লাল মোরাম বিছানো রাস্তা। গাড়ি গেলে খরখর করে শব্দ হয়।
অবশ্য গাড়ি আর ক'টা! স্কুল ট্রিপ বা মার্কেটিং ট্রিপের ভ্যান, নয়তো বাবার অফিসের এম ডি মাঝেসাঝে এলে।
রাস্তার দু'ধারে কৃষ্ণচূড়া দেবদারু আর নাগকেশর গাছ। তার তলায় রঙ্গন, সিনোয়ারি, বাবলা, লজ্জাবতীর ঝোপ। ওইখানে বহুরূপীগুলো লুকিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে ঘাড় তুলে দেখে কে এলো। মাঝে মাঝে টকটকে লাল রঙ, ভেলভেটের মতো গা, ছোট্ট মাকড়সা দেখা যায়। তুড়ুক তুড়ুক করে কাঠবিড়ালি লাফায়। ফড়িং ওড়ে। একটু ভিজে জায়গায় শামুক থাকে।
রাস্তা দিয়ে এগোলে কলোনীর গেট। পাশে বুগনভিলিয়া। তার ছায়াতে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে থাকে সিকিউরিটি কাকু। আমি ছিপটি হাতে রাস্তায় দাগ টানতে টানতে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাই। কাকু আমাকে চেনে, হাসে। এখন গরমের ছুটি। সকালেই আমার পড়াশোনা শেষ করে বেড়াতে বেরোই। হাতে থাকে ছিপটিটা। নতুন কোনো ফুল, নতুন কোনো পাতা পেলে কুড়িয়ে আনি। দুপুরে বাবা ভাত খেতে আসলে দেখাই। গোল নুড়ি পেলে মা-কে এনে দিই। মা সাজিয়ে রাখে।
এইরকমই একদিন হাঁটতে হাঁটতে কলোনীর বাইরে দেখি একটা জটলা। কয়েকজন লোক একটা বাচ্চা বাঁদরকে ঘিরে বসে আছে। মায়ের কোল থেকে নাকি পড়ে গেছে, ভয়ে জুলজুল করে তাকাচ্ছে। আমাকে দেখেই আমার কোলে উঠে পড়লো। সবাই বলল, তাহলে ওটা আমার কাছেই থাক। আমিও নিয়ে চলে এলুম বাড়ি। মা খুব খুশী, বাবাও এসে খুশী হল। ছোট প্লাস্টিকের ডিশে একটু দুধ দিতে চুকচুক করে খেল। জল খেল। আর আমার কোলে উঠে বসে রইল। আমি নাম দিলুম জুলজুল। বাবা নাম দিল মাঙ্কিম্যান। মা নাম দিল চিক্কুস। মায়ের দেওয়া নামটাই রয়ে গেল।
এইভাবে চিক্কুস আমাদের বাড়ি এল। আমার একটা সারাদিনের সঙ্গী হল। বিস্কুট দিলে অনেকটা মুখে পুরে গালের একপাশে রেখে দিত। রাত্তিরে আমাদের বাইরের চৌবাচ্চার পাশে একটা বস্তা নিয়ে মাথায় ঘোমটার মতো টেনে ঘুমোতো। তখন ওকে দেখতে লাগতো ঠিক একটা বুড়ো দাদুর মতো। সেই সময় ওকে জাগিয়ে দিলে রেগে দাঁত খিঁচোত খুব! চান করতে চাইত না। আমি ওকে ধরে বাগানে জলের পাইপ দিয়ে চান করাতুম। নখ কেটে দিতুম। আমার কাছে খুব শান্ত হয়ে থাকতো। মা একটা প্যান্ট সেলাই করে দিয়েছিল, ল্যাজের জায়গায় ফুটো। সেটা পরে ঘুরতো।
তারপর আমার স্কুল খুলে গেল। সারাদিন আর দেখতে পেতুম না চিক্কুসকে। বিকেলে আমি ফিরলেই লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরতো। মা বলতে শুরু করতো ওর সারাদিনের গল্প। বদমায়েশীর নালিশ করলে চিক্কুস চুপ করে বসে থাকতো, মাথা নীচু। যেন কতো অনুতাপ। অনুতাপ কথাটা বাবা শিখিয়েছিল আমাকে।
আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো, বদমায়েশিও বাড়তে লাগল। রাস্তায় কুকুরগুলোর সঙ্গে খেলতো, কাঠবিড়ালি দেখলে তাড়া করে জামগাছে, পেয়ারাগাছে উঠে যেত। একদিন দরজা রঙ করবার জন্যে সবুজ রঙের কৌটোটা উল্টে সারা গায়ে মাখলো, ঘরময় করলো। সেদিন ওকে কেরোসিন তেল দিয়ে চান করাতে হলো। টেবিলে পেয়ারা বা কলা রাখলেই এসে খেয়ে নিত। বকলে মাথা নীচু করে থাকতো, আবার যে কে সেই। বাথরুম পেলে টয়লেটে যেত, শিখিয়ে দিয়েছিলুম। মাঝে মাঝে দেখতুম উদাস হয়ে বসে আছে, হয়তো ওর মায়ের জন্যে মন কেমন করতো...
তারপর কলোনীর অন্য কাকুরা নালিশ করতে আরম্ভ করলো। চিক্কুস নাকি ওদের বাড়ি গিয়ে সব নষ্ট করছে! লোকের চাপে ওকে বেঁধে রাখা হোত। করুন স্বরে কাঁদতো, আমার মায়া হোত। খুলে দিতুম। আবার বদমায়েশি করতো, আবার নালিশ আসতো।
এর মধ্যে আমাকে একটা বড় ইস্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিতে হোল। সেখানে নাকি হস্টেলে থাকতে হবে! চিক্কুসকে একদিন বললুম, যে আমাকেও ওর মতো মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে। ও কী বুঝল কে জানে, আমাকে জড়িয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ওকে ভদ্র করবার যতোই চেষ্টা করতুম, ও আরও বাঁদর তৈরি হছিল। সেই সময়েই ঘটলো দুর্ঘটনাটা। বাবার অফিসের ডিরেক্টরের ছোট্ট নাতি এসেছিল বেড়াতে। আমাদের কোয়ার্টার্সের সামনে দিয়ে হাঁটছিল। নতুন ছেলে দেখে চিক্কুস তেড়ে গেছিল, ভয় পেয়ে ছেলেটা দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে গেল। হাঁটু ছড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়ে সে বানিয়ে বললো চিক্কুস নাকি ওকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে! বাবাকে ডেকে ডিরেক্টর বললেন, বাঁদরটাকে এখনই বিদায় করতে। বাকিরাও সায় দিল। যারা চিক্কুসের খেলা দেখে মজা পেত এতদিন, তারাও একে একে নালিশ করতে লাগলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলুম।
সেই ডিরেক্টরই এক রবিবার ফোন করে ব্লু ক্রসের গাড়ি ডেকে পাঠালো। সেদিন আমরা সকাল থেকে কেউ কিচ্ছু খাইনি। চিক্কুসও খায়নি। ভ্যান থেকে দুজন কাকু নামতেই চিক্কুস পালিয়ে গাছের ওপর উঠে পড়লো। কিছুতেই নামছিল না। শেষে আমি গিয়ে ডাকলুম, তখন নেমে এল। আমার কোলে উঠে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। একজন কাকু ওকে কী একটা ইঞ্জেকশন দিল, ঘুমের ওষুধ নাকি। চিক্কুস একটু কেঁপে উঠে আমাকে আরো জড়িয়ে ধরলো। আমি দাকলুম, "চিক্কুস! চিকাই!" জুলজুল করে তাকালো, সেই একদম প্রথম দিনের মতো। কী যেন একটা বলতে চাইল। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল আমার কোলে। আমি ওর পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলুম।
ব্লু ক্রসের কাকুটা বাবাকে বলল, আমরা ওকে যখন খুশী গিয়ে দেখে আসতে পারব। কিন্তু তাতেও বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। মা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই বসেছিল। কাকুটা আমার কোল থেলে যত্ন করে চিক্কুসকে নিলেন, একটা নরম তোয়ালে জড়িয়ে ভ্যানে তুললেন। দরজা বন্ধ হল, তারপর চিক্কুসের জামগাছের তলা দিয়ে, পেয়ারা গাছের পাশ দিয়ে, সেই লাল রাস্তা দিয়ে খরখর শব্দ করে ভ্যানটা...
...আর লিখতে পারছি না...
রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬
চিক্কুস ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন