বুধবার, ২২ জুলাই, ২০২০

৭% ভোট ~ সুশোভন পাত্র

গৃহপালিত মিডিয়ার ভাড়া করা পণ্ডিতরা বলেছেন বামপন্থীরা ভোট পাবে না! ৭%-র এক ইঞ্চিও এদিক সেদিক হবে না। সে বামপন্থীরা রাজ্য জুড়ে যতই ঐ সব, কমিউনিটি কিচেন করুক, শ্রমজীবী ক্যান্টিন খুলুক, মাস্ক-স্যানিটাইজার বিলি করুক, এক গলা জলে ডুবে রান্না করা খাবার ফেরি করুক, মুমূর্ষু রুগী কে রক্ত দান করুক, ত্রাণ নিয়ে আজ সন্দেশখালি, কাল হাসনাবাদে ঘুরুক, কৌটা নাড়িয়ে জোগাড় করা পয়সায় রেশন বিলি করুক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত অফিস ঘেরাও করুক, নন্দীগ্রামে বন্ধ হয়ে যাওয়া পার্টি অফিস খুলুক আর খেজুরি লাল ঝাণ্ডার মিছিলে সাজুক -বামপন্থীরা কিন্তু ভোট পাবে না! ৭%-র এক ইঞ্চিও এদিক সেদিক হবে না। 
তাহলে ভোট পাবে কে? পণ্ডিতরা সেফলজি গাঁতিয়ে বলেছেন, ভোট পাবেন 'বাংলার গব্বো মমতা'। ঐ যে ওনার খড়ি মাটি ঘষে রাস্তায় আঁকা গোল দাগে করোনা বৃত্তবন্দী হয়েছিল, ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে মিডিয়া খিচিক করে ফটো তুলেছিল, পরের দিনে ফ্রন্ট পেজে সিক্সটি পয়েন্টের গদগদ হেডিং টপকে পড়েছিল; ঐ যে টলিউডের নামকরা গ্রাফিক্স ডিজাইনারা আগুন ঝরা ছবি এঁকেছিল আর কিষানজির সেমি-হাফ-কোয়ার্টার-ফুল ভক্তরা ফেসবুকে 'দিদি-দিদি' করে উদ্বাহু হয়ে নেত্য করেছিল –এসবই নাকি পিকের কনটেম্পোরারি "হাউ টু উইন ইলেকশন"র কপিবুক ব্যাকরণ। মার্কেটে আজকাল নাকি এসবই ট্রেন্ডিং। কমিউনিটি কিচেন-টিচেন, ভুখা মানুষের পেট, যৌথ খামার -ওসব নাকি আজকাল ব্যাকডেটেড ফ্যাশন। 
আর ভোট পাবে কে? বিজেপি। ঐ যে দেখলেন না, দিলীপ ঘোষ আমফানের পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে সং সেজে, ঢং করে গাছ কাটলেন, সন্ধেবেলা টক শো তে বাতেলা বাজির ঘুঁটে দিলেন, অগ্নিমিত্রা পল, লকেট চাটুজ্যে সাধ্যমত ফুটেজ খেলেন, আমফান কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা না করা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৮৫হাজার এলইডি টিভি লাগিয়ে বক্তৃতা দিলেন –এসবই নাকি অমিত মালব্য-র কনটেম্পোরারি "হাউ টু উইন ইলেকশন"র কপিবুক ব্যাকরণ। মার্কেটে আজকাল নাকি এসবই ট্রেন্ডিং। ওসব 'রক্ত দান জীবন দান' টাইপস শ্লোগান নাকি আজকাল আর কেউ খাচ্ছে না।
তৃণমূল ভোট পাবে কারণ, প্যান্ডেমিক ও আমফানের নির্মম আবহেও ত্রাণ লুটে লিমকা গিনেস বুকে নাম তুলছে তৃণমূল নেতারা। কেন পঞ্চায়েত-ব্লকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা টাঙ্গানো হচ্ছে না? কেন ওয়েবসাইটে তালিকা দেওয়া যাচ্ছে না? কে বানাল তালিকা? প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতি না শাসকদলের এমএলএ? কে সই করলেন তালিকায়? বিডিও না তার অধস্তন? কে পাঠালেন লুটের টাকা? ডিএম না তার অনুসঙ্গিরা  ? টাকা কি খোলামকুচি, না কারোর বাপের সম্পত্তি? লুটের দায় কার? চোরেদের বিরুদ্ধে সরকার কি ব্যবস্থা নিল? মুখ্যমন্ত্রী বলছেন "একটু দুর্নীতি!" কাইন্ডলি আপনারা মুখ্যমন্ত্রী কে এক-টু বিশ্বাস করুন। বোঝার চেষ্টা করুন, চোরেদের কে নিয়েই তো দল চালাতে হয় ওনাকে। তাই ওনার দোষ নেই। দুর্নীতির হিসেব নেই। সৎ প্রশ্নের জবাব নেই। কিন্তু গৃহপালিত মিডিয়া বলছে ভোট আছে। 
তৃণমূল ভোট পাবে কারণ, চিকিৎসার জন্য চোদ্দ ঘণ্টায় পাঁচটি হাসপাতাল-নার্সিংহোমে ঘুরে, মায়ের আত্মহত্যার হুমকি পর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করার আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে শুভ্রজিৎ-র। রাজ্যে, খোদ কলকাতায় সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে প্রতিদিন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বাড়ছে। রাজ্যে প্রথম ৫হাজার জন আক্রান্ত হয়েছিলেন ৭৪ দিনে। আর পরের ৫হাজার জন ৩দিনে। রেকর্ড হার আক্রান্ত গত ২৪ ঘণ্টায়। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৬জন। মোট ১০৪৯। দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যু হার। সর্বনিম্ন পরীক্ষা। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন "সরকার কত করবে?"। ঠিকই তো! কাইন্ডলি আপনারা মুখ্যমন্ত্রী কে এক-টু বিশ্বাস করুন। বোঝার চেষ্টা করুন, এই সরকারের দায় নেই। দায়িত্ব নেই। লজ্জাও নেই। কিন্তু গৃহপালিত মিডিয়া বলছে ভোট আছে।
একান্তই তৃণমূল কে পছন্দ না হলে বিজেপি কে ভোট দিন। কারণ, আপনাকে বলা হয়েছিল 'মমতাকে আটকাতে পারে একমাত্র বিজেপি।' অতএব তৃণমূল ২২ বিজেপি ১৮। এই জরাসন্ধ-সময়ে সেই অমূল্য ১৮জন কোথায়? আমফান আছড়ে পড়ল। ৮৬জনের মৃত্যু হল। ঘর হারালেন কয়েক লক্ষ। তারপরও জল গড়াল মুড়িগঙ্গা, মৃদঙ্গভাঙা, তালপাটি দিয়ে। অথচ আমফান কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবী জানালেন না ১৮জন সাংসদের একজনও। লকডাউনে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বাড়ল, পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ল, স্যানেটাইজারে ১৮% ট্যাক্স বসল। বিজেপির ইকুয়েশনে বিপর্যস্ত মানুষ নেই। অসহায় মানুষ নেই। বিপন্ন মানুষ নেই। কিন্তু বিজেপির ক্যালকুলেশনে ভোট আছে।    
বিজেপি ভোট পাবে কারণ বিজেপিই তো তৃণমূলের যোগ্য উত্তরসূরি। মিনাখায় হরিণখোল গ্রামে আমফানে যৌথভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করল বিজেপি এবং তৃণমূল। ক্ষতিগ্রস্ত ৫০৫। তালিকা হল ১২২ জনের। ভাগাভাগি তে ক্ষতিপূরণ পেল, তৃণমূলের ৬৭ বিজেপি'র ৫৫। আসল ক্ষতিগ্রস্তরা আঙুল চুষলেন। আর তাই, ৪১% ভোটে নিয়েও তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির প্রতিবাদ নেই, পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূলের সভাপতির চোখে চোখ রাখার হিম্মত নেই। লড়াই-সংগ্রামের-আন্দোলনের বালাই নেই। অবশ্য দরকারও নেই। কারণ তৃণমূলের সঙ্গে আপোষ আছে। পর্দার আড়ালে সেটিং আছে। 
কেমন সেটিং? কেমন আপোষ? যেমন ধরুন তৃণমূলের চাল চুরি তে বিজেপি স্পিকটি নট। বিজেপির ৪১টি কয়লা খনি নিলাম করলে মমতা ব্যানার্জি স্পিকটি নট। পিএম কেয়ারসের দুর্নীতি তে তৃণমূলের সাংসদরা স্পিকটি নট। আমফান কে জাতীয় বিপর্যয় দাবী তে বিজেপির বাংলার সাংসদরা স্পিকটি নট। রেলের বেসরকারিকরণে প্রাক্তন রেলমন্ত্রী স্পিকটি নট। গোয়েঙ্কা ছাপ লাগাম ছাড়া ইলেকট্রিক বিলে দিলীপ ঘোষ স্পিকটি নট। কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার খর্ব হলে তৃণমূল স্পিকটি নট। শুভ্রজিৎ-র মৃত্যু নিয়ে বিজেপি স্পিকটি নট।   
তাই চোখ বন্ধ করে গৃহপালিত মিডিয়া কে বিশ্বাস করুন। ত্রাণের চাল চুরি তে রেকর্ড করতে তৃণমূলকেই ভোট দিন। লোকাল  মস্তান নেতা কে আমফানের ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করার সুযোগ দিতে তৃণমূলকেই ভোট দিন। করোনার মৃত্যু হারে দেশের মধ্যে পয়লা র‍্যাঙ্ক ধরে রাখতে তৃণমূলকেই ভোট দিন। সরকারী হসপিটালে শুভ্রজিৎ'দের বিনা চিকিৎসায় মরতে দিতে  তৃণমূলকেই ভোট দিন। 
আমফান কে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করার দাবী কে সাবোটেজ করতে বিজেপিকেই ভোট দিন। আপনার রক্ত চুষে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি বাড়াতে বিজেপিকেই ভোট দিন। পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়াতে বিজেপিকেই ভোট দিন। তৃণমূলের সঙ্গে আপোষ করে লুটে খেতে বিজেপিকেই ভোট দিন। থানায় বসে তৃণমূলের পুলিশের সঙ্গে খাসি মাংস ভাত সাঁটাতে বিজেপিকেই ভোট দিন। 
আর তৃণমূল কে তাড়াতে চাইলে, বিজেপি কে ঠেকাতে চাইলে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে চাইলে, আমফানের ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবী তে সোচ্চার হতে চাইলে, আপনার জীবন-জীবিকার প্রতিদিনের সমস্যার বিরুদ্ধে আপোষ হীন সংগ্রাম চাইলে -প্রকাশ্যে লাল ঝাণ্ডা ধরুন। কারণ গোপনে বিজেপি তো দিদিমণিও করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন