ টাকা হতে গেলে, রাজ্যের ৬৩ শতাংশ মহিলাকে জেনারেল এবং ৩৭ শতাংশ মহিলাকে রিজার্ভ ক্যাটাগরি হতে হবে। ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের ৩১ শতাংশ মানুষ এসসি-এসটির আওতায় পড়েন। এর ওপর ১০ শতাংশের বেশি ওবিসি আছেন। অর্থাৎ সংখ্যাটা ৪০%-এর বেশি হবে। সেনসাসে বহুদিন যাবৎ দেখা গেছে যে এসসি-এসটির ভেতর জন্মহার জেনারেলের তুলনায় কিছু বেশি। তা ছাড়া যাঁরা অবস্থাপন্ন বা সরকারী চাকরি করার দরুন এই প্রকল্পতে আগ্রহী হবেন না, তাঁদের মধ্যেও অধিকাংশ  জেনারেল হবেন কারণ উচ্চবর্ণরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে। অর্থাৎ অন্তত ৪০% রিজার্ভড ক্যাটাগরির উপভোক্তা হবেন। সে ক্ষেত্রে মাথাপিছু খরচ কম করে ৭০০ টাকা হওয়া উচিত। তাহলে মোট মাসিক খরচ হয়ে দাঁড়ায় ২.৩*৭০০ = ১৭১০ কোটি টাকা। বার্ষিক খরচ দাঁড়ায় ২০,৫০০ কোটি টাকা। 

সরকারের হিসেবের থেকে ৬০% বেশি।

হয় সরকার ঠিকই করেছে যে সকল যোগ্য ব্যক্তিকে প্রকল্পর আওতায় আনবে না, নয় সারা বছর এই টাকা আসবে না, বকেয়া পড়ে থাকবে। অথবা হিসেবে বড় সর গোলমাল করছে।

এই ২০,৫০০ কোটি টাকা ঠিক কতটা? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বার্ষিক আয় গত বছর ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকার কিছু কম ছিল। অর্থাৎ, লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পে সরকারের বার্ষিক আয়ের ১৩.৩ শতাংশ খরচ হবে। 

কোথা থেকে আসবে এই বাড়তি টাকা? রাজ্য সরকারের হাতে কর বৃদ্ধির রাস্তা জিএসটির পর থেকে একেবারেই সংকুচিত। রাজ্য আয়কর নিতে পারে না, জিএসটির ফলে সামগ্রীর ওপরও নিজের ইচ্ছে মত কর চাপাতে পারে না। রাজ্যের হাতে পড়ে রয়েছে শুধু জমি থেকে আদায় করা কর আর আবগারি কর। এই দুই উৎস থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা কর বৃদ্ধির দূর দুরান্তের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে? পড়ে রইলো দুটো পথ - ধার করা এবং অন্য খাতে খরচ কমানো। কিন্তু এই দুটো পথ আসলে একই। ধার করলে যে সুদ গুনতে হবে তা অন্য খাতে খরচের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং শেষ অবধি সুদ সমেত ধার ফেরত দিতে খরচ হবে প্রায় দ্বিগুণ। আয় উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়লে, সেই দ্বিগুন টাকা শোধ হবে অন্য খাতের খরচ কমিয়েই। 

অর্থাৎ লক্ষীর ভান্ডারের টাকা আসবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক, কৃষি, পঞ্চায়েত, যুবকল্যান, সংখ্যালঘু উন্নয়ন ইত্যাদি দফতর থেকে টাকা কেটেই। কেউ কেউ হয়ত বলবেন যে এসব সরকারী দফতরের প্রকল্প কাটছাঁট করে, সরাসরি লোকের হাতে বেশি টাকা গেলে ভালোই। তারা হয়ত বিশ্বাস করেন যে টাকার অভাবে ভাঙা রাস্তা সরকার মেরামত না করলে বা সেচের খালের সংস্কার না করলে, হাজার হাজার গ্রামবাসী লক্ষীর ভান্ডার থেকে কিছু টাকা চাঁদা তুলে নিজেরাই তা করে নেবে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন