সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে কারুর সম্পর্কে বলেছিলেন যে সে কী করে বলবে, তার তো কোলে ছেলে? প্রসঙ্গ ছিল কোনো একটা বিষয়ে প্রতিবাদ করা যে ব্যাপারে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি অপারগ কারণ তার কোনো একটা নাছোড় পিছুটান বা ভালনারেবিলিটি আছে | "কোলে ছেলে" ছিল চূড়ান্ত ব্যক্তিগত পিছুটানের প্রতীক |
বাংলার চলতি বিধানসভা ভোট এই সাধারণভাবে সত্যি অসাধারণ অবলোকনটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে |
সেদিন হালিশহরে একটি সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে লাঠি দিয়ে পেটায় শাসক দলের গুণ্ডারা! কারণ বাচ্চাটির পরিবারে বিরোধী সমর্থক আছে! অবাক হবেননা না বন্ধুগণ, কারণ গতকালই ভাঙরে একটি দশ বছরের বাচ্চাকে বেধড়ক পিটিয়ে ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কারণ সেই নাকি শাসক দলের "পোস্টার ছিঁড়েছে" |
অবাক হন এর পরের খবরটিতে | হালিশহরের ওই বাচ্চাটির মা গুণ্ডাদের হুমকি উপেক্ষা করে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন!
বাংলায় এখন রাজনৈতিক তর্কের কোনো পরিসর নেই, যেটা আমাদের এই কদিন আগেও ছিল | যেমন ধরুন কৃষিজমিতে শিল্প হওয়া উচিত কিনা; হলে জীবিকা-হারাদের কী হবে, না হলে জমি আসবে কোথা থেকে, সেজ হওয়া কাম্য কিনা, হলে কী শর্তে, ভর্তুকি দেওয়া ঠিক কী না, ইত্যাদি | এই ধরনের প্রশ্নের এখন কোনো পরিসর নেই কারণ রাজনীতির মঞ্চ দখল করেছে গুন্ডা আর চোরাকারবারীরা, যে চোরাকারবার শুরু হয়েছিল ভুয়ো ডকটরেট ডিগ্রি দিয়ে আর সারদা নারদ পেরিয়ে প্রতিদিনের ব্যবসার সর্বশেষ নিদর্শন জাল ছবি দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন, কৃতিত্বে শাসক দলের সাংসদ ! বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, সিন্ডিকেট মাফিয়া, ওয়াগন-ব্রেকার তো ছেড়েই দিলাম | এদের হাত থেকে মুক্তি এবং ন্যুনতম গণতন্ত্রের আশাই (যাতে কার্টুন ফরওয়ার্ড করে আর সারের দাম বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করে অন্তত জেলে যেতে না হয়) এখন মূল ইস্যু, তাই রাজনৈতিক প্রশ্ন আপাতত তোলা আছে | এমনকি একদম হালের প্রশ্নও হালে খুব একটা পানি পাচ্ছেনা, যথা বহু কষ্টে প্রতিষ্ঠিত কমিশনগুলোকে, স্কুল সার্ভিস কলেজ সার্ভিস পাবলিক সার্ভিস, প্রায় তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো কার স্বার্থে, পঞ্চায়েতের অধিকার প্রশাসন দিয়ে খর্ব করা হচ্ছে কেন, শিল্পের ব্যাপারে রাজ্যের জমি নীতিটা ঠিক কী, চা-বাগানের জীবন-মরণ পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান কী, চাষীরা দাম পাচ্ছেন না কেন, ডোল-পলিটিক্সকে আদৌ কোনো উন্নয়ন বলা যায় কিনা, ইত্যাদি |
এই খরতাপ, লু-বওয়া বৈশাখের বাংলায় আপাতত এই প্রশ্নগুলো তোলা আছে | কারণ চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে ঘুষ খাওয়া, প্রধান শিক্ষিকাকে যোগ ছোঁড়া, পুলিশকে চর মারা, ক্রমাগত প্রকাশ্য সভায় বিবিধ হুমকি দিয়ে চলা নেতারা কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে | দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র বিরোধী পোলিং এজেন্ট হওয়ার "অপরাধে" খুন হলেন তিনজন, ক্রমাগত হামলা অব্যাহত | আর শেষ অবধি দেখা গেল যে দুটি শিশুকে আক্রমণ করলো ঠ্যাঙ্গারেরা |
গল্পটা এখানেই শেষ করার ইচ্ছা ছিল শাসকের | কিন্তু হলো কই!
সাড়ে তিন বছরের মেয়ে মার খাওয়ার পর তাকে কোলে নিয়ে ভোট দিলেন হালিশহরের দেবশ্রী ঘোষ, শুধুমাত্র ভোট দিতে যাওয়ার "অপরাধে" দুর্বৃত্তরা দুটো হাত লাঠি দিয়ে মেরে ভেঙে দেওয়ার পর আরো জেদ নিয়ে ভোট দিলেন গয়েশপুরের পলিটেকনিক শিক্ষক শিবু দাস ও তাঁর স্ত্রী টুলটুল দাস, ছমাস আগের অজস্র দুর্বৃত্তের রক্তচোখকে জবাব দিতে ভোর থেকে লাইন দিয়ে ভোট দিলেন বিধাননগরের বাসিন্দারা, কাল তিরিশ তারিখ ওই ভাঙরের মার খাওয়া দশ বছরের শিশুটির পরিবারও হয়ত ভোট দেবে |
অসংখ্য বুথ দখল, ভয় দেখানো, ছাপ্পা চলছে | কিন্তু প্রতিরোধও চলছে | এই নির্বাচনের এটাই প্রধান পাওনা, ফল যাই হোক |
গ্রীষ্ম প্রচন্ড | কিন্তু বৃষ্টির পূর্বাভাষ আছে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন