বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

টু কমরেডস ~ অর্ক রাজপন্ডিত

২৯শে আগস্ট সকাল ঠিক ৯টা ৫৫। ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর সিক্স ই টু ওয়ান থ্রি সিক্স সবে পাড়ি দিয়েছে শ্রীনগরের পথে।
সীতারামের সঙ্গে রয়েছেন তাঁর এক সহকর্মী। ঠিক বেলা সাড়ে এগারোটায় শ্রীনগর বিমানবন্দরের মাটি ছুঁলো বিমান। বিমান থেকে নামা মাত্রই দুই পুলিশ অফিসার এসে হাজির, একজনের নাম ইমতিয়াজ হোসেন, তিনি পুলিশের সিনিয়র সুপারিটেন্ডেন্ট। ইমতিয়াজ জানালেন সীতারামকে, তিনিই তাঁকে নিয়ে যাবেন তাঁর কমরেড তারিগামির কাছে। ইমতিয়াজ এও জানালেন সীতারামকে সেদিনই ঠিক বিকাল পাঁচটার দিল্লিগামী বিমানে তাঁকে উঠিয়ে দেওয়া হবে।
ইমতিয়াজকে থামালেন সীতারাম। স্পষ্ট বললেন, তিনি সেদিনই ফিরবেন কি না তা নির্ভর করছে কমরেড ইউসুফ তারিগামির স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর। সিংহ গর্জে উঠলো স্বমহিমায়। কনভয়ে তোলা হল সীতারাম এবং তার সহকর্মীকে। আগে পিছে পুলিশি গাড়ি। কনভয় থামলো গুপকার রোডে তারিগামির বাড়ির সামনে।
২৯শে আগস্ট, ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সাড়ে বারোটা। তারিগামির বাড়িতে পৌঁছলেন সীতারাম। ৫ই আগস্ট থেকে সহযোদ্ধাদের দেখেননি তারিগামী। ৫ই আগস্ট থেকে গৃহবন্দী তারিগামী। সীতারামকে দেখে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলেন। দুই কমরেড জড়িয়ে ধরলেন পরস্পরকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে।
তারিগামির বৈঠক খানায় বসলেন সীতারাম ও তারিগামী। পাক্কা একটি ঘন্টা অনাহুতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজ। সীতারাম জানতে চাইলেন ইমতিয়াজের কাছে, তারিগামির অপরাধ কি? ইমতিয়াজ বলে উঠলেন তারিগামির বিরুদ্ধে আইনি কোন অভিযোগই নেই, এবং তিনি নাকি ‘মুক্ত’। ইমতিয়াজকে এবার প্রশ্ন তারিগামির। তাঁর জেড প্লাস নিরাপত্তার গাড়ি গুলি কেন উধাও হয়ে গেল? কেন গত ২৫ দিন ধরে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাইরের কেউ যাতে ঘরে আসতে না পারে? কেন তাঁকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি?
তারিগামি সীতারামকে জানান, তিনি শেষ বারের মত শ্রীনগরের ‘শের ই কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স’ চিকিৎসার জন্য যান ৩১শে জুলাই। সেদিনই চিকিৎকরা জানান হার্ট এবং ফুসফুস সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করা দরকার।
৫ই আগস্ট এলো কারফিউ। ৫ই আগস্ট থেকে বাইরে শুধুই পুলিশি বুট। আর হাসপাতালে যাওয়া হয়নি তারিগামির। বারংবার তারিগামি এবং তার পরিবার জানিয়েছেন প্রশাসনকে চিকিৎসা করা দরকার। ১৯শে আগস্ট তাঁকে বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তায় দেখতে আসেন একজন কার্ডিওলজিস্ট। বার বার অনুরোধের পর ২৪শে আগস্ট পুলিশি ঘেরাটোপে তারিগামিকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘শের ই কাশ্মীর ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স’এ। তারিগামি হার্ট এবং ফুসফুস জনিত নানান সমস্যায় ভুগছেন। ভুগছেন ডায়াবিটিসের সমস্যাতেও। জানিয়েছেন সহযোদ্ধা সীতারামকে।
বৈঠকখানায় কথা চলতে থাকে। সীতারাম পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজকে অনুরোধ করেন ঘরের বাইরে যেতে, ইমতিয়াজ বাইরে গেলেও তারিগামির বাড়ি জুড়ে প্রহরা।
সীতারাম অনড় থাকেন। তাঁর দিল্লি ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সামনে একজন চিকিৎসককে ডাকতে হবে যিনি তারিগামির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে পুঙ্খানুপুঙ্খু তাঁকে জানাবেন। পুলিশ কর্তা ইমতিয়াজ সীতারামকে জানান পরের দিন সকালে অর্থাৎ ৩০শে আগস্ট সকালে একন ডাক্তার ডাকা সম্ভব।
সীতারাম পুলিশকে জানান আজ রাতটা তিনি তারিগামির বাড়িতেই থাকতে চান। পুলিশ নাছোড়বান্দা, তারা পাল্টা জানায় তারিগামির বাড়িতে থাকা যাবে না, অন্য কোথাও তাঁকে থাকতে হবে।
এরই মধ্যে বৈঠক খানায় আসেন তারিগামির স্ত্রী। তারিগামি এবং তাঁ স্ত্রী দুজনেই সীতারামকে জানিয়ে দেন তিনি যেন সুপ্রিম কোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ চালিয়ে যান। সুপ্রিম কোর্ট যদি অনুমতি দেয় তারিগামিকে নিয়ে আসা হবে দিল্লিতে এইমস’এ। তারিগামি এবং তার পরিবার সীতারামকে এও জানান, তাঁর পরিবার এমনকি নাতি নাতনিরাও ‘গৃহবন্দী’। তাঁর বাড়ির ল্যান্ডলাইন, মোবাইল বন্ধ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের সব পথই বন্ধ করে রেখেছে সরকার। বাড়িতে বন্দী, ফুরিয়ে আসছে টাকাও।
বিকাল সাড়ে চারটের সময় সীতারাম বিদায় নিলেন তারিগামির থেকে। বলে গেলেন কাল সকালে ফের আসবেন। তাঁর সামনেই ডাক্তাররা তাঁকে পরীক্ষা করবেন। সীতারামকে হাত মুঠো করে বিদায় জানালেন তারিগামি।
কনভয় ছুটলো রাস্তায় । ঝিলাম পেরিয়ে সরকারের গেস্টহাউসে সীতারামকে রাত্রিবাসের জন্য রাখা হল। পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায় সীতারাম চলে এলেন তারিগামির বাড়িতে। এসে গিয়েছেন চিকিৎসকও। ডাক্তার তাঁর নাম জানাতে চাননি!
ডাক্তারবাব স্পষ্ট জানালেন এখানে ডায়াবিটিসের চিকিৎসা সম্ভব নয়। ফুসফুস এবং চেস্ট ইনফেকশনের জন্য তারিগামির চিকিৎসা হওয়া উচিৎ এইমস’এ।
সীতারাম সব বুঝলেন, শুনলেন। সেদিন সকাল ১১টা ১০’এ সীতারাম এবং তাঁর সহকর্মী দিল্লিগামী বিমানে উঠলেন শ্রীনগর থেকে।
ও হ্যাঁ। দিল্লি থেকে শ্রীনগরের বিমান ভাড়া তো বটেই ফেরার বিমান টিকিট যা পুলিশ কেটেছিল তারও দাম মিটিয়েছেন সীতারাম।
ঝিলাম নদী পার হওয়া রাত্রিবাসের সরকারি অতিথিশালার বিলটিও মিটিয়েছেন সীতারমই!
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর।
আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ প্রশ্নে সব লিবেরালরা ন্যুড হয়েছিলেন।
এই এক মাসে কাশ্মীরে চলছে নিরন্তর অবরোধ। চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। পেলেটে মুখে আলপনা আঁকছে কাশ্মীরের যৌবন।
দু দু বার শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে এসেছিলেন কমরেড সীতারাম। তৃতীয় বার আর ফিরে আসেননি। কমরেড সীতারামকে রাষ্ট্র আটকাতে পারেনি।
আজ ৫ই সেপ্টেম্বর। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন তারিগামিকে নিয়ে আসতে হবে এইমস’এ।
জিতলেন সীতারাম। জিতলো সিপিআই(এম)।
ফ্যাসিস্টদের সামনে কোনদিন হাঁটু মুড়ে বসে থাকেননি কমিউনিস্টরা। সীতারামরা হারতে শেখেননি। স্থিতাবস্থাকে মেনে নিতে শেখেননি।
সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির হলফনামা ভারতের গণতন্ত্র, ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
সহযোদ্ধার জন্য এই লড়াইনামা ঠাঁই পাবেই ফ্যাসিবিরোধী দুনিয়া জোড়া লড়াইয়ের মহাফেজ খানায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন