আনুষ্ঠানিক শিক্ষক দিবস আজ।অবশ্যই ভারতবর্ষে।অন্য কোনো দেশ এই দিনে এই উদযাপন করেনা।একেক দেশের একেক তারিখ রয়েছে।এমনিতে ইউনেস্কো অক্টোবরের পাঁচ তারিখকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস বলে ঘোষণা করেছে ১৯৯৪ সালে।আমাদের দেশে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনে এই শিক্ষক দিবস উদযাপন করা শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সাল থেকে।অর্থাৎ যে বছর উনি রাষ্ট্রপতি হলেন।এটা ছিল ওঁর ছাত্রদের পরিকল্পনা।তাঁদের শিক্ষক দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন,এই উপলক্ষটিকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন তাঁরা।কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত গুরুদক্ষিণা যে আজ গোটা দেশের হয়ে দাঁড়িয়েছে।সেটার পিছনে অবদান স্বয়ং রাধাকৃষ্ণানেরই।---
" Instead of celebrating my birthday,
it would be my proud privilege if September 5th is observed as Teachers' Day."
নিজের জন্মদিনকে এভাবেই নিজের জীবদ্দশাতেই অমর করে দিয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি।
এমনিতে আমাদের দেশে গুরুপ্রণামের অন্য একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দিন ছিল।গুরুপূর্ণিমার দিন, যেটি এখন প্রায় বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছে।হিন্দু,বৌদ্ধ,জৈন সব শাখাতেই এই তিথির উদযাপন ছিল।
ভারতবর্ষ ভক্তির দেশ।
সে শিক্ষকই হোন আর রাষ্ট্রপ্রধানই হোন,ভক্তির আবেগ এ দেশে যুক্তি মানে না।তবে কিনা বেসুরো গাওয়া আমার চিরকালের অভ্যেস।তাই আজ যখন ফেসবুক ছেয়ে গেছে গুরুপ্রণামীর বন্দনামন্ত্রে তখন আমি একটা অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ তুলছি আপনাদের কাছে।এটা গত বছর ফেসবুকে লিখেছিলুম।আজ ফিরে শেয়ার করছি।
জানেন কি,আমাদের দেশ এমন একজনের জন্মদিনে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা জানায়,যিনি নিজে শিক্ষক হয়ে ছাত্রতুল্য গবেষকের গবেষণা থেকে টুকে বই লিখে ধরা পড়েছিলেন?সে অন্যায়ের জন্য তিনি শাস্তি পাননি।নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অপরপক্ষকে বাধ্য করেছিলেন বিষয়টি মিটিয়ে নিতে।আঁতকে উঠছেন?উঠবেন না।ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান প্লেজিয়ারিজমের দায়ে আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে উঠেছিলেন।সেই কলঙ্কিত ইতিহাস আজ তাঁর জন্মদিনে একটু স্মরণ করি।
১৯২৯ এর জানুয়ারি।মিরাট কলেজের দর্শনের তরুণ অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ সারা ভারতের সারস্বত সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে ছাপার অক্ষরে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তুলে।প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য প্রদত্ত যদুনাথের গবেষণা "ইন্ডিয়ান সাইকলজি অব পারসেপশন" প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড থেকে ব্যাপকভাবে টুকে সে সময় ধরা পড়েছিলেন রাধাকৃষ্ণান।
যদুনাথ সিংহ "ইন্ডিয়ান সাইকোলজি অব পারসেপশন" নাম দিয়ে একটি বৃহৎ গবেষণা প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন যার প্রথম খণ্ড ১৯২২ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড ১৯২৩ সালে তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন।পুরো গবেষণাটি শেষ হয়েছিল ১৯২৫ নাগাদ।ওই সময়েই বাকি খণ্ডগুলিও জমা দিয়েছিলেন যদুনাথ।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাথমিকভাবে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল এবং সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানকে এই গবেষণার পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন।দ্বিতীয় খণ্ড থেকে পরবর্তী খণ্ডগুলি পড়বার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রাধাকৃষ্ণানের সঙ্গে সঙ্গে জনৈক অধ্যাপক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যকেও সেই সময় দায়িত্ব দিয়েছিলেন।১৯২২ সালে যদুনাথ বৃত্তিটি লাভ করেছিলেন।
১৯২৫ সালে যদুনাথের গবেষণা শেষ হয়েছিল।আর ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রাধাকৃষ্ণানের সাড়া জাগানো বই "ইন্ডিয়ান ফিলজফি"র দ্বিতীয় খণ্ড।যদুনাথের মুশকিল ছিল এই যে সুদূর মিরাটে থাকার দরুন কলকাতার সারস্বত সমাজের সব খবর যথাযথ সময়ে ঠিকঠিক তিনি পেয়ে উঠতেন না।ফলে তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পান নি যে তাঁর মৌলিক গবেষণাকর্মটি থেকে রাধাকৃষ্ণান একপ্রকার পুকুরচুরি করে বসে ছিলেন।চুরিটা তাঁর গোচরে এল যখন পরের বছর অর্থাৎ ১৯২৮ সালে রাধাকৃষ্ণানের "দ্য বেদান্ত অ্যাকর্ডিং টু শংকর অ্যান্ড রামানুজ" নামে আরো একটি বই বেরোল।এই বইটি ছিল আসলে "ইন্ডিয়ান ফিলজফি" দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম এবং নবম অধ্যায়ের একটি স্বতন্ত্র পুনর্মুদ্রণ।এই বইটি পড়েই যদুনাথ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে তাঁর গবেষণার প্রথম দুটি অধ্যায় থেকে অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ নিজের বইতে টুকে বসে আছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান।
যদুনাথ সিংহ ছিলেন প্রকৃতই সিংহপুরুষ।এযুগের একলব্য হওয়ার বাসনা তাঁর ছিল না।শ্রদ্ধেয় আচার্য রাধাকৃষ্ণানের চৌর্যকে তিনি রেহাই দেন নি।প্রাথমিকভাবে ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ যদুনাথ সরাসরি রাধাকৃষ্ণানকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করে দীর্ঘ এক পত্র লিখে পাঠিয়েছিলেন তৎকালের বিখ্যাত "মর্ডার্ন রিভিয়্যু" ইংরেজি পত্রিকার দপ্তরে।এত কাগজ থাকতে মর্ডার্ন রিভিয়্যু কেন?কারণ রাধাকৃষ্ণানের "ইন্ডিয়ান ফিলজফি" দ্বিতীয় খণ্ড বের হওয়ার এই পত্রিকাই দেখিয়েছিল যে রাধাকৃষ্ণান তাঁর বেশ কিছু সিদ্ধান্তের পিছনে যথাযথ যুক্তিপরম্পরা এবং তথ্যসূত্র উল্লেখ করেনি।তারা সে নিয়ে প্রশ্নও তুলেছিল।কিন্তু রাধাকৃষ্ণান কোনো জবাব দেন নি।
যাই হোক,যদুনাথ সিংহ ২০ ডিসেম্বর ১৯২৮ তারিখে তাঁর প্রথম চিঠিটি লিখে পাঠালে মর্ডার্ন রিভিয়্যু সেটি ১৯২৯ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশ করে।একটি চিঠি লিখেই যদুনাথ ক্ষান্ত হননি।তাঁর আরো তিনটি চিঠি এই পত্রিকাতেই পরপর ছাপা হয় ফেব্রুয়ারি,মার্চ এবং এপ্রিলে।এখানে একটি তথ্য জানানো দরকার যে রাধাকৃষ্ণানের দুর্ভাগ্যক্রমে এবং যদুনাথের সৌভাগ্যক্রমে যদুনাথের গবেষণাকর্মের প্রথম দুই অধ্যায়ের(যেখান থেকে রাধাকৃষ্ণান টুকেছিলেন) নির্যাস নিয়ে যদুনাথ বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রাধাকৃষ্ণানের বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে মিরাট কলেজের পত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলেছিলেন।এই খবরটা সম্ভবত রাধাকৃষ্ণান জানতেন না।কিন্তু এর ফলে যদুনাথের পক্ষে রাধাকৃষ্ণানের চুরি প্রমাণ করার কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।মর্ডার্ন রিভিয়্যুর পাতায় নিজের লেখা থেকে এবং রাধাকৃষ্ণানের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করে করে যদুনাথ চুরির বহর সে সময় সবিস্তারে দেখিয়েছিলেন কিস্তিতে কিস্তিতে।চুরি তো নয়,নিলাজ টুকলির এক ইতিবৃত্ত সেটি।
বিক্ষুব্ধ যদুনাথের একটি পত্রাংশ আপনাদের এখানে পড়াই।--
"It is indeed true that not only in our unfortunate land, but all over the world, self praise is sought by some by dispraise of others. But this is comparatively a trifling thing. It pales into insignificance when compared with the moral perversity involved in the violation of sacred trust by a cultured and honorable man if and when there is any. I sincerely pray, all scholars, young and old may outgrow this perversity"
আসলে যদুনাথের চিঠি মর্ডার্ন রিভিয়্যু ছাপতে শুরু করলে চারদিকে যে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল,তাতে রাধাকৃষ্ণানের পক্ষে আর চুপ করে থাকাটা তখন অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল।ফলে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনিও পালটা দুটি চিঠি মর্ডার্ন রিভিয়্যুতে লিখেছিলেন।কিন্তু সেগুলির না ছিল মাথা না ছিল মুণ্ডু।এই চিঠিগুলিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে রাধাকৃষ্ণান আসলে যদুনাথ সিংহকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছিলেন।প্রাথমিকভাবে রাধাকৃষ্ণানের বক্তব্য ছিল এই যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে দু'জনে কাজ করলে,বিশেষত দর্শনের মতো বিষয় হলে,কিছু কিছু পারিভাষিক শব্দ এক হয়েই যায়।কিন্তু মুশকিল হল,কিছু পারিভাষিক শব্দ এক হওয়া আর অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ মিলে যাওয়া তো এক নয়।এটা রাধাকৃষ্ণানও বুঝতেন।তাই এরপরে যদুনাথের বিরুদ্ধে তিনিই উলটে প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ হেনে বসেন।তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে তিনি তাঁর বইয়ে প্রকাশিত বক্তব্য আগেই নানা বক্তৃতায় এবং ক্লাসে পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন এবং যদুনাথ সেইখান থেকে অমুদ্রিত বক্তব্যগুলি চুরি করে নিজের লেখায় ছাপিয়ে দিয়েছেন তাঁর বই বেরোবার আগেই।এবং যদুনাথ নাকি প্রসিদ্ধ চোর যিনি আগেও নানা লেখকের মত চুরি করে নিজের গবেষণাপত্রে ছাপিয়েছেন।উদাহরণ হিসেবে রাধাকৃষ্ণান নাম করেন গঙ্গানাথ ঝা'য়ের।
দ্বিতীয় বক্তব্যটা ছিল একেবারেই বাজে কথা।যদুনাথ সিংহ সম্পর্কে এরকম উদ্ভট কথা আগে বা পরে কেউই কখনো বলেননি।।রইলো প্রথমটি।যদুনাথ এম.এ. পাস করেন ১৯১৭ সালে।তখনো রাধাকৃষ্ণান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে আসেননি।কাজেই যদুনাথকে ওঁর ক্লাসের ছাত্র বলা যায় না।মিরাট কলেজে যাওয়ার আগে যদুনাথ কিছুকাল ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।রাধাকৃষ্ণান দক্ষিণ ভারতে থাকাকালীন কিছু বক্তৃতা দিয়ে থাকলে সুদূর বঙ্গদেশে বসে তার হদিশ পাওয়া যদুনাথের পক্ষে প্রায় অসম্ভবই ছিল।রাধাকৃষ্ণান যখন কলকাতায় আসেন তখন যদুনাথ ঢাকায়।সেখান থেকেও নিয়মিত কলকাতায় এসে রাধাকৃষ্ণানের বক্তৃতা শোনা তাঁর পক্ষে কতদূর সম্ভব ছিল সে নিয়ে সন্দেহ আছে।তারপরে তো তিনি মিরাটে চলেই যান।
কিন্তু এসবের থেকেও বড়ো কথা হল এই যে যদুনাথের মূল গবেষণাটির প্রথম দুটি খণ্ড যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন রাধাকৃষ্ণান নিজেই তো ছিলেন সেগুলির অন্যতম পরীক্ষক।ওই দুটি খণ্ডের নির্যাসই তো যদুনাথ মিরাট কলেজের মুখপত্রে ছাপিয়েছিলেন।কাজেই ওই প্রবন্ধগুলি না পড়লেও মূল গবেষণাটি পড়বার সময় রাধাকৃষ্ণান কি দেখেননি যে যদুনাথ সিংহ তাঁর বক্তৃতা থেকে চুরি করে কিছু লিখেছেন।১৯২২ থেকে ১৯২৯ অবধি রাধাকৃষ্ণান চুপ করে বসে ছিলেন কেন?তিনি তো আগাগোড়া যদুনাথের পরীক্ষক ছিলেন।যদুনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি তো দিয়েছিলই, তাছাড়াও ১৯২৩ সালে গ্রিফিথ পুরস্কার এবং ১৯২৫ সালে মোয়াট মেডেল পেয়েছিলেন যদুনাথ।১৯২৫ সালেই তাঁর আলোচ্য গবেষণাটি শেষ হয়।এত কাণ্ড হল স্রেফ চুরির উপর দাঁড়িয়ে আর রাধাকৃষ্ণান নীরব রইলেন,এটা বিশ্বাসযোগ্য?সেই সময় যদুনাথের তুলনায় তিনি অনেক বেশি খ্যাত্যাপন্ন ছিলেন।তিনি অভিযোগ তুললে তা গুরুত্বের সঙ্গেই বিচার করা হত।ওইসব সংক্রান্ত বক্তৃতা তিনি সত্যি কিছু দিয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তাঁর কাছে নিশ্চয় ছিল।তো প্রমাণ হিসেবে তিনি সেগুলি দেখালেন না কেন?
আসলে রাধাকৃষ্ণান হয়তো ভেবেছিলেন যে এ দেশের আর পাঁচটা ভীরু ছাত্রের মতো এই যদুনাথও তাঁর খ্যাতি আর পদকে ভয় করে চুরি হজম করে যাবেন।কিন্তু তা যখন হল না,দেখা গেল পদবীর সিংহ আদপেই সিংহ,তখন আক্রোশ প্রকাশ করে কালি ছিটোনো ছাড়া রাধাকৃষ্ণান কীই বা করতেন?তিনি সম্ভবত গোটা ব্যাপারটা মর্ডার্ন রিভিয়্যুর পাতায় ফাঁস হওয়াতেই আরো ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।এই কাগজটির প্রতি তাঁর প্রসন্নতা ছিলনা কারণ তাঁর বইয়ের অসংগতি নিয়ে এরাই প্রথম কথা তুলেছিল।ফলে রাধাকৃষ্ণান প্রচার করতে শুরু করেন যে তাঁকে অপদস্থ করবার একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে যাতে যদুনাথের পাশাপাশি যুক্ত আছে মর্ডার্ন রিভিয়্যু পত্রিকাও।এই মর্ডার্ন রিভিয়্যু ছিল বাংলা প্রবাসী কাগজের সহোদর প্রকাশনা।দুটিই এলাহাবাদ থেকে বের হতো আর দুইয়েরই সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।রাধাকৃষ্ণানের এই ভিত্তিহীন ও আপত্তিজনক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রামানন্দ বিরাট এক সম্পাদকীয় লিখেছিলেন সেই সময়।রাধাকৃষ্ণান আত্মপক্ষ সমর্থনে যে কথাগুলি বলছিলেন সেগুলি যে নিতান্ত জোলো ছিল তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন।যদুনাথের আক্রমণ রাধাকৃষ্ণান সামলাতে পারেননি।ফলে যদুনাথের চারটে চিঠির উত্তরে তিনি দুটি চিঠি লিখেই ক্ষান্ত হন।
কিন্তু যদুনাথ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো ছিলেন না।১৯২৯ এর আগস্টে কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয়ে যদুনাথ স্বত্বাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ দাবী করেন কুড়ি হাজার টাকা।সেই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায় যে যদুনাথ সিংহ আদালতে দাবী করেছিলেন রাধাকৃষ্ণানের অভিযুক্ত বইগুলির সমস্ত অবিক্রিত কপি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার।তিনি চেয়েছিলেন হয় চুরি করে লেখা অংশগুলি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপুন রাধাকৃষ্ণান অথবা ওই অংশগুলির জন্য তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিন এবং বই বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত লভ্যাংশেরও ন্যায্য ভাগ দিন।এই খবর সে সময় ছাপা হয়েছিল "বসুমতী","বঙ্গবাণী","দ্য পাইয়নিয়র","দ্য হিন্দুস্থান টাইমস","ইস্ট বেঙ্গল টাইমস","দ্য লিডার","দ্য লিবার্টি" প্রভৃতি নামী সব খবরের কাগজে।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের মতো প্রভাবশালী বিদ্বজ্জনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো মেরুদণ্ডের জোর ছিল যে যদুনাথ সিংহের তাঁর পরিচয় রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিনে শিক্ষকদিবস পালন করা আজকের বাঙালি বিশেষ জানেনা।এখানে সে পরিচয় একটু দিই।
১৮৯২ সালে জন্মানো যদুনাথ সিংহ ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি ধর্মতাত্ত্বিক,সুলেখক ও দার্শনিক।বেদান্ত,যোগ,শক্তিসাধনা,বৈষ্ণব তত্ত্ব,নীতিশাস্ত্র,তর্কশাস্ত্র,মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে চল্লিশটিরও বেশি বই এবং অসংখ্য নিবন্ধের রচয়িতা যদুনাথ সিংহের সারস্বত কৃত্যের গুরুত্ব পণ্ডিতসমাজ মাথা পেতেই নিয়েছিল।এ দেশে তো বটেই বিদেশের নানা জায়গা থেকেও তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে,সমাদৃতও হয়েছে।কলকাতার রিপন কলেজ,সিটি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদুনাথের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষালাভ ঘটেছিল।দর্শনের ছাত্র হিসেবে তাঁর কেরিয়ার ছিল তাক লাগানো।রাধাকৃষ্ণানের মতো বাধ্যত দর্শন পড়েননি তিনি।১৯১৫ সালে ফিলিপ স্যাম্যুয়েল স্মিথ পুরস্কার এবং ক্লিন্ট স্মৃতি পুরস্কার পেয়ে তিনি দর্শনে স্নাতক হন।অতঃপর ১৯১৭ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত হওয়া।ততদিনে তাঁর বিদ্যাবত্তার খ্যাতি এতদূর ছড়িয়েছিল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তরের ফল প্রকাশ করার আগেই তিনি রিপন কলেজে সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।পরে যদুনাথ সিংহ রাজশাহী সরকারি কলেজ এবং ঢাকা জগন্নাথ কলেজেও অধ্যাপনা করেছেন।সবশেষে মিরাটে বিভাগীয় প্রধানের পদ নিয়ে চলে যান এবং ১৯৫৩ অবধি ওখানেই ছিলেন।তিনি চাকরির মেয়াদ পুরো করেননি।অবসরের আগেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন।নিজের জ্ঞানচর্চার জগতে সম্বৃত হয়ে গিয়েছিলেন।আর শেষজীবনে অধ্যাত্ম ছিল যদুনাথের অবলম্বন।১৯৭৮ সালে যদুনাথ সিংহের জীবনাবসান হয়েছিল।
যাই হোক,প্রসঙ্গে ফিরি।রাধাকৃষ্ণান হয়তো ভেবেছিলেন যে যদুনাথের চিঠির উত্তরে তিনি নীরব থাকলে ব্যাপারটা মিটে যাবে,চাপা পড়বে।কিন্তু সেটা হল না।যদুনাথ আদালতে গেলেন।ফলে আক্রমণ আত্মরক্ষার সর্বোত্তম উপায়----এই নীতি নিলেন রাধাকৃষ্ণান।যদুনাথ কর্তৃক মামলা দায়ের হওয়ার একমাসের মাথায় ১৯২৯ এর সেপ্টেম্বরের গোড়ায় ওই একই ন্যায়ালয়ে রাধাকৃষ্ণানও একটি পালটা মামলা ঠুকলেন এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবী করে।তিনি মানহানির অভিযোগ এনেছিলেন যদুনাথ সিংহের পাশাপাশি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও।সেই সময় এটি ছিল কলকাতার একটি অন্যতম "গরম খবর"।
রাধাকৃষ্ণানের আচরণ নিয়ে এখানে একটু বলি বন্ধুরা।এক তো তিনি নিজের মৌলিক ভাবনা টুকে লেখা হয়েছে এমন এক গবেষণাপত্র পরীক্ষা করে গবেষককে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রদান করে তারপরে আরো সাত বছর সন্দেহজনক ভাবে নীরব ছিলেন।তারপরে যখন বিষয়টি সামনে এলো,তখনো তাঁরই কি উচিত ছিল না প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগে যদুনাথের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া?যখনও বা গেলেন,অভিযোগ করলেন মানহানির।কেন?প্লেজিয়ারিজম প্রমাণ করার অসুবিধা ছিল?যদুনাথ সিংহ যখন মর্ডার্ন রিভিয়্যুতে চার কিস্তি ধরে তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন,তখনই কি তাঁর যথেষ্ট মানহানি হয় নি?তাহলে এপ্রিলে যদুনাথের লেখা থামার পর সেপ্টেম্বর অবধি মানহানির মামলা না করে ছিলেন কেন রাধাকৃষ্ণান?যদুনাথের আদালতে যাওয়ার অপেক্ষায় কি ছিলেন তিনি?উত্তর সহজ।চোর নিজে যেচে থানার চৌকাঠ কবেই বা মাড়ায়?আর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কেই বা মামলায় জড়ানো কেন?মর্ডার্ন রিভিয়্যুর উপর এত ক্রোধ কেন ছিল তাঁর?তিনি কি জানতেন না যে পত্রিকা যদুনাথের চিঠিগুলি ছেপেছে বটে,কিন্তু পত্রের বক্তব্যের দায় তো পত্রলেখকেরই।তাছাড়া মর্ডার্ন রিভিয়্যু তো রাধাকৃষ্ণানেরও দুটি চিঠি ছেপেছিল।আসলে এর কি কারণ কি এই যে মর্ডার্ন রিভিয়্যু ১৯২৭ সালে রাধাকৃষ্ণানের বই সম্বন্ধে "inadequate references" ছাড়াও "faulty English","ignorance of Bengali","lack of Sanskrit learning" ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ হেনেছিল?রাধাকৃষ্ণান যতই সেসময় বলুন না কেন,"I respect the rights of reviewers to hold any opinion they please regarding works which are public property",আসলে তিনি তো রক্তমাংসেরই মানুষ।
এত কাণ্ডের পরেও যদুনাথ সিংহ কিন্তু সুবিচার পাননি।কেন জানেন?কারণ দেশটা ভারতবর্ষ।সে সময় কলকাতার তাবৎ পণ্ডিতসমাজের চোখে আসল ঘটনা কী তা বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন যদুনাথ।এখানকার শিক্ষাজগতের প্রবীণ সদস্যেরা প্রায় সকলেই যদুনাথের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিয়েছিলেন।অনেকেই সহানুভূতিশীলও ছিলেন প্রকৃত বিদ্বান এই মানুষটির প্রতি।কিন্তু সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের খ্যাতি-প্রতিপত্তি,সারস্বতসমাজ ও রাজনৈতিক মহলে তাঁর প্রতাপের কারণে এঁরা কেউ সেদিন রাজি হননি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে।বরং রাধাকৃষ্ণানের অপ্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে যদুনাথ সিংহের উপর তখন নানাভাবে চাপ তৈরি করা হয়েছিল আদালতকক্ষের বাইরে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য।এমনকি যদুনাথের গবেষণাপত্রের অন্যতম পরীক্ষক ব্রজেন শীল মশাইও "বিশেষ অনুরোধ" করেছিলেন যাতে তাঁকে এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে না ডাকা হয়।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও ছিল সেই সময় আশ্চর্যজনক।তাঁদেরই এক অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁদেরই এক গবেষকের মামলা চলছে তাঁদেরই শিলমোহর পাওয়া গবেষণা নিয়ে,অথচ তাঁরা একটি শব্দও প্রকাশ্যে এ নিয়ে খরচ করেননি তখন।
ঘরে বাইরে নানা চাপ সত্ত্বেও যদুনাথ সিংহ মামলা হয়তো তুলতেন না যদি তাঁর আর্থিক টানাপোড়েন না তৈরি হতো।১৯২৯ এর আগস্টে শুরু হয়ে মামলা চলেছিল ১৯৩৩ এর মে মাসে।মামলার বিপুল খরচ টানা তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে উঠছিল।রাধাকৃষ্ণান সেই সময় মাসিক এক হাজার টাকা বেতন পেতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।তাঁর পক্ষে আর্থিক টান খুব বেশি ছিল না।তাঁর স্বজন বন্ধুর অভাব যেমন ছিল না তেমনি ছিল চাতুর্য।তিনি আদালতে যদুনাথের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করতে পারেননি কিন্তু মামলাটিকে জটিল করে দিয়ে দীর্ঘ আয়ু দিয়েছিলেন।তবে শেষ অবধি মামলাটি চলতে দিলে কী হত বলা যায় না।কিন্তু বিষয়টির মধ্যে সহসাই নাক গলালেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।ইনি ছিলেন রাধাকৃষ্ণানের বিশেষ বন্ধু এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য।সরকারিভাবে নয় অবশ্য,শ্যামাপ্রসাদ ব্যক্তিগতভাবেই এর মধ্যে ঢুকেছিলেন তখন।আসলে ১৯২১ সালে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল উপাচার্য হয়ে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ই রাধাকৃষ্ণানকে পঞ্চম জর্জ অধ্যাপক পদে এখানে নিয়ে আসেন।ফলে আশুতোষপুত্র শ্যামাপ্রসাদও যে রাধাকৃষ্ণানের হয়েই কাজ করবেন এটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল।মূলত এঁর হস্তক্ষেপেই যদুনাথ পিছু হটতে বাধ্য হন।দুটি মামলারই রফা-নিষ্পত্তি হয় আদালতের বাইরে।১৯৩৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অ্যাক্টিং চিফ জাস্টিস ফণীভূষণ চক্রবর্তীর সামনে একটি ডিক্রির মধ্যে দিয়ে দুটি মামলা মিটিয়ে দেওয়া হয়।ডিক্রির শর্তগুলি কিন্তু আজও কেউ জানে না।
এখানে একটা কথা মনে আসা স্বাভাবিক,যদি বাস্তবিক যদুনাথ দোষী ও মিথ্যাভাষী ছিলেন আর রাধাকৃষ্ণান ছিলেন নিরাপরাধ,তাহলে রাধাকৃষ্ণানের তরফে কেন বারেবারে চাপ দিয়ে আপোষে মামলা মেটানো হল?রাধাকৃষ্ণান কেন আদালতের কাঠগড়ায় যদুনাথের মুখোশ খুলে দিলেন না?রাধাকৃষ্ণানের পক্ষে যে তিনজন খ্যাতকীর্তি পণ্ডিত সেই সময় আদালতে বক্তব্য রেখেছিলেন সেই নলিনী গঙ্গোপাধ্যায়,কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রী এবং গঙ্গানাথ ঝা,এঁরা প্রত্যেকেই ওই রাধাকৃষ্ণানের ক্লাসে পড়ানোর তত্ত্বটাই তখন আওড়েছিলেন।ওঁদের বক্তব্য ছিল যদুনাথ নিশ্চয় রাধাকৃষ্ণানের ছাত্রদের কাছ থেকে ক্লাসনোটস হাতিয়ে নিজের লেখাটি তৈরি করেছিলেন।কেউ কেউ এমনকি স্বয়ং রাধাকৃষ্ণানও বলেছিলেন যে উভয়ের লেখায় সাদৃশ্যের অংশটুকু চুরি হতেই পারে না কারণ ওগুলো হল কিছু মূল সংস্কৃত রচনার সারানুবাদ।সারানুবাদে তো মিল থাকতেই পারে।কিন্তু খেয়াল করুন আপনারা,মিল যদি শুধু সারানুবাদই হবে তাহলে আবার যদুনাথের বিরুদ্ধে উলটো প্লেজিয়ারিজমের অভিযোগ তো আসতে পারে না।আরো খেয়াল করুন,গঙ্গানাথ ঝা,যাঁর লেখা থেকেও যদুনাথ টুকেছিলেন বলে রাধাকৃষ্ণান ১৯২৯ সালে অভিযোগ করেছিলেন(মূল গবেষণাটি পরীক্ষা করার সময় এই চুরিটাও রাধাকৃষ্ণান দেখেননি বোধহয়।আসলে তখন দেখার দরকারই তো ছিল না।),সেই গঙ্গানাথও আদালতে যদুনাথের বিরুদ্ধে যখন সাক্ষী দিতে এলেন একবারের জন্যও বললেন না তিনি নিজেও যদুনাথের চুরির শিকার!!কিমাশ্চর্যম!!
"ইন্ডিয়ান ফিলজফি" হল রাধাকৃষ্ণানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ।এই বইটির পরিপ্রেক্ষিতেই একের পর এক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠগুলির দরজা রাধাকৃষ্ণানের কাছে খুলে গিয়েছিল।অজস্র সাম্মানিক ডক্টরেট,বক্তৃতার সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণান।বৃটিশ রাজদরবার তাঁকে নাইটহুড সম্মানেও অলংকৃত করেছিল সেই সময়।সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের প্রতিপত্তি কতটা ছিল সেই সময় তা বুঝতে পারি যখন দেখি ১৯৩১ সালে প্লেজিয়ারিজমের মতো অভিযোগে মামলা চলাকালীন তিনি অক্লেশে অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে গিয়েছিলেন।১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদুনাথ সিংহকে পিএইচ.ডি. উপাধি প্রদান করে।ভাগ্যিস,তখন রাধাকৃষ্ণান তাঁর পরীক্ষক আর ছিলেন না।এই উপাধি কি তখন মামলা তুলে নেওয়ায় সান্ত্বনা পুরস্কার গোছের কিছু ছিল?কে জানে।
আমরা বুনো রামনাথের দেশের মানুষ।গৌতম বুদ্ধের মতো সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আমাদের দেশ।এ দেশের মাটিতেই জন্মেছেন অতীশ দীপঙ্করের মতো আচার্য।এ দেশে জন্মানো বিশ্ববরেণ্য মহাকবি দেশের জন্য তাঁর শিক্ষাচিন্তার ফসল হাতেকলমে তৈরি করে দেখিয়েছেন যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না।আমাদের কি শিক্ষক দিবস পালনের জন্য তারিখের এতই দৈন্য ছিল?রাধাকৃষ্ণান নিজের জন্মদিনকে "শিক্ষক দিবস" করে দিয়ে একে যে অমরতা দিয়েছিলেন তা কি নিজেকে সর্বকালের আদর্শ শিক্ষক ভেবে নিয়ে?তাই বা কে জানে।বড়ো বিচিত্র এ আত্মশ্লাঘা।তবে আজ যখন চারপাশে তাকিয়ে দেখি কোনো সর্বজনশ্রদ্ধেয় আচার্য ভুয়ো পিএইচ.ডি. দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসেন অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বজনপোষণের অভিযোগে কিংবা আর্থিক কেলেংকারির দায়ে জেলযাত্রা করেন,কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর কোনো অধ্যপককে বিবৃতি দিয়ে প্লেজিয়ারিস্ট ঘোষণা করার পরেও তিনি বুক ফুলিয়ে মুখে রং মেখে সং সেজে হাততালি কুড়োন অথবা ভিনদেশি লেখকের গবেষণা থেকে টুকে বই লিখে ধরা পড়া কোনো অ্যাকাডেমিশিয়ান যুগের হাওয়ায় হয়ে বসেন কোনো গবেষণাপ্রকল্পের নিয়ামক,তত্ত্বাবধায়ক তখন মনে হয় ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হওয়াটাই এ দেশের নিয়তি।এর চেয়ে বড়ো আয়রনি আর কী হতে পারে?
আমি যাঁদের আমার আচার্য বলে শিক্ষক বলে আক্ষরিক অর্থেই মনে করি,শ্রদ্ধা করি,তাঁদের কাউকেই আমি এই দিনে আলাদা করে কোনো সম্ভাষণ বা প্রণাম জানাই না।শিক্ষক হিসেবে নিজেরও এই দিনে কোনো সম্ভাষণ পেতে কেমন ক্লিন্ন লাগে।আপনারা কী ভাবছেন?
এই গোটা লেখাটির তথ্যসূত্রঃ
★Dr. Sarvepalli Radhakrishnan: The teacher who stole from his student's thesis--Utpal Aich
★The Strange Meaning of Teachers' Day in India----Ratnesh Katulkar
★Jadunath Sinha---Internet archive
★'Subcontinental plagiarism' ---Idrees Bakhtiar
★A reported case of Radhakrishnan's literary piracy---Bārīna De
★Radhakrishnan: His Life and Ideas----
K. Satchidananda Murty, Ashok Vohra
★Radhakrishnan: A Religious Biography---Robert Neil Mino
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন