ফোর্বসের 'রিয়েল টাইম বিলিওনারিস'-র লিস্টে পঞ্চম স্থানে উঠে এসে মুকেশ ভাই বলেছেন "টাকা কামানোর জন্য ব্যবসা করার মানেই হয় না। পৃথিবীতে টাকা দিয়ে বিশেষ কিছুই কেনা যায় না।" হ্যাংলা মিডিয়া মুকেশ ভাই-র হাম্বেল বাণী তে মুগ্ধ হয়ে হামলে পড়ে এমন জিভ বের করেছে যে, জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষকরা আজকাল অনলাইন ক্লাসে নাকি প্রতিবর্ত ক্রিয়া বোঝাতে কুকুরের জিভের বদলে অর্ণব গোস্বামীদের জিভের উদাহরণ দিচ্ছেন।
কুকুরের কিংডমে এই নির্মম দখলদারি তে বিমর্ষ হয়ে, মুদি দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে রাস্তার কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওমনি পাড়ার রাজনৈতিক বিরোধী কাকু এসে বললেন "দেখলে তো, মুকেশ আম্বানি কেমন দিল! অর্থনীতি কে এবার রোখে কোন বাপের ব্যাটার সাধ্যি দেখি।" অগত্যা প্রতিবর্ত ক্রিয়া থেকে অর্থনীতি তে সুইচ করে বললাম, "কাকু, ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে প্রতি মিনিটে মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি গড়ে ২৩,৪০,১৫০টাকা করে বেড়েছে¹। আপনার স্যালারিটা যেন কত বেড়েছে?" বিরোধী কাকু জনসমক্ষে স্যালারির প্রসঙ্গ তোলায় পুরো জেনারেশেনের স্বভাব-ভদ্রতার ১৪গুষ্ঠি উদ্ধার করে দিলেন। কুকুরটা অবশ্য বসেই ছিল।
থাকুক গে। বিবেকানন্দ তো বলেছেন, যে বসে থাকে, তার ভাগ্যও নাকি বসে থাকে। অবশ্য এসব থিওরি সাধারণ মানুষের জন্য। মুকেশ ভাই ব্যতিক্রম। মুকেশ ভাই বসে থাকলেও, ভাগ্য দাঁড়িয়েই থাকে। ঐ যে কি বলে যেন? 'ক্রনি ক্যাপিটালিজম' না কি ছাই!
'ক্রনি-ফনি' ছাড়ুন। পয়েন্টে আসুন। ৪২তম অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং-এ মুকেশ ভাই যেদিন ঘোষণা করলেন ১৮মাসের মধ্যে রিলায়েন্স কে 'ঋণমুক্ত' করার রোডম্যাপ রেডি, তখন বাজারে রিলায়েন্সের মোট ঋণ ১.৫৪লক্ষ কোটি। ক্রেডিট সুইসের বিচারে স্টক মার্কেটে রিলায়েন্সের শেয়ারের মান 'নিম্ন'।
ঘোষণার ৯দিনের মাথায়, Serious Fraud Investigation Office জানালো, যে সময়ে চিদাম্বরম INX মিডিয়া তে মরিসাসের কোম্পানির অবৈধ বিনিয়োগ কে মান্যতা দিয়েছিলেন, সেই সময়ে রিলায়েন্সই, INX-র অধীনস্থ নিউজ-X চ্যানেলের মালিকানা কিনে ঐ অবৈধ বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করেছিল²।
INX নিয়ে তদন্তের মাঝেই, মুম্বাই উপকূলে পান্না-মুক্তা-তাপ্তি বেসিনের গ্যাস এবং তেল উত্তোলনে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে, দিল্লি হাইকোর্টে সৌদি আরামকোর সঙ্গে রিলায়েন্সের ৫৭হাজার কোটির চুক্তি আইনি জটিলতায় পড়ল। অন্যদিকে লকডাউনের মুখে, রাসায়নিক পিউরিফাইয়েড টেরেফথালিক অ্যাসিডের আমদানি শুল্ক কমলে, পলিয়েস্টার তৈরিতে মার্কেটে রিলায়েন্সের একছত্র আধিপত্যও খর্ব হল। পর পর, বাণিজ্যিক ধাক্কায়, গোল্লায় যাওয়া 'মার্কেট রেপুটেশনের' ক্যাসক্যাডিং এফেক্টে রিলায়েন্সের শেয়ারের মূল্য তখন ১৩৫০টাকা থেকে গোত্তা খেয়ে ৮৬৭-তে³।
কিন্তু মুকেশ ভাই তো ব্যতিক্রম। তাই মুকেশ ভাই-র ভাগ্য ফেরাতে মাঠে নামল স্বয়ং আরবিআই। রেপো রেট পরিবর্তন করে, সরকারী বন্ড কিনে, অর্থনীতি তে পর্যাপ্ত ক্যাশের জোগান বজায় রাখার মনিটারি পলিসির চল বহুদিনের। কিন্তু এই প্রথমবার আরবিআই জানালো, প্রয়োজনে ১৯৩৪-র অ্যাক্ট বদলে, 'কর্পোরেট বন্ড' কেনার কথাও ভাবছে তারা⁴। খবর চাউর হতেই রিলায়েন্সের শেয়ারের দাম বাড়ল ২৩%। ৬ মাসে প্রথমবার।
প্রধানমন্ত্রীর 'আত্মনির্ভর' বক্তৃতার ২৪ঘণ্টা পেরনোর আগেই মুকেশ ভাই ঘোষণা করলেন 'সম্পূর্ণ দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে' টেলিকমে 5G-র বিপ্লব আনবে রিলায়েন্স। আমেরিকার Qualcomm আর দক্ষিণ কোরিয়ার Samsung-র সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হয়ে, Huawei-র পেটেন্ট ব্যবহার করে কিভাবে জিও "সম্পূর্ণ দেশীয় 5G-র বিপ্লব আনবে" সে প্রশ্ন শিকেয় তুলে, বক্তৃতা আর ঘোষণার আন্তঃ সম্পর্কের ইঙ্গিত বুঝতে ভুল হয়নি জুকেরবার্গের মত ব্যবসিকদের⁵। ফলত দু-মাসে জিও-র ঝুলিতে এলো ফেসবুক সহ বিভিন্ন কোম্পানির মোট ৮৬,৬৫৪কোটির চুক্তি। কিন্তু তখন রিলায়েন্স'র ১.৫লক্ষ কোটির 'ঋণমুক্তি'র লক্ষ্য দুরস্ত।
তাই মুকেশ ভাই-র ইচ্ছে হল, মার্কিন শেয়ার বাজার ন্যাসড্যাকে রিলায়েন্সের 'রাইটস ইস্যু' করবেন। গোদা বাংলায়, শেয়ার হোল্ডারদের কম পয়সায় নতুন শেয়ার কেনার সুযোগ দিয়ে পয়সা কামাবেন। কিন্তু আপনি বলবেন তা আবার হয় নাকি? সেবি-র নিয়মে তো কোন কোম্পানির বিরুদ্ধে আর্থিক অসঙ্গতির অভিযোগ থাকলে তার রাইটস নাকি ইস্যু করা যায় না? কাগজ-কলমে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া রাইটস নাকি ইস্যু করা যায় না? ভারতীয় কোন কোম্পানির রাইটস বিদেশী শেয়ার মার্কেটে নাকি ইস্যু করা যায় না⁶?
'যায় না' নয়, বলুন যেত না। কারণ মুকেশ ভাই ব্যতিক্রম। তাই দেখা গেলো মুকেশ ভাই-র 'রাইটস ইস্যু'র ইচ্ছে হওয়ার ঠিক আগেই, সেবি, প্রথম দুটি নিয়মই শিথিল করতে সার্কুলার জারি করেছে। আর অর্থমন্ত্রী স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার ভারতীয় কোম্পানির রাইটস ইস্যুর জন্য বিদেশের শেয়ার মার্কেটে ব্যবহারের অনুমতিও দিয়ে বসেছেন। অতএব, মুকেশ ভাই 'রাইটস ইস্যু'ও করলেন, ন্যাসড্যাকেই করলেন, ৮৪,৪৬৭কোটি ঘরেও তুললেন। রিলায়েন্স ঋণমুক্ত'ও হল। আর মুকেশ ভাই বিলিওনারিসের লিস্টে পঞ্চম স্থানে উঠেও এলো।
রিলায়েন্স ছাড়া আর কোন কোম্পানি নতুন নিয়মের ভিত্তিতে রাইটস ইস্যু করল? হঠাৎ কেনই বা এতদিনের নিয়ম শিথিল হল? কেন INX মিডিয়ার তদন্ত থমকে গেলো? উত্তর খুঁজে লাভ নেই। কারণ মুকেশ ভাই ব্যতিক্রম হতে পারেন, বেইমান নয়! গুরুদক্ষিণা বাবদ PMCares-এ ৫০০ কোটি উনি আগেই দিয়েছেন⁷!
এতক্ষণ সব ঠিকই ছিল। কিন্তু 'গুরুদক্ষিণা' কথা শুনেই কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আর অমনি বিরোধী কাকু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, "তো কি এমন অন্যায় হয়েছে? রিলায়েন্স অর্থনীতি তে কত কর্মসংস্থান তৈরি করে জানো? সরকার ওনাকে সুযোগ-সুবিধা দেবে না তো তোমাকে দেবে? র্যাস্কাল কোথাকার।"
আসলে বিরোধী কাকুর, ব্রেকফাস্টে চিজ-বাটার, লাঞ্চে পাৎসা আর ডিনারে লো-ক্যালরি কর্ণফেল্কস আছে। বিরোধী কাকুর, মাস গেলে বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে। তাই বিরোধী কাকুর, হাতে অ্যান্ড্রয়েড ফোন গুঁজে, দেশের অর্থনীতি নিয়ে বাতেলা দেওয়ার সুযোগ আছে। উইকঅ্যান্ডে 30ml স্কচের পেগে, "রিলায়েন্স অর্থনীতি তে কত কর্মসংস্থান তৈরি করে জানো?" -ভেবে নাবালক সুলভ অবাক হবার ফ্যান্টাসি আছে। দুঃখ একটাই, এতো কিছু 'আছে'র মধ্যে বিরোধী কাকুর শুধু গায়ে মানুষের চামড়া রাখার অভ্যাসটাই বাদ পড়ে গেছে।
না হলে বিরোধী কাকু জানতেন কর্মসংস্থান মানে কেবল হোয়াইট কলার জব নয়, কর্মসংস্থান মানে MNREGA-ও। না হলে জানতেন রিলায়েন্স গ্রুপে মোট কর্মসংস্থান ৭৫০০০। আর MNREGA-তে ৫.২কোটি⁸। না হলে জানতেন সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানিয়েছে ২০০৫-১৫ ২৭কোটি ৩০লক্ষ মানুষ কে দরিদ্রের অন্ধকার থেকে টেনে তুলছে ভারত⁹। কোনও রিলায়েন্স-র দৌলতে নয়, বরং MNREGA-র সৌজন্যে।
তাই যে আপনার আশে পাশের যে সব বিরোধী কাকুরা, কর্মসংস্থান বলতে রিলায়েন্স বোঝেন কিন্তু MNREGA বোঝেন না; কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ে কর্মসংস্থানের যুক্তি খোঁজেন, কিন্তু MNREGA-র বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাই হলে পুছেও দেখেন না; আম্বানি নিয়ে আদিখ্যেতা করেন, কিন্তু পাড়ার মস্তান তৃণমূল নেতা ক্যালাবে বলে রাজ্যে এসএসসি-টেটের কর্মসংস্থান নিয়ে ট্যাঁ-ফোও করেন না। এই দুঃসময়ে তাঁদের চিনুন। চিজ-বাটার-পাৎসা-কর্ণফেল্কসের নেপথ্যে তাঁদের শ্রেণী চরিত্রটা বুঝুন। চিনুন-বুঝুন, কারণেই পৃথিবীর রোগ একদিন ঠিক সেরে যাবে। তখন অবিকল মানুষের মত দেখতে এই জন্তুদের সোশ্যাল ডিসটেন্সিং লাগবে। কোয়রেন্টাইন লাগবে। দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা লাগবে।
সূত্র:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন