বোম্বের খেতওয়ারি মেন রোডের ওপর 'রেড ফ্ল্যাগ হল' তখন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পার্টি কমিউন। আটটা ঘর আর একটা হলঘর নিয়ে সেই কমিউনের অবস্থান। হলঘরে বসত পার্টির মিটিং আর আটটা ঘরে থাকতেন পরিবার সহ বিভিন্ন কমরেডরা। সেখানেই জীবনের প্রায় সারাটা বছর কাটিয়েছেন আলি সরদার জাফরি তাঁর স্ত্রী সুলতানা জাফরি আর দুই পুত্রকে নিয়ে। এখানে বসেই উনি খাজা আহমেদ আব্বাসের 'ধরতি কে লাল' সিনেমার গানের লিরিক্স সহ আরো অসাধারণ কিছু উর্দু কবিতার জন্ম দিয়েছেন।
সদ্য সদ্য তখন পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠেছে। প্রকাশ্যে কাজকর্ম করা শুরু করেছে পার্টি। সেই সময়েই সরদার জাফরি রেড ফ্ল্যাগ হল এ নিয়ে এলেন একজন তরুণ পার্টির হোলটাইমার কমরেডকে। সাথে তাঁর স্ত্রী আর বছর খানেকের এক কন্যাসন্তান। একটা ঘর তখন ফাঁকা হয়েছে একজন কমরেড ছেড়ে দেওয়ার জন্য। সেই ফাঁকা ঘরে থাকতে এলেন সেই কমরেড। আইপিটিএর সক্রিয় কর্মী সেই তরুণ নিজের ব্রিফকেসে সব সময়ে পার্টির কার্ড নিয়ে ঘুরতেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই কার্ডটা বের করে বলতেন 'এটা আমার জীবনের সবথেকে বড় সম্পদ'।
তরুণ কমরেডটি পার্টির কাজের পাশাপাশি লেখালেখিও করেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু উর্দু কবিতা লিখে মোটামুটি একটা পরিচিতি পেয়েছেন। রেড ফ্ল্যাগ হল এ এসে সেই তরুণ কমরেড একটা ইয়াং রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুললেন। প্রতি রবিবার হলঘরে ইয়াং রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরুণ সাহিত্যিকদের গল্প ও কবিতা পাঠের আসর বসে। সেই আসরে আসত সাগর সারহাদি, জাফর গোরখপুরি ইত্যাদি। এরা প্রত্যেকেই আবার আইপিটিএরও সদস্য। এদের সাথে সাথেই ফর্সা লম্বা মতন আরেকটি ছেলে আসত। নাম ছিল সম্পূরণ সিং কালরা। সদ্য সদ্য দেশভাগের পর সম্পূরণের বাবা মাখখন সিং তাঁর পরিবার নিয়ে বোম্বে চলে এসেছিলেন। ছেলের লেখালেখি করার খুব শখ, কিন্তু কোনো কারণে বাবা মাখখন সিং এর লেখালেখি ব্যাপারটা খুব অপছন্দের। জীবন ধারণের তাগিদে সম্পূরণ সিং নানা রকম ছোটখাটো কাজকর্ম করে যাচ্ছে বোম্বেতে। তার মধ্যেই একটা গ্যারেজে মোটর মেকানিকের কাজ করে কিছু পয়সা আসতে শুরু করেছে। এরই সাথে বাড়িতে বাবাকে লুকিয়ে চলছে সাহিত্যচর্চা। সেই সাহিত্যের তাগিদেই আসা শুরু হল রেড ফ্ল্যাগ হল এ।
তরুণ কমরেডটি কবি হিসেবে পরিচিত হলেও উপার্জনের দিক থেকে সেরকম কিছু করতে পারছিলেন না। এদিক ওদিক পত্র পত্রিকায় লিখে কিছু হয়ত উপার্জন হয়, কিন্তু কন্যা সন্তানের পর আবার এক পুত্র সন্তান যখন হল তখন সত্যিই খুব বিপদে পড়লেন তিনি। যদিও তাঁর স্ত্রী তখন পৃথ্বি থিয়েটারের অভিনেত্রী, কিন্তু সংসারের সুরাহা কিছুতেই হয়ে উঠছে না। এরকম এক সময়ে এক নামী পরিচালকের এক সিনেমায় গান লেখার অফার এলো। ঠিক তার পরপরই আরো কিছু ছবিতে গান লেখার সুযোগ পেলেন। কিন্তু কপাল এমনই খারাপ যে গানগুলো হিট করলেও ছবিগুলো খুব বেশি হিট করল না। সিনেমার জগতে সেই তরুণের ছাপ পড়ে গেল দুর্ভাগা বলে। সেই জন্য আর কেউই এগিয়ে এলো না সিনেমার কাজ নিয়ে।
বেশ কয়েক বছর বাদে রেড ফ্ল্যাগ হল এ সেই কবির ঘরে এলেন এক পরিচালক। তাঁর পরের ছবিতে সেই কবিকে দিয়ে তিনি গান লেখাতে চান। শুনে কবি বললেন, কেন শুধু শুধু আমাকে দিয়ে লেখাচ্ছেন? লোকে বলে আমার গান খারাপ নয়, তবে আমার নসীব খুব খারাপ। আপনি ডুবে যাবেন। শুনে সেই পরিচালক বললেন আমার নসীবও খুব খারাপ বুঝলেন। পরপর কয়েকটা ছবি আমার ফ্লপ করেছে। একবার ভাগ্যের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখাই যাক না।
নেওয়া শুরু হল ভাগ্যের চ্যালেঞ্জ। ১৯৬২ সালের ভারত চিন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তৈরি সেই সিনেমা রিলিজ করল ১৯৬৪ সালে। চেতন আনন্দের পরিচালনায় 'হাকিকত' জিতে নিল ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড সহ নানা পুরষ্কার। গীতিকার সেই কবি কইফি আজমির লেখা গান 'কার চলে হাম ফিদা জান ও তান সাথিও/ আব তুমহারে হাওয়ালে ওয়াতন সাথিও' গানটা ফিরতে লাগল সবার মুখে মুখে। আজও সেই গান অমর হয়ে রয়েছে।
এর ঠিক আগের বছরই ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় বিমল রায়ের শেষ ক্লাসিক 'বন্দিনী', যেখানে সেই মোটর মেকানিক সম্পূরণ সিং ছেলেটি গীতিকার হিসেবে নজর কেড়ে নিয়েছে অনেকের। বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য তার বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই সম্পূরণ সিং এর বদলে নিজের নাম সে লিখত 'গুলজার'।
আমার ভুল ধারণা ছিল, আমি শুনছিলাম, গুলজারের আসল নাম - গুলজার সিং
উত্তরমুছুন